আরবলীগের জেদ্দা সম্মেলন ও সোনায় মোড়ানো জিলাপি
আরবলীগের জেদ্দা সম্মেলনে বাশার আলআসাদ
বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের মনে প্রশ্ন
মে ২০১২ সালে আলকাউসারে ‘আরববিশ্বে জিহাদের প্রত্যাবর্তন’ শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে জানা গিয়েছিল, পুরো আরববিশ্ব সিরিয়া ও তার শাসক বাশার আলআসাদের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়েছে। এবং তার বিরুদ্ধে পরিচালিত সামরিক অভিযানকে জিহাদ আখ্যা দিচ্ছে। যদিও ইতিপূর্বে দীর্ঘদিন থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে (বর্তমানের মতো) জিহাদ শব্দ প্রায় অনুচ্চারিতই হয়ে গিয়েছিল। এমনকি মসজিদের খতীবগণও কুরআন মাজীদের জিহাদের আয়াতগুলো এবং এ বিষয়ক হাদীসগুলো এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু তখন রাতারাতি পরিস্থিতি পাল্টে দেওয়া হয়েছিল। হারামাইনসহ মসজিদে মসজিদে জিহাদের ফযীলতের ওয়াজ এবং সিরিয়ার বিরুদ্ধে যৌথ অভিযানকে জিহাদ আখ্যাদান তখনকার নিয়মিত ঘটনা ছিল।
যাইহোক, এরপর গত হয়ে গেছে অনেক বছর। কথিত সে জিহাদে প্রাণ হারিয়েছে লাখো মানুষ। আহত ও ঘরবাড়ি ছাড়া হয়েছেন বহু লোক। কিন্তু আরবের রাজা-বাদশাহগণ এবং আন্তর্জাতিক শক্তি মিলে বাশার আলআসাদের টিকিটিও নাড়াতে পারেনি। পরিহাসের বিষয় হল, এত কিছুর পরে এসে এখন বাশার হয়ে গেছেন সেই আরব নেতাদের প্রাণের বন্ধু। তাঁকে বিশেষভাবে আনা হয়েছে জেদ্দায় অনুষ্ঠিত আরব লীগের শীর্ষ বৈঠকে। জানানো হয়েছে রাজকীয় অভ্যর্থনা। সঙ্গত কারণেই বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছে, তাহলে কি বাশার আলআসাদ তাওবা করে ভালো মানুষ হয়ে গেছেন? তিনি কি তার নাগরিকদের ওপর বর্বরতম জুলম-নির্যাতন করার জন্য অনুতপ্ত হয়েছেন? ভবিষ্যতে এমনটি করবেন না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন? কার্যত এমন কিছুই ঘটেনি। তাহলে কী কারণে এত বনী আদমের হত্যা ও ক্ষয়ক্ষতি করা হল? কেন ক্ষমতার আধিপত্যকে জিহাদ নামে অবহিত করা হল? শুধুই কি অস্ত্র কেনা-বেচা, সামরিক মহড়া, আঞ্চলিক আধিপত্য, না আরও কিছু? আজকের তথাকথিত সভ্য পৃথিবীতে এসেও আরব ও পশ্চিমা নেতারা যে শিশুদের খেলনার মতো তামাশা করে যুদ্ধে লাগিয়ে দেন আবার কিছুদিন পর শিশুদের মতোই সবকিছু ছেড়ে আগের জায়গায় চলে যান— এর আরেকটি নজির হল, সিরিয়া ও বাশার আলআসাদের ঘটনা।
সাদ্দামের কাছে বিশেষ মারণাস্ত্র রয়েছে বলে লক্ষ ইরাকীকে হত্যা করা এবং একটি সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যবাহী রাষ্ট্রকে সমূলে ধ্বংস করে দেওয়ার পর তারাই স্বীকার করে নিল যে, আসলে এমন কোনো মারণাস্ত্র ছিল না। এরপর ধ্বংস করা হল লিবিয়া, ইয়ামানসহ বহু ঐতিহাসিক আরব নগরী ও দেশকে। অবশ্য সম্ভবত এখন ইয়ামান যুদ্ধ থেকেও পালাবার পথ খুঁজছেন এমবিএস খ্যাত সৌদি যুবরাজ। এভাবেই তাদের কাছে মুসলমানদের জানমাল ও দেশ ক্ষমতার বলি হয়ে থাকছে যুগ যুগ থেকে। কিন্তু এ অন্ধকার আর কত দিন? আর কত দিন সা¤্রাজ্যবাদী বিশ্ব ও তাদের দোসর ও তল্পিবাহক আরব আজমের মুসলিম নেতা-নেত্রীরা মানুষের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু নিয়ে খেলবে? নিশ্চয় অনন্তকাল নয়। অন্ধকার কেটে যাবে একদিন। জালেমদের পতন তো অবশ্যম্ভাবী। শুধু মুসলমানদের সত্যিকারের মুমিন হওয়া এবং জেগে ওঠার অপেক্ষায়।
ইফতারে সোনায় মোড়ানো জিলাপি
কেন এজাতীয় বিলাসিতা?
