ফিলিস্তিন ইস্যু : শায়েখ বিন বায রাহ.-এর তিনটি ফতোয়া
‘ফিলিস্তিনে প্রতিরোধকারী মুজাহিদগণের লড়াই ইসলাম স্বীকৃত জিহাদ’
[এটি সর্বজনবিদিত বিষয় যে, ফিলিস্তিনের মজলুম মুসলমানরা জায়নবাদী দখলদার ইসরাইলের বিরুদ্ধে যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন তা ইসলামের জন্য, বায়তুল মাকদিস ও মজলুম ফিলিস্তিনের জন্য। সুতরাং তা জিহাদ হিসেবেই গণ্য। এ বিষয়ে মুসলিম বিশ্বের বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম একমত। কিন্তু গত ৭ অক্টোবর দখলদার ইসরাইলের ওপর হামাসের সফল হামলার পর এ দেশে একটি গোষ্ঠীর কিছু ভাই এ ঐক্যমত্যপূর্ণ বিষয়কেও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন করে তোলার চেষ্টা করেন, যা বর্তমান নাযুক পরিস্থিতিতে মোটেও কাম্য ছিল না।
এখানে আমরা এমন একজন ব্যক্তিত্বের ফতোয়া তুলে ধরছি, যিনি কিনা ঐ গোষ্ঠীটির কাছেও স্বীকৃত ও মান্য। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা তাঁর উদাহরণ টেনে থাকেন। তিনি হচ্ছেন সৌদি আরবের তৎকালীন মুফতীয়ে আম-শায়েখ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায রাহ. (১৪২০ হি.)। তাঁর তিনটি ফতোয়ার নির্বাচিত অংশ পেশ করা হচ্ছে।
পাঠক স্পষ্ট দেখতে পাবেন, শায়েখ বিন বায রাহ. সেই নব্বইয়ের দশকের শেষেই ফতোয়ায় কতটা আকুতির সাথে বারবার গোটা ইসলামী বিশ্বকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন- ফিলিস্তিনী মুজাহিদগণকে সহায়তা করতে। প্রথম বক্তব্যটি মিশরের ‘আত-তাওহীদ’ পত্রিকায় ১৯৯৩ সালে এবং শেষ দুটি বক্তব্য ‘আল-বুহুছুল ইসলামিয়্যাহ’ পত্রিকায় ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীতে বক্তব্যগুলো শায়েখের ফতোয়া সংকলন ‘মাজমুউল ফাতাওয়া’তে স্থান পেয়েছে। সেখান থেকে আলকাউসারের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন, মাওলানা সালমান।]
প্রথম ফতোয়া
প্রশ্ন : দিনদিন পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে, ফিলিস্তিন ইস্যুর ভবিষ্যত কী?
উত্তর : ফিলিস্তিন ইস্যুর মারাত্মকভাবে ক্রমাবনতি দেখে মুসলিম মাত্রই ব্যথিত হচ্ছেন। পরিস্থিতি জটিলতর হতে হতে এ অবস্থা দাঁড়িয়েছে। এর কারণ হল, পাশ্ববর্তী আরব রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের বিভেদ ও মতানৈক্য কাটিয়ে উঠে নিজেদের শত্রুর বিরুদ্ধে এক হতে পারছে না। তারা সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে ইসলামী বিধান পালনের শর্ত পূরণ করছে না, অথচ আল্লাহ তাআলা বিজয়ের জন্য ঐক্যকে শর্ত ঘোষণা করেছেন এবং এই শর্ত পূরণ হলেই আল্লাহ দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠা ও নিয়ন্ত্রণ দান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আরব দেশগুলো যদি এক হয়ে ফিলিস্তিন ইস্যুতে ইসলামী বিধান পালনে এগিয়ে না আসে, তাহলে এখনকার অবস্থা ভবিষ্যতের করুণ পরিণতির ইঙ্গিত দেয়।
এখানে এই বিষয়টি পরিষ্কার করে দেওয়া দরকার যে, ফিলিস্তিন ইস্যু শুরু থেকে শেষ সম্পূর্ণ ইসলামী ইস্যু। কিন্তু ইসলামের শত্রুরা ভয়াবহ রকমের প্রোপাগান্ডা চালিয়েছে, যেন ইস্যুটি ইসলামের সীমানার বাইরের বিষয় বলে উপস্থাপন করা যায় এবং অনারব মুসলিমদের আশ্বস্ত করা যায় যে, এটি তো আরব ইস্যু, অনারবদের মাথা ঘামানোর কিছু নেই।
মনে হচ্ছে, এতে শত্রুরা একরকম সফল হয়েছে। তাই আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ফিলিস্তিন ইস্যুকে ইসলামী ইস্যু হিসেবে সামনে আনা, মুসলিমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এর সমাধানে সচেষ্ট হওয়া এবং ফিলিস্তিনের মাটি তার প্রকৃত মালিকদের কাছে হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত ইহুদীদের বিরুদ্ধে ইসলামী বিধান অনুসারে জিহাদ জারি রাখা ছাড়া এ ইস্যু সমাধানের কোনো বিকল্প পথ নেই। -মাজমুউ ফাতাওয়া বিন বায ১/২৭৭
দ্বিতীয় ফতোয়া
প্রশ্ন : ফিলিস্তিনে চলমান জিহাদের ব্যাপারে ইসলামী শরীয়তের বক্তব্য কী? এটি কি ‘জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ’, নাকি স্রেফ ভূমি রক্ষা ও স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই? স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই কি ‘জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ’ গণ্য হবে?
