যিলকদ-যিলহজ্ব ১৪২৮   ||   ডিসেম্বর ২০০৭

কুরবানীতে ‘সমাজ প্রথা’ বিষয়ক একটি প্রশ্ন ও তার উত্তর

মাননীয়, মুফতি সাহেব

মারকাযুদ্দাওয়া আল ইসলামিয়া, ঢাকা।

 

বিষয় : কুরবানী প্রসঙ্গে।

 

প্রশ্ন : জনাব, যথাযথ সম্মানপ্রদর্শনপূর্বক বিনীত নিবেদন এই যে, আমরা কাজলার পাড় অধিবাসী। নিম্নে স্বাক্ষরকারীগণ সমাজের পক্ষ হতে জানতে ইচ্ছুক যে, আমরা সামাজিকভাবে পূর্বপুরুষ হতে যেভাবে কুরবানী করে আসছি তা

শরীয়তসম্মত না। এ বিষয়ে সহীহ ফায়সালা মেহেরবানী করে লিখিতভাবে আমাদেরকে অবহিত করার অনুরোধ জানাচ্ছি।

১. আমরা সমাজে একত্রিতভাবে একক বা শরিকী হিসাবে গরু, বকরী ইত্যাদি কুরবানী দিয়ে থাকি। কুরবানীর গোশত অর্ধেক সমাজে দেওয়া হয় এবং বাকী অর্ধেক মাথা-কলিজাসহ কুরবানী দেনেওয়ালা মালিক নিয়ে যায়। সমাজে দেওয়া গোশত হতে প্রতি ঘরে সমানভাবে বণ্টন করে দেওয়া হয়। এতে কুরবানী দেনেওয়ালারাও সমাজের এক ভাগ পেয়ে থাকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সবার উপার্জন হালাল নাও হতে পারে। এমতাবস্থায় ঘরে ঘরে বণ্টকের গোশত আমরা সবাই খেতে পারি কি?

২. কুরবানী চামড়া অকশন বা ডাকে বিক্রি করে টাকা সমাজের মাতবর/সরদারগণ কয়েকদিন পরে কুরবানী দেনে ওয়ালাদের ডেকে বিভিন্ন মাদরাসা ও সমাজের ভিতর গরীব যারা আছে তাদেরকে কিছু কিছু দেওয়া হয় এবং অবশিষ্ট টাকা হতে সমান ভাগে ভাগ করে প্রত্যেক গরুওয়ালাকে দেওয়া হয়। হয়ত ৫০০ টাকা করে সবাইকে দিল। এর মধ্যে গরু রয়েছে ২০,০০০ টাকা, ১০,০০০ টাকা, ,০০০ টাকা ও ৬,০০০ টাকা দামের। এখন সবাইকে ৫০০ টাকা করে দেওয়া ঠিক হল কি বেঠিক হল, মাসআলা জানতে চাই? আর, কুরবানী জন্তুর চামড়া আমরা নিজেরাই ব্যবহার করতে পারি কি?

৩. অপর দিকে সমাজের লোক এটাও করছে যে, এলাকার মসজিদ-মাদরাসার জন্য মাসিক চাঁদা যারা দেয়, তাদের মধ্যে যারা বছরে বা মাসে চাঁদা আদায় করেনি বা বাকী আছে, এই সুযোগে তাদের বাকী টাকা পয়সা আদায় করে নেয়। কুরবানীর বিষয়ে এটাই সমাজের বন্ধন বা নিয়ম। এ সম্পর্কে শরীয়তের কী নির্দেশ, জানতে চাই।

অতএব, হুজুর সমীপে আমাদের আবেদন এই যে, কুরবানী প্রসঙ্গে উল্লেখিত বিষয় বা অবস্থার উপর অনুগ্রহ করে শরীয়ত মোতাবেক সঠিক মাসআলা অবগত করে বাধিত করতে হুজুরের সদয় মর্জি হয়।

আমরা যদি খুশিমত নিজ নিজ কুরবানী আলাদাভাবে করে সমাজের গরীব-দুঃখীদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ দিয়ে দেই তবে শরীয়ত মোতাবেক হবে কি?

