যিলকদ-যিলহজ্ব ১৪২৮   ||   ডিসেম্বর ২০০৭

এক মনীষীর অধ্যয়ন-নির্দেশিকা

মাওলানা সায়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.

প্রশ্ন : আপনি মুতালাআ বা অধ্যয়নের আগ্রহ কখন থেকে অনুভব করছেন? এর সূচনা ও বিকাশ কীভাবে হয়েছে? কী ধরনের পারিপার্শ্বিক অবস্থা আপনার মুতালাআর জন্য সহায়ক হয়েছিল? কারা আপনার মুতালাআর স্পৃহা সৃষ্টি করেছেন এবং এই পথে রাহনুমায়ী করেছেন? আপনার অধ্যয়ন-জীবনের বিভিন্ন পর্যায় এবং যাওকের উন্নতি ও পরিবর্তন সম্পর্কে বলুন।

উত্তর : আমার বর্তমান অবস্থা এ পর্যায়ে নেই যে, দেমাগের ওপর চাপ সৃষ্টি করে কিছু করব কিংবা পূর্ণ একাগ্রতার সাথে কোন বিষয় লিখব। বেশি সময় বিছানায় শুয়ে থেকে কেটে যায়। ঠিক এ সময়ে আপনার প্রশ্নের কাগজগুলো বের হল এবং একজন আমাকে তা পড়ে শোনাল। প্রশ্নগুলো খুব সচেতনভাবে সাজানো হয়েছে, যা উদ্যম সৃষ্টি করে। তাই মনের মধ্যে জওয়াব দেওয়ার আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। আপনি আমাকে প্রশ্নোত্তর নির্বাচনের স্বাধীনতা দিয়েছেন, তাই সহজ সহজ কিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছি।

উত্তর : বুযুর্গানে কেরাম, উলামায়ে ইযামের দস্তুর মোতাবেক এবং বিশেষ কিছু কারণে অন্যদের তুলনায় আমাদের ঘরে উত্তরাধিকারী সূত্রে পাওয়া একটি বিশাল কুতুবখানা ছিল। আমার দাদা মেহরে জাহাঁ তাব-এর মুসান্নিফ হাকীম সাইয়েদ ফখরুদ্দিন এবং পিতা গুলে রানা নুযহাতুল খাওয়াতির-এর মুসান্নিফ সাইয়েদ আব্দুল হাই রহ. উভয়েই বড় মাপের লেখক ছিলেন। এই কুতুবখানায় কয়েক হাজার কিতাব ছিল, যাতে আরবী, উর্দু, ফারসী এই তিন ভাষারই কিতাব বিদ্যমান ছিল। আমার বড় ভাই মরহুম ডাক্তার হাকীম মৌলভী সাইয়েদ আব্দুল আলী স্নেহশীল অভিভাবক ছিলেন এবং মনমানস অনুধাবন ও তার গতি প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণে তাঁর বিশেষ পারদর্শিতা ছিল। কিতাবগুলোর সাথে অন্তরঙ্গতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এর হিফাযত ও সংরক্ষণের কাজে আমাকে শরীক করেছিলেন। এরপর এ কাজ আমার ওপরই ন্যস্ত করেছিলেন। ফলে প্রথমে কিতাব ও মুসান্নিফের সাথে আমার সাথে পরিচয় ঘটে এবং সেগুলো পড়া ও মুতালাআর স্পৃহা তৈরি হয়। এভাবে কিতাব মুতালাআর স্বভাবজাত আগ্রহ উন্নতি করে তা অভ্যাসে পরিণত হল; বরং নেশার রূপ ধারণ করল।

প্রশ্ন : আপনার মুতালাআর প্রিয় বিষয় বস্তু কী ছিল?

