যিলকদ-যিলহজ্ব ১৪২৮   ||   ডিসেম্বর ২০০৭

যিলহজ্ব, হজ্ব ও কুরবানী

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

প্রবন্ধটিতে কুরআন-হাদীস থেকে কুরবানীর দলীল সমূহ কিছুটা বিস্তারিতভাবে পেশ করা হয়েছে। কুরবানীর মত একটি শত সিদ্ধ ওয়াজিব আমল যা শায়াইরে ইসলামের অন্তর্ভূক্ত -এর ব্যপারে গবেষণাধর্মী আলোচনার প্রয়োজন কেন দেখা দিয়েছে তার উত্তর প্রবন্ধের শেষদিকে পাওয়া যাবে।

যিলহজ্ব শব্দটির আরবী উচ্চারণ  ذو الحجة যুলহিজ্বাহ। বাংলায় যিলহজ্ব উচ্চারণে প্রসিদ্ধ। এই মাস আশহুরে হুরুম-তথা সম্মানীত চার মাসের অন্তর্ভুক্ত। এ মাসের, বিশেষত এর প্রথম দশ দিনের অনেক ফযীলত রয়েছে। ইসলামের অনেক বড় একটি রোকন ও নিদর্শন হজ্ব এবং অপর বড় নিদর্শন কুরবানী এ মাসেই পালিত হয়। এ থেকেও এ মাসের গুরুত্ব অনুধাবন  করা যায়

আলকাউসারের যিলহজ্ব ১৪২৬ হিজরী, জানুয়ারী ২০০৬ঈ. সংখ্যায় যিলহজ্ব মাস : ফযীলত ও করণীয় শিরোনামে যেহেতু মোটামুটি বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে তাই উপরোক্ত বিষয়ে কিছু লিখছি না। শুধু এটুকু আরজ করছি যে, অন্তত এ মাসে মুমিনদের অবস্থা এমন হওয়া উচিত যে, তারা হজ্বের স্থান ও স্মৃতিচিহ্নগুলোকে স্মরণ করে মেহেরবান আল্লাহর কাছে দুআ করবেন, ইয়া আল্লাহ! আমাদের যে ভাইদের হজ্বে যাওয়ার তাওফীক হয়েছে তাদের হজ্বে মাবরূর নসীব করুন। তাদের কাজগুলো সহজ করে দিন এবং তাদেরকে সুস্থ ও নিরাপদ স্থানে রাখুন। আর আমরা যারা হজ্বের দেশ থেকে দূরে পড়ে আছি আমাদেরকে সেখানে যাওয়ার তাওফীক দান করুন এবং বার বার উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য দান করুন।

আরাফার দিন আল্লাহর দয়া ও রহমতের সাগরে জোয়ার আসে এবং সেদিন তিনি হাজ্বীদের ক্ষমা করে থাকেন, জাহান্নাম থেকে মুক্তির পরওয়ানা দিয়ে থাকেন। সেদিন তাদের ওসিলায় অন্য অনেক সৌভাগ্যবানও ক্ষমার নেয়ামত লাভ করে থাকে। আমাদের প্রত্যেকের অন্তরেই এই তামান্না থাকা উচিত  যে, সেই সৌভাগ্যবানদের তালিকায় আমার নামটিও যেন এসে যায়।

পাশাপাশি এই চিন্তাও সদা জাগ্রত রাখা উচিত যে, এখন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে রহমত ও মাগফিরাতের বারিধারা বর্ষিত হচ্ছে। এ সময় সতর্ক থাকা উচিত এবং গুনাহ থেকে বিরত থাকা উচিত। এমন যেন না হয় যে, আল্লাহ না করুন, রহমত ও মগফিরাতের এই মৌসুমেও অসতর্কতার কারণে বঞ্চিতই রয়ে গেলাম।

বাইতুল্লাহর হজ্ব

হজ্বের বিধান ও তাৎপর্য সম্পর্কে অনেক কিছু লেখা হয়েছে। আলকাউসারের বিগত সংখ্যাগুলোতেও একাধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এখানে আমি শুধু হজ্বের তালবিয়া সম্পর্কে একটি কথা আরজ করব।

হজ্বের মধ্যে হাজ্বী সাহেবদের সার্বক্ষণিক অজিফা হল,

لبيك اللهم لبيك، لبيك لا شريك لك لبيك، إن الحمد والنعمة لك والملك، لا شريك لك

ইহরামের সূচনা নিয়ত ও উপরোক্ত তালবিয়া পাঠের মাধ্যমে হয়। তালবিয়ার মর্ম নিয়ে সামান্য চিন্তা করলেই দেখা যাবে, এতে ঈমান, তাওহীদ, তাফবীয, ইহসান শোকর, তাওয়াক্কুল ইত্যাদি সব-কিছুই বিদ্যমান রয়েছে। ঈমানের সর্বশ্রেষ্ঠ পর্যায় হল তাফবীয ও ইহসান অর্থাৎ নিজেকে এবং নিজের সকল কিছুকে আল্লাহ তাআলার হাওয়ালা করে দেওয়া এবং এই অনুভূতির সঙ্গে জীবনযাপন করা যে, আমি আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর সামনে উপস্থিত। তালবিয়ার মাধ্যমে বান্দার পক্ষ থেকে এই ঘোষণাই প্রদান করা হয় এবং এটাই তালবিয়ার মর্মবাণী। ঈমানের এই অবস্থা সৃষ্টি করা এবং এই পর্যায়ে উপনীত হওয়ার জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা আমাদের কর্তব্য। শুধু হাজ্বী সাহেবদের কর্তব্য নয়, সবার কর্তব্য। শুধু হজ্ব-মওসুমের কর্তব্য নয়, সারা জীবনের কর্তব্য। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দিন। আমীন।

কুরবানী

কুরবানী ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান এবং ইবাদতের একটি বিশেষ প্রকার। কুরবানীর একটি ইসলামী তাৎপর্য রয়েছে এবং একটি জাহেলী ধারণা রয়েছে। জাহেলী ধারণা হল, মূর্তি বা দেব-দেবীর সন্তুষ্টি লাভের জন্য, কিংবা জিন-শয়তান বা অশুভ শক্তির কাল্পনিক ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাদের উদ্দেশ্যে কোনো প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করার কুসংস্কার প্রসূত রীতি। তাওহীদের ধর্ম ইসলামে এ রীতি-নীতির অনুসরণ শিরক ও হারাম।

এর বিপরীতে কুরবানীর ইসলামী অর্থ হল, আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের জন্য শরীয়তনির্দেশিত পন্থায় কোনো প্রিয় বস্তু যা শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত, আল্লাহ তাআলার দরবারে পেশ করা এবং শরীয়তনির্দেশিত পন্থায় তা ব্যবহার করা।