উত্তর : নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের সাক্ষ্য মারফত আমাদের কাছে প্রমাণ হয়েছে, ফিলিস্তিনে আন্দোলনকারী মুজাহিদগণ সেখানকার সম্ভ্রান্ত মুসলিম এবং তাদের লড়াই ইসলাম স্বীকৃত জিহাদ। কারণ তারা ইহুদীদের দ্বারা নিপীড়িত, তাদের কর্তব্য হল, নিজেদের দ্বীন, জান, পরিবার ও শিশুদের রক্ষায় প্রতিরোধ গড়ে তোলা, সামর্থ্যরে সবটুকু দিয়ে শত্রুসেনাদের ভূমি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া। নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিরা -যারা কাছ থেকে মুজাহিদগণের সাথে মিশেছেন, তাদের জিহাদে শরীক হয়েছেন- আমাদেরকে ফিলিস্তিনী মুজাহিদদের লালন করা ইসলামী চেতনা ও নিজেদের অঞ্চলে ইসলামী শরীয়াহ বাস্তবায়নের আগ্রহের কথা অবগত করেছেন। তাই মুসলিম রাষ্ট্রসমূহ এবং সকল মুসলিমের দায়িত্ব, তাদেরকে সমর্থন দেওয়া ও সহযোগিতা করা, যেন তারা শত্রুর দখল থেকে মুক্তি পেয়ে আপন বাসভূমিতে ফিরতে পারে। এতে করে আল্লাহর এই বাণীসমূহের ওপর আমল হবে-
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا قَاتِلُوا الَّذِيْنَ يَلُوْنَكُمْ مِّنَ الْكُفَّارِ وَ لْيَجِدُوْا فِيْكُمْ غِلْظَةً وَ اعْلَمُوْۤا اَنَّ اللهَ مَعَ الْمُتَّقِيْنَ.
হে মুমিনগণ! কাফেরদের মধ্যে যারা তোমাদের নিকটবর্তী, তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ কর। তারা যেন তোমাদের মধ্যে কঠোরতা দেখতে পায়। জেনে রাখো, নিশ্চয়ই আল্লাহ মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন। -সূরা তাওবা (০৯) : ১২৩
আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেন-
اِنْفِرُوْا خِفَافًا وَّ ثِقَالًا وَّ جَاهِدُوْا بِاَمْوَالِكُمْ وَ اَنْفُسِكُمْ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ ذٰلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ اِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ.
তোমরা (জিহাদের জন্য) বের হয়ে পড়, হালকা অবস্থায় থাকো বা ভারী অবস্থায় (নিজেদের কাছে যতটুকুই না অস্ত্রশস্ত্র থাকুক) এবং নিজেদের জান-মাল দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ কর। তোমরা যদি বুঝ-সমঝ রাখো, তবে এটাই তোমাদের পক্ষে উত্তম। -সূরা তাওবা (০৯) : ৪১
আল্লাহ আরো বলেন-
(তরজমা) হে মুমিনগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন এক ব্যবসার সন্ধান দেব, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক আযাব থেকে রক্ষা করবে? (তা এই যে,) তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনবে এবং তোমাদের ধন-সম্পদ ও জান-প্রাণ দিয়ে আল্লাহর পথে জিহাদ করবে। এটা তোমাদের জন্য শ্রেয়, যদি তোমরা উপলব্ধি কর। এর ফলে আল্লাহ তোমাদের গোনাহ ক্ষমা করবেন এবং তোমাদের প্রবেশ করাবেন এমন উদ্যানরাজিতে, যার তলদেশে নহর প্রবাহিত থাকবে এবং এমন উৎকৃষ্ট বাসগৃহে, যা স্থায়ী জান্নাতে অবস্থিত। এটাই মহা সাফল্য। এবং তোমাদেরকে দান করবেন আরও একটি জিনিস, যা তোমরা মনে-প্রাণে চাও। (তা হল) আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও আসন্ন বিজয়। আর (হে রাসূল!) মুমিনদেরকে (এর) সুসংবাদ দিন। -সূরা সফ (৬১) : ১০-১৩
বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের জান-মাল ও যবান দিয়ে মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়াই করো।’
যেহেতু ফিলিস্তিনী ভাইয়েরা মজলুম, তাই তাদের মুসলিম ভাইদের কর্তব্য জালিমের বিরুদ্ধে তাদেরকে সাহায্য করা। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
المُسْلِمُ أَخُو المُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يُسْلِمُه.
