যিলহজ্ব ১৪৪৪   ||   জুলাই ২০২৩

সালাফের হজ্ব : কিছু ঘটনা কিছু শিক্ষা

মাওলানা মুহাম্মাদ তাহের বিন মাহমুদ

হজ্ব ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। হজ্ব মুমিন জীবনের সাধ, মুমিন জীবনের স্বপ্ন। আল্লাহর সাথে বান্দার সম্পর্কের এক বিশেষ আমল। আপন রবের সামনে আবদিয়্যাত ও দাসত্ব প্রকাশের এক বিশেষ আয়োজন। হজ্বের আমলের ক্ষেত্রে সালাফের বিভিন্ন হাল-অবস্থা, মন্তব্য-অনুভূতি, আমল-ইবাদত, শিক্ষণীয় বিভিন্ন ঘটনা থেকে আলো লাভের উদ্দেশ্যেই আজকের এ আয়োজন।   

আশা করি, যারা হজ্বে গিয়েছেন বা  যাবেন সকলেই এ থেকে উপকৃত হবেন।

হাজ্বীদের খেদমত

এলাকার সকল হাজ্বীর খরচ বহন

১. আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক রাহ. সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, তিনি যখন হজ্জের সফরের ইচ্ছা করতেন তখন তাঁর এলাকা মার্ভ-এর বাসিন্দাদের একত্রিত করে বলতেন, তোমাদের কে কে এবার হজ্বে যাবে?

যারা হজ্জে যাওয়ার কথা জানাত তাদের থেকে তাদের হজ্জের খরচাদি বাবদ জমা অর্থ নিজের কাছে নিয়ে নিতেন। সেগুলো একটি সিন্দুকে রেখে সিন্দুক তালা দিয়ে দিতেন। অতঃপর নিজ খরচে এলাকার সব হজ্বযাত্রীদের নিয়ে হজ্বের উদ্দেশে বের হতেন। সফরে মুক্তহস্তে উদারচিত্তে তাদের পেছনে খরচ করতেন। উন্নত মানের খাবারের ব্যবস্থা করতেন। মক্কা থেকে বিভিন্ন হাদিয়া-তোহফা কিনে দিতেন। এলাকায় ফিরে একটি দাওয়াতের আয়োজন করতেন। এরপর সিন্দুক খুলে প্রত্যেকের জমানো টাকা যার যার কাছে ফিরিয়ে দিতেন।

দ্রষ্টব্য : তারীখে বাগদাদ ১/১৫৮; সিয়ারু আলামিন নুবালা ৭/৩৬৯; লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ৫১৭

২. নিজ শাগরিদের খেদমত

মুজাহিদ রাহ. বলেন, আমি (হজ্ব ও অন্যান্য) সফরে আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর সঙ্গী হতাম এ উদ্দেশ্যে যে, তাঁর একটু খেদমত করার সুযোগ হবে। কিন্তু দেখা যেত উল্টো তিনি আমার খেদমত করছেন। -কিতাবুল জিহাদ, ইবনুল মুবারক ১/১৫৯; তারীখুল ইসলাম, যাহাবী ৩/১৪৮

৩. তিন শত উট হাজ্বীদের খেদমতে সুলাইমান ইবনে রাবী বলেন, আমি বসরার এক কাফেলার সাথে হজ্বের সফরে ছিলাম। হজ্বের পরে আমরা আব্দুল্লাহ ইবেন আমর রা.-এর সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করলাম। হঠাৎ আমরা উটের এক বিশাল বহর দেখতে পেলাম। একশত উট  যাত্রীবাহী ও দুই শত উট মালবাহী। আমরা লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম এ বহরটি কার?

তারা বলল, এটি আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা.-এর বহর।

আমরা জিজ্ঞেস করলাম, পুরোটিই কি তিনি নিয়ে এসেছেন।

তারা বলল হাঁ, পুরোটাই তাঁর।

আমরা প্রশ্ন করলাম, একজন বিনয়ী ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনকারী ব্যক্তি হয়েও তিনি কীভাবে এ বিলাসী বহর নিয়ে আসলেন?

