পর্দানশীন
আলকুরআনে নারী
وَ یَجْعَلُوْنَ لِلّٰهِ الْبَنٰتِ سُبْحٰنَهٗ ۙ وَ لَهُمْ مَّا یَشْتَهُوْنَ۵۷ وَ اِذَا بُشِّرَ اَحَدُهُمْ بِالْاُنْثٰی ظَلَّ وَجْهُهٗ مُسْوَدًّا وَّ هُوَ كَظِیْمٌۚ۵۸ یَتَوَارٰی مِنَ الْقَوْمِ مِنْ سُوْٓءِ مَا بُشِّرَ بِهٖ ؕ اَیُمْسِكُهٗ عَلٰی هُوْنٍ اَمْ یَدُسُّهٗ فِی التُّرَابِ ؕ اَلَا سَآءَ مَا یَحْكُمُوْنَ۵۹ لِلَّذِیْنَ لَا یُؤْمِنُوْنَ بِالْاٰخِرَةِ مَثَلُ السَّوْءِ ۚ وَ لِلّٰهِ الْمَثَلُ الْاَعْلٰی ؕ وَ هُوَ الْعَزِیْزُ الْحَكِیْمُ
ওরা নির্ধারণ করে আল্লাহর জন্য কন্যা সন্তান-তিনি পবিত্র মহিমান্বিত, আর ওদের জন্য তা-ই,যা তারা কামনা করে!
ওদের কাউকে যখন কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয় তখন তার মুখম-ল কালো হয়ে যায় এবং সে অসহনীয় মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়।
যে সু-সংবাদ তাকে দেওয়া হল তার গ্লানিতে সে নিজ সম্প্রদায় হতে আত্মগোপন করে। (সে চিন্তা করে,) হীনতা স্বত্ত্বেও তাকে রেখে দিবে, না মাটিতে পুঁতে দিবে! সাবধান! ওরা যা সিদ্ধান্ত করে তা কত নিকৃষ্ট!
যারা আখিরাত বিশ্বাস করে না তারা নিকৃষ্ট প্রকৃতির আর আল্লাহ মহত্মম গুণাবলির অধিকারী। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। -সূরা নাহল, আয়াত ৫৭-৬০
এ আয়াতগুলোতে জাহেলী যুগের দু’টি মন্দ বিষয়ের নিন্দা করা হয়েছে। একদিকে তারা নিজেদের জন্য কন্যা সন্তানকে চরম অপমানজনক মনে করত, অন্যদিকে আল্লাহর জন্য কন্যাসন্তান সাব্যস্ত করত। তারা বলত, ফেরেশতারা হচ্ছে আল্লাহর কন্যা! এই উভয় কাজের উপর আল্লাহ তাআলা তাদের নিন্দা করেছেন।
আল্লাহ তাআলা পুত্র-কন্যা থেকে পবিত্র।
قُلْ هُوَ اللّٰهُ اَحَدٌۚ۱ اَللّٰهُ الصَّمَدُۚ۲ لَمْ یَلِدْ ۙ۬ وَ لَمْ یُوْلَدْۙ۳ وَ لَمْ یَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌ
‘তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাঁকেও জন্ম দেওয়া হয়নি এবং তার সমতুল্য কেউ নেই।’তিনি পরাক্রমশালী, তাঁর সন্তানের প্রয়োজন নেই। সকল প্রয়োজন ও সকল দূর্বলতা থেকে তিনি পবিত্র।
তিনি মানুষকে পুত্র-কন্যা দান করেন।
یَهَبُ لِمَنْ یَّشَآءُ اِنَاثًا وَّ یَهَبُ لِمَنْ یَّشَآءُ الذُّكُوْرَۙ۴۹ اَوْ یُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَّ اِنَاثًا ۚ وَ یَجْعَلُ مَنْ یَّشَآءُ عَقِیْمًا ؕ اِنَّهٗ عَلِیْمٌ قَدِیْرٌ
“তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা দান করেন, যাকে ইচ্ছা পুত্র দান করেন অথবা পুত্র-কন্যা দুই-ই দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা নিঃসন্তান রাখেন। তিনি সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান।”
অতএব পুত্র হোক বা কন্যা,দুটোই আল্লাহর দান, আল্লাহর ফয়সালা। এ ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা ইসলামের শিক্ষা। জাহেলী যুগে কন্যা সন্তানকে অপমানজনক মনে করার যে প্রচলন ছিল তা অত্যন্ত নিন্দিত। কন্যা সন্তান কখনো অপমানজনক নয়,বরং তা পিতা-মাতার জন্য সৌভাগ্যের বারতাবাহক। সূরা নাহলের যে আয়াতগুলো উপরে উল্লেখিত হয়েছে তাতে কন্যা সন্তান জন্ম লাভের সংবাদকে بُشِّرَ শব্দে ব্যক্ত করা হয়েছে। বোঝা গেল, কুরআনের দৃষ্টিতে এ সংবাদ হচ্ছে ‘সুসংবাদ’। যে সংবাদে পিতা-মাতার চেহারা আনন্দে উদ্ভাসিত হওয়া উচিত। এর বিপরীতে এ সংবাদ পেয়ে চেহারায় মলীনতা আসা হচ্ছে জাহালাত ও মূর্খতা।
৬০ নং আয়াতের শেষে وَ هُوَ الْعَزِیْزُ الْحَكِیْمُ “তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়” শব্দেও ইঙ্গিত রয়েছে যে, মানুষকে কন্যা সন্তান দান করার মাঝে আল্লাহ তাআলার গভীর প্রজ্ঞার নিদর্শন রয়েছে।
