শাওয়াল-যিলকদ ১৪২৮   ||   নভেম্বর ২০০৭

বাইতুল্লাহর মুসাফির-৩

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

তেইশে রামাযান বিকেল চারটায় মাওলানা হারুন ছাহেব আমাকে আবুধাবী বিমানবন্দরে পৌঁছে দিলেন। রিয়াদের বাসিন্দা আবুধাবীর শরীয়া আদালতে বিচারকের পদে কর্মরত জনৈক আলিম ছুটিতে সস্ত্রীক রিয়াদ যাচ্ছেন একই বিমানে। মাওলানা হারুন ছাহেব তাকে বললেন আমার দিকে খেয়াল রাখতে। এখানে বিদায়ের মুহূর্তে তিনি অন্যরকম এক স্নেহের প্রকাশ ঘটালেন, যাতে ছিলো পিতৃস্নেহের ছায়া।

এরকম স্নেহের বন্ধন কারো ভাগ্যে যদি জোটে তাহলে অবশ্যই তা আসমানের দান। এর মর্যাদা যদি রক্ষা করা হয় তাহলে তার জীবনের উদ্যানে আসে চিরবসন্ত এবং সর্বদা সেখানে প্রস্ফুটিত হতে থাকে সৌভাগ্যের নানান ফুল। যারা এর অমর্যাদা করে তাদের জীবনে কখনো না কখনো, কোন না কোনভাবে ঘটে দুর্ভাগ্যের ছায়াপাত।

এক সফরে বারবার আমি গ্রহণ করছি অশ্রু-ছলছল চোখে বিদায়ের আলিঙ্গন। এ যেন পরম মিলনের অব্যাহত প্রস্তুতি। ফলে সফরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত প্রতিটি বিদায়ে আমি মিলনেরই স্বাদ পেয়েছি। আজ যেন সে স্বাদ আরো ঘন ও ঘনীভূত হলো। বিমানবন্দরভবনের অভ্যন্তর-ভাগে প্রবেশের মুহূর্তে পিছনে ফিরে তাকালাম। একদৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে আছেন আমার গমনপথের দিকে। অত দূর থেকে চোখের অশ্রু দেখা যায় না, তবে বোঝা যায়; আমিও বুঝলাম। একবার রুমালে চোখ মুছতেও দেখলাম। অন্যরা তাদের আপনজনদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছে ; এদিক থেকেও প্রতি উত্তরে হাত নড়ছে। কিন্তু তিনি দাঁড়িয়ে আছেন স্থিরভাবে। আমার বড় জানতেইচ্ছে করছিলো তাঁর হৃদয়ের তখনকার অনুভূতি। আল্লাহর ঘরের মুসাফিরকে বিদায়জ্ঞাপনের সময় সবার মনে, সব হৃদয়ে কি একই রকম অনভূতি হয়, না হৃদয়ে হৃদয়ে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি হয়? বাইতুল্লাহর মুসাফির যারা তাদের হৃদয়ের অনুভব-অনুভূতি আমার জানতে বড় ইচ্ছে করে, তেমনি জানতে ইচ্ছে করে তাদের হৃদয়ের অনুভব-অনুভূতি যারা অল্লাহর ঘরের মুসাফিরকে বিদায় জানান অশ্রুর ঊষ্ণতা দিয়ে এবং আলিঙ্গনের উত্তাপ দিয়ে। প্রিয় পাঠক! তুমি যদি আল্লাহর ঘরের কোন মুসাফিরকে বিদায় জানাবার সুযোগ পাও তাহলে খুব মহব্বতের সাথে বিদায় জানিও। তার চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবতে চেষ্টা করো, এ চোখ দুটো কালো গিলাফের এবং সবুজ গম্বুজের সৌন্দর্য দেখতে পাবে। আমি তো এ চোখ দুটো আজ দেখতে পারি! এ হাত দুটো আল্লাহর ঘরের গিলাফ স্পর্শ করবে। আমি তো এ হাত দুটো স্পর্শ করতে পারি! এ মানুষটি আল্লাহর ঘরের ডাক পেয়েছে, আহা কত ভাগ্যবান! আমিও ভাগ্যবান হতে পারি এমন মানুষকে চোখের পানিতে বিদায় জানিয়ে। বাইতুল্লাহর মুসাফির আল্লাহর এত প্রিয় যে, তাকে যারা বিদায় জানায় তাদেরও আল্লাহ ভালোবাসেন; বিদায়ের সৌভাগ্য থেকে তাদেরও আল্লাহ মিলনের সৌভাগ্য দান করেন। আমারও সৌভাগ্য হয়েছিলো বাইতুল্লাহর বহু মুসাফিরকে বিদায় জানাবার। বিদায় জানিয়েছি, আর আসমানের দিকে তাকিয়ে নীরবে জিজ্ঞাসা করেছি, পিপাসা আর কত তীব্র হলে তুমি পানি দান করো হে আল্লাহ! আমি বিশ্বাস করি, অন্তরের ভালোবাসায় সিক্ত করে বাইতুল্লাহর মুসাফিরদের বারবার বিদায় জানাবারই এটা আজ পুরস্কার।

মাওলানা হারুন ছাহেব একইভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবং তাকিয়ে ছিলেন। শেষে আমি হাত নেড়ে ভিতরে চলে এলাম। তবে হৃদয়ের কানে স্পষ্টই যেন শুনতে পেলাম, তিনি বলছেন, আল্লাহ হাফিয। আজ পঁচিশ বছর পর এ সফরনামা যখন লিখছি তখন আমার এ প্রিয় মানুষটি পৃথিবীতে নেই, কিন্তু আমার হৃদয়ের জগতে তার অনেক ছবি আছে এবং থাকবে। এখনো আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাই আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে আমার গমনপথের দিকে স্থির তাঁর ব্যাকুল দৃষ্টি। এখনো আমি যেন অনুভব করি তাঁর সেদিনের সেই বিদায় আলিঙ্গনের মিষ্টি! আল্লাহ তাঁকে চিরশান্তি দান করুন।

আমাদের সফরে ঢাকা থেকে পাকিস্তান ছিলো বাংলাদেশ বিমান। আবুধাবী পর্যন্ত ছিলো পি আই এ। এখন জিদ্দা পর্যন্ত হলো সাউদিয়া। রিয়াদে এক ঘণ্টার জন্য যাত্রাবিরতি। তারপর জিদ্দা। সেখান থেকে...! দয়াময় আল্লাহ যদি দয়া করেন।

বিমানে আরোহণ করলাম। এই জীবনের পান্থপথে চলতে গিয়ে কতজনের সাথে দেখা হয়! কখনো বহুবার, কখনো মাত্র একবার। কেউ হারিয়ে যায় স্মৃতির পাতা থেকে, আবার কারো স্মৃতি মনে পড়ে থেকে থেকে। কারো স্মৃতি হয়ে পড়ে ম্লান, কোন স্মৃতি হয়ে থাকে চিরঅম্লান। তেমনি একজনের সাথে পরিচয় হলো বিমানে। তার শুভ্রসুন্দর নূরানী চেহারা আজো সমুজ্জ্বল আমার হৃদয়ের পাতায়। বিমানে আমার পাশের আসন ছিলো তার। বিমান তখন আকাশে উঠেছে এবং ডানা মেলে ওড়ছে। হঠাৎ দেখতে পেলাম, সেই নূরানী চেহারার মানুষটি বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছেন। সে দৃষ্টিতে কী ছিল, আমি জানি না। বেদনা! বিষণ্নতা! মমতা! স্মৃতির ব্যাকুলতা! কিছু একটা ছিলো, যা বৃদ্ধের প্রতি আমাকে আকৃষ্ট করলো। আমি সালাম দিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করতেই অপরিচয়ের সকল বাঁধ যেন মুহূর্তে ভেঙ্গে গেলো। তিনি নাম জিজ্ঞাসা করলেন। বললাম, আবু তাহের। বৃদ্ধ চমকে উঠলেন, আবু তাহের! তোমার ছেলের নাম তাহের! আমি বুঝিয়ে বললাম, তাহের নামে আমার কোন ছেলে নেই। এভাবেই আমার নাম রাখা হয়েছে। তিনি একটু বিষণ্ন হাসি হেসে বললেন, ওহ! আমাকেও সবাই আবু তাহের ডাকে। আমার একমাত্র ছেলের নাম ছিল তাহের। বেঁচে থাকলে এখন তোমার বয়সের হতো। কেন জানি তোমাকে দেখার পর থেকে বারবার মনে  হচ্ছে, আমার তাহের বেঁচে থাকলে দেখতেও তোমার মতই হতো! এতটুকু বলতেই বৃদ্ধের চোখ ছলছল করে উঠলো। এরপর তিনি তার জীবনের যে দীর্ঘ কাহিনী শোনালেন তা যেমন রক্তভেজা তেমনি অশ্রুভেজা, যেমন লোমহর্ষক তেমনি মর্মস্পর্শী। শুনতে শুনতে সেদিন আমারও চোখ থেকে অশ্রু ঝরেছিলো।