তারা বলল আপত্তি কেন করছেন? যাত্রীবাহী উটগুলো তিনি তাঁর ভাই-বেরাদার ও পাড়া-প্রতিবেশী হাজ্বীদের যাতায়াতের কাজে নিয়োজিত রেখেছেন। আর মালবাহী উটগুলো দূর দূরান্ত থেকে আগত হজ্বযাত্রী ও মেহমানদের আহার ও আপ্যায়নের ব্যবস্থাপনার জন্য রেখেছেন।

বিষয়টি শুনে আমরা খুবই বিস্মিত হলাম।

তারা বলল, আশ্চর্যের কিছু নেই। আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ধনী ও সম্পদশালী লোক। তিনি তো মনে করেন, তাঁর কাছে আগত সকল হাজ্বীর মেহমানদারী করা তাঁর দায়িত্ব।

আমরা জিজ্ঞেস করলাম, তিনি কোথায় আছেন?

তারা বলল, মসজিদে হারামে অবস্থান করছেন।

আমরা তাঁকে খঁুজতে বের হয়ে দেখি, তিনি বাইতুল্লাহ্র পেছনে পাগড়ি ও দুটি চাদর পরে সাধারণ মানুষের মতো বসে আছেন। গায়ে কোনো জামা পর্যন্ত নেই। বামদিকে জুতাটি ঝুলিয়ে রেখেছেন। তাঁর এ অবস্থা দেখে আমাদের আরও ভুল ভাঙল। -মুসতাদরাকে হাকেম ৪/৫৭৭; হিলইয়াতুল আউলিয়া ১/২৯১

ইহরাম বাঁধা : ঈমান ও ইয়াকীনে পূর্ণ হৃদয়ের অনুভূতি

১. আলী ইবনুল হুসাইন যখন ইহরামের কাপড় পরে বাহনে উঠে বসলেন তখন ভয়ে তাঁর চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তিনি কাঁপছিলেন। ভয়ের আতিশয্যে তালবিয়া পর্যন্ত পড়তে পারছিলেন না। জিজ্ঞেস করা হল, আপনার কী হল, তিনি বললেন-

أخشى أن يقول لي: لا لبيك ولا سعديك.

আমার ভয় হচ্ছে, আমি লাব্বাইক (হে আল্লাহ! আমি হাজির) বললাম আর এর উত্তরে বলা হল, লা লাব্বাইক ওয়া লা সাদাইক (তুমি হাজির নও, তুমি ভাগ্যবান নও)।

আবার তালবিয়া পাঠের চেষ্টা করলেন; কিন্তু এবার উট থেকে পড়ে বেহুঁশ হয়ে গেলেন। শরীরে প্রচণ্ড আঘাত পেলেন। পুরো হজ্বজুড়ে তাঁর মধ্যে এ ভয় কাজ করে। -তারীখে দিমাশক ৪১/৩৭৮; সিয়ারু আলামিন নুবালা ৪/৩৯২; তারীখুল ইসলাম, যাহাবী ২/১১৪৪

২. মালিক বিন দিনার রাহ. ইহরামের কাপড় পরে তালবিয়া পড়তে চাইলেন, কিন্তু ভয়ে তিনি উট থেকে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে আবারো তালবিয়া পড়তে চাইলেন, এবারও পড়ে জ্ঞান হারালেন। বলা হল কী হল আপনার?

তিনিও বললেন-

أخشى أن أقول لبيك، فيقول ولا سعديك.

আমার ভয় হচ্ছে, আমি লাব্বাইক বললাম, আর এর উত্তরে বলা হল, লা সাদাইক (তুমি ভাগ্যবান নও) -তারীখে দিমাশক ৫৬/৪১২; তারীখুল ইসলাম, যাহাবী ৬/২৪৮

৩. কাজী শুরাইহ রাহ.-এর ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে-

وكان شريح القاضي إذا أحرم كأنه حيّة صماء من كثرة الصمت والتأمل والإطراق لله عز وجل.

কাজী শুরাইহ রাহ. যখন ইহরাম বাঁধতেন তখন এত চুপচাপ, চিন্তামগ্ন ও আল্লাহমুখী থাকতেন যে, তাঁকে বধির সাপের মত মনে হত; যেন আশপাশের কোনো কিছু শুনতে পান না। -আততবাকাতুল কুবরা, ইবনে সাদ ৬/১৯০; সিয়ারু আলামিন নুবালা ৪/১৪০

আরাফার মাঠে অবস্থান

কান্না ও রোনাজারির চিত্র

১. হাকীম ইবনে হিযাম রা. এক শত পশু ও এক শত গোলাম সাথে নিয়ে আরাফার মাঠে অবস্থান করতেন। তিনি (পশুগুলোকে আল্লাহর রাস্তায় জবাই করে দিতেন আর) গোলামগুলোকে আযাদ করে দিতেন। তাঁর অবস্থা দেখে মানুষ দু্আ ও কান্নায় লুটিয়ে পড়ত আর বলত-

ربنا هذا عبدك، قد أعتق عبيدَه، ونحن عبيدك، فأعتقنا من النار.

