জুমাদাল উলা-জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪৫   ||   ডিসেম্বর ২০২৩

মুসলিম শাসকদের কারণেই ইসরাইল শক্তিশালী হয়েছে

আনসার আব্বাসী

এক মাসের বেশি হয়ে গেছে, ইসরাইল গাজার ওপর মর্মান্তিক ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে। যা এখনো জারি আছে। ইতিমধ্যে (১৩ নভেম্বর পর্যন্ত) ১১ হাজার ফিলিস্তিনী -যার মধ্যে প্রায় অর্ধেক শিশু- শহীদ হয়ে গেছে। এতকিছুর পর অবশেষে মুসলিম উম্মাহ্র রাহনুমা তথা আরব ও অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর নেতৃস্থানীয় লোকদের বসার সুযোগ হয়েছে। গত ১২ই নভেম্বর সৌদি আরবে গাজা ও চলমান ইস্যু সংক্রান্ত তাদের প্রথম বৈঠক হয়। কিন্তু কেবল নিয়ম রক্ষা আর সামাজিক দায় এড়ানোর জন্য যতটুকু বলতে হয় ঠিক ততটুকু বলেই তারা ক্ষান্ত থেকেছে। একটি যৌথ বিবৃতি, একটি নিন্দা বার্তা আর কিছু দাবি করা ছাড়া বাড়তি কিছুই তারা করতে পারেনি। এভাবে তারা কেমন যেন কার্যত ইসরাইলের এ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডই শক্তি জোগাল। ফিলিস্তিনীদের সহমর্মিতা প্রকাশক দু-চারটি বাক্য বলেই তাদেরকে ইসরাইলের দয়া-দক্ষিণার হাতে ছেড়ে দিল। সাথে সাথে গাজাকে এ বার্তা জানিয়ে দিল, আমাদের কাছ থেকে কোনো আশা রেখ না। অন্যদিকে আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইউরোপের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোকে জানিয়ে দিল, আমরা আপনাদের নিরাশ করব না। জালেম ইসরাইলের এত নির্যাতন সত্ত্বেও আমরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকব।

মুসলিম বিশ্বের নেতৃস্থানীয় লোকেরা জালেম ইসরাইল এবং তাদের এ সন্ত্রাসবাদে মদদদাতা আমেরিকা, ব্রিটেন ও ইউরোপকে এটাও জানিয়ে দিল, আমরা আপনাদেরকে অসন্তুষ্ট করতে পারি না। তাই যা করব তা শুধু মুখে বা যবানেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কার্যত আমরা ইসরাইলের সাথে সম্পর্কও ছিন্ন করব না, তাদের সাথে ব্যবসায়িক লেনদেনও বন্ধ করব না। তাদেরকে জ্বালানী সামগ্রী তথা তেল-গ্যাস প্রদান অব্যহত রাখব। মুসলিম দেশে দেশে তাদের পণ্য এখনো সরবরাহ হবে। এগুলো বয়কটের কোনো সিদ্ধান্তও আমরা নেব না। আমরা ফিলিস্তিনীদের কেবল মুখের বুলি দিয়ে সাহায্য করে যাব। তাদের প্রতিরক্ষার জন্য আমরা কোনো সেনাবাহিনীও প্রস্তুত করব না, কোনো অস্ত্রসামগ্রীও পাঠাব না।

মুসলিম উম্মাহ্র এ সমস্ত শাসকগণ বিগত এক মাস যাবৎ ফিলিস্তিনীদের ওপর ইসরাইলীদের বর্বর হামলা বিষয়ে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে হাত গুটিয়ে বসে ছিল। আর দুনিয়াব্যাপী মুসলিম জনতা এদের জন্য বদদুআ করে আসছিল। এতদিন পর অবশেষে তারা বসল। আশা তো ছিল, হয়তো তারা এবার কিছু হলেও করবে। কিন্তু তারা কিছুই করেনি; কেবল দুনিয়ার ২০০ কোটি মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিরাশ করেছে।

