পতন
ক্ষয় ও অবক্ষয়ের গল্প
গত ১৮ অক্টোবর রাজধানীর অভিজাত এলাকা থেকে ইয়াবাসহ ছয় তরুণ গ্রেফতার হয়েছে। এরপর বিভিন্ন জায়গা থেকে আরো কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ সম্পর্কে প্রতিবেদনমূলক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সেসব রিপোর্টে উঠে এসেছে সমাজের উচ্চবিত্ত ও অভিজাত শ্রেণীর অবক্ষয়ের একটি করুণ চিত্র। গ্রেফতারকৃত সকলেই বিত্তশালী পরিবারের সন্তান। দামী মোটরসাইকেল ও প্রাইভেট কারে করে নির্ধারিত গ্রাহকদের কাছে তারা ইয়াবা পৌঁছে দিত। রাজধানীর বিভিন্ন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সামনে এরা আড্ডা দিত এবং নতুন গ্রাহক সংগ্রহ করত। আড্ডা ও বন্ধুত্বের ছল করে তরুণ-তরুণীদেরকে ইয়াবাসেবনে উদ্বুদ্ধ করা হত। একবার নেশা হয়ে গেলে ইচ্ছা করলেও তা আর পরিত্যাগ করা যায় না। অনেক ইয়াবাসেবী ও তাদের অভিভাবকরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাংবাদিকদের কাছে এসে তাদের যন্ত্রণার কথা জানাচ্ছেন। এক ইয়াবাসেবী তরুণী বলেছে, সে এ নেশা থেকে মুক্তি পেতে চায়। কিন্তু ইয়াবাসেবন বন্ধ করলে বিভিন্ন হুমকি দেওয়া হয় তাকে এবং এজন্য একবার তাকে অপহরণও করা হয়েছিল। ইয়াবাসেবীরা সাইবারক্রাইমেও জড়িয়ে পড়ছে। আড্ডার মাধ্যমে আকৃষ্ট করার পর তরুণ-তরুণীদের ইয়াবা-বার বা আখড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। এদের মধ্যে মেয়েদের ব্লাকমেইল করে নীল ছবি তৈরি করা হয়, টাকা আদায় করা হয় এবং তাদের মাধ্যমে তাদের বান্ধবীদেরও এ চক্রে আনা হয়। পরে নতুন নতুন পর্ণো সিডি তৈরি করে তা বাজারজাত করা হয়। ইন্টারনেটেও কিছু বাংলাদেশি তরুণীর সেক্সক্লিপ ছাড়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া সারাদেশে মোবাইলের এমএমএসের মাধ্যমেও স্কলাস্টিকা স্ট্যামফোর্ড ও আরো কিছু ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ইয়াবাসেবী ছাত্র-ছাত্রীদের অশ্লীল ক্লিপ ছড়িয়ে পড়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনেক ইয়াবাসেবী বিশ্বব্যাপী এসব ক্লিপিং ছড়িয়ে দিচ্ছে। র্যাবের হাতে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে ২৪টি পর্ণো সিডি উদ্ধার করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রায় অর্ধশতাধিক এ দেশীয় তরুণ-তরুণীর বিকৃত যৌনতার প্রমাণ রয়েছে। পুলিশ ও র্যাবের গোয়েন্দাদের মতে এরা সবাই ইয়াবাসেবী। তারা এদের সন্ধানে নেমেছে। বাংলাদেশের সঙ্গীতশিল্পীদের একটি বড় অংশ ইয়াবাআসক্ত। তরুণ সঙ্গীতশিল্পীদের পাশাপাশি সর্বোচ্চ সারির তারকারাও এতে যুক্ত রয়েছে। জানা গেছে, সারা দেশে ব্যা-সঙ্গীতের জমজমাট আসরগুলো ছিল ইয়াবা বিক্রেতাদের অন্যতম কেন্দ্র।
গত ২৫ অক্টোবর গুলশান এলাকায় ইয়াবা তৈরির কারখানা আবিষ্কার করেছে র্যাব এবং সেখান থেকে আনুমানিক চার কোটি টাকার ইয়াবাসহ প্রায় ২০ কোটি টাকার মালামাল উদ্ধার করেছে। এগুলো হচ্ছে পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত কিছু তথ্য। এ থেকে সমাজের এ শ্রেণীটির চূড়ান্ত অবক্ষয়ের কিছু চিত্র পাওয়া যায়। এসব সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন মন্তব্য আসছে। কোনো কোনো পত্রিকায় সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে! যুবসমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করা হয়েছে। বলাবাহুল্য যে, অবশ্যই এ অবস্থা উদ্বেগজনক। কিন্তু এ অবস্থা কি একদিনে সৃষ্টি হয়েছে? কিংবা যেসব বুদ্ধিজীবী বা মিডিয়াকর্মী আজ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছেন তারাও কি এর দায় থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারেন? এ কথাগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত।
পাশ্চাত্য জীবনযাত্রার নির্বিচার অনুকরণের যে মোহ দেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণীকে পেয়ে বসেছে তারই কিছু কিছু কুফল এসব টুকরো টাকরা সংবাদের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। এ অধঃপতন থেকে ফিরে এসে সুস্থ ও শালীন জীবনের অধিকারী হতে হলে প্রথমেই দরকার মানসিকতার আমূল পরিবর্তন। পাশ্চাত্যের উদ্দাম উচ্ছৃঙ্খলায় এদেশকে ভাসিয়ে দেওয়ার যে তোড়জোড় ইদানীং প্রকটভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে তা কীভাবে প্রতিরোধ করা যায় তা আমাদের এখনই ভাবতে হবে। এ সত্য কখনো অস্বীকার করা যায় না যে, ক্ষয় ও অবক্ষয়ই হচ্ছে পাশ্চাত্য জীবন ধারার শীতল উপহার। মেধা ও প্রতিভা এবং জীবনে ও চরিত্রের আর কত ক্ষয়ের পর এ সত্য অনুধাবনের সময় আসবে?