স্মৃতিচারণা ॥
তাঁর কিছু ছিল না আবার কোনো কিছুর অভাবও ছিল না
نحمده ونصلي على رسوله الكريم، أما بعد! فأعوذ بالله من الشيطان الرجيم، بسم الله الرحمن الرحيم.
اِنَّ الَّذِیْنَ قَالُوْا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوْا تَتَنَزَّلُ عَلَیْهِمُ الْمَلٰٓىِٕكَةُ اَلَّا تَخَافُوْا وَ لَا تَحْزَنُوْا وَ اَبْشِرُوْا بِالْجَنَّةِ الَّتِیْ كُنْتُمْ تُوْعَدُوْنَ.
উলামায়ে কেরাম ও বিজ্ঞজনদের অনেকেই দীর্ঘদিন যাবৎ প্রফেসর হযরত হামীদুর রহমান রাহ.-এর কাজকর্ম দেখেছেন। তিনি মূলতÑ
الْكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَه وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ-
এই হাদীসের ওপর পূর্ণ আমলকারী ছিলেন। হাদীসের অর্থÑ বুদ্ধিমান তো সে, যে নিজেকে চিনল এবং মৃত্যুপরবর্তী সময় ও চিরস্থায়ী জীবনের জন্য কাজ করল।
হাদীসের ভাষায় যাকে বলা হয়েছে ‘কায়্যিস’, আমার বাবাকে আমি তেমনই মনে করি। নিজের বাবা হিসেবে বলছি না, বরং বাস্তবতাটাই বলছি এবং দিল থেকে বলছি।
আমার বাবা ছিলেন একেবারে দুনিয়াবিমুখ একজন মহান ব্যক্তি। হাকীম আখতার ছাহেব একদিন আমাকে তাঁর খাস কামরায় ডাকলেন। তিনি তাঁর খাস কামরাকে ‘আইসিইউ’ বলতেন। মানুষ তাঁর কাছে ইসলাহ ও আত্মশুদ্ধির জন্য আসত। আসলে ইসলাহ ও আত্মশুদ্ধি বিষয়ে আমাদের কী যে হালত, তা তো আমরা বুঝতে পারি না। কিন্তু আল্লাহওয়ালরা বোঝেন যে, অবস্থা আমাদের কত খারাপ! এজন্য হাকীম ছাহেব রাহ. তাঁর ওই খাস কামরাকে ‘আইসিইউ’ বলতেন। আমাকে ডেকে বললেনÑ
ىہاں آئى سىو مىں آجاؤ۔
এখানে ‘আইসিইউ’তে আসো! তারপর বললেন, ‘আচ্ছা, তোমহারে ওয়ালেদ ছাহাব কা কুইঈ বাংলা ভী হায়?’ ‘বাংলা’ বলতে বাংলো বা বড় বাড়িকে বুঝিয়েছেন। অর্থাৎ তোমার বাবার কি নিজস্ব বাড়ি আছে?
আমি বললাম, ‘হযরত, মেরে ওয়ালেদ ছাহাব কী কুইঈ মামলূকা যমীন হী নেহী; বাংলা কাহাঁ সে হো?’ আব্বার তো নিজের মালিকানাধীন কোনো জমিই নেই, বাড়ি থাকবে কোত্থেকে?
বিষয়টি হযরত জানতেন, তার পরও ডেকে প্রশ্ন করেছেন সবাইকে শোনানোর জন্য। কারণ তখন তাঁর সামনে ছিল বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার ও সাধারণ শিক্ষিত ব্যক্তিগণ। তারপর হযরত সবাইকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘ইন কে ওয়ালেদ ছাহেব বহুত বড়ে মুতাওয়াক্কিলীন মেঁ সে হ্যায়।’ এর বাবা অনেক বড় তাওয়াক্কুলকারী ।
জীবনের শুরু থেকেই আব্বা এমন ছিলেন। আমার আম্মা বলেছেন, তোর আব্বাকে কখনো দেখিনি সঞ্চয় করতে। আব্বার কাছে অনেক বড় বড় শিল্পপতি ও ধনী লোকদের আসতে দেখেছি, কিন্তু আব্বা দ্বীনী কাজের জন্যও কোনোদিন কারো অর্থের দিকে তাকাননি।
আমরা জানি, ঈমানদারের জন্য তার দ্বীনী কাজেও বাহ্যিকভাবে দুনিয়ার দরকার হয়। তবে তারা দুনিয়াকে যেমন ত্যাগ করেন না, দুনিয়ার ওপর নির্ভরশীলও হন না। বরংÑ
وَّ عَلٰى رَبِّهِمْ ىَتَوَكَّلُوْنَ.
