পরিমাপে ঠকানো ধ্বংসের বড় কারণ
বেচাবিক্রিতে সঠিক দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করা ও যথাযথভাবে মাপা ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিধান। ওজনে বিন্দুমাত্র কম করাও জায়েয নেই। আল্লাহ তাআলা সঠিক পরিমাপের প্রতি অনেক গুরুত্বারোপ করেছেন। কুরআন কারীমের একাধিক জায়গায় সঠিকভাবে ওজন করার নির্দেশ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-
وَ اَوْفُوا الْكَيْلَ اِذَا كِلْتُمْ وَ زِنُوْا بِالْقِسْطَاسِ الْمُسْتَقِيْمِ ذٰلِكَ خَيْرٌ وَّ اَحْسَنُ تَاْوِيْلًا.
যখন পরিমাপ পাত্র দ্বারা কাউকে কোনো জিনিস মেপে দাও, তখন পরিপূর্ণ মাপে দিও আর ওজন করার জন্য সঠিক দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করো। এ পন্থাই সঠিক এবং এরই পরিণাম উৎকৃষ্ট। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ৩৫
অন্যত্র সূরা আনআমের ১৫২ নম্বর আয়াতেও সঠিকভাবে মেপে দেওয়ার আদেশ করা হয়েছে।
ওজনে হেরফের করা এবং অন্যকে মাপে ঠকানো ধ্বংস ও বরবাদের অন্যতম বড় কারণ। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَيْلٌ لِّلْمُطَفِّفِيْنَ،الَّذِيْنَ اِذَا اكْتَالُوْا عَلَي النَّاسِ يَسْتَوْفُوْنَ، وَ اِذَا كَالُوْهُمْ اَوْ وَّ زَنُوْهُمْ يُخْسِرُوْنَ، اَلَا يَظُنُّ اُولٰٓىِٕكَ اَنَّهُمْ مَّبْعُوْثُوْنَ، لِيَوْمٍ عَظِيْمٍ.
বহু দুর্ভোগ আছে তাদের, যারা মাপে কম দেয়। যারা মানুষের নিকট থেকে যখন মেপে নেয়, পূর্ণমাত্রায় নেয়। আর যখন অন্যকে মেপে বা ওজন করে দেয়, কমিয়ে দেয়। তারা কি চিন্তা করে না, তাদেরকে এক মহা দিবসে জীবিত করে ওঠানো হবে? -সূরা মুতাফফিফীন (৮৩) : ১-৫
মাপে হেরফের করাকে আরবীতে ‘তাতফীফ’ বলে এবং যারা এটা করে তাদেরকে বলে ‘মুতাফফিফ’। এর বহুবচন ‘মুতাফফিফূন’। যারা ব্যবসায় অন্যের থেকে নিজের প্রাপ্য উসূল করার ব্যাপারে কোনো ছাড় দেয় না; পূর্ণমাত্রায় মেপে নেয়। কিন্তু অন্যকে দেওয়ার সময় হেরফের করে। এ আয়াতসমূহে এ ব্যপারে সতর্ক করে বলা হয়েছে, তারা কি ভাবে না, একদিন তাদেরকে আল্লাহ তাআলার সামনে দাঁড়াতে হবে? এই ন্যক্কারজনক কাজের জন্য কঠিন শাস্তি পেতে হবে?
ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও মানুষের যেকোনো হকই এ আয়াতের মর্মের অন্তর্ভুক্ত। যারা অন্যের থেকে নিজের প্রাপ্য কড়ায় গণ্ডায় উসূল করে, বিন্দুমাত্র ছাড় দেয় না, সময় ও সুযোগ দেয় না; কিন্তু অন্যের প্রাপ্য আদায় করার সময় গড়িমসি ও টালবাহানা করে, কোনো না কোনোভাবে ঠকাতে চায় এবং একে বুদ্ধিমত্তা মনে করে- তাদের প্রতি কুরআন সুন্নাহ্য় আরো অনেক সতর্কবার্তা ও হুঁশিয়ারবাণী রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা সঠিক পরিমাপের ব্যাপারে আরো বলেন-
وَ السَّمَآءَ رَفَعَهَا وَ وَضَعَ الْمِيْزَانَ، اَلَّا تَطْغَوْا فِي الْمِيْزَانِ، وَ اَقِيْمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ وَ لَا تُخْسِرُوا الْمِيْزَانَ.