উত্তর : আমার মুতালাআর সবচেয়ে প্রিয় ও আনন্দদায়ক বিষয় হলো মনীষীদের জীবনী, জীবনকাহিনী এবং জীবনচরিত। এসব মুতালাআ করতে গিয়ে কোন সময় ব্রেনে চাপ অনুভব করিনি এবং পাঠ করে পরিতৃপ্ত হতে পারিনি। এর কারণ সম্ভবতঃ এই ছিল যে, আমার পিতা ও দাদা ঐতিহাসিক এবং ইতিহাসদ্রষ্টা ছিলেন এবং তাদের জীবনের বড় একটি অংশ এর পিছনে ব্যয় হয়েছিল।

সাহিত্য, বিশেষ করে ওই সব রচনা যা কৃত্রিমতা, কষ্টকল্পনা এবং শব্দবাহুল্য থেকে মুক্ত, যাতে রয়েছে হৃদয়ের স্বতঃস্ফূর্ততা, সেসব ছিল আমার পছন্দের দ্বিতীয় তালিকায়। তবে পদ্যের চেয়ে গদ্য পড়ার ঝোঁক বেশি ছিল এবং তা আরবী উর্দু উভয় ক্ষেত্রেই।

প্রশ্ন : উর্দু ছাড়া আরবী, ইংরেজি, ফার্সী, বাংলা, হিন্দি, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, পশতু, বেলুচী এবং অন্যান্য ভাষা কী পরিমাণ অধ্যায়ন করার সুযোগ হয়েছে আপনার?

উত্তর : সবচেয়ে বেশি মুতালাআ করা হয়েছে আরবী ভাষায় এরপর উর্দু ভাষায়। আর ইংরেজি ভাষায় মুতালাআ করা হয়েছে কেবল প্রয়োজনের খাতিরে। দৃষ্টিশক্তি কমে গেলে ইংরেজিতে মুতালাআ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।

প্রশ্ন : উর্দু এবং ইংরেজি সামনে রেখে বলুন, কোনটাতে আপনার মুতালাআ বেশি গভীর? আপনার প্রিয় লেখক, মুসান্নিফ, প্রিয় কিতাব, পছন্দের রেসালা-পুস্তক, প্রিয় কবি, গল্পকার এবং পছন্দের রম্যগল্পকারের নাম বলুন।

উত্তর : প্রিয় লেখক মুসান্নিফ, পছন্দের সংকলন এবং এতদসংশ্লিষ্ট আলোচনা আমার লেখা মেরি মোহসিন কিতাবেঁ পুস্তকে আলোচনা করা হয়েছ। রম্যলেখকদের মধ্যে প্রাচীন লেখক মির্জা ফারহাতুল্লাহ বেগ দেহলভী আমার পছন্দের শীর্ষে। এছাড়া প্রফেসর রশীদ আহমদ সিদ্দিকীর যেসব প্রবন্ধ অতিরিক্ত দর্শন ও ফালসাফা মুক্ত সেগুলো আমার পছন্দনীয়। বিশেষত তার রচনাসমগ্র গন্জহায়ে গেরাঁ মায়াহ অত্যন্ত সফল ও চিত্তাকার্ষক সংকলন।

কটাক্ষ রচনা লেখকদের মধ্যে মাওলানা আব্দুল মাজীদ দরিয়াবাদী বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। বিশেষ করে যে সব রচনা অতিরিক্ত শ্লেষমিশ্রিত ও আক্রমণাত্মক নয় সেগুলো আমার বেশি পছন্দনীয়। এই সতর্কতা মাওলানা আযাদের সংকলনে খুব বেশি। তাঁর এই সাহিত্যের পরিমাণ সংখ্যায় কম হলেও তা সূক্ষ্ম ও আকর্ষণীয়।

প্রশ্ন : আপনি আপনার মুতালাআ (অধ্যায়ন) জগতে কোন মুসান্নিফকে সর্বশীর্ষে স্থান দেন, আপনার বেড়ে ওঠার পিছনে অবদান সবচেয়ে বেশি কার ছিল বলে মনে করেন? বিশেষ করে উর্দু লেখকদের মধ্যে।