তারা তাদের রবের ওপরেই ভরসা করে।
এই বিষয়টা আমি আমার আব্বার মধ্যে পুরো মাত্রায় দেখেছি। কখনো কারো থেকে পাওয়ার চিন্তা করেননি। একজনের কাছে ঋণের জন্য গিয়েছেন। সে বলেছেÑ কে বলেছে আপনাকে ঋণ করে মাদরাসা করতে? পরের দিন মাদরাসার বাসাভাড়া দিতে হবে। কত পেরেশান! তিনি বাসায় বসে বসে পড়ছেনÑ
اَلَيْسَ اللهُ بِكَافٍ عَبْدَهٗ.
(হে রাসূল!) আল্লাহ কি তার বান্দার জন্য যথেষ্ট নয়? Ñসূরা যুমার (৩৯) : ৩৬
‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে!’Ñ এই নীতিতেই তাঁকে চলতে দেখেছি।
যাহোক, পরে একটা ঘটনা ঘটেছে। তাঁর এক ছাত্র এসেছিল। সে একটা প্রজেক্ট করেছে। ওই সময়েই সে পাঁচ-ছয় লক্ষ টাকা পেয়েছে। এসে আব্বাকে বলেছে, স্যার, করযে হাসানা হিসেবে এই পুরো টাকা আপনার কাছে রাখুন। আপনি যে কাজই করতে চান, করুন।
আমার দাদির মামাতো ভাই। খুবই সম্পদশালী। আমার আব্বাকে খুব মহব্বত করতেন। কিন্তু আব্বাকে কখনো দেখিনি, ওই দাদাভাই থেকে কিছু চাইতে। দাদাভাই এত চাইতেনÑ আব্বাকে দেবেন আর আব্বা তার চেয়েও বেশি চাইতেনÑ দাদাভাই কীভাবে দ্বীন পাবেন! তার বাসায় গেলে আব্বাকে গল্প শোনাতেন, মামা! (মূলত তিনি আব্বার মামা, কিন্তু বয়সে যেহেতু আব্বা বড়, সেজন্য তিনি আব্বাকে মামা বলে ডাকতেন) আজ এখানে এই কাজ করলাম, এখানে এত টাকা ঋণ করলাম, ওখানে ওই প্রজেক্ট শুরু করলাম ইত্যাদি। এটা স্বাভাবিক কথা যে, দ্বীনদারদের ফিকির আর দুনিয়াদারদের ফিকিরের মাঝে আকাশ-পাতাল ব্যবধান। এটা একটা ভিন্ন রকম জিনিস। অবশ্য আব্বার এই মামা আব্বার প্রচেষ্টার বদৌলতে উলামায়ে কেরামকে অনেক মহব্বত করতেন। দ্বীনের রাস্তায় অনেক খরচ করতেন। নিজের বাড়িতে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত বিরাট মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। বড় একটি মসজিদও নির্মাণ করেছেন। আব্বার ইন্তেকালের কয়েকদিন আগে তিনিও ইন্তেকাল করেছেন। আব্বা তার জানাযায় শরীকও হয়েছেন। আল্লাহ তাআলা তাকে মাফ করে দেন এবং জান্নাত দান করেন।
আব্বা মূলত চাইতেন, আগে যেন তিনি দ্বীনদার হন। হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.-কে কেউ হাদিয়া দিতে আসলে তিনি বলতেনÑ
پہلے اپني جان پہ خرچہ کرو پھر تمہارا پىسہ قبول ہوگا۔
অর্থাৎ আগে দ্বীন শেখ; এরপর তোমার হাদিয়া নেওয়া হবে।
সাধারণ মানুষ মনে করে, আমাদের টাকা না হলে আলেমরা চলবে কীভাবে? এটাও তাদের দ্বীন থেকে বেখবরির আরেক প্রকাশ। আমার দাদাভাই কীভাবে আব্বাকে দিতে চাইতেন আর আব্বা কীভাবে পালিয়ে বেড়াতেনÑ সে তো আমাদের চোখে দেখা। এমন ঘটনা আমাদের বড়দের জীবনীতে অনেক।
হযরত মাওলানা রূহুল কিস্ত রাহ. একবার বলেছিলেনÑ আমার ছোটবউ আমাকে বলে, কাকরাইল থেকে খাবেন না, আমি আপনার জন্য খাবার পাঠাব। তখন তিনি তাকে বলেছেন, তুমি তো আমাকে খাবার দিতে চাইছ, যাতে মানুষ মনে করে, মৌলবী সাহেব নিজেরটাই খায়। এতে কোনো লাভ হবে না। তুমি খাবার পাঠালেও মানুষ বলবে, টোয়াই টোয়াই খায়!