 

নিবেদক

মুহা. আবদুল হান্নান

মুহা. আলী হোসেন,

মুহা. সালাহ উদ্দীন

উত্তর : জওয়াবের আগে ভূমিকাস্বরূপ কিছু বিষয় জেনে নেওয়া প্রয়োজন।

ভূমিকা

ক) কোনো এলাকায় যদি এলাকাবাসী সকল মুসলিম ঐক্যবদ্ধভাবে কোনো সামাজিক সংঘ গড়ে তোলেন তবে তা অত্যন্ত প্রশংসণীয় বিষয়। এই সংঘবদ্ধতার উদ্দেশ্য হবে তাআউন আলাল বির ওয়াত তাকওয়া অর্থাৎ পুণ্য ও খোদাভীতির কাজে পারস্পরিক সহযোগিতা, অসহায়, নিপীড়িত ও দুর্গত মানুষের সাহায্যে অগ্রসর হওয়া এবং শরীয়তের সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করে সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে বাঁধা প্রদান। এজন্য এ ধরনের সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি বা দায়িত্বশীলদের মধ্যে আলেম-উলামা ও যোগ্যতাসম্পন্ন দ্বীনদার ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত থাকা প্রয়োজন।

অন্তত আলিমদের নিকট প্রয়োজনীয় মাসাইল জিজ্ঞাসা করে, যাতে তাদের সংঘবদ্ধতার উদ্দেশ্য সফল হয়, দায়িত্বশীলগণ দায়িত্ব পালনে অগ্রসর হবেন একটুকু তো একান্ত জরুরি।

খ) মুসলমানদের বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যে তা-ই যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু অনেক সময় কিছু অতিউৎসাহী মানুষ এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের মধ্যে এমন কিছু বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত করে সম্মিলিতরূপ দিতে চান যেগুলোকে শরীয়ত ব্যক্তিগত পর্যায়ের কাজ সাব্যস্ত করেছে এবং ব্যক্তির ইচ্ছাস্বাধীনতার উপর ছেড়ে দিয়েছে।

এ ধরনের পদক্ষেপ ভালো নিয়তে ভুল পদক্ষেপ। আর শুধু নিয়ত ভালো হলেই কাজ ভালো হয় না। ভালো কাজ সেটাই যার পদ্ধতিটিও সঠিক। কোনো ঐচ্ছিক বিষয়কে অপরিহার্য বানানো, ব্যক্তিগতভাবে সম্পাদনযোগ্য বিষয়কে সম্মিলিত রূপ দেওয়া এবং তাতে সকলের অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা, সে মৌখিক ঘোষণার মাধ্যমে হোক বা বাধ্য-বাধকতার পরিস্থিতি সৃষ্টির মাধ্যমে, অনেকগুলো কারণে ভুল। যথা :

১. এ ধরনের উদ্যোগের মাধ্যমে শরীয়তের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। কেননা, শরীয়ত তো বিশেষ উদ্দেশ্যেই এ বিষয়গুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ে রেখেছে।

২. এর মাধ্যমে শরীয়ত-নির্দেশিত পন্থা পরিবর্তন করা হয়।

৩. শরীয়ত-নির্দেশিত পন্থা পরিবর্তনের অবশ্যম্ভাবী পরিণতিরূপে অনেক জটিলতা ও শরীয়তের দৃষ্টিতে নিন্দিত অনেক বিষয়ের অবতারণা ঘটে। এসব জটিলতা এড়ানোর একমাত্র পদ্ধতি হচ্ছে, শরীয়ত যে বিষয়কে ইনফিরাদী বা ব্যক্তিপর্যায়ে রেখেছে তাকে সম্মিলিতরূপ না দেওয়া এবং যে কাজ ঐচ্ছিক রেখেছে তাকে অপরিহার্য না করা।

গ. কুরবানী একটি ইনফেরাদী তথা ব্যক্তিগতভাবে আদায়যোগ্য আমল। ঈদের দিন সম্মিলিতভাবে জামাতে নামায আদায় করতে বলা হয়েছে, কিন্তু কুরবানীর পশু কোথায় জবাই করবে, গোশত কীভাবে বণ্টন করবে এ বিষয়গুলো শরীয়ত সম্পূর্ণরূপে কুরবানীদাতার ইচ্ছা-স্বাধীনতার উপর ছেড়ে দিয়েছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের নামাযের জন্য ঈদগাহে একত্রিত হতে বলেছেন, কিন্তু কুরবানীর পশু জবাই করার জন্য কোনো বিশেষ স্থান নির্ধারণ করেননি বা সবাইকে বিশেষ কোনো স্থানে একত্রিতও হতে বলেননি। গোশতের ব্যাপারে বলেছেন, নিজে খাও, অন্যকে খাওয়াও, দান কর এবং ইচ্ছা হলে কিছু সংরক্ষণ কর। তিনি সাহাবায়ে কেরামকে একথা বলেননি যে, তোমরা গোশতের একটি অংশ আমার কাছে নিয়ে আস আমি তা বণ্টন করে দিব কিংবা এই আদেশও দেননি যে, তোমরা নিজেদের এলাকা ও মহল্লার কুরবানীর গোশতের একটি অংশ একস্থানে জমা করবে এবং এলাকার নেতৃস্থানীয় লোকেরা তা বণ্টন করবে।

