সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
আমরা কি আল্লাহর শোকরগোযার বান্দা? আমরা কি নবীর ওয়াফাদার উম্মত?
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
সকল আসমানী নেয়ামত আমরা পেয়েছি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অসীলায়।
প্রথম নেয়ামত আল্লাহর মারিফত
মানুষমাত্রই আল্লাহকে পেতে চায়, তাঁর পরিচয় ও সান্নিধ্য লাভ করতে চায়। মানবাত্মার এই ব্যাকুলতা শাশ্বত ও চিরন্তন। তবে এর সফল পরিণতির জন্য অপরিহার্য সঠিক অন্বেষণ। কারণ এ তো অমোঘ সত্য যে, শুধু সঠিক পথের শেষেই থাকে সঠিক গন্তব্য।
আল্লাহর মারিফাত ও রেযামন্দি হাসিলের একটিই মাত্র পথ। আর তা হল, নবুওত ও রিসালাত। নবী ও রাসূলগণের মাধ্যমেই আল্লাহ তাঁর পরিচয় মানব জাতিকে দান করেছেন। তাই শুধু নবী-রাসূলগণের মাধ্যমেই পাওয়া যায় আল্লাহর মারিফাত এবং হাসিল করা যায় তাঁর রেযামন্দি।
আমাদের পরম সৌভাগ্য, আমরা আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত। তাই পৃথিবীর সকল জাতি যাঁকে অন্বেষণ করে তাঁর সন্ধান শুধু আছে আমাদের কাছে।
আমরা কি আল্লাহর শোকরগোযার বান্দা? আমরা কি নবীর ওয়াফাদার উম্মত?
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
দ্বিতীয় নেয়ামত আল্লাহর কালাম।
পৃথিবীর সকল জাতি ঐশী বাণীর দাবিদার। নিজ ধর্মগ্রন্থকে সকলেই বলেন, ঐশী গ্রন্থ। কিন্তু এই দাবির প্রমাণ কী?
আসমানী কালামের একমাত্র সূত্র ওহী। ওহী ছাড়া অন্য কিছু যেমন : কাশফ, ইলহাম, সাধনা ও জপতপ, কোনো কিছুই আসমানী কালামের নির্ভুল সূত্র নয়। তাই নবী ও রাসূলের সূত্র ছাড়া আসমানী কালামের দাবি সম্পূর্ণ অসার। অথচ কাকে বলে নবুওত তা-ই তো জানা নেই অনেক জাতির এবং জানা নেই তার নবীর পরিচয়।
দ্বিতীয় শর্ত নবী ও উম্মতের যোগসূত্র। যারা নবীকে দেখেছেন এবং তাঁর সাহচর্য লাভ করেছেন তাদের সনদের প্রয়োজন নেই। কিন্তু যারা নবুওতের যমানা পায়নি তাদের তো সনদ ছাড়া উপায় নেই। সুতরাং জানতে হবে, কারা নবীর সাহচর্য পেয়েছেন এবং তাঁর নিকট থেকে আসমানী কালাম ধারণ করেছেন। এরপর কাদের নিকট এই আমানত অর্পণ করেছেন। এভাবে সেই যুগ থেকে এই যুগ পর্যন্ত শক্তিশালী ধারাপরম্পরা অপরিহার্য। অন্যথায় আসমানী কালামের দাবি অবাস্তব। আজ কি ঈসায়ীদের কাছে হযরত ঈসা আ. পর্যন্ত এবং ইহুদিদের কাছে হযরত মুসা আ. পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন সূত্র আছে? যদি না থাকে তাহলে কীভাবে দাবি করা যায়, এটাই সেই কালাম যা হযরত মুসা ও হযরত ঈসা আ.-এর উপর নাযিল হয়েছিল? বরং স্বীকৃত সত্য হচ্ছে, যুগে যুগে তাওরাত ও ইঞ্জিলে শুধু পরিবর্তন ও পরিবর্ধনই হয়েছে, হেফাযত ও সংরক্ষণ হয়নি।
আর সর্বশেষ কথা এই যে, আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আগমনের পর আল্লাহ ও বান্দার মাঝে তিনিই একমাত্র সূত্র। কারণ রাসূলগণের মাধ্যমে যে আদর্শ আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে যুগে যুগে দান করেছেন তার চূড়ান্ত ও সর্বশেষ রূপটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দান করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলার ঘোষণা : (তরজমা) ‘আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন মনোনীত করলাম।’ (সূরা মায়িদা : ৩)
এই আয়াতের তাৎপর্য উপলব্ধি করেই জনৈক ইহুদি হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা.কে বলেছিল, আমীরুল মুমিনীন! এই আয়াত যদি আমাদের সম্পর্কে নাযিল হত তাহলে ওই দিনকে আমরা উৎসবের দিবস হিসেবে গ্রহণ করতাম।
আজ স্রষ্টার আনুগত্যের একমাত্র সূত্র হযরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাঁর প্রতি ঈমান আনা ছাড়া নবী-রাসূলের অনুসারী হওয়ার দাবি অসার। কারণ নবীর সম্পর্ক আদর্শের সাথে, সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের সাথে নয়।
কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, (তরজমা) ইবরাহীম ইহুদিও ছিলেন না, খ্রিস্টানও ছিলেন না। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ আত্মসমর্পণকারী। তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না।’ নিশ্চয়ই সকল মানুষের মধ্যে তারাই ইবরাহীমের ঘনিষ্ঠতর, যারা তাঁর অনুসরণ করেছে এবং এই নবী ও যারা ঈমান এনেছে। আর আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক। (সূরা আলেইমরান : ৬৭-৬৮)
বিভিন্ন প্রসঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও এই বাস্তবতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এক হাদীসে ইহুদিদেরকে সম্বোধন করে বলেছেন, ‘আনা আহাককু বিমূসা মিনকুম’। অর্থাৎ তোমাদের চেয়ে আমি মূসা (আ.)-এর নিকটতর।
অন্য হাদীসে ইরশাদ করেছেন-
أنا أولى ا لناس بعيسى بن مريم في الدنيا والآخرت، والأنبياء إخوت لعلات، أمهاتهم شتى ودينهم أنا أولى ا لناس بعيسى بن مريم في الدنيا والآخرة، والأنبياء إخوة لعلات، أمهاتهم شتى ودينهم واحد.
