সোনালী জীবন-যাত্রা
জীবন-যাত্রায় নির্ধারিত উদ্দেশ্য থাকে সবারই। যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হল আল্লাহ পাকের রেজামন্দী অর্জন, তাঁরা নেহায়েত সফলকাম। যারা নিজের জীবনকে আখেরাতমুখী করতে সফল হয়েছেন তাঁরা অবশ্যই আল্লাহ পাকের খাস বান্দা। এমনই একজন মানুষ হলেন আমার দাদু ভাই। ছোট থেকে তাকে যেভাবে দেখেছি আর লোকমুখে যতটুকু শুনেছি তাতে আমার এ বিশ্বাস জন্মেছে। তাঁর সুশৃংখল জীবনে কোনোদিন বিন্দুমাত্র দুনিয়ার প্রতি লোভ-লালসা বা ভোগ-বিলাস লাভের ইচ্ছা দেখা দেয়নি। এখনো তিনি জীবিত আছেন, দুনিয়ার কোনো খবর তাঁর নেই। দুনিয়াব্যাপী ঝড় আরম্ভ হলেও তাঁর সুশৃঙ্খল জীবনের রুটিন : জামাতে সালাত আদায়, নিয়মিত ইশরাক-চাশত-আওয়াবীন, দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর কায়লুলাহ, মাসে তাবলীগে তিনদিন ব্যয়। মাসিক জোড়, গাস্ত, এজতেমা কখনো বাদ যায় না। এ বৃদ্ধ বয়সেও আমলে কোনো ঘাটতি নেই। অনেক সময় চাচারা বকাবকিও করে থাকেন, এ অসুস্থ শরীরে এবার বিশ্ব এজতেমায় হাজির না হলে কী হয়! সাহস করে আবার বাঁধাও কেউ দেয় না, যদি অভিশাপ এসে যায়! সবাই জানে, তিনি নেহায়েত একজন বুযুর্গ ব্যক্তি। ছোটকাল হতে এ যাবৎ তাঁর নামায নয়, কখনো জামাত কাযা হওয়ার কথাও স্পষ্ট মনে পড়ে না।
কয়েক বছর আগের কথা। এর আগে তাঁর হাটা চলা করতে লাঠি ভর দিতে হত না, সেই হতে শুরু। হঠাৎ করেই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। তখন ছিল রমযান মাস। কেবল আরম্ভ হয়েছে। ফজর হতে মাগরিব পর্যন্ত আমি আর আমার ছোট ভাইকে নিয়ে জামাতে নামায পড়েছেন, কিন্তু তারাবী হতে আর ঠেকানো যায় না। অথচ চলাফেরা তো দূরের কথা দাঁড়ানো পর্যন্ত সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে। আব্বা বলে গেলেন বাসায় তারাবীর জামাত করতে। কিন্তু তা আমারও পছন্দ ছিল না, প্রথম তারাবীহ কীভাবে বাসায় পড়ি! একদিন আমি দাদুকে ফাঁকি দিয়ে মসজিদে চলে গিয়েছিলাম, তিনি ছোট ভাইয়ের সাথে জামাত করে রাগে শুয়েছিলেন। আমি আসার পর আমাকে প্রায় মারার মতো অবস্থা। এর দুদিন পর হতে ধরে ধরে মসজিদে নিয়ে যেতাম।
এ ধরনের মেজাজ তাঁর ছোটকাল থেকেই। তিনি যখন স্কুলে পড়তেন তখন ঐ স্কুল মসজিদেই (খুলনা জেলার তেরখাদা থানাস্থ বারাসাত গ্রামে) বাংলাদেশের সর্বপ্রথম তাবলীগের কাজ আরম্ভ করেন (বড় হুজুর) মাওলানা আব্দুল আজিজ রহ., ফাজায়েলে আমল (বঙ্গানুবাদ)-এ তাঁর হস্তলিপিতে ‘অভিমত’ লিপিবদ্ধ রয়েছে। আমার দাদু ভাই ছাত্রজীবন থেকেই তাবলীগের সাথে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত রয়েছেন। সে সময় তাবলীগের এ নিয়মতান্ত্রিকতা ছিল না। স্কুলের ছোট ছোট ছাত্রদেরকে চকলেটের লোভ দেখিয়ে নাকি মসজিদে বসতে বলা হত।
পরবর্তী সময়ে ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদে তিনি নিয়োগ হন। তাঁর সততা ও নিষ্ঠার সুনাম ছিল সর্বমহলে, ছিল সম্ভ্রান্ত বংশ পরিচয়ও। এলাকায় কোনো মাহফিল-সভা ইত্যাদি হলে আমাদের বাড়িতেই মেহমানদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হত। প্রথম যমানা থেকে তাবলীগের সাথে জড়িত থাকায় বড় হুজুর মাওলানা আব্দুল আজিজ রহ.-এর সাথে গাঢ় সম্পর্ক তৈরি হয়, ভালোবাসার সম্পর্ক। হুজুরের মৃত্যু পর্যন্তই তা ছিল। হুজুরের বাড়ি পার্শ্ববর্তী ‘বামনডাঙ্গা’ গ্রামে। সে সময় যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল নিতান্ত দুর্ভোগপূর্ণ। দাদুর মুখে শুনেছি, জামাতবন্দী হয়ে দূর শহরে রওয়ানা করলে সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই এক চিল্লার অর্ধেক সময় কেটে যেত, এত দিন পথিমধ্যে কোনো কোনো মসজিদে যাত্রাবিরতি হত।
বড় হুজুর যখন শহরে আসা-যাওয়া করতেন তখন যেতে আসতে আমাদের কাচারী ঘরে বিশ্রাম করতেন। আমাদের বাড়ির পার্শ্ব দিয়ে বয়ে গেছে বড় খাল, সে সময় তার স্রোত নদীর চেয়ে মোটেও কম ছিল না। ঐ খালই ছিল শহরে যাতায়াতের একমাত্র সহজ নৌ-পথ।
বারবার বড় হুজুরের উপস্থিতিতে আমাদের বাড়ির সবার সাথেই বেশ ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি হয়েছিল। মেহমানদারীতে আমার দাদীর হাতও খুব পাকা, তার হাতের চালের রুটি আর গোশত ছিল হুজুরের খুব প্রিয়। ছোট বেলায় দেখতাম, আমার দাদী রান্না করে টিফিন ক্যারিয়ার ভরে দিতেন। আর আমার আব্বাজান শহরে হুজুরের বাসায় নিয়ে যেতেন। পরবর্তীতে কাকরাইল প্রধান মারকায হওয়ায় হুজুর খুলনা শহরেই বেশি সময় কাটাতেন। পরে যখন আব্বাজান শহরে বাসা নিয়েছিলেন তখন আমাদের সাথে আবার ঘন ঘন যোগাযোগ শুরু হয়েছিল। তখন দেখতাম আমার আম্মাও হুজুরের জন্যে খাবার পাঠাতেন। দাদাজানের কারণে আমাদের পরিবারের সবাই এই বুযুর্গ ব্যক্তির খিদমত ও সাহচর্যের সুযোগ লাভ করেছিলাম।