 

এ প্রসঙ্গে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করছি।

১.  উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন, একবার গ্রাম থেকে অনেক গরীব মানুষ ঈদুল আযহার সময় শহরে এসেছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা কুরবানীর গোশত তিনদিন পর্যন্ত রাখতে পারবে। এরপর যা উদ্বৃত্ত থাকবে তা সদকা করে দিবে। পরের বছর কুরবানীর সময় বললেন, আমি সেবার গরীব মানুষের উপস্থিতির কারণে তোমাদেরকে নিষেধ করেছিলাম। এখন তোমরা নিজেরা খেতে পার, সংরক্ষণ করতে পার এবং দান করতে পার। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭১/২৮

আরো বলেছেন, তোমরা নিজেরা খাও, সফরে খাওয়ার জন্য প্রস্তুত করে রাখ এবং আগামীর জন্য সংরক্ষণ কর। -সহীহ বুখারী হাদীস ১৭১৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭২

২.  অন্য হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার বলেছিলেন, হে মদীনাবাসী, তোমরা তিনদিনের অধিক কুরবানীর গোশত খাবে না। (অর্থাৎ তিন দিন পর যা থাকবে তা দান করে দিবে) (পরের বছর) সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, অনেকের পরিবারে সদস্য-সংখ্যা বেশি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা খাও, অন্যকে খাওয়াও এবং সংরক্ষণ করে রাখ। আমি সে সময় ওই কথা এজন্য বলেছিলাম যে, মানুষের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র বেশি ছিল। এজন্য গরীব লোকদের সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৭৩-১৯৭৪; সহীহ বুখারী হাদীস ৫৫৬৯

৩.  অন্য হাদীসে এসেছে, কুরবানীর গোশত থেকে যে পরিমাণ ইচ্ছা তোমরা খাও, অন্যদেরকে খাওয়াও, সফরে পাথেয়রূপে সঙ্গে রাখ এবং যে পরিমাণ ইচ্ছা আগামীর জন্য সংরক্ষণ কর। -সুনানে নাসায়ী হাদীস ৪৪২৯-৪৪৩০; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫১০

৪.  আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কুরবানীর অবস্থা বয়ান করেন, তিনি কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ নিজের পরিবারের সদস্যদেরকে খাওয়াতেন, এক-তৃতীয়াংশ গরীব প্রতিবেশীদেরকে খাওয়াতেন এবং একতৃতীয়াংশ প্রার্থনাকারীকে দান করতেন। -আলওজাইফ, আবু মূসা আলমাদীনী, আলমুগনী, ইবনে কুদামা, ১৩/৩৭৯-৩৮০

ফিকহে হানাফীর প্রসিদ্ধ ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান রহ. তার হাদীসের সুপরিচিত কিতাব আলমুয়াত্তায় (পৃষ্ঠা : ২৮২) এই বিষয়ের হাদীসগুলো লিখেছেন যে, কুরবানীর গোশতের সদকার পরিমাণ যেন এক তৃতীয়াংশ থেকে কম না হয়। অবশ্য কেউ যদি এক-তৃতীয়াংশ থেকে কম সদকা করে তাহলে সেটা না জায়েযও হবে না। আর কুরবানীর চামড়ার ব্যাপারে শরীয়তের শিক্ষা নিম্নরূপ।

১. কুরবানীদাতা ইচ্ছা করলে তা দাবাগাত করে অর্থাৎ প্রক্রিয়াজাত করে নিজে ব্যবহার করতে পারবে। -মুসনাদে আহমদ ৪/১৫, হাদীস ১৬১৬৩; বাদায়েউস সানায়ে খণ্ড ৪ পৃষ্ঠা ২২৫; আলমুহাল্লা বিল আছার ৬/৫১-৫৩

