জুমাদাল উলা-জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪৫   ||   ডিসেম্বর ২০২৩

অপচয়, অথচ আমরা একে অপচয়ই মনে করছি না

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

আলহামদু লিল্লাহ, একথা তো সকল মুসলিমেরই জানা আছে যে, ইসলামে ইসরাফতাবযীরহারাম। ইসরাফ অর্থ অপচয়আর তাবযীর অর্থ অপব্যয়। যে কোনো ইসরাফতাবযীরহারাম। যে এমন করবে, কুরআনের ভাষায়- সে শয়তানের ভাই। কুরআন কারীমে ইরশাদ হয়েছে-

وَ لَا تُبَذِّرْ تَبْذِیْرًا، اِنَّ الْمُبَذِّرِیْنَ كَانُوْۤا اِخْوَانَ الشَّیٰطِیْنِ وَ كَانَ الشَّیْطٰنُ لِرَبِّهٖ كَفُوْرًا.

আর অপব্যয় করো না। নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই, আর শয়তান স্বীয় রবের চরম অকৃতজ্ঞ। -সূরা বনী ইসরাঈল (১৭) : ২৬-২৭

আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন-

وَّ كُلُوْا وَ اشْرَبُوْا وَ لَا تُسْرِفُوْا  اِنَّهٗ لَا یُحِبُّ الْمُسْرِفِیْنَ.

আর তোমরা খাও, পান করো; কিন্তু অপচয় করো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা অপচয়কারীকে পছন্দ করেন না। -সূরা আরাফ (৭) : ৩১

ইসরাফ শুধু অর্থ-সম্পদের ক্ষেত্রেই হয়- বিষয়টি এমন নয়। শুধু অর্থ-সম্পদের ইসরাফ তথা অপচয় করা নাজায়েয তা নয়; বরং আল্লাহ তাআলার দেওয়া যেকোনো নিআমত অপাত্রে  ব্যবহার, অপব্যবহার, অনর্থক ব্যবহার, আল্লাহ তাআলার নিআমত ব্যবহারের ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার দেওয়া সীমারেখা লক্ষ না রাখা, আল্লাহ তাআলার নির্ধারিত হকসমূহ আদায় না করা, এক হক আদায়ে বেশি বাড়াবাড়ি করে অন্য হক আদায়ের সুযোগই না থাকা, একজনের হক আদায়ে খুব বেশি জোর দিয়ে অন্যদের হকের প্রতি ভ্রুক্ষেপই না করা, এমনিভাবে  নিজের মূল দায়িত্বের ব্যাপারে গাফেল থেকে নফল বিষয়ে খরচ করা- এসবই ইসরাফ। আসলে উল্লিখিত  আয়াতের পূর্বপ্রসঙ্গ থেকে বুঝা যায়, ইসরাফ তথা অপচয়ের সূরতগুলোও স্তরভেদে তাবযীর তথা অপব্যয়ের মধ্যে দাখিল। কাজেই তাবযীরকারীদের ব্যাপারে যে সতর্কবাণী আয়াতে এসেছে, তাতে ইসরাফকারীরাও শামিল।

যাই হোক, ইসরাফ যেমনিভাবে পানাহারের ক্ষেত্রে হয় তেমনি পোশাক-আশাকের মধ্যেও হয়। এমনকি ওযু-গোসলের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি খরচ করার মধ্যেও ইসরাফ হয়। এ কারণে ইসরাফ-সংশ্লিষ্ট সমস্ত জরুরি মাসআলা জানা খুব প্রয়োজন। এমনিভাবে কোন্ ইসরাফ একেবারেই নাজায়েয, কোন্ ইসরাফ মাকরূহ আর কোন্টা এমন, যেখানে ক্ষেত্রবিশেষে ওযরওয়ালাদের জন্য কিছু ছাড় আছে- এগুলোও জানা থাকা জরুরি।

একথা ঠিক যে, ইসরাফের কিছু সূরত আপেক্ষিক। মানে সেগুলো কারো জন্য ইসরাফ হলেও অন্য কারো জন্য রুখসতের অন্তর্ভুক্ত।