প্রিয় পাঠক! আমি বুঝতে পারছি, পথেই আমার সফরনামা অনেক দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার মনে হয়, সেদিন বিমানে সেই বৃদ্ধের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিলো গায়বেরই ইশারায় এবং উদ্দেশ্য ছিলো বাইতুল্লাহর মুসাফিরের তারবিয়ত। তাই ফিলিস্তীনের অধিবাসী সেই নূরানী চেহারার বৃদ্ধের পরিচয় তোমাকে না জানিয়ে আমি এগিয়ে যেতে পারলাম না। কারণ এখানেও রয়েছে আমাদের ঈমানী গায়রতের জন্য যথেষ্ট খোরাক। বিপদগ্রস্ত মুসলিম ভাইদেরকে দুফোঁটা রক্ত হয়ত আমি দিতে পারবো না, দুফোঁটা অশ্রু তো দিতে পারি; সেই দুফোঁটা অশ্রুর জন্যই আমি তোমাকে শোনাতে চাই এ কাহিনী।

১৯৪৮ সনে ইহুদী পশুদের নিষ্ঠুর উচ্ছেদ-অভিযানের মুখে হাজার হাজার ফিলিস্তীনী আরব মুসলিমকে তাদের হাজার বছরের বাস্তুভিটা ত্যাগ করে বিভিন্ন আরব দেশে হিজরত করতে হয়েছিলো। তখন তিনি ছিলেন পঁয়ত্রিশ বছরের যুবক। সে সময় হাজার হাজার অসহায় ফিলিস্তীনীর সঙ্গে তিনিও বিতাড়িত হয়েছিলেন এবং জর্দানে আশ্রয় নিয়েছিলেন সহায় সম্পদ, এমনকি স্ত্রী-পুত্রকে হারিয়ে। তাঁর মা-বাবা দুজনই ছিলেন ফিলিস্তীনী মুজাহিদ। দুজনই অস্ত্র হাতে লড়াই করে শহীদ হয়েছিলেন।

তিনি তার আম্মার সাহস ও নির্ভীকতার এবং ঈমানী গায়রত ও জিহাদী জাযবার এমন সব ঘটনা আমাকে শুনিয়েছিলেন, যা আমার দেশের কোন মর্দে মুমিন সম্পর্কেও কল্পনা করা যায় না। শাহাদাতের পূর্বমুহূর্তেও ফিলিস্তীনের বীরাঙ্গনা সেই মুসলিম নারী শুধু খঞ্জর হাতে একটা ইহুদী জানোয়ারকে জাহান্নাম রাসীদ করেছিলেন।

আম্মা-আব্বার শাহাদাতের পর তার অটল প্রতিজ্ঞা ছিলো, যে কোন মূল্যে পিতৃভূমির মাটি কামড়ে তিনি পড়ে থাকবেন। পূর্বপুরুষের বাস্তুভিটা ইহুদীদের হাতে ছেড়ে দেবেন না, কোন ভাবেই না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসে গেলো সেই ভয়াবহ রাত। সেটা ছিলো রামাযানের মাঝামাঝি সময়। গভীর রাত। ছয় বছরের শিশু তাহির ও তার মা ঘুমিয়ে আছেন। পালাক্রমে পাহারা দিতে হয়। তিনি বন্দুক হাতে পাহারা দিচ্ছেন। এমন সময় ইহুদী পশুরা হানা দিলো তাদের বস্তিতে। একদল হায়েনা অস্ত্র হাতে ঢুকে পড়লো তার বাড়ীতেও। তিনি প্রতিরোধ করতে চাইলেন। তিনজন ইহুদী তার হাতে মারা পড়লো। তিনি আহত ও বন্দী হলেন। বাকী ছয়-সাত ইহুদী হায়েনা উল্লাসে মেতে উঠলো। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও তার স্ত্রী সাহস হারাননি। তিনি জানতেন, ইহুদীদের কবলে যাওয়ার পরিণতি কী? তিনি আত্মহননের পথ বেছে নিলেন, তবে দুই ইহুদী পশুকে জাহান্নামের খোরাক বানানোর পর। তার চোখের সামনেই, স্ত্রীর শহীদী লাশের বে-হুরমতি হলো। তিনি কিছুই করতে পারেননি, কিছুই করার ছিলো না। কারণ তিনি তখন পশুদের হাতে বন্দী আহত ব্যঘ্র। এমনকি যখন পশুরা ছয়বছরের শিশুকে তার চোখের সামনে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করলো তখনো তিনি কিছু করতে পারেননি। প্রাণপণে শুধু ভিতরের চিৎকারটুকু রোধ করার চেষ্টা করেছেন, যাতে পশুগুলোর সামনে একজন মুসলমানের দুর্বলতা প্রকাশ না পায়। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে তাহিরের পিতা বললেন, খুব ভালো মায়ের দুধ পান করেছিলো আমার বেটা। সহজে তার জান বের হয়নি। পশুরা যখন অতটুকু নিষ্পাপ শিশুকে বেয়নেটের মাথায় বিদ্ধ করে শূন্যে তুলে রেখেছিলো তখনো সে চেয়েছিলো আমার দিকে এবং শান্ত দৃষ্টিতে। ধীরে ধীরে তার মাথাটা ঝুলে পড়লো, আর জানটা বের হয়ে গেলো। এ দৃশ্য দেখে পশুগুলোও অবাক না হয়ে পারেনি। আমার বেটার বড় শক্ত জান ছিলো। বেঁচে থাকলে জানবাজ মুজাহিদ হতো।

শায়খ এমনভাবে স্ত্রীপুত্রের শাহাদাতের ঘটনা বলছিলেন যেন গতকালকের ঘটনা। যেন স্ত্রীর, পুত্রের তাজা লাশ তার চোখের সামনে। চোখ থেকে ঝরা ফোঁটা অশ্রু যেন অশ্রু নয়, যেন ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে স্ত্রীর, মজলুম বাচ্চার রক্তাক্ত দেহ থেকে। তিনি বললেন, একসময় আমাকে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে পশুরা ফিরে গেলো। কিন্তু আমার তাকদীরে ছিলো বেঁচে থাকা। হাঁস্ত্রী-পুত্রের মৃত্যুর বীভৎসতার স্মৃতি বুকে ধারণ করে বেঁচে থাকা; অবশ্য যদি একে বেঁচে থাকা বলতে চাও। কীভাবে আমি বেঁচে গেলাম এবং পিতৃভূমি থেকে প্রাণ হাতে পালিয়ে জর্দান সীমান্ত পার হলাম, সে এক দীর্ঘ কাহিনী। শুধু এইটুকু বলতে পারি, পদে পদে আল্লাহর কুদরত আমাকে সাহায্য করেছে এবং কয়েকবার মৃত্যুর ঘেরাও পার হয়ে আমি জর্দানে পৌঁছতে পেরেছি।

ফিলিস্তীনে ইহুদীদের পাশবিকতা ও বর্বরতার অনেক ঘটনা আমার জানা ছিলো। বিভিন্ন পত্রিকায় এবং বইপত্রে পড়েছি। কিন্তু আজ আমার সামনে ছিলো একটি জীবন্ত কাহিনী। দুর্ভাগা ফিলিস্তীনের রক্তাক্ত মানচিত্র যেন আমি দেখতে পেলাম বৃদ্ধের বেদনাক্লিষ্ট মুখমণ্ডলে।