তিনি আসলেই খুব সাদাসিধে মানুষ ছিলেন। তাঁর বয়ান শুনলে মনে হত না যে, কোনো মাওলানা সাহেব কথা বলছেন। অথচ আরববিশ্বে তাঁর এত কদর! এত পরিচিতি! যখন তিনি অসুস্থ হয়েছিলেন, সেখান থেকে লোকজন এসে তাঁকে নিয়ে গেছে। আরবের লোকেরা তাঁকে খুবই ভালবাসত।
আমাকে একদিন ডেকে ঘটনা শোনালেন। একজন এসে তাঁকে বলেছে, হুযুর, আপনার জন্য আঙ্গুর হাদিয়া এনেছি। ইফতারের সময় তিনি তাঁর ছেলেকে ডেকে বললেন, দেখ, খাটের নিচে একজন আঙ্গুর হাদিয়া রেখে গেছে। ছেলে খাটের নিচ থেকে আঙ্গুরের প্যাকেট বের করে বলে, আব্বা, প্যাকেটে দেখি আঙ্গুরের সাথে টাকা!
দেখুন, আজ থেকে বিশ বছর আগের কথা। সরাসরি হাদিয়া পেশ করা হলে গ্রহণ না হওয়ার আশঙ্কায় আঙ্গুরের পুটলিতে করে চল্লিশ হাজার টাকা হাদিয়া রেখে গেল। এরকম অনেক ঘটনা আছে আমাদের সালাফের।
হযরত মাওলানা নূরুদ্দীন গওহরপুরী ছাহেব রাহ. শুনিয়েছেন। একবার আমি আমার উস্তাযের সঙ্গে মাদরাসার জন্য চাঁদা করতে বের হয়েছিলাম। ব্রিটিশ আমলের কথা। আাসামের পাহাড়ে। আমি খাদেম ছিলাম; হুযুরের আগে আগে হাঁটতাম। হুযুর আমাকে বললেন, নুরুদ্দীন দেখিয়া যাও! দেখিয়া যাও!! এই যে সোনা! এই যে সোনা!! আল্লাহর খিযানা! আমি বললাম, হুযুর, আপনি এইখান থেকে কিছু সোনা লইয়া লন। আমরা চান্দা খরতে যাইমু কেন? গওহরপুরী সাহেব বলেন, আমার উস্তায ওই গাছকে মাটিতে লাগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আল্লাহর খিযানা আল্লাহর যমিনে পুতিয়া রাখিয়া আল্লাহর রাস্তায় চলিলাম।’
গওহরপুরী রাহ. আমাদের বলেছেন, ‘তোমরা নদী দেখেছ? নদীর মধ্যে একেক পয়েন্ট দিয়ে কত পানি যাচ্ছে। কত কোটি টাকা দিলে তুমি এই পানি পাবে? এই পানি কে দেয়? যেরকম নদীর একেক পয়েন্ট দিয়ে পানি যাচ্ছে, এরকম আল্লাহওয়ালাদের হাত দিয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। তোমরা টেরও পাও না।’
আমার আব্বার জীবন এমনই ছিল। তাঁর হাত হয়ে দ্বীনের জন্য, বিভিন্ন প্রয়োজনগ্রস্ত মানুষের জন্য কত টাকা-পয়সা যে খরচ হয়েছে, হিসাব দেওয়া যাবে না। কোনো এক প্রসঙ্গে আমার এক ভাই এক লোককে বলেছিল, আপনি কি জানেন, প্রফেসর হামীদুর রহমান সাহেবের খরচ কত?