মুসলিমগণ একে অপরের ভাই, কোনো মুসলিম অপর ভাইয়ের ওপর জুলুম করতে পারে না, তাকে শত্রুর মোকাবিলায় সহায়তা না করে সঙ্গহীন একা ছেড়ে দিতে পারে না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৪২
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন-
তোমার ভাইকে সাহায্য করো; হোক সে জালিম বা মজলুম। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, জালিমকে কীভাবে সাহায্য করব? তিনি বললেন, তাকে জুলুম থেকে ফেরাও, এটিই তাকে সাহায্য করার শামিল। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৪৪
আল্লাহর রাহে জিহাদ করা, মজলুমকে সাহায্য করা, জালিমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা ওয়াজিব হওয়ার বিষয়ে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
হে আল্লাহ! ফিলিস্তিন ও অন্যান্য অঞ্চলে আল্লাহর রাহে জিহাদরত আমাদের ভাইদেরকে শত্রুর মোকাবিলায় নুসরত করুন, হক বিষয়ে তাদেরকে একতাবদ্ধ করুন, সকল মুসলিমকে ফিলিস্তিনী মুজাহিদদের সাহায্য করা এবং তাদের সারিতে দাঁড়ানোর তাওফীক দান করুন, ইসলামের শত্রুরা যেখানেই থাকুক তাদেরকে লাঞ্ছিত করুন, শত্রুদের ওপর নিজ আযাব নাযিল করুন, নিশ্চয়ই আপনি সবকিছু শোনেন, সবার নিকটেই আছেন। -মাজমুউ ফাতাওয়া বিন বায ১৮/৪০৮-৪১৫
তৃতীয় ফতোয়া
হামদ, সালাত ও সালামের পর, আল্লাহ তাআলা স্বীয় অকাট্য কিতাবে ঘোষণা করেছেন-
(তরজমা) ...বস্তুত আল্লাহ মুমিনদের কাছ থেকে তাদের জীবন ও তাদের সম্পদ খরিদ করে নিয়েছেন, তাদের জন্য জান্নাত আছে- এর বিনিময়ে। তারা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করে। অতঃপর তারা হত্যা করে আবার নিহতও হয়। এটা এমন সত্য প্রতিশ্রুতি, যার দায়িত্ব আল্লাহ তাওরাত ও ইনজীলে নিয়েছেন এবং কুরআনেও। আল্লাহ অপেক্ষা বেশি প্রতিশ্রুতি পূর্ণকারী আর কে আছে? সুতরাং তোমরা আল্লাহর সঙ্গে যে সওদা করেছ, সেই সওদার জন্য আনন্দিত হও এবং এটাই মহা সাফল্য। -সূরা তাওবা (০৯) : ১১১
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
مَثَلُ الْمُؤْمِنِينَ فِي تَوَادِّهِمْ، وَتَرَاحُمِهِمْ، وَتَعَاطُفِهِمْ مَثَلُ الْجَسَدِ إِذَا اشْتَكَى مِنْهُ عُضْوٌ تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ الْجَسَدِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى.
পারস্পরিক ভালবাসা-সম্প্রীতি, দয়া-রহম, সহমর্মিতা ও সমব্যথী হওয়ার ক্ষেত্রে মুমিনদের দৃষ্টান্ত এক দেহের মতো, যার কোন একটি অঙ্গ আক্রান্ত হলে বা অসুস্থ হলে পুরো দেহ নিদ্রাহীনতা ও জ¦রে কাতর হয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮৬
তিনি আরো বলেছেন-
الْمُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا.
মুমিনগণ পরস্পরে দেয়ালের মতো, যার এক অংশ অপর অংশকে শক্তি যোগায়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৮৫
তিনি আরো বলেন-
مَنْ جَهَّزَ غَازِيًا فِي سَبِيلِ اللهِ فَقَدْ غَزَا، وَمَنْ خَلَفَ غَازِيًا فِي سَبِيلِ اللهِ بِخَيْرٍ فَقَدْ غَزَا.
যে ব্যক্তি যুদ্ধে গমনকারী কোনো মুজাহিদকে যুদ্ধ-প্রস্তুতিতে সহযোগিতা করবে, সে জিহাদে শামিল, যে ব্যক্তি যুদ্ধে গমনকারী মুজাহিদের রেখে যাওয়া পরিবারের উত্তমরূপে দেখাশোনা করবে, সেও জিহাদে শামিল। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২৮৪৩
ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে মুজাহিদগণ -আল্লাহ তাদের সবাইকে শক্তিশালী করুন- ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে গিয়ে বহুমুখী সংকট মোকাবিলা করছেন। দ্বীনের শত্রুরা তাদেরকে সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করা সত্ত্বেও তারা দাঁত চেপে সহ্য করে যাচ্ছেন। শত্রু নিজ সামর্থ্য ব্যয় করে সবধরনের ধ্বংসযজ্ঞ চালানো সত্ত্বেও -আলহামদু লিল্লাহ- মুজাহিদগণ দৃঢ়তা ও অবিচলতার সাথে আল্লাহর রাহে জিহাদ চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা হীনবল হননি, হীনম্মন্যতার শিকার হননি। কিন্তু মুসলিম ভাইদের সহযোগিতা তাদের এখন অনেক প্রয়োজন। ইহুদীদের নাপাক হাত থেকে ফিলিস্তিনকে উদ্ধারে মুসলমান ভাইদের জান-মালের সহযোগিতা তাদের তীব্র প্রয়োজন।
আল্লাহ তাআলা মুজাহিদগণকে আপন করমে একতাবদ্ধ থাকার এবং দৃঢ় মনোবলে জিহাদ জারি রাখার তাওফীক দিয়েছেন। তাই মুসলিম শাসকবর্গ ও সম্পদশালী শ্রেণির কর্তব্য, ফিলিস্তিনী মুজাহিদগণকে সমর্থন করা এবং শক্তি যোগানো, যাতে তারা জিহাদের বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে আল্লাহর ইচ্ছায় চূড়ান্ত বিজয়ী হতে পারেন।
হে মুসলিমগণ! ফিলিস্তিনে তোমাদের মুজাহিদ ভাইয়েরা উৎখাত, হত্যা, বুলেট-বোমার ক্ষত ও ক্ষুধার বর্ণনাতীত কষ্ট ভোগ করছে। তাদের খাদ্য, পোশাক ও ওষুধ প্রয়োজন, আল্লাহ ও তাদের শত্রুদের মোকাবিলা করতে অস্ত্রও দরকার।
তাই হে মুসলিমগণ! তাদের জন্য অকাতরে দান করো, তাদের প্রতি দিলখোলা হও, আল্লাহ তোমাদের সম্পদে বরকত দেবেন, তোমাদেরকে উত্তম জিনিস দান করবেন, তোমাদের সাওয়াব বাড়িয়ে দেবেন।... -মাজমুউ ফাতাওয়া বিন বায ১৮/৪১৬-৪১৭
হামাস ও টিকে থাকার লড়াই
হামযা খান
হামাস
حركة المقاومة الإسلامية এরই সংক্ষিপ্ত রূপ (حماس) হামাস। সংক্ষেপে হামাসের পরিচয়, দখলদার ইহুদিদের বিরুদ্ধে লড়াই করা একটি ইসলামী সংগঠন।
প্রতিষ্ঠা
১৯৭৩ সালে শায়েখ আহমাদ ইয়াসীন ইখওয়ানুল মুসলিমীনের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে সেবা সংস্থা الجمعية الخيرية الدينية الاجتماعية প্রতিষ্ঠা করেন। সংক্ষেপে যাকে ‘আলমারকাযুল ইসলামিয়্যা’ও বলা হত। তাঁরা মসজিদ, মাদরাসা, হাসপাতাল ইত্যাদি নির্মাণ করতেন। বিভিন্নভাবে মানুষকে সাহায্য করতেন। ১৯৮৪ সালে শায়েখ আহমাদকে অস্ত্র সংগ্রহের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৮৭ সালের দিকে এসে শায়েখ আহমাদ ইয়াসীন হামাস প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ধীরে ধীরে সামরিকীকরণ শুরু করেন। তাদের সামরিক শাখার নাম ‘ইয্যুদ্দীন আলকাস্সাম ব্রিগেড’।
ইন্তিফাদার ডাক ও রাজনীতিতে প্রবেশ
১৯৮৭ সালে ইসরাইলী এক ট্রাকের আঘাতে কয়েক জন ফিলিস্তিনী শ্রমিক শহীদ হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনীদের মাঝে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। যার বিস্ফোরণ ঘটে প্রথম ইন্তিফাদা-গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। হামাসের ডাকে সাঁড়া দিয়ে ফিলিস্তিনী শিশু-কিশোরেরা মৃত্যুর ভয় উপেক্ষা করে গোলাবারুদ ও ট্যাঙ্কের সামনে দাঁড়িয়ে যায়। যা অব্যাহত থাকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত।
২০০০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রোজ বৃহস্পতিবার আইজ্যাক শ্যারন কয়েক হাজার নিরাপত্তারক্ষী নিয়ে মসজিদুল আকসা পরিদর্শনে যায়। এর প্রতিবাদে হামাস দ্বিতীয় ইন্তিফাদার ডাক দেয়, যা ২০০৬ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
২০০৪ সালে হামাস প্রধান আব্দুল আযিয আর রানতীসী বিমান হামলায় শহীদ হলে দায়িত্বে আসেন খালেদ মিশাল। বলা হয়, তার হাতেই হামাসের নতুন উত্থান হয় ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে।
২০০৬ সালের নির্বাচনে খালেদ মিশালের হাত ধরেই হামাস নিরঙ্কুশ জয় লাভ করে। ফলে ফাতাহের সঙ্গে তাদের একটা অস্থিরতা ও বৈরিতা তৈরি হয়। কারণ ৬৭-এর যুদ্ধের পর থেকে ফাতাহ্ই ফিলিস্তিনের একমাত্র রাজনৈতিক দল ছিল। ফলে তারা হামাসের সামনে নিজেদের এই পরাজয় মানতে পারছিল না। কয়েক মাস চলা অস্থিরতার পর উভয়পক্ষের মাঝে একটি চুক্তি হওয়ার সম্ভবনা তৈরি হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর হয়নি।
নির্বাচনে ফাতাহের পরাজয়ের অন্যতম একটি করণ ছিল, ইসরাইলের সাথে করা কথিত বিভিন্ন শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা। যদিও ফিলিস্তিনের পক্ষ থেকে চুক্তির শর্তগুলো মেনে চলা হচ্ছিল। কিন্তু বিনিময়ে শুধু বিশ্বাসঘাতকতা আর চুক্তি লঙ্ঘনের মতো জঘন্য আচরণ ফেরত দিয়েছে ইসরাইল। ইয়াসির আরাফাত তো ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে নোবেল প্রাইজ নিয়ে ঘরে ফিরেছিলেন, কিন্তু ফিলিস্তিনীরা পেয়েছিল বিমান হামলা ও দখলদার বাহিনী কর্তৃক নিত্যনতুন পদ্ধতির হয়রানি।
২০০৭ সালের মার্চের পর থেকে উভয়পক্ষের মধ্যে ইসরাইলের ওপর হামলা করা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দেয়। হামাস ইসরাইলের ওপর হামলা করতে চাইলে ফাতাহ (ইসরাইলের শত অনাচার সত্ত্বেও) শান্তি নীতি থেকে সরে আসতে অস্বীকৃতি জানায়। এরই জের ধরে ২০০৭ সালের জুন মাসে হামাস গাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ফাতাহ নেতা মাহমুদ আব্বাস জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ভ্রাতৃঘাতি যুদ্ধে লিপ্ত হয় হামাসের সাথে। কিন্তু তখনো মাহমুদ আব্বাস দখলদার ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর ছিল। যদিও দখলদারেরা কৌশলে একের পর এক ভূমি দখল করতে থাকে। ভ্রাতৃঘাতি এই যুদ্ধে প্রায় ১০০ জন নিহত হয়েছিল।
২০০৮ সালের গাজা যুদ্ধ
২০০৮ সালে ইসরাইল গাজায় একটি রকেট নিক্ষেপ করে যুদ্ধ শুরু করে। পাল্টা জবাবে হামাসও আক্রমণ শুরু করে। এই যুদ্ধ যদিও ২০০৮ সালে শুরু হয়েছে কিন্তু এর বীজ বপন হয়েছিল ২০০৬ সালে। যখন হামাস ইসরাইলের অভ্যন্তরে একটা সেনা ক্যাম্পে আক্রমণ করে একজন সৈন্যকে হত্যা এবং আরেকজনকে অপহরণ করে। ইসরাইলীরা কল্পনাও করতে পারেনি তাদের নিরাপত্তা বলয়ে ঢুকে হামাস এই কাজ করতে পারে। ফলে ইসরাইল হন্যে হয়ে অপহৃত সেনা উদ্ধারে তৎপরতা শুরু করে। বছরের পর বছর ইসরাইলীরা সৈন্য মুক্ত করাতে গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের সর্বোচ্চটুকু ব্যবহার করেও কোনো কুল কিনারা করতে পারেনি। তখন ফিলিস্তিনের সাধারণ জনগণের ওপর বোমা ফেলে হামাসকে চাপে ফেলতে চেয়েছিল। এমনকি যুদ্ধে ব্যবহার নিষিদ্ধ এমন বোমাও ইসরাইল বর্ষণ করেছিল।
এই যুদ্ধে হামাসের রকেটের পাল্লা ছিল ১৭ কিলোমিটার। যুদ্ধ প্রায় ২৩ দিন অব্যাহত ছিল।
এখানে হামাসের শক্তি দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারা যায় না। কারণ, তারা ইসরাইলের মতো একটা শক্তির বিরুদ্ধে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় একজন সৈন্যকে ৫ বছর আটকে রেখেছে! শেষ পর্যন্ত হামাস এই সৈন্যের বিনিময়ে ইসরাইল থেকে চড়া মূল্য আদায় করেছে। হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনী বন্দিকে মুক্ত করে আনতে সক্ষম হয়। যদিও এ কারণে হামাসকে কয়েকজন বড় পর্যায়ের কমান্ডারকে হারাতে হয়েছিল এবং ২০০৮ সালে ইসরাইলের দেওয়া যুদ্ধের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে যুদ্ধের ময়দানে টিকে থাকতে হয়েছিল।
যুদ্ধ শেষ হয়েছিল ইসরাইলের তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী এহুদ উলমাটের্র একতরফা যুদ্ধ বিরতি ঘোষণার মাধ্যমে। আমরা সাধারণত ইসরাইলী গোয়েন্দা বাহিনী মোসাদের দুর্র্ধর্ষ অভিযানগুলোর সফলতার গল্প শুনে অভ্যস্ত। এটাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মোসাদ খুবই দুর্ধর্ষ একটি গোয়েন্দা বাহিনী। কিন্তু ৫ বছর পর্যন্ত ইসরাইলী একজন সৈন্যকে উদ্ধার করতে না পারার ব্যর্থতা, গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক নিয়ে ইসরাইলীদের গর্বের ওপর পানি ঢেলে দেয়।
২০১২ সালের যুদ্ধ
ইসরাইল ‘কস্সাম ব্রিগেডে’র কমান্ডার আহমদ আলজাবারীকে ড্রোন হামলার মাধ্যমে শহীদ করে। এই ঘটনা ঘটেছিল মিশরের মধ্যস্থতায় গাজা ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তি চুক্তির মেয়াদ চলাকালে।
যুদ্ধ আট দিন অব্যাহত ছিল। এই যুদ্ধে ইসরাইল যুদ্ধ জাহাজ, যুদ্ধ বিমান সবকিছু ব্যবহার করে সাধারণ ফিলিস্তিনীদের হত্যা করে। তখন গাজা সীমান্তে ৫৭ হাজার সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছিল।
এই যুদ্ধে দেখা যায়, হামাস তাদের রকেটের পাল্লা ১৭ কিলোমিটার থেকে ৮০ কিলোমিটারে উন্নীত করে। যুদ্ধ শেষ হয় আট দিনের মাথায় মিশরের মধ্যস্থতায়।
২০১৪ সালের যুদ্ধ
দুই বছর না যেতেই ইসরাইল আবার ফিলিস্তিনে হামলা করে। ইসরাইলী সামরিক বাহিনী মধ্যরাতে গাজা ভূখণ্ডে আক্রমণ করে। ইসরাইলী সরকার দাবি করে, গাজা থেকে আসা রকেট হামলার পাল্টা জবাব হিসেবে অক্রমণ করা হয়েছে।
এই ঘটনার সূত্রপাত ঘটে তিনজন ইসরাইলী কিশোর হত্যাকে কেন্দ্র করে, যার জন্য ইসরাইলী সরকার হামাসকে দায়ী করে। কিন্তু হামাস এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে। যদিও এই ঘটনার জন্য কয়েক শ’র বেশি ফিলিস্তিনীকে পশ্চিম তীরে আটক করা হয়। এই ঘটনার জের ধরে কয়েকজন কট্টর ইহুদী আবু খাদির নামের এক ১৬ বছর বয়সী কিশোরকে নির্যাতন করে এবং পুড়িয়ে হত্যা করে।
হামাসের মিসাইল তৈরি ও আরব দেশগুলোর ইসরাইলের সাথে বন্ধুত্ব
২০১৪ সালের যুদ্ধে ইসরাইল হামাসকে পঙ্গু করে দেওয়ার জন্য সবকিছুই করেছিল। গাজার একাংশকে একদম গুড়িয়েই দিয়েছিল। কিন্ত আল্লাহ তো অনেক আগেই বলে দিয়েছেন-
اِنَّ کَیْدَ الشَّیْطٰنِ کَانَ ضَعِیْفًا.
[নিশ্চয়, শয়তানের কৌশল অতি দুর্বল।]
যেখানে আল্লাহ আছেন সেখানে কারও তো কিছু করার ক্ষমতা নেই। ৫১ দিনের যুদ্ধে গাজা উপত্যকা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। হামাস সেই ধ্বংসস্তুপ থেকে ইসরাইলী বিমানের নিক্ষিপ্ত অবিস্ফোরিত বোমাগুলো উদ্ধার করে। এই বিষয়গুলো কতটা জটিল এখানে বসে বোঝা সম্ভব নয়। তাও গাজার মতো একটি অবরুদ্ধ উপত্যকায়। হামাসের কাস্সাম ব্রিগেডের বিশেষ একটি ইউনিট অবিস্ফোরিত বোমাগুলো থেকে খুবই উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক উদ্ধার করে। এগুলো ব্যবহার উপযোগী করতে হলে প্রয়োজন ছিল প্রচুর পরিমাণ স্টীল। এই অবরুদ্ধ অবস্থায় যা আমদানী বা উৎপাদন সম্ভব নয়। সুতরাং অন্য রাস্তা বের করতে হবে। আসলে যেখানে আল্লাহর সাহায্য থাকে সেখানে আর কিছু লাগে না। বিষয়টা বোঝার জন্য একটু অতীতে যাই। ২০০৫ সালে ইসরাইল ফিলিস্তিনের পশ্চিম দিকে মাটির নিচ দিয়ে স্টীলের পাইপ লাইন স্থাপন করে। যা পূর্ব দিক দিয়ে ইসরাইলের ভেতরে ঢোকে। এই পাইপ লাইন বিছানো হয়েছিল ফিলিস্তিন থেকে পানি চুরির জন্য। জনবসতি থেকে অনেক দূরে হওয়ার কারণে এই পাইপ লাইন কখনোই কারো চোখে পড়েনি। হামাস এই পাইপগুলো মাটির নিচ থেকে উদ্ধার করে মিসাইলের বডি হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী করে তোলে। ইসরাইল হয়তো কল্পনাও করতে পারেনি, নিজেদের খোঁড়া গর্তে এভাবে পড়বে।১
এই কাজটা এত বিস্ময়কর, তা একমাত্র সমরবিদরাই যথার্থ উপলব্ধি করতে পারবেন। আল্লাহ তো কাফেরদের ব্যাপারে ঘোষণা দিয়েই রেখেছেন-
وَمَکَرُوْا وَمَکَرَ اللهُ وَاللهُ خَیْرُ الْمٰکِرِیْنَ.
(আর কাফিরগণ ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নিল এবং আল্লাহ্ও গুপ্ত কৌশল করলেন। বস্তুত আল্লাহ সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কৌশলী।)
লক্ষণীয় ব্যাপার হল, ইসরাইল যখনই হামাসকে দমন করার জন্য খুব কঠিন পদক্ষেপ নিয়েছে উল্টো হামাস আরো শক্তিশালী হয়েছে। আরো ভালো করে বললে, আল্লাহ তাদেরকে শক্তিশালী হওয়ার অলৌকিক রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছেন। আগে তাদেরকে বিভিন্ন দেশ থেকে সামরিক সরঞ্জাম আমদানি করে চলতে হত, কিন্তু এখন তারা মাঝারি পাল্লার মিসাইলও নিজেরা তৈরি করে নিতে পারে। তারা যা করেছে, যেভাবে করেছে তা দেখে চরম শত্রু ইসরাইলের উপদেষ্টারা পর্যন্ত অবাক হয়েছেন।
২০১৯ সালের মিসাইল হামলার পর ইসরাইল হামাসকে খতম করতে নতুন করে ফন্দি আঁটতে থাকে। তারা ট্রাম্পকে ব্যবহার করে আরবদেশগুলোকে বোঝায়, প্রতিবেশী হিসাবে তোমরা ইসরাইলকে বন্ধু বানাতেই পারো। তোমাদেরকে বুঝতে হবে, মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যা ইসরাইল নয়, ইরান। সুতরাং তোমাদের এখনই ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার।
প্রায় সবাই ট্রাম্পের কথায় সায় দিল। এর মধ্যে আরব আমিরাত তো সবকিছু ইসরাইলের জন্য বিলিয়ে দিল। বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য ইসরাইল থেকে প্রশিক্ষক নিয়ে এল। জাপানে ইসরাইল-আরব আমিরাতের সম্মিলিত মহড়া দিল। আরব আমিরাত তেলআবিবে দূতাবাস উদ্বোধন করে। আরো কত কী!
যারা এ ডাকে সাড়া দেয়নি তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল সুদান। পরিণামে কিছুদিনের মধ্যেই ওমর আলবশীর সরকারের পতন হয়। ক্ষমতায় আসে সেনাপ্রধান বুরহান২। কেউ কিছু বলল না। আর বলবেও না। গণতন্ত্রের ঠিকাদার আমেরিকাও না!