এরপর বৃদ্ধ আবু তাহির শোনালেন তার জীবনের প্রথম আল্লাহর ঘর যিয়ারতের কথা। তিনি বললেন, ১৯৫২ সালের রামাযান মাসে আমার সুযোগ হলো চাকুরী নিয়ে সউদী আরব আসার। দিল ছিলো যখমে পরিপূর্ণ। প্রতিমুহূর্তে যেন তা থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো। আমার শহীদ আম্মা-আব্বার জানাযা আমি পড়িয়েছি এবং নিজের হাতে তাদের দাফন-কাফন করেছি। তাই আমার সান্ত্বনা ছিলো। কিন্তু আমার স্ত্রী! আমার মাসুম বাচ্চা! তাদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ তো পড়েছিলো সেই ঘরে! একটা চাদর দিয়েও ঢেকে রেখে আসতে পারিনি তাদের! আমি যেন আমার স্ত্রী ও মাসুম বাচ্চার লাশ আমার বুকের ভিতরে দাফন করে রেখেছিলাম। আমার যখমি দিলের তখনকার অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই। সেই রামাযানে আমি ওমরা করলাম এবং জীবনে প্রথম আল্লাহর ঘর যিয়ারত করলাম। আল্লাহর ঘরের প্রথম দীদারের স্মৃতি আমি কোন দিন ভোলবো না। কালো গিলাফে ঢাকা বাইতুল্লাহর উপর নযর পড়ামাত্র যেন আমার দিলের সমস্ত যখমের উপশম হয়ে গেলো। আমি সব ভুলে গেলাম, আমি সব ফিরে পেলাম। আমি যেন আমার রবের কুদরতি হাতের সুশীতল স্পর্শ অনুভব করলাম। চোখ থেকে অবিরল ধারায় যে অশ্রুর ঢল নেমে এলো তা সবকিছু ধুয়ে মুছে নিয়ে গেলো। যখন আল্লাহর ঘর তাওয়াফ শুরু করলাম তখন আমি খুব স্পষ্টভাবে অনুভব করলাম, যেন আমার স্ত্রী আমার পাশে রয়েছে; আমার মাসুম বাচ্চা আমার হাত ধরে আমার সঙ্গে তাওয়াফ করছে!

সে বছরই আল্লাহ আমাকে হজ্ব করার তাওফীক দিলেন। তারপর প্রতি রামাযানে আমি আল্লাহর ঘর যিয়ারত করি। এ পর্যন্ত কোন রামাযান বাদ যায়নি। যখনই আমি আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করি, আমার পাশে আমি আমার স্ত্রী-পুত্রের উপস্থিতি অনুভব করি। যেন একেবারে শরীরী উপস্থিতি। আমার স্ত্রী তেমনি জোয়ান, আমার বেটা সেই নিষ্পাপ শিশুটি। তাদের মাঝে কোন পরিবর্তন নেই, আমারই শুধু বয়স বেড়ে চলেছে এবং আমি বুড়ো হয়ে চলেছি। আমার বিশ্বাস হয়, জান্নাতে আমি ওদেরকে পাবো এবং আমিও তখন আমার স্ত্রীর মত জোয়ান হবো, আর আমার বেটা তেমনি শিশু থাকবে এবং গেলমানদের সাথে ঘুরে বেড়াবে।

ফিলিস্তীনের সেই বৃদ্ধ, আমার ধারণা, এখন আর দুনিয়াতে নেই। নিশ্চয় এখন তিনি জান্নাতবাসী। নিশ্চয় তিনি জান্নাতে আপন স্ত্রী-পুত্রের সান্নিধ্য লাভ করেছেন। অন্তত আল্লাহর রহমতের কাছে এটাই আমি আশা করি।

আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, আমি বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি কি আবার শাদী করেছেন? আমার প্রশ্ন শুনে তিনি এমন এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন যে, আমি কুণ্ঠিত হয়ে পড়লাম। তার দুই ঠোঁটের মাঝে তখন যে নূরানী হাসি খেলা করছিলো তা আমি এখনো ভুলিনি। এমন হাসি কারো ঠোঁটে আমি আর কখনো দেখিনি। তিনি অবাক কণ্ঠে বললেন, শাদী! কেন? আমার স্ত্রী তো আমার পাশেই রয়েছে ! আমার পুত্র তো এখনো আমার হাত ধরে হাঁটে।

বৃদ্ধের কথায় আমি শ্রদ্ধায় অভিভূত হয়েছিলাম। আমি সেদিন কামনা করেছিলাম, পৃথিবীর সব পুরুষ যেন হৃদয়ের গভীরে এমন ভালোবাসা পোষণ করতে পারে তাদের স্ত্রী-সন্তানের প্রতি।

আমার আরো মনে পড়ে, জেদ্দা বিমানবন্দরে তিনি আমার হাতে কিছু রিয়াল দিয়ে বলেছিলেন, এটা নাও, আল্লাহর রাস্তায় খরচ করো। আমি ইতস্তত করায় তিনি বলেছিলেন, আমার শহীদ বেটার স্মরণে এই হাদিয়াটুকু গ্রহণ করো। আমি আর কিছু বলতে পারিনি। জিদ্দা থেকে আল্লাহর ঘর পর্যন্ত আমাদের একসঙ্গে সফর করা হয়নি। জিদ্দায় বসবাসকারী তার আত্মীয় তাকে নিতে এসেছিলেন, তিনি তার সঙ্গে জিদ্দা শহরে চলে গিয়েছিলেন। আবুধাবী থেকে প্রকাশিত পত্রিকার তিনি সম্পাদক ছিলেন।

ফিলিস্তীনের পবিত্র ভূমিতে এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা আরো কত ঘটেছে কে জানে, কিংবা এখনো ঘটছে! আমরা কজন তার খবর রাখি। অন্তত হাত তুলে আল্লাহর কাছে তাদের জন্য ফরিয়াদ করি। আমাদের সেই লাল রক্ত এখন হয়ত সাদা হয়ে গেছে। আমাদের চোখের পানির উৎসমুখ হয়ত এখন শুকিয়ে গেছে। একশ কোটিরও বেশী জনসংখ্যার মুসলিম উম্মাহ রক্ত পিপাসু হিংস্র হায়েনাদের কবলে এখন এতীম অসহায়, মুসলিম উম্মাহ এখন প্রতীক্ষায় আছে একজন গাজী সালাহুদ্দীনের। আমি জানি না, মুসলিম উম্মাহর মায়েদের বুকের দুধে এখনো সেই গুণ আছে কি না! কিংবা এখনো তারা নিজেদের গর্ভে এমন সন্তান কামনা করে কি না, যারা বাঁচবে গাজী হয়ে, মরবে শহীদ হয়ে!

হারামাইন শরীফাইনের খেদমত-সৌভাগ্য এখন যে দেশের হাতে সেদেশেরই বিমানের যাত্রী আমরা এবং আমাদের গন্তব্য আল্লাহর ঘর। কিন্তু বিমানে সেবকের চেয়ে সেবিকার সংখ্যা ছিলো বেশী এবং বিদেশিনী, অমুসলিম তো অবশ্যই। বিষয়টা শুধু আমাকেই পীড়া দিয়েছে এমন নয়; ফিলিস্তীনের শায়খও আফসোস করলেন এবং আমাকে উপদেশ দিলেন, যথাসম্ভব নযরের হেফাযত করো এবং পুরুষ সেবকের অপেক্ষা করো। কথাটা তিনি বলেছিলেন আমাকে এক সেবিকার কাছে পানি চাইতে দেখে। তার সে উপদেশ আমি এখনো ভুলিনি এবং এ ভুল আর কখনো করিনি।

অনেক আগেই বিমান সউদী আকাশ-সীমা অতিক্রম করেছে। সামনের স্ক্রীনে তীরচিহ্ন দ্বারা সে দৃশ্য দেখানো হয়েছে। জানালাপথে কিছু দেখা যায় না, তবে ঘোষণা থেকে জানা গেল, আমরা মরু অঞ্চল পাড়ি দিচ্ছি। কিছু পূর্বে বিমানের পক্ষ হতে ইফতার সরবরাহ করা হয়েছে। আমি একা একা মাগরিবের নামায আদায় করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ফিলিস্তীনের নূরানী চেহারার শায়খ নাছোড়বান্দা। বিমানক্রুদের নিষেধ সত্ত্বেও তিনি আমাকে নিয়ে জামাআত করলেন। দ্বীনের বিষয়ে আরবদের নিজস্ব জোশ ও জযবা সেদিন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হলো। তিনি আমাকে উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, দ্বীনের বিষয়ে কখনো শিথিলতাকে প্রশ্রয় দেবে না। তুমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলে অবশ্যই আল্লাহ তোমাকে সাহায্য করবেন।

