সফর ১৪৩২   ||   জানুয়ারী ২০১১

তালিবানে ইলমের উদ্দেশে : তোমরা কে, তোমরা কী, তোমাদের গন্তব্য কোথায় -৫

মাওলানা মানযূর নো‘মানী রাহ.

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আপনার নামায তো এমন হবে যে, আপনি যখন বলবেন- (আরবী)

তখন আপনি গায়ব থেকে শুনতে পাবেন      (আরবী)       এর খোশখবর! একই ভাবে শুনতে পাবেন-   

                          এবং       

                  এর সাওগাত! তদ্রূপ যখন আপনি বলবেন-

(আপনারই ইবাদত করি আমরা এবং আপনারই সাহায্য চাই।)

তখন আপনার হৃদয় শুনতে পাবে গায়বের এ আশ্বাসবাণী-

 

তদ্রূপ যখন আপনি তিলাওয়াতে মগ্ন হবেন তখন আপনার ধ্যান হবে এই যে, আল্লাহ আপনাকে দেখছেন এবং খুশী হয়ে আপনার তিলাওয়াত শুনছেন! আপনি বুঝতে পারবেন, আল্লাহ তা‘আলা কোথায় কী বলছেন! আপনাকে সম্বোধন করে আপনার কাছে কী চাচ্ছেন! ‘ইয়া ইবাদী’ বলে যখন আল্লাহ নেদা করবেন তখন আপনার প্রাণ-মন শীতল হয়ে যাবে।

আযাব ও গযবের আয়াতে আপনার ভিতরটা ভয়ে কেঁপে ওঠবে এবং মনে মনে আপনি আল্লাহর কাছে জাহান্নাম থেকে পানাহ চাইবেন। আর নায-নেয়ামতের আয়াতে আপনার মন খুশিতে বাগবাগ হবে এবং আপনি আল্লাহর কাছে জান্নাতের আরযু জানাবেন।

হাদীছ ও সীরাতের কিতাবে আপনারা নিশ্চয় পড়েছেন যে, এমনই ছিলো রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায এবং এমনই ছিলো তাঁর তিলাওয়াত।

তো আপনারা যদি শুধু এতটুকু করেন যে, যেভাবে আপনাদের নামায পড়া উচিত সেভাবে নামায পড়েন এবং যেভাবে তিলাওয়াত করা উচিত সেভাবে তিলাওয়াত করেন। অর্থাৎ শুধু নামায ও তিলাওয়াতের ক্ষেত্রেই যদি আপনারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায ও তিলাওয়াতের বিরাছাত ও নিয়াবাত বা উত্তরাধিকার ও প্রতিনিধিত্ব অর্জন করতে পারেন তাহলে আমি বলছি, আপনাদের আর কিছু লাগবে না। এতটুকুই যথেষ্ট হয়ে যাবে আল্লাহর সঙ্গে তা‘আল্লুক পয়দা হওয়ার জন্য এবং আল্লাহর গায়বী মদদ ও নোছরত নাযিল হওয়ার জন্য। আর যদি এর সঙ্গে সামান্য পরিমাণ যিকির-তাসবীহের অভ্যাসও করে নেন তাহলে তো ইনশাআল্লাহ ‘নূরুন আলা নূর’ হয়ে যাবে।

আল্লাহর ওয়াস্তে এপথে একবার চলতে শুরু করুন, তারপর দেখুন, আল্লাহর পক্ষ হতে কী মু‘আমালা হয় আপনার সঙ্গে। আমার পেয়ারে ভাই! এটাই বেলায়েত বা অলী হওয়ার রাস্তা, যার সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, আমার কোন অলীর সাথে (খাছ বান্দর সাথে) যদি কেউ শত্রুতা পোষণ করে তাহলে আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলাম।