বিশ্লেষকদের মতে, ২০২০ সালে মিশরে উদ্বোধন করা ‘বারনিস’ মিলিটারি ঘাঁটি মূলত বানানো হয় গাজা থেকে সব ধরনের সমরিক সাহায্য বিচ্ছিন্ন করতে। উদ্বোধনের দিন প্রধান অতিথি ছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট মুহাম্মাদ বিন যায়েদ। বিশেষজ্ঞদের মতে ভূমধ্যসাগরে সামরিক ঘাঁটি হবে ইসরাইলের সম্মতি ছাড়া- এটা অসম্ভব। নিশ্চয় এখানে ইসরাইলের সাথে মিশরের কোনো গোপন চুক্তি আছে। আজকের দিনে ইসরাইল কীভাবে আরব দেশগুলোকে কাবু করে রেখেছে- এটা শুধু তার একটা নমুনা মাত্র।
ইসরাইল সেই ২০০৮ সাল থেকে বিভিন্ন দেশকে ব্যবহার করে গাজাকে অবরুদ্ধ করে। বিপরীতে গাজা উল্টো আরো শক্তিশালী হচ্ছিল। আগে তারা অস্ত্র আমদানির ওপর নির্ভরশীল ছিল, এখন তারা নিজেরাই সে অস্ত্র তৈরি করতে পারছে। সবচেয়ে বড় কথা, আগে হামাস ইসরাইলে যতটুকু আঘাত হানতে পারত এখন সে তুলনায় ১০০ গুণ বেশি আঘাত হানতে সক্ষম। এই সক্ষমতা হামাস অর্জন করেছে এমন একটা সময়, যখন হামাসের বন্ধুরাও শত্রুর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে শেষ করে দেওয়ার জন্য।
এদিকে হামাসের ‘কাসসাম ব্রিগেড’ সাগরের নিচে দুটি ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজের সন্ধান পায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জাহাজদুটি ডুবে গিয়েছিল প্রচুর গোলাবারুদ নিয়ে। এতে গোলাবারুদ ছিল প্রচুর, কিন্তু সত্য কথা হল, ১০০ বছর আগে ডুবে যাওয়া একটা জাহাজ থেকে সীমিত লজিস্টিক সাপোর্ট নিয়ে টনকে টন বোমা উদ্ধার করা ছিল চ্যালেঞ্জিং ও বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এই অপারেশন এতটাই জটিল ও কষ্টসাধ্য ছিল যে, ব্রিটিশরা এগুলো উদ্ধার করার চেয়ে নতুন অস্ত্র ক্রয় করাকেই প্রাধান্য দিল। গোলাবারুদের বড় অংশই ছিল একটি সুরক্ষিত রুমে। ব্রিটিশরা ভেবেছিল, এই দরজা খুলে গোলাবারুদ ব্যবহার করা প্রায় অসম্ভব। আলজাজিরাতে এ বিষয়ে সাক্ষাৎকার দিতে যে ব্রিটিশ অফিসার এসেছিলেন তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কেউ এই জাহাজগুলোতে পৌঁছতে পারলে কী পরিমাণ গোলাবারুদ উদ্ধার করা সম্ভব?
তিনি বলেছিলেন, কয়েকটি মেশিনগান আর হালকা কিছু গোলাবারুদের জন্য এত কষ্ট করার চেয়ে নতুন ক্রয় করাই ভালো।
মানে তারা এটা কল্পনাও করতে পারেনি, ওই সুরক্ষিত রুমে ঢোকা সম্ভব। কিন্তু আল্লাহর সাহায্য বলে কথা। (এ বিষয়টি নিয়ে আলজাজিরা দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করে)
ইসরাইল ভেবেছিল, তারা গাজাকে একদম অবরুদ্ধ করে ফেলেছে সুতরাং গাজায় কোনো দিক দিয়ে কোনোভাবেই সামরিক সাহায্য পৌঁছা সম্ভব নয়। তাই এখন হামাস অনেক দুর্বল। এখন তাদেরকে হামলা করলে খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না। নেতানিয়াহুর আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল নিজের ক্ষমতা ধরে রাখা। তাই তারা আবারো ফিলিস্তিনীদের সাথে ছোট ছোট উৎপাতের মাধ্যমে বড় ধরনের ঝামেলা পাকানোর চিন্তা-ভাবনা শুরু করে।
পূর্ব জেরুসালেমের আরব অধ্যুষিত এলাকা শায়েখ জাররায় মোট ২৮টি পরিবার বাস করে। ২০২১ সালে এর মধ্য থেকে চারটি ফিলিস্তিনী পরিবারকে বাড়ি ছাড়া করতে ইসরাইলী সুপ্রিম কোর্টের বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তারপর পুলিশ আলআকসা মসজিদ চত্বরে ঢুকে মুসল্লিদেরকে বেধড়ক লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস এবং রাবার বুলেটের মাধ্যমে প্রায় পাঁচ শ ফিলিস্তিনীকে আহত করে। এত নির্যাতন ও অন্যায় সিদ্ধান্তের পরও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ ‘ফাতাহ’ লিপ সার্ভিস দেওয়া ছাড়া কিছুই করছিল না। তখন ১০ মে হামাস আলআকসা মসজিদ এলাকা ও শায়েখ জাররাহ উভয় স্থান থেকে সকল পুলিশ ও সামরিক কর্মকর্তাদের সরিয়ে নিতে ইসরাইলেকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়। ঘোষণা দেয়, যদি ইসরাইলে তা না করে তাহলে গাজা ভূখণ্ডের সম্মিলিত সামরিক বাহিনী ইসরাইলের ওপর আক্রমণ করবে। জানা কথা, ইসরাইল হামাসের কথার কোনো গুরুত্ব দেয়নি। ফলে ১১ মে হামাস ও ফিলিস্তিনী ইসলামী জিহাদ ‘আশদোদ’ ও ‘আসকালানে’ শতাধিক রকেট নিক্ষেপ করে। এতে দুজন নিহত হয়। ৯০ জনেরও বেশি আহত হয়।