হে আমাদের রব! সে (হাকীম ইবনে হিযাম) আপনার গোলাম হয়েও তাঁর গোলামদের মুক্ত করে দিয়েছে। আমরা আপনার গোলাম, আপনি আমাদেরকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দিন। -সিয়ারু আলামিন নুবালা ৩/৫০; লাতায়িফুল মাআরিফ ১/২৮৪

২. ফুযাইল ইবনে ইয়ায রাহ. আরাফার মাঠে স্বামীহারা অসহায় মহিলার ন্যায় ডুকরে কাঁদছিলেন। মানুষ দুআ-মুনাজাত করছিল। ফুযাইল রাহ. কান্নাকাটি করেই যাচ্ছিলেন। আরাফা থেকে প্রস্থানের সময় হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কান্নার প্রাবল্যে দুআ-মুনাজাত পর্যন্ত করতে পারছিলেন না। -সিয়ারু আলামিন নুবালা ৭/৪০০; লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ৬৩০

আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলী রাহ. বলেন-

وقف مطرف بن عبد الله وبكر المزني بعرفة، فقال أحدهما: اللهم لا ترد أهل الموقف من أجلي.

وقال الآخر: ما أشرفه من موقف وأرجاه لإله، لولا أني فيهم.

বকর আলমুযানী ও মুতাররিফ ইবনে আব্দুল্লাহ আরাফায় অবস্থান করছিলেন। তাদের একজন বলছিলেন, হে আল্লাহ! মেহেরবানী করে আমার কারণে আরাফায় অবস্থানকারীদের ক্ষমার বারিধারা থেকে বঞ্চিত করবেন না।

অপরজন বললেন, কত না মহিমান্বিত স্থান। সকলের ক্ষমাপ্রাপ্তির জন্য কত আশাব্যঞ্জক পরিবেশ, যদি আমি এখানে না থাকতাম!! -লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ৬৩০

আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাতের ইয়াকীন ও বিশ্বাস

১. আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক রাহ. বলেন, আরাফার দিন সন্ধ্যায় আমি সুফিয়ান ছাওরী রাহ.-এর নিকট এলাম। তিনি উবু হয়ে বসা ছিলেন। তাঁর চোখ দিয়ে অশ্রম্ন ঝরছিল। আমাকে দেখে ফিরে তাকালেন। আমি বললাম-

من أسوأ هذا الجمع حالاً؟

এ মাজমায় সবচেয়ে হতভাগা কে?

তিনি বললেন-

الذي يظنُّ أن الله لا يغفر له.

যে ধারণা করে, আল্লাহ তাআলা আজকের দিনেও তাকে ক্ষমা করবেন না। -হুসনুয যান্নি বিল্লাহ, ইবনে আবিদ্দুনইয়া, পৃ. ৯২; লাতায়িফুল মাআরিফ ১/২৮৭

২. ফুযাইল ইবনে ইয়ায রাহ. আরাফার দিন সন্ধ্যায় মানুষের কান্নাকাটি ও রোনাজারীর দৃশ্য দেখে বললেন, তোমাদের কি মনে হয়, এ লোকসকল যদি কোনো ব্যক্তির কাছে গিয়ে দানিক (এক দিরহামের  ছয় ভাগের এক  ভাগ) পরিমাণ কোনো বস্তু চায়, তবে কি সে তাদেরকে তাড়িয়ে দেবে?

তারা বলল, না (এত ক্ষুদ্র জিনিস থেকে এ বড় জমায়েতকে) তাড়িয়ে দেবে না। তিনি বললেন-

واللهِ لَلْمغفرةُ عند الله أهونُ من إجابة رجل لهم بدانق.

আল্লাহর শপথ, দানিক পরিমাণ বস্তু তাদেরকে দানের চেয়েও আল্লাহ তাআলার কাছে তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া আরও ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ বিষয়। (অতএব এটি কীভাবে বিশ্বাস কর যে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করবেন না।) -আলমাজমু, নববী ৬/১১৬; লাতায়িফুল মাআরিফ ১/২৮৭

আলী ইবনুল মুওয়াফফাক রাহ. সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে-

حج علي بن الموفق ستين حجة، قال فلما كان بعد ذلك جلست في الحجر، أفكر في حالي وكثرة تردادي إلى ذلك المكان، ولا أدري هل قبل مني حجي أم رد! ثم نمت فرأيت في منامي قائلا يقول لي: هل تدعو إلى بيتك إلا من تحب! قال: فاستيقظت وقد سرى عني.