২.  কিংবা পুরো চামড়া গরীব-মিসকীনকে, বিশেষত তারা যদি দ্বীনদার হয়, সদকা করতে পারবে। এটিই উত্তম। তাই কুরবানীদাতা স্বাধীনভাবে যাকে ইচ্ছা সদকা করতে পারে। কিন্তু চামড়া বা তার মূল্য দ্বারা কসাইকে পারিশ্রমিক দেওয়া সম্পূর্ণ না জায়েয। কসাইয়ের পারিশ্রমিক ভিন্ন অর্থ থেকে দিতে হবে। -ফাতহুল বারী ৩/৬৫০-৬৫১; আলমুহাল্লা ৬/৫১-৫৩

৩.  যদি একাধিক গরীব-মিসকিনকে চামড়ার মূল্য সদকা করতে চায় তবে এই উদ্দেশ্যে তা বিক্রিও করা যাবে। বিক্রি করার পর প্রাপ্ত অর্থ নিজ প্রয়োজনে ব্যবহার করা মোটেই জায়েয নয়। এই অর্থ যাকাত গ্রহণের উপযুক্ত গরীব-মিসকিনকে সদকা করে দেওয়া জরুরি।  -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৫; তাকমিলী ফাতহুল ক্বাদীর ৮/৪৩৬-৪৩৭; লাউস সুনান ১৭/২৫৪-২৬০

উপরোক্ত হাদীস ও মাসাইল থেকে পরিষ্কার হয়েছে যে, কুরবানীদাতা তার কুরবানীর গোশত কী পরিমাণ নিজে রাখবে, কী পরিমাণ অন্যকে খাওয়াবে, কী পরিমাণ সদকা করবে এবং কী পরিমাণ আগামীর জন্য সংরক্ষণ করবে এগুলো সম্পূর্ণ তার ইচ্ছার ব্যাপার। যে কুরবানীদাতার পরিবারের সদস্য-সংখ্যা বেশি তিনি যদি সব গোশত তার পরিবারের জন্য রেখে দেন তবে এটারও সুযোগ রয়েছে। তবে ক্ষুধা ও দারিদ্রের সময় গরীব-মিসকিন ও পাড়া প্রতিবেশীর প্রতি লক্ষ রাখা একদিকে যেমন মানবতার দাবি, অন্য দিকে তা একটি ঈমানী কর্তব্যও বটে। আর যার সামর্থ্য আছে তিনি যদি অল্প কিছু গোশত নিজেদের জন্য রেখে বাকি সব গোশত সদকা করে দেন তবে এটাও ভালো কাজ। মোটকথা, এই বিষয়টি শরীয়ত কুরবানীদাতার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দিয়েছে। এখানে অন্য কারো অনুপ্রবেশ অনুমোদিত নয়।

তদ্রূপ কুরবানীর চামড়ার বিষয়টিও শরীয়ত কুরবানীদাতার উপরই ছেড়ে দিয়েছে। কুরবানীদাতা শরীয়তের মাসআলা মোতাবেক যা ইচ্ছা তা করতে পারবে। এখানে অন্য কারো বাধ্যবাধকতা আরোপের কোনো অধিকার নেই।

ঘ. মাসাইল জানা না থাকার কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রশ্নোক্ত পদ্ধতিটি প্রচলিত হয়েছে। এতে দেখা যাচ্ছে, একটি ব্যক্তিগত ও ঐচ্ছিক বিষয়ে অঘোষিতভাবে এক ধরনের বাধ্যবাধকতা আরোপের কারণে নানা ধরনের অশোভনীয় ও আপত্তিকর বিষয়ের অবতারণা হচ্ছে। যথা;

১.  অনেক মানুষ নিজেদের বিবেচনামতো কুরবানীর গোশত নানাজনকে হাদিয়া কিংবা সদকা করতে চান। তদ্রূপ চামড়াও নিজের বিবেচনামত সদকা করতে চান। কিন্তু এই সামাজিক বাধ্যবাধকতার কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সামাজিক রীতি অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য হন, নিজের স্বাধীন বিবেচনামতো করতে পারেন না। অথচ কোনো মুসলমানের সম্পদ তার সন্তুষ্টি ব্যতীত অন্যের জন্য হালাল নয়। অথচ হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে, কোনো মুসলমানের সম্পদ তার মনের সন্তুষ্টি ব্যতিত হালাল নয়। -মুসনাদে আহমাদ; শুআবুল ঈমান