উত্তর : এটা বলতে পারি যে, শুরুতে যেহেতু নদওয়াতুল ওলামা আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্টদের সংকলন বেশি পড়া হয়েছে একারণে আমার ওপর তাঁদের প্রভাব পড়েছিল সবচেয়ে বেশি। উর্দু লেখার ক্ষেত্রে আমার আব্বার প্রভাব প্রধান ও সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে তাঁর সংকলিত ইয়াদেআইয়াম এবং গুলে রানা কিতাব দুটির প্রভাব। তাছাড়া মাওলানা শিবলী নোমানীরও বিস্তর প্রভাব আছে

প্রশ্ন : আপনার ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল এরূপ রচনা বা দুয়েকটি উর্দু কিতাবের নাম বলবেন? এবং এমন দুচারটি প্রবন্ধ, কবিতা বা গল্পকাহিনীর নাম বলবেন, যা আপনার চিন্তা ও আমলী জগতে প্রভাব ফেলেছিল?

উত্তর : আমার পূর্বোক্ত প্রবন্ধটিতে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

প্রশ্ন : উর্দু ভাষার সাময়িকীগুলোর যেসব বিশেষ সংখ্যা আপনার নজরে পড়েছে এর মধ্যে আপনার সর্বাধিক পছন্দের কোনগুলো? কোনো একটিকে সর্বাধিক পছন্দনীয় হিসেবে চিনহিত করতে পারলে বিশেষভাবে উপকৃত হব।

উত্তর : উর্দু পত্রিকার বিশেষ কোনো সংখ্যা বেশি দেখাও হয়নি এবং এখন তা মনেও নেই। তবে আমার রুচি ও পছন্দ অনুযায়ী আলফুরকানের মুজাদ্দিদ সংখ্যা এবং শাহ ওয়ালিউল্লাহ সংখ্যা দুটি আমার কাছে অতি চমৎকার মনে হয়েছে।

প্রশ্ন : মুতালাআর ক্ষেত্রে পছন্দ অপছন্দ দুটি দিকই থাকে। এক্ষেত্রে আপনার অপছন্দের বিষয় কী ছিল? কোন বিষয়ের মুতালাআ আপনার জন্য কষ্টকর? এমন কোনো রচনা বা প্রবন্ধের নাম বলুন যার প্রতি আপনার বীতশ্রদ্ধ ভাব রয়েছে।

উত্তর : কঠিনকষ্ট স্বীকার এবং অতি প্রয়োজন ছাড়া যেসব কিতাবের কয়েক পৃষ্ঠা পড়াও আমার জন্য দুষ্কর ছিল সেগুলো তিন ধরনের।

১.  তর্কবিকর্ত ও খ-নমূলক কিতাব।

২.  শুষ্ক দর্শকভিত্তিক কিংবা ওয়াহদাতুল উজুদ সম্পর্কীয় প্রবন্ধ এবং চরিত্রদর্শনের সুফীয়ানা বইপত্র।

৩.  কাদিয়ানী লেটারচার, যাতে সুন্দর উপস্থাপনা, রচনার মাধুর্য এবং চিন্তার গভীরতা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত।

প্রশ্ন : স্বাভাবিক অবস্থায় আপনার মুতালাআর সময়সূচি কী? মুতালাআর পরিকল্পনা কীরূপ? কীভাবে বসা আপনার পছন্দ? আপনার মুতালাআর গতি কেমন?

উত্তর : গ্রীষ্মকালে আমার সংকলন ও তাসনীফের সময় ছিল বাদ ফজর চা পানের পর থেকে সূর্য উত্তপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত এবং শীতকালে প্রায় যোহর পর্যন্ত। এসময় ছাড়া বহু বছর যাবত অন্য কোনো সময় রচনার কাজ করি না। একারণে পড়ার সময় ছিল স্বাভাবিক অবস্থায় যোহর থেকে আসর পর্যন্ত এবং সফরে প্রায় সারাদিন (খাওয়া ও আরাম করার সময় ছাড়া) দৃষ্টি কমযোর হওয়ার পর রাতের মুতালাআ প্রায় ২০/২৫ বছর যাবৎ বন্ধ হয়ে গেছে। যে সময় দারুল উলূমে কোনো হাদীসের কিতাব পড়ানোর যিম্মাদারী নিতাম সে সময় এর জন্য প্রচুর মুতালাআ করতে হত। এ সময় লেখার কাজ প্রায় হতই না বললে চলে কিংবা লেখার জন্য মুতালাআর প্রয়োজন হলেও ফজর ও যোহরের মধ্যবর্তী সময়ও মুতালাআর মধ্যেই ব্যয় হত।