রিয়াদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান যখন অবতরণের প্রস্তুতি ঘোষণা করলো তখন অর্জিত হলো আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি অবস্থানের দুর্লভ অভিজ্ঞতা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গর্বে গর্বিত মানুষের অসহায়ত্বের এমন মূর্তরূপ আমি আর কখনো দেখিনি।

বিমানবন্দরের আকাশে বিমান বারবার চক্কর দিচ্ছে, কিন্তু অবতরণ করছে না। বিষয়টি প্রথমদিকে কেউ খেয়াল করেনি। যে যার মত করে বসেছিলো, নিশ্চিন্ত, নিরুদ্বিগ্ন। কেউ কথা বলছে, কেউ জানালাপথে রাতের নগরী রিয়াদের আলোক-সৌন্দর্য অবলোকন করছে। পরে যখন ঘোষণা দেয়া হলো যে, বিমানের সামনের চাকা নামছে না এবং শেষ পর্যন্ত বিমানকে জরুরী অবতরণ করতে হতে পারে তখন হঠাৎ করেই বিমানের ভিতরের পুরো দৃশ্য পাল্টে গেলো। মৃত্যুর ছায়া যেন নেমে এলো সবার চেহারায়, আমারও। এদিকে কান্নার রোল, ওদিকে কালিমার আওয়ায। কেউ কেউ সিটবেল্ট খুলে পাগলের মত আচরণ শুরু করেছে। বিমানের নারী ও পুরুষকর্মীরা নিজেদের ভীতি চেপে রেখে যাত্রীদের নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করছে। ককপিট থেকে বারবার ঘোষণা আসছে; কিন্তু তা শোনার বা বোঝার উপায় নেই। সে এক ভয়াবহ দৃশ্য। দৃশ্য হলো দেখার এবং অনুভব করার বিষয়, বলার এবং শোনার বিষয় নয়। শুধু বলতে পারি, সেটা ছিলো কিয়ামতের ক্ষুদ্র এক নমুনা। এখনো সে দৃশ্য ভেসে উঠলে বুকটা কেঁপে ওঠে। এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে, মৃত্যু-আশঙ্কার সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মাঝে একটি চেহারায় ছিলো পূর্ণ প্রশান্তি। তিনি আমার পাশের আসনে বসা ফিলিস্তীনের শায়খ। তার হাতে ছিলো তাসবীহ, মুখে ছিলো যিকিরের শান্ত উচ্চারণ। এখনো আমার কানে বাজে তার একটি আয়াত তিলাওয়াতের আবেগকম্পিত কণ্ঠ

اَمَّنْ یُّجِیْبُ الْمُضْطَرَّ اِذَا دَعَاهُ وَ یَكْشِفُ السُّوْٓءَ وَ یَجْعَلُكُمْ خُلَفَآءَ الْاَرْضِ ؕ ءَاِلٰهٌ مَّعَ اللّٰهِ ؕ قَلِیْلًا مَّا تَذَكَّرُوْنَ

(কিংবা কে বিপদগ্রস্তের ডাকে সাড়া দেয় যখন সে তাকে ডাকে, এবং (কে) বিপদ দূর করে!... আছে কি আল্লাহর সঙ্গে কোন ইলাহ! খুব কমই উপদেশ গ্রহণ করো তোমরা)

তিনি আমাকে বলেছিলেন, আল্লাহর উপর ভরসা রাখো এবং আল্লাহকে ডাকতে থাকো, বিপদে তিনি ছাড়া কোন সাহায্যকারী নেই। জীবনের কোন সংকটমুহূর্তে এমন নূরানিয়াতের অধিকারী মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া সত্যি বড় কিসমতের বিষয়।

আমি মৃদু উচ্চারণে কালিমা তাইয়েবা পড়ছি, আর মনে মনে স্মরণ করার চেষ্টা করছি, মৃত্যুর হালাত কিতাবে কী কী পড়েছিলাম! হাদীসে কী কী বয়ান এসেছে! ভয়-ভীতি যখন ঘিরে ধরে, উপায়-আসবাব যখন গায়েব হয়ে যায়, সামনে যখন মৃত্যুর ছায়া দেখা যায়, বে-বাসী ও বে-কাসী যখন চরমে পৌঁছে যায় তখন বান্দা যেভাবে আল্লাহর কাছে নিজেকে সঁপে দেয়, যেভাবে আকুল হয়ে আল্লাহকে ডাকে এবং যেভাবে আল্লাহর কাছে দুআ করে তার সত্যি কোন তুলনা নেই। সে সময় আল্লাহ আমাকে যে দুআ করার তাওফীক দিয়েছিলেন তাতে আমার অন্তরে তখন এ প্রশান্তি এসেছিলো যে, যদি মৃত্যু আসে ইনশাআল্লাহ আসানির সাথেই আসবে এবং শাহাদাত-সৌভাগ্য নছীব হবে।

আমার জন্য তখনকার অবস্থা আরো মর্মন্তুদ ছিলো এ কারণে যে, তিন বছর আগে এই রিয়াদ বিমানবন্দরেই ঘটেছিলো শতাব্দীর সবচেয়ে শোকাবহ বিমানদুর্ঘটনা। সেটাও ছিলো সাউদিয়ার এবং হজ্ব-কাফেলার বিমান। বিমানবন্দরে অবতরণের পর অজ্ঞাত কারণে বিমানে আগুন ধরে গিয়েছিলো এবং দরজা খোলার স্বয়ংক্রীয় ব্যবস্থা বিকল হয়ে পড়েছিলো। ফলে বিমান থেকে একজনও যাত্রী বের হতে পারেনি। বিমানবন্দরকর্তৃপক্ষের তখন যাত্রীবোঝাই জ্বলন্ত বিমানের অসহায় দর্শক হয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার ছিলো না।

সে দুর্ঘটনায় চারশতাধিক হজযাত্রী জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে শাহাদাত বরণ করেছিলেন।  হযরত হাফেজ্জী হুযুর (রহ) এর মেঝো ছাহেবযাদা আলহাজ্ব ক্বারী ওবায়দুল্লাহ ঐ বিমানের ভিতরে শাহাদাত বরণ করেছিলেন।

বারবার মনে পড়ছিলো সে ঘটনা। কিছুই জানা নেই, কী ঘটতে যাচ্ছে! আমাদের ভাগ্যে কী অপেক্ষা করছে! তাকদীরের হাতে ইনসানের মজবুরির এর চেয়ে জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত আর কী হতে পারে! তবে আল্লাহ যাকে দয়া করেন তার অন্তরে সাকীনা ঢেলে দেন এবং কালিমার সাথে মওত নছীব করেন। এগুলো বড় কঠিন পরীক্ষা! আমাকে, তোমাকে, আমাদের সবাইকে, আপন-পর সবাইকে আল্লাহ যেন পরীক্ষা থেকে হেফাজত করেন; আল্লাহ যেন ঈমানের সাথে আসানির সাথে মওত নছীব করেন, আমীন।

সত্য কথা যদি বলতে চাই তাহলে বলবো, সে কঠিন সময়ে মায়ের কথা, বাবার কথা, স্ত্রীর কথা, কারো কথাই আমার মনে পড়েনি; শুধু মনে পড়েছে আমার মেয়েটির কথা, আমার অস্তিত্বের ছায়া হয়ে মাত্র যে দুনিয়াতে এসেছে, যাকে আমার এখনো ভালো করে দেখা হয়নি, ভালো করে কোলে নেয়া হয়নি; আমার হৃদয়ে যার স্পষ্ট কোন ছবিও নেই। তবু তার কথা আমার মনে পড়েছিলো। আজ এতদিন পরেও স্পষ্ট মনে পড়ে, সেই কঠিন অবস্থার মাঝেও মেয়ের জন্য আমার ব্যাকুলতার কথা। আল্লাহর কাছে আমি ফরিয়াদ করেছিলাম, আমার মেয়েকে তুমি এতীম করো না হে আল্লাহ!

