তাঁরা চলে গেলেন, আমরা এতিম হলাম
মাত্র একবছরের মধ্যে মাদরে ইলমী দারুল উলূম দেওবন্দের দু’জন বুযুর্গ বিদায় নিলেন। পৃথিবী তাঁদের বিদায় জানালো অশ্রুসজল হয়ে। তাঁরা চলে গেছেন, রেখে গেছেন তাঁদের স্মৃতি, অক্ষয় কীর্তি। দু’জনই ছিলেন এশিয়ার বিখ্যাত ও অনন্য দ্বীনি দরসগাহ দারুল উলূম দেওবন্দের অঙ্গতুল্য। ভারতবর্ষের আযাদী আন্দোলনের স্মারক, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্বপ্ন-নির্দেশ এবং উপমহাদেশের দ্বীন ও ইলমে দ্বীন প্রচার-প্রসারের কেন্দ্র এই দারুল উলূম দেওবন্দ পৃথিবীকে দিয়েছে অসংখ্য কীর্তিমান পুরুষ, জাতির ত্যাগী অতন্দ্র প্রহরী ও নিঃস্বার্থ সেবক। এই মনীষীদ্বয়ও এই সবুজ ইলমীকাননের শুভ্রপুষ্প। একজন হলেন দারুল উলূমের মুহতামিম ‘আমিরুল হিন্দ’ হযরত মাওলানা মারগুবুর রহমান রহ.। আর দ্বিতীয়জন দারুল উলূমের শায়খুল হাদীস, উস্তাযুল আসাতিযা হযরত মাওলানা নাসীর আহমদ খাঁন রহ.। এগারো মাসের ব্যবধানে তাঁরা দু’জন চলে গেলেন মাওলায়ে হাকীকীর সান্নিধ্যে। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
দীর্ঘ তিন দশকের সফল মুহতামিম
চৌদ্দশ বত্রিশ হিজরীর প্রথম দিন। হিজরী নববর্ষের প্রভাতবেলা। ঠিক সেই মুহূর্তে রাববুল আলামীনের ডাক এসে গেল। এতদঞ্চলের মুসলিমমাত্রেরই আত্মার বন্ধন দারুল উলূম দেওবন্দের সাথে। তাই দারুল উলূমের মুহতামিম ও পরিচালকের ইন্তেকালে মুসলিমমাত্রই ব্যথিত হবেন-এটাই স্বাভাবিক। তাঁর ইন্তেকালে যে শূন্যতা তৈরি হল তা কি আর পূরণ হবে? রাববুল আলামীনের কাছে হৃদয়ের মিনতি, তিনি যেন আমাদের দান করেন ‘নি’মাল বদল’, তাঁর উত্তম উত্তরসূরী।
হযরত মাওলানা মারগুবুর রহমান রহ. ১৯১৪ খৃস্টাব্দে ভারতের বিজনুর শহরের এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বংশগত সূত্রে তিনি খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত আবু বকর রা. এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। মাদরাসায়ে রহীমিয়ায় প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। সেখানে উর্দূ, ফার্সিসহ বিভিন্ন কিতাবাদি পড়ার পর উচ্চশিক্ষা অর্জনের উদ্দেশ্যে দারুল উলূম দেওবন্দে ভর্তি হন। দাওরায়ে হাদীস সমাপ্ত করার পর আবারো কিতাব অধ্যয়নে মনোনিবেশ করেন তিন বছর। এরপর দারুল উলূমের ইফতা বিভাগে ভর্তি হন এবং দু’বছরে ইফতা সমাপ্ত করে ১৩৫২ হিজরী, মোতাবেক ১৯৩২ খৃস্টাব্দে ছাত্রজীবন থেকে ফারাগাত লাভ করেন।
দারুল উলূম দেওবন্দে অধ্যয়নকালে তিনি ছিলেন ছাত্র-শিক্ষক সবার প্রিয়। প্রখর মেধা ও স্মৃতিশক্তি ও বিভিন্ন বিষয়ে পান্ডিত্যের কারণে চারদিকে তাঁর সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। পড়াশুনায় মনোযোগিতা, কঠোর সাধনা ও সুন্দর চরিত্রের দরুন তাঁর প্রতি আসাতিযায়ে কিরামের দোয়া ও নেক নজর ছিল।