আমি চেয়ার টেবিলে বসে কিংবা টুলের উপর লিখতে কখনো অভ্যস্ত ছিলাম না। সাধারণত সেভাবেই লিখি যেভাবে আপনি হস্তলিপি অনুশীলনকারীদের লিখতে দেখেছেন।

আমার মুতালাআর গতি সাধারণত শ্লথ। দ্রুত মুতালাআ করে আমি পরিতৃপ্ত হতে পারি না। অবশ্য এগুলো অনেকটা নির্ভর করে বিষয়বস্তুর ওপর। সাহিত্য ও ইতিহাসের বইপুস্তক দ্রুত এবং ইলমী বিষয়গুলো ধীরে সুস্থে ভেবে চিন্তে মুতালাআ করি।

প্রশ্ন : আপনার মুতালাআর জন্য নির্জন ও নিরিবিলি পরিবেশ জরুরি কিনা নাকি কোলাহল ও ব্যস্ততার মধ্যেও মুতালাআ চালিয়ে যেতে পারেন?

উত্তর : ব্যস্ততা, কোলাহল এবং মানুষের ভীড়ের মধ্যেও সাধারণত আমার মুতালাআয় এবং অনেক সময় রচনা কার্যেও বিঘ্ন ঘটে না। অনেকের কাছে আশ্চর্যজনক মনে হতে পারে যে, কখনও কখনও এ ধরনের পরিবেশ আমার মুতালাআর জন্য সহায়কও হয়ে ওঠে। আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ কিতাব ও প্রবন্ধ ট্রেনের থার্ডক্লাশে বসে লিখেছি। আসলে মনে যখন প্রফুল্লতা ও ক্ষীপ্রতা আসে এবং নিজের মধ্যে লেখার অনুপ্রেরণা অনুভূত হয় তখন কোলাহল ও হৈ চৈ এতে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। কিন্তু যখন এরূপ অনুকূল পরিবেশ থাকে না এবং তবিয়তও সহায়ক হয় না তখন নির্জনতা ও নিরবতা অনুসন্ধান করতে হয় বৈকি।

প্রশ্ন : সফরে আপনার মুতালাআর অভিজ্ঞতা কীরূপ?

উত্তর : যখন কর্মস্থলে অবস্থানের সময় কাজের ব্যস্ততা বেড়ে গেল তখন সফরের সময়কেই নতুন কিতাব মুতালাআ করার মোক্ষম সুযোগ বলে মনে হত, আর সফরের সুযোগও হত অনেক। এদিক থেকে সফর আমার কাছে অনেক কল্যাণকর প্রমাণিত হয়েছে। হাজার হাজার পৃষ্ঠার গ্রন্থ সফরেই অধ্যয়ন করেছি।

প্রশ্ন : মুতালাআ করার সময় আপনি কি কিতাবের গায়ে চিহ্ন লাগান? আলাদা কোনো স্থানে কোনো নোট বা সারসংক্ষেপ লিখে রাখেন?