২.  অনেক মানুষ আছেন যারা প্রত্যেকের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে চান না। আর শরীয়তও কাউকে সকলের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে বাধ্য করেনি। কিন্তু সামাজিক বন্ধনের কারণে প্রত্যেকেই অন্য সকলের হাদিয়া বা সদকা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। বলাবাহুল্য, এ ধরনের বাধ্যবাধকতাহীন বিষয়াদিতে বাধ্যবাধ্যকতা আরোপ করা মোটেই দুরস্তনয়।

৩.  এ ধরনের ক্ষেত্রে বাধ্যবাধকতা আরোপের একটি ক্ষতি হল, সমাজের লোকজনের মধ্যে একটি গুঞ্জন সৃষ্টি হয় যে, অমুকের সম্পদ সন্দেহজনক, অমুকের আয়-রোযগার হারাম, কিন্তু তার কুরবানীর গোশতও সবাইকে খেতে হচ্ছে! ইত্যাদি। এখন এ জাতীয় কথাবার্তা শুধু অনুমান নির্ভর হোক বা বাস্তবভিত্তিক উভয় ক্ষেত্রেই এ ধরনের আলোচনা-সমালোচনা দ্বারা সমাজের মধ্যে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এবং ঝগড়া-বিবাদের সূত্রপাত ঘটে। এর দ্বারা একদিকে যেমন সমাজিক শান্তি-স্বস্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় অন্যদিকে কুধারণা, গীবত-শেকায়েত এবং হিংসা-বিদ্বেষের গোনাহে লিপ্ত হতে হয়। তাছাড়া বাস্তবিকই যদি সমাজের কিছু মানুষ এমন থাকে যাদের আয়-রোজগার হারাম পন্থায় হয় সেক্ষেত্রে জেনেবুঝে তাদের কুরবানীর গোশত সমাজের সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া যে একটি গোনাহর কাজ তাতো বলাই বাহুল্য।

৪.  প্রত্যেক এলাকায় গোটা সমাজের কুরবানীর গোশত কাটা এবং তা বণ্টনের বন্দোবস্ত করার জন্য উপযুক্ত জায়গা থাকে না। তখন স্বাভাবিকভাবেই কারো বাড়ির আঙ্গিনা বা বাংলা ঘর ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে প্রতিবছর বাড়ির মালিক তার বাড়িতে এসব কাজকর্ম করার জন্য খুশি মনে অনুমতি দিবেন এমনটি নাও হতে পারে। অনেক সময় তো এনিয়ে ঝগড়া-বিবাদও হতে দেখা যায়। কোনো কোনো স্থানে তো এমন কা-ও করা হয় যে, কোনো উপযুক্ত জায়গা না থাকায় মসজিদের মধ্যে এই কাজ আরম্ভ করা হয়-নাউযুবিল্লাহ। এর দ্বারা মসজিদের সম্মান ও পবিত্রতা কী পরিমাণ বিনষ্ট হয় তাতো খুব সহজেই অনুমেয়।

৫.  এরপর যেসব অঞ্চলে সমাজ প্রথা চালু আছে, সব অঞ্চলের গোশত গ্রহণ ও বণ্টনের পদ্ধতি এক নয়। বিভিন্ন পদ্ধতিতে এই কাজ করা হয়। প্রত্যেক পদ্ধতিতে ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা ও আপত্তিকর বিষয় বিদ্যমান রয়েছে। সবগুলো আলাদাভাবে উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। কেননা, উল্লেখিত আপত্তিগুলোই এই মূল পদ্ধতি বর্জণীয় হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। যদি এই প্রথায় ভিন্ন কোনো সমস্যা না-ও থাকে তবু এ সমস্যা তো অবশ্যই আছে যে, শরীয়তের দৃষ্টিতে যে বিষয়টি ব্যক্তিগত পর্যায়ের কাজ ছিল এবং কুরবানীরদাতার ইচ্ছা-স্বাধীনতার উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল তাতে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এই মৌলিক সমস্যাই উপরোক্ত প্রথা আপত্তিকর ও বর্জণীয় হওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।

এই সংক্ষিপ্ত ভূমিকার পর এবার উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর শুনুন।