এই সংঘাত চলাকালে দক্ষিণ ও মধ্য ইসরাইলে প্রতিদিন গড়ে ৪০০টি করে মোট ৪,৩৬০টিরও বেশি রকেট ও মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হয়। প্রায় ৩,৪০০ রকেট সফলভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে এবং ৬৮০টি গাজায় ও ২৮০টি সমুদ্রে পতিত হয়। আয়রন ডোম ১,৪২৮টি রকেট ধ্বংস করে, যেগুলো জনবহুল এলাকার দিকে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। আয়রন ডোম প্রায় অনেক রকেট আটকাতে ব্যর্থ হওয়ায় এগুলো জনবহুল এলাকায় আঘাত হানে।
এছাড়াও আইডিএফ হামাসের ছোট মনুষ্যবিহীন ডুবোজাহাজের বহর ডুবিয়ে দেয়, যেটি ইসরাইলী নৌ-জাহাজ বা তেল ও গ্যাস ড্রিলিং রিগের নিচে বা কাছাকাছি বিস্ফোরিত হওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। হামাস বারবার ইসরাইলের গ্যাসক্ষেত্রে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। ইসরাইলী নৌবাহিনীর একটি জাহাজ, হামাস কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত একটি ডুবোজাহাজ ধ্বংস করে, যখন এটি তীরের কাছাকাছি ছিল।
মিশরের মধ্যস্থতায় সংঘাত অবসানে রাজি হয় হামাস ও ইসরাইল।
২০২৩ সালের যুদ্ধ
৭ অক্টোবরের হামলার জন্যও পশ্চিম তীরে ইহুদী সেটেলারদের অত্যাচার-অনাচারই দায়ী। গাজা সীমানায় দেয়াল, সার্ভিলেন্স ক্যামেরা, অত্যাধুনিক সেন্সর ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে ইসরাইল সৈন্যদের বিরাট অংশকে পশ্চিম তীরে সরিয়ে নেয়।
হামাস এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়ে ইসরাইলে হামলা করে। প্রথমে প্রচুর পরিমাণে রকেট নিক্ষেপ করা হয়। তারপর ড্রোনের মাধ্যমে সীমান্তবর্তী নজরদারি টাওয়ার, সেন্সর ও ক্যামেরাগুলো নষ্ট করে দেয়। যার ফলে সেগুলো হেডকোয়ার্টারে কোনো তথ্য পাঠাতে পারেনি। এ সুযোগে প্যারাগ্লাইডিং এর মাধ্যমে তারা দেয়ালের ভেতরে ঢুকে সামরিক স্থাপনায় হামলা করে। একপর্যায়ে হামাস সদস্যরা দেয়াল ভেঙে ফেলে। একইসাথে তারা সমুদ্রপথেও হামলা করে। পরিকল্পিতভাবে একে একে সামরিক স্থাপনায় হামলা এবং ইসরাইলী নাগরিদের অপহরণ করতে শুরু করে। ইহুদীদের মনে আতঙ্ক ধরিয়ে দেয়ার জন্য হামলার ভিডিও খুবই গুরুত্বসহ মিডিয়ায় প্রচার করা হয়। হামাসের দাবি তারা এখনো সব অস্ত্র ব্যবহার করেনি। ভিডিওর মাধ্যমে তাদের কাছে থাকা কিছু নতুন প্রযুক্তি প্রদর্শন করেছে।
হামাস হামলার জন্য যে সময় নির্ধারণ করেছে, যেভাবে হামলা করেছে বড় বড় জেনারেলরাও প্রশংসা করতে বাধ্য হচ্ছে। তারা বলছে, হামলার পরিকল্পনাটি সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে হামাসের উচ্চপর্যায়ের সামরিক দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছে।
এখানে হামাসের সামরিক শাখা আলকাস্সামের প্রধান মুহাম্মাদ দাঈফের কথা না বললেই নয়। করণ এই মাস্টার প্লান তাঁরই তৈরি। গত ২৫ বছর ধরে ইসরাইল তাঁকে হত্যার চেষ্টা করছে। প্রথমবার ২০০১ সালে। দ্বিতীয় বার ২০০২ সালে। তৃতীয়বার ২০০৩ সালে। চতুর্থবার ২০০৬ সালে। প্রত্যেকবারই মারাত্মক আহত হন, কিন্তু অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। শেষ ২০১৪ সালে যখন হামলা করা হয় তখন তাঁর স্ত্রী ও সন্তান মারা যায় এবং তাঁর পা গুরুতর আহত হয়। আইডিএফ শুরু থেকে এই হামলার জন্য তাঁকেই দায়ী করছে।
টীকা :
১। https://youtu.be/9lkarL5uWeI
২। নেতানিয়াহু তার সাথে দেখা করে এসে নিজের টালমাটাল ক্ষমতা টেকানোর জন্য বিভিন্ন কনফারেন্সে গিয়ে আরবদের সাথে ইসরাইলের বন্ধুত্বের গল্প শুনিয়ে জনগণকে আশ্বস্ত করে যে, আমি আমাদের শত্রুদেরকে বন্ধু বানিয়ে নিয়েছি এবং ইসরাইলকে শত্রুমুক্ত করেছি; সুতরাং ইসরাইলের স্বার্থে তোমাদের উচিত আমাকে ভোট দেওয়া।