জুমাদাল উলা-জুমাদাল আখিরাহ ১৪৪৫   ||   ডিসেম্বর ২০২৩

মাওলানা কারী সৈয়দ সিদ্দীক আহমদ বান্দবী রাহ.

মাওলানা ফজলুদ্দীন মিকদাদ

ভারতের উত্তর প্রদেশের বান্দাজেলার হাতূরানামক এলাকায় ১৩৪১ হিজরী মোতাবেক ১৯২৩ ঈসাব্দ সনে মাওলানা কারী সৈয়দ সিদ্দীক আহমদ বান্দবী রাহ. জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ আহমদ এবং মায়ের নাম খায়রুন নিসা।

সিদ্দীক আহমদ বান্দবী রাহ. সাত আট বছর বয়সী থাকতেই তাঁর পিতা ইন্তেকাল করেন। তাঁর দাদা কারী আবদুর রহমান রাহ. ছিলেন খুব ভালো হাফেজ এবং মুজাওয়িদ (তাজবীদশাস্ত্রে পণ্ডিত)। তিনি ছিলেন কারী ও মুহাদ্দিস মাওলানা আবদুর রহমান পানিপথী রাহ.-এর শাগরিদ। বান্দবী রাহ. দাদার কাছে কয়েক পারা হিফজ করেন এবং তাজবীদশাস্ত্রের প্রাথমিক ইলম হাসিল করেন। দাদার ইন্তেকালের পরে তিনি মাওলানা আমীনুদ্দীন সাহেব রাহ.-এর কাছে হিফজ সমাপ্ত করেন। শেষ অংশটুকু রমজান মাসে হিফজ করেন।

তারপর কয়েক বছর পানিপথে পড়াশোনা করেন। সেখানে উলূমে কুরআন এবং উলূমে তাজবীদ হাসিল করেন। পানিপথ অন্যতম এক ইলমী মারকাজ। তখন সেখানে ইলমে কিরাআত এবং ইলমে তাজবীদের বিশেষ চর্চা ছিল। অনেক কারী ও হাফেয ছিলেন। পুরো হিন্দুস্তানে পানিপথের ইলমুল কিরাআত এবং ইলমুত তাজবীদ শাস্ত্রের সুনাম সুখ্যাতি ছিল। তখন সেখানকার শিক্ষাপদ্ধতি দেওবন্দ ও সাহারানপুরের মতো পুরোপুরি প্রাতিষ্ঠানিক ছিল না। বহু মাদরাসা ছিল, কিন্তু অনেক তালিবে ইলম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে না পড়ে বিভিন্ন উস্তাযের কাছে গিয়ে গিয়ে নিজের পছন্দমতো শাস্ত্রের ইলম হাসিল করতেন। বান্দবী রাহ.-ও পানিপথে এভাবেই ইলম হাসিল করেছেন। তিনি কারী আবদুর রহমান পানিপথী রাহ.-এর নামে নামকৃত মসজিদে থাকতেন। আর বিভিন্ন উস্তাযের কাছে গিয়ে গিয়ে ইলম হাসিল করতেন।

তখন সেখানে শাইখুল র্কুরা মাওলানা কারী ফাতাহ মুহাম্মাদ পানিপথী রাহ. ছিলেন।

তাছাড়া কারী আবদুল হামীদ রাহ., কারী আবদুল হালীম রাহ. (তারা দুজন কারী আবদুর রহমান পানিপথী রাহ.-এর পৌত্র), কারী মুশতাকসহ আরো অনেকেই ছিলেন। কারী ফাতাহ মুহাম্মাদ পানিপথী রাহ. বান্দবী রাহ.-এর ইলমুল কিরাআত এবং ইলমুত তাজবীদের উস্তায ছিলেন। তাছাড়া কারী মুশতাক আহমদ রাহ.-এর কাছে তিনি কুরআন কারীম মশক করেন। কারী আবদুল হালীম রাহ.-এর কাছে তিনি ইলমুল কিরাআতের জগদ্বিখ্যাত কিতাব শাতিবিয়্যার কিছু অংশ পড়েন, সাত কেরাত শেখেন এবং কারী ও তাদের রাবীদের সম্পর্কে ইলম হাসিল করেন। পরবর্তীতে শাহী মুরাদাবাদ মাদরাসায় পড়ার সময় কারী আবদুল্লাহ ছাহেব রাহ.-এর কাছেও তিনি ইলমুল কিরাআত হাসিল করেন।