এটাই মানুষের স্বভাব, এটাই সত্য। নীচের থেকে উপরে নয়, ভালোবাসা সব সময় উপর থেকে নীচে প্রবাহিত হয়। মানুষ তার গর্ভধারিণী মাকে এবং জন্মদাতা বাবাকে অবশ্যই ভালোবাসে, কিন্তু সন্তানের প্রতি ভালোবাসা অনেক নিবিড় এবং গভীর, আমার ক্ষেত্রে এটা যেমন সত্য আমার মা-বাবার ক্ষেত্রেও তেমনি সত্য। অনেক বছর পর আলী তানতাভীর আত্মজীবনীতে এ ফালসাফা পড়েছিলাম। আততায়ীর গুলিতে শাহাদাত বরণকারিণী তাঁর মেয়ের প্রসঙ্গে তিনি মুহাব্বতের এই ফালসাফা ও দর্শন উল্লেখ করেছিলেন। পড়ে আমি অবাক হইনি। কারণ আমার মনে পড়েছিলো ঐ দিনের ঐ মুহূর্তটি এবং আমি ছিলাম তার বাস্তব নমুনা।

আল্লাহর রহমতে বিপদ অবশ্য কেটে গেলো। ত্রিশ মিনিটেরও বেশী সময় পর শেষপর্যন্ত বিমানের চাকা নামলো এবং বিমান স্বাভাবিকভাবেই অবতরণ করলো। মৃত্যুর ছায়াপড়া মুখগুলোতে স্বস্তির হাসি ফুটে উঠলো। হামদ ও শোকরের সুমধুর আওয়াযে বিমানের অভ্যন্তর মুখরিত হলো। বিমানের সিঁড়ি থেকে নেমে সেখানেই ফিলিস্তীনী শায়খের দেখাদেখি আমি এবং আরো কয়েকজন দুরাকাত শোকরানা আদায় করলাম। বাসে করে আমাদেরকে বিমানবন্দরভবনে আনা হলো। একঘণ্টা পর আমাদের যাত্রা শুরু হবে জিদ্দার উদ্দেশ্যে।

রিয়াদের বাসিন্দা যে ভদ্রলোককে মাওলানা হারুন ছাহেব আমার প্রতি খেয়াল রাখার জন্য বলে দিয়েছিলেন তিনি খুঁজে খুঁজে আমাকে বের করলেন। দেখামাত্র বিপুল আবেগে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, হু হু করে কাঁদলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি ঠিক আছো তো? ভয় পাওনি তো? আমি তোমার কথা ভেবেছি। আল্লাহর কুদরতে আমরা সবাই রক্ষা পেয়েছি।

একটু আগের যে ভীতিকর পরিস্থিতি আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো এখন তা দূর হয়ে গেলো। আমি যেন আবার আমাকে, বাইতুল্লাহর মুসাফিরকে ফিরে পেলাম। আহ! শৈশবের অবুঝ হৃদয়ে যিয়ারাতে বাইতুল্লাহর স্বপ্নের যে বীজ অংকুরিত হয়েছিলো এবং ধীরে ধীরে লালিত হয়ে যৌবনে এসে যা হৃদয়ের ভূমিতে সবুজ ছায়া বিস্তার করেছে, স্বপ্নের সেই সবুজ বৃক্ষে এই কিছুদিন আগে একটি কলিও এসেছে; বিশ দিনের দীর্ঘ সফরে স্বপ্নের সেই কলি যেন একটু একটু করে ফুটছে; আলোর পরশ পেয়ে পেয়ে একটু একটু করে যেন মুখ খুলছে; সেই কলিটি পূর্ণ ফুল হয়ে ফোটার পরম মুহূর্তের এখন যেন শুভ উদ্বোধন হলো। অজু করে আমি ইহরামের লেবাস ধারণ করলাম। এশার নামায থেকে ফারিগ হয়ে ইহরামের দুরাকাত আদায় করলাম। তারপর! তারপর দুরু দুরু বুকে কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে উচ্চারণ করলাম সেই শব্দ কটি, চৌদ্দশ বছর আগে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব যা উচ্চারণ করেছিলেন মদীনা থেকে বাইতুল্লাহর উদ্দেশ্যে যাত্রার সময়

لبيك اللهم لبيك لبيك لا شريك لك لبيك، إن الحمد والنعمة لك والملك لا شريك لك.

(আমি হাযির, তোমার দুয়ারে হে আল্লাহ আমি হাযির! তোমার কোন শরীক নেই। আমি হাযির, নিঃসন্দেহে সকল প্রশংসা ও নেয়ামত তোমারই এবং রাজত্বও তোমারই, তোমার কোন শরীক নেই।)

ফিকাহর কিতাবুল হজ্ব পড়াতে কতবার এ শব্দ উচ্চারণ করেছি, অর্থ বুঝিয়েছি এবং মর্ম ব্যাখ্যা করেছি! কিন্তু আজকের উচ্চারণ, এ যেন অন্য কিছু! শব্দগুলো তখন যেন উচ্চারণ থেকে অনুভবে গিয়েছে, এখন তা অনুভব থেকে উচ্চারণে আসছে; তখন মর্ম ব্যাখ্যা করেছি, এখন মর্ম উপলব্ধি করছি, (বলা ভালো, উপলব্ধি করার চেষ্টা করছি।) তখন ইহরামের আলোচনা করেছি এখন ইহরাম গ্রহণ করছি। এতদিন হৃদয়ে স্বপ্ন লালন করেছি, হৃদয়ে লালিত সেই স্বপ্নকে এখন হৃদয়ে বরণ করছি। মনে হলো, আমি গান্দেগির নীচতা থেকে বান্দেগির উচ্চতায় উপনীত হলাম। আমার মনিব যেন বান্দাকে বান্দার আসল লেবাস পরিয়ে দিলেন। জীবনের বিভিন্ন অঙ্গনে মানুষের বিভিন্ন রকম পরিচয়-পোশাক থাকে। ইহরাম হলো বান্দার সারা যিন্দেগির বান্দেগির পরিচয়-পোশাক। সেই পাক-পবিত্র ও সাদা-শুভ্র পোশাক আল্লাহ তার অধম বান্দাকে আজ পরিয়ে দিলেন, শোকর আলহামদু লিল্লাহ।

ইহরামের লেবাস পরার তরীকা আমার জানা ছিলো না। আমার পেরেশান অবস্থা দেখে আল্লাহর এক বান্দা আমাকে সাহায্য করলেন। নিজের হাতে আমাকে ইহরামের লেবাস পরিয়ে দিলেন। তার নাম তখনো জানা হয়নি, এখনো জানা নেই। তখনো তাকে মনে হয়েছিলো পরম উপকারী বন্ধু, এখনো মনে হয় এবং আরো বেশী করে মনে হয়। আল্লাহ তাকে, আমার জীবনের প্রথম লিবাসুল ইহরাম ধারনে সাহায্যকারী সেই উপকারী বন্ধুকে উত্তম থেকে উত্তম বিনিময় দান করুন। আমীন।

রিয়াদের সেই ভালো মানুষটি আমার জন্য মাকবূল সফরের শুভকামনা জানিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। সফর শুরু হয়েছিলো তিনজনের কাফেলায়। তাই যাকে বলে সফরের নিঃসঙ্গতা, সেটা তখনো ছিলো না। আর আবুধাবীতে মাওলানা হারুন ছাহেবের কাছে এসে তো রীতিমত ঘরের ছায়া লাভ করেছিলাম। আবুধাবী থেকে যখন বিমানে আরোহণ করলাম তখন থেকেই শুরু হয়েছিলো প্রকৃত সফর। একজন মুসাফিরের নিঃসঙ্গ সফর। তারপরও ছিলো পরিচয়ের ক্ষীণ একটি সূত্র, রিয়াদ পর্যন্ত। সেটা এখন ছিন্ন হলো।