এই কুরবানী আদম আ.-এর যুগ থেকে বিদ্যমান রয়েছে। সূরা মাইদায় আয়াত ২৭-৩১ এ আদম আ.-এর দুসন্তানের কুরবানীর কথা এসেছে। তবে প্রত্যেক নবীর শরীয়তে কুরবানীর পন্থা এক ছিল না। সবশেষে  সকল জাতি ও ভূখণ্ডের জন্য এবং কিয়ামত পর্যন্ত সময়ের জন্য যে নবী প্রেরিত হয়েছেন অর্থাৎ হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর প্রতি নাযিল হয়েছে সর্বশেষ ও চিরন্তন শরীয়ত, কুরআন ও সুন্নাহর শরীয়ত। এ শরীয়তে কুরবানীর যে পন্থা ও পদ্ধতি নির্দেশিত হয়েছে তার মূলসূত্র মিল্লাতে ইবরাহীমীতে বিদ্যমান ছিল। কুরআন মজীদ ও সহীহ হাদীস থেকে তা স্পষ্ট জানা যায়। এজন্য কুরবানীকে সুন্নতে ইবরাহীমী নামে অভিহিত করা হয়।

ফার্সী, উর্দু ও বাংলা ভাষায় কুরবানী শব্দটি আরবী কুরবান শব্দ স্থলে ব্যবহৃত হয়। কুরবান শব্দটি  ق ر ب  মূলধাতু (যার অর্থ হচ্ছে, নৈকট্য) থেকে নির্গত। তাই আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের জন্য শরীয়তসম্মত পন্থায় বান্দা যে আমল করে, আভিধানিক দিক থেকে তাকে কুরবান বলা যেতে পারে। তবে শরীয়তের পরিভাষায় কুরবান শব্দের মর্ম তা-ই যা উপরে উল্লেখিত হয়েছে।

ইসলামী শরীয়তে এই পারিভাষিক অর্থে দু ধরনের কুরবানী রয়েছে।

১. যা হজ্বের মওসুমে নির্ধারিত (মক্কা ও মিনায়) স্থানে হজ্ব ও উমরা কারীগণ আদায় করে থাকেন। তা কিরান বা তামাত্তু হজ্ব আদায়কারীর ওয়াজিব কুরবানী হতে পারে, কিংবা ইফরাদ হজ্বকারীর নফল কুরবানী। হাজ্বী সঙ্গে করে নিয়ে আসা হাদি হতে পারে, কিংবা হজ্ব আদায়ে অক্ষম হওয়ার বা কোনো নিষিদ্ধ কর্মের জরিমানারূপে অপরিহার্য কুরবানী। মানতের কুরবানী হতে পারে কিংবা দশ যিলহজ্বের সাধারণ কুরবানী। এ কুরবানীর বিধান মৌলিকভাবে এসেছে সূরা হজ্ব ২৭-৩৭, সূরা বাকারা ১৯৬, সূরা মাইদা ২, ৯৫-৯৭, সূরা ফাতহ ২৫-এ। আর হাদীস শরীফে তা বিস্তারিতভাবে উল্লেখিত হয়েছে।

২. সাধারণ কুরবানী, যা হজ্ব-উমরার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এবং এ কুরবানীর স্থানও নির্ধারিত নয়। তবে সময় নির্ধারিত। যে তারিখে হজ্ব আদায়কারীগণ মিনা-মক্কায় কুরবানী করে থাকেন সে তারিখে অর্থাৎ যিলহজ্বের দশ, এগারো, বারো তারিখে এ কুরবানী হয়ে থাকে। এটা পৃথিবীর সকল মুসলিম পরিবারের জন্য; বরং প্রত্যেক মুকাল্লাফ মুসলমানের জন্য এসেছে। কারো জন্য তা ওয়াজিব, আর কারো জন্য নফল।

এ কুরবানীর উল্লেখ এসেছে সূরা আনআমের ১৬১-১৬৩ আয়াতে এবং সূরা কাউসারের ২ আয়াতে। আর বিস্তারিত বিধি-বিধান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহতে বিদ্যমান রয়েছে।

৪. সূরা আনআমে এসেছে,

قُلْ اِنَّنِیْ هَدٰىنِیْ رَبِّیْۤ اِلٰی صِرَاطٍ مُّسْتَقِیْمٍ ۚ۬ دِیْنًا قِیَمًا مِّلَّةَ اِبْرٰهِیْمَ حَنِیْفًا ۚ وَ مَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِیْنَ۝۱۶۱ قُلْ اِنَّ صَلَاتِیْ وَ نُسُكِیْ وَ مَحْیَایَ وَ مَمَاتِیْ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَۙ۝۱۶۲ لَا شَرِیْكَ لَهٗ ۚ وَ بِذٰلِكَ اُمِرْتُ وَ اَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِیْنَ.

আপনি বলে দিন, আমার প্রতিপালক আমাকে পরিচালিত করেছেন সরল পথের দিকে এক বিশুদ্ধ দ্বীনের দিকে, অর্থাৎ একনিষ্ঠ ইব্রাহীমের মিল্লাত (তরীকা), আর ছিলেন না তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত। আপনি বলুন, নিঃসন্দেহে আমার সালাত, আমার নুসুক এবং আমার জীবন এবং আমার মৃত্যু সমস্ত জগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। তাঁর কোন শরীক নেই। আর ঐ বিষয়েই আমাকে আদেশ করা হয়েছে, সুতরাং আমি হলাম অত্মসমর্পণকারীদের প্রথম।

এ আয়াতে نُسُكٌ শব্দটি বিশেষ মনোযোগের দাবিদার। এটি نسيكة শব্দের বহুবচন, যার অর্থ হল, আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য আল্লাহর নামে জবাইকৃত পশু। এখান থেকেই আরবী ভাষায় এবং শরীয়তের পরিভাষাতেও কুরবানীর স্থানকে منسك বলা হয়। আরবী ভাষার প্রাচীন, আধুনিক, ছোট, বড় যেকোনো অভিধানে এবং লুগাতুল কুরআন, লুগাতুল হাদীস, লুগাতুল ফিকহের যেকোনো নির্ভরযোগ্য কিতাবে نُسُكٌ শব্দের উপরোক্ত অর্থ পাওয়া যাবে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ কিছু প্রাচীন গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিচ্ছি।

আসসিহাহ খ. ৪ পৃ. ১৬১২; লিসানুল আরব খ. ১৪ পৃ. ১২৭-১২৮; তাজুল আরূস খ. ৭ পৃ. ২৮৭; আলমুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআন পৃ. ৮০২; আননিহায়া ফী গারীবিল হাদীসি ওয়াল আছার খ. ৫ পৃ. ৪৮; মাজমাউ বিহারিল আনওয়ার খ. ৪ পৃ.৭১৪-৭১৫; আলমিসবাহুল মুনীর ফাইয়ুমী পৃ. ৩১১; আলমুগরিব, মুতাররিযী খ. ২ পৃ. ৩০০

সূরা বাকারার ১৯৬ নং আয়াতেও نُسُكٌ শব্দ একই অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