অর্থাৎ আমিই ঈসা ইবনে মারইয়ামের সর্বাধিক নিকটবর্তী দুনিয়া ও আখিরাতে। কারণ সকল নবীর দ্বীন ও আদর্শ অভিন্ন। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩৪৪৩)
আমরা রাববুল আলামীনের কী শোকর আদায় করব যে, তিনি আমাদের জন্য তাঁর কালাম নাযিল করেছেন এবং তার প্রতিটি শব্দ ও বাক্য সংরক্ষণ করেছেন। আজ শুধু মুসলিম জাতিই বলতে পারে, আল্লাহর কালায যদি দেখতে চাও তাহলে এই যে, তা আছে আমাদের কাছে। এস! আল্লাহর কালাম পাঠ কর। তোমার হৃদয় ও মস্তিষ্কের সকল অন্ধকার দূর হোক এবং তোমার সর্বসত্তা ঐশী আলোয় উদ্ভাসিত হোক। মনে রেখ, এ কোনো ‘সম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ’ নয়, এ তোমার স্রষ্টার বাণী, তোমার রবের কালাম।
তৃতীয় নেয়ামত আহকাম ও হেদায়েত, স্রষ্টার নির্দেশ ও নির্দেশনা
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ জীবনের কোনো না কোনো ক্ষেত্রে ঐশী বিধানের দাবিদার। একথা যেমন সত্য যে, পৃথিবীতে ধর্মের অবমাননা ও অস্বীকারকারীর অভাব নেই, তেমনি একথাও সত্য যে, সকল ধর্মের প্রভাবমুক্ত মানুষও পৃথিবীতে নেই।
সকল ধর্মের গোড়ার কথা, সৃষ্টিকর্তার আনুগত্য ও উপাসনা। অথচ আনুগত্যের জন্য চাই বিধান আর উপাসনার জন্য পদ্ধতি। আল্লাহর আহকাম ও বিধানের সূত্র কী?
পূর্বপুরুষের সংস্কার, গোত্রীয় রীতি-নীতি, সামাজিক প্রচলন, গোত্রপতি ও সমাজপতিদের আদেশ-নিষেধ, আহবার-রোহবান বা মুনি-ঋষিদের উদ্ভাবিত নিয়মকানুন-এসব কি আসমানী বিধানের সূত্র? নাউযুবিল্লাহ। অথচ এসবের ভিত্তিতেই তো কত জাতি স্রষ্টার ‘উপাসনায়’ লিপ্ত এবং তাঁর ‘সন্তুষ্টি’ অন্বেষণে মগ্ন! অথচ এসব ছিদ্রপথেই মানব-সমাজে বিস্তার লাভ করেছে নানাবিধ কুসংস্কার এবং মানুষে মানুষে বিভেদ-বৈষম্য। কিছু মানুষ ‘স্রষ্টার আসন’ অধিকার করেছে আর কিছু মানুষ তাদের দাসত্বে নিয়োজিত হয়েছে। এইসব মানবরচিত নিয়মকানুন ঐশী বিধান নয়; বরং মানবজাতিকে এই চরম লাঞ্ছনা থেকে মুক্ত করার জন্যই প্রয়োজন আসমানী আহকাম। এই সত্যই রোস্তমের দরবারে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন আল্লাহর নবীর সাহাবী হযরত রিবয়ী ইবনে আমির রা.। তিনি বলেছিলেন-
الله ابتعثنا لنخرج من نشاء من عبادة العباد إلى عبادة الله، ومن ضيق الدنيا إلى سعتها، ومن جور الأديان إلى عدل الإسلام الله ابتعثنا لنخرج من نشاء من عبادة العباد إلى عبادة الله، ومن ضيق الدنيا إلى سعتها، ومن جور الأديان إلى عدل الإسلام.