অতএব আল্লাহ তাআলার সিদ্ধান্তকে অপমানজনক মনে করা বান্দার পক্ষে দুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছুই নয়।
উল্লেখিত আয়াতে দেখা যাচ্ছে যে, সন্তান দান প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা প্রথমে কন্যা সন্তানের কথাই উল্লেখ করেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় কন্যা সন্তান পিতা-মাতার জন্য যে পরিমাণ দরদ ও মহব্বতের প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে তার কোনো তুলনা হয় না। হাদীস শরীফে কন্যা সন্তানের লালন-পালন এবং তাদের সকল বিষয়ে ধৈর্য্য ধারণের বিনিময়ে পিতামাতাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তির সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে।
একজন ‘মা’
‘আমার জন্য তাঁর সবচেয়ে বড় কামনা এই ছিল যে, আমার মাধ্যমে যেন দ্বীনের খিদমত হয় এবং ইসলামের প্রচার-প্রসার হয়। মাঝে মাঝে আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন, আলী, তোমার হাতে কি কেউ মুসলমান হয়েছে? আমি বলতাম, জ্বী হাঁ, একজন দু’জন আমার হাতেও কালেমা পড়েছে। তিনি বলতেন, ‘আমার আরজু এই যে, দলে দলে লোক তোমার হাতে ইসলাম গ্রহণ করুক।’
একদিন খুব দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়ছিলেন। ছোট বোন বলল, আম্মাজী, আপনি আর কী চান? আপনি কি চান, আলী নবী হয়ে যাক? তিনি বললেন, ‘বেটি, আমি কি জানি না, নবুওতের দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে? আমার আরজু হল, তার হাতে যেন দলে দলে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করে আর পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত ইসলামের বিজয়-ডংকা বেজে ওঠে।’
(মাওলানা আবুল হাসান আলী নাদাভী রহ.,তাঁর পুণ্যাত্মা জননী সম্পর্কে।)
দৈনন্দিন কাজে নিয়তের গুরুত্ব
উম্মে মায়মূন
বিখ্যাত সাহাবী খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, সকল কর্মই নিয়তের উপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক মানুষের জন্য তা-ই রয়েছে যা সে নিয়ত করে।
এই হাদীস ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাদীস। মানবের সকল প্রকার কাজ-কর্ম গ্রহণযোগ্য হওয়া নিয়তের উপরই নির্ভরশীল। যে কাজ সৎ নিয়ত বা সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে করা হবে তা সৎ কাজ রূপেই গণ্য হবে এবং আল্লাহর দরবারে হবে তাই গ্রহণযোগ্য। পক্ষান্তরে মন্দ নিয়তে করলে আল্লাহর দরবারে সৎ হিসেবে গ্রহণীয় হবে না। এমনকি ভালো কাজও মন্দ নিয়তে করলে তা-ও আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে না। এ জন্য সৎ কর্মের সাথে পূর্ণ আন্তরিকতা ও ইখলাস থাকা একান্ত আবশ্যক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ে অন্যত্র বলেছেন, ‘তোমার প্রতিপালক অত্যন্ত দয়ালু। কারণ যে শুধু একটি সৎ কাজের সংকল্প করে তার জন্য একটি নেকী লেখা হয়। ইচ্ছাকে কর্মে পরিণত করুক আর নাই করুক। অতঃপর যখন সে সৎ কাজটি সম্পাদন করে তখন তার আমলনামায় ১০টি নেকী লিখে দেওয়া হয়।’