উপরোক্ত আয়াতের অর্থ পরিষ্কার। হযরত ইবরাহীম আ.কে যে খালেছ তাওহীদ ও সিরাতে মুস্তাকীমের প্রত্যাদেশ আল্লাহ তাআলা করেছিলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিও তা নাযিল করেছেন এবং তাঁকে আদেশ করেছেন যে, বল, আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মরণ সব আল্লাহ তাআলার জন্য।

উল্লেখ্য আরবী ভাষায় نُسُكٌ শব্দটি ইবাদতের অর্থেও ব্যবহার হয়। এখান থেকেই ইবাদতকারীকে ناسك ও ইবাদতের পদ্ধতিকে  منسك বলা হয়। সূরা আনআমের উক্ত আয়াতে যদি نُسُكٌ শব্দের অর্থ ইবাদতও করা হয়, তবুও এর ব্যাপকতার মধ্যে কুরবানী অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল আযহার কুরবানীকে একাধিক হাদীসে نُسُكٌ বলেছেন। কুরবানীর পশু যবেহ করার সময় যে দুআ পড়ার কথা হাদীসে এসেছে তাতেও ওই আয়াত রয়েছে। পূর্ণ হাদীস লক্ষ করুন।

জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন দুটি দুম্বা যবেহ করলেন। যবেহর সময় যখন সেগুলোকে কিবলামুখী করেছেন তখন বলেছেন,

إني وجهت وجهي للذي فطر السموات والأرض على ملة إبراهيم حنيفا مسلما وما أنا من المشركين، إن صلاتي ونسكي ومحياي ومماتي لله رب العالمين، لا شريك له وبذلك أمرت وأنا أول المسلمين، بسم الله، والله أكبر، اللهم منك ولك عن محمد وأمته.

-সুনানে আবু দাউদ ৩/৯৫, হাদীস : ২৭৯৫; মুসনাদে আহমদ ৩/৩৭৫ হাদীস : ১৫০২২;

সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৮৯৯ واللفظ منهما جميعا

কুরবানীর শুরুতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই আয়াত ও দুআ পড়া থেকে যেমন প্রমাণ হয়, কুরবানী খালিছ ইবাদত তেমনি একথাও প্রমাণ হয় যে, সূরা আনআমের ১৬২ নং আয়াতে نُسُكٌ শব্দের অর্থ ঈদুল আযহার কুরবানী কিংবা তাতে অবশ্যই কুরবানী শামিল রয়েছে।

অপর যে আয়াতে সাধারণ কুরবানীর উল্লেখ রয়েছে তা হল সূরা কাউসারের দ্বিতীয় আয়াত। ইরশাদ হয়েছে,

اِنَّاۤ اَعْطَیْنٰكَ الْكَوْثَرَؕ۝۱ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَ انْحَرْؕ۝۲ اِنَّ شَانِئَكَ هُوَ الْاَبْتَرُ

এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এবং তাঁর মাধ্যমে গোটা উম্মতকে সালাত (নামায) ও নাহর (কুরবানীর) আদেশ দেওয়া হয়েছে। نحر শব্দের মূল ব্যবহার হল উট যবেহ করা, তবে সাধারণত যেকোনো পশু যবেহ করাকেই نحر বলা হয়। আয়াতে এমন যবেহ উদ্দেশ্য, যা আল্লাহ তাআলার জন্য ইবাদত হিসেবে করা হয়। সেটা হচ্ছে হজ্ব ও উমরার কুরবানী এবং ঈদুল আযহার সাধারণ কুরবানী।

এ কুরবানীর সময় যদিও তিন দিন অর্থাৎ যিলহজ্বের দশ, এগারো ও বারো তারিখ, তবে উত্তম দিন হল দশ তারিখ। সাধারণভাবে এ তারিখেই অধিকাংশ কুরবানী হয়ে থাকে। এজন্য দশ যিলহজ্বের ইসলামী নাম হল ইয়াওমুন নাহর -সহীহ বুখারী হাদীস ৫৫৫০

আয়াতে নামাযের যে আদেশ এসেছে তাতে ঈদের নামাযও শামিল রয়েছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুন্নাহর মাধ্যমে এ আয়াতে নাযিল হওয়া ইলাহী নির্দেশের অনুসরণ-পদ্ধতি বাতলে দিয়েছেন। একটি হাদীস লক্ষ করুন।

সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য হাদীসগ্রন্থে বহু সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল আযহার দিন নামায পরবর্তী খুতবায় বলেছেন, এই দিনের প্রথম করণীয় হল সালাত আদায় করা এরপর নহর (কুরবানী) করা। যে সালাত আদায়ের পর নুসুক (কুরবানী) করল তার নুসুক পূর্ণ হল এবং সে মুসলিমদের পন্থা অনুসরণ করল। আর যে সালাতের আগে যবেহ করল সেটা তার গোশতের প্রয়োজন পূরণ করবে, কিন্তু তা নুসুক হিসেবে গণ্য হবে না।

এই হাদীস বহু সহীহ সনদে বিভিন্ন হাদীসগ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে। কোথাও বিস্তারিতভাবে, কোথাও সংক্ষিপ্তভাবে। এখানে কিছু হাওয়ালা উল্লেখ করছি। -সহীহ বুখারী, হাদীস, ৯৫১, ৯৫৫, ৯৬৫, ৯৬৮, ৫৫৪৫, ৫৫৪৬; সহীহ মুসলিম হাদীস ১৯৬১, , , ; মুসনাদে আহমদ ৪/২৮১-২৮২, ৩০৩; জামে তিরমিযী হাদীস ১৫০৮, সুনানে নাসায়ী হাদীস ৪৩৯৪-৪৩৯৫; সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস ৫৯০৭, ৫৯১০, ৫৯১১

এই হাদীসে সূরাতুল কাউসারের ব্যাখ্যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল থেকে পাওয়া গেল, যার সারমর্ম এই যে,

فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَ انْحَرْ

সুতরাং আপনার পালনকর্তার উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করুন এবং কুরবানী করুন। সালাত আদায় করুন শব্দে ঈদের নামায এবং কুরবানী করুন শব্দে ঈদুল আযহার কুরবানীও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আমল ও ইরশাদ থেকে একথাও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, ঈদুল আযহার কুরবানী হচ্ছে, ওই নুসুক, যা সূরা আনআমের ১৬২ নং আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে। আর তা আদায় করা হয় আল্লাহ তাআলার ইবাদত হিসেবে। এর উদ্দেশ্যে গোশত ভক্ষণ করা বা গোশতের প্রয়োজন পূরণ করা নয়। তবে কুরবানী হয়ে যাওয়ার পর আল্লাহ তাআলা সে পশুর গোশত কুরবানীদাতার জন্য হালাল করেছেন এবং দশ যিলহজ্ব থেকে মোট চার দিন রোযা রাখতে নিষেধ করে যেন তাঁর মেহমানদারী কবুল করার আদেশ দিয়েছেন।