উত্তর : কিতাবের বিশেষ বিশেষ জায়গায় চিহ্ন লাগানোর অভ্যাস আমার অনেক পুরানো। এটা আমি শ্রদ্ধেয় উস্তায মাওলানা সাইয়েদ তালহা ছাহেব এম. এ সাবেক উস্তায ওরিয়েন্টাল কলেজ লাহোর-এর কাছ থেকে শিখেছি। তবে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে লাল রঙের পেন্সিলের দাগ লাগাতাম। গাড়ির গতি দ্রুত হলে তা থামার অপেক্ষা করতাম, যাতে চিহ্নটা কিতাবের সৌন্দর্য নষ্ট না করে। কিতাবের পার্শ্বে নিজ মতামত সুন্দর হস্তাক্ষরে লিখে রাখার চেষ্টা করতাম। কোনো কোনো সময় এ ধরনের পার্শ্বটীকা অন্যদের চোখে মুদ্রিত বলে মনে হয়েছে, এই চিহ্ন ও টীকাগুলো আমাকে ঐ কিতাব দ্বিতীয়বার পড়ার সময় অনেক সহায়তা করেছে এবং কিতাবের সর্বোত্তম অংশ ছবির মতো চোখের সামনে এসে যায়।

প্রশ্ন : আপনার মুতালাআর বিস্তৃতির সাথে স্মৃতিশক্তি সঙ্গ দিত কেমন? আপনার কি পঠিত কিতাবের বিষয়বস্তু এবং মুসান্নিফের নাম পুরোপুরি মুখস্থ থাকত?

উত্তর : বংশগতভাবে আমার স্মৃতিশক্তি দুর্বল। তবে আমার প্রিয় বিষয়বস্তুর ক্ষেত্রে স্মৃতিশক্তি দারুণ সঙ্গ দিয়েছে। অন্য বিষয়ে এরূপ হত না। আমার ধারণা, রুচি ও পছন্দের সাথে স্মৃতিশক্তির গভীর সম্পর্ক রয়েছে।

প্রশ্ন : আপনি কি আপনার মুতালাআ, মুতালাআলব্ধ জ্ঞান এবং মুতালাআর রুচিশীলতার মধ্যে নিজস্ব লোকদের বিশেষ করে বাচ্চাদের (যদি থাকে) অংশীদার করেন? বাচ্চাদের রুচি গঠনে আপনার অভিজ্ঞতা কী?

উত্তর : প্রিয় বস্তুতে আপনজন, সহপাঠীদের শামিল করা মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। সম্ভবত এই বিষয়টা আমার মধ্যে অন্যদের চেয়ে একটু বেশি। আমি আমার পূর্বপুরুষ বুযুর্গদের এই বৈশিষ্ট্য দ্বারা বিশেষভাবে উপকৃত হয়েছি এবং আমার পরিবার পরিজন এবং সহকর্মীদের জন্যও তা উপকারী বলে বিবেচিত হয়েছে।

প্রশ্ন : আপনার নিজস্ব লাইব্রেরি আছে কি? তার বৈশিষ্ট্যগুলো বলুন? এতে সংরক্ষিত কিতাবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিতাব কোনগুলো? বিশেষ বিশেষ কিতাব সংগ্রহের জন্য আপনার উল্লেখযোগ্য কোনো অভিজ্ঞতা থাকলে তা বর্ণনা করুন। বড় কোনো ব্যক্তিত্ব কর্তৃক প্রাপ্ত আপনার কিতাব সম্পর্কেও কিছু বলুন।