দারুল উলূম দেওবন্দে তাঁর উস্তাদদের মধ্যে ছিলেন শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী রহ., হযরত মাওলানা ইজায আলী রহ., হাকিমুল ইসলাম হযরত মাওলানা ক্বারী তাইয়েব রহ., হযরত মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ শফী রহ. প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ।
জীবনের সিংহভাগ দারুল উলূম দেওবন্দে অধ্যাপনার খিদমাত আঞ্জাম দেন। হাদিসে নববীর দরস দান করেন প্রায় অর্ধ শতাব্দীকাল ধরে। সমগ্র পৃথিবীতে তাঁর হাজার হাজার ছাত্র আছে যাঁরা ইসলামের এই চিরসজীব ধারাকে সমুন্নত রেখেছেন।
১৯৬২ সালে তিনি দারুল উলূম দেওবন্দের মজলিসে শূরার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালে হাকিমুল ইসলাম ক্বারী মুহাম্মদ তাইয়েব রহ. এর অসুস্থতার কারণে তাঁকে দারুল উলূম দেওবন্দের নায়েবে মুহতামিম নিযুক্ত করা হয়। অনন্য যোগ্যতা ও দক্ষতার কারণে ১৯৮২ সালে তাঁর উপর অর্পিত হয় মুহতামিমের দায়িত্ব। এরপর দীর্ঘ ত্রিশ বছর তিনি এই দ্বীনী শিক্ষাকেন্দ্রের, এই উম্মুল মাদারিসের প্রধান ছিলেন। ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত তিনি এই পদে আসীন ছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের পর ইহতিমামের দায়িত্বভার অর্পিত হয় মুফতি আবুল কাসিম নূ’মানীর উপর।
মরহূম অত্যন্ত সঙ্কটময় মুহূর্তে দারুল উলূমের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তাঁকে ওই সময় থেকে বহু প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয়েছে। কিন্তু ইখলাস ও তা‘আল্লুক মাআল্লাহর কারণে তাঁকে বড় কোনো বাধার সম্মুখীন হতে হয় নি।
তাঁর নেতৃত্বে দারুল উলূম দেওবন্দের বহুমুখী উন্নতি হয়েছে। শিক্ষা ও নির্মাণ উভয় ক্ষেত্রে সংস্কারমূলক কর্মকান্ড হয়েছে। নতুন নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে এবং শিক্ষা বিভাগীয় কার্যক্রমে বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন ও ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন করা হয়েছে। নতুন ভবন যেমন নির্মিত হয়েছে তেমনি অনেক পুরনো ভবনের সংস্কার হয়েছে। ছাত্র-শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার পরিসর বৃদ্ধি করা হয়েছে। বলতে গেলে তাঁর যুগ ছিল দারুল উলূম দেওবন্দের ইতিহাসের একটি সোনালী অধ্যায়।
তিনি ভারত উপমহাদেশের অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী রহ.এর নিকট আধ্যাত্মিক সবক নিয়েছিলেন। ব্যক্তিজীবনে ছিলেন সহজ-সরল ও সাদাসিধে চরিত্রের অধিকারী। বিশ্বখ্যাত ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন অনাড়ম্বর জীবন-যাপনে অভ্যস্ত। আকাবিরের পদাঙ্ক অনুসরণের ব্যাপারে পুরোপুরি যত্নবান ছিলেন। ভারতের রাজনৈতিক পরিমন্ডলেও তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ছিল। তিনি ভারতের জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। দারুল উলূমের প্রশাসনিক কার্যক্রমে ব্যস্ততার মধ্যেও ইসলাহী ও জনকল্যাণমূলক সভা-সেমিনারে যোগদান করতেন। যে কোনো সঙ্কটকালে তিনি দারুল উলূম ও ভারতের মুসলমানদের পক্ষে সম্মানজনক ভূমিকা রাখতে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন।