জিদ্দার উদ্দেশ্যে বিমানের সিড়িতে যখন আরোহণ করলাম, মনে হলো এই পৃথিবীতে আমি সম্পূর্ণ একা; আল্লাহ ছাড়া আমার কোন সঙ্গী নেই। আল্লাহ ছাড়া আমার কোন সঙ্গীর প্রয়োজনও নেই। এই পৃথিবীতে কারো সাথে আমার পরিচয় নেই। আল্লাহ ছাড়া কোন পরিচয়ের আমার চাহিদাও নেই।

মানুষ যখন একা ও নিঃসঙ্গ হয় তখনই সে পূর্ণরূপে অনুভব করতে পারে আল্লাহর সঙ্গ এবং সেই সঙ্গের আত্মিক স্বাদ ও রূহানী লয্যত। মানুষের যখন কোন পরিচয় থাকে না তখনই সে লাভ করে আল্লাহর পরিচয়। ইহরামের লিবাস ধারণ করে মানুষ আসলে তার ক্ষণস্থায়ী সমস্ত পরিচয় বর্জন করে এবং একমাত্র আল্লাহর পরিচয় গ্রহণ করে; আল্লাহর বান্দা হওয়ার পরিচয়, তার সৃষ্টির মূল পরিচয়। মানুষ তখন ধন্য হয়, তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য সার্থক হয়।

হজ্ব বা ওমরা শেষে ইহরামের লিবাস যখন তুমি খুলে ফেলবে তখন যদি তুমি এই লিবাসের শুভ্রতাটুকু ধরে রাখতে পারো জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাহলেই তুমি কামিয়াব ও খোশনছীব। জীবনে অহরহ আমরা পোশাক বদল করি, ইহরাম যদি হয় অনুভব অনুভূতিহীন তেমনি সাধারণ কোন পোশাক পরিবর্তন তাহলে সত্যি সত্যি আল্লাহর প্রয়োজন নেই বান্দার এই প্রাণহীন ইহরাম ধারণের। আমাকে, তোমাকে, আমাদের সবাইকে আল্লাহ তাওফীক দান করুন লিবাসুল ইহরামের পবিত্রতা ও শুভ্রতায় জীবনকে, জীবনের সকল কর্মকে শুভ্র ও পবিত্র রাখার।

প্রিয় পাঠক! তুমি তো আমার দেশের, আমার ভাষার! তুমি কি কাশবনে কাশফুল দেখোনি! সেই চিরচেনা কাশবনের কাশফুলের শুভ্রতা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো জিদ্দার উদ্দেশ্যে বিমানে আরোহণ করার পর। শুভ্রতা, পবিত্রতার অনুভূতি সৃষ্টি করে। আমারও হৃদয়ে পবিত্রতার অপূর্ব এক অনুভূতি সৃষ্টি হলো। আমার চারপাশে ইহরামের আরো অনেক শুভ্র লেবাস, আল্লাহর ঘরের আরো অনেক মুসাফির। আমার সামনে পিছনে নতুন পরিচয়ে পরিচিত অনেক মানুষ! মাঝে মাঝে সমবেত কণ্ঠে শুনি তালবিয়ার সুমধুর ধ্বনি, কলবে ইশকের মউজ এবং হৃদয়ে প্রেমের তরঙ্গ সৃষ্টিকারী লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনি।

আল্লাহর রহমতে ছহী-সালামতে বিমান জিদ্দায় অবতরণ করলো। বিমানের সিঁড়ির পাটাতনে এসে দাঁড়ালাম। আহ! হিজাযভূমির ঝিরঝির বাতাস দেহ-প্রাণ জুড়িয়ে দিলো। এই প্রথম হিজাযের পবিত্র বাতাসে আমি শ্বাস গ্রহণ করলাম। আলী তানতাভী যে লিখেছেন نفحات الحرم তা যেন আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করলাম। বাংলায় ঠিক কোন শব্দে نفحات الحرم এর ভাব ও মর্ম প্রকাশ করা যায় এখনো আমার জানা নেই। এটা বাংলা ভাষার দৈন্য, কিংবা আমার অক্ষমতা, তবে তখন আমি তা অনুভব করেছিলাম। আল্লাহ মেহেরবান আমাকে তাওফিক দিয়েছিলেন। আমাদের অনুভব এবং আল্লাহর যারা পেয়ারা বান্দা তাদের অনুভব কি এক হতে পারে! পশ্চিমের নাম না জানা এক কবির ভাষায়-

লায়লার গলিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা

কতজন আসে যায়, কিন্তু বলো বন্ধু

মজনু ছাড়া কে পায় লায়লার ঘ্রাণ!

আমি মজনু নই, মজনুর অনুসারীও নই। তবু আমি সামান্য কিছু পেয়েছিলাম এবং সেই অনুভবের, সেই স্বাদ ও লয্যতের সামান্যটুকুরও কোন তুলনা নেই।

ইশক ও মুহব্বতের আন্দায বড়ই নিরালা। আকল ও বুদ্ধির শাসন এখানে চলে না। যারা আশিক তারা দিওয়ানা। তাই আকল-বুদ্ধির বিচার দিয়ে তাদের তিরস্কার করো না। একথাগুলো আমার নয়, আমাকে সেদিন বলেছিলেন বাইতুল্লাহর এক আশিক দিওয়ানা, যখন আমি তাকে বললাম, তুমি এমন করছো কেন? এটা তো সঙ্গত নয়!

আমি তার আচরণকে অনুমোদন করিনি, তবে ইশকের মউজে ডুবে যাওয়া তার কলব থেকে কথাগুলো বের হলো তা অস্বীকারও করতে পারিনি। তবে মাওলানা মানাযির আহসান গীলানী (রহ.) তার হজের সফরনামায় যা বলেছেন এ ধরনের ক্ষেত্রে আমার মনে হয় সেটাই অনুসরণযোগ্য, তিনি লিখেছেন, মানুষের  সেচ্চার এমন কিছু কারো না যা অন্যের জন্য ফেতনা হতে পারে

জিদ্দা থেকে বাস রওয়ানা হলো, কোনদিকে?! মক্কাভূমির দিকে, আল্লাহর ঘর যেদিকে, যে ঘর যিয়ারাতের স্বপ্ন দেখেছি আজীবন সে ঘরের দিকে।

বাসের উনপঞ্চাশজন যাত্রী, ইহরামের লিবাসে সবাই আল্লাহর ঘরের যাত্রী। পুরো বাসে ক্ষণে ক্ষণে লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক ধ্বনি। সমবেতকণ্ঠে সেই সুমধুর ধ্বনি সময়ের প্রাচীর অতিক্রম করে আমাকে নিয়ে গেলো সুদূর অতীতে, চৌদ্দশ বছর পূর্বের আলোকময় অতীতে। পর্বত, উপত্যকা ও মরুভূমি পার হয়ে নূরের কাফেলা এগিয়ে চলেছে মক্কার পথে, বাইতুল্লাহর উদ্দেশ্যে। উটের পিঠে, এমনকি কেউ কেউ পায়ে হেঁটে। সালারে কাফেলাকে অনুসরণ করে কাফেলার সবার মুখে লাব্বাইক ধ্বনি। নূরানী যবান থেকে উচ্চারিত এ ধ্বনি সৃষ্টি করছে নূরের কম্পন, আলোর তরঙ্গ। সে কম্পন ও তরঙ্গ অনুভূত হচ্ছে সৃষ্টির অণুতে অণুতে। তারপর থেকে যুগের পথ ধরে এবং শতাব্দীর সিঁড়ি বেয়ে যত কাফেলা পথ অতিক্রম করেছে; যত কাফেলা মরুভূমি পার হয়েছে; সাগর পাড়ি দিয়েছে এবং আকাশে উড্ডয়ন করেছে তারা সব এই নূরানী কাফেলারই অনুগামী, এই নূরানী কাফেলার নূরে তারাও স্নাত।

আমাদের বাস চলছে। পথ কখনো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, কখনো মরুভূমির বুক চিরে। রাতের অন্ধকারে আলোর হালকা আভাস। কিছু দেখা যায়, কিছু দেখা যায় না; তবু আমি তাকিয়ে আছি দূর দিগন্তের দিকে, যেখানে দেখা যায় পর্বত শ্রেণীর অস্পষ্ট ছায়া। আমার মনে, আমার কল্পনায় বারবার ভেসে আসছে সেই নূরানী কাফেলার ছবি। জানি, মাঝখানে আছে সময়ের দূরত্ব এবং যুগের ব্যবধান। আছে বহু শতাব্দীর প্রাচীর। তবু তো সেই নূরানী কাফেলারই অনুসারী এ কাফেলা। আমাদের দৃষ্টি তো সেই আলোরই দিকে। আমরা চলেছি তো সেই আলোকেই অনুসরণ করে।

আমরাও তো বলছি লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক! জানি; তাতে ধ্বনি আছে, মর্ম নেই। তবু এটা তো তাদেরই অনুসরণ, সেই লাব্বাইক ধ্বনিরই অনুরণন।

আমরাও তো পরেছি ইহরামের সাদা লেবাস! জানি, আমাদের লেবাসে সে শুভ্রতা ও পবিত্রতা নেই, তবু তো এ লেবাস সে লেবাসেরই ধারাবাহিকতা! নাম তো এখানেও লিবাসুল ইহরাম! স্বীকার করি, এ কাফেলার কোন কিছুতেই সেই কাফেলার দৃশ্য নেই, কিন্তু সাদৃশ্য তো আছে! যাত্রা তো একই দিকে, আল্লাহর ঘর অভিমুখে!