কিছু মানুষ আব্বাকে কথা বলে কষ্ট দিয়েছে; আপনাকে কে বলেছে ঋণ করে মাদরাসা চালাতে? আব্বা বলতেন, হাফেজ্জী হুযুর আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আমি স্বীকৃত ঋণগ্রহীতা।
বলছিলাম, আব্বার ওই মামা আমাদের দাদাভাইয়ের কথা। তিনি এসে বলতেন, মামা, এত টাকা ঋণ করেছি। ওই প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি। বিশাল প্রজেক্ট আর ঋণের গল্প শোনাতেন। আব্বাকে খুব পছন্দ করতেন তিনি। এখান থেকে আমারও মনে হয়েছে, আহারে, বড় বড় ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ করে বড় বড় ফ্যাক্টরি করে; আমার আব্বাও ব্যবসা করেন; কিন্তু সেটা আখেরাতের ব্যবসা। আল্লাহর খাযানা থেকে নিয়ে করেন এবং আল্লাহর জন্য করেন। আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে বলেছেনÑ
مَنْ ذَا الَّذِىْ ىُقْرِضُ اللهَ قَرْضًا حَسَنًا فَىُضٰعِفَهٗ لَهٗ وَ لَهٗۤ اَجْرٌ كَرِىْمٌ.
অর্থাৎ কে আছে, যে আল্লাহকে করযে হাসানা দেবে? উত্তম ঋণ দেবে? তাহলে তিনি সে দাতার জন্য তা বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেবেন এবং তার জন্য রয়েছে মহা প্রতিদান। Ñসূরা হাদীদ (৫৭) : ১১
আল্লাহর দ্বীনের জন্য খরচ করলে আল্লাহ তাআলা তা বহুগুণে বৃদ্ধি করে তাকে প্রতিদান দেবেনÑ এই বিশ্বাস আমার বাবার অন্তরে অনেক বেশি ছিল।
মাওলানা আবদুল মালেক সাহেবরা আমার আব্বাকে দেখেছেন। তাঁরা জানেন। আমার চাচারা জানেন, আব্বার জীবনটা কেমন ছিল? মাওলানা আবদুল মালেক সাহেবকে আমি সাথী হিসেবে পেয়েছি। চট্টগ্রামের সাঈদুল আলম নামের আমাদের আরেক সাথী ছিল। তিনি আমাদের উপরের জামাতে পড়তেন। পাকিস্তান থেকে তিনি দেশে আসবেন। আমি সেখান থেকে আব্বাকে ফোন করেছি, ‘আব্বা, বড় আলেম। আমাদের বড় ভাই। চিটাগাংয়ের মানুষ। আপনি পারলে তাকে একটু সহযোগিতা করুন।’ আমি তো নিজের থেকে করেছি। কিন্তু আব্বাকে আমার ফোন করার কারণে সাঈদুল আলম ভাই অনেক পেরেশান হয়েছেন।
তারপর যা হল, আব্বা নিজেই এয়ারপোর্ট গিয়ে তাকে রিসিভ করেছেন। এরপর তাকে বাসায় নিয়ে গিয়েছেন। মেহমানদারি করেছেন। তারপর আবার চিটাগাংয়ের ট্রেনে উঠিয়ে দিয়েছেন। পুরো ঘটনা তিনি চিঠিতে লিখেছেন। সেখানে আছে, ‘হাম নে সাহাবা কো নেহী দেখা, লেকিন সাহাবা কা নমুনা দে-খা।’ আমরা সাহাবীদের দেখিনি, কিন্তু তাদের নমুনা দেখেছি।
হাদীসে যে আছে, বুদ্ধিমান সে, যে নিজেকে চিনেছে এবং আখেরাতের কাজ করেছে। আমার বাবা তেমনি একজন মানুষ ছিলেন। তিনি বুয়েটের শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু সেখানে তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল অনন্য সাধারণ। মানুষ তাঁকে অনেক সম্মান করত, একইসাথে সবাই এ-ও বলত, ‘হামীদুর রহমান তো পাগল, তার সঙ্গে থেকে তুমিও কি পাগল হবে?’
