শাওয়াল-যিলকদ ১৪২৮   ||   নভেম্বর ২০০৭

পবিত্র কুরআনে উল্লেখিত দুআ

জুবাইর আহমদ আশরাফ

ফিরআউনের যাদুকরদের প্রার্থনা

হযরত মূসা আলাইহিস সালাম তৎকালীন ফিরআউন দ্বিতীয় রেমেসীস-এর পুত্র মিনফাতাহ যার রাজত্ব খৃষ্টপূর্ব ১২১৫ থেকে ১২৩০-এর নিকট দ্বীনের দাওয়াত পেশ করলে, সে হযরত মূসা আ.-এর নিকট তাঁর দাবীর স্বপক্ষে প্রমাণ দেখাতে বলল। হযরত  মূসা আ. আপন লাঠি মাটিতে ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে তা এক অজগরে পরিণত হল। ফিরআউনের পরিষদবর্গ বলল, এ তো এক সুদক্ষ যাদুকর। একে প্রতিহত করার জন্য সারা দেশ থেকে বড় বড় যাদুকরদের একত্র করা হোক।

মিশরীয় কিবতীদের বিশেষ এক উৎসবের দিন আলোকদীপ্ত পূর্বাহ্নে প্রায় পনের হাজার বিখ্যাত যাদুকর একত্র করা হল। যাদুকরেরা তাদের রজ্জু ও লাঠি নিক্ষেপ করে এক বিশাল ময়দান ভরে ফেলল।  যাদুকরগণ দর্শকদের দৃষ্টি বিভ্রম ঘটিয়ে দেওয়ায় সকলের মনে হতে লাগল।, এগুলি ঘন ঘন কাঁপছে। এ অবস্থা দেখে সকলেই আতংকিত হয়ে গেল। হযরত মূসা আ. আল্লাহ তাআলার হুকুমে তাঁর লাঠি নিক্ষেপ করলেন।  সঙ্গে সঙ্গে তা যাদুকরদের লাঠি ও রজ্জুগুলি গ্রাস করে ফেলল। এ দৃশ্য দেখে যাদুকরদের নিশ্চিত বিশ্বাস হল যে, হযরত মূসা আ. কোনো যাদুকর নন; তিনি আল্লাহ পাকের প্রেরিত রাসূল। তারা তখন সিজদায় লুটিয়ে পড়ল এবং বলল আমরা মূসা ও হারুনের প্রতিপালক আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রতি ঈমান আনলাম। ফিরআউন বলল, এতো এক চক্রান্ত; আমি তোমাদের হস্তপদ বিপরীত দিক থেকে কর্তন করব এবং তোমাদের সকলকে শূলীতে চড়াব। তারা বললেন, আমাদের নিকট আমাদের প্রতিপালকের  নিদর্শন আসার পর আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। ফিরআউন তাদের সকলকে শূলীতে চড়িয়ে শহীদ করে দিল। পূর্বাহ্নে যারা যাদুকর ছিলেন অপরাহ্নে তারা শাহাদাত লাভ করলেন। তারা শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করার পূর্বে আল্লাহ পাকের মহান দরবারে বিনয়াবনত হয়ে প্রার্থনা করেছিলেন

رَبَّنَاۤ اَفْرِغْ عَلَیْنَا صَبْرًا وَّ تَوَفَّنَا مُسْلِمِیْنَ

হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে পরিপূর্ণ ধৈর্য দান করুন এবং আপনার নিকট আত্মসমর্পণ কারীরূপে আমাদের মৃত্যু দিন। -আরাফ  ১২৬

হযরত মূসা আ.-এর কওমের দুআ

হযরত মূসা আ.-এর যুগের ফিরআউন ছিল একজন উদ্ধত ও স্বৈরাচারী বাদশাহ। তার ও তার পারিষদবর্গের নির্যাতনের ভয়ে অনেকেই হযরত মূসা আ.-এর প্রতি ঈমান আনেনি। বনী ইসরাঈলের যারা হযরত মূসা আ.-এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছিল, তিনি তাদের সকলকে বললেন, হে আমার কওম, তোমরা যদি মুসলিম হয়ে থাক তবে তোমরা শুধু  আল্লাহরই উপর নির্ভর কর। তখন তারা আল্লাহ পাকের নিকট প্রার্থনা করলেন।

