অপরের হক্ব ক্ষুণ্ন করে অনাকাঙ্খিত দখলদারত্ব সমীচীন নয়
সীমালংঘন করার নাম জুলুম। সীমালংঘনের এ বিষয়টি হক্বুল্লাহর ক্ষেত্রে হলে সেটা তো অবশ্যই বড় জুলুম। কিন্তু বান্দার সঙ্গে বান্দার, মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ও আচার-আচরনের ক্ষেত্রেও সীমা লংঘন বা জুলুমের বিষয়টি কম পীড়াদায়ক ও কম বিড়ম্বনাকর নয়। আমরা স্পষ্টতই লক্ষ্য করি, দেশ সমাজ নির্বিশেষে এ জুলুমের বিস্তার এখন ব্যাপক। এ ক্ষেত্রেও বড় ও মোটা দাগের জুলুমের ঘটনাগুলো আমাদের চোখে সহজে ধরা পড়ে। বড় রাষ্ট্র ছোট রাষ্ট্রের প্রতি, বড় পদাধিকারী ছোট পদাধিকারীর প্রতি, শক্তিমান শক্তিহীনের প্রতি জুলুমের যে আচরন করে থাকে সেটা চিহ্নিত করা দুরূহ হয় না। এসব ক্ষেত্রে যেহেতু বড়র পক্ষ থেকে ছোটর প্রতি অধিকার প্রয়োগ ও চাপ সৃষ্টির কোনো নৈতিক ও বাস্তব সুযোগ থাকে না তাই শিক্ষিত অশিক্ষিত সাধারণ দ্বীনদার ও দ্বীন অনুসরনে নিয়মিত নন এমন সব শ্রেণীর মানুষই এ পর্যায়ের পরিস্কার জুলুমের বিষয়টিকে বুঝতে পারেন। জুলুম করা থেকে বাঁচতে চাইলে বুঝে-শুনে এ গুনাহ থেকেও বাঁচতে পারেন।
কিন্তু সীমালংঘন বা জুলুমের এমন একটি পর্যায়ও রয়েছে যেখানে একজনের প্রতি অপরজনের অধিকার ও সম্পর্কের একটি মাত্রা ও সীমা পর্যন্ত দখল থাকার বিষয়টি সহজেই অনুধাবনযোগ্য। সর্বস্বীকৃত যে, জামাতার প্রতি শ্বশুরের, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর, মুরীদের প্রতি পীরের একটি বিশেষ প্রয়োজনীয়, নৈতিক ও বাস্তব দখল ও কর্তৃত্ব বিদ্যমান। এটা নিয়ে কারো মাঝেই কোনো সংশয় নেই। কিন্তু এ কর্তৃত্বের মাত্রা ও সীমা কতটুকু এ বিষয়টি স্পষ্ট না থাকা কিংবা স্পষ্ট করতে না চাওয়ার কারণে এ ক্ষেত্রেও যে সীমালংঘন করার ঘটনা ঘটতে পারে এটা যেন আমরা ভুলতেই বসেছি। সে কারণে এ সব ক্ষেত্রে যেমন ঘটে চলেছে পারস্পরিক সীমালংঘনের বহু অনাকাঙ্খিত ঘটনা তেমনি জুলুম ও বিড়ম্বনার নানামুখি আচরনে তিক্ত হয়ে চলেছে বহু মধুর সম্পর্ক, ভেঙ্গে পড়ছে বহু আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্যরে ভিত।
হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের একটি হাদীসের তরজমা হলো- কোনো মানুষের ইসলাম অনুসরনের একটি সৌন্দর্য হচ্ছে অর্থহীন ব্যাপারগুলো বর্জন করা।’ হাদীসে বর্ণিত এই অর্থহীন ব্যাপারগুলো বা ‘মা লা ইয়ানী’- এর মর্ম আসলে কতটুকু? এর প্রথম তাৎপর্য হচ্ছে অনর্থক কথা ও কাজ বর্জন করা। কিন্তু এর সঙ্গে অর্থহীনতা বা অনর্থকতার আরো কিছু তাৎপর্যের দিকেও আমাদের মনোযোগ আকর্ষিত হয়। এর আরেকটি মর্ম হচ্ছে যে বিষয়ে আমার কোনো সামর্থ বা ক্ষমতা নেই, যে বিষয়ে আমার কোনো অবগতি ও অভিজ্ঞতা নেই সে বিষয় নিয়েও দখলদারিত্ব দেওয়া, কর্তৃত্ব এবং অধিকার প্রয়োগ করা। এর তৃতীয় আরেকটি মর্ম হচ্ছে, যে বিষয়ে আমার অধিকার ও কর্তৃত্ব সীমিত সেখানেও আমার সম্পৃক্ততা বা অধিকার পুরো মাত্রায় রয়েছে ধরে নিয়ে সীমা পার হয়ে অধিকার ও কর্তৃত্বের চর্চা করে যাওয়া। এ সবই হচ্ছে পরিত্যাজ্য অর্থহীনতা বা অনর্থকতা। একজন মানুষের জীবনে ইসলামের সৌন্দর্য ধারন করতে যে যে বিষয় ও কারণগুলোকে অবলম্বন করতে হয় সে সবের মধ্যে উপরোক্ত