অর্থাৎ আমরা এসেছি আল্লাহর আদেশে, মানুষকে মানুষের উপাসনা থেকে মুক্ত করে স্রষ্টার উপাসনায় নিয়োজিত করতে আবিল ও সংকীর্ণ জীবন থেকে মুক্ত করে উদার-স্বাধীন জীবনের সন্ধান দিতে এবং সকল মনগড়া মতবাদের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিয়ে ইসলামের সাম্য ও শান্তির ছায়ায় স্থান দিতে।’ (আলবিদায়া ওয়ান নিহায়া)
আমরা কীভাবে এই নেয়ামতের শোকর আদায় করব যে, কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে রাববুল আলামীনের নির্দেশ ও নির্দেশনা শুধু আছে আমাদেরই কাছে।
আমরা কি আল্লাহর শোকরগোযার বান্দা? আমরা কি নবীর ওয়াফাদার উম্মত?
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
চতুর্থ নেয়ামত আল্লাহর ওয়াদা
হৃদয় ও আত্মার শাশ্বত প্রশ্ন, আমি কোথা থেকে এসেছি এবং কোথায় চলেছি। এই জীবন-সফরে আমার গন্তব্য কী। এর জবাব শুধু আছে তাঁর কাছে যিনি হৃদয় ও আত্মার স্রষ্টা এবং যাঁর আদেশে প্রাণের বিকাশ ও পরিণতি।
‘তারা আপনাকে রূহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। বলুন, রূহ আমার পালনকর্তার আদেশঘটিত। আর তোমাদেরকে সামান্যই জ্ঞান দেওয়া হয়েছে।’ (সূরা বনী ইসরাইল : ৮৫)
তিনিই বপন করেছেন মানব-হৃদয়ে প্রশ্নের বীজ। এরপর নিজেই তার জবাব দিয়েছেন। ঈমানদার বান্দাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন জান্নাতের চিরশান্তির এবং রবের রিযা ও সন্তুষ্টির।
জীবনের শেষে মুমিনকে বলা হবে-‘হে প্রশান্ত চিত্ত! তুমি ফিরে এস পালকর্তার নিকট সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও। আর আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।’ (সূরা ফজর : ২৭-৩০)
এই সকল আসমানী নেয়ামত আমরা পেয়েছি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওসীলায়।
তিনি যেমন আল্লাহর কালাম কুরআন মজীদ পৌঁছে দিয়েছেন তেমনি নিজেও ছিলেন জীবন্ত কুরআন। তাঁর বাণী ও কর্ম কুরআন মজীদের সর্বোত্তম ব্যাখ্যা। তিনি একদিকে ছিলেন আল্লাহর মহববত ও মারিফাত এবং ইবাদত ও ইতাআতের সর্বোত্তম নমুনা, অন্যদিকে ছিলেন বান্দার হক ও অধিকার এবং সৃষ্টির সেবা ও খিদমতের সর্বশ্রেষ্ঠ দায়ী।
তিনি যেমন রেখে গেছেন জীবন যাপনের সর্বোত্তম আদর্শ তেমনি দেখিয়ে গেছেন আখিরাতের প্রস্ত্ততির সর্বোৎকৃষ্ট উপায়। তিনি তাঁর অতুলনীয় শিক্ষক-গুণের দ্বারা এমন এক জামাত তৈরি করেছেন, যাঁরা ছিলেন তাঁর প্রকৃত উত্তরসূরী। নবীর জীবন ও আদর্শকে তাঁরা ধারণ করেছেন, এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস। একদিকে আসমানী ইলম নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত হয়েছে অন্যদিকে জীবনের সকল অঙ্গনে আসমানী আহকাম বাস্তাবায়িত হয়েছে।
কুরআন ও সুন্নাহর সেবার জন্য উদ্ভাবিত হয়েছে অসংখ্য ফন ও শাস্ত্র এবং প্রস্ত্তত হয়েছে অসংখ্য মনীষীর চিন্তা ও গবেষণার অমূল্য ভান্ডার। ধর্মীয় জ্ঞানের এই বিশাল জ্ঞানভান্ডার একমাত্র ইসলামেরই বৈশিষ্ট্য।
খোলাফায়ে রাশেদীনের শাসনামলে ইসলামী খিলাফতের বিপুল বিস্তার, সমাজের সর্বস্তরে ইনসাফ ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা, জনসাধারণের নৈতিক ও বৈষয়িক উন্নতি, অর্থের সুষম বণ্টন এবং জ্ঞান ও গবেষণার উদার পৃষ্ঠপোষকতাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে, অনাগত কাল পর্যন্ত যার কোনো দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইসলামী খিলাফত ছিল সময় ও কালের ওই সোনালী পর্ব, যখন রাজ্যহীন ধর্মের অসহায়ত্ব আর ধর্মহীন রাজ্যের অভিশাপ থেকে মানবজাতি মুক্তি পেয়েছিল।
সত্যিই আমরা কি আল্লাহর শোকরগোযার বান্দা? আমরা কি নবীর ওয়াফাদার উম্মত?
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ষ