عَلَی اللّٰهِ تَوَكَّلْنَا ۚ رَبَّنَا لَا تَجْعَلْنَا فِتْنَةً لِّلْقَوْمِ الظّٰلِمِیْنَۙ۝۸۵ وَ نَجِّنَا بِرَحْمَتِكَ مِنَ الْقَوْمِ الْكٰفِرِیْنَ

আমরা সকলে একমাত্র আল্লাহর উপর নির্ভর করলাম। হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে অপরাধী পম্প্রদায়ের উৎপীড়নের পাত্র করবেন না এবং আমাদেরকে আপনার অনুগ্রহে কাফির সম্প্রদায় থেকে রক্ষা করুন। -ইউনুস ৮৫-৮৬ 

আল্লাহ পাক তাদের দুআ কবুল করেছিলেন এবং তাদেরকে ফিরআউনের নির্যাতন থেকে রক্ষা করেছিলেন। তারা সদলবলে মিসর থেকে লোহিত সাগর অতিক্রম করে পূর্ব পার্শ্বস্থ গিণাই উপত্যকায় চলে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ফিরআউনের গোষ্ঠীর একজন মুমিনের সর্বশেষ দুআ

ফিরআউনের এক চাচাতো ভাই হযরত মূসা আ.-এর প্রতি ঈমান এনেছিলেন। তিনি তাঁর ঈমান গ্রহণের  বিষয়টি গোপন রাখেন। ফিরআউন একদিন দম্ভভরে বলল, আমি মূসাকে হত্যা করব। কারণ সে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করছে। ফিরআউনের ওই জ্ঞাতি ভাই তাকে বললেন, তোমরা কি একজন ব্যক্তিকে শুধু এ জন্য হত্যা করবে যে, সে বলে, আমার প্রতি পালক একমাত্র আল্লাহ। সে তো প্রতিপালকের নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণসহ তোমাদের কাছে এসেছে। আজ কর্তৃত্ব তোমাদের; দেশে তোমরাই প্রবল, কিন্তু আমাদের উপর আল্লাহর শাস্তি এসে পড়লে কে আমাদেরকে সাহায্য করবে? হে আমার সম্প্রদায়, আমি তোমাদের জন্য কওমে নূহ, কওমে আদ, সামূদ ও তাদের পরবর্তীদের শাস্তির অনুরূপ দুর্দিনের আশা করছি।

মুমিন ব্যক্তিটি আরও বললেন, হে আমার সম্প্রদায়, এই পার্থিব জীবন তো অস্থায়ী উপভোগের বস্তু এবং পরকালই চিরস্থায়ী আবাস। অবশেষে এ মুমিন কিবতী তাঁর ঈমান গ্রহণের কথা প্রকাশ করে বললেন, তোমরা আমাকে বলছ, আল্লাহকে অস্বীকার করতে এবং তাঁর সমকক্ষ দাঁড় করাতে। পক্ষান্তরে আমি তোমাদের কে আহবান করছি ক্ষমাশীল, পরাক্রমশালী আল্লাহর দিকে। বস্তুত আমাদের প্রত্যাবর্তন তো আল্লাহরই নিকট এবং সীমালঙ্ঘনকারীরাই জাহান্নামের অধিবাসী। আর আমি তোমাদেরকে যা বলছি, তোমরা তা অচিরেই স্মরণ করবে। তিনি সর্বশেষ দুআ করেন,

وَ اُفَوِّضُ اَمْرِیْۤ اِلَی اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ بَصِیْرٌۢ بِالْعِبَادِ

আমি আমার যাবতীয় বিষয় আল্লাহর নিকট অর্পণ করছি। আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখেন।  -মুমিন ৪৪