ঈদুল আযহার দিবস মুসলমানদের জন্য খুশির দিবস। খুশির অন্তর্নিহিত কারণ হচ্ছে আরাফা দিবসের ব্যাপক মাগফিরাত, কুরবানী দিবসে আল্লাহর দরবারে কুরবানী পেশ করার সৌভাগ্য এবং আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়া কুরবানী থেকে মেহমানদারী লাভ। বলাবাহুল্য, এই তাৎপর্য অনুধাবন করার জন্য অন্তরে প্রয়োজন ঈমানের মিষ্টতা এবং খালিক ও মালিকের মহব্বত ও ভালোবাসা। বস্তুবাদী ও যুক্তিপুজারী হৃদয় দুঃখজনকভাবে এ নিয়ামত থেকে শূণ্য।

সুন্নাহর আলোকে কুরবানী

এ পর্যন্ত শুধু কুরআন মজীদ থেকে আলোচনা করা হল। যদি এ বিষয়ের সহীহ হাসান হাদীসগুলো একত্রিত করা হয় তবে একটি দীর্ঘ কিতাব তৈরি হতে পারে। শুধু সহীহ ইবনে হিব্বানে কিতাবুল উযহিয়া হাদীসের ধারাবহিক ক্রমিক নং অনুসারে ৫৮৯৭ থেকে ৫৯৩৩ পর্যন্ত বিস্তৃত। এগুলোকে মধ্যে সামান্য কিছু পুনরুল্লেখ রয়েছে। পক্ষান্তরে এ কিতাবের বাইরেও এ বিষয়ে আরো সহীহ হাদীস অন্যান্য কিতাবে রয়েছে।

উপরে উল্লেখিত হাদীসগুলো ছাড়া এখানে আরো কয়েকটি হাদীস পেশ করছি।

১. উম্মে সালামা রা. থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কুরবানীর ইরাদাকারী যিলহজ্বের চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর, যেন তার নখ, চুল ইত্যাদি কর্তন না করে, কুরবানী করা

পর্যন্ত। -সহীহ মুসলিম হাদীস ১৯৭৭/৩৯-৪২; তিরমিযী হাদীস ১৫২৩; আবু দাউদ, হাদীস ২৭৯১; নাসায়ী হাদীস ৪৩৬২-৪৩৬৪, সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস ৫৮৯৭, ৫৯১৬, ৫৯১৭

২. আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রা. সূত্রে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসে এসেছে যে, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে দ্বীন বিষয়ে জানতে এসেছিল। জওয়াব নিয়ে যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে আবার ডাকলেন এবং বললেন,

أمرت بيوم الأضحى جعله الله عيدا لهذه الأمة.

আমাকে ইয়াওমুল আযহার আদেশ করা হয়েছে (অর্থাৎ, এ দিবসে কুরবানী করার আদেশ করা হয়েছে।) এ দিবসকে আল্লাহ এ উম্মতের জন্য ঈদ বানিয়েছেন। লোকটি বলল, আমার কাছে যদি শুধু পুত্রের দেওয়া একটি দুধের পশু থাকে আমি কি তা-ই কুরবানী করব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, বরং তুমি সেদিন তোমার মাথার চুল কাটবে (মু-াবে বা ছোট করবে) নখ কাটবে, মোচ কাটবে এবং নাভির নিচের চুল পরিষ্কার করবে। এটাই আল্লাহর কাছে তোমার পূর্ণ কুরবানী গণ্য হবে। -মুসনাদে আহমদ ২/১৬৯; হাদীস ৬৫৭৫; সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস ৭৭৩, ৫৯১৪; আবু দাউদ হাদীস ২৭৮৯; নাসায়ী হাদীস ৪৩৬৫

৩. আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যার কাছে সম্পদ আছে এরপরও সে কুরবানী করল না (অর্থাৎ কুরবানী করার সংকল্প তার নেই) সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটেও না আসে। -মুসনাদে আহমদ ২/৩২১; মুসতাদরাক হাকিম ৪/২৩১, হাদীস ৭৬৩৯

وحسنه الألباني في تخريج مشكلة الفقر ،، وقد أصاب

৪. আলী রা. বলেন,

أمرنا رسول الله صلى الله عليه وسلم أن نسشرف العين والأذن وأن لا نضحي بمقابلة ولا مدابرة، ولا شرقاء، ولا خرقاء.

আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করেছেন আমরা যেন (কুরবানী পশুর) চোখ ও কান ভালো করে দেখে নিই এবং কান কাটা বা কান ফাড়া ও কানে গোলাকার ছিদ্র করা পশু দ্বারা কুরবানী না করি। -মুসনাদে আহমদ ১/৮০; ১০৮, ১৪৯; সহীহ ইবনে খুযাইমা হাদীস ২৯১৪-২৯১৫; আবু দাউদ হাদীস ২৮০৪; নাসায়ী হাদীস ৪৩৭৩-৪৩৭৪

৫. বারা ইবনে আযিব রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

أربع لا يضحى بهن : العوراء البين عورها، والمريضة البين مرضها، والعرجاء البين ظلعها، والعجفاء التي لا تنقي.

চার ধরনের পশু দ্বারা কুরবানী করা যায় না। যে পশুর চোখের জ্যোতি ক্ষতিগ্রস্ত, যে পশু অতি অসুস্থ, যে পশু খোঁড়া আর যে পশু অত্যধিক শীর্ণকায়। -মুয়াত্তা মালিক ২/৪৮২; সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস ৫৯১৯; নাসায়ী হাদীস ৪৩৭০-৪৩৭১; তিরমিযী হাদীস ১৪৯৭

واللفظ لابن حبان

কুরবানী সম্পর্কে আরো অনেক হাদীস ও আছার এসেছে। এখানে সবগুলো সংকলিত করা আমার উদ্দেশ্য নয়, আমি শুধু আরেকটি হাদীস উল্লেখ করে শেষ করছি। আম্মাজান আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানী করার জন্য একটি দুম্বা আনতে বললেন, যার শিং রয়েছে, যার পা কালো, পেটের চামড়া কালো এবং চোখ কালো। দুম্বা আনা হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আয়েশা, আমাকে ছুরি দাও। এরপর বললেন, একটি পাথরে ঘষে ধারালো করে দাও। তিনি ধারালো করে দিলেন। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছুরি হাতে নিলেন এবং দুম্বাটি মাটিতে শায়িত করলেন। এরপর বিসমিল্লাহ বলে যবেহ করলেন এবং বললেন,

اللهم تقبل من محمد وآل محمد ومن أمة محمد.

ইয়া আল্লাহ! মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে, মুহাম্মাদের পরিবারের পক্ষ থেকে এবং মুহাম্মাদের উম্মতের পক্ষ থেকে কবুল করুন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৯৬৭, সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস ৫৯১৫; আবু দাউদ হাদীস ২৭৯২

অন্য হাদীসে এসেছে যে, কুরবানীর পশু যবেহ করার সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দুআ পড়েছেন.-

بسم الله، اللهم منك ولك، اللهم تقبل من محمد.

