মুহাররম ১৪৪৫   ||   আগস্ট ২০২৩

গুনাহে জারিয়া

জাভেদ চৌধুরী

[জাভেদ চৌধুরী। পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ সাংবাদিক, কলাম লেখক ও উপস্থাপক। এক্সপ্রেস নিউজে (৯ জুলাই ২০২৩) গুনাহে জারিয়া শিরোনামে তাঁর লেখাটি ছিল অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। লেখক কোনো আলেম নন। তাই লেখাটির প্রতিটি অংশ ফিকহী বিচারে দেখার সুযোগ নেই। তবে এই লেখা থেকে শিক্ষা নেওয়ার আছে অনেক কিছু। আলকাউসারের পাঠকদের জন্য এর বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করা হল।

অনুবাদ করেছেন : ওয়ালিউল্লাহ আব্দুল জলীল]

 

আহমাদ ইমাদুদ্দীন রাযী ছিলেন মিশরের প্রসিদ্ধ অর্থোপেডিক সার্জন। তিনি আইনুশ শামস বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডেপুটি ডিন এবং মিশরের স্বাস্থ্যমন্ত্রীও ছিলেন। তিনি সব দিক দিয়েই প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

ডা. রাযী ৫ জুন হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হন। তাঁকে পূর্ব কায়রোর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালটি ছিল তাঁর বন্ধুর। তিনিও দেশের বিখ্যাত কার্ডিওলজিস্ট। ডা. রাযীর শারীরিক অবস্থা খুব একটা গুরুতর ছিল না। তিনি এর আগেও এই হাসপাতালে এবং একই ডাক্তারের কাছে অপারেশন করিয়েছিলেন। তাই সমস্ত কেস নিয়ন্ত্রণে ছিল।

ডা. রাযীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার কার্ডিয়াক ক্যাথেটারাইজেশন শুরু হয়। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে হার্ট চেম্বারে একটি সূক্ষ্ম ইলাস্টিক টিউব (ক্যাথেটার) প্রবেশ করানো হয়। এটি রোগীর রোগ নির্ণয় করে। ক্যাথেটারাইজেশন কর্মী খুব দক্ষ ছিলেন না। তিনি সামান্য ভুল করে বসলেন। এই সামান্য ভুলের কারণে মিশরের প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও অর্থোপেডিক সার্জন অপারেশন টেবিলেই মারা যান। এটি বড় ধরনের সংবাদ ছিল। মিশরীয় মিডিয়া ঘটনাটিকে লুফে নিয়েছিল।

সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটিও ক্যাথেটারাইজেশনকে দায়ী করে। এটি আপাতদৃষ্টিতে একটি সাধারণ খবর। সারা বিশ্বে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকে। চিকিৎসাকর্মী ও চিকিৎসকদের অবহেলার কারণে প্রতিদিন শত শত রোগী মারা যায়। কিন্তু এ খবর সাধারণ হয়েও অসাধারণ হল কেন?

কারণ মিশরে কার্ডিয়াক ক্যাথেটারাইজেশনের জন্য ২০১৬ সালের আগে সার্জনের চেয়ে বেশি অভিজ্ঞতা ও সার্টিফিকেশনের প্রয়োজন ছিল। ডা. রাযী তার মেয়াদকালে অভিজ্ঞতা ও সার্টিফিকেশন কমিয়ে শত শত যুবককে প্র্যাক্টিসের অনুমতি দিয়েছিলেন।

তাঁর চিন্তা ছিল, সার্জারি সার্জন করেন। তাই সার্জন কোয়ালিফাইড ও অভিজ্ঞ হওয়া প্রয়োজন। সাপোর্টিং স্টাফরা অপারেশনের সময় কেবল ছুরি ও কাঁচি ধরে রাখে। এতে খুব বেশি সার্টিফিকেশন ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় না। তাই ডা. রাযীর অনুকম্পায় সার্জারির সাপোর্ট-স্টাফ বৃদ্ধি পায়। এভাবে ডাক্তার ও সার্জনদের ব্যক্তিগত অনুশীলন বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ডা. রাযী নিজেই অনভিজ্ঞ স্টাফের অনভিজ্ঞতার শিকারে পরিণত হন।

আমাদের বন্ধু রেজা বশির তারার এই পরিস্থিতিকে গুনাহে জারিয়া বলে থাকেন। তিনি জাপানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত। আমি গত মাসে জাপানে গিয়েছিলাম। রেজা বশির তারার আমাকে টোকিওর সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিং রুপিং হিলসের ৫৪ তম তলায় নৈশভোজের দাওয়াত দিয়েছিলেন। নৈশভোজটি ছিল আড়ম্বরপূর্ণ; কিন্তু আমি তারার সাহেবের সঙ্গই বেশি উপভোগ করেছি।