এসব চিন্তায় আমি পুলকিত হলাম এবং বিগলিত হলাম। অদৃশ্যলোক থেকে আমি যেন এই সান্ত¡না লাভ করলাম, বান্দা! আমার রহমত ও করুণা সময়ের বাধা মানে না। যে যুগের হোক, যে দেশের হোক, যে ভাষা ও বর্ণের হোক, যারা অনুসরণ করবে আমার হাবীবের নূরানী কাফেলা, যত ক্ষুদ্রতা ও অসম্পূর্ণতা থাকুক, তাদের সবার উপর বর্ষিত হবে আমার রহমত ও করুণা।

আমার পাশের আসনে বসেছিলেন যিনি, দেহের বর্ণে তিনি বিলাল হাবশীর (রা.) সমগোত্রীয়। তিনি তার ভাষায় আমাকে কিছু বলতে চাইলেন। আমি বুঝতে পারলাম না, তিনিও আমার কথা বুঝলেন না। আমি অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম আর মনে মনে বললাম, তবু আমাদের লক্ষ্য এক, উদ্দেশ্য অভিন্ন। আমাদের লেবাস সাদা, আমরা আল্লাহর ঘরের যাত্রী। তোমার মুখের ভাষা আমি বুঝিনি, কিন্তু আমার অন্তরে রয়েছে তোমার প্রতি ভালোবাসা ও শুভ কামনা। ঈমানের বন্ধনে তুমি যে আমার ভাই!

একটু পরে অবশ্য বুঝতে পারলাম, তিনি কী চাচ্ছেন! ব্রিফকেস থেকে ছোট্ট বোতল বের করে যখন পানি পান করতে যাবো তখন তিনি পানির দিকে ইশারা করে বুঝালেন, তার খুব পিপাসা পেয়েছে। পানি ছিলো অল্প, আমারও পিপাসা ছিলো সামান্য। তাই নিজের প্রয়োজন চিন্তা না করে পানির বোতল আমি আমার হাবশী ভাইকে দিলাম এবং পিপাসার মাঝে অদ্ভুত এক তৃপ্তি লাভ করলাম।

আলোর শহর মক্কা এসে গেলো। দূর থেকে দেখা গেলো অসংখ্য বাতি এবং তার ঝলমল আলো। সমবেত কণ্ঠে উচ্চারিত হলো লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। সে ধ্বনিতে কী আবেগ-উচ্ছ্বাস! কী উত্তাপ-উদ্দীপনা! আমি রোমাঞ্চিত হলাম। আমার সমগ্র অস্তিত্বে অপার্থিব এক শিহরণ অনুভূত হলো। আল্লাহর পেয়ারা হাবীবের প্রিয় জন্মভূমি এ মক্কাভূমি! সত্যি সত্যি আমি তাহলে দেখতে পেলাম এ পবিত্র ভূমি! এ সৌভাগ্য তাহলে লেখা ছিলো আমার ভাগ্যে! হে আল্লাহ, তোমার শোকর।

ভিতরে আমার পবিত্রতা ছিলো না, তবে পবিত্রতার অনুভূতি ছিলো। সেই অনুভূতিকে সম্বল করে আমরা পবিত্র মক্কা শহরে প্রবেশ করলাম এবং.....এবং দেখতে পেলাম! দূর থেকে হারামের আলোকিত মিনারগুলো দেখতে পেলাম! আবার ধ্বনিত হলো, লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। (তোমার দুয়ারে আমি হাযির হে আল্লাহ, তোমার বান্দা হাযির!)

সব কিছু যেন চোখের পলকে ঘটে যাচ্ছে। আমার হৃদয়ের স্বপ্নকলির পাপড়িগুলো একে একে বিকশিত হচ্ছে, কিন্তু খুব দ্রুত। এতদিন যেন সময়ের গতি ছিলো ধীর, আর মন ছিলো অধীর। এখন সময়ের গতি এত দ্রুত যে, কিছু অনুভব করার আগেই যেন দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে চলে যাচ্ছি!

হযরত ইবরাহীম (আ.) এর শহর! হযরত ইসমাঈল (আ.) এর শহর! এবং আমাদের পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শহর! এ শহরেই তিনি জন্ম গ্রহণ করেছেন! এখানেই কেটেছে তার শৈশব, কৈশোর! এখানেই তিনি যৌবনের পবিত্রতা দিয়ে মুগ্ধ করেছেন, এমন কি শক্রদেরও হৃদয়! সেই শহর, আমার সারা জীবনের  স্বপ্নের মক্কা শহর আজ আমার চোখের সামনে! আমি এখন মক্কা শহরের ভিতরে, মক্কার আলো ঝলমলতার মাঝে!

এত দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন এত সহজে সত্য হয়ে যায়! তোমার শোকর হে আল্লাহ, তোমার শোকর!

হারামের আলোকিত মিনার দৃষ্টির আড়ালে  চলে গেলো, কিছুক্ষণ পর আমার দৃষ্টি আবার আলোকিত হলো। আবার লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক -এর উচ্ছ্বাস ধ্বনিত হলো। হারাম শরীফের খুব নিকটে এসে বাস থামলো।

বাস থেকে নামলাম। ইমামুল হারামের সুমধুর তেলাওয়াত কানে এলো। এখন মনে নেই, কোন আয়াত তিনি তিলাওয়াত করছিলেন, কিন্তু মনে আছে অনেকক্ষণ আমি ভাবাচ্ছন্ন অবস্থায় দাঁড়িয়েছিলাম। তিলাওয়াতের সুমধুর ধ্বনি আমার হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করেছিলো এবং আমার হৃদয়কে বিগলিত করেছিলো। মনে হয়েছিলো, এ যেন মানুষের কণ্ঠস্বর নয়, এ যেন আসমান থেকে নেমে আসা সুর ! এ যেন আসমান থেকে নেমে আসা নূর!