আল্লাহর নামে। ইয়া আল্লাহ! তোমার নিকট থেকে এবং তোমার উদ্দেশ্যে। ইয়া আল্লাহ! মুহাম্মাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। -আলমুজামুল কাবীর, তবারানী হাদীস ১১৩২৯; মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২১

মোটকথা, পূর্ণ তাওহীদ ও ইখলাসের সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেখানো পদ্ধতিতে আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার আশা অন্তরে নিয়ে কুরবানী করা উচিত। আল্লাহ তাআলার আদেশ পালন করে কবুল হওয়ার প্রত্যাশা এবং আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মেহমানদারীর সৌভাগ্য লাভের অনুভূতি বান্দার মধ্যে আনন্দও সৃষ্টি করে। আর এটাই হচ্ছে ঈদুল আযহার প্রাণকথা। কুরবানীর সময় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দুআতে

اللهم منك ولك.

ইয়া আল্লাহ! তোমার নিকট থেকে এবং তোমারই উদ্দেশ্যে চিন্তা-ভাবনা করলে খুব সহজেই বোঝা যায়, কুরবানীর হাকীকত কী। আল্লাহ-প্রদত্ত রিযক এবং আল্লাহর নেয়ামত আমরা লাভ করেছি আর আল্লাহর হুকুমে তা কুরবানী রূপে তাঁর দরবারে পেশ করার সৌভাগ্য লাভ করেছি আবার তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মেহমানদারী হিসেবে তা গ্রহণ করার নির্দেশনা পেয়েছি।

এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, কুরবানী নামায-রোযার মতো ফরয আমল নয়, তবে এটি অন্যান্য সুন্নতে মুয়াক্কাদার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব আমল। সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিত কুরবানী করেছেন, কোনো বছর বাদ দেননি (আল ইসতিযকার, ইবনে আব্দিল বার ১৫/১৬৩-১৬৪) কখনো কখনো কুরবানী করার জন্য সাহাবীদের মধ্যে কুরবানীর পশু বণ্টন করেছেন। -সহীহ বুখারী হাদীস ৫৫৫৫

আর হযরত আলী রা.কে আদেশ করেছেন (ইন্তেকালের পরেও) তাঁর পক্ষ থেকে কুরবানী করতে। তাই তিনি প্রতি বছর নিজের কুরবানীর সঙ্গে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকেও কুরবানী করতেন। -মুসনাদে আহমদ হাদীস ৮৪৩, ১২৭৮, আবু দাউদ হাদীস ২৭৮৭

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত উম্মতের মধ্যে এই ইবাদত তাওয়ারুছ তাওয়াতুরের সঙ্গে চলমান রয়েছে এবং প্রতিবছর শিয়াররূপে (ইসলামের একটি প্রকাশ্য ও সম্মিলিতভাবে আদায়যোগ্য ইবাদত হিসেবে) তা আদায় করা হয়েছে। অতএব কেউ যদি মনে করে, কুরবানী ইবাদত নয় এবং ইসলামী শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত নয় তবে সে শরীয়ত অস্বীকারকারী।

নয়া যামানার তাহরীফী ফিতনা

কেউ হয়ত ভাবতে পারেন, কুরবানীর মতো একটি সর্বজনবিদিত বিধান সম্পর্কে এত দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন কী? কুরবানীর ফযীলত ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু মাসলা-মাসায়েল উল্লেখ করা হলেই তো প্রয়োজন সেরে যায়, কুরবানী যে শরীয়তের একটি বিধান-এ বিষয়ে দলীল প্রমাণের আলোচনা-উদ্ধৃতির প্রয়োজন আসলে কী?

বস্তুত এ সময়টা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে বিশৃঙ্খলা ও নীতিহীনতার যুগ। কোনো বিষয়ের প্রকৃত রূপ বিকৃত করে অভিনব কিছু প্রকাশ করাই যেন এ সময়ের গবেষকদের কীর্তি হিসেবে গণ্য হয়। পাশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণায় প্রভাবিত একটি শ্রেণী অজ্ঞতা ও অহংবোধের সঙ্গে যে বিষয়কে তাদের নির্যাতনের টার্গেট বানিয়েছে তা হল ইসলামী শরীয়তের বিধিবিধান। ভারত-পাকিস্তানের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী, মুনকিরে হাদীস এবং মুলহিদ-মুনাফিক দীর্ঘদিন পর্যন্ত কুরবানীর মতো ইসলামী বিধানকে ভিত্তিহীন, অযৌক্তিক প্রমাণ করার অপচেষ্টায় লিপ্ত আছে। তাদের প্রতিনিধি হয়ে কিংবা তাদের দেখাদেখি কোনো আগুপিছু না ভেবে আমাদের দেশেরও কিছু লোক ওই আলোচনাগুলো নকল করে থাকে। আমার এক বন্ধু তাদের একটি প্রবন্ধ সংকলন আমাকে এনে দিয়েছিলেন। আমি সংকলনটি দেখে আশ্চর্য হয়েছি।

তাদের জ্ঞান-গরিমার একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি। সূরা ছাফ্ফাতে, যেখানে ইবরাহীম আ.-এর এই ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে যে, আল্লাহ তাআলা পুত্র (ইসমাইল আ.)কে যবেহ করার আদেশ দিয়ে ইবরাহীম আ.-এর পরীক্ষা গ্রহণ করেন এবং তিনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আল্লাহ ইসমাইল আ.কে রক্ষা করেন আর তার পরিবর্তে একটি পশু কুরবানী হওয়ার জন্য প্রেরণ করেন সেখানে এসেছেকুরআন মজীদের শব্দ হল। যিবহুন আর তাকে বানিয়েছে যাবহুন অথচ প্রথমটির অর্থ হচ্ছে যবহের জন্য প্রস্তুতকৃত পশু আর দ্বিতীয়টির অর্থ হচ্ছে, যবেহ করা। সেই প্রবন্ধ থেকে অনুমিত হয় যে, তারা যিবহুন যাবহুন এই দুই শব্দের পার্থক্য না বোঝার মত জাহিল নয়। ভাবতে যতই কষ্ট হোক সত্য কথা এটাই মনে হয় যে, তাদের পক্ষে মিল্লাতে ইবরাহীমীর একটি বিধান ও ইবাদত হিসেবে কুরবানীকে সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই ইচ্ছাকৃতভাবে তারা এই তাহরীফ বা অপব্যাখ্যা করেছে এবং গায়ের জোরে একথা বলে দিয়েছে যে, ইসমাইল আ.-এর স্থলে কোনো পশু কুরবানী করা হয়নি। অথচ وَ فَدَیْنٰهُ بِذِبْحٍ عَظِیْمٍ আয়াতে একথাই বলা হয়েছে যে, ইসমাইল আ. এর পরিবর্তে একটি পশু আল্লাহ পাঠিয়েছেন। আর তা-ই যবেহ করা হয়েছিল।

পশুটি কী ছিল তা হাদীস শরীফে এসেছে। তা ছিল একটি দুম্বা। মুজামে কাবীর তবারানীতে নির্ভরযোগ্য সনদে এসেছে, নুমান ইবনে আবু ফাতিমা বলেন, তিনি একটি শিং ওয়ালা ও বড় চোখ বিশিষ্ট দুম্বা ক্রয় করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা দেখে বললেন, এটা তো হুবহু ওই দুম্বার মতোই মনে হচ্ছে যা ইবরাহীম আ. যবেহ করেছিলেন। একথা শুনে এক আনসারী সাহাবী ওই রকম একটি দুম্বা কিনে আনলেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা কুরবানী করলেন। -মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২৩

قال الهيثمي : رواه الطبراني في الكبير، ورجاله ثقات.

