মকতবে আকীদা শিক্ষা
গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও কর্মপদ্ধতি
الحمد لله، وسلام على عباده الذين اصطفى، وأشهد أن لا إله إلا الله، وأشهد أن محمدا عبده ورسوله، وخاتم أنبيائه ورسله، صلى الله عليه وآله وسلم تسليما كثيرا كثيرا، أما بعد!
কিছুদিন আগে কয়েকজন দ্বীনদার সাথী আমাকে বললেন- মকতবের শিশুদেরকে আকীদার বিষয়গুলো অনেক গুরুত্বের সঙ্গে শেখানো উচিত; কিন্তু আমাদের দেশে এ বিষয়ে কোনো গুরুত্ব নেই। অথচ বিষয়টি কত গুরুত্বপূর্ণ তা সবারই জানা। প্রথমত আকীদার বিশুদ্ধতা পুরো ঈমানের ভিত্তি। দ্বিতীয়ত অনেক শিশু মকতবের পরেই অন্য পথে চলে যায়। অর্থাৎ তারা আর দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণ করে না; বরং প্রচলিত সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জাগতিক শিক্ষা লাভ করে, যেখানে দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদি শেখানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। বরং এখন তো যে কোনো বিষয়কে আদ্যোপান্ত নিরেট সেক্যুলার পদ্ধতিতে শেখানো হচ্ছে; বরং সেগুলোকে একদম দ্বীন-পরিপন্থী বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেজন্য শিশুরা যদি মকতবে থাকাবস্থায় আকীদার বিষয়গুলো শিখে ফেলে তাহলে সামনে গিয়ে তারা যে শিক্ষাই গ্রহণ করুক কিংবা পার্থিব যে কাজেই নিয়োজিত হোক, আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহে তার ঈমান হেফাযতে থাকবে এবং আশা করা যায়, ইনশাআল্লাহ সে কোনো বাতিলপন্থীর দাওয়াতের শিকারে পরিণত হবে না।
তারা এ কথাও বলেছেন- শুধু মকতব নয়, বরং সাধারণ মানুষের জন্যও ঈমান আকীদা এবং ইসলামের মৌলিক শিক্ষার তেমন কোনো কিতাব আমরা পাই না।
তাদের কথা আমার এজন্য ভালো লেগেছে যে, তারা ইসলামী আকীদার গুরুত্ব অনুভব করেছেন এবং তার শিক্ষা সর্বসাধারণের মধ্যে প্রসার করার প্রয়োজনীয়তাও অনুধাবন করেছেন। বাস্তবিকপক্ষে সমাজের প্রতিটি ছেলেশিশু ও মেয়েশিশুকে এবং সব পেশা ও সব শ্রেণির মানুষকে কেবল ইসলামী আকীদা নয়, বরং দ্বীনী ইলমের কমপক্ষে ফরয অংশটুকু সবাইকে শিখিয়ে দেওয়া উচিত। আর মৌলিক আকীদার বিষয়গুলো তো একেবারে মুখে মুখে মুখস্থও করিয়ে দেওয়া উচিত।
ঈমান ও ইসলামের ওপর অবিচল থাকার জন্যে সবচেয়ে বড় বিষয় হল, অন্তরে আল্লাহ তাআলা ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আযমত ও মহব্বত বদ্ধমূল করে দেওয়া। আখেরাতের মুক্তির চিন্তা, আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের অনিবার্যতা এবং আল্লাহ তাআলার ক্রোধ ও অসন্তুষ্টির ভয়াবহতার মতো মৌলিক বিষয়গুলো মন-মস্তিষ্কে গেঁথে দেওয়া। এ কথা অন্তরে প্রোথিত করে দেওয়া যে, আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও আখেরাতের মুক্তি শুধু এবং শুধু ইসলামের মধ্যে। বান্দার প্রতি আল্লাহ তাআলার কী কী হক এবং তার প্রতি অন্যান্য মাখলুকের কী কী হক- এ সম্পর্কে সহীহ ইলম হাসিল করতঃ সেসব হক আদায় করা ইসলামের সবচেয়ে বড় এবং মৌলিক ফরয।
আমাদের পূর্বসূরিগণ মকতবের তালীম-তরবিয়ত সংক্রান্ত দিকনির্দেশনামূলক যেসব কিতাব লিখেছেন তাতে তাঁরা এ বিষয়ে অত্যন্ত জোর দিয়েছেন যে, বাচ্চাদেরকে গুরুত্বের সঙ্গে আকীদা শেখাতে হবে এবং তাদের ঈমানী তরবিয়তের দিকে সযত্ন দৃষ্টি রাখতে হবে।
অবশ্য ওই সাথীদের এ চিন্তা সঠিক নয় যে, বাচ্চাদের আকীদা শেখানোর বিশেষ কোনো ব্যবস্থা নেই অথবা সাধারণ মানুষদেরকে আকীদা শেখানোর জন্য ভালো কোনো কিতাব নেই!