তালূত ও তাঁর সঙ্গীদের প্রার্থনা

হযরত মূসা আ.-এর প্রায় সহস্রাধিক বৎসর পর জালূত নামক জনৈক অত্যাচারী শাসক বনী ইসরাঈলের উপর নিপীড়ন চালিয়ে তাদেরকে আপন আবাসভূমি থেকে বহিস্কার করেছিল। সে সময় বনী ইসরাঈল তৎকালীন নবী হযরত শামবীল আ.-এর নিকট আবেদন করেছিল যে, তাদের জন্য যেন একজন রাজা নিয্ক্তু করা হয়, যার নেতৃত্বে তারা জালূতের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে। আল্লাহ পাকের হুকুমে তাদের জন্য তালূত নামক একজন শক্তিশালী ও প্রজ্ঞাবান মহান ব্যক্তিকে রাজা নিযুক্ত করা হল। নির্ধারিত সময়ে তালূত গৈণ্যবাহিনী নিয়ে বের হলেন। বললেন, আল্লাহ তোমাদেরকে একটি নদী দ্বারা পরীক্ষা করবেন। তোমরা এ নদী থেকে পানি পান করবে না। একান্তভাবে কারও করতে হলে স্বল্প পরিমাণে করবে। মাত্র তিনশ তের জন ছাড়া সকলেই অধিক পরিমাণে পান করল। যারা অধিক পরিমাণে পান করল, তারা আর সম্মুখে অগ্রসর হতে পারল না। কিন্তু খাঁটি ঈমানদারগণ এতে সাহস হারালেন না। তারা বললেন, আল্লাহর হুকুমে অনেক ক্ষুদ্র দল বৃহৎ দলকে পরাভূত করেছে। সুতরাং আমরা আল্লাহ পাকের উপর নির্ভর করে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবই। তাঁরা প্রবল প্রতাপশালী জালূত ও তার বিশাল গৈণ্য বাহিনীর সম্মুখীন হয়ে আল্লাহ পাকের নিকট দুআ করলেন,

رَبَّنَاۤ اَفْرِغْ عَلَیْنَا صَبْرًا وَّ ثَبِّتْ اَقْدَامَنَا وَ انْصُرْنَا عَلَی الْقَوْمِ الْكٰفِرِیْنَ

হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের কে ধৈর্য দান করুন, আমাদের পা অবিচলিত রাখুন এবং কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন। -বাকারা ২৫০

আল্লাহ পাকের সাহায্যে তাঁরা শক্তিধর জালূত বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়ী হন।

পূর্বযুগের একজন মুমিনের দুআ

পূর্ববর্তী কোনো যুগে এক ব্যক্তির দুটি আঙুর বাগান ছিল। এ বাগান দুটি প্রচুর পরিমাণে ফল দান করত। উদ্যানের চতুর্দিকে খেজুর গাছ, দুই বাগানের মধ্যখানে শস্যক্ষেত এবং ফাঁকে ফাঁকে নহর প্রবাহিত ছিল। সে একদিন তার এক দরিদ্র বন্ধুর সঙ্গে অহঙ্কার করে বলল, আমি তোমার থেকে শ্রেষ্ঠ। সে তার উদ্যানে প্রবেশ করে আরও বলল, আমি মনে করি না যে, কখনও কিয়ামত সংঘটিত হবে এবং এ উদ্যান কোনো দিন ধ্বংস হবে। তার দরিদ্র বন্ধু ছিলেন মুমিন। তিনি বললেন, তুমি কি তাঁকে অস্বীকার করছ, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন? কিন্তু আমি বলি, আল্লাহই আমার প্রতিপালক। আমি কাউকেও আমার প্রতিপালকের সঙ্গে শরীক করি না। তুমি যখন তোমার উদ্যানে প্রবেশ করলে তখন কেন এ দুআ পড়লে না

مَا شَآءَ اللّٰهُ ۙ لَا قُوَّةَ اِلَّا بِاللّٰهِ

এইসব আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছে। আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত কোনো শক্তি নেই। -সূরা কাহ্ফ ৩৯

