কুরআন ও সালাফে সালেহীন
হৃদয় পবিত্র হলে কুরআন পাঠে তৃপ্ত হতে পারত না
সালাফে সালেহীন তথা সাহাবা, তাবেঈন, তাবে তাবেঈন ও তাঁদের আদর্শের অনুসারী পরবর্তী যুগের মানুষদের জীবনে কেমন ছিল কুরআন, তার কিছুটা আমরা অনুমান করতে পারি তাঁদের এই বাণী ও বক্তব্যগুলো থেকে-
আমীরুল মুমিনীন উসমান ইবনে আফফান রা. বলেছেন, যদি আমাদের অন্তরগুলো পবিত্র হত তাহলে কখনোই কুরআন পাঠে তৃপ্ত হতে পারত না। আমার কাছে এটা খুবই অপছন্দ, কোনো একটি দিন এমন যাবে, যেদিন কুরআন পড়া হল না। -আলআসমা ওয়াসসিফাত, বাইহাকী, বর্ণনা ৫২৪
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেছেন, আমাদের অন্তরগুলো হল পাত্র (যাতে অনবরত বিভিন্ন ভাব ও চিন্তার উদয় হতে থাকে), অতএব কুরআন দিয়ে অন্তরকে ব্যস্ত রাখো, অন্য কিছু দিয়ে নয়। -মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, বর্ণনা ৩০৬৩৩
হাসান ইবনে আলী রা. বলেছেন, তোমাদের পূর্ববর্তীরা কুরআনকে এভাবে দেখেছেন যে, এ হচ্ছে আমার রবের পক্ষ থেকে আমার কাছে আসা চিঠি। তাই সারা রাত তারা সেটা নিয়ে তাদাব্বুর ও চিন্তাভাবনা করতেন, আর দিনের বেলায় বাস্তবায়ন করতেন। সে অনুযায়ী সব কাজ করতেন। -আততিবয়ান ফী আদাবি হামালাতিল কুরআন পৃ.৫৪
হাসান বসরী রাহ. বলেছেন, যে ব্যক্তি এটা জানতে চায় যে, সে কেমন -সে যেন নিজেকে কুরআন দিয়ে যাচাই করে। (কারণ কুরআন হল আল্লাহর কালাম। কুরআনের সঙ্গে যার ভালবাসা রয়েছে, বোঝা যাবে সে আল্লাহকে ভালবাসে)। -কিতাবুয যুহদ, আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক, বর্ণনা ৩৮; আসসুন্নাহ, আবদুল্লাহ ইবনে আহমাদ, বর্ণনা ১২৫
তারীখ ও তারাজিম তথা ইসলামী ইতিহাস ও মনীষীদের জীবনীগ্রন্থগুলোতে কুরআনের সঙ্গে সালাফের সম্পর্ক বিষয়ক ঘটনাসমূহ পাঠ করলে আমরা দেখতে পাই- তাঁদের কাছে কুরআন কত প্রিয় ছিল। কুরআনের একেকটি কথা তাঁদের কেমন প্রভাবিত করত। শত ব্যস্ততার মধ্যেও কুরআনের মাশগালা তারা ভুলতেন না। একটিমাত্র আয়াত পাঠ করতে করতে রাত ভোর হয়ে যেত। কুরআন এত পড়তেন তবু ক্লান্ত হতেন না, পিপাসা মিটত না। কী এক আকর্ষণে একের পর এক তারা কুরআন খতম করে চলতেন। সময় পেলেই কুরআন তিলাওয়াতে লেগে যেতেন। সারাদিনের ব্যস্ততার পর রাতের বেলা নামাযে দাঁড়িয়ে তিলাওয়াত করতে থাকতেন...। এরকম অসংখ্য ঘটনা আমরা পাই ইতিহাসের গ্রন্থে, সব যামানার সালাফ ও মনীষীদের জীবনবৃত্তান্তে। কিন্তু কীভাবে এমনটা সম্ভব হয়েছিল- সে প্রশ্নের, সেই কৌতুহলের উত্তর রয়েছে উপরে উল্লিখিত বাণীগুলোতে।
আসলে কুরআন মিশে গিয়েছিল তাঁদের মন ও মগজে, অস্থি ও মজ্জায়। কুরআন মিশে গিয়েছিল তাঁদের হৃদয় ও আত্মায় এবং সমগ্র সত্তায়।
বারবার কুরআন পড়ে কুরআনের প্রতিটি কথাকে তাঁরা পরিণত করেছিলেন জীবনের অংশরূপে। যেন একেকটি আয়াত তাঁদের জীবনবৈশিষ্ট্যের একেকটি শিরোনাম! কুরআনের প্রতিটি আয়াত তারা এত শতবার পড়েছেন যে, কুরআনে বর্ণিত সবকিছু ছিল তাদের কাছে চোখে দেখা বাস্তবতা; বরং তার চাইতেও বেশি। কুরআনের প্রত্যেকটি কথা ছিল তাদের কাছে পৃথিবীর সবচাইতে দামী, সবচেয়ে সত্য এবং নির্ভুল কথা। যার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যখন তারা নেমেছেন জীবনের বিস্তীর্ণ অঙ্গনে। জীবন ও জগতের চরম দুর্বিপাকে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় তারা নিজেদের সিদ্ধান্তে, নিজেদের আদর্শে অটল থাকতে পেরেছেন কুরআনের সাথে সার্বক্ষণিক অটুট সম্পর্কের বরকতে। কুরআনই তাদের পথ দেখিয়েছে। প্রেরণা যুগিয়েছে। সান্ত্বনা দিয়েছে এবং আশ্বস্ত করেছে। কুরআনকে তারা দেখেছেন আল্লাহর সঙ্গে কথা বলার মাধ্যম হিসেবে। আল্লাহর কালামকে ভালবেসে লাভ করতে চেয়েছেন এবং লাভ করতে পেরেছেন আল্লাহর ভালবাসা।
কুরআন দিয়েই তারা নিজেদের ব্যস্ত রেখেছেন, যেন দুনিয়া তাদের ব্যস্ত করতে না পারে, তার মোহে ফেলতে না পারে। গাফেল করতে না পারে আল্লাহ ও আখেরাতের স্মরণ থেকে।
কুরআনের শিক্ষা, কুরআনী বিধান, কুরআনের গভীর বার্তা... কালামুল্লাহর অলঙ্কার ও অলৌকিকত্ব- এসবই ছিল তাদের দিনরাতের ভাবনার বিষয়। যা কিছু মিলে শরীয়ত, তার সবকিছুই তাই তাঁদের সামনে সদা জ্বলজ্বল করত। যে কোনো পরিস্থিতি এসেছে, সেটার মোকাবিলা তাঁরা করেছেন কুরআন দিয়ে। যে কোনো প্রশ্ন জেগেছে, তার উত্তর খুঁজে পেয়েছেন কুরআনে।
দ্বীন ও শরীয়ত তারা শিখেছেন রাসুলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বয়ান ও তালীম থেকে। আর সেই শিক্ষাকে সর্বদা তাজা রেখেছেন কুরআন পাঠে নিমগ্ন থেকে, কুরআনের সাথে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ বজায় রেখে। তাই ইসলামের কোনো শিক্ষাই কখনো তাদের জীবনে অনুপস্থিত হয়নি। কীভাবেই বা হবে; কুরআন তো আল্লাহ দিয়েছেনই যিকির ও যিকরা হিসেবে। যা মুমিনকে সবসময় তার লক্ষ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তার কর্তব্যগুলো মনে করিয়ে দেয়। তার শত্রুমিত্র চিনিয়ে দেয়...। তার উদ্দেশ্যের পথে তাকে রাখে অবিচল...।
কুরআনকে তাঁরা এভাবে আঁকড়ে ধরে থেকেছেন বলে আল্লাহর সাথে তাঁদের সম্পর্ক শিথিল হয়নি। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যে কখনো ত্রুটি হয়নি।
কুরআনের একেকটি আয়াত বারবার পড়ে পড়ে, শুনে শুনে এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে অনুসরণের চেষ্টার মধ্য দিয়ে কুরআনের প্রত্যেকটি আয়াতের প্রতি তাদের বিশ্বাস এমনই গাঢ় হয়েছে যে, কুরআনে বলা বিষয়গুলো চাক্ষুস দেখার পর তাদের ঈমান এর চেয়ে বৃদ্ধি পাবার অবকাশ ছিল না।
এজন্যই তাঁদের জীবনী পড়লে আমরা দেখতে পাই, কোনো একটি আয়াত শোনার পর কেউ বেহুঁশ হয়ে যাচ্ছেন। কেউবা দিনের পর দিন অসুস্থ থাকছেন আর কেউ হয়তো ওখানেই মারা যাচ্ছেন...।
কেন হয়েছে এমনটা? কারণ কুরআনের কথার সত্যতার ঐ চরম-পরম উপলব্ধি...। যে উপলব্ধির পরে কেউ নির্লিপ্ত থাকতে পারে না। নিশ্চিন্ত জীবন কাটাতে পারে না; বরং যে কয়দিন এ দুনিয়াতে বেঁচে থাকার সুযোগ পাওয়া যায়, তাকে গনিমত মনে করে চিরস্থায়ী জীবনের জন্য প্রস্তুতি নেয়াই হয়ে যায় তার দিনরাতের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। আর তাঁদের বেলায় ঠিক এটাই হয়েছিল। কুরআন ছিল তাঁদের জীবনে তেমনই, যেমনটি নবীজীর এই দুআ থেকে আমরা পাই :
اللَّهُمَّ إِنِّي عَبْدُكَ، ابْنُ عَبْدِكَ، ابْنُ أَمَتِكَ، نَاصِيَتِي بِيَدِكَ، مَاضٍ فِيَّ حُكْمُكَ، عَدْلٌ فِيَّ قَضَاؤُكَ، أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ، سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ، أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ، أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ، أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ، أَنْ تَجْعَلَ الْقُرْآنَ رَبِيعَ قَلْبِي، وَنُورَ بَصَرِي، وَجِلَاءَ حُزْنِي، وَذَهَابَ هَمِّي.
হে আল্লাহ! আমি আপনার বান্দা, আপনার বান্দা ও বান্দীর সন্তান। আমার সবকিছু আপনার হাতে। আমার বিষয়ে আপনার সিদ্ধান্তই কার্যকর। আমার বিষয়ে আপনার ফয়সালা সম্পূর্ণ ইনসাফপূর্ণ। হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করছি ঐসব নামের আশ্রয় নিয়ে, যে নাম আপনার, যে নাম আপনি নিজের জন্য রেখেছেন কিংবা আপনার কিতাবে যার উল্লেখ করেছেন কিংবা আপনার কোনো মাখলুককে যা শিক্ষা দিয়েছেন কিংবা যার খবর শুধু আপনিই জানেন। আমি প্রার্থনা করছি- কুরআনকে করুন আমার হৃদয়ের বসন্ত, আমার চোখের জ্যোতি, আমার দুঃখ ও দুশ্চিন্তা দূরকারী, আমার পরম প্রশান্তি।
-মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদীস: ২৯৯৩০; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস: ৩৭১২; সহীহ ইবনে হিব্বান, হাদীস: ৯৭২