তারা তো চাইলে পারত, ইসরাইলীদের প্রতিরক্ষার নামে এ ধ্বংসলীলা বন্ধের দাবি করতে, গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব আনতে, ইসরাইল আগ্রাসন চিরতরে বন্ধের কোনো বন্দোবস্ত করতে।

তারা চাইলে পারত, গাজায় হতাহতদের নিকট সেবা ও সাহায্যের কোনো পথ খুলতে। তারা চাইলে পারত, জায়নবাদী গোষ্ঠীর কাছে অস্ত্র-বিক্রি নিষিদ্ধঃকরণের কোনো দাবি তুলতে। সাথে সাথে তারা চাইলে পারত আত্মরক্ষার নামে ইসরাইলের এ প্রতারণামূলক প্রচারণা প্রত্যাখ্যান করতে। চাইলে পারত, গাজা ও পশ্চিম তীরের রাজনৈতিক কোনো সমাধান এনে দিতে। এ প্রস্তাবও আনতে পারত যে, জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদকে ইসরাইলী আগ্রাসন বন্ধে চূড়ান্ত কোনো আইন পাশ করতে হবে।

নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত কোনো আইন পাশ না হওয়ার কারণেই তো আজও ইসরাইল নিজেদেরে আগ্রাসন সমানতালে চালিয়ে যেতে পারছে। নিরাপরাধ শহরবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করতে পারছে। মানচিত্র থেকে গাজা নামের শহরটাই নিশ্চিহ্ন করার পাঁয়তারা করছে।

কন্ফারেন্সে অংশগ্রহণকারী নেতৃবৃন্দ আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে গাজায় ইসরাইলের এ হামলাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছে, ফিলিস্তিনীদের ওপর হামলা করার কোনো অধিকার ইসরাইলের নেই। তবে এগুলোও সেই মুখের বুলি মাত্র। কার্যত তারা এক কদমও সামনে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

খবরে বলা হয়, প্রস্তাবিত রেজুলেশনে কিছু দেশ ইসরাইল ও তার মিত্রদেরকে তেল সরবাহ বন্ধের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ইত্যাদি সরবরাহের জন্য আরব রাষ্ট্রগুলোর আকাশসীমা ব্যবহারের নিষেধাজ্ঞার দাবি করে। কিন্তু ক্ষমতাসীন কয়েকটি দেশ ভেটো দেওয়ায় এর ওপর আর একমত হওয়া যায়নি।

হামাসের পক্ষ থেকে আরব ও মুসলিম নেতাদের অনুরোধ করা হয়, তারা যেন ইসরাইলের সাথে সব ধরনের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে, যুদ্ধাপরাধে জড়িত ইসরাইলীদের বিরুদ্ধে একটি আইনি কমিটি গঠন করে এবং গাজা নতুনভাবে পথ চলার জন্য একটা আর্থিক ফান্ড তৈরি করে দেয়। কিন্তু তারা তাদের একটি অনুরোধও রাখেনি।

যদি সত্য বলি, তাহলে বলতে বাধ্য হব যে, আরব ও মুসলিম দেশগুলোর নেতারা গাজা ও ফিলিস্তিনীদের সমর্থন না দিয়ে জালেমদের সমর্থন দিয়েছে। তাদের হাতকেই শক্তিশালী করেছে। যা করার ছিল তা-ও করেনি। শুধু মুসলিম উম্মাহ্র জন্য বদনাম কুড়িয়েছে। পুরো বিশে^র মুসলমানদেরকে নিরাশ করেছে। গাজায় নিহত শিশুদের সাথে গাদ্দারি করেছে। সেইসাথে আগ্রাসী শক্তি ইসরাইল ও তাদের মদতদাতা দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক আরো জোরদার করেছে। যদি এমন কিছু করাই মাকসাদ, তাহলে তো উত্তম ছিল, ঘরেই বসে থাকা। দুনিয়া জুড়ে অপদস্থতা আর লাঞ্ছনা অর্জনের কী দরকার ছিল? সাথে নিজেদের আখেরাতও ডুবল!

 

[ডেইলি জং থেকে ১৩ নভেম্বর, ২০২৩ ঈ.

ভাষান্তর : খালিদ সাইফুল্লাহ]

 

 

advertisement