১.  উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে জানা গেল যে, শরীয়তের শিক্ষা মোতাবেক প্রত্যেককে তার কুরবানীর বিষয়ে স্বাধীন রাখতে হবে। কুরবানীদাতা নিজ দায়িত্ব ও বিবেচনামতো যাকে যে পরিমাণ হাদিয়া করতে চায় করবে এবং গরীব-মিসকীনকে যে পরিমাণ সদকা করতে চায় করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় থেকে শত শত বছর যাবত এ পদ্ধতিই চলমান ছিল এবং এখনও সুন্নতের অনুসারী আলেম-উলামা ও দ্বীনদার মানুষের মধ্যে এই পদ্ধতিই চালু রয়েছে। এই পদ্ধতিই অবলম্বন করা জরুরি। বিশেষত এই ফিতনার যুগে নানামুখী ঝামেলা, মনোমালিন্য থেকে মুক্ত থাকার এটিই একমাত্র পন্থা এবং স্বাভাবিকভাবে সমাজের শান্তিপ্রিয় মানুষজনও এই পন্থা গ্রহণ করতে চান।

প্রশ্নে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে যে, কারো কুরবানীর অর্থ যদি হারাম হয় তবে সেই কুরবানী গোশত ঘরে ঘরে পৌঁছানো শরীয়তের দৃষ্টিতে কেমন? এর উত্তর স্পষ্ট। যদি সুনির্দিষ্টভাবে কারো সম্পর্কে জানা থাকে যে, বাস্তবিকই তার কুরবানী হারাম উপার্জন থেকে হয়েছে তাহলে জেনে বুঝে এই কুরবানীর গোশত হাদিয়া বা সদকা হিসেবে বণ্টন করা এবং ব্যবহার করা কোনোটাই জায়েয নয়। তবে কেবল ধারণা ও অনুমানের ভিত্তিতে কারো কুরবানীকে হারাম উপার্জনের বলে দেওয়া কোনোভাবেই উচিত নয়।

২.  কুরবানীর পশুর চামড়ার বিষয়টি উপরোক্ত বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে যে, এ প্রসঙ্গে উপরোক্ত রীতি অবশ্যই বর্জণীয়। এই বিষয়টিও কুরবানীদাতার ইচ্ছা ও বিবেচনার উপর ছেড়ে দিতে হবে। তিনি মাসআলা মোতাবেক যে সিদ্ধান্ত নিতে চান নিবেন। জুমা ও ঈদের দিন মসজিদ ও ঈদগাহে এ বিষয়টি মানুষদেরকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, কুরবানীর চামড়ার মূল্যের হক্বদার তারাই যারা যাকাতের হক্বদার এবং এই অর্থ সেসব ফকির-মিসকীনকে দেওয়াই উত্তম যারা দ্বীনদার কিংবা দ্বীনী শিক্ষা-দীক্ষার মধ্যে মশগুল আছে।

চামড়ার ব্যাপারে উপরে হাদীস শরীফের উদ্ধৃতিতে লেখা হয়েছে যে, কুরবানীদাতা তা নিজেও ব্যবহার করতে পারবে। তবে বিক্রি করলে এর অর্থ ফকির-মিসকীনের হক্ব হয়ে যায়। তাদের না দিয়ে এ টাকা কোনো ব্যক্তিগত কাজে কিংবা সামাজিক কাজকর্মে লাগানো জায়েয নয়।

৩.  চামড়ার পয়সা দ্বারা প্রশ্নোক্ত পদ্ধতিতে বকেয়া চাঁদা ইত্যাদি উসূল করাও জায়েয নয়। শুধু এতটুকুই ভাবুন, যে অর্থ সদকা করা জরুরি তা দিয়ে চাঁদা উসূল করা কীভাবে সঠিক হতে পারে?

প্রশ্নের শেষে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, আমরা যদি খুশিমত নিজ নিজ কুরবানী আলাদা আলাদাভাবে সমাজের গরীব-দুঃখীদের জন্য এক তৃতীয়াংশ দেই তবে তা শরীয়ত মোতাবেক হবে কি না? জ্বী হবে। ভূমিকায় উল্লেখিত হাদীস ও মাসাইল থেকে তা প্রমাণিত হয়েছে। তবে এক তৃতীয়াংশই সদকা করতে হবে এমনটি জরুরি নয়। যার সামর্থ্য আছে তিনি এর চেয়ে বেশিও সদকা করতে পারেন। আর যার ঘরে প্রয়োজন রয়েছে তিনি এর চেয়ে কমও সদকা করতে পারেন। মোটকথা, এটা কুরবানীদাতার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে শরীয়তের আহকাম সঠিকভাবে বোঝার এবং আন্তরিকভাবে তার উপর আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

 

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

৯/১২/১৪২৭ হি.

৩০/১২/২০০৬ ঈ.

 

 

advertisement