ধারণা করলাম, হারাম শরীফে কেয়ামুললায়ল শুরু হয়েছে। এক দোকানে গিয়ে অনুরোধ করলাম ব্রিফকেসটা আমানত রাখার জন্য, তিনি রাজি হলেন। ব্রিফকেস রেখে প্রয়োজন থেকে ফারিগ হলাম। অজু করে পাক-ছাফ হলাম। হে আল্লাহ, আমি তো শুধু বাইরে পাক-ছাফ হলাম তোমার হারামে প্রবেশ করার জন্য। তোমার বান্দাকে তুমি কবুল করো হে আল্লাহ! তোমার ঘর যিয়ারতের জন্য, তোমার ঘর তাওয়াফের জন্য এবং তোমার ঘরের আনওয়ার ও বারাকাত লাভের জন্য তোমার বান্দাকে তুমি ভিতর থেকে পাক-ছাফ করে দাও হে আল্লাহ! আমার কলবকে পাক করে দাও, হৃদয়কে পবিত্র করে দাও, আমার সমগ্র অস্তিত্বকে আলোকিত করে দাও।

অবশেষে আমার জীবনে এলো শৈশব থেকে হৃদয়ে লালিত স্বপ্নের কলি পূর্ণ প্রস্ফুটিত হওয়ার পবিত্রতম মুহূর্ত। ধীর পদক্ষেপে আমি মসজিদুল হারামে প্রবেশ করলাম এবং দৃষ্টি অবনত রেখে দুরু দুরু বুকে অগ্রসর হলাম। আমার চারপাশে যেন নূরের ঢেউ। আমি যেন সাঁতার কেটে কেটে এগিয়ে চলেছি। আমি যেন নূরের সাগরে ডুবে যাচ্ছি, তলিয়ে যাচ্ছি। সময়ের সব কিছু যেন হারিয়ে গেলো। চারপাশের উঁচু উঁচু ভবন, এমনকি হারামের সুরম্য ইমারত সব হারিয়ে গেলো। আধুনিক সবকিছু মুছে গেলো। নূরের বন্যায় সময়ের সব চিহ্ন ভেসে গেলো এবং আমি ডুবে গেলাম।

এখন আমি চোখ মেলে তাকাবো। এখন আমার স্বপ্ন দেখার ব্যথা ও বেদনার উপশম হবে। এখন হৃদয়ে আমার স্বপ্নের পূর্ণতার শান্তি ও প্রশান্তি অর্জিত হবে। এখন আমি দেখতে পাবো আমার আল্লাহর ঘর। কতদিন স্বপ্ন দেখেছি! কত রাত জেগে পশ্চিমের আকাশে তাকিয়েছি! বিগলিত হৃদয় থেকে কত অশ্রু ঝরিয়েছি! সফরে সফরে কত পথ পাড়ি দিয়েছি! কতদূর থেকে কত ব্যাকুলতা নিয়ে এসেছি আল্লাহর ঘর দেখবো বলে। হে আল্লাহ! সমস্ত পাপ পঙ্কিলতা সত্ত্বেও তুমি আমাকে তোমার পাক হারামে তোমার পবিত্র ঘরের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছো। হে আল্লাহ! করুণা করো, আমার দৃষ্টির মলিনতা দূর করো, আমি তোমার ঘর দেখবো। আল্লাহর ঘরের দীদার লাভের সময় পড়তে হয়

الله أكبر، لا إله إلا الله

আমি পড়লাম। আবারো পড়লাম

اللهم زد بيتك عزا وشرفا.

(হে আল্লাহ তোমার সম্মান ও মর্যাদা বৃদ্ধি করো) ধীরে ধীরে দুরু দুরু বুকে চোখ তুলে তাকালাম এবং দেখতে পেলাম। আমার আল্লাহর ঘর আমি দেখতে পেলাম। কালো গিলাফে এবং নূরের পর্দায় ঢাকা বাইতুল্লাহ আমি দেখতে পেলাম। সৃষ্টির সকল সৌন্দর্য যেন কেন্দ্রীভূত হলো কাবাতুল্লাহর মাঝে। কালো গিলাফের সৌন্দর্যের মাঝে আমি যেন সৃষ্টিজগতের সমগ্র সৌন্দর্য অবলোকন করলাম, সমগ্র সৌন্দর্যে আমি যেন অবগাহন করলাম।

সময়ের প্রাচীর ভেঙ্গে শত শত শতাব্দীর পথ পাড়ি দিয়ে আমি পৌঁছে গেলাম সেই সুদূর অতীতে, সেই নূর ও নূরানিয়াতের যুগে! আমি যেন দেখতে পেলাম সেই নূরানী কাফেলাকে আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করতে! আমিও শামিল হলাম সেই কাফেলায়। আমি ধন্য হলাম। আমার জীবন ধন্য হলো। আমার অস্তিত্ব সার্থক হলো। হে আল্লাহ, কীভাবে, কোন ভাষায় তোমার শোকর আদায় করবো! কী করে, কোন উপায়ে তোমার সমীপে হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা নিবেদন করবো! হে আল্লাহ! আমার তো সাধ্য নেই তোমার প্রশংসা করার। তুমি নিজে তোমার যে প্রশংসা করেছো সে-ই তো তোমার যোগ্য প্রশংসা।

এই যে হাজারে আসওয়াদ! হস্ত প্রসারিত করলেই যেন স্পর্শ পাবো। কিন্তু হে আল্লাহ, তোমার বান্দাদের যে কষ্ট হবে! আমি তো চাই শুধু তোমার সন্তুষ্টি! হে আল্লাহ, আমার অন্তরের আকুতি, আমার হৃদয়ের ব্যাকুলতা তুমি জানো। তোমার হাবীব যে প্রস্তর স্পর্শ করেছেন, তোমার হাবীব যে প্রস্তরে চুম্বন করেছেন তার একটু স্পর্শের জন্য, একটি চুম্বনের জন্য আমি প্রাণ উৎসর্গ করতে পারি। কিন্তু তোমার সন্তুষ্টির জন্য হে আল্লাহ, আমি বিসর্জন দিলাম আমার হৃদয়ের লালিত আকাক্সক্ষা।

আল্লাহু আকবার বলে দূর থেকে শুধু হাতের ইশারায় সম্মান জানালাম নবীজীর চুম্বনধন্য হাজারে আসওয়াদকে।

এই যে আল্লাহর ঘরের দুয়ার! এই যে বাইতুল্লাহর মুলতাযাম! আল্লাহ সুযোগ করে দিলেন। ধীরে ধীরে নিকটবর্তী হলাম এবং দুহাত উঁচিয়ে দুয়ারের চৌকাঠ ধরলাম। মুলতাযামে বুক লাগালাম। আহ, কী শান্তি! কী প্রশান্তি! আবার যেন সময়ের ব্যবধান মুছে গেলো। শতাব্দীর প্রাচীর আবার যেন ভেঙ্গে গেলো। মুলতাযামের স্পর্শে আমি যেন সেই পবিত্র পরশ স্পর্শের অনুভব করলাম। আমার সর্বসত্তা যেন নূরানিয়াতে পূর্ণ হলো। আবার যেন আমি ভেসে গেলাম নূরের বন্যায়।

হে আল্লাহ, তোমার ঘরের মুলতাযামে দাঁড়িয়ে জানি না কী আমি বলবো! কী আমি চাইবো! তুমিই বলে দাও, তুমিই শিখিয়ে দাও। হে আল্লাহ, তুমি আমার হয়ে যাও এবং আমাকে তোমার করে নাও। হে আল্লাহ, দয়া করে খুলে দাও, তোমার ফকীর বান্দার জন্য তোমার অফুরন্ত ভা-ারের দুয়ার খুলে দাও।

এই যে মাকামে ইবরাহীম! ধীরে ধীরে নিকটবর্তী হলাম। চোখ দুটোকে ধন্য করে দেখলাম। আল্লাহর খালীলের পাক কদমের ছাপ দেখলাম। এ পাক কদমের ছাপ আল্লাহর পেয়ারা হাবীব দেখেছেন, এ কথা কি সত্য নয়! আমি জানি, এ দেখা সেই দেখা নয়, তবু তো দেখা! দৃৃশ্য নেই, সাদৃশ্য তো আছে!

من تشبه بقوم فهو منهم

এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কী হতে পারে! সাদৃশ্যেরও মূল্য আছে। দৃশ্যের সঙ্গে সাদৃশ্য যদি অর্জন করতে পারো তাহলে তুমিও জামাতে শামিল হতে পারো।

আল্লাহর পেয়ারা হাবীব (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাওয়াফ শেষ করে মাকামে ইবরাহীমের নিকটে দুরাকাত নামায পড়েছেন। এ দুরাকাত উম্মতের উপর ওয়াজিব করা হয়েছে; কেন? আল্লাহর পেয়ারা হাবীবের সঙ্গে সাদৃশ্য গ্রহণের জন্যই তো! মারেফাতের জ্ঞানে অন্তর্জ্ঞানী আল্লাহর কোন এক বান্দা তো বহু যুগ পূর্বে কিছু না কিছু অবলোকন করে এবং কিছু না কিছু উপলব্ধি করে বলে গেছেন-

رحمت حق بہا نمى جويد + رحمت بہانہ مى جويد

আল্লাহর রহমত আমলের বাহার দেখে না, দেখে আমলের বাহানা।

আল্লাহর রহমত নেