সফর ১৪৪৫   ||   সেপ্টেম্বর ২০২৩

মাদরাসা ছাত্র হত্যাকাণ্ড : এ নৃসংশতার কি কোনো প্রতিকার নেই?

মাদরাসার ছাত্র রেজাউল করিম হত্যার পর তো অনেক দিন পার হয়ে গেল। কোনো বিচার শুরু হয়েছে বলে শোনা যায়নি। কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও খবর পাওয়া যায়নি। ইতিমধ্যে পাঠকবৃন্দ জেনে গেছেন-‘রাজধানীর গুলিস্তানে শান্তি সমাবেশশেষে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের সময় ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত রেজাউল করিম (২১) যাত্রাবাড়ীর একটি মাদরাসায় পড়তেন। কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না তিনি। রোববার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন ঢামেকের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকরা। এর আগে ঘটনার দিন রাতে সিআইডির একটি দল ময়নাতদন্ত করে। রোববার বিকাল সাড়ে  তিনটার দিকে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

রেজাউলের ফুপু ফারিয়া যুগান্তরকে জানান, তার ভাতিজা যাত্রাবাড়ীর জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলূম মাদরাসায় জালালাইন জামাতে অধ্যয়নরত ছিল। কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল না। আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যকার বিরোধ একটি নিরপরাধ ছেলের জীবন কেড়ে নিয়েছে। রেজাউল অসুস্থ ছিল। করোনার পর তার ডেঙ্গু হয়। সুস্থ হওয়ার পর জন্ডিস হয়। তাই নিয়মিত ডাক্তার দেখাত, ওষুধ খেত।

নিহতের বেয়াই রাসেল মিয়া জানান, গত বুধবার গ্রাম থেকে এসে রাজধানীর খিলগাঁও গোড়ানে তার বাসায় ওঠে রেজাউল। সেখানে অসুস্থতা অনুভব করে। বৃহস্পতিবার রাতে চিকিৎসকের কাছে গেলে তাকে বাসায় অবস্থান করে প্রয়োজনীয় ওষুধ খেতে পরামর্শ দেওয়া হয়। পরদিন শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে রেজাউল বাসা থেকে বের হয়। যাওয়ার সময় বলে যায়, মাদরাসায় গিয়ে ছুটি নিয়ে ফিরবে। শনিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি জানতে পারেন, গুলিস্তানে এক যুবক মারা গেছে। এরপর ঢামেকে গিয়ে তিনি রেজাউলের লাশ শনাক্ত করেন।’-যুগান্তর, ৩১ জুলাই ২০২৩

একটি দেশের রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে কওমী মাদরাসার একজন ছাত্রকে হত্যা করা হল। এ নিয়ে কারও তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া শোনা গেল না। চারদিক থেকে তার মতো বা তার সহপাঠীদের গালমন্দ বা বকাঝকা শুনে দুচারটা বিবৃতি পর্যন্ত গিয়েই থেমে গেছে। অথচ এটা তো স্বতঃস্বিদ্ধ বিষয় যে, ঘটনাটা ঘটিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের লোকজন। তাদের পারস্পরিক সংঘর্ষের মাঝে এই ছেলেকে তারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এখান থেকে বহু প্রশ্ন, বহু কিছুই উত্থাপিত হয়। অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্টের শিরোনাম ছিল, ‘আ.লীগের সংঘর্ষ চলাকালে রেজাউলের পায়ে কোপ দিল কারা?’

ক্ষমতাসীনদের অতীত তো এদেশের দ্বীনদার সমাজ ভুলবে না। তারা অতীতে ধর্মীয় লোকদের সাথে, মাদরাসার মানুষদের সাথে ১৯৯৬ থেকে ২০০১, ২০১৩, ২০১৪, ২০২১ পিরিয়ডে কী আচরণ করে এসেছে- তা কারও অজানা নয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, তারা এসব থেকে কিছু না কিছু শিক্ষা নেয়। কিছু পরিবর্তন দেখায়। ভাব দেখায়, আমরা ধর্মীয় লোকজন, মাদরাসা-মসজিদের বিরোধী নই। কিন্তু মাঝে মাঝেই এমন ঘটনা ঘটে, যা থেকে প্রতীয়মান হয়- তারা যেই সেই রয়ে গিয়েছে। এখানে তো তাদের বিরুদ্ধে কেউ আন্দোলন করতে যায়নি। কেউ কিছু বলতেও যায়নি। এ ছেলে কোনো রাজনীতি করে- এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ, পরিচয় এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