সাধারণ মানুষের ঈমান আকীদা ও ফরয পরিমাণ ইলম শেখার জন্য তো মাশাআল্লাহ অনেক ব্যবস্থাই রয়েছে। তারা এ ইলম কিতাব থেকে শিখতে চাইলেও তা হতে হবে কোনো আলেমের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণের মাধ্যমে অথবা তার তত্ত্বাবধানে। আর যেসব বিষয়ের জন্য আমলী মশকের প্রয়োজন তা তো যথাযথ মশকের মাধ্যমেই অর্জন করতে হবে। এ বিষয়ে সহায়ক কিছু কিতাবের নাম আমরা আলকাউসারের বিগত একাধিক সংখ্যায় লিখেছি।
বাচ্চাদের আকীদা শেখানোর জন্য এটা জরুরি নয় যে, একেবারে ‘কিতাবুল আকাইদ’ বা ‘আকীদার বই’ নামে কোনো কিতাব নেসাবে যুক্ত করা হবে এবং সেটাকে সবক সবক করে পড়ানো হবে, যেভাবে বড় ছাত্রদের পড়ানো হয়। বরং আকীদার বিষয়গুলো কোনো না কোনোভাবে এবং কোনো না কোনো শিরোনামে যদি তাদের মুখস্থ করিয়ে দেওয়া যায়, তাদের অন্তরে যদি আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূল খাতামুন নাবিয়্যীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়সাল্লামের ভালবাসা বদ্ধমূল করে দেওয়া যায় এবং দ্বীন, ঈমান ও শাআইরুল ইসলামের সম্মান অন্তরে গেঁথে দেওয়া যায় তাহলে আকীদা পড়ানোর মাকসাদ হাসিল হয়ে যাবে।
মকতবের নেসাব কোথাও তিন বছর আর কোথাও চার বছরও হয়। চতুর্থ বছরে তো সহজ কোনো কিতাবও পড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। ইমাম আবু যায়েদ কায়রাওয়ানী রাহ. (৩১০ হি.-৩৮৬ হি.)। তার বন্ধু শায়েখ আবু মাহফুয মুহরায ইবনে খালাফ, যিনি মকতবের মুন্শি ছিলেন। তার অনুরোধে ইমাম আবু যায়েদ কায়রাওয়ানী রাহ. মকতবের শিশুদের ফরয ইলম শেখানোর জন্য ‘আররিসালা’ কিতাবটি রচনা করেন। কিতাবের শুরুতে তিনি ইসলামী আকীদাগুলো উল্লেখ করেন এবং সেগুলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মাসলাক অনুযায়ী পেশ করেন। শায়েখ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ. ‘আররিসালা’ থেকে আকীদা অংশটুকু আলাদাভাবে ছাপেন, যার নাম তিনি রেখেছেন-
العَقِيْدَةُ الإِسْلَامِيّةُ الّتِي يُنَشَّأ عَلَيْهَا الصِّغَارُ.