অনেকে এমনও বলেছেন, হামীদুর রহমানের মতো ভালো মানুষ হয় না; কিন্তু তার কাজকর্ম আমাদের বুঝে আসে না। পার্সোনালিটি বা ব্যক্তিত্বের দিক থেকে তাঁর মতো লোক হয় না, কিন্তু নিজের বাচ্চাদের তিনি কেন মাদরাসায় দিলেনÑ বুঝে আসে না! আচ্ছা, বাচ্চাদের মাদরাসায় দিয়েছেন ভালো কথা, কিন্তু নিজের জন্য একটা বাড়িও কেন করলেন না! আবার দেখি, নিজে মাদরাসাও করলেন, তাও ঋণ করে!!
আম্মা বলেছেন, বিয়ের পর থেকেই দেখেছি, তোর বাবা কেবল ঋণ করেন, কোনো সঞ্চয় নেই। আগে ঋণ করেছেন সেটা ছিল এক ধরনের। আত্মীয়-স্বজনকে টাকা পয়সা দিয়েছেন। বুয়েটে কেউ ভর্তি হবে, টাকা নেই, তাকে দিয়েছেন। কেউ প্রতিষ্ঠিত হবে, তাকে সহযোগিতা করেছেন। এসবের জন্য তিনি ঋণ করতেন। গ্রামের মাদরাসার ছাত্ররা যেমন বাড়িতে বাড়িতে জায়গির থাকে, বুয়েটে যারা পড়তে আসত, হলে সীট হয়নি, আমাদের বাসা ছিল তাদের জন্য জায়গির বাড়ির মতো। বাসায় এসে থাকত, কোনো সমস্যা নেই। ঢাকা মেডিকেল থেকে এসেছে, কোনো সমস্যা নেই। শুধু তাই নয়, আত্মীয়-স্বজনের যারা ঢাকায় পড়তে আসতো, তারা তো একা আসত না। সাথে এক-দুজনকে নিয়ে আসত। তাদের উদ্দেশ্য হয়তো একটু ঢাকা ঘুরে দেখা, চিড়িয়াখানায় যাওয়া। যাই হোক, কিন্তু সবার ঠিকানা ছিল আমাদের বাসা।
ঘরে এত মেহমান আসত, মুরগি জবাই হলে দেখা যায়, সবই মেহমানদের জন্য দেওয়া হয়ে গেছে। একবার খেতে বসেছি। মুরগি রান্না হয়েছে। আম্মার কাছে আমি রানের টুকরোটা চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার ভাই মুসতাফিজ, সে খেতে বসে আম্মাকে বলেছে, আম্মা, আপনি কী খাচ্ছেন? তখন আব্বা আমাকে তরবিয়ত করেছেন। বলেছেন, দেখ, তুমি তোমার জন্য রান চাচ্ছ আর মুসতাফিজ মায়ের খবর নিচ্ছেÑ মা আপনি কী খাচ্ছেন? তুমি তোমার নিজের কথা বলছ, তোমার আম্মুর কথা কেন জিজ্ঞেস করছ না? এই ধরনের তরিবয়ত আব্বা আমাদের সব সময়ই করতেন। ঈযধৎরঃু নবমরহং ধঃ যড়সব (বদান্যতার সূচনা ঘর থেকেই) একথাও আব্বা বলতেন সব সময়।
আমার আম্মা মাস্টার্স পাস। মাস্টার্স পরীক্ষাও দিয়েছেন বিয়ের পরে। আমরাও বড় হলাম। মাদরাসায় যাতায়াত শুরু করলাম। আত্মীয়-স্বজন ও মেহমানদের আসা-যাওয়া অব্যাহত। বুয়েটের ক্যাম্পাসে আমাদের পাশের বাসার এক ভদ্রমহিলা আব্বার সহকর্মীর স্ত্রী। আমরা চাচি ডাকতাম। তিনি এসে দাদিকে বলতেন, খালাম্মা, মাস্টার্স পাস বউ এনে ‘ডেগ মাস্টারি’ করান কেন?