অবশেষে তার ফল সম্পদ বিপর্যয়ে বেষ্টিত হল। তার দ্রাক্ষা উদ্যান মাচানসহ ভূমিসাৎ হয়ে গেল। সে তাতে যা ব্যয় করেছিল তার জন্য আক্ষেপ করতে লাগল। তাকে সাহায্য করবার কেউ ছিল না এবং সে নিজেও প্রতিকারে সমর্থ হল না।

হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ পাক কোনো বান্দার সম্পদে, সন্তানে বা পরিবার পরিজনের মধ্যে কোনো নেয়ামত দান করার পর সে যদি পাঠ করে-

مَا شَآءَ اللّٰهُ ۙ لَا قُوَّةَ اِلَّا بِاللّٰهِ

তবে আল্লাহ পাক এ নেয়ামত থেকে সর্বপ্রকার বিপদ আপদ সরিয়ে দেন।

হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেনরাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে বলেছেন, আবু হুরায়রা, আমি কি তোমাকে জান্নাতের এক ধন-ভাণ্ডারের দিকে পথ প্রদর্শন করব না? তা হল, তুমি পাঠ করবে-

. لَا قُوَّةَ اِلَّا بِاللّٰهِ

হযরত ওহাব ইবনে মুনাব্বিহ রহ. তাঁর ঘরের দরজার উপর লিখে রেখেছিলেন

مَا شَآءَ اللّٰهُ ۙ لَا قُوَّةَ اِلَّا بِاللّٰهِ

কেউ তাকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি সূরায়ে কাহাফের বর্ণিত আয়াতখানি পাঠ করেন।১০

রানী বিলকীসের দুআ

হযরত সুলাইমান আ.-এর সাবা বংশীয় রানী বিলকীস বিনতে শারাহীল ইয়ামানের শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। তিনি প্রভূত বিত্তবৈভবের মালিক ছিলেন। রানীর একটি বিশাল সিংহাসন ছিল, যা স্বর্ণ, রৌপ্য ও বিভিন্ন প্রকার মূল্যবান পাথর দ্বারা সুসজ্জিত ছিল। রানী ও তার সম্প্রদায় ছিল সূর্যপূজারী। হযরত সুলাইমান আ. রানীর নিকট এই মর্মে পত্র প্রেরণ করেছিলেন যে, সে যেন কুফর ও শিরক বর্জন করে আল্লাহ এক বলে বিশ্বাস করে এবং ক্ষমতার অহমিকা পরিত্যাগ করে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করে তার নিকট  উপস্থিত হয়। এদিকে হযরত সুলাইমান আ. দরবারের লোকদেরকে বলেন, হে পারিষদবর্গ, ইয়ামানের রানী আত্মসমর্পণ করে আমার নিকট আসার পূর্বে তোমাদের মধ্যে কে তার সিংহাসন আমার নিকট নিয়ে আসতে পারবে? এক শক্তিশালী জ্বীন বলল, আপনার মজলিস শেষ হওয়ার পূর্বেই আমি তা আপনার নিকট এনে দিতে পারব। হযরত সুলাইমান আ.-এর একজন নিকটতম সাহাবী ও লেখক বললেন, আপনার চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আমি তা আপনার নিকট নিয়ে আসতে পারব।

ইনি আসমানী কিতাবের জ্ঞানসম্পন্ন ছিলেন এবং তাঁর ইসমে আযমও জানা ছিল। মুহূর্তের মধ্যে সে সিংহাসন নিয়ে আসল। 

রানী বিলকীস হযরত সুলাইমান আ.-এর দরবারে উপস্থিত  হলেন। তিনি এখানে তার নিজ সিংহাসন দেখে বিস্মিত হলেন এবং এক আল্লাহর প্রতি নিজের ঈমান প্রকাশ করলেন। রানী হযরত সুলাইমানের আল্লাহ প্রদত্ত জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ঐশ্বর্য ও অভূতপূর্ব ক্ষমতার প্রতাপ লক্ষ করে পাঠ করেছিলেন-

رَبِّ اِنِّیْ ظَلَمْتُ نَفْسِیْ وَ اَسْلَمْتُ مَعَ سُلَیْمٰنَ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ

হে আমার প্রতিপালকআমি তো নিজের প্রতি জুলুম করেছিলাম। আমি সুলাইমানের সঙ্গে জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করছি। -সূরা নামল : ৪৪

হযরত ঈসা আ.-এর হাওয়ারীদের দুআ

হযরত ঈসা আ. বনী ইসরাঈলের নিকট নবী হিসেবে আগমন করেন। তাদের অধিকাংশই তাঁর দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করে। উপরন্তু তারা তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করল। তিনি তা উপলব্ধি করতে পেরে বললেন, আল্লাহর দিকে গমনে কে আমার সাহায্যকারী হবে? হযরত ঈসা আ-এর একান্ত অনুগত হাওয়ারীগণ বললেন, ্আমরাই আল্লাহর পথে সাহায্যকারী। আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি। আমরা আত্মসমর্পণকারী, আপনি এর স্বাক্ষী থাকুন। অতঃপর তারা কথাটিকে আরও সুদৃঢ় করার জন্য আল্লাহ পাকের নিকট প্রার্থনা করে বললেন,

رَبَّنَاۤ اٰمَنَّا بِمَاۤ اَنْزَلْتَ وَ اتَّبَعْنَا الرَّسُوْلَ فَاكْتُبْنَا مَعَ الشّٰهِدِیْنَ

হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি যা অবতীর্ণ করেছেন তাতে আমরা ঈমান এনেছি এবং আমরা এই রাসূলের অনুসরণ করেছি। সুতরাং  আপনি আমাদেরকে সাক্ষ্য প্রদানকারীদের তালিকাভূক্ত করুন। -সূরা আল-ইমরান ৫৩

আসহাবে কাহ্ফের দুআ

হযরত ঈসা আ.-এর কিছুকাল পর রোম সম্রাজ্যের অন্তর্গত তারাসূস শহরে এক স্বৈরাচারী শাসকের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই অত্যাচারী বাদশা সকল মানুষকে মূর্তিপূজার প্রতি আহবান করত এবং যে সকল মুমিন তার এহেন দুষ্কর্মে সাড়া দিত না তাদেরকে সে হত্যা করত।

ঈমানদার সমাজের জন্য এটি এক গুরুতর সঙ্কটরূপে দেখা দিল। এ পরিস্থিতি দেখে একদল যুবক অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তাদের সংবাদ বাদশাহর কানে পৌঁছে গেল এবং বাদশাহ তাদেররকে ডেকে পাঠাল। জালেম বাদশাহর সম্মুখে উপস্থিত হলে বাদশাহ তাদেরকে মূর্তিপূজা না করলে হত্যার হুমকি দিল। ঈমানদীপ্ত যুবকেরা বাদশাহর মুখোমুখি দণ্ডায়মান হয়ে নিজেদের ঈমান প্রকাশ করে বলল, আকাশম-লী ও পৃথিবীর অধিপতিই আমাদের রব। আমরা তাঁকে ছাড়া অন্যকে কক্ষনো প্রভু হিসেবে গ্রহণ করব না। অত্যাচারী শাসক তাদেরকে বলল, তোমরা অল্প বয়স্ক যুবক তোমাদেরকে নিজেদের সিদ্ধান্ত প্রকাশের জন্য আগামীকাল পর্যন্ত সুযোগ দেওয়া হল। ঈমানদার যুবকের সংখ্যা ছিল সাতজন। তারা বাদশাহর অত্যাচারের ভয়ে রাতের বেলায় শহর ছেড়ে পলায়ন করল। তাদের পাহারাদার হিসেবে একটি কুকুরও তাদের অনুসরণ করল। ভোরের আলো ফুটতে আরম্ভ করলে তারা পাহাড়েরর একটি গুহায় আত্মগোপন করল। তাদেরকেই আসহাবে কাহফ বা গুহাবাসী বলা হয়। বাদশাহ ও তার সেনাবাহিনী তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেছিল, কিন্তু অত্যাচারী গোষ্ঠী গুহামুখে পৌঁছামাত্র ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল এবং গুহায় প্রবেশ করতে পারল না। বাদশাহ বলল, গুহার দরজা বন্ধ করে দাও। তাহলে ওরা ক্ষুৎ পিপাসায় মারা যাবে।১১

