সফর ১৪৪৫   ||   সেপ্টেম্বর ২০২৩

অসহিষ্ণুতা : প্রয়োজন ইনসাফ, মানবিকতা ও দ্বীন

মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ

ব্যক্তির সততা-শুদ্ধি এবং সমাজের সুস্থতা ও নিরাপত্তা- দ্বীনের তাকাযা। ইসলামের নেযাম ও পরিচর্যানীতির দাবি হচ্ছে, মানুষ নেককার হবে এবং সমাজ নেকির সঙ্গে নিরাপদ ও শান্তিময় থাকবে। বিপথগামিতা ও অনিরাপত্তামূলক পরিস্থিতি কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়; এমনকি সহনীয়ও নয়। কিন্তু দ্বীনের অনুশীলন থেকে বিচ্যুতি ও দূরত্ব অনেক সময় মুসলমানদের যে কোনো সমাজকে ব্যাপক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিতে পারে। এর অবধারিত একটি ফল এটাও হয় যে, সমাজে পারস্পরিক শান্তিময়তা ও নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। কখনো কখনো বিদ্বেষ, বিরোধ ও অসহিষ্ণুতা সমাজে চেপে বসে ব্যাপকভাবে।

এ-জাতীয় অসহিষ্ণুতার পরিস্থিতিতে দায়ী এবং শিকারের ভিন্নতা তো থাকেই, কিন্তু জটিলতা ও বিরোধের ব্যাপকতায় সংকটের মাত্রাটি বড় হয়ে ওঠে। জেদ, প্রতিবাদ, ক্ষোভ ও ক্ষমতার নানামাত্রিক প্রয়োগ গোটা সমাজকেই আচ্ছন্ন করে ফেলে। কখনো গোষ্ঠী ও স্বার্থকেন্দ্রিক সংঘাত, কখনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিরোধে ও সংকটে জুলুম ও অমানবিকতার মেঘ প্রলম্বিত হতে থাকে। পাশাপাশি তৈরি হয় কিংবা তৈরি করা হয় দ্বীনী কদর ও মূল্যবোধেরও অবনমন। দ্বীনের সাধারণ অনুশীলন থেকে, ইবাদত-আমল থেকে মানুষের দূরত্ব বাড়ার মতো পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। যেকোনো মুসলিম-প্রধান সমাজের জন্য এমন অসহিষ্ণু ও বিরোধপূর্ণ পরিস্থিতি মারাত্মক ক্ষতিকর। জুলুম, অমানবিকতা, বিরোধ এবং দ্বীন থেকে বিচ্যুতির কারণে সৃষ্ট সামাজিক ফাটল ও ছিদ্র ধরে ঘটে ভিন্ন সমাজ ও কর্তৃত্বের অনুপ্রবেশ। অথচ এসবের কোনোটাই অকল্যাণ ও বিপর্যয় থেকে মুক্ত নয়।

এজন্যই সমাজে বিরোধ ও অসহিষ্ণুতার উদ্ভব হলে জুলুমের মাত্রা যেন ব্যাপক হয়ে উঠতে না পারে- সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা এবং ইনসাফের চর্চা জারি রাখা সব পর্যায়ের মানুষের কর্তব্য। বিরোধ-হানাহানির সময় ক্ষমতা, জেদ ও ক্ষোভ একশ্রেণির মানুষকে বিপথে পরিচালিত করে। নিজের সুবিধা ও অপরপক্ষের প্রতিকূলতা সৃষ্টির জন্য তারা বাছবিচারহীনভাবে বিরোধ, বাড়াবাড়ি ও দূরত্বের বাজার গরম করে তোলে। এতে এক জায়গা থেকে বিরোধের নির্বিশেষ স্ফুলিঙ্গ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে সমাজের ছোট ছোট অংশেও ক্ষত তৈরি হয়, জুলুমের চিহ্ন নেমে আসে। মুসলিম হিসেবে এমন জুলুম ও বেদনা উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। মজলুমের ক্ষতি নগদ ও দৃশ্যমান, জালিমের ক্ষতি ভয়ংকর ও অবধারিত। এমন পরিস্থিতিতে ইনসাফ বজায় রাখা তাই সবার জন্য নিরাপদ। সামাজিক ও ধর্মীয় উভয় বিবেচনাতেই ইনসাফ একটি সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার অন্যতম প্রধান অবলম্বন।

ভালো আচরণ তো ভালো, কিন্তু আমি যার সঙ্গে বিরোধপূর্ণ কিংবা রুঢ় আচরণ করতে যাচ্ছি, তিনি সেটার প্রাপক কি না, আমার ভুল আচরণটি ভুল মানুষের সঙ্গে হচ্ছে কি না- এটুকু বিবেচনায় রাখলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে সামাজিক ইনসাফের নিচের স্তরের খুঁটিটি শক্ত থাকে। অসহিষ্ণুতার বাতাস- রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক যে কারণেই হোক, প্রবল হয়ে উঠলে ব্যক্তিগত ও সামাজিক ইনসাফের চর্চা জারি রাখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যার যার জায়গায় ইনসাফের জিজ্ঞাসা ও অনুশীলন সজাগ থাকলে অনেক বেদনাদায়ক জুলুম থেকে, অনেক অবক্ষয় ও কান্না থেকে সমাজ রক্ষা পেতে পারে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْا كُوْنُوْا قَوّٰمِيْنَ لِلهِ شُهَدَآءَ بِالْقِسْطِ وَلَا يَجْرِمَنَّكُمْ شَنَاٰنُ قَوْمٍ عَلٰۤي اَلَّا تَعْدِلُوْا اِعْدِلُوْا هُوَ اَقْرَبُ لِلتَّقْوٰي وَ اتَّقُوا اللهَ  اِنَّ اللّٰهَ خَبِيْرٌۢ بِمَا تَعْمَلُوْنَ.

হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর (বিধি-বিধানের) পূর্ণ প্রতিষ্ঠাকারী, ইনসাফের সাথে সাক্ষ্য প্রদানকারী হয়ে যাও। আর কোনো সম্প্রদায়ের শত্রুতা যেন সুবিচার বর্জনে তোমাদের প্ররোচিত না করে। তোমরা সুবিচার করো। এটাই তাকওয়ার বেশি নিকটবর্তী এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। নিশ্চয়ই তোমাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আল্লাহ অধিক অবগত। -সূরা মায়েদা (৫) : ৮

জুলুমের বিপরীতে ইনসাফ চর্চার পর, সামাজিক অস্থিরতা, বিরোধ ও অসহিষ্ণুতার পটভূমিতে যে বিষয়টি অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য সেটি হল, মানবিকতার মুআমালা; সহৃদয় মুআশারা। সদাচার, সেবা এবং বিপদাপদে মানুষের উপকার করার চর্চাটি সব রকম সময় ও পরিস্থিতির জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশংসিত। তবে দূরত্ববাচক ও বিরোধপূর্ণ সময়ে সদাচার অনেক বেশি সওয়াব ও কল্যাণের কারণ হয়ে ওঠে। বিপন্ন মানুষকে সাহায্য করা, পীড়িত-অসুস্থকে চিকিৎসা দেওয়া, ক্ষুধার্তকে খাবার দেওয়া এবং বিপদগ্রস্তকে বিপদ থেকে উদ্ধার করা অনেক সওয়াবের কাজ। বিরোধপূর্ণ ও অসহিষ্ণু পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণত সাহায্যের হাত এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে লাল চোখের আগুন ঝরতে থাকে। দূরত্বপূর্ণ এ-জাতীয় পরিবেশ ও পটভূমিতে নিজেকে সংযত রাখা এবং অপরের প্রতি সদাচার করার মর্যাদা ও গুরুত্ব অনেক। এতে সামাজিক অবক্ষয়ের গতি দুর্বল হয় এবং শান্তি ও নিরাপত্তার মাত্রা বৃদ্ধি পায়।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُؤْمِنٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنْيَا، نَفَّسَ اللهُ عَنْهُ كرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَمَنْ يَسَّرَ عَلَى مُعْسِرٍ يَسَّرَ اللهُ عَلَيْهِ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ، وَاللهُ فِي عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِي عَوْنِ أَخِيهِ...

যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দুনিয়ার কষ্টসমূহের মধ্য থেকে একটি কষ্ট দূর করে দেবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার কষ্টসমূহের একটি কষ্ট দূর করে দেবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো অভাবগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে সহজতার আচরণ করবে আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখেরাতে তার সঙ্গে সহজ আচরণ করবেন। এবং যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ গোপন করবে, আল্লাহ দুনিয়ায় ও আখেরাতে তার দোষ গোপন করবেন। আল্লাহ তার বান্দার সাহায্য করবেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্য করবে। ... -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৯৯

ইনসাফ ও মানবিকতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ের দ্বীনদারি, দ্বীন ও ইবাদতের অনুশীলনের দিকে পূর্ণ যত্নশীল থাকার গুরুত্ব ও প্রাধান্য সব সময়ের জন্যই প্রযোজ্য। অস্থিরতা ও সংকটের সময়কালে ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে দ্বীনী বিষয়ে শৈথিল্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়। অনেক সময় এমন পরিস্থিতি বিভিন্ন দিক থেকে তৈরিও করা হয়। তাই মুসলমানের জীবনের সবচেয়ে প্রাধান্যপূর্ণ বিষয়টির প্রতি, ব্যক্তিগত ইবাদত-আমল, দ্বীনের বিধান-আহকাম, সমাজে বিরাজমান দ্বীনী শৃঙ্খলা ও অনুশীলন এবং দ্বীনী প্রতিষ্ঠান ও কেন্দ্রগুলোর মর্যাদা রক্ষার প্রতি পূর্ণ সজাগ ও যত্নশীল থাকা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। অসহিষ্ণু সময়ে দ্বীন-বিরোধী সুযোগসন্ধানী মহল অনেক ক্ষেত্রে মুসলিম সমাজে নিয়ম ও নেযামগত পর্যায়ে বিশৃঙ্খলার বীজ বপন করার চেষ্টা করে থাকে। যে কোনো সংকটে-বিরোধে দ্বীন অনুশীলন  ও দ্বীনী অনুশাসন রক্ষায় সজাগ সতর্কতা মুসলমানদের দ্বীনী যিম্মাদারি। এই যিম্মাদারির যথাযথ পরিপালনের সাথে তাদের অস্তিত্বের সুস্থতাও যুক্ত। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক নাতিদীর্ঘ নসীহতে ইরশাদ করেন-

احْفَظِ اللهَ يَحْفَظْكَ، احْفَظِ اللهَ تَجِدْهُ تُجَاهَكَ، إِذَا سَأَلْتَ فَاسْألِ اللهَ، وَإِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِاللهِ...

তুমি আল্লাহর বিধানকে হেফাযত করো, আল্লাহ তোমাকে হেফাযত করবেন। তুমি আল্লাহর বিধানকে হেফাযত করো, তুমি আল্লাহ তাআলাকে তোমার সামনেই পাবে। যখন প্রার্থনা করবে আল্লাহরই কাছে প্রার্থনা করবে আর যখন সাহায্য চাইবে আল্লাহরই কাছে সাহায্য চাইবে। ... -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৫১৬

ব্যক্তিগত পর্যায়ে হোক, সামাজিক কিংবা জাতীয় পর্যায়েই হোকঅসহিষ্ণুতার ক্ষতি থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করা সবার দায়িত্ব; বিশেষভাবে দায়িত্বশীলদের। আর সর্বাবস্থায় জুলুম মুক্ত থেকে ইনসাফ বজায় রাখা, মানুষের ক্ষতি করার পরিবর্তে সদাচার ও মানবিকতা প্রদর্শন করা এবং দ্বীনী অনুশীলন ও মূল্যবোধ রক্ষা করার প্রতি যত্নশীল ও আন্তরিক থাকা দলমত নির্বিশেষে সব মুসলিমের দায়িত্ব। মুসলিম সমাজকে শান্তিময়, জুলুমমুক্ত, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ এবং দ্বীনের অনুগামী করে রাখার যে প্রয়াস ও প্রয়োজনীয়তা- তার তো কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহ তাআলা দ্বীন, ভ্রাতৃত্ব ও নিরাপত্তার সঙ্গে আমাদের কিসমত যুক্ত করে দিন- আমীন। 

 

 

advertisement