আলী ইবনুল মুওয়াফফাক জীবনে মোট ষাটটি হজ্ব করেন। তিনি বলেন- ষাটতম হজ্বের পর আমি বসে নিজের অবস্থা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছিলাম। চিন্তা করছিলাম, অধিক পরিমাণে আল্লাহর ঘরে আসা তো হল, কিন্তু  জানি না এ আসা কবুল হয়েছে কি না? এরপর ঘুমিয়ে গেলাম। স্বপ্নে দেখলাম, কেউ একজন আমাকে বলছে, আরে! তুমি তো তোমার ঘরে কেবল তাকেই দাওয়াত কর, যাকে তুমি পছন্দ কর-ভালবাস।

(আল্লাহ আতালা যেহেতু তোমাকে তার ঘরে আসতে দিয়েছেন, তাই তিনি তোমার হজ্বও কবুল করেছেন ইনশাআল্লাহ) এরপর আমি সজাগ হলাম। লোকটির পরিচয় বা অন্য কিছুই আমি আর বলতে পারি না। -তারীখে বাগদাদ ১৩/৫৯৮; লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা ১৬২

আল্লাহর ঘরে এসে অন্যের কাছে চাইব?!

হযরত ওমর রা.-এর দৌহিত্র সালিম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. তাওয়াফ করছিলেন। এসময় তাঁর পাশে মাতাফে তৎকালীন শাসক হিশাম ইবনে আব্দুল মালেক অবস্থান করছিলেন। ওমর রা.-এর নাতির দিকে চোখ পড়তেই হিশাম তাঁর দিকে ছুটে এলেন এবং তাঁর হাত ধরে বললেন, হে সালিম, তোমার কোনো প্রয়োজন থাকলে বল। সালিম রাহ. সাথে সাথে বলে উঠলেন-

إنَّنِي أستحيي من الله تبارك وتعالى أن أسأل في بيت الله غيره.

(হে আমিরুল মুমীনিন!) আল্লাহর ঘরে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে চাইতে লজ্জা হয়। -তারীখে দিমাশক ২০/৬৪; সিয়ারু আলামিন নুবালা ৪/৪৬৬

অন্য বর্ণনায় এসেছে সালিম রাহ. এক ব্যক্তিকে আরাফার মাঠে মানুষের কাছে ভিক্ষা করতে দেখে বললেন-

أي عاجز أفي هذ اليوم تسأل غير الله؟

হে অথর্ব! আজকের দিনেও তুমি আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে চাইছ? -তারীখে দিমাশক ৪৮/৪০১; আততামহীদ ১/১২৯; আলআযকার, নববী ২/৪০০

বারবার হজ্বের তামান্না

সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা রাহ.-এর ভাতিজা হাসান বিন ইমরান বলেন, আমি ১৯৭ হিজরীতে চাচাজানের সাথে তাঁর সর্বশেষ হজ্বের সফরে ছিলাম। আমরা যখন মুযদালিফায় অবস্থান করছিলাম, চাচাজান নামায পড়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বললেন-

قد وافيت هذا الموضع سبعين عاما أقول في كل سنة: اللهم! لا تجعله آخر العهد من هذا المكان، وإني قد استحييت من الله من كثرة ما أسأل ذلك.

এ মুবারক জায়গায় উপস্থিতির সত্তর বছর পূর্ণ হল। প্রতি বছরই আল্লাহর কাছে এই দুআ করি, আল্লাহ এটাই  যেন আমার এখানে উপস্থিতির শেষ বছর না হয়। এবার আমার এ কথা বলতে সঙ্কোচ হচ্ছে।

তিনি এভাবেই ফিরে যান এবং এ বছরই ১৯৮ হিজরীতে মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। -আততবাকাতুল কুবরা, ইবনে সাদ ৬/৪১; সিয়ারু আলামিন নুবালা ৮/৪৬৫; তারীখুল ইসলাম, যাহাবী ৪/১১০

হজ্ব অবস্থায় বা হজ্বের পরপরই মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা

১. খাইছামা ইবনে আব্দুর রহমান বলেন-

كان يعجبهم أن يموت الرجل عند خير يعمله، إما حج، وإما عمرة، وإما غزوة.