গত কয়েকমাস ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে বিজনুরে নিজ বাড়িতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। বিভিন্ন স্থানে তাঁর সুস্থতার জন্য দো’আ হচ্ছিল, কিন্তু আল্লাহ রাববুল আলামীনের ইচ্ছা ছিল ভিন্ন। অবশেষে বিগত ৮ ডিসেম্বর ২০১০, বুধবার সকাল সাড়ে দশটায় তিনি এই নশ্বর জগত থেকে বিদায় নেন। হাজারো ভক্ত, অনুরক্ত, ছাত্র-শিষ্য ও আত্মীয় স্বজনকে শোকসাগরে ভাসিয়ে অন্তিম শয়ানে শায়িত হন দারুল উলূমের মাকবারায়ে কাসেমীতে। আল্লাহ তাঁর কবরকে নূর দ্বারা ভরপুর করে দিন।
মাদরে ইলমীর শায়খুল হাদিস
১৮ সফর ১৪৩১ হিজরী, মোতাবেক ৪ ফেব্রুয়ারী ২০১০ ঈসায়ী, বৃহস্পতিবার ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের দ্বীনি দরসগাহগুলো হারিয়ে ফেলল এক মহান মুরুববী, ইলমী আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং একজন আদর্শ শিক্ষক শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা নাসীর আহমদ খাঁন রহ.কে ।
বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটায় হযরত মাওলানা ক্বারী উসমান দা.বা. এর ইমামতিতে তাঁর নামাজে জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। অতঃপর মাকবারায়ে ক্বাসেমীতে তাঁর বড় ভাই হযরত মাওলানা বশীর আহমদ রহ. এর পাশেই তাঁকে শায়িত করা হয়।
১৩৩৭ হিজরীর ২১ রবিউল আওয়াল মোতাবেক ২৩ ডিসেম্বর ১৯১৯ ঈসায়ীতে ভারতের উত্তর প্রদেশের বুলন্দশহর জেলার বেসী নামক স্থানের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে তিনি জন্মলাভ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুশ শাকুর। তিনি দ্বীনদার ও আলেমভক্ত মানুষ ছিলেন একজন। তৎকালীন ইংরেজ সরকারের সেনাবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। হযরত মাওলানা খলীল আহমদ আম্বেটভী রহ.-এর হাতে বায়আত হয়ে তাঁর মুরীদ হয়েছিলেন। ভারত উপমহাদেশে যখন উসমানী খেলাফত রক্ষার্থে শায়খুল হিন্দ হযরত মাওলানা মাহমুদ হাসান রহ.-এর পক্ষ থেকে ‘তরকে মুওয়ালাত’ অর্থাৎ ‘ইংরেজদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ ও তাদেরকে কোনো প্রকার সহযোগিতা করা অবৈধ’ এই ফাতওয়া প্রদান করা হয় তখন তিনি ইংরেজের চাকরি ছেড়ে দেন এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য চাষবাসের পেশা গ্রহণ করেন। ঈমানী গায়রত ও চেতনাবোধের এরূপ দৃষ্টান্ত খুবই বিরল। তিনি খুব অতিথিপরায়ণ ছিলেন, কোনো মেহমান তাঁর কাছে গিয়ে কিছু না খেয়ে আসতে পারত না; বিশেষ করে আলেম-ওলামাদের অত্যন্ত সমাদর করতেন।