ফয়জুল উলূমের পর আব্বা নিজের বাসাতেই মাদরাসা বানালেন। মাদরাসার নাম ছিল রহমানিয়া। এই রহমানিয়া কিন্তু বর্তমানের জামেয়া রহমানিয়ারও আগে। শাইখুল হাদীস সাহেব হুযুর আশ্চর্য হয়ে গেলেন। খতীব উবাইদুল হক সাহেবের কাছে বিস্ময় প্রকাশ করলেনÑ আরে, এটা তো দেখি রহমানিয়ার আগেই রহমানিয়া। ওই মাদরাসা আমাদের বাসাতেই হয়েছিল; ফয়যুল উলূমে হালত সৃষ্টি হওয়ার পর। মাদরাসা করেছেন বটে, কিন্তু অর্থের যোগান হবে কোত্থেকে? কী করবেন, কোনো উপায় না পেয়ে আব্বা ঋণ শুরু করেন।
আমি ওই হাদীসটাই আবার উল্লেখ করতে চাচ্ছি, ‘বুদ্ধিমান সে, যে নিজেকে চিনল এবং আখেরাতের জন্য কাজ করল।’ আব্বা কোনো ফ্যাক্টরি-কারখানা করেননি, কিন্তু আখেরাতের ব্যবসা করেছেন। আল্লাহর প্রতি তাঁর ইয়াকীন এতই মজবুত ছিল যে, তিনি মনে করতেন, এখান থেকে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই তাঁকে ফল দান করবেন। কিন্তু কখনো কারো অর্থের দিকে তাকাননি। তাকিয়েছেন কেবল আল্লাহর দিকে। আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ ভরসা ও আস্থাই ছিল তাঁর পুঁজি। তাই সারা জীবন এভাবেই চলেছেন যে, কোনো কিছু নেই, আবার কোনো কিছুর অভাবও তাঁর নেই। আমি আবারো বলছি, আমার আব্বার কোনো কিছু ছিল না, কিন্তু কোনো কিছুর অভাবও ছিল না, আলহামদু লিল্লাহ। তাঁর জীবনের দিকে তাকালে কেবলÑ
اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ الَّذِىْنَ اِذَا ذُكِرَ اللهُ وَ جِلَتْ قُلُوْبُهُمْ وَ اِذَا تُلِىَتْ عَلَىْهِمْ اٰىٰتُهٗ زَادَتْهُمْ اِىْمَانًا وَّ عَلٰى رَبِّهِمْ ىَتَوَكَّلُوْنَ.
[মুমিন তো তারাই, (যাদের সামনে) আল্লাহকে স্মরণ করা হলে তাদের হৃদয় ভীত হয়, যখন তাদের সামনে তাঁর আয়াতসমূহ পড়া হয়, তখন তা তাদের ঈমানের উন্নতি সাধন করে এবং তারা তাদের প্রতিপালকের ওপরই ভরসা করে। Ñসূরা আনফাল (৮) : ২]
Ñএ আয়াতটির কথাই মনে পড়ে। আব্বা জীবিত থাকলে এরকম বলতে পারতাম না। কারণ পাশে থাকলে হয়তো আমার থেকে মাইকটা নিয়ে নিতেন।
আব্বার আরেক বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি সারা জীবন যা বলেছেন, তার চেয়ে বেশি করেছেন। যতটুকু বয়ান ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিল তাঁর কাজ।
ইন্তেকালের কিছুদিন আগে আব্বা হাসপাতালে ছিলেন। সেখান থেকে বের হয়ে মনোহরদী এক মাদরাসার মাহফিলে গেলেন। একেবারে চুপচাপ সবার বয়ান পুরো শুনেছেন। পরের দিন সোমবার, অর্থাৎ গত সোমবারের আগের সোমবার, সেদিনও বয়ান হয়েছিল। আমি ভেতরে গিয়ে দেখি, আব্বা নীরবে পুরো বয়ান শুনছেন। যখন আযান হচ্ছিল, নিষ্পলক দৃষ্টিতে ওপরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। এর পরের সোমবার আব্বা আর আসতে পারেননি।
আপনি একটু চিন্তা করুন, এই বয়সে, এত অসুস্থ অবস্থায় হুইল চেয়ারে করে গাড়িতে শুয়ে পুরো বাংলাদেশে আব্বা যেভাবে সফর করে বেড়াতেন, জেনারেল শিক্ষিত কোনো মানুষের এমন নজির আছে কি? হাঁ, আল্লাহওয়ালা আলেম বুযুর্গদের তো উদাহরণ থাকবেই; কিন্তু ইংরেজি শিক্ষিত মানুষ, যিনি বস্তুবাদী পরিবেশে ও বস্তুবাদী মানসিকতা লালনকারী মানুষের মধ্যে বড় হয়েছেন; ওসব পরিবেশে, যেখানে সর্বদা ওই বাক্য উচ্চারিত হতÑ ‘পড়ালেখা করে যে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে’, এমন পরিবেশে থেকেও কীভাবে তিনি দ্বীনের জন্য সবকিছু উৎসর্গ করে দিলেন! এমনকি নিজের বাচ্চাদের পর্যন্ত জাগতিক শিক্ষা না দিয়ে মাদরাসায় দ্বীনী শিক্ষা দিলেন। এজন্য আব্বাকে এমন কথাও শুনতে হয়েছে যে, ‘হামীদ, আমার যদি অথরিটি থাকত, আমি তোমার ইঞ্জিনিয়ারিং সার্টিফিকেট কেটে দিতাম! তুমি আল্লাহর কাছে কী জবাব দেবে? সবগুলো বাচ্চাকে মাদরাসায় কেন পড়িয়েছ?’
