রবিউল আউয়াল ১৪৪৫   ||   অক্টোবর ২০২৩

আল্লাহ নিজের ওপর রহমতকে অবধারিত করে নিয়েছেন

মাওলানা ফজলুদ্দীন মিকদাদ

আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে ইরশাদ করেনÑ

وَ اِذَا جَآءَكَ الَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِاٰيٰتِنَا فَقُلْ سَلٰمٌ عَلَيْكُمْ كَتَبَ رَبُّكُمْ عَلٰي نَفْسِهِ الرَّحْمَةَ اَنَّهٗ مَنْ عَمِلَ مِنْكُمْ سُوْٓءًۢا بِجَهَالَةٍ ثُمَّ تَابَ مِنْۢ بَعْدِهٖ وَ اَصْلَحَ فَاَنَّهٗ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ.

যারা আমার আয়াতসমূহে ঈমান রাখে, তারা যখন তোমার কাছে আসে, (তখন তাদেরকে) বল, তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। তোমাদের প্রতিপালক নিজের ওপর রহমতকে অবধারিত করে নিয়েছেন; তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অজ্ঞতাবশত কোনো মন্দ কাজ করে, তারপর তাওবা করে এবং নিজেকে সংশোধন করে, তবে আল্লাহ তো অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। Ñসূরা আনআম (৬) : ৫৪

এ আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘তোমাদের প্রতিপালক রহমতকে নিজের ওপর অবধারিত করে নিয়েছেন।আল্লাহ তাআলা তাঁর সৃষ্টিজীবের সাথে সকল ক্ষেত্রে দয়া ও অনুগ্রহের আচরণ করেন। ইহজগতে এবং পরকালে সর্বাবস্থায় বান্দা আল্লাহ তাআলার সব ধরনের দয়া ও অনুগ্রহের মুখাপেক্ষী। আল্লাহ তাআলার দয়া ও অনুগ্রহ যদি বান্দার সাথে না থাকে তাহলে তার ইহকালও দুর্বিষহ হবে, আর আখেরাতে সে পুরোপুরি বরবাদ হয়ে যাবে। বান্দা আল্লাহ তাআলার মর্জিমতো না চললেও আল্লাহ তাআলা সর্বাবস্থায় বান্দার প্রতি রহমত বর্ষণ করতে থাকেন, সব ধরনের নিআমত দান করতে থাকেন।

আল্লাহ তাআলা জুলুম তো করেনই না; উপরন্তু দুনিয়া ও আখেরাতে যদি বান্দার সাথে রহমতের আচরণ না করে ইনসাফের আচরণ করেন, তাহলেও বান্দার আর দুর্দশার শেষ থাকবে না। এজন্য আল্লাহ তাআলা নিজের জন্য আবশ্যক করে নিয়েছেনÑ তিনি বান্দার সাথে রহমতেরই আচরণ করবেন।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেনÑ

وَ لَوْ لَا فَضْلُ اللهِ عَلَيْكُمْ وَ رَحْمَتُهٗ فِي الدُّنْيَا وَ الْاٰخِرَةِ لَمَسَّكُمْ فِيْ مَاۤ اَفَضْتُمْ فِيْهِ عَذَابٌ عَظِيْمٌ.

দুনিয়া ও আখেরাতে তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া না হলে তোমরা যে বিষয়ে জড়িয়ে পড়েছিলে তজ্জন্য তোমাদেরকে স্পর্শ করত কঠিন শাস্তি। Ñসূরা নূর (২৪) : ১৪

আল্লাহ তাআলার এ অনুগ্রহ সকল সৃষ্টিজীবের ওপরেই ব্যাপ্ত। ইহজগতের কেউই আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত নয়মুসলিমের প্রতি যেমন তাঁর অনুগ্রহ রয়েছে, কাফেরের ওপরেও তাঁর অনুগ্রহ রয়েছে। যারা তাঁর বাধ্য ও অনুগত তাদের প্রতিও তিনি রহমত বর্ষণ করেন, যারা তাঁর অবাধ্যতায় লিপ্ত, তাদেরকেও তিনি নিজ রহমত থেকে বঞ্চিত করেন না। তাঁর এ সর্বব্যাপী রহমত মুমিন ও কাফের এবং পাপিষ্ঠ ও পুণ্যবান সকলেই ভোগ করে। সকলকেই তিনি রিযিক, সুস্থতা, নিরাপত্তাসহ অসংখ্য নিআমত দান করেন।

আল্লাহ তাআলা বলেনÑ

قَالَ عَذَابِيْۤ اُصِيْبُ بِهٖ مَنْ اَشَآءُ  وَ رَحْمَتِيْ وَ سِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ.