রমযানুল মুবারক আসে বিশ্ব মুসলিমের জন্য শান্তি ও বারাকাহ্র পয়গাম নিয়ে। কুরআন কারীমের ঘোষণা অনুযায়ী রোযার প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে তাকওয়া ও সংযম অর্জন। কিন্তু আফসোসের সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিগত কয়েক বছর থেকে অভিশপ্ত পুঁজিবাদের দোসররা এই তাকওয়ার রমযানকেও তাদের অন্যতম পুঁজি বানিয়ে ফেলেছে। এখন রোযা আসার পূর্বেই ঘোষণা হতে থাকে, কোন্ তারকা হোটেলে ইফতারিতে কী কী মেনু থাকবে। সাহরীতে কী মেনু থাকবে। একটা বুফে ইফতার কিনলে সাথে কয়টা বুফে ইফতার ফ্রি পাওয়া যাবে? একটি সাহরী বুফের সাথে কয়টা সাহরী বুফে পাওয়া যাবে? এজাতীয় ব্যাপক প্রচারণায় শুধু ধনাঢ্য শ্রেণির লোকেরাই আকৃষ্ট ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না; বরং কিছু কিছু মধ্যম আয়ের লোকজনও এসবের ফাঁদে পা দিচ্ছে।
এই বুফে অফারগুলোর পেছনে মুসলমানরা বিলীন করছে— ইফতারির সময় দুআ কবুলের বিশেষ মুহূর্ত, জামে মসজিদগুলোয় জামাতে নামাযের সুন্দর পরিবেশ, সাহরীর সময়ে তাহাজ্জুদের বিশেষ সুযোগ।
ভেবে দেখা দরকার, এসব অফারের পেছনে কি শুধুই ব্যবসা, নাকি মুসলিম সমাজকে রমযানের তাকওয়া ও বারাকাহ অর্জন থেকে বিরত রাখার একটি কৌশল ও ষড়যন্ত্র। কিন্তু এসবের সাথে বিগত রমযানুল মুবারকে নতুন যোগ হয়েছে আরেকটি অরুচিকর কাণ্ড। যা নিয়ে প্রচার মাধ্যমে কিছুদিন তোলপাড় চলেছে। রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল তাদের ইফতার মেনুর সাথে বিশ হাজার টাকা কেজি জিলাপি বিক্রির ঘোষণা দিয়েছে। সে জিলাপির বৈশিষ্ট্য— তা বিশেষ ধরনের সোনায় মোড়ানো। ঘটনাটি শুধু অতটুকু থাকলে তো বোঝা যেত, এটি হয়তো অতি ধনির দুলালেরা কিনে নেবে। অন্যদের তাতে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। কিন্তু পরে দেখা গেল, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল পৃথক বিবৃতিতে জানিয়ে দিয়েছে, সোনায় মোড়ানো জিলাপি অর্ডার নেওয়া শেষ হয়ে গেছে। নতুন করে আর কোনো অর্ডার নেওয়া হবে না।
সমাজচিন্তকেরা অবাক-বিস্ময়ে এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। এক কেজি জিলাপি বিশ হাজার টাকা। জিলাপির গায়ে সোনা। তাও আবার প্রচার-প্রচারণা করে কেনাবেচা। এবং এটি এমন একটি দেশে, যেখানে বাস করে কোটি কোটি হতদরিদ্র মানুষ। যাদের অনেকের শুধু নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন নয়, বরং পান্তার জোগান দেওয়াই কঠিন বিষয়। তাই এটিকে অপচয় বললে খুব কমই বলা হয়। তারকা হোটেলগুলোতে এমনিতেই অপচয়ের কোনো শেষ নেই। কিন্তু এটি কি শুধু অপচয় ও বিলাসিতা, নাকি এক প্রকারের ছোটলোকি মানসিকতা? এই দেশে এই সমাজে ঘোষণা দিয়ে চার শ টাকার জিলাপিকে সোনায় মুড়িয়ে বিশ হাজার টাকায় বিক্রি করা— একধরনের অসুস্থ মানসিকতার পরিচায়ক নয় কি? আল্লাহ তাআলা ধনিক শ্রেণিসহ এদেশের সকল মানুষের মধ্যে শুভবুদ্ধি জাগ্রত করুন। সকলকে হেদায়েত দিন এবং অহেতুক কর্মকাণ্ড ও লোক দেখানো মানসিকতা পরিহার করার তাওফীক দিন।