তিনিই আকাশকে উঁচু করেছেন এবং তুলাদণ্ড স্থাপন করেছেন, যাতে তোমরা পরিমাপে জুলুম না কর, ইনসাফের সাথে ওজন ঠিক রাখ এবং পরিমাপে কম না দাও। -সূরা আররহমান (৫৫) : ৭-৯
হযরত শুআইব আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় মাদইয়ানবাসীদের একটি মারাত্মক বদ স্বভাব ছিল, তারা মাপে কম দিত, ওজন করার সময় অন্যকে ঠকাত। সূরা হূদ এবং সূরা শুআরায় তাদের আলোচনায় এই দিকটি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। শুআইব আলাইহিস সালাম তাদেরকে বলেছেন, তোমরা ওজনে কম দিও না, ঠিকমতো মেপে দিও। কিন্তু তারা কথা শোনেনি। এ অপকর্ম করেই চলেছিল। এটিই তাদের ধ্বংসের অন্যতম প্রধান কারণ। এছাড়াও তারা মানুষের হক ও সম্পদ নষ্ট করত। তাদেরকে এ ব্যাপারেও সতর্ক করা হয়েছিল। ইরশাদ হয়েছে—
وَ اِلٰي مَدْيَنَ اَخَاهُمْ شُعَيْبًا قَالَ يٰقَوْمِ اعْبُدُوا اللهَ مَا لَكُمْ مِّنْ اِلٰهٍ غَيْرُهٗ وَ لَا تَنْقُصُوا الْمِكْيَالَ وَ الْمِيْزَانَ اِنِّيْۤ اَرٰىكُمْ بِخَيْرٍ وَّ اِنِّيْۤ اَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ مُّحِيْطٍ، وَ يٰقَوْمِ اَوْفُوا الْمِكْيَالَ وَ الْمِيْزَانَ بِالْقِسْطِ وَ لَا تَبْخَسُوا النَّاسَ اَشْيَآءَهُمْ وَ لَا تَعْثَوْا فِي الْاَرْضِ مُفْسِدِيْنَ.
আর মাদইয়ানে তাদের ভাই শুআইবকে নবী করে পাঠাই। সে (তাদেরকে) বলল, হে আমার সম্প্রদায়! আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো মাবুদ নেই এবং ওজন ও পরিমাপে কম দিও না। আমি তোমাদেরকে সমৃদ্ধশালী দেখছি। আমি তোমাদের প্রতি এমন এক দিনের শাস্তির আশঙ্কা করছি, যা তোমাদেরকে চতুর্দিক থেকে বেষ্টন করে ফেলবে।
হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা পরিমাণ ও ওজন ন্যায়সঙ্গতভাবে পূর্ণ করবে। মানুষকে তাদের দ্রব্যাদি কম দেবে না। এবং পৃথিবীতে অশান্তি বিস্তার করে বেড়াবে না। -সূরা হূদ (১১) : ৮৪-৮৫
আরো দ্রষ্টব্য : সূরা শুআরা (২৬) : ১৮১-১৮৩
তাদের উপর্যুপরি অবাধ্যতার কারণে আল্লাহ তাআলা শেষ পর্যন্ত আগুনবৃষ্টি বর্ষণ করে তাদেরকে ধ্বংস করে দেন।
আজকাল আমাদের মধ্যে সর্বক্ষেত্রে অন্যের হক লঙ্ঘনের বিষয়টি অনেক ব্যাপক হয়ে গেছে। বিশেষত ব্যবসার ক্ষেত্রে অনেকেই চুক্তির পরে অন্যকে কোনো না কোনোভাবে ঠকাতে চাই। এটাকে ব্যবসায়িক সাফল্য ও বুদ্ধির পরিচয় মনে করি।
স্মরণ রাখা দরকার, বাহ্যিক চোখে যেটাকে সাফল্য মনে হচ্ছে, আদতে সেটা মোটেও সাফল্য নয়। দুনিয়ার এ যৎকিঞ্চিৎ লাভ (!) তো আখেরাতের বিপুল প্রাপ্তিকে ধ্বংস করে দিচ্ছেই। সাথে এটা দুনিয়াতেও বরবাদির এক বড় কারণ। এটা বরকত ওঠে যাওয়াসহ সবধরনের অকল্যাণ টেনে আনতে পারে। আল্লাহ তাআলার এ নির্দেশ ও সতর্কবাণী সকলেরই মনে রাখা ও মেনে চলা আবশ্যক।