বিষয়গুলোর বর্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এখানে তৃতীয় পর্যায়ে উল্লিখিত অধিকার ও কর্তৃত্বমুক্ত বিষয়গুলোকে আমরা লক্ষ্য করলেই দেখবো অধিকার তো আছে, কিন্তু তার যে একটি সীমা ও মাত্রাও আছে সেটা ভুলে যাওয়া। এখানে আমার সম্পৃক্ততা বা অধিকার আছে ধরে নিয়ে নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে যাওয়া, অধিকার ও কর্তৃত্বের প্রয়োগকে ব্যাপক ও অপরের জন্য বিড়ম্বনাকর করে তোলা হয়। এটা অনর্থক কাজগুলোর মধ্যে এমন যে, জুলুম বা সীমালংঘন হিসেবে অনুধাবন করতেও অনেকের সমস্যা হয়। স্নেহ-শাসন কিংবা অধিকারের বন্ধনের নামে চোরা স্রোতের মতো নীরব জুলুমের একটি অনাকাঙ্খিত ধারার সৃষ্টি হচ্ছে এভাবে।
জুলুমের নীরব ও অপ্রকাশ্য এই দিকটি সম্পর্কে ভাবলে দেখা যায়, এখানে মন্দ ও গুনাহর কারণ অনেক ক’টি বিদ্যমান। অধিকারের সীমালঙ্ঘন করে কর্তৃত্ব করার ফলে ‘ঈযায়ে মুসলিম’ বা মুসলমানদের দুর্ভোগ পৌঁছানোর একটি গুনাহ এখানে পাওয়া যায়। আর এটাতো সচেতন সবারই জানা যে, কোনো মুসলিমকে দুর্ভোগ পৌঁছানো কত মারাত্মক গুনাহ। দ্বিতীয়ত এ ধরনের ভুল অধিকার চর্চার কারণে হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পক্ষ থেকে উম্মাহর কাছ থেকে নেওয়া সাধারণ অঙ্গীকারের খেলাফ আমল করার গুনাহও এর দ্বারা সংঘটিত হয়। সে অঙ্গীকারের একটি বাক্য ছিল-[আমরা কোনো বিষয়ে তার উপযুক্ত পাত্রের সঙ্গে বিবাদ করব না] অধিকার প্রয়োগের নামে কর্তৃত্ব করতে গিয়ে যার সঙ্গে সীমা পার করার ঘটনা ঘটে থাকে, বাস্তবে দেখা যায় ওই বিষয়ে সে-ই অধিক হকদার ও দায় গ্রহণকারী। সুতরাং তার ওপর মাত্রাহীন অধিকার গ্রয়োগ করতে গিয়ে তাকে বিব্রত করার মানে হচ্ছে কাজের উপযুক্ত পাত্রের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে যাওয়া। তৃতীয়ত অনাকাঙ্খিত এই সীমা অতিক্রম, এই অনধিকার চর্চার দ্বারা যে ক্ষতিটি সাধিত হয় সেটি হচ্ছে এতে অনেকের বৈধ স্বাধীনতা নষ্ট হয়। শরীয়ত তাকে কোনো কাজ করতে যে স্বাধীনতা দিয়েছে সেখানে অনাকাঙ্খিত হস্তক্ষেপ করে তাকে বিব্রত করা হয়। কারো বৈধ স্বাধীনতা ও এক্তিয়ার বা ক্ষমতা নষ্ট করাও গুনাহ।
সর্বোপরি এ ধরনের সীমাবহির্ভূত অধিকার চর্চার বিষয়টি এক প্রকার জুলুম নিঃসন্দেহে।
জামাতার প্রতি শ্বশুরের, ছাত্রের প্রতি শিক্ষকের, মুরীদের প্রতি পীরের, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কম-বেশি হীতাকাঙ্খা, কর্তৃত্ব ও অধিকারের বিষয়টি সর্বজনবিদিত। এর প্রয়োজনীয়তাও প্রশ্নাতীত। কিন্তু এ হীতাকাঙ্খা প্রকাশের ধরন, এ কর্তৃত্ব ও অধিকার প্রয়োগের মাত্রা নিয়ে যদি স্তরের দিক থেকে উপরে অবস্থানকারীর মনে কোনো বিভ্রান্তি বা বাড়াবাড়ি থাকে তাহলেই সীমালংঘনের বহু ঘটনা দুর্ঘটনার মতো ঘটতে থাকে, বিশৃঙ্খলা বাড়তে থাকে, অনাবিল পরিবেশের শান্তিময়তা নষ্ট হতে থাকে। দূরত্ব ও শক্রতার কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে। এজন্যই এ ধরনের নিকট সম্পর্কের আওতাধীন সূত্রগুলোর ক্ষেত্রে অধিকার-অনধিকার চর্চার প্রয়োগে সবারই সতর্কতা কাম্য। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সীমালঙ্ঘনের গুনাহ থেকে হেফাযত করুন।