রজব ১৪৪৫   ||   জানুয়ারি ২০২৪

দুনিয়ার মানুষ হয়েও তিনি ছিলেন দুনিয়াত্যাগী

এস. এম. লুৎফুল কবীর

হযরত প্রফেসর মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান রাহ. ছিলেন আমার সরাসরি ক্লাস-রুম শিক্ষক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েটে) আমি ফাইনাল ইয়ারে স্যারের কাছে দুটো বিষয় পড়েছি। পাশ করার পর একই বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার সুবাদে তাঁর সহকর্মী হওয়ারও সৌভাগ্য হয়েছিল।  পরবর্তীতে স্যার যখন দ্বীনের লাইনে এক দীপ্তময় সূর্যে পরিণত হয়ে প্রফেসর হযরত হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন তখনো তাঁর সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ আল্লাহ আমাকে দান করেছিলেন। তাই তাঁকে বিভিন্ন আঙ্গিকে দেখার এবং তা থেকে শিক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্র আল্লাহ আমার সামনে তৈরি করে দিয়েছিলেন।  তবে তাঁর থেকে নেওয়ার যে পরিমাণ সুযোগ আল্লাহ আমাকে দিয়েছিলেন, আমার অযোগ্যতার কারণে সামান্যটুকুও কাজে লাগাতে পারিনি।  আজ তাঁর ইন্তেকালের পর সেই চেতনা তীব্র হয়ে আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করে তুলেছে।  আমার অযোগ্যতা থাকলেও যাদের তাঁর কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়নি, তারা যদি আমার অভিজ্ঞতাগুলো জানতে পারে, তারা উপকৃত হবেএই বিশ্বাস থেকেই তাঁকে নিয়ে কিছু অনুভূতি প্রকাশ করব মাত্র।

একজন সফল শিক্ষক ও প্রকৌশলী

আমাদের মতো ইংরেজি শিক্ষিতদের একটা ধারণা আছে, যারা দ্বীনের লাইনে অগ্রসর তারা দুনিয়ার কাজ-কর্মে অদক্ষ, আনস্মার্ট ও অকার্যকর হয়ে থাকে।  ধারণাটি যে ভুল, তা প্রফেসর হযরতের কাছে যারা পড়েছে তারা এক বাক্যে স্বীকার করবে।  এই প্রসঙ্গে আমাদের এক বড় ভাইয়ের উপলব্ধি আপনাদের শোনাই।  তিনি যখন ছাত্র হিসেবে স্যারের প্রথম ক্লাসে যান, স্যারকে দেখে তার মধ্যে একধরনের উন্নাসিকতা কাজ করে। মনে মনে ভাবতে থাকেন, পাঞ্জাবি-পাজামা পরা, টাখনুর অনেক উপরে কাপড়, পায়ে প্লাস্টিকের জুতো, দাড়ি সমেত এক মৌলভি কেন ঢুকেছেন ক্লাসে? তিনিই কি আমাদের পড়াবেন?

সেই ভাই বলেন, ‘স্যার যখন পড়ানো শুরু করলেন, এক আশ্চর্য ভালো লাগা কাজ করতে শুরু করল। এরপর যখন অনর্গল ইংরেজিতে লেকচার দেওয়া আরম্ভ করলেন। থ হয়ে, কান খাড়া করে শুনছিলাম। মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিলতে থাকলাম। কীভাবে যে ৫০ মিনিটের ক্লাস শেষ হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। কোর্স যেদিন শেষ হল, সেদিন অন্তরের অন্তস্তল থেকে স্বীকৃতি বেরিয়ে এল, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের আমি যে কজন ভালো শিক্ষক পেয়েছি, তাদের মধ্যে সর্বোত্তম শিক্ষক হলেন, হামীদুর রহমান স্যার।

আমাদের হযরত কি কেবলমাত্র সেই বড় ভাইয়ের সর্বোত্তম শিক্ষক ছিলেন? না, হযরতের কাছে কোনো বিষয়ে একদিনের জন্যও যে পড়েছে সে-ই সাক্ষ্য দেবে, তিনিই তার জীবনের সর্বোত্তম শিক্ষক।

প্রফেসর হযরত পিএইচডি করেননি, এই সোনার হরিণ যাদের নসীব হয়েছে তাদের ধারণা, যিনি পিএইচডি করেননি, তিনি গবেষণায় পারদর্শী নন। অথচ আমি যখন থেকে তাঁর সহকর্মী হয়েছিলাম, বিভিন্ন পরামর্শ-সেবার কাজে আমি তাঁর সহযোগী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আমার অভিজ্ঞতা সেই ধারণার বিপরীত হয়েছিল। আপনাদেরকে একটি ঘটনা বলি।