উত্তর : আমাদের দুই ভাইয়ের উত্তরাধিকার সূত্রে বিশাল ও বিভিন্ন রকমের কিতাব সম্বলিত একটি কুতুবখানা মিলেছিল, যা কয়েক বংশ এবং এক ইলমী পরিবারের বহু দিনের সঞ্চিত উত্তরাধিকার। এতদসত্ত্বেও আমার পসন্দ ও প্রয়োজনের কিতাব সংগ্রহের আগ্রহ সেই বাল্যকাল থেকে। এক্ষেত্রে বাল্যকালের কিছু ঘটনাও রয়েছে যা একই সঙ্গে হাসির ও শিক্ষণীয়। এই আগ্রহ আমার মধ্যে ঐ বয়স থেকে সৃষ্টি হয়েছে যে বয়সে বাচ্চাদের খেলনা এবং মিষ্টান্ন দ্রব্য ক্রয়ের প্রতি প্রবল ঝোক থাকে। রুচি, আগ্রহ এবং গাম্ভীর্যতা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই স্পৃহাতেও সংশোধনী ও উন্নতি ঘটেছিল। এভাবে নিজের ক্রয়কৃত এবং মিশর, শাম থেকে সংগৃহীত কিতাবের বড় এক ভা-ার জমে গেল। এটা বিশালাকারের না হলেও নির্বাচিত। এতে বেশির ভাগ ঐ সব কিতাব বিদ্যমান ছিল, যা বিষয়বস্তুর বিচারে ছোট ইনসাইক্লোপিডিয়ার বরং ছোটখাটো কুতুবখানার কাজ দেয়। যেহেতু শুরু থেকেই আরবী সাহিত্য ও রচনার প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল এ কারণে সংগ্রহশালায় এমন কিতাবও রয়েছে যার ইলমী ও ফিকরী গুরুত্ব নেই। কিন্তু এগুলো অধ্যয়নে অন্তরে স্নিগ্ধতা এবং লেখায় গতিময়তা সৃষ্টি করে। যেমন আগানী ও সাহিত্যিকদের রচনাসমগ্র। নির্বাচিত এই ভাণ্ডারে দিওয়ানে গালিব মিরআতুল মাসনবী, কালামে ইকবাল, গুলিস্তা, বুস্তা প্রভৃতি শামিল ছিল।

কোনো কোনো সময় মিশর ও শামের মূদ্রিত কিতাব পাওয়ার জন্য সেখানকার বন্ধু ও পরিচিতজনদের কাছে চিঠি লিখতে হয়। তারা কাক্সিক্ষত কিতাবগুলো পাঠিয়ে দেন। কোনো সময় এমনও হয় যে, কোনো কিতাবের স্বাভাবিক মূল্য যেখানে আট-দশ রুপীর বেশি নয় প্লেনের ডাকযোগে সেটা পেতে ৫০/৬০ রুপী খরচ হয়ে যায়। আরব বিশ্বের গবেষক লিখকগণ তাদের রচনা হাদিয়াস্বরূপ পাঠান। অধিকাংশ সফরে মুসান্নিফগণের স্বাক্ষর সম্বলিত কিতাব হস্তগত হয়েছে, যা আমার কুতুবখানার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে।

প্রশ্ন : কিতাব ধার দেওয়া নেওয়ার ব্যাপারে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন? এক্ষেত্রে আপনার মত কী? এমন কোনো    ঘটনা ঘটেছে কি, যার কারণে কোনো বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কিতাব হাত ছাড়া হয়েছে?

উত্তর : কিতাব ধার দেয়ার ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা বড় তিক্ত। এ ব্যাপারে বড় বড় আহলে ইলেমের উদাসীনতা ও শিথীলতা বেশ প্রসিদ্ধ। কোনো সময় ধার গ্রহীতা নিজের যিম্মাদারী অনুধাবন করে না এবং দাতারও মনে থাকে না কাকে ধার দেওয়া হয়েছিল। আমার জীবনে এরূপ দুঃখজনক ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। এরচেয়ে আরেকটু কম দুঃখজনক ঘটনা হল ধারগ্রহীতার যত্নের সাথে কিতাব না পড়া। এতে কিতাবের ওপর দাগ ও চিহ্ন পড়ে যায়। কোন সময় এতে নিজের মতামত ও বক্তব্য লিখে রাখে। এতে করে কিতাবের সৌন্দর্য বিনষ্ট হয়ে যায় অনেকক্ষেত্রে। অনেক কিতাব থেকে আমাকে এজন্য হাত গুটিয়ে নিতে হয়েছে যে, এর ওপর অংকিত দাগ, পার্শ্বদেশের টীকা কিতাবগুলোর সৌন্দর্য ও কমনীয়তা বিলুপ্ত করে দিয়েছে। এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য হল আমি শুরু থেকেই কিতাবের ব্যাপারে সৌন্দর্যপ্রিয় এবং তীক্ষè অনুভূতিসম্পন্ন। কিতাবের ওপর প্রক্ষিপ্ত এক ফোটা ঘাম কিংবা পাঠকের সংযুক্ত মতামত অনেকসময় আমাকে মুতালাআ থেকেই বঞ্চিত করেছে। আর কোনো সময় ধারগ্রহীতাকেই এই বলে কিতাব ফেরত দিয়ে দিয়েছি যে, আমার আর এই কিতাবের প্রয়োজন নেই।

প্রশ্ন : সাহিত্য অধ্যয়নের সাধারণ প্রয়োজনীয়তা কী? সাধারণ মানুষের জন্য এবং তালিবে ইলমদের জন্য?