হযরত রাহ.-এর মাতাও একজন আলেমা ও সুবোধসম্পন্ন সচেতন নারী ছিলেন। তিনি তাঁর বাড়িকে মাদরাসায় পরিণত করেছিলেন এবং গ্রামের মুসলিম শিশুদেরকে কোরআন মজিদ, আকায়েদ ও দ্বীনি তা’লীম-তরবিয়াত দিতেন।
হযরত রাহ. তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু করেন বুলন্দশহর নগরীর কিলাউতী পল্লীর ‘মানবা‘উল উলূম’ নামক মাদ্রাসায়। সেখানে তাঁর বড় ভাই হযরত মাওলানা বশীর আহমদ রহ.-এর তত্ত্বাবধানেই তাঁর পড়ালেখার সূচনা হয়। প্রথমে কোরআন মজিদ হেফজ করেন অতঃপর ফার্সি ভাষা শিক্ষা করেন। এরপর বিভিন্ন স্তরের কিতাবাদির পাঠ গ্রহণ করেন। ১৩৬২ হিজরীতে যখন তার বড় ভাই দারুল উলূম দেওবন্দের মুদাররিস নিযুক্ত হন তখন তিনিও তাঁর সঙ্গে সেখানে চলে আসেন এবং যুগের শ্রেষ্ঠ আলিমদের সোহবত ও সান্নিধ্য গ্রহণ করেন। ১৩৬৩ হি. সনে পুনরায় দারুল উলূমে দাওরায়ে হাদীস পড়েন। তারপর দু’বছর বিভিন্ন বিষয়ে যথা তাফসীর, ফিক্হ, উসূলে ফিক্হ, মানতিক, ফালসাফা, তিবব প্রভৃতি বিষয় অধ্যয়ন করেন। ১৩৬৫ হিজরীতে ফারাগাত লাভ করেন।
দারুল উলূম দেওবন্দে তাঁর আসাতিযাদের মধ্যে হযরত মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী রহ., শায়খুল আদব হযরত মাওলানা ই’জায আলী রহ., হযরত মাওলানা আবদুল খালেক মুলতানী রহ., হাকীমুল ইসলাম ক্বারী তাইয়েব রহ., মাওলানা হিফজুর রহমান রহ., হযরত মাওলানা ফখরুল হাসান রহ. ও তাঁর সহোদর হযরত মাওলানা বশীর আহমদ রহ. সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
হযরত মাওলানা নাসীর আহমদ রহ. তাঁর ইলমী যোগ্যতা, চারিত্রিক মাধুর্য ও কঠোর সাধনার কারণে সকলের প্রিয়পাত্র ছিলেন। ফলে দরসে নেজামী ও তাখাস্সুসাতের পাঠ শেষ করার পরই তিনি দারুল উলূম দেওবন্দে শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৩৬৫ হি. থেকে ১৩৯১ হি. পর্যন্ত দরসে নেজামীর মীজান মুনশায়েব থেকে শুরু করে মাওকুফ আলাইহি (মিশকাত) পর্যন্ত প্রায় সব কিতাব সুনামের সাথে পড়িয়েছেন। ফলে তা’লীম ও পাঠদানের বিষয়ে এরূপ দক্ষতা অর্জন করেন যে, পুরো ভারতে দরসে নেজামীতে তাঁর মতো দক্ষ শিক্ষক পাওয়া ছিল দুষ্কর! ইলমে হাদীস, তাফসীর ও ইলমে হাইয়াত বিষয়ে তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। ‘ইলমুল হাইআহ’ বিষয়ক একটি গ্রন্থে তিনি ব্যাখ্যামূলক টীকা লিখেছেন, যা পাঠক মহলে বেশ সমাদৃত হয়েছে।