মানুষ তো মনে করে, পীর সাহেবরা কেবল মানুষ থেকে হাদিয়া নেয়। দুহাতে নেয় আর পকেট ভরে! কিন্তু আমি শুধু একটা ঘটনা বলছি। আব্বার জীবনের প্রথম হজ¦ হয়েছিল হাফেজ্জী হুযুরের খাদেম হিসেবে। সেই হজ¦ তিনি করেছেন ঋণ করে। হাফেজ্জী হুযুরকে কেউ হাদিয়া দিলে Ñচাই তা ডলারে হোক কিংবা রিয়ালে অথবা টাকায়Ñ তিনি আব্বার কাছে রাখতেন। কামরাঙ্গিচর মাদরাসায় পুকুরের পূর্বপাড়ের যে ঘরটা (এখন অবশ্য পুকুর নেই), সেটা ওই টাকা দিয়েই নির্মাণ করা হয়েছিল।
আল্লাহওয়ালাদের আল্লাহ যেভাবে দেন, আমরা বুঝি না। তাঁদের হাত হয়ে দ্বীন ও উম্মতের জন্য যেভাবে টাকা খরচ হয়, আমরা কল্পনাও করতে পারি না। এই যে আমাদের উপমহাদেশের বড় বড় মাদরাসা, বাংলাদেশের হাটহাজারী, পটিয়াসহ বড় মাদরাসাগুলো কীভাবে হয়েছে? মাওলানা তাকী উসমানী সাহেব দামাত বারাকাতুহুম তাঁর ‘সফর দর সফর’ কিতাবে লিখেছেন, ইন্ডিয়ার উত্তর প্রদেশের বড় বড় মাদরাসা, যেমন দারুল উলূম দেওবন্দ, সাহারানপুর মাদরাসা, এগুলোর চেয়েও আয়তনে বড় বড় মাদরাসা আছে দক্ষিণে। পুরো হিন্দুস্তানের এই অবস্থা নিয়ে যদি চিন্তা করা হয়, আমরা বুঝতে পারব, আল্লাহওয়ালাগণ আল্লাহর ওপর ভরসা করে কত কী করতে পারেন! আমাদের আকাবির ও উলামায়ে দেওবন্দের এই কীর্তিটা বড়ই অদ্ভুত ও বিস্ময়কর! সে বিষয়ে আমি কথা বলার হক রাখি না। তার জন্য মাওলানা আবুল বাশার সাহেব, যিনি দারুল উলূম দেওবন্দের সরাসরি ছাত্র এবং মাওলানা আবদুল মালেক সাহেবের মতো যোগ্য ব্যক্তিগণ আছেন। তাঁরা এসব বুঝবেন, উপলব্ধি করবেন এবং বলতেও পারবেন। আমি সাধারণ মানুষ এসব বুঝতে পারব না। সেজন্যই বলি, আমি আব্বার কাজ বুঝিনি, এখনো বুঝি না, তবে এতটুকু বুঝি যে, এর মধ্যেই কামিয়াবি ও সফলতা। আল্লাহ তাআলা আমাদের বোঝার তাওফীক দান করুন। আব্বাকে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন। তাঁর কবরকে নূরে নূরান্বিত করুনÑ আমীন।