মুসনাদে আহমদ ৪/৬৮, হাদীস ১৬৫৯৫; সুনানে আবু দাউদ হাদীস ২০২৭; মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক ৫/৮৬-৮৮ এবং ইমাম আবুল ওয়ালিদ আল আযরাকী (মৃত্যু ২৪৭ হিজরী পরবর্তী) কর্তৃক তারীখু মক্কা হাদীস ২২৩-২২৪ বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য বর্ণনার মাধ্যমে একথাও উল্লেখিত আছে যে, ইসমাইল আ. এর পরিবর্তে যে দুম্বা যবেহ করা হয়েছিল তার দুটি শিং দীর্ঘদিন পর্যন্ত কাবা শরীফের দেওয়ালে ঝোলানো ছিল। যখন কাবা শরীফে আগুন লেগেছিল তখন অন্যান্য বস্তুর সঙ্গে এটাও বিনষ্ট হয়ে যায়। এই সকল বিষয়কে অস্বীকার করার জন্য কুরআনের যিবহুন আযীম শব্দকে যাবহুন আযীম শব্দে পরিবর্তন করা হয়েছে। নাউযুবিল্লাহ।

আশ্চর্যের বিষয় এই যে, নিজেদের অজ্ঞতা অনুধাবন করার পরিবর্তে তারা অন্যদের ওপর এই অভিযোগ দায়ের করেছে যে, তারা আযীম শব্দের অনুবাদ করেছেন দুম্বা! বলা বাহুল্য, এ দাবি সত্য নয়। কেননা, কোনো আলিম তো দূরের কথা, মাদরাসার একজন তালিবে ইলমও এই তরজমা করতে পারে না। সবারই জানা আছে যে, আযীম অর্থ বড়, মহান ইত্যাদি। কিন্তু যিবহুন শব্দের অর্থ হচ্ছে, যবেহর পশু আর হাদীস শরীফে এসেছে যে, তা ছিল দুম্বা।

এরপর তাদের আরেক অভিনব দাবি এই যে, কুরবান শব্দ কোথাও পশু-জবাই অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। একথাও একেবারে ভুল। জুমার দিন তাড়াতাড়ি মসজিদে যাওয়া বিষয়ে যে হাদীস এসেছে তা অনেক সাধারণ মানুষেরও জানা আছে। ওই হাদীসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জুমার দিন যারা প্রথমে আসে তারা যেন উট কুরবানী করল, যারা এরপরে আসে তারা যেন গরু কুরবানী করল.... -সহীহ বুখারী হাদীস ৮৮১

আরবীতে কথাগুলো এভাবে এসেছে।

فكأنما قرب بدنة، ... فكأنما قرب بقرة ... .

মুসনাদে আহমদে এসেছে নিম্নোক্ত শব্দে-

المهجر يريد الجمعة كمقرب القربان، فمقرب جزورا، ومقرب بقرة، ومقرب شاة ومقرب دجاجة، ومقرب بيضة.

উট, গরু এবং বকরীর কুরবান হয় যবেহ করার মাধ্যমে আর মুরগী ও ডিমের কুরবান সাদাকার মাধ্যমে। কেননা এ ছওয়াবের কথাই অন্য হাদীসে এসেছে এভাবে,

كناحر البدنة، كناحر البقرة ...

অর্থাৎ উট যবেহকারীর মতো, গরু যবেহকারীর মতো।-সুনানে ইবনে মাজা হাদীস ১০৯৩

قال البوصيري في الزوائد : إسناده صحيح.

তাই কুরবান শব্দ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীতে পশু যবেহের মাধ্যমে আল্লাহ নৈকট্য অর্জনের অর্থে ব্যবহৃত হয়নি একথা বাস্তবসম্মত নয়।

অরেকটি বড় ইলমী খিয়ানত এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মিথ্যারোপের দৃষ্টান্ত দিচ্ছি।

মুসলিম সমাজে তথাকথিত কুরবানির ঈদ অর্থাৎ পশু জবাইর আনন্দ ধ্যানে রেখেই এই বিনোদন। এ ব্যাপারে আল্লাহর হুকুম থাকলেএ নিবেদনের সুযোগ থাকতো না।

তারপরও ইয়াউমুল আদহা বা ঈদুল আদ্হা অর্থাৎ বলি বা উৎসর্গ দিবস বা উৎসর্গের আনন্দ বলে মুসলিম সমাজে একটি পর্বরীতি চালু আছে। এ দিবসে মুসলিমগণ দিবসের প্রথম ভাগে সকালের দিকে দু রাকাত নামাজ পড়ে এবং অতপর পশু জবাই করে অংশ বিশেষ দান করে বাকিটা আত্মীয়-স্বজন নিয়ে ধুম ধারাক্কা করে আনন্দ করে ভোগ উপভোগ করে। রাসূলের সময় থেকে দেখা যায়, এদিবসে প্রত্যেকেই সাধ্যমত নতুন পোশাক পরিধান করে; ...নানা রকম বিনোদনের মধ্য দিয়ে দিবস যাপন করে। এ উৎসব চলে তিন দিনব্যাপী। রাসূল এ উৎসবটি চালু করেন। তিনি অন্য সমাজের দেখাদেখি এটি চালু করেন। তিনি বলেন, প্রত্যেক জাতি-সম্প্রদায়েরই কিছু কিছু আনন্দের দিবস আছে; আর এটি হলো আমাদের আনন্দের দিন। এ দিনে আমরা নামাজ পড়বো; অতঃপর পশু জবাই করবো। রাসূলের কোন বাণীতেই এ দিবসটি ত্যাগের দিবস বা কুরবানির দিবস বলে উল্লেখ নেই।

বস্তুতঃ এ একটি যৌথ সামাজিক আনন্দ অনুষ্ঠান। আনন্দ করে পশু জবাই করার অনুষ্ঠান নয়। তবে, অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে পশু জবাই করা নয়। যৌথ সামাজিক আনন্দ অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে যথা প্রয়োজন পশু জবাই করার অনুমোদন মাত্র। এটা কোনবাধ্যতামূলক অনুষ্ঠান নয়। পশু কোরবানী একটি বিকল্প প্রস্তাব : পৃ. ১৭-১৮ (নাউযুবিল্লাহ ছুম্মা নাউযুবিল্লাহ)

এখানেও কুরবানী বিষয়ক কুরআনী আয়াত ও দ্বীনী ধারাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