ইসরাফের মাসায়েল এবং এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা এখন আমার উদ্দেশ্য নয়। বরং কিছু ঘটনা বয়ান করা উদ্দেশ্য, যেন তার আলোকে  ইসরাফের এমন কিছু রূপের প্রতি আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ হয়, যেগুলোকে আমরা ইসরাফই মনে করি না। অথচ সেগুলো এবং সেগুলোর মতো আরো অনেক রূপ ইসরাফের মধ্যে দাখিল; কিন্তু এ বিষয়ে আমাদের কোনো অনুভূতিই নেই।

থাকল তাবযীর ও ইসরাফের ঐসকল রূপ, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আমরা যেগুলোতে জড়িত। এর মধ্যে কিছু তো এত স্পষ্ট যে, সবাই বোঝে- এটা অপচয় তথা ইসরাফ বা তাবযীর। আর কিছু অপচয় খানিকটা অস্পষ্ট, কিন্তু খুবই ভয়ানক; যেগুলোর ব্যাপারে সচেতন বুযুর্গ আলেমগণ সতর্ক করতে পারেন। বান্দা এখানে কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করছি মাত্র-

১. শৈশবকালে আমাদেরকে খুব তাকীদের সাথে বলা হয়েছে- খাওয়ার সময় পড়ে যাওয়া খাবার উঠিয়ে না খাওয়া এবং নষ্ট করা ইসরাফ

২. যখন বান্দা জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়া বানূরী টাউনে তালেবে ইলম ছিলাম তখন দেখতাম, ফরয নামাযগুলোর পরে বিশেষভাবে ফজর নামাযের পরে অনেকে তিলাওয়াত, যিকির-আযকার, দুআ-আওরাদ ও নফল আমলে মশগুল থাকতেন। অর্ধেক বা দুই তৃতীয়াংশ মুসল্লী বের হয়ে যেতেন। অনেকে থাকতেন। কিন্তু এত বড় মসজিদে তারা যার যার জায়গায় বসে  থেকে আমল করতে চাইতেন। বান্দা একাধিকবার মসজিদের ইমাম ও খতীব কারী রশীদুল হাসান রাহ.-কে দেখেছি, তিনি  তাদেরকে খোশামোদ করে বলছেন, ভাই আপনারা তিলাওয়াত, যিকির দুআই তো করছেন, আমলগুলো কাছাকাছি বসে করুন। যাতে প্রত্যেকের জন্য বা দুই দুইজনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পাখা ও বাতি জ্বালানোর প্রয়োজন না হয়।

মসজিদগুলোতে এ দৃশ্য অনেক দেখা যায় যে, নামাযের আগে এক-দুই কাতার মুসল্লী আছে, কিন্তু  তখন থেকেই মসজিদের সবগুলো পাখা কিংবা অধিকাংশ পাখা ছেড়ে রাখা হয়। এমনিভাবে  নামাযের পরে এখানে এক-দুজন বসে থাকেন, খানিক দূরে এক-দুজন- এজন্য বিনা দরকারে কয়েকটি পাখা ছেড়ে রাখতে হয়। অথচ একটু খেয়াল করলে এবং মুসল্লীগণ একটু কষ্ট করে উঠে এসে কাছাকাছি বসলে এই ইসরাফ থেকে বাঁচা সহজ হয়।

৩. বানূরী টাউন মাদরাসায় পড়াকালীন দেখেছি, জামে মসজিদের দক্ষিণ পাশে একদিকে যদিও ট্যাপে ওযু করার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু অন্য পাশে হাউযে ওযু করারও ব্যবস্থা আছে।  অনেককে দেখেছি, তারা শুধু একারণে হাউযে ওযু করা পছন্দ করতেন যে, তাতে পানির অপচয় থেকে বাঁচা বেশি সহজ।

৪. যখন জামিয়া দারুল উলূম করাচীতে পড়াশোনার জন্য যাওয়া হল, দেখলাম উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুফতী আব্দুর রউফ সাখখারবী দামাত বারাকাতুহুম কখনো মৌখিকভাবে সতর্ক করতেন আবার কখনো ওযু খানায় দাঁড়িয়ে আমলীভাবে তাম্বীহ করতেন। কখনো নির্দিষ্ট করে কোনো ভাইকে মহব্বতের সঙ্গে বলতেন- ভাই পানির ট্যাপ হালকা করে ছাড়ো। কেবল ওযুর (অঙ্গ ধোয়ার) সময় চালু রাখ, এছাড়া বন্ধ রাখ। চালু অবস্থায় রেখে দিও না। কতেক ভাই হযরতের এ তাম্বীহ বুঝতে পারত না। তারা বলত, হযরত আমি তো ওযুই করছি! অথচ হযরতের উদ্দেশ্য থাকত, মিসওয়াক করা, ‘দালকতথা ওযুর অঙ্গগুলো ডলে ধোয়া ও মাথা মাসেহ করার সময় ট্যাপ বন্ধ রাখা। এ সময়গুলোতে ট্যাপ চালু রাখার কী দরকার!