গুনাহে জারিয়ার টার্ম ওই সাক্ষাতেরই নির্যাস ছিল। তারার সাহেবের বক্তব্য ছিল, আমরা জীবনে যেসব সৎকর্ম করি, তাকে সদকায়ে জারিয়া বলা হয়। বিশেষ বিশেষ নেককাজ সদকায়ে জারিয়া হলে আমাদের কিছু কিছু গুনাহ ও ভুলগুলোও গুনাহে জারিয়া। এগুলোর কুপ্রভাবও অনবরত চলতে থাকে এবং মানুষকে বছরের পর বছর বরং শত শত বছর এর পরিণতি ভোগ করতে হয়। আমাদের মৃত্যুর পরেও আমাদের খাতায় লিপিবদ্ধ হতে থাকে।

এ পয়েন্টটি আমার কাছে নতুন ছিল। আমি পয়েন্টটি নোট করে নিই। আমি আজকাল আবার কুরআনের অনুবাদ পড়ছি। আমার এক বন্ধু কয়েক বছর আগে ভারত থেকে একজন মাওলানা সাহেবের অনুবাদ আনিয়ে দিয়েছিলেন।

বিশ্বাস করুন, কুরআনের অনুবাদ আমার সমস্ত উপলব্ধি পরিবর্তন করে দিয়েছে। ইসলাম শুধু অতটুকুর নাম নয়, যা সচরাচর আমরা করে বা বুঝে থাকি। আল্লাহর বাণী সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং এই ভিন্ন বাণীতে তিনি বারবার বলছেন, আপনি এই পৃথিবীতে যা করছেন তার জন্য আপনাকে দুনিয়া ও আখেরাত উভয় ক্ষেত্রেই জবাবদিহি করতে হবে। ডা. আহমাদ ইমাদুদ্দীন রাযীর সঙ্গে এটাই ঘটেছে। তিনি তাঁর ভুল সিদ্ধান্তের গ্রাসে পরিণত হয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, মৃত্যুতে কি তিনি রক্ষা পেয়ে যাবেন?

না, তার (ইচ্ছাকৃত) ভুল সিদ্ধান্তের দায় তাকে বহন করতে হবে। যতদিন মিশরের লোকেরা তার কারণে নিয়োগ হওয়া অযোগ্য লোকদের ভুল কার্ডিয়াক ক্যাথেটারাইজেশনের শিকার হতে থাকবে, ডা. রাযীর বোঝাও বাড়তে থাকবে। তাই আমাদেরও বেঁচে থাকা উচিত। এই ধরনের গুনাহ আমাদের দুনিয়ার জীবনে এবং আখেরাতে উভয় জগতেই দংশন করতে থাকবে।

অনেক দিন আগে একজন দায়রা জজের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। তাঁর একটি হাত ছিল কাটা। আমি তাঁকে দুর্ঘটনার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। তিনি বলছিলেন, আমি আমার মেয়েকে নিয়ে কেনাকাটা করতে গিয়েছিলাম। সেখানে মোটরসাইকেল আরোহী দুই ছেলে আমার মেয়ের ব্যাগ টান দেয়। আমার মেয়ে ব্যাগটি শক্ত করে ধরে। ফলে সেও বাইকের সাথে হেচড়াতে লাগল। আমি সাহায্যের জন্য ছুটে গেলে ডাকাতেরা আতঙ্কিত হয়ে গুলি চালায়। একটি গুলি আমার হাতে এবং অন্যটি মেয়ের মাথায় লাগে। মেয়ে সেখানেই মারা যায়। আমার হাতের ক্ষত বেশ খারাপ হয়ে ওঠে। ডাক্তার দুই মাস পরে হাত কেটে ফেলতে বাধ্য হন।

এরপর তিনি ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। আমি তাঁকে সান্ত্বনা দিলে তিনি চোখ মুছতে মুছতে বললেন, আমি আমার মেয়ে বা আমার হাতের জন্য কাঁদছি না। আমি অপরাধীদের কারণে কাঁদছি। আমি চাকরিকালে মাত্র কয়েক হাজার টাকার লোভে অনেক চোর-ডাকাত আসামীকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। প্রতিদিন আমার মনে হয়, আমাকে যে গুলি করেছে সে আমারই ছেড়ে দেওয়া কোনো অপরাধী হবে। এই অনুভূতি আমাকে আর বাঁচতে দিচ্ছে না।

করাচিতে এক ট্রাফিক পুলিশ অফিসারের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাঁর গল্পটিও খুব বেদনাদায়ক। তাঁর পরিবার ভ্রমণে বের হয়েছিল। রাস্তার অপর পাশ থেকে একটি গাড়ি এসে তাদের গাড়িকে ধাক্কা দেয়। গাড়িটি ছোট ছিল। একেবারে খাদে গিয়ে পড়ে। অফিসারের পুরো পরিবার দুর্ঘটনায় মারা যায়।

তিনি তার ঘটনা শোনান। বলেন, আমি টাকার বিনিময়ে ড্রাইভিং ভালোভাবে জানে না এমন ব্যক্তির জন্যও ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করতাম। যারা রাস্তায় ট্রাফিক আইন অমান্য করেছে তাদের কাছ থেকে এক-দুই হাজার টাকা নিয়ে ছেড়ে দিতাম।