১. তাদের কথার ঢং থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, যদি কুরবানীর আদেশ আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আসত তাহলে কোনো আপত্তি ছিল না কিংবা তার বিপরীতে নতুন কোনো প্রস্তাব পেশ করারও প্রয়োজন হত না, কিন্তু যেহেতু বিষয়টি শুধু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে এসেছে এজন্য তা সংশোধন যোগ্য! আর তাই তারা কুরবানীর বিভিন্ন বিকল্প পেশ করতে শুরু করেছে।

মনে রাখতে হবে যে, এটা মুনকিরে হাদীস (হাদীস অস্বীকারকারী) ফের্কার ধারণা, যারা উম্মাহর সর্বসম্মতিক্রমে কুরআনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুসলিম উম্মাহ থেকে খারিজ। কুরআনের ঘোষণা হচ্ছে,

আর যে রাসূলের আনুগত্য করে সে আল্লাহর অনুগত হল।-সূরা নিসা : ৮০

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে,

আর যে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে তার নিকটে হেদায়াত প্রকাশিত হওয়ার পর এবং মুমিনদের পথ ভিন্ন পথের অনুসরণ করে আমি তাকে সেদিকেই ফিরিয়ে দিব যেদিকে সে ফিরে গেল। আর তাকে জাহান্নামে প্রবিষ্ট করব, তা কতই না মন্দ নিবাস। ¬-সূরা নিসা ১১৫

আরও ইরশাদ হয়েছে,

না তোমার রবের শপথ, তারা মুমিন হবে না যে পর্যন্ত তাদের মধ্যকার  বিসংবাদিত বিষয়ে তোমাকে ফয়সালাদাতা হিসেবে গ্রহণ না করে। অতপর তোমার ফয়সালায় কোনরূপ কুন্ঠা অনুভব না করে আর পূর্নরূপে সমর্পিত না হয়। -সূরা নিসা : ৬৫

অতএব এই ধারণা একেবারেই ভুল যে, ঈদুল আযহার কুরবানীর হুকুম আল্লাহর পক্ষ থেকে আসেনি। কেননা প্রথমত যে বিধান সহীহ হাদীসে এসেছে তা পরোক্ষভাবে আল্লাহ তাআলারই হুকুম এবং ওহীর শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত।

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে যা উপরে আলোচনা করা হয়েছে। তা এই যে, ঈদুল আযহার কুরবানীর বিধান কুরআন মজীদের অন্তত দুই আয়াতে এসেছে।

২. ঈদুল আযহা ইসলামের একটি পরিভাষা, যার অর্থ হচ্ছে ওই ঈদ যাতে আল্লাহর হুকুমে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের জন্য তাঁর দেওয়া পশু থেকে রাসূল নির্দেশিত তরীকায় যবেহ করা। কুরবানী হয়ে যাওয়ার পর তাঁরই আদেশ সে পশুর গোশত নিজেরাও খেয়ে থাকে, আত্মীয়-স্বজনকে হাদিয়া দিয়ে থাকে এবং গরীব-মিসকীনকে সদকা করা হয়।

أضحى আযহা أضحاة শব্দের বহুবচন। আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য নুসুক হিসেবে যে পশু যবেহ করা হয় তাকে আরবী ভাষায় আযহা বলে। তাহলে আযহা অর্থ কুরবানী। ইয়াওমুল আযহা অর্থ কুরবানীর দিন এবং ঈদুল আযহা অর্থ যে ঈদে কুরবানী করা হয়।

এই মর্যাদাপূর্ণ দ্বীনী পরিভাষার অমর্যাদা করে তারা তাকে হিন্দুদের শিরকী উৎসব বলি উৎসবের  সঙ্গে তুলনা করেছে। অথচ বলি হচ্ছে সম্পূর্ণ শিরকী কাজ আর কুরবানী হচ্ছে তাওহীদের শিক্ষা অবলম্বনকারীদের আল্লাহর আদেশ পালন, যা সম্পূর্ণরূপে শিরক মুক্ততা ইখলাস ও তাওহীদের উপর নির্ভরশীল।

৩. এটাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি মিথ্যারোপ যে, তিনি ঈদুল আযহার বিধান অন্যদের দেখাদেখি জারি করেছেন! নাউযুবিল্লাহ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বীনের বিষয় ওহী থেকে গ্রহণ করতেন, অন্য কোনো জাতির অনুকরণ থেকে নয়। অন্যদের দেখাদেখি যদি শরীয়ত প্রণয়ন সম্ভব হত তাহলে আর রাসূলের কী প্রয়োজন ছিল। বুদ্ধিজীবীরাই তা করে ফেলতে পারতেন!

ঈদ সম্পর্কে হাদীস শরীফে এসেছে যে, জাহেলী যুগের লোকদের বৎসরে দুটি দিন ছিল, যে দিনগুলোতে তারা ক্রীড়া-কৌতুক করত। যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় তাশরীফ আনলেন তখন বললেন,

قد أبدلكم الله بهما خيرا منهما : يوم الفطر ويوم الأضحى.

আল্লাহ তোমাদেরকে এ দুদিনের পরিবর্তে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন। তা হচ্ছে ইয়াওমুল ফিতর ও ইয়াওমুল আযহা। -সুনানে নাসায়ী হাদীস ১৫৬১, মুসনাদে আহমদ ৩/১৭৮ হাদীস ১২৮২৭; ৩/১০৩ হাদীস ১২০০৬; সুনানে আবু দাউদ হাদীস ১১৩১

পূর্বের আলোচনায় বিভিন্ন উদ্ধৃতিতে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী উল্লেখ করা হয়েছে,

أمرت بيوم الأضحى جعله الله عيدا لهذه الأمة.

আমাকে ইয়াওমুল আযহাতে কুরবানী করার আদেশ দেওয়া হয়েছে। এ দিনকে আল্লাহ আমাদের জন্য ঈদ সাব্যস্ত করেছেন। এরপরও কি যার রাসূলের প্রতি ঈমান আছে সে এ কথা বলতে পারে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বিধান অন্যদের দেখাদেখি জারি করেছেন? নাউযুবিল্লাহ।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি আল্লাহ তাআলার উদ্ধৃতি ছাড়াও এ বিধান জারি করেছেন তবুও তা আল্লাহ তাআলারই পক্ষ থেকে হত। কেননা, তিনি দ্বীন ও শরীয়ত আল্লাহ তাআলার কাছ থেকেই ওহীর মাধ্যমে গ্রহণ করতেন।

৪.  এ কথাও আপক্তিকর যে, রাসূলের কোনো বাণীতেই এ দিবস ত্যাগের দিবস বা কুরবানীর দিবস বলে উল্লেখিত হয়নি।

মুসলিমরা তো একে ত্যাগের দিবস বলেন না। অতএব এর সূত্র খোঁজারও প্রয়োজন নেই। আর কুরবানীর দিবস শব্দেরই বা কেন প্রয়োজন হল? কেননা হাদীস শরীফে এর সমার্থক বা নিকটবর্তী অর্থবোধক শব্দ বিদ্যমান রয়েছে। হাদীস শরীফে এ দিন কে সাধারণভাবে ইয়াওমুন নাহর বলা হয়েছে। ইয়াওমুন যাবহ শব্দও এসেছে। এ দিনের বিশেষ আমলকে নুসুক তাযহিয়া বলা হয়েছে। আমাদের ভাষায় এর তৃতীয় নাম কুরবান বা কুরবানী সাধারণভাবে পরিচিত। এই নামও হাদীস শরীফে এসেছে, যা ইতোপূর্বে সহীহ বুখারী ও মুসনাদে আহমদের উদ্ধৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে।

এখান থেকেই এ দিবস কুরবানীর দিবস হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। এ নামের সঙ্গে যদি কারো দ্বিমত থাকে তবে তিনি আরবী নাম ইয়াওমুল আযহা ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু তাতে কি মূল বিষয়ে কোনো পরিবর্তন হবে?