গুলিস্তান এলাকা কি ক্ষমতাসীন দলকে ভাড়া দিয়ে দেওয়া হয়েছে? ওখানকার ফুটপাথ, রাস্তা দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে ওই দলের লোকজন মেরে ফেলবে? অনেকেই মনে করেন, এ ঘটনা ইচ্ছাকৃত ঘটানো হয়েছে। হয়তো তাদের দলের ধর্মবিদ্বেষী লোকজন এ ছেলেকে দাড়ি-টুপিওয়ালা দেখে প্রতিপক্ষের ধার্মিক সদস্য মনে করে ইচ্ছে করেই মেরে ফেলেছে। যারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? আমরা কি প্রতিকার করতে পেরেছি? খুব স্বাভাবিকভাবেই মাদরাসার ছাত্ররা দলীয় রাজনীতি করে না, ছাত্ররা তাদের শিক্ষকদের দিকনির্দেশনার বাইরে গিয়ে আন্দোলনও করে না। এ অবস্থার সুযোগ নিয়ে মাদরাসার দায়িত্বশীল বোর্ডগুলোর একটি-দুটি বিবৃতি দিয়েই কি দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? এ ঘটনায় বোঝাপড়া করে দোষীদের গ্রেফতার করিয়ে বিচারের আওতায় আনার দায়িত্ব কি নেই কারও? কিন্তু এসব দায় গ্রহণ ও দায়িত্ব পালনের কোনো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একজন মাদরাসার শিক্ষার্থীকে যারা এভাবে শেষ করে দিয়েছে তারা কি এমনি এমনিই পার পেয়ে যাবে? আল্লাহর বিচার তো আছেই। এধরনের হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে তারা যদি পার পেতে থাকে তাহলে তারা অন্য সময়ও এমন খুন-খারাবি করতে দ্বিধা করবে না।

আলকাউসারের অনেক পাঠকই এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আমরা মনে করি, এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার করে সুষ্ঠু বিচারের মুখোমুখি করা দরকার। সরকার ব্যবস্থা না নিলে কওমী মাদরাসার বোর্ডগুলোর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ সরকারের উচ্চপর্যায়ে বিষয়টি উত্থাপন করে এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সোচ্চার হতে পারেন।

বিজ্ঞ কিছু মহল থেকে আরেকটি বিষয়েও দীর্ঘদিন থেকে চাপা অসন্তোষ লক্ষ করা যাচ্ছে। তা হচ্ছে, কওমী মাদরাসার একটি বড় বোর্ডের ফেইসবুক-প্রীতি। তারা নাকি কোনো নোটিশ প্রদান করলে তা ফেইসবুকে করেন। বিবৃতি দেন ফেইসবুকে মহাপরিচালকের স্বাক্ষরে। এটি কেমন কথা! তাহলে কি তারা ধরে নিচ্ছেন যে, তাদের বোর্ড-সংশ্লিষ্ট সব ছাত্র-শিক্ষক বা মাদরাসাওয়ালারা অবশ্যই ফেইসবুক ব্যবহার করেন। ফেইসবুকে বিবৃতি দিতে হবে কেন? সেটা কি মাদরাসা-সংশ্লিষ্টদের ফেইসবুকের প্রতি আকর্ষণের একটি নীরব দাওয়াত হয়ে যাচ্ছে না? যদি অনলাইনেই দিতে হয়, তাহলে সেটা তো নিজস্ব ওয়েবসাইটেও প্রচার করা যেতে পারে। মাদরাসার ছাত্র রেজাউল করিম রাহ. হত্যার পর চারদিক থেকে শোকাহত লোকজনের প্রতিবাদী আওয়াজ ওঠার পর নাকি ফেইসবুকে একটি বিবৃতি এসেছে। কেউ কেউ বলছেন, তাতে নাকি অনেক ব্যক্তিত্বের নামের মাঝে মরহুম রেজাউল করিমের নাম বের করে নেয়া কষ্টকর ছিল। আবার ভিন্ন বিবৃতিতে নিহত ছাত্রটির পরিবারকে টাকা প্রদানের কথাও প্রচার করা হয়েছে। তাতেও দুঃখ লেগেছে অনেকের মনে। এ প্রচারণার কী অর্থএমন তো নয় যে আপনারা এক কোটি টাকা দিয়ে দিয়েছেন। ৫০ লক্ষ টাকা দিয়ে দিয়েছেন। এক লাখ টাকা দিয়ে আপনি প্রচার করছেন পুরো দুনিয়া। কোনো অনুদান দিলে তা তো ছেলেটির পরিবারকে নীরবেই দেওয়া যেত। এ ধরনের প্রচারণা কি শোকাহত পরিবারটির জন্য বিব্রতকর ও আরও কষ্টকর নয়?

এখানে আমরা তালেবে ইলমদের প্রতি একটি আহ্বান রাখতে চাই। সেটা হল, এ মুহূর্তে রাজনীতির মাঠ চারদিকে উত্তপ্ত। এসময়ে তালেবে ইলমদের চলা-ফেরায় খুব সতর্ক থাকা দরকার। বিনা প্রয়োজনে মাদরাসা থেকে বের না হওয়া। যে এলাকায় গণ্ডগোল কিংবা দলীয় কর্মসূচি চলছে, সেসব এলাকা থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা। এসব বিষয়ে সতর্কতা কাম্য। মাদরাসা কর্তৃপক্ষ ও তালেবে ইলম সবারই সতর্ক থাকা দরকার। বুঝতে হবে, এখনকার রাজনীতি মানুষকে মানুষ মনে করে না। নিজেদের ক্ষমতাটাকেই বড় বিষয় হিসেবে ধরে নিয়েছে। তাই নিজেদের সতর্কতা অবলম্বন অতীব জরুরি।

আল্লাহ তাআলা মাদরাসা-সংশ্লিষ্ট সকল স্তরের উলামা-তলাবা-অভিভাবকদেরকে হেফাজত করুন। অন্যদের অনিষ্ট থেকে, ষড়যন্ত্র থেকে এবং অন্যদের আধিপত্যের মুখে পড়া থেকে রক্ষা করুন। 

 

 

advertisement