নামায-রোযা,যিকির-তাসবীহ, যাকাত ও সদকা-খায়রাত এবং প্রত্যেক নেক কাজে কেবল আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি লাভ করার প্রতি লক্ষ রাখতে হবে। লৌকিকতা,যশ-খ্যাতি ও সুনাম অর্জনের জন্য আমল করা উচিত নয়। যারা মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্যে আমল করে,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন যে, দোযখে একটি গর্ত আছে খোদ দোযখই প্রতিদিন তা হতে একশত বার আশ্রয় প্রার্থনা করে। লোকদেখানোর উদ্দেশ্যে যারা ইবাদত করে তারা সেই গর্তে প্রবেশ করবে। অতএব পৃথিবীতে খ্যাতি ও সুনামের চিন্তায় নামায ও দান-খয়রাত করা উচিত হবে না। দান-খয়রাত করতে হবে এতই গোপনে যে, ডান হাত দান করলে বাম হাতও যেন তা জানতে না পারে। যে সকল কাজ মানুষ নিরেট দুনিয়ার কাজ বলে বিবেচনা করে থাকে যেমন ক্ষুধা লাগলে খাবার খাওয়া, পিপাসা লাগলে পান করা, ঘুম পেলে ঘুমানো-এসব ক্ষেত্রেও যদি এই নিয়ত করা হয় যে, এতে যে শক্তি সঞ্চয় হবে তা আখেরাতের কাজে ব্যয় করা হবে। সকল কাজেই লক্ষ রাখতে হবে যেন এগুলো শুধু সহীহ নিয়তের অনুপস্থিতিতে নিরর্থক না হয়ে যায়। যে কাজটি করেছিলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। তাঁকে অনুসরণ করেছিলেন তাঁর সাহাবা ও তাঁদের অনুসারী বুযুর্গানেদ্বীন। আর এভাবেই তাঁরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন জান্নাতের উচ্চ আসনে স্থান করে নিয়েছেন।
বেতাগী, বরগুনা
পর্দা কেন করব
সালেহীন বিনতে যায়েদ
লজ্জা-শরম হচ্ছে মেয়েদের মহামূল্য অলংকার। একজন নেককার মেয়ে ও লজ্জা-শরমের মধ্যে এতই দৃঢ় সম্পর্ক যে, একটি ছাড়া অন্যটি কল্পনা করাই দুষ্কর। নেককার মেয়ে মানেই হচ্ছে, লজ্জা-শরমের মূর্ত প্রতীক এক অনন্যা মহিলা। কোনো মেয়ের এই মহামূল্যবান অলংকার হারিয়ে গেলে সে দুনিয়াবী সম্মান-মর্যাদা ও বিত্ত-সম্পদের দিক দিয়ে যত উচ্চ স্থানেই থাকুক না কেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দৃষ্টিতে তার স্থান অতি নিম্নে। তাই এ সম্পদ হেফাযত করা প্রতিটি মেয়ের অবশ্য কর্তব্য। আর এটা হেফাযতের সবচেয়ে উত্তম পন্থা হল পর্দা। পর্দার মাধ্যমে তারা ভিন্ন পুরুষের কাছে নিজেদের দৈহিক সৌন্দর্য গোপন রাখবে, হায়া-শরমের প্রতি পূর্ণ খেয়াল রাখবে এটাই শরীয়তে ইসলামীর নির্দেশনা। পর্দার প্রতি উন্নাসিক মেয়েরা বেগানা পুরুষের সামনে পাতলা ফিনফিনে কাপড় পরে ঘুরে বেড়ায়। অথচ তারা মুসলমানেরই কন্যা-জায়া-জননী। আমাদের অতীত তো এমন ছিল না। হযরত আয়েশা রা. পর্দার যে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এবং পর্দার প্রতি যত্নবান বহু পুণ্যবতী মহিলার যে কথা ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায় তা সত্যিই আশ্চর্যজনক। পর্দার বিষয়ে হযরত আয়েশা রা. কতটা সতর্ক ছিলেন তা নিম্নের ঘটনা থেকে বোঝা যায়। প্রিয় নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও হযরত আবু বকর রা. উভয়কে একই ঘরে দাফন করা হয় এই ঘরে আরেকটি কবরের স্থান বাকী ছিল, যা হযরত আয়েশা রা. নিজের জন্য রেখেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে হযরত ওমর রা. নিজের জন্য চেয়ে নিলেন সে স্থানটি। শাহাদাতের পর তাকে সেখানেই সমাহিত করা হয় । প্রথম কবর দুটির অধিবাসীদের একজন হলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, হযরত আয়েশা রা.-এর স্বামী। আর অপরজন তার পিতা। এখানে তার পর্দার প্রশ্নই উঠে না, কিন্তু হযরত ওমর রা. সেখানে সমাহিত হওয়ার পর থেকে কখনও বেপর্দা অবস্থায় এ ঘরে প্রবেশ করেননি।
তিনি নিজে পর্দা করেই ক্ষান্ত হননি অন্যদেরও পর্দার বিষয়ে তাকীদ করেছেন। একবার তার ভাতিজী পাতলা ওড়না পরে তার সামনে এলে তিনি রেগে যান এবং তার ওড়না ছিঁড়ে ফেলেন। এরপর একটি মোটা কাপড়ের ওড়না এনে পরিয়ে দেন তাকে। বলাবাহুল্য, তাঁরাই হলেন আমাদের আদর্শ। তাঁদের অনুসরণের মধ্য দিয়েই আমরা সুন্দর ও শালীন জীবনের অধিকারী হতে পারি।