হযরত তাঁর জীবদ্দশায় দারুল উলূম দেওবন্দের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে সমাসীন হয়েছেন। ১৩৯১ হিজরী সালে নায়েবে মুহতামিম নিযুক্ত হন। ১৩৯১ হি. হতে ১৩৯৭ হি. পর্যন্ত তিনি সহীহ মুসলিম, সুনানে তিরমিযী, মুয়াত্বা মালিক, মুয়াত্তা মুহাম্মদ ও শরহু মাআনিল আছারের মতো হাদীসের প্রসিদ্ধ কিতাবসমূহের দরস দান করেন। ১৩৯৭ হি. সালে হযরত মাওলানা শরীফুল হাসান রহ.-এর ইন্তেকালের পর বুখারী শরীফের দরস তাঁর দায়িত্বে দেয়া হয়। এরপর দীর্ঘ ৩৩ বছর ধরে তিনি দারুল উলূমের শায়খুল হাদীস ছিলেন। সে বছরেই তিনি জামেয়ার শিক্ষা বিভাগের সহকারী প্রধান পদেও আসীন হন। পরে হযরত মাওলানা মি’রাজুল হক রাহ.-এর ইন্তেকালের পর নাযেমে তালীমাতও ছিলেন। দীর্ঘ ৬৩ বছর ধরে তা’লীম ও তাদরীসের খিদমত আঞ্জামদানের পর বার্ধক্যের কারণে গত দু’বছর পূর্বে অবসর গ্রহণ করেন। দারুল উলূম দেওবন্দের ইতিহাসে তিনিই প্রথম শিক্ষক, যিনি প্রাথমিক কিতাব মীযান মুনশায়িব হতে শিক্ষকতার সফর শুরু করেছেন আর বোখারী শরীফে এসে সেই সফরের সমাপ্তি হয়েছে। হযরত শুধু উস্তায ছিলেন না, বরং উস্তাযুল আসাতিযা ছিলেন। দারুল উলূমে কয়েকজন বাদে সব শিক্ষকই ছিলেন তাঁর ছাত্র। দীর্ঘ শিক্ষক-জীবনে তিনি অসংখ্য ছাত্র গড়ে তোলেন; একটি পরিসংখ্যান মতে চল্লিশ সহস্রাধিক ছাত্র তাঁর দরস-রসে ত…ৃপ্ত লাভ করে। বর্তমানে ভারতের প্রায় সব মাদ্রাসার শিক্ষক হয়তো তাঁর ছাত্র অথবা তাঁর ছাত্রের ছাত্র।
দারুল উলূম দেওবন্দের মতো এত বড় শিক্ষাকেন্দ্রে এত উঁচু পদের অধিকারী হয়েও তাঁর মাঝে অহংকার কিংবা দম্ভের লেশমাত্র ছিল না। তাঁর সম্পর্কে দারুল উলূমের প্রতিটি শিক্ষক, ছাত্র ও কর্মচারীর অনুভূতি এই ছিল যে, তিনি বিনম্র, সহাস্য ও অমায়িক। এককথায় ছোট বড় সবার জন্যে তিনি ছিলেন আল্লাহর রহমত।
তাঁর সামান্য সাহচর্য যে পেয়েছে সে-ই মনে করত যে, তিনি আমাকেই সবচেয়ে বেশী মুহববত করেন! আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সাধারণ নগরবাসী, এমনকি একজন রিকশাচালক পর্যন্ত তাঁকে অন্তর থেকে ভালবাসত। অথচ তাদের সাথে তাঁর প্রত্যক্ষ সম্পর্ক থাকার কোনো পথ ছিল না। এর কারণ কী? কারণ একটাই; ইখলাছ ও তাকওয়া। এ যেন হাদীস শরীফের বাস্তব দৃষ্টান্ত। আল্লাহ তা’আলা যখন কোনো বান্দাকে মুহববত করেন তখন জিবরীলকে ডেকে বলেন, জিবরীল! আমি অমুক বান্দাকে মুহববত করি, তুমিও তাকে মুহববত করো। জিবরীল আ. তাকে মুহববত করেন আর আসমানবাসীকে বলে দেন যে, আল্লাহ অমুক বান্দাকে মুহববত করেন তোমরাও তাকে মুহববত করো। এরপর আসমানবাসীও তাকে মুহববত করা আরম্ভ করে। অতঃপর যমীনেও তার প্রতি মুহাববত ও ভালবাসা ঢেলে দেওয়া হয়। (মুসলিম শরীফ)
নূরের জ্যোতিতে উদ্ভাসিত, তাকওয়ার দীপ্তিতে উজ্জ্বল, ফেরেশতাতুল্য পবিত্রতায় স্নিগ্ধ, গায়ে শেরোয়ানী, মাথায় উজ্জ্বল রঙের পাগড়ি, চোখে চশমা, নিচু দৃষ্টি, হাতে একটি ঘনকালো রঙের যষ্টি -প্রতিদিন এভাবে রিকশায় চড়ে হাদীসে নববীর দরসে উপস্থিত হতেন। ছাত্রদের দেখলেই নিজে আগে সালাম দিতেন। দারুল হাদীসে প্রবেশের পর লাউড স্পীকারে সালাম করতেন। অতঃপর গাম্ভীর্যের সাথে দরস দিতেন। কখনও মুচকি হাসতেন; তখন মনে হতো জান্নাতি নূরের একটুখানি ঝলক এখানে ছড়িয়ে গেল!