আল্লাহ বললেন, আমি আমার শাস্তি যাকে ইচ্ছা করি দিয়ে থাকি আর আমার দয়াÑ সে তো প্রত্যেক বস্তুতে ব্যাপ্ত। Ñসূরা আরাফ (৭) : ১৫৬

কেউ আল্লাহ তাআলার অপছন্দনীয় কোনো কাজ করে ফেললেই আল্লাহ তাকে শাস্তি দেন না। এটা বান্দার প্রতি আল্লাহ তাআলার অনেক বড় দয়া ও অনুগ্রহ। এরচেও বড় অনুগ্রহের প্রকাশ ঘটবে আখেরাতে। তিনি সেদিন তাঁর মাগফিরাত ও রহমতের সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটাবেন। তাঁর প্রতি বিশ্বাসী মুমিনদের ব্যাপকভাবে ক্ষমা করবেন। কতভাবে যে তিনি কত বান্দাকে ক্ষমা করে দেবেন!

এজন্যই আল্লাহ তাআলার অন্যতম প্রধান গুণবাচক নাম, আররহমান (দয়াবান) এবং আররহীম (পরম দয়ালু)। কুরআন কারীমের অনেক জায়গায় বিভিন্নভাবে আল্লাহ তাআলার সর্বময় রহম ও রহমতের কথা এসেছে। আল্লাহ তাআলা কতভাবে বান্দার ওপরে দয়া ও অনুগ্রহ করেছেনÑ তা শতাধিক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ

لَمَّا قَضَى اللهُ الْخَلْقَ، كَتَبَ فِي كِتَابِهِ، فَهُوَ عِنْدَهُ فَوْقَ الْعَرْشِ: إِنَّ رَحْمَتِي سَبَقَتْ غَضَبِي.

আল্লাহ যখন সবকিছু সৃষ্টি করেন, তখন তিনি একটি কিতাবে লেখেন, ‘আমার অনুগ্রহ আমার ক্রোধের ওপরেসেই কিতাবটি আরশে তাঁর কাছে রয়েছে। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৩১৯৪, ৭৪০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭৫১

তিনি আরো ইরশাদ করেছেনÑ

إِنَّ اللهَ خَلَقَ الرَّحْمَةَ يَوْمَ خَلَقَهَا مِائَةَ رَحْمَةٍ، فَأَمْسَكَ عِنْدَهُ تِسْعًا وَتِسْعِينَ رَحْمَةً، وَأَرْسَلَ فِي خَلْقِهِ كُلِّهِمْ رَحْمَةً وَاحِدَةً.

আল্লাহ এক শ ভাগ রহমত সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে নিরানব্বই ভাগ নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। আর এক ভাগ দয়া তাঁর সকল সৃষ্টির মাঝে ভাগ করে দিয়েছেন। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪৬৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭৫২, ২৭৫২

পৃথিবীর শুরু থেকে কিয়ামত পর্যন্ত সকল সৃষ্টিজীব সকল ক্ষেত্রে যত দয়া ও অনুগ্রহের পরিচয় দিয়েছে এবং দেবে, এসবকিছুই সে এক ভাগের অন্তর্ভুক্ত। বাকি নিরানব্বই ভাগ আল্লাহ তাআলার কাছে রয়েছে। আল্লাহ তাআলার মহান সত্তা সে নিরানব্বই ভাগ দয়া ও অনুগ্রহের ধারক এবং এর প্রকাশ তিনি সকল ক্ষেত্রে ঘটিয়ে থাকেন।

একবার এক গ্রাম্য লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এল। নামাযের সময় সে দুআ করতে লাগল, ‘হে আল্লাহ, আমার ও মুহাম্মাদের ওপরে অনুগ্রহ করেন। আর কারো ওপরে অনুগ্রহ করবেন না।

এ দুআ শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘তুমি তো একটা বিস্তৃত বিষয়কে (অর্থাৎ আল্লাহর অপার অনুগ্রহকে) সংকুচিত করে ফেললে।Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৬০১০

আল্লাহ তাআলা চান, তাঁর সকল সৃষ্টির স্বভাবেও এ দয়া ও অনুগ্রহের গুণ ছড়িয়ে পড়ুক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেনÑ

الرَّاحِمُونَ يَرْحَمُهُمُ الرَّحْمنُ، ارْحَمُوا مَنْ فِي الأَرْضِ يَرْحَمْكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ.

অনুগ্রহকারীদের ওপরে আল্লাহ্ও অনুগ্রহ করেন। তোমরা জগদ্বাসীর প্রতি অনুগ্রহ কর, তাহলে যিনি আসমানে আছেন (আল্লাহ) তিনিও তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করবেন। Ñজামে তিরমিযী, হাদীস ১৯২৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৯৪১

আরো ইরশাদ করেনÑ

لاَ يَرْحَمُ اللهُ مَنْ لاَ يَرْحَمُ النَّاسَ.

মানুষের ওপর যে দয়া করে না, আল্লাহ্ও তার ওপর দয়া করেন না। Ñসহীহ বুখারী, হাদীস ৭৩৭৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩১৯

কোনো বান্দা যখন অপর বান্দার প্রতি দয়া করে, আল্লাহ তাআলা খুশি হন। প্রত্যেক বান্দার জন্য জরুরি, দয়া ও অনুগ্রহের এ বৈশিষ্ট্য নিজের মধ্যে ধারণ করা, এতে আল্লাহ বান্দার প্রতি আরো বেশি রহমত বর্ষণ করবেন। 

 

 

 

advertisement