তালীম-তরবিয়তের ইতিহাস দেখলে এমন অনেক কিতাবের নাম পাওয়া যাবে, যেগুলো মকতবে আকায়েদ ও দ্বীনের ফারায়েয শেখানোর উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে কিংবা যেসব কিতাব মকতবের মুআল্লিমগণ শিশুদের উপযোগী মনে করে পড়াতেন।
উদাহরণস্বরূপ আমাদের দেশে বিভিন্ন পদ্ধতির যেসব মকতব আছে, সেগুলোতে বাচ্চাদেরকে ঈমান ও যিকিরের বিভিন্ন কালিমা অর্থসহ মুখস্থ করানোর ব্যবস্থা রয়েছে। ওইসমস্ত কালিমায় আকীদার শিক্ষা বিদ্যমান আছে। অধিকাংশ মকতবে মুআল্লিমদের জন্য দ্বীন ও শরীয়তের মৌলিক শিক্ষা সম্বলিত কোনো পুস্তিকাও প্রস্তুত করে দেওয়া হয়; তারা সেগুলো বাচ্চাদের মুখস্থ করিয়ে দেন।
অধিকাংশ মকতবে ‘হিফযুল হাদীস’ ও ‘আদইয়ায়ে মাসনূনা’ বিষয়দুটিও নেসাবে থাকে। সেগুলোর মধ্যেও আকীদার অনেক শিক্ষা বিদ্যমান থাকে।
অনেক মকতবে হযরত মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ দামাত বারাকাতুহুম লিখিত ‘ছোটদের আকীদা সিলসিলা’ এর ১০টি রিসালা নেসাবে অন্তর্ভুক্ত আছে। কেউ চাইলে বাচ্চাদেরকে এসব রিসালার খোলাসা বা খোলাসার খোলাসা আলাদাভাবে লিখে মুখস্থ করিয়ে দিতে পারেন।
একথা অবশ্য ঠিক- এটা যেহেতু ফেতনার যামানা, এদিকে সমাজের অনেক শিশু মকতবের পর দ্বীনী ইলম থেকে একদম বিচ্ছিন্ন থাকে, সেহেতু মকতবের তালীম একেবারে সাদামাটা না রেখে তাতে ফরয পরিমাণ ইলম অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। যাতে এ শিশু যখন বড় হবে তখন -আল্লাহ না করুন- কোনো অমুসলিম বা কোনো ভ্রান্ত চিন্তাধারার লোক তার কাছে কোনো কুফর বা গোমরাহির দাওয়াত নিয়ে আসলে ইনশাআল্লাহ সে প্রভাবিত হবে না। সে বুঝে যাবে, এই লোক যে কথা বলছে, সেটা অমুক ইসলামী আকীদার খেলাফ। অথবা এটা গোমরাহী; কারণ এটা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর নীতি ও আদর্শের পরিপন্থী।
এই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য উস্তাযের পক্ষ থেকে বাচ্চাদের যেহেন প্রস্তুত করা এবং তাদের ঈমানী তরবিয়ত করাই হল মূল কাজ। সেজন্য আমার মতে মকতবের মুআল্লিমগণের জন্য আকাইদ, ফরয ইলম ও ঈমানী তরবিয়ত বিষয়ক সহজ সাবলীল ও কিছুটা বিস্তারিত আকারের কিতাব দরকার, যেটা তাদরীবুল মুআল্লিমীনের তাদরীবী কর্মশালাগুলোতে দাখেলে নেসাব থাকবে। পরবর্তীতে পড়ানোর সময় মুআল্লিমগণ মূল বিষয়গুলো বারবার ছাত্রদের সঙ্গে মুযাকারা করবেন, যাতে সেগুলো তাদের আত্মস্থ হয়ে যায় এবং তাদের মধ্যে আখেরাতের ফিকির পয়দা হয়।
বাচ্চারা তো মাশাআল্লাহ ষাট-সত্তরটি হাদীস অনুবাদসহ এমনিতেই মুখস্থ করে। অতএব এটাও সম্ভব যে, তারা কুরআন মাজীদের আয়াতে কারীমার ছোট ছোট অংশ তরজমাসহ মুখস্থ করে নেবে। যদি বিরতি দিয়ে দিয়ে অর্থসহ এক-দুই বাক্য করে মুখস্থ করানো হয়, তাহলে এটা কোনো কঠিন বিষয় নয়।
সওয়াব হাসিল ও সকদায়ে জারিয়ার ফায়েদা হাসিলের আশায় বান্দা এখানে কেবল নমুনাস্বরূপ ঈমান ও যিকিরের কিছু কালিমা ও দুআ এবং আয়াত ও হাদীসের কিছু বাক্য উল্লেখ করব। আল্লাহ তাআলা নিজ ফযল ও করমে কবুল করুন এবং এটিকে সদকায়ে জারিয়া বনিয়ে দিন- আমীন।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)