মুমিন যুবকেরা গুহায় প্রবেশ করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মহান দরবারে প্রার্থনা করেছিলেন-

رَبَّنَاۤ اٰتِنَا مِنْ لَّدُنْكَ رَحْمَةً وَّ هَیِّئْ لَنَا مِنْ اَمْرِنَا رَشَدًا

হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি নিজের কাছ থেকে আমাদেরকে অনুগ্রহ দান করুন এবং আমাদের জন্য আমাদের কাজকর্ম সঠিকভাবে পরিচালনার ব্যবস্থা করুন।-সূরা কাহফ : ১০

আল্লাহ তাআলা তখন তাদেরকে গুহায় শান্তির নিদ্রা দান করেছিলেন।

ফেরেশেতাদের দুআ

ফেরেশতা আল্লাহ পাকের এক প্রকার সম্মানিত মাখলুক। আল্লাহ তাআলা কোটি কোটি ফেরেশতা সৃষ্টি করেছেন। তন্মধ্যে চারজনের একটি দল আল্লাহ পাকের আরশ বহন করে আছেন। ১৩

আর একদল ফেরেশতা আরশের চতুর্দিকে আরশ ঘিরে আছেন। এ উভয় দল আল্লাহ পাকের অত্যন্ত নৈকট্যপ্রাপ্ত ফেরেশতা। তাঁরা সর্বদা আল্লাহ পাকের প্রশংসা পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করেন। তাঁরা মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেন-

رَبَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَیْءٍ رَّحْمَةً وَّ عِلْمًا فَاغْفِرْ لِلَّذِیْنَ تَابُوْا وَ اتَّبَعُوْا سَبِیْلَكَ وَ قِهِمْ عَذَابَ الْجَحِیْمِ۝۷ رَبَّنَا وَ اَدْخِلْهُمْ جَنّٰتِ عَدْنِ ِ۟الَّتِیْ وَعَدْتَّهُمْ وَ مَنْ صَلَحَ مِنْ اٰبَآىِٕهِمْ وَ اَزْوَاجِهِمْ وَ ذُرِّیّٰتِهِمْ ؕ اِنَّكَ اَنْتَ الْعَزِیْزُ الْحَكِیْمُۙ۝۸ وَ قِهِمُ السَّیِّاٰتِ ؕ وَ مَنْ تَقِ السَّیِّاٰتِ یَوْمَىِٕذٍ فَقَدْ رَحِمْتَهٗ ؕ وَ ذٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِیْمُ

হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার দয়া ও জ্ঞান সর্বব্যাপী। অতএব যারা তাওবা করে ও আপনার পথ অবলম্বন করে আপনি তাদেরকে ক্ষমা করুন এবং জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।

হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি তাদেরকে দাখিল করুন স্থায়ী জান্নাতে, যার প্রতিশ্রুতি আপনি তাদেরকে দিয়েছেন এবং তাদের পিতামাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকর্ম করেছে তাদেরকেও। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আপনি তাদেরকে শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। সেইদিন আপনি যাকে শাস্তি থেকে রক্ষা করবেন তাকে তো অনুগ্রহই করলেন। এ-ই তো মহাসাফল্য।-সূরা মুমিন : ৭-৯

আরাফে অবস্থানকারীদের দুআ

পরকালের হিসাব-নিকাশের পর জান্নাতবাসী ও জাহান্নামবাসীদের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করা হবে। জান্নাত ও জাহান্নাম ভিন্ন তৃতীয় একটি স্থান হল আরাফ। যাদের নেক আমল ও বদ আমল সমান সামন হবে, তাদেরকে প্রাথমিকভাবে আরাফে রাখা হবে। আরাফের অধিবাসীগণ নিজেদের স্থান থেকে জান্নাতী ও জাহান্নামী উভয় দলকে দেখতে পাবে। তারা জান্নাত লাভের আকাঙ্খায় থাকবে। এক পর্যায়ে তাদেরকে জান্নাতে পৌঁছানো হবে। আরাফ থেকে তাদের দৃষ্টি যখন জাহান্নামীদের উপর পতিত হবে তখন তারা ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বলবে-