দাদার সাহচর্যে থেকে বান্দবী রাহ.-এর মনে ছোটবেলা থেকেই কুরআন কারীমের প্রতি বিশেষ মহব্বত ছিল। রমযান মাসে সারাদিন কুরআন তিলাওয়াত করতেন। তিলাওয়াত ছাড়াও রমযানে তিনি আওয়াবীন, তারাবীহ ও তাহাজ্জুদে কয়েক খতম কুরআন তিলাওয়াত করতেন। ইন্তেকাল পর্যন্ত প্রায় সুদীর্ঘ ষাট বছরব্যাপী তাঁর এ আমল জারি ছিল।

বেশ কয়েক বছর তাঁর রমযানের আমল এমন ছিল, প্রথম দশ দিনে এক মসজিদে তারাবীতে কুরআন কারীম খতম করতেন। শেষ দশ দিনে যে মসজিদে ইতিকাফ করতেন সেখানে তারাবীতে কুরআন খতম করতেন। আর মাঝের দশ দিনে বিভিন্ন মহল্লার মসজিদে গিয়ে গিয়ে কয়েক পারা করে শোনাতেন। নিজেই বিভিন্ন মহল্লায় গিয়ে লোকদেরকে ডাকতেন। তিনি চাইতেন, এর দ্বারা যেন সবার মধ্যে কুরআনের প্রতি মহব্বত বাড়ে, কুরআন হিফজ করার আগ্রহ হয়।

সিদ্দীক আহমদ বান্দবী রাহ. নিজ এলাকায় জামিয়া আরাবিয়া নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। মাদরাসা প্রতিষ্ঠার প্রথমদিকে তিনি হিফজখানায় তালিবে ইলমদের সবক শুনতেন, কেরাত শেখাতেন, তাজবীদ শেখাতেন। ব্যস্ততা বাড়ার পরেও তিনি সময় সুযোগ পেলে হিফজখানায় সময় দিতেন এবং সেখানে বসেই মুতালাআ করতেন। নিজেই হিফজখানার ছাত্রদের পরীক্ষা নিতেন।

জামিআ আরাবিয়া বান্দায় ইলমুল কিরাআত ও ইলমুত তাজবীদ শাস্ত্রের আলাদা একটি জামাত ছিল। বান্দবী রাহ. ফজরের পরে এক রুকূ পরিমাণ কেরাত মশক করাতেন। আসরের পরে ফাওয়ায়েদে মাক্কিয়্যাহ’-এর দরস দিতেন। ফাওয়ায়েদে মাক্কিয়্যাহ কিতাবটি কারী আবদুর রহমান মাক্কী রাহ. (১৩৪৯ হি.) রচিত ইলমুত তাজবীদ শাস্ত্রের একটি প্রাথমিক কিতাব। এছাড়া রাতে এশার পরে জামিয়া আরাবিয়ার সকল ছাত্রের জন্য তাজবীদের উন্মুক্ত দরস দিতেন। জীবনের শেষদিকে তিনি মাগরিবের পরে শাতিবিয়্যাহ-এর দরস দেওয়া শুরু করেন। এছাড়াও তাফসীরে জালালাইন ও তাফসীরে বায়যাবীসহ দরসে নেযামীর প্রায় সকল কিতাবেরই তিনি দরস দিয়েছেন।

জামিয়া আরাবিয়া বান্দা ছাড়াও বান্দবী রাহ. সর্বসাধারণের কুরআন শিক্ষার জন্য বেশ কয়েকটি মকতব প্রতিষ্ঠা করেন।

বান্দবী রাহ. তাসহীলুত তাজবীদনামে ইলমুত তাজবীদ ফনের একটি প্রাথমিক কিতাব রচনা করেন। যা আজও পর্যন্ত ব্যাপক সমাদৃত। এ কিতাবটি বিভিন্ন মাদরাসায় নেসাবের অন্তর্ভুক্ত। উল্লেখ্য, এ নামে একাধিক মুসান্নিফের কিতাব রয়েছে।

২৪ রবীউস সানী ১৪১৮ হিজরী মোতাবেক ২৮ আগস্ট ১৯৯৭ ঈসাব্দ সালে মাওলানা কারী সৈয়দ সিদ্দীক আহমদ বান্দবী রাহ. ইন্তেকাল করেন।

তথ্যসূত্র : তাজকিরাতুস সিদ্দীক, মাওলানা উবায়দুল্লাহ আসআদী 

 

 

advertisement