উত্তর : আমার মতে প্রাথমিক পর্যায়ে সাহিত্য অধ্যয়নের প্রয়োজনীয়তা অতীব। সৌভাগ্যক্রমে সূচনাতেই যাদের ভালো মানের সাহিত্যের কিতাব অধ্যয়নের সুযোগ হয়েছে এবং তার সাহিত্য রুচি একটা বিশেষ পর্যায়ে গিয়ে পৌছেছে, সে চাই দর্শন বেছে নিক কিংবা দ্বীনী কোনো বিষয়, তার লিখনীর মধ্যে মিষ্টতা ও কমনীয়তা বিদ্যমান থাকে এবং সে প্রতিষ্ঠিত লেখক হিসেবে আত্ম-প্রকাশ করতে পারে। আমার মতে প্রতিটি ক্লাশে কিছু না কিছু আরবী সাহিত্য পাঠ করার ব্যবস্থা রাখা উচিত।

প্রশ্ন : উর্দূ সাহিত্য পাঠের বিষয়ে নওজোয়ানদের আপনি কী পরামর্শ দেন? তারা কোন মুসান্নিফের কি ধরনের কিতাব মুতালাআ করবে?

উত্তর : উর্দূ সাহিত্য পাঠ এবং লিখনীর অনুশীলনের জন্য এ সময়ে নওজোয়ানদের জন্য মাওলানা শিবলী নোমানী, মাওলানা হালী, মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী, মাওলানা আযাদ, মাওলানা আব্দুল মাজিদ দরিয়াবাদী, ডক্টর সাইয়েদ আবেদ হোসাইন, চৌধুরী গোলাম রাসূল মেহের, মাওলানা শাহ মুঈনুদ্দীন নদভী প্রমুখ মনীষীদের সংকলন ও রচনা অবশ্যই মুতালাআয় রাখতে হবে। এর চেয়ে বেশি সাহিত্য-রুচি ও ভাষা-জ্ঞান অর্জন করতে হলে সেক্ষেত্রে আর কোনো সীমারেখা নেই। মৌলভী মুহাম্মাদ হোসাইন আযাদ, ডেপুটি নযীর আহমাদ এবং নিরেট সাহিত্যিকদের বিশুদ্ধ সাহিত্যও পড়তে পারে। এ সকল নাম- লেখার পরিপক্কতা ও গতিময়তা এবং ভাষার সাবলিলতা ও বিশুদ্ধতার দিক থেকে পেশ করা হয়েছে, চিন্তাধারার বিশুদ্ধতার দিক থেকে নয়।

প্রশ্ন : আপনি কি উত্তম ও কার্যকরী কোনো পদ্ধতি বাতলে দিবেন, যা মানুষকে একথা বুঝাতে সক্ষম হবে যে, কেবলমাত্র বিনোদনমূলক সাহিত্য যথেষ্ট নয়? এর সাথে ইলমী, আদবী এবং অন্যান্য জ্ঞানেরও সমাবেশ থাকতে হবে এবং প্রোগ্রাম বানানোর ক্ষেত্রে ভারসাম্যতা থাকতে হবে?