رَبَّنَا لَا تَجْعَلْنَا مَعَ الْقَوْمِ الظّٰلِمِیْنَ

হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে জালিম সম্প্রদায়ের সঙ্গী করবেন না।-সূরা আরাফ : ৪৭

জান্নাত লাভের পর মুমিনদের দুআ

মুমিনদের জন্য আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার হল জান্নাত। জান্নাত চিরস্থায়ী শান্তির নিবাস। পরকালের হিসাব-নিকাশ ও মহাবিচারের পর মুমিনদেরকে যখন চিরস্থায়ীভাবে শান্তি ও আনন্দের নিবাস জান্নাতে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে তখন তারা সেখানে প্রবেশ করেই পিছনের জীবনের সকল দুঃখ-কষ্ট, ঘাত-প্রতিঘাত ও সংগ্রাম-সংকটের কথা ভুলে যাবে। তাদের অন্তর থেকে এ দুআ উচ্চারিত হবে-

الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِیْ هَدٰىنَا لِهٰذَا ۫ وَ مَا كُنَّا لِنَهْتَدِیَ لَوْ لَاۤ اَنْ هَدٰىنَا اللّٰهُ ۚ لَقَدْ جَآءَتْ رُسُلُ رَبِّنَا بِالْحَقِّ

সকল প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি আমাদেরকে এর পথ দেখিয়েছেন। আল্লাহ আমাদেরকে পথ না দেখালে আমরা কখনও পথ পেতাম না। আমাদের প্রতিপালকের রাসূলগণ তো সত্যবাণী এনেছিলেন।-সূরা আরাফ : ৪৩

মুমিনগণ কখনও এ দুআ করবে-

الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِیْ صَدَقَنَا وَعْدَهٗ وَ اَوْرَثَنَا الْاَرْضَ نَتَبَوَّاُ مِنَ الْجَنَّةِ حَیْثُ نَشَآءُ ۚ فَنِعْمَ اَجْرُ الْعٰمِلِیْنَ

সকল প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি আমাদের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করেছেন এবং আমাদেরকে অধিকারী করেছেন এই ভূমির; আমরা জান্নাতে যেখায় ইচ্ছা বসবাস করব। সদাচারীদের পুরস্কার কত উত্তম।-সূরা যুমার : ৭৪

তারা কখনও বলবে-

الْحَمْدُ لِلّٰهِ الَّذِیْۤ اَذْهَبَ عَنَّا الْحَزَنَ ؕ اِنَّ رَبَّنَا لَغَفُوْرٌ شَكُوْرُ

প্রশংসা আল্লাহরই, যিনি আমাদের দুঃখ-দুর্দশা দূরীভূত করেছেন, আমাদের প্রতিপালক তো ক্ষমাশীল, গুণগ্রাহী।-সূরা ফাতির : ৩৪

জান্নাতে গিয়ে মুমিনগণ প্রতিটি নেয়ামত ভোগ করার পর প্রতি নিশ্বাসে নিশ্বাসে আল্লাহ পাকের শ্রেষ্ঠত্ব, সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করবে। শ্রেষ্ঠত্ব, পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে এবং প্রশংসা করে পরম তৃপ্তি লাভ করবে। জান্নাতে তাদের প্রধান ও শেষ কথা ও দুআ হবে-

الْحَمْدُ لِلّٰهِ رَبِّ الْعٰلَمِیْنَ

প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই প্রাপ্য।-সূরা ইউনুস : ১০

আলহামদুলিল্লাহ শুধু জান্নাতীদের প্রধান ও শেষ দুআই নয়; বরং দুনিয়ায়ও সকল মুমিনের সর্ব অবস্থায় শ্রেষ্ঠ দুআ। যেমন হযরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, সর্বশ্রেষ্ঠ দুআ হল, আলহামদুলিল্লাহ।১৪

হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ পাক কোনো বান্দাকে কোনো নেয়ামত দেওয়ার পর সে যদি আলহামদুলিল্লাহ বলে তবে সে যা গ্রহণ করল আল্লাহ পাক তাকে এর চেয়ে অধিক দান করেন।১৫

হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপর একখানি হাদীসে ইরশাদ করেছেন, আলহামদুলিল্লাহ মীযানকে ভরে দেয়।১৬

হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত অপর এক হাদীসে রয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমার কোনো উম্মতের হাতে যদি সমগ্র পৃথিবী উঠিয়ে দেওয়া হয় এবং সে আলহামদুলিল্লাহ পাঠ করে তবে আলহামদুলিল্লাহর মর্যাদা পৃথিবী ও এর সমগ্র বস্তু থেকে উত্তম।

ইমাম কুরতুবী বলেন, এর কারণ হল দুনিয়ার সকল নেয়ামত এক সময় নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহর সওয়াব কখনো খতম হবে না।

এ জন্যই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা পবিত্র কুরআনের প্রথম সূরার প্রথম আয়াতে ইরশাদ করেছেন, আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। যেন আমরা এ দুআ করি-আমাদের জীবনের প্রতি দিবসে নিশীথে, প্রভাতে সন্ধ্যায়। শুধু তাই নয়, আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদতের প্রতি রাকাতে আমরা যেন পাঠ করি, আলহামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। সুতরাং সকল প্রশংসা আল্লাহ তাআলার। তিনি চির প্রশংসিত। প্রারম্ভে, সমাপ্তিলগ্নে, ইহকালে, পরকালে।

 

গ্রন্থপঞ্জী

১. ড. শাওকী আবু খলীল, আতলাসুল কুরআন, পৃ. ৮১

২. ইবনে কাসীর, আলবিদায়া খণ্ড : ১, পৃষ্ঠা : ২৮৪

৩. ইবনে কাসীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, খণ্ড : ৩, সূরা আরাফ, পৃ. ৪৫৯

৪. তাফসীরে ইবনে কাসীর, খণ্ড : ৭, সূরা গাফির, পৃ. ১৪০

৫. তাফসীরে ইবনে কাসীর, খণ্ড : ১, সূরা বাকারা, পৃ. ৬৬৫

৬. তাফসীরে ইবনে কাসীর, খণ্ড : ১, সূরা বাকারা, পৃ. ৬৬৫

৭. মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল আলবুখারী, আল জামিউস সহীহ, খণ্ড : ২, কিতাবুল মাগাযী, পৃ. ৫৬৪

৮. শুআবুল ঈমান, খণ্ড : ৪, পৃ. ৯০ (মুসনাদে আবু ইয়ালা আলমাওসিলী খণ্ড : ৩, পৃ. ৯৪)

৯. মুসনাদে আহমাদ খণ্ড : ৮, পৃ. ৩৮০, হাদীস : ৮৬৪৫

১০. তাফসীরে কুরতুবী, মাআরিফুল কুরআন, ইদরীস কান্ধলভী, খণ্ড : ৪, সূরা কাহফ, পৃ. ৪১৮

১১. মুহাম্মাদ আলী আসসাবুনী, সাফওয়াতুত তাফাসীর, সূরা কাহফ, পৃ. ৩

১২. ইবনে কাসীর, খণ্ড : ৭, সূরা গাফির, পৃ. ১৩০

১৩. আলবিদায়া, খণ্ড : ১, পৃ. ৫৪

১৪. জালালুদ্দীন সুয়ূতী, আদ্দুররুল মানসূর, খ- : ১, সূরা ফাতিহা, পৃ. ৩১ (ইবনে মাজাহ, বায়হাকী)

১৫. সহীহ মুসলিম, খণ্ড : ১, কিতাবুত তহারাত, পৃ. ১১৮

১৬. তাফসীরে কুরতুবী, খণ্ড : ১, সূরা ফাতিহা, পৃ. ৯২

 

 

advertisement