আমার মনে হয়, যে আমার পরিবারকে হত্যা করেছে, সে অবশ্যই আমার থেকে পাওয়া লাইসেন্সধারী অথবা আমিই কোনো ছোট/বড় ভুলের পর তাকে ছেড়ে দিয়ে থাকব। পরে সে আমার পুরো পরিবারকে হত্যা করেছে।

একইভাবে আমি শিক্ষা বোর্ডের একজন সাবেক চেয়ারম্যানকে পেয়েছি, যার পরিবার একটি নির্মাণাধীন সেতুর পিলার চাপায় নিহত হয়েছে। তাঁর বক্তব্য ছিল, আমি শত শত অযোগ্য যুবককে মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ করে দিয়েছিলাম। হয়তো সেতুটি তাদের কারো হাতে নির্মিত হয়েছিল এবং এটি আমার নিজের পরিবারের ওপর পড়েছিল।

একজন দুধওয়ালাকে পেয়েছিলাম। তাঁর তিনটি সন্তান ছিল। তিনজনই শারীরিকভাবে দুর্বল ছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমার বাচ্চাদের শৈশবে দুধে অ্যালার্জি ছিল। তারা দুধ পান করতে পারত না। যার কারণে তাদের শারীরিক বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গেছে।

আমি বললাম, আজকাল এই রোগটি নিরাময়যোগ্য। আপনি একজন ভালো ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করতেন!

তিনি মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, জাভেদ সাহেব! দুনিয়ায় এই রোগের চিকিৎসা থাকবে; কিন্তু আমার বাচ্চারা এই চিকিৎসায় সেরে উঠতে পারবে না।

এই বিশ্বাসের কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি একটি ভয়ানক গল্প বলেন, আমার পঞ্চাশটি মহিষ ছিল। আমি এগুলোর দুধ বিক্রি করতাম। আমি লোভে পড়ে বেশি দুধের জন্য মহিষকে ইনজেকশন দিতে শুরু করি। দুধে ডিটারজেন্ট পাউডার, ইউরিয়া সার ও পানি মিশিয়ে পরিমাণ বাড়াতে শুরু করি। আমি এটি থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করি। কিন্তু মহান আল্লাহ আমার বাচ্চাদের জন্য দুধে অ্যালার্জি তৈরি করেছিলেন। আমি তাদের নিয়ে ঘুরতে থাকি। কোনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে আমার চোখের সামনে ওই হাজারো শিশুর চেহারা ভেসে ওঠে, যাদেরকে আমি ইউরিয়া, ডিটারজেন্ট পাউডার মেশানো দুধ পান করিয়েছি। তাদের কী পরিণতি হয়েছে? তারা কি বেঁচে আছে? বেঁচে থাকলে তাদের পাকস্থলির কী অবস্থা? তাই আমি এই উপসংহারে পৌঁছেছি যে, আমার সন্তানদের রোগ অনিরামেয়। চিকিৎসা হয়ে থাকে রোগের, গুনাহের নয়; আর আমি একজন গুনাহগার।

কিছুদিন আগে আমি এক বন্ধুর অফিসে গিয়েছিলাম। সেদিন তাঁর ডিপার্টমেন্টে নিয়োগ চলছিল। বন্ধু আমাকে বলে, এটা স্বজনপ্রীতির দুনিয়া। আমার কাছে প্রথম শ্রেণি ও দ্বিতীয় শ্রেণির জন্যও মন্ত্রীদের কাছ থেকে সুপারিশ আসছে।

তারপর চিরকুটের পুরো স্তুপ আমার সামনে রাখল। আমি আমার বন্ধুকে গুনাহে জারিয়ার তত্ত্ব শুনিয়ে বললাম, তুমি তোমার কোনো সুপারিশকৃত ও অযোগ্য চাপরাশির হাতে মরতে চাইলে সমস্ত চাকরি এই চিরকুটগুলোতে ভাগ করে দাও। আর নিজের এবং নিজ পরিবারের সুরক্ষা চাইলে কেবল যোগ্যতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নাও। যোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচন কর। তুমিও সদকায়ে জারিয়ার অংশ হয়ে যাবে। তাদের এবং তাদের পরিবারের লোকদের দুআ দশকের পর দশক তোমার পরিবারকে রক্ষা করবে।

আমার বন্ধুর চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠল। সে সব চিরকুট ছিঁড়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিল। পিএকে ডেকে বলল, আমরা প্রার্থীদের তালিকা ঝুলাব না। তুমি তাদের সবাইকে অফিসে সরাসরি ডাকো। তাদের সরাসরি নিয়োগ দেব।

পিএ ঘাবড়ে গিয়ে বলল, স্যার এনএবি (বাংলাদেশের দুদকের মতো সংস্থা)।

আমার বন্ধু উত্তর দিল, আমি এই সেবামূলক কাজের জন্য জেলে যেতেও প্রস্তুত!

 

 

advertisement