উত্তর : শুধু বিনোদনমূলক সাহিত্য অধ্যয়ন মানুষের মেধায় এক ধরনের অগভীরতা, জ্ঞান ও চিন্তাধারায় অন্তসারশূন্যতা এবং জ্ঞান ভা-ারে নিঃস্বতা সৃষ্টি করে। এ ধরনের মানুষ কখনও মৌলিক এবং কার্যকর কর্ম সম্পাদন করতে পারে না। বিনোদনমূলক সাহিত্যের পরিমাণ হওয়া চাই খাদ্যে লবণ  কিংবা ফলমূল খাওয়ার মতো। আর কোনো কোনো সময় চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ও দর্শন ভিত্তিক অধ্যয়নও ইলমী জীবনে বিপ্লব সৃষ্টি করে। এ ধরনের বিষয়ও কিছু না কিছু অধ্যয়নে শামিল থাকা চাই।

প্রশ্ন : বর্তমানে বিভিন্ন উর্দূ ডাইজেস্টের যে ধারা শুরু হয়েছে সে ব্যাপারে আপনার মতামত কী? কারও মতে এ ধরনের পত্রিকা ইংরেজি পত্রিকার জায়গা দখল করে উর্দুর ব্যাপারে সহায়তা করছে। দ্বিতীয় মত হল, এটা সাহিত্য অধ্যয়নের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে।

উত্তর : উর্দু ডাইজেস্টের ধারাবাহিকতা উপকারী বলেই মনে হয়। তবে এতে প্রচুর মেহনত এবং উত্তম বিষয়াদি নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। উর্দু ভাষার উন্নতি ও প্রচার-প্রসারে এই ধারা নিঃসন্দেহে কল্যাণকর বলে প্রমাণিত হবে। আর এতে যদি সাহিত্যের বিষয়টি যুক্ত হয় এবং সাহিত্যিকদের জীবনী ও টাকশালী সাহিত্য পরিচয়ের ধারাবহিকতা  শুরু হয় যাতে সেগুলোর অধ্যয়নে স্পৃহা সৃষ্টি হয় তাহলে এই আশঙ্কাও তিরোহিত হবে যে, তা প্রাচীন সাহিত্য থেকে পাঠকের সম্পর্ক ছিন্ন করছে।

প্রশ্ন : এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, আমাদের বর্তমান মুসলিম সমাজে যে তরুণ সম্প্রদায় রয়েছে তাদের মৌলিক প্রয়োজন হল ইসলামের বিপ্লবী জীবনব্যবস্থা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং তাঁর গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞঝান অর্জন করা। এক্ষেত্রে আপনি কার কার এবং কোন কোন লেখা পড়ার পরামর্শ দেন?

উত্তর : এক্ষেত্রে দারুল মুসান্নিফীন, নদওয়াতুল মুসান্নিফীন, ইসলামিক পাবলিকেশন্স, ইকবাল একাডেমি, শাহ ওয়ালিউল্লাহ একাডেমি, মজলিসে তাহক্বীকাত ওয়া নশিরিয়াতে ইসলামি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত কিতাবাদি অধ্যয়ন করলে লাভবান হবে। বিনয়ের সাথে আমার লিখিত তারীখে দাওয়াত ওয়া আজিমাত গ্রন্থখানাও পাঠ করার পরামর্শ দেব।

প্রশ্ন : কিছু মানুষের ধারণা, কুরআন শরীফ নাযেরা পড়ার চেয়ে অর্থ বুঝে পড়া উচিত। তোতা পাখির মত বাক্য আওড়িয়ে লাভ কী? এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য জানতে চাচ্ছি।

উত্তর : আমার মতে শুরুতে নাযেরা কুরআন শরীফ পড়া খুবই জরুরি। আমি এ ব্যাপারে কখনই একমত নই যে, কুরআন শরীফ বুঝে পড়ার যোগ্যতা অর্জনের আগ পর্যন্ত নাযেরা পড়া মাওকুফ রাখতে হবে। নাযেরা পড়া এবং শুধু তিলাওয়াতই বড় এবং মুখ্য একটি ইবাদত। অর্থ বুঝে পড়া আলাদা বিষয় এবং জরুরি। একটির কারণে অপরটিকে বাদ দেওয়া যায় না।

 

(লাহোরের মাসিক সাইয়ারা-এর সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ সংখ্যায় এ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়।

[অনুবাদ করেছেন আবু বকর সিরাজী])

 

 

advertisement