দরস ছিল সাবলীল ও প্রাঞ্জল; জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় পরিপূর্ণ। পঁচান্নববই বছর বয়সেও তাঁর কণ্ঠস্বর ছিলো সুস্পষ্ট ও জোরালো। নববী হাদীসের ‘দ্যুতি’ ছড়িয়ে দিয়ে দারুল হাদীস থেকে যখন বের হতেন তখন তালিবে ইলমরা তাঁর পেছনে পেছনে যেত; যেন প্রজ্জ্বলিত প্রদীপের পেছনে ছুটে চলছে ‘আলোক প্রেমিক’ পতঙ্গ! রিকশায় উঠে উপস্থিত ছাত্রদেরকে আবার একবার সুমধুর কণ্ঠে সালাম দিয়ে রওয়ানা হতেন। শ্রোতারা সালামের জওয়াব দিত এবং মুগ্ধ দৃষ্টিতে শুধুই তাকিয়ে থাকত তাঁর গমনপথের দিকে।
আলাপচারিতায় ছিল মিষ্টতা ও হৃদ্যতা। খুবই কম কথা বলতেন, তবে যা বলতেন তা হতো হৃদয়গ্রাহী। যেন নববী আদর্শের মূর্তপ্রতীক! খাছ মজলিসেও কখনও কারো গীবতের শব্দও মুখে নিতেন না এবং কারো মুখে তা শুনতেও পছন্দ করতেন না।
তাঁর তিনি ছিলেন বিনয়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কখনও কোনো ভুল হয়ে গেলে সবার সামনে দাঁড়িয়ে দোষ স্বীকার করে নিতেন। এমন কি প্রাতিষ্ঠানিক আইনের আওতায় কারো উপর কোনো কড়াকড়ি হয়ে গেলে পরবর্তীতে তাকে সান্ত্বনা দিতেন এবং নিজের অপারগতার কথা বলে ওজরখাহী করতেন। তিনি বড় ছিলেন, কিন্তু বড়ত্বের প্রকাশ তাঁর আচরণে ছিল না।
দারুল উলূম দেওবন্দের খেদমত ও উন্নতিই ছিল তাঁর জীবনসাধনা। একসময় দারুল উলূমে একটি হাঙ্গামা হয়েছিল। তখন তিনি খুবই বিচলিত হলেন এবং নারাজ হলেন। যে-সব ছাত্র ওই হাঙ্গামায় জড়িত ছিল প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা ও ভাবমূর্তি রক্ষার্থে তাদেরকে সাথে সাথে বহিষ্কার করার নির্দেশ দিলেন। সব সময় মাদরাসার সুনাম ও কল্যাণের প্রতি তাঁর নজর ছিল। তিনি বলতেন, দারুল উলূম উম্মতের মীরাছ, জাতির সম্পদ, এর হেফাজত করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য।
তিনি শায়খুল ইসলাম হযরত মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর হাতে বায়আত ছিলেন। মাদানী রহ. এর ইন্তেকালের পর হাকীমুল ইসলাম হযরত মাওলানা ক্বারী তাইয়েব রহ. এর হাতে বায়আত হন এবং তাঁর ইজাযত ও খেলাফত লাভে ভূষিত হন।
বিবাদ-বিসংবাদ থেকে অনেক দূরে ছিলেন। বিভক্তি ও কোন্দল আদৌ পছন্দ করতেন না। সম্পূর্ণ প্রচারবিমুখ ছিলেন। কোনো সভা সম্মেলনে যেতেন না। রাত-দিন একাগ্রচিত্তে দারুল উলূমের কাজ-কর্মে, দরস-তাদরীসে মশগুল থাকতেন। হযরত মাদানী রহ.-এর বিশিষ্ট শাগরিদ ও মুরীদ হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক কোনো মঞ্চে তাঁকে দেখা যেত না। শেষজীবন পর্যন্ত এরূপ একাগ্র ও একনিষ্ঠ ছিলেন।
বছরের শুরুতে দারুল উলূম দেওবন্দের আসাতিযাদের বিশেষ খেতাব করতেন, যা হতো সারগর্ভ ও প্রজ্ঞায় ভরপুর। আসাতিযায়ে কেরাম তাতে পেতেন গোটা বছরের পাথেয়। বছরের শেষে খত্মে বোখারী অনুষ্ঠানে বিদায়ী ছাত্রসহ উপস্থিত সকলকে মূল্যবান নসীহত করতেন। তাঁর নসীহতে ছিল রূহ, উপদেশে ছিল প্রাণ, তাই তা হত নয়া জীবনদানকারী, আমলের মোড় পরিবর্তনকারী। তাঁর বিনয়-নম্রতা, ধৈর্য-সহনশীলতা, তাকওয়া ও খোদাভীরুতা লিখে শেষ করা যাবে না।
আল্লাহ তাআলা উভয় অভিভাবককে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন, আখেরাতে তাঁদের দরজা বুলন্দ করুন এবং আমাদের সবাইকে সবর করার এবং তাঁদের পথে চলার তাওফীক দান করুন। আমীন।
(তথ্যসূত্র: উর্দূ মাসিক দারুল উলূম দেওবন্দ ও আরবী মাসিক আদ্দাঈ, ইন্টারনেট সংস্করণ।)