৫. একথা বলা যে, আইয়ামে নাহরে (১০-১২ যিলহজ্ব) কুরবানীর কথা ইসলামে এসেছে আসলে উৎসবের প্রয়োজনে। কেননা, উৎসবে গোশতের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। সে প্রয়োজন পূরণ করার  জন্যই এ আয়োজন, নির্ধারিত কোনো ইবাদত হিসেবে নয়!

একথাও সম্পূর্ণরূপে দীনের তাহরীফ বা বিকৃতিসাধন। যদি উৎসবের প্রয়োজনেই কুরবানী বিধিবদ্ধ হত তাহলে তো এত নিয়ম-কানুন, এত মাসআলা-মাসায়েলের প্রয়োজন হত না। এত শর্ত-শারায়েতের প্রয়োজন ছিল না যে, কুরবানীর জন্য এমন পশু হতে হবে। এই এই ত্রট্টটি থাকলে সে পশু দিয়ে কুরবানী শুদ্ধ হবে না। শুধু গৃহপালিত পশু দ্বারাই কুরবানী হবে। অন্য পশু দ্বারা হবে না। এত বয়সের পশু হতে হবে, তার চেয়ে কম বয়সী পশু দ্বারা কুরবানী হবে না। ঈদের নামাযের আগে যবেহ করলে কুরবানী হবে না। শুধু ১০ থেকে ১২ যিলহজ্ব পর্যন্ত কুরবানী করা যাবে, এরপরে আর করা যাবে না। ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি শুধু গোশতের উদ্দেশ্যেই কুরবানী হতো তবে তো যেকোনো হালাল পশু যেকোনো দিন যেকোনো সময় যবেহ করা অনুমোদিত হত।

সালাতুল ঈদের আগে যবেহকৃত পশু সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিষ্কার বলেছেন যে, এটা ইচ্ছে শাতু লাহমিন অর্থাৎ গোশতের ছাগল এর মাধ্যমে নুসুক আদায় হবে না। কুরবানী যদি গোশতের জন্যই হত তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একথার কোনো অর্থ থাকে না।

যদি কুরবানী গোশতের প্রয়োজন পূরণের জন্য হত তাহলে এর জন্য ইখলাস শর্ত হত না এবং শরীয়তে এই মাসআলা থাকত না যে, কোনো শরীক যদি গোশতের নিয়তে কুরবানীতে শরীক হয় তাহলে না তার কুরবানী হবে না অন্যদের।

মোটকথা, কুরবানী একটি ইবাদত। একে সাধারণ পশু-জবাই সাব্যস্ত করা কিংবা গোশতের প্রয়োজন পূরণের মাধ্যমে সাব্যস্ত করা হয় জাহালাত ও অজ্ঞতা, কিংবা পরিকল্পিতভাবে শরীয়ত-বিকৃতির অপচেষ্টা।

৬. একথা বলা যে, ঈদুল আযহার আনন্দ হচ্ছে পশু-জবাইয়ের আনন্দ কিংবা শুধু আনন্দ করার জন্য পশু ধরে ধরে জবাই করা-এটাও হয় জাহালাত, কিংবা শরীয়ত বিকৃতির অপচেষ্টা।

ঈদুল আযহার আনন্দ হচ্ছে আল্লাহর আদেশ পালনের আনন্দ। আল্লাহ এ আনন্দ উদযাপনের আদেশ করেছেন। এ আনন্দ আরাফা-দিবসের সাধারণ মাগফিরাত হাসিল হওয়ার আনন্দ। হাজীদের জন্য হজ্ব সম্পন্ন করতে সক্ষম হওয়ার আনন্দ। সবার জন্য আল্লাহর দরবারে কুরবানী পেশ করার সৌভাগ্য লাভের আনন্দ। এরপর আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়া বস্তু থেকে, যা ইখলাসের সঙ্গে কুরবানী আদায়কারী প্রত্যেক মুমিনের অন্তরের প্রত্যাশা, আল্লাহ তাআলার মেহমানদারীরূপে গ্রহণ করার আনন্দ। পশু জবাইয়ের দর্শন-সুখে(!) কোনো মুমিন কি সুখী হয়? তাঁদের সুখ তো আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মধ্যে।

বস্তুত ইসলামী ঈদকে যখন লোকেরা অন্যান্য জাতির উৎসবের সঙ্গে তুল্যমূল্য মনে করতে থাকে তখনই তারা এ ধরনের অদ্ভুত সব কথাবার্তা বলতে থাকে। অথচ ইসলামের ঈদ স্বরূপ ও তাৎপর্য, বিধান ও সম্পাদন-পদ্ধতি সকল দিক থেকে অন্যদের পর্ব-উৎসব থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ বিষয়ে আলকাউসারের রমযান-শাওয়াল ১৪২৭ হি. সংখ্যায় কিছুটা বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি।

আলোচিত বইটিতে ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তি, অপব্যাখ্যা ও অপপ্রচারের যে দৃষ্টান্তগুলো রয়েছে তার ফিরিস্তি অনেক দীর্র্ঘ। আমি শুধু ভূমিকা থেকে নেওয়া কিছু কথার পর্যালোচনা করলাম সম্পূর্ণ বইয়ের উপর আলোচনা এক প্রবন্ধে করা সম্ভব নয়, এর জন্য স্বতন্ত্র রচনা প্রয়োজন।

আল্লাহ তাআলা প্রতি যুগের বেদীন, বেইলম ও বেআমল গবেষকদের অপপ্রচারের ফিতনা থেকে উম্মতকে রক্ষা করুন এবং আমাদেরকে সম্পূর্ণ তাওহীদ ও ইখলাসের সঙ্গে সুন্নত মোতাবেক এই গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত আদায় করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

প্রসঙ্গত পাঠকদের কাছে অনুরোধ থাকবে, তারা যেন এ সংখ্যার মাসায়িলে কুরবানী শীর্ষক প্রবন্ধটিও মনোযোগের সঙ্গে পড়েন, যাতে আমাদের এই আমল সকল রকম ভুল ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকে এবং আল্লাহর দরবারে মাকবুল হয়।

 

 

advertisement