স্বীকৃতি : আস্থার দৃঢ়তাই সমাধান
সত্যকে ছাই দিয়ে ঢেকে রাখা যায় না-এটাও আরেকটা সত্য। কিন্তু সত্যের উপর মিথ্যার আস্তর ফেলতে ফেলতে সাময়িকভাবে সত্যকে চোখের আড়ালে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে আস্থাহীন ও দুর্বলচিত্ত মানুষের চোখে পর্দা পড়ে যায়। তারা সহজেই বিভ্রান্তির চোরাবালিতে তলিয়ে যায়। অবশ্য সত্যকে যারা সত্যের রূপে চেনেন-জানেন, তারা পুরো আস্তরের নিচে চাপা পড়া সত্যটা তখন আগের মতোই দেখেন।
এরপর যখন বিরোধী শিবির থেকেই সত্যের পক্ষে কোনো স্বীকৃতি অথবা তথ্য-প্রমাণ চলে আসে তখন দুর্বলচিত্ত, লোকেরা হকচকিয়ে যান এবং তাদের চোখের পর্দা আবার কিছু সময়ের জন্য সরে যায়। মিডিয়ার প্রচারণায় সত্যকে একবার যারা অবাঞ্চিত মনে করেন, তারাই আবার জন্য সত্যের পক্ষ হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে চান। ইসলাম ও মুসলিম বিষয়ে এরকম দোদুল্যমান ও হীনম্মন্যতাগ্রস্ত মুসলিম সন্তানের সংখ্যা এখন অসংখ্য। নিজেদের ‘অপরাধী সম্প্রদায়ে’র লোক ভেবে নিজেরাই ছোট হয়ে যেতে থাকেন। অথচ দোদুল্যমানদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটাতে দরকার আস্থার দৃঢ়তা। তাহলে বিরোধী পক্ষের অনবরত মিথ্যা প্রচারণা কিংবা হঠাৎ সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য-সাবুদে তাদের অন্তরে কোনো দোলা লাগবে না।
এদেশের সংবাদপত্রগুলো ‘রয়টার্স’-এর সূত্রে গত ৭ ডিসেম্বর একটি খবর প্রকাশ করেছে। প্রাসঙ্গিক কারণে খবরটি হুবহু নিচে তুলে ধরা হল।
বিশ্বে সন্ত্রাসী ঘটনার ৯৪ শতাংশের সঙ্গে জড়িত অমুসলিমরা
বিশ্বজুড়ে সংঘটিত সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য ঢালাওভাবে মুসলমানদের গালমন্দ করার দিন আর নেই। খোদ এফবিআই এবং ইউরোপোল পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদনেই স্বীকার করা হয়েছে ‘ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জঙ্গি বলে গালমন্দ করার সুযোগ এখন শেষ।’
এফবিআই অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৯৮০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার মধ্যে শতকরা ৯৪টি ঘটনার সঙ্গে অমুসলিমরা জড়িত।
ওয়েবসাইটটিতে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মধ্যে ৪২ শতাংশ লাতিন, ২৪ শতাংশ বামমনা চরমপন্থী, ৭ শতাংশ চরমপন্থী ইহুদি, ৬ শতাংশ মুসলিম, ৫ শতাংশ সমাজতন্ত্রী এবং বাকি ১৬ শতাংশ অন্যান্য গ্রুপের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে। অপর দিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলা বিশ্লেষণ করে প্রায় একই রকমের তথ্য প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউরোপোল।
২০০৭, ০৮ ও ০৯ সালে ইউরোপের মাটিতে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলার তদন্ত করে প্রতিষ্ঠানটি একটি তালিকা প্রণয়ন ও গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ইউরোপের মাটিতে সংঘটিত (২০০৭-২০০৯) সন্ত্রাসী ঘটনার মাত্র ০.৬ শতাংশ করেছে মুসলিম নামধারী সন্ত্রাসীরা। বাকি ৯৯ দশমিক ৪ ভাগই হয়েছে অন্য ধর্মের লোকদের দ্বারা। এর মধ্যে ৮৪ দশমিক ৬ ভাগই হয়েছে বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের মাধ্যমে।
এ খবরটি দেখার পর কিছু প্রশ্ন সামনে চলে আসে। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘এফবিআই’ আর ইউরোপের ‘ইউরোপোল’-এর গবেষণায় একটি সত্য তুলে ধরা হয়েছে। তাদের নীতি ও স্বভাবের সঙ্গে তো এর কোনো মিল নেই। এ কাজটি তারা কেন করছে-তা এখনো স্পষ্ট নয়। কিন্তু গোটা পৃথিবীতে গত প্রায় এক দশক যাবত ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ যত কর্মকান্ড যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের নেতৃত্বে চলছে, তার বেশির ভাগই তো মুসলমানদের বিরুদ্ধে। এটা কেন হচ্ছে? আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশ্ব মোড়লদের ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ যত পদক্ষেপ, সম্মেলন ও প্রচারণা হচ্ছে তার প্রায় সবকিছুতেই মুসলমানদের টার্গেট করেই করা হচ্ছে। এটা কিভাবে সম্ভব হচ্ছে? আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে ‘টেররিজম’ কিংবা ‘সন্ত্রাস’ জাতীয় কোনো বিষয় আসলেই বিষয়ের ভাব ও গতির ওপর চোখের রেখে বাংলা অনুবাদ হচ্ছে ‘জঙ্গিবাদ’। ইনিয়ে বিনিয়ে দায়ী ও দোষী বানানো হচ্ছে মুসলমানদেরকেই। এটা কেন হচ্ছে?
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’র অজুহাতে ‘ইরাক’ ও ‘আফগানিস্তান’ নামের মুসলিম দু’টি দেশ রক্তের বন্যায় ভেসেছে। আরো বেশ ক’টি দেশ ‘সন্ত্রাস দমনে’র নামে চালানো বিভিন্ন অপারেশনে চরম বিপর্যস্ত ও বিপন্ন হয়ে গেছে। এসব মুসলিম দেশ ও তাদের নাগরিকদে নিগ্রহের পেছনে এই ‘এফবিআই’ ও ‘ইউরোপোল’-এর ভূমিকাই বিরাট। একদিকে তারা মুসলমানদেরকে দেশে দেশে টার্গেট করছেন, আরেকদিকে সন্ত্রাসের সঙ্গে মুসলিম নামধারীদের সংখ্যা বলছেন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর। এই দ্বৈত আচরণের রহস্যটা কী?
এসব প্রশ্নের আসলে কি উপযোগী কোনো উত্তর আছে? সম্ভবত নেই। তাই স্বীকৃতি ও পদক্ষেপের ভিন্নতা থেকে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু। প্রচারণা কিংবা স্বীকৃতিতে কিছুই যায় আসে না। আস্থায় দৃঢ়তার কোনো বিকল্প আসলে মুসলমানদের নেই।