ছাত্রকালে বাইআত হওয়া না হওয়া

হয়ত আপনার বড়দের কাছে শুনেছেন, বা কোন কিতাবে পড়েছেন যে, হযরত গাঙ্গোহী (রাহ.) এবং আমাদের অন্যান্য আকাবির ছাত্রদেরকে বাই‘আত করতেন না। যতক্ষণ না তাদের প্রথাগত ছাত্রত্বের অবসান হতো, তাদেরকে তাঁরা সুলূক ও আধ্যাত্মিক সাধনার পথের যিকির-শোগল থেকে বিরতই রাখতেন। স্বয়ং হযরত থানবী (রাহ.) নিজের ঘটনা লিখেছেন যে, ছাত্র যামানায় তিনি হযরত গাঙ্গোহী (রাহ.)-এর কাছে বাই‘আতের দরখাস্ত করেছিলেন, কিন্তু তিনি তা কবুল করেননি, বরং বলে দিয়েছিলেন যে, এটা শয়তানের ওয়াসওয়াসা। অর্থাৎ শয়তান তলবে ইলমের নিমগ্নতা থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য বাহ্যত একটি নেক চিন্তা মনে ঢুকিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে কোরআন ও সুন্নাহর গভীর ইলম অর্জন করা থেকে মাহরূম রাখা।

এ বিষয়ে আসল কথা এই যে, তখনকার বাই‘আত এখনকার মত ছিলো না। তখন বাই‘আত হওয়ার পর মুরীদকে সুলূক ও আধ্যাত্মিকতার দীর্ঘ সাধনায় নিযোজিত করা হতো। যিকিরের লম্বা লম্বা অযীফা দেয়া হতো, সেই সঙ্গে শুরু হয়ে যেতো মুজাহাদা ও আত্মদমনের কঠিন এক সিলসিলা। তারপর সালিক-এর ভিতরে দেখা দিতে শুরু করতো মোজাহাদার বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া এবং আধ্যাত্মিক জগতে তারাক্কির বিভিন্ন মারহালা অতিক্রম করার ধারাবাহিকতা। এর অনিবার্য ফল এই হতো যে, ইলমের প্রতি মনোনিবেশ ও নিমগ্নতা হ্রাস পেতো, বরং লোপ পেতো। যিকিরের মযা পাওয়ার কারণে ইলমী মেহনতকে তখন মনে হতো বে-মযা। কারণ যারা যিকিরের স্বাদ পেয়ে যায় তাদের কাছে সবকিছু বিস্বাদ হয়ে যায়। তখন হিদায়া, তাওযীহ, তালবীহ, বায়যাবী, উমূরে আম্মাহ ও খায়ালী-এর মত জটিল ও নীরস কিতাবে মন বসানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এককথায় তার জীবন ও জগত তখন অন্যরকম এবং অন্যকিছু হয়ে যায়।

তো ছাত্রকালেই যদি হযরত থানবী (রাহ.) কে বাই‘আতের মাধ্যমে সুলূক ও আধ্যাত্মিক সাধানার রহস্যময় জগতে নিয়ে আসা হতো এবং যিকির-আযকার ও মোরাকাবা-মোজাহাদায় নিয়োজিত করা হতো তাহলে তিনি উচ্চস্তরের একজন ছাহিবে দিল বুযুর্গ অবশ্যই হতেন, কিন্তু ইলমের প্রশস্ততা ও গভীরতা কিছুতেই অর্জিত হতো না, যা আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে দান করেছেন। এই ‘পুরফিতান’ যামানায়, এই চরম দ্বীনী দুর্যোগের সময় উম্মত একজন হাকীমুল উম্মত এবং মুজাদ্দিদে মিল্লত পেতো না; এত শত ‘রাহনুমা’ কিতাব তার কলম থেকে এবং এত অসংখ্য ‘হিদায়াতনুমা’ বয়ান তার যবান থেকে বের হতো না, যা আজ পথহারা উম্মতকে সরল পথের দিশা দান করছে এবং বহু যুগ পর্যন্ত করে যাবে ইনশাআল্লাহ। 

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

advertisement