৫. ১৪১৯ হিজরীর রমযানের শেষে মাদরাসা দাওয়াতুল হক হারদুঈ, ইউপিতে হাযিরী হয়েছিল। সেখানে অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সাথে দুটি বিষয় ছিল-

ক. সেখানে ওযুর জন্য লোটা রাখা হয়েছে। লোটা দিয়ে ওযু করা হলে পানির অপচয় কম হয়। কেননা  সত্যি কথা হল একটু খেয়াল করে পানি খরচ করা হলে পরিপূর্ণরূপে মাসনূন ওযুর জন্য প্রচলিত সাইজের এক লোটা পানিরও প্রয়োজন হয় না। ওযুর মধ্যে দালকতথা ওযুর অঙ্গগুলো ডলে ধোয়া সুন্নত এবং তাসলীসতথা অঙ্গগুলো তিনবার ধোয়া সুন্নত। কিন্তু দালককরার সময় পানির কল এভাবে ছেড়ে রাখে যে, তাসলীসের কোনো নাম-গন্ধও থাকে না। একবারের ধোয়া এত লম্বা হয় যে, তা যদি কয়েকবারে ভাগ করা হয়, তাহলে তা দ্বারা হয়তো কয়েক তাসলীসহয়ে যাবে।

আলহামদু লিল্লাহ, আমাদের দেশে কয়েক জায়গায় দেখেছি, লোটা দ্বারা ওযু করার ব্যবস্থা আছে। এটি অনুসরণীয় বিষয়। তবে কোনো হাম্মামে বা ওযুখানায় যদি আরএফএল কোম্পানির লোটা বা অন্য কোনো সামান কিংবা অন্য কোনো নামে এই কোম্পানির কোনো সামান দেখি, তাহলে দিলে অনেক ব্যথা লাগে। কারণ উদাহরণস্বরূপ, তাদের একটা লোটা কেনার অর্থ হল- কাদিয়ানী ফিতনার মতো ইলহাদ ও যিন্দীকওয়ালা ভয়াবহ কুফরের প্রসারে নিশ্চিতভাবে আর্থিক সহযোগিতা করা। এই কোম্পানির আয়ের অনেক বড় অংশ কাদিয়ানী ধর্মের প্রসারে ব্যয় করা হয়। আল্লাহ তাআলার ইবাদত ওযু-নামায তো করছি খাতামুন্নাবিয়্যীন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তরীকা অনুযায়ী; কিন্তু এর জন্য উপকরণ ব্যবহার করছি এমন, যা দ্বারা আল্লাহ ও খাতামুন্নাবিয়্যীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খুল্লমখোলা বিদ্রোহকারীদের সরাসরি সাহায্য করছি!  আশা রাখি, আমরা এ বিষয়ে ঈমানী গায়রতের  পরিচয় দেব।

খ.  হারদুঈতে দ্বিতীয় বিষয় দেখেছি, ঈদুল ফিতর ঘনিয়ে এলে যখন মেহমানের সংখ্যা কমে আসে তখন প্রথম অবস্থায় মেহমানগণকে বিভিন্ন কামরা থেকে বড় এক কামরায় নিয়ে আসা হয়। মেহমানের সংখ্যা আরো কমে গেলে তাদেরকে কাছে কাছে থাকার জন্য বলা হয়, যাতে এমন না হয় যে, চারজন মেহমানের জন্য কামরার চার কোণে চারটি পাখা চালু রাখতে হয়!

এ ধরনের আরো অনেক ঘটনা আছে, ইনশাআল্লাহ অন্য কোনো সুযোগে পাঠকের খেদমতে পেশ করার ইচ্ছা আছে।  আল্লাহ তাআলা এসকল শিক্ষণীয় ঘটনা থেকে আমাদেরকে শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফীক দান করুন- আমীন।

 

-আরযগুযার

বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক

২৫ রবিউল আখির, ১৪৪৫ হি.

 

 

advertisement