তাঁরা (সাহাবী-তাবেয়ীগণ) আকাক্সক্ষা করতেন যে, কোনো ভালো আমল যেমন হজ্ব, ওমরা বা জিহাদ অবস্থায় যেন তাদের মৃত্যু হয়। -হিলইয়াতুল আউলিয়া ৪/১১৫

২. মুহাম্মাদ ইবনে ইউছুফ, হাকাম ইবনে বুরদার নিকট এ কথা লিখে পাঠালেন-

يا أخي! اتق الله الذي لا يطاق انتقامه ... إن استطعت أن تختم عمرك بحجة فافعل، فإن أدنى ما يروى في الحاج أنه يرجع كيوم ولدته أمه.

হে আমার ভাই! আল্লাহকে ভয় কর, যার পাকড়াও বড় কঠিন। ...যদি সম্ভব হয় হজ্বের মাধ্যমেই তোমার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাবে, তাহলে তাই করবে। কারণ হজ্বকারীর ব্যাপারে ন্যূনতম যে ফযীলত বর্ণিত হয়েছে তা হল, হজ্বকারী নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে বাড়িতে ফেরে। -হিলইয়াতুল আউলিয়া ৮/২৩২

মক্কা ও হরম এলাকার প্রতি সম্মান

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর দুটি তাঁবু ছিল। একটি হরম এলাকায়, অপরটি হিলে। হরম এলাকায় অবস্থিত তাঁবুতে নামায পড়তেন। আর হিলে অবস্থিত তাঁবুতে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক প্রয়োজন সারতেন। কেউ তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন-

إن مكة مكة.

ভাই, এটি মক্কা, এটি মক্কা। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৩/২৬৮

তাল্ক ইবনে হাবীব বলেন, উমর রা. বলেন, আমার কাছে মক্কার বাইরে দশটি পাপ করার চেয়ে  মক্কার ভেতর একটি পাপ করা গুরুতর মনে হয়। -শুয়াবুল ঈমান, বাইহাকী ৫/৪৬৪

হজ্বের সফরে ইবাদত-বন্দেগী

১. মাসরূক রাহ. সম্পর্কে বর্ণিত  হয়েছে-

حَجّ مَسروقٌ فَمَا نَامَ إلاّ سَاجدًا.

মাসরূক রাহ. হজ্বের দিনগুলোতে ঘুমাতেন না; তবে সিজদারত অবস্থায় ছাড়া। (অর্থাৎ সারা রাত্র ইবাদতে কাটিয়ে দিতেন; কখনো সিজদায় গিয়ে ঘুম এসে যেত। ওইটুকুই ছিল তার ঘুম।) -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৭/১৪৭

২. যামরা ইবনে রবীআ ইমাম আওযায়ী রাহ. সম্পর্কে বলেন-

حَججنا مع الأوزاعي سنة خمسين ومائة، فما رأيته مضطجعًا في المحمل في ليل ولا نهار قط، كان يصلي...

আমি ইমাম আওযায়ী রাহ.-এর সাথে হজ্ব করেছি। দিনে বা রাতে কখনোই তাঁকে ঘুমাতে দেখা যায়নি। সারাক্ষণ নামায পড়তেন। -তারীখে দিমাশক ৩৫/১৯৫; সিয়ারু আলামিন নুবালা ৭/১১৯

৩. মুহাম্মাদ ইবনে ইসহাক আব্দুর রহমান ইবনুল আসওয়াদ সম্পর্কে বলেন-

قدم علينا عبد الرحمن بن الأسود حاجًّا، فاعتلت إحدى قدميه، فقام يصلي حتى أصبح على قدم، فصلى الفجر بوضوء العشاء.

মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক  বলেন, আব্দুর রহমান ইবনুল আসওয়াদ হজ্বের সফরে আমাদের কাছে এলেন। তাঁর একটি পায়ে অসুখ ছিল। এতদসত্ত্বেও তিনি এক পায়ে ভর করে ফজর পর্যন্ত নামায পড়লেন। এবং এশার ওযু দিয়ে ফজরের নামায আদায় করলেন। -তারিখে দিমাশক ৩৪/২৩১; তাহযীবুত  তাহযীব ৬/১৪০; সিয়ারু আলামিন নুবালা ৫/১২

এই ঘটনাগুলো থেকে হজ্বের সফরে ইবাদতের প্রতি মনোযোগী হওয়ার শিক্ষা পাওয়া যায়। তবে সুস্থতার প্রতি লক্ষ্য রাখাও জরুরি। কারণ হজ্বের সফরে অন্যান্য ফরয ইবাদাতের পাশাপাশি হজ্বই মূল আমল। আর তার জন্য সুস্থতা অপরিহার্য।

 

 

advertisement