একদিন মিরপুরে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা ট্রেনিং ইন্সটিটিউট ক্যাম্পাসের একটি সমস্যা দেখার জন্য স্যার ও আমি গিয়েছিলাম। সমস্যাটি ছিল এরকম, বিগত এক মাস যাবৎ একটা ঘটনা বার বার ঘটছে।  তা হল, তাদের সাব-স্টেশনে শর্ট-সার্কিট হয়ে মূল লাইন থেকে হঠাৎ পুরো ক্যাম্পাস বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আবার কয়েকদিন পর সেই সমস্যা থাকে না। এক ভূতুড়ে কাণ্ড।  আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলাম।  আমরাও প্রাথমিকভাবে সেই সাব-স্টেশনের সব যন্ত্রপাতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কোনো সমস্যা পেলাম না। তাদের মতো আমরাও হতবুদ্ধি হয়ে পড়লাম। স্যার আমাকে সমস্যাটির বিস্তারিত হিস্টোরি জানতে বললেন। আমি সব জেনে স্যারের কাছে পেশ করলে তিনি মন্তব্য করলেন, ঘটনাটি বৃষ্টির সাথে সম্পৃক্ত। কারণ, সময়টা ছিল বর্ষাকাল। কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হলে এরকম হয়। বৃষ্টি বন্ধ হলে সমস্যাও দূর হয়ে যায়।  এরপর আবার যখন সাব-স্টেশনটিতে এরকম ঘটনা ঘটল, সাব-স্টেশনের কিছু সংবেদনশীল যন্ত্র খুলে বুয়েটের ল্যাবে নিয়ে গেলাম। আমার একধরনের উত্তেজনা কাজ করছিল, ভূতের সন্ধান পেতেই হবে। সেগুলো ল্যাবে আমাদের সিস্টেমের সাথে লাগিয়ে একই ধরনের ফলাফল পেলাম। সেগুলো কাজ করছিল না। ল্যাবের পরিবেশকে কৃত্রিমভাবে আর্দ্রতা মুক্ত করা হল, তখন আর সমস্যা নাই।  পুনরায় আর্দ্রতার পরিবেশ তৈরি করে দেখা গেল সমস্যা এসে হাজির।  অনেকবার এরকম অবস্থা প্রয়োগ করে এবং বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করে প্রমাণ হল, অতি বৃষ্টিই সেই সাব-স্টেশনকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলে, যা সেখানকার কিছু সংবেদনশীল যন্ত্রকে প্রভাবিত করে।  এবার শুরু হল সমাধান বের করার কাজ।  আমরা কয়েকভাবে সমাধানের পদ্ধতি প্রয়োগ করে বের করলাম কার্যকরি পদ্ধতি কোন্টি। সেটি যখন সেই সাব-স্টেশনে প্রয়োগ করা হল, আলহামদু লিল্লাহ, এর পর থেকে সেই সমস্যার পুনরাবৃত্তি ঘটেনি। সম্পূর্ণ কাজটি ছিল গবেষণাপ্রসূত। আমাদের হযরতের পিএইচডি ছিল না; কিন্তু তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবি একজন শিক্ষক। তাঁর মেধা, প্রজ্ঞা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছিল।

আহলে হক আলেমদের সাহচর্য

তিনি দুনিয়ার কাজকর্মে অনেক পারদর্শী হওয়া সত্ত্বেও সময়ের পরিক্রমায় এক মহান বুযুর্গে পরিণত হয়েছিলেন।  এর পেছনে মূল কারণ ছিল, আল্লাহওয়ালাদের সোহবত। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি যখনই সময় পেতেন ছুটে যেতেন আল্লাহওয়ালাদের সাহচর্যে, কখনো তাদের কোনো মজলিসে, কখনো কোনো পরামর্শ গ্রহণ করতে। প্রায় প্রতিদিনই হাফেজ্জী হুযুরের পেছনে ফজর নামায পড়তেন। যখনই জানতে পারতেন, দেশের ভেতর বা বাইরে থেকে কোনো বড় আলেম নিকটস্থ কোথাও এসেছেন, তিনি তাদের খেদমতে হাজির হয়ে যেতেন। তাদের সফরের পুরোটা সময় তাদের সান্নিধ্যে কাটাতেন। নিজেকে মিটিয়ে তাদের কাছে বসে থাকতেন।  বড়দের সম্মান করে তাদের সাহচর্য অবলম্বন করে, তাঁদের সকল গুণাবলি সিনা থেকে সিনায় তিনি নিয়েছিলেন। যা তাকে নিয়ে গিয়েছিল এক উচ্চতায়। প্রফেসর থেকে হয়েছিলেন প্রফেসর হযরত।

প্রফেসর হযরত হাফেজ্জী হুযুরের খাদেম হিসেবে জোঁকের মতো হুযুরের সাথে লেগে থাকতেন।  একবার হাফেজ্জী হুজুর রাহ-এর সাথে ইংল্যান্ড সফরে যাবেন, বুয়েটের তৎকালীন উপচার্য তাঁকে ছুটি দিলেন না, তিনি হাফেজ্জী হুযুরের সোহবতে থাকাটাকে এত গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিলেন যে, বুয়েট থেকে ইস্তফা দিয়ে চলে গেলেন। যদিও পরে সেই পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়নি, তিনি বুয়েটেই থেকে গেছেন।

একজন ইংরেজি শিক্ষায় উচ্চতর পর্যায়ে পৌঁছানোর পরও আল্লাহওয়ালাদের সোহবতে থেকে নিজের ইসলাহ করে নিজেই আল্লাহওয়ালায় পরিণত হতে পারেনপ্রফেসর হযরত তার এক বাস্তব নমুনা।  আমরা সবাই জানি, একপর্যায়ে হাফেজ্জী হুজুর রাহ. এবং পরবর্তীতে আবরারুল হক সাহেব রাহ. তাঁকে খেলাফত দিয়েছিলেন। একইসাথে তিনি দুই মহান ব্যক্তির খেলাফত পেয়েছিলেন।

আলেমদের মাথার তাজজ্ঞান করা

আলেমদের সম্মান ও শ্রদ্ধা করার প্রকৃত পন্থা কীপ্রফেসর হযরত বাস্তবে তা নিজে করে, আমাদের দেখিয়ে গেছেন। সাধারণ আলেম, এমনকি তালেবে ইলমদেরকেও তিনি অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখতেন। তার ব্যবহার দিয়ে আমাদের মতো ইংরেজি শিক্ষিতদের যেন বলতেন, আখেরাতে তো বটেই, যদি দুনিয়ার জীবনেও সৌভাগ্যবান হতে চাও, আলেমদের সম্মান করো, আত্মগর্ব ভুলে, অহংকার মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে আলেমদেরকে মাথার উপরে রাখ।  ইংরেজি শিক্ষিত ভাইদের এক স্ট্যান্ডার্ড কথা তিনি নকল করতেন— ‘আলেমরা ব্যাকডেটেড, কূপমণ্ডূকতায় নিমজ্জিত, এই আলেমরাই সমাজকে পেছনে নিয়ে যায়। অনেকে তো মুখ ফুটে বলেই বসে, আলেমরাই খাইল।

হযরত বলতেন ঠিক উল্টো, এই আলেমদের কারণে সমাজ টিকে আছে, তাঁরা আছেন বলেই চৌদ্দ শ বছর পরও আমরা সঠিক স্থানে দ্বীন পাচ্ছি। আজ আলেমদেরকে সমাজ যে চোখে দেখে তা সম্পূর্ণ ভুল, তাদের সাহচর্যে যাও, নিজে বাঁচো, পরিবারকে বাঁচাও।

তাঁর মাদরাসার শিক্ষকদের তিনি এত বেশি মূল্যায়ন করতেন, যা ছিল ব্যতিক্রমধর্মী।  মাদরাসার পূর্ণকালীন শিক্ষকগণকে কোয়াটার দিয়েছেন। তাদের ও পরিবারের জন্য খাবার পাঠাতেন, চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করতেন, এ ছাড়াও বিভিন্নভাবে তাদের দেখভাল করতেন।

হযরতের উদ্দেশ্য ছিল, মাদরাসার শিক্ষককে আয়-রোজগারের পেরেশানি থেকে মুক্ত রাখা গেলে তিনি যে ওহীর জ্ঞান লাভ করেছেন তা পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারবেন।  আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর যুগান্তকারী এসব পদক্ষেপ অনুসরণ করার তাওফীক দিনআমীন।

বিজ্ঞানকে আল্লাহর নিআমত চেনার উপায় বানানো

হযরত একদিকে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন, অন্যদিকে বিজ্ঞান বিষয়ে অনেক পড়াশোনা করতেন।  পড়াশোনার উদ্দেশ্য ছিল, আল্লাহ আমাদের যেসব নিআমতের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছেন, তা আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করা।  হযরতের বিভিন্ন বয়ানে মানব-সৃষ্টির স্তরগুলোআমাদের এক এক অঙ্গ কত দামি বোঝাতে গিয়ে চোখ, কান, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, মস্তিষ্কএসবের বিস্ময়কর কার্যকারণ, মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের পর্যায়, বাতাসে অক্সিজেন ও নাইট্রোজেনের অনুপাত সারা বিশ্বের সকল স্থানে এক হওয়া, বাতাসে সামান্য কার্বন-ডাই-অক্সাইড যে পৃথিবীর সকল খাদ্যশস্যের মূল উপাদান, মহাবিশ্বের তারকারাজির বিস্তৃতি, মানব জাতির ওপর সূর্যের বিস্ময়কর অবদান, আহ্নিক ও বার্ষিক গতির ফলে দিন-রাত, মাস-বছরের পরিক্রমা চক্রাকারে ঘুরতে থাকা ইত্যাদি বিষয়ে সবিস্তারে উল্লেখ করতেন।  কুরআনের আয়াতের মর্মের আলোকে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতেন। 

আবার বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার ওপর আমরা যেন নির্ভরশীল হয়ে না পড়ি, বিজ্ঞানের কোনো তত্ত্ব কুরআনের বাণীর সাথে সাংঘর্ষিক হলে আমরা যেন হতাশাগ্রস্ত না হই, তাই হযরত বলতেন, বিজ্ঞানের তত্ত্ব পরিবর্তনশীল; কিন্তু কুরআনের কথা শিরোধার্য, অপরিবর্তনশীল।

এ প্রসঙ্গে আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর একটি উদ্ধৃতির প্রতি শ্রোতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন, থানভী রাহ. বলতেন, ‘কুরআন বিজ্ঞানের বই নয়, কুরআন তো আত্মিক চিকিৎসক, আত্মার রোগ দূরকারী, তাই কুরআনে বিজ্ঞানের সববিষয়ের আলোচনা থাকা জরুরি নয়।

হযরত বুয়েট থেকে অবসর নেওয়ার পর ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অফ টেকনোলজি (আইইউটি)-তে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে অধ্যাপনাকালে তিনি কুরআন, বিজ্ঞান ও টেকনোলজিএই বিষয়ে একটি কোর্স পড়াতেন। কোর্সটিতে কুরআনে ইশারা রয়েছে আল্লাহর এমন সব সৃষ্টির বিভিন্ন নিআমত প্রাসঙ্গিকভাবে আলোচনায় আনতেন। অত্যন্ত তথ্য সমৃদ্ধ উপস্থাপনা শ্রোতাকে সেই নিআমতসমূহের প্রতি আকৃষ্ট না করে পারত না। তাদের মুখ দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে বেড়িয়ে পড়তআল্লাহু আকবার, সুবহানাল্লাহ, আলহামদু লিল্লাহ।

ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতদের জন্য দ্বীনের পথে অগ্রসরের প্রেরণা

নিজে ইংরেজি শিক্ষিত হওয়ায় সমাজের বিভিন্ন স্তরের ইংরেজি শিক্ষিতরা কোনোভাবে হযরতের পরিচয় পেলে তাঁর কাছে আসতেন। একবার যিনি হযরতকে দেখেছেন, কথা বলেছেন তিনি হযরতের প্রতি আকৃষ্ট হতেন। হযরত ছিলেন পাওয়ারফুল এক ম্যাগনেট।  একবার আকর্ষিত হলে কাউকে দেখিনি সেই আকর্ষণ বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছে। উত্তরোত্তর সেই আকর্ষণ বেড়েছে। একপর্যায়ে হযরতের কাছে এসে সন্তানকে পেশ করে বলেন, হুজুর আপনার তত্ত্বাবধানে আমার সন্তানকে দিতে চাই। এভাবে কত পরিবার যে পরিবর্তন হয়েছে  হিসাব করে বলা যাবে না!

হযরত কাউকে আপন করে তাকে একটা না একটা সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ করতেন। কেউ হয়ে যেত চাচা, কেউ দুলাভাই, আবার কেউ মামা, কেউ ভাই, কাউকে হাস্যরস করে বলতেন, অমুক জায়গার পীর সাহেবএভাবে কোনো না কোনো সম্বন্ধ করে ডাকতেন।  এত আপন করে নিতেন, নতুন কেউ তাদের মধ্যকার কথোপকথন শুনলে বুঝতেই পারত না যে, তাদের মধ্যে সত্যিকারের আত্মীয়তা নেই। এক অপূর্ব বন্ধনে জড়িয়ে এক একজন পথভোলাকে পথের সন্ধান দিতেন। এক অপার্থিব ভালবাসা দিয়ে এই মানুষগুলোকে ধংসের পথ থেকে টেনে এনে পথের দিশা দিতেন।  আপনি উত্তরায় হযরতের বাসস্থানে এলে দেখবেন সেই ৩ নং সেক্টর এবং আরো তিন/চারটি সেক্টরে তাঁর মুহিব্বীনদের এক বিশাল জামাত বসবাস করে। তাদের কেউ হয়তো মালিবাগে নিজের বাড়িতে থাকতেন, কেউ মিরপুরে, কেউ ধানমন্ডিতে থাকতেন, সব ছেড়ে দিয়ে উত্তরায় হুযুরের কাছে চলে এসেছেন। হযরতের মাদরাসার কাছে বাসা ভাড়া নিয়ে সপরিবারে থাকছেন, ছেলে-মেয়েদের হুযুরের মাদরাসায় পড়াচ্ছেন। কীসের আশায়? নিজে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে, পরিবারকে বাঁচাতে।

ভালো মানুষ কে?

আইইউটির এক টেকনিশিয়ান মাসুদের সাথে হযরতের এক কথোপকথন শুনলে বোঝা যায়, হযরত ভালো মানুষকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করতেন। মাসুদ বলে

আমি একদিন স্যারের সাথে একটা এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে কাজ করছিলাম। স্যার যেভাবে কানেকশন দেওয়ার জন্য বলেছিলেন সেভাবে কানেকশন দিচ্ছিলাম। কিছু ভুল করে ফেলছিলাম, স্যার এক-দুবার কিছু বললেন না। ভুল ধরিয়ে দিলেন। আমি ঠিক করে দিলাম। তৃতীয়বার যখন একই ধরনের ভুল করলাম, স্যার একটু রাগ হয়ে বললেন, মাসুদ মন দিয়ে কাজ করো, বার বার ভুল করছ কেন?

এটা বলেই কী কাজে যেন স্যার ল্যাব থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি কানেকশন ঠিকঠাক করে টেবিলের পাশে একটা টুলের ওপর বসে ছিলাম। কিছুক্ষণ পর স্যার আবার ল্যাবে এসে আমাকে এভাবে গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বললেন, কী মাসুদ! বকা দিয়েছি বলে মন খারাপ হয়েছে? আরে বড়রা তো একটু বকা দিতেই পারে, এজন্য মন খারাপ করতে হয় নাকি?

আমি স্যারকে বললাম, না স্যার আপনার বকার জন্য মন খারাপ হয়নি। 

তাহলে কেন মন খারাপ হল?

বললাম, স্যার ভাবছি, ভালো হতে পারলাম না।

স্যার বললেন, ভালো বলতে তুমি কী বোঝ?

বললাম, স্যার সেটাও তো বুঝি না, আপনিই বলে দেন। 

স্যার তখন বললেন, নির্লোভ মানুষই ভালো মানুষ।

পাঠক, আপনারা যারা হুজুরকে চেনেন, তারা জানেন, হুজুর নিজের সংজ্ঞা অনুযায়ী নিজেই ছিলেন একজন ভালো মানুষ।

কুরআনের মহব্বত

আমাদের হযরত ছিলেন কুরআনের এক আশেক। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে যতক্ষণ জেগে থাকতেন পুরো সময়টা কুরআন নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখতেন।  হয় নিজে তিলাওয়াত করছেন, না হয় কারো তিলাওয়াত শুনছেন অথবা তিলাওয়াতের পাশাপাশি তাফসীর দেখছেন, কিংবা কুরআন দিয়ে নসীহত করছেন।

হুযুরের গোশত-অস্থি-মজ্জায়-রক্তে-শিরা উপশিরায় কুরআন মিশে গিয়েছিল।  গাড়িতে চলার সময় দুই-তিনজন হাফেজ সাহেব থাকলে তাদেরকে বলতেন, অমুক অমুক জায়গা থেকে শোনাও।  যখন দূরে কোনো সফরে যেতেন, যেখানেই থাকতেন, যত দূরেই হোক, মোবাইলের ব্যালেন্স লোড করছেন আর নাতি, নাতনি বা কোনো ছাত্রের কুরআন শুনছেন। ব্যালেন্স শেষ হয়ে যাচ্ছে, আবার ভরছেন, কোনো পরোয়া নেই। কুরআন শুনছেন তো শুনছেন!

তিনটি কাজকে জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ বানানো

হুজুর তাঁর কাজের মাধ্যমে বুঝিয়ে গেছেন, আমরা যেন তিনটি কাজ আঁকড়ে ধরি।

১. মক্তব প্রতিষ্ঠা করা।

২. ঘরে ঘরে দ্বীনী মাহফিল করা।

৩. বয়স্কদের জন্য কুরআন সহীহ করার ব্যবস্থা করা।

মক্তব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে হুজুর অনেক বেশি তাকিদ দিতেন। বলতেন, সবাই যেন তাঁর মহল্লায় মক্তব প্রতিষ্ঠা করে। শুরু করার জন্য জায়গা কেনার দরকার নেই, বিল্ডিং তোলার প্রয়োজন নেই। আপনার ড্রইংরুমকে মক্তব বানান, একজন খুব ভালো দেখে উস্তায রাখেন, তার থাকার ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন, মক্তব চালু করে দিন। উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতার পেছনে পড়বেন না। আগে শুরু করেন, উদ্বোধন হবে পরে। কাজ করা উদ্দেশ্য।

হুজুর আরো বলতেন, মক্তব করা সহজ, কিন্তু এর পরের সময়টা আপনাকে সতর্ক থাকতে হবে। আজ উস্তাযে উস্তাযে, কাল উস্তাযে ছাত্রে, পরশু গ্রামের/এলাকার গণ্যমান্য সদস্যের সাথে সমস্যা লেগে থাকবে। মনে হবে, কী যন্ত্রণা ঘাড়ে নিলাম! ঘাবড়াবেন না, মুরব্বির পরামর্শ নিয়ে এগুতে থাকেন।

আমাদের হযরত এরকম সমস্যা এসে হাজির হলে হাফেজ্জী হুযুরের একটা বিখ্যাত উক্তি নকল করতেন, ‘শয়তান কি চায়, তার দুশমন তৈয়ার হোক?’

আপনি যখন উপলদ্ধি করতে পারবেন, শয়তানের বিরুদ্ধে আপনি লড়ছেন, আপনি নিশ্চয় তখন সেসকল সমস্যা  ফেলে রেখে শয়তানকে জয়ী হতে দেবেন না।

ঘরে ঘরে দ্বীনী মাহফিলের ব্যাপারে হযরত বলতেন, পুরুষরা এখানে সেখানে গিয়ে দ্বীনের কথা শুনতে পারে। মহিলাদের সে সুযোগ হয় খুব কম। বাসায় বাসায় কোনো খাবার-দাবার আয়োজন ছাড়া মাহফিল করো। তোষামোদ করে একজন আলেমকে ডেকে নাও। দ্বীনের মৌলিক কিছু কথা হয়ে যাক।  কোনো আলেম না পাওয়া গেলে, নিজেরাই একসাথে বসে কিতাব পড়ে দুআ করে দাও। ৪০-৪৫ মিনিটের এরকম মাহফিল সপ্তাহে একদিন করাটা কষ্টকর না। না পারলে দুই সপ্তাহে একদিন করো, আর তাও না পারলে মাসে একদিন মাহফিল করো। ঘরে ঘরে এরকম মাহফিলের আয়োজন করো। নিয়মিত করো, অনেক ফায়দা হবে ইনশাআল্লাহ।

বয়স্কদের কুরআন সহীহ করার ব্যাপারে হযরত খুব জোর দিতেন। বলতেন, ৬০/৬৫ বছরের কোনো ব্যক্তি বালেগ হওয়ার পর থেকে নামায পড়ছে, তার কুরআন তিলাওয়াত যদি সহীহ না থাকে, তার নামাযের কী দশা হচ্ছে? তাই হযরতের তত্ত্বাবধানে যত মাদরাসা পরিচালিত হয়, সকল মাদরাসায় বয়স্কদের কুরআন শেখার ব্যবস্থা রাখা হয়। শুধু শেখানোই হয় তা নয়, এদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণেরও ব্যবস্থা রাখতে বলতেন, এতে অন্যান্য বয়স্ক যারা মাদরাসায় শিখতে আসে না, তারাও আগ্রহী হবে।

সকল কাজে নিষ্ঠা ও একাগ্রতা

হযরতের একটা বড় গুণ ছিল, দ্বীনী কাজগুলো নিষ্ঠার সাথে সার্বক্ষণিকভাবে ইস্তেকামাতের সাথে (নিয়মিত) চালু রাখতেন। দ্বীনী কাজে আল্লাহকে খুশি করাই যেহেতু উদ্দেশ্য, তাই কতজন সে কাজে অংশগ্রহণ করল, কতজন সেই কাজের সমালোচনা করল, সেটা তাঁর কাছে মুখ্য বিষয় ছিল না। বুয়েটে সপ্তাহে একদিন কুরআনের ভাষা শিক্ষার ওপর একটা ক্লাস নিতেন। আজ ৩৫ বছর প্রতি সপ্তাহে ক্লাসটি হয়ে আসছে। যতদিন সুস্থ ছিলেন তিনি পড়াতেন। এখন তাঁর প্রিয় এক মাওলানা সাহেব সেখানে পড়ান। ছাত্র হিসেবে থাকে বুয়েটের কিছু প্রফেসর এবং আশেপাশের কিছু লোক। কুরআনে কতজন পারদর্শী হল, তা দেখার বিষয় ছিল না। তিনি পড়িয়ে যেতেন, ফাঁকে ফাঁকে তিলাওয়াত হত। কোনো আয়াত পড়াতে পড়াতে তার অর্থ বলতেন, তাফসীর করতেন। মূল পড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে এইসব চর্চাও চলতে থাকত।

মুন্সিগঞ্জে হুযুরের বাড়ি। সেখানে তাঁর বাড়িতে একটা মক্তব চলে, সেখানে প্রতি মঙ্গলবার যেতেন, বাচ্চাদের পড়াতেনআসরের পর থেকে  মাগরিবের আগ পর্যন্ত।  প্রতি মঙ্গলবার ফজর পড়ে কয়েকজন সফরসঙ্গী নিয়ে রওয়ানা হতেন। ওখানে বিশ্রাম করতেন, বিকালে পড়াতেন। ফিরতে ফিরতে রাত দশটা-এগারোটা বেজে যেত। নিয়মিত যেতেন। মক্তবে পড়ানোকে এত গুরুত্ব দিতেন যে, মঙ্গলবার দিন বাইরের কোনো সফর রাখতেন না। চৌদ্দ ঘণ্টা ব্যয় করতেন শুধু ওই এক ঘণ্টা বাচ্চাদের সাথে কাটানোর জন্য। তেমনি আরেকটি নিয়মিত প্রোগ্রাম থাকত বুধবারে। সেদিন হত নাতনিদের পড়ানোর প্রোগ্রাম। এছাড়া প্রতি আরবী মাসের তৃতীয় বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম যেতেন। মাসের অন্য তিন বৃহস্পতিবারের এক দিন যেতেন বড় ছেলের বাসার মাহফিলে। আরেকদিন মেঝ ছেলের ঝিগাতলা মাদরাসায়। বাকি এক বৃহস্পতিবার যোগ দিতেন হুজুরের চতুর্থ ছেলের ধানমন্ডি মাদরাসার মাহফিলে। উত্তরা মাদরাসায় প্রতি সোমবার যে মাহফিল হয়ে থাকে, হুজুর সবগুলোতে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করতেন।

আরেকটি মজলিসে হুজুর নিয়মিত গুরুত্ব দিয়ে যোগ দিতেন। সেটা হল প্রতি বৃহস্পতিবার বাদ ফজর নিমতলীর বিবাহ সমিতির মিটিংয়ে। তিনি যেসব দ্বীনী কাজ করতেন, নিয়মিত তা করে যেতেন। 

সদা সর্বদা একজন শোকরগোযার বান্দা

হযরতের সাথে দেখা হলে যদি জিজ্ঞেস করা হত, হুজুর কেমন আছেন?

হুযুরের উত্তর ছিল, ‘আলহামদু লিল্লাহ, খুব ভালো

দেখা যেত, হুজুর হাসপাতালের বিছানায়। অক্সিজেনের নল লাগানো নাকে। হাতে সাল্যাইনের নল লাগানো। সে অবস্থায়ও যদি সেই প্রশ্ন করা হত যে, হুজুর কেমন আছেন?

একটাই উত্তর, ‘আলহামদু লিল্লাহ, খুব ভালো আছি।

হুজুর শোকরগোযারির এক চলন্ত নমুনা ছিলেন। উঠতে বসতে তাঁর মুখ থেকে শোনা যেত আলহামদু লিল্লাহ। কোনো অভিযোগ নেই।

এমন শোনা যেত না, কদিন ধরে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে বা পিঠের পেছনে বাম দিকটার ব্যথাটা একটু বেড়েছে।

আমাদেরকে আবরারুল হক ছাহেব রাহ.-এর কথা শোনাতেনযখন কোনো সমস্যা এসে পড়ে, এটা ভাবোএর চেয়ে খারাপ হতে পারত কি না? এর চেয়ে খারাপ যে হয়নি তাই বল, ‘আলহামদু লিল্লাহ

আমাদের হযরত সেই অনুভূতি থেকেই সর্বাবস্থায় বলতেন, ‘আলহামদু লিল্লাহ, খুব ভালো আছি।

হুজুর যেদিন ইন্তেকাল করেন, সেদিন তাঁর অক্সিজেন লেভেল খুব বেশি উঠানামা করছিল। শ্বাস-প্রশ্বাস নিচ্ছিলেন খুব কষ্ট করে, সেই সময় তাঁর পাশে থাকা তাঁর এক প্রিয় মানুষ হুজুরকে একই প্রশ্ন করেছিলেন, হুজুর কেমন আছেন?

সেদিন সচরাচর যেভাবে কথাদুটো বলে থাকেন, সেভাবে না বলে বলেছিলেন, ’খুব ভালো আছি, আলহামদু লিল্লাহ।

আলহামদু লিল্লাহশব্দটা বলেছেন শেষে। মাওলার দিদার লাভ করতে রওয়ানা হবেন, তাই একপ্রকার খুশিতে হযরতের মুখ-নিঃসৃত শেষ কথা ছিল— ‘আলহামদু লিল্লাহ

নিজের ওপরে অন্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া

হুজুর সকল কাজে নিজেকে পেছনে ফেলে অন্যকে অগ্রাধিকার দিতেন।  মাইক্রোবাসে উঠবেন, তিনি আগেভাগে পেছনের সিটটায় গিয়ে বসতেন। বাকিদের সামনের সিটে বসতে বলতেন। কারো কোনো আপত্তিতে কর্ণপাত করতেন না। 

সবাই জানেন মিনার ময়দানে সিট পাওয়া কত কষ্টকর। এক কাফেলায় সব সময় কিছু সিট কম পড়ে। হযরত সবার জন্য সিটের ব্যবস্থা করে তারপর নিজের সিট নিতেন। সবার শেষে সিট নিতেন বলে প্রায়ই তাবুর মধ্যে তাঁর জায়গা হত না; দেখা যেত টয়লেটের পাশে বেডিং বিছিয়ে শুয়ে আছেন। কম বয়স্ক হাজ্বী সাহেবরা অনুনয়-বিনয় করে বলত, আমরা বাইরে থাকি, আপনি ভেতরে যান।

উত্তরে বলতেন, এখানে কত আরাম, আমাকে কি আরামে থাকতে দিতে চাও না

একবার তাবু থেকে কংকর মারার জায়গায় যাচ্ছি, বিশাল কাফেলা।  পদব্রজে পাঁচ কিলোমিটার রাস্তা।  হুজুরের কষ্ট হবে মনে করে তাঁর মুহিব্বীন থেকে একজন হুইল চেয়ার সাথে নিয়েছে, হুযুরের কষ্ট হলেই যেন সেটা ব্যবহার করতে পারেন। যাত্রা শুরু হল, সবার সাথে হুজুরও পায়ে হেঁটে চলছেন। এক-দেড় কিলো যাওয়ার পর থেকে মাঝে মাঝে আমাদের নূরুল ইসলাম ভাই হুজুরকে অনুরোধ করছেন, স্যার, হুইল চেয়ারে বসেন, আমরা ঠেলে নিয়ে যাই।

হুজুর প্রতিবার বলছেন, সবার সাথে আমি হেঁটেই যাব।

কোনোভাবেই হুজুরকে বসাতে পারলেন না। কিছু সময় পর নূরুল ইসলাম ভাই আবার অনুরোধ করায়, এবার হুজুর অদ্ভুত এক কাণ্ড করলেন। বললেন, আমার কষ্ট হচ্ছে কি হচ্ছে না, তুমি বুঝলা কেমন করে? আসলে তোমার কষ্ট হচ্ছে, তুমি বসো চেয়ারে আমরা ঠেলে নিয়ে যাব।

নূরুল ইসলাম ভাই কি আরে বসে? এরপর বড় হুজুর জোর করে উনাকে চেয়ারে বসালেন, পেছনে আরো কয়েকজনের সাথে নিজেও হুইল চেয়ার ঠেলতে শুরু করলেন। এক মজার দৃশ্যের অবতারণা হল।

মিনা থেকে যেদিন মক্কায় ফিরছি, ফিরতে ফিরতে রাত বারোটা বেজে গেল। বাস থেকে নামতেই হযরত দেখলেন, এক বুড়ি রাস্তার ফুটপাতে বসে কাঁদছেন। হুজুর জিজ্ঞেস করলেন, কাঁদছেন কেন?

ইশারা ইঙ্গিতে বোঝা গেল, হারিয়ে গেছেন, বাসা খুঁজে পাচ্ছেন না। ইন্ডিয়ান বুড়ি। সাথে মোবাইলও নেই। হুজুর আমাদের বললেন, তোমরা ক্লান্ত, তোমরা সবাইকে নিয়ে হোটেলে যাও, আমি তাঁকে ইন্ডিয়ান হজ্ব মিশনে পৌঁছে দিয়ে আসি।

আমরা বললাম, হুজুর আপনিও তো ক্লান্ত, আপনি হোটেলে যান, আমরা উনাকে দিয়ে আসি।

না, তিনি আমাদের প্রস্তাবে রাজি হলেন না। গেলেনই গেলেন, হুজুর দেখলাম রাত ২টার দিকে ফিরেছেন হোটেলে।

এরকম অনেক ঘটনা আছে, সাথীদের আরাম পৌঁছানোর জন্য তিনি নিজে কষ্ট বরণ করে নিয়েছেন। 

অহেতুক কথা-কাজ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলা

যখন আমরা কয়েকজন একসাথে হই, গল্প-গুজব, দেশের রাজনীতি, বহির্বিশ্বের নানান কূট-কৌশল, কত বিষয়ই না আমাদের আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায়! কে কত খবর রাখে তার প্রতিযোগিতা চলে। আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অথচ একজন দুনিয়াবী শিক্ষায় উচ্চপর্যায়ে পৌঁছানো ব্যক্তি আমাদের হযরত বলতেন, কী লাভ এসব আলোচনায়? হাঁ, খবর নিলে, হেডিং দেখলে, হল তো! এ নিয়ে এত সময় অপচয় কেন কর?

একবার এক সফর শেষে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা ফিরছি। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে এক রেস্টুরেন্টে হুযুরের সাথে সফরসঙ্গীরা সবাই নাস্তা করছি।  শয়তান ওইরকম এক অবস্থা তৈরি করে দিল। এ কথা সে কথা চলতেই থাকল। হুজুর লক্ষ করলেন। বেশ কিছুক্ষণ কিছু বললেন না। শেষে একসময় হুঙ্কার দিয়ে বললেন, তোমরা কি এসব আলোচনা বন্ধ করবে?

আমাদের নাস্তার টেবিল মুহূর্তে পিন-পতন নীরবতায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল।

আরেক সফরে আমাদের একজন কারো গীবত করতে থাকলে হুজুর গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলেন। বললেন, নিজের ব্যবস্থায় আসো। সে মাফ চাইল।

হুজুর বললেন, তুমি আসো, তবে আমাদের সাথে না।

হয়তো আমাদের শেখানোর জন্য এই দুই ক্ষেত্রে হুজুর কঠোর হয়েছিলেন।

 

হুজুর এখন কেবলই স্মৃতি; কিন্তু...

আমার আশা, আমাদের হযরত তাঁর মওলার কাছে প্রশান্তিতে আছেন। অনেক সুখে তাঁর সময় কাটছে। হুজুর আর আসবেন না, আমাদের কান্না আসবে, কষ্ট হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তিনি শান্তি পাবেন যে কাজে, সেটা হল তাঁর অনেক ত্যাগের ফসল, তাঁর কাজগুলো যদি আমরা সবাই মিলে আঁকড়ে ধরি। একাট্টা হয়ে তাঁর দেখানো পথকে যদি আমরা আমাদের পথ বানাই।

পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, আমাদের কোনো কাজ ও আচরণের কারণে যেন তাঁর বদনাম না হয়।

আল্লাহ, তুমি আমাদের হযরতকে জান্নাতুল ফিরদাউসের আলা মাকাম দান করো। তাঁর কাজগুলোকে যেন আমাদের নিজেদের কাজ বানাতে পারি, আল্লাহ তুমি আমাদের সে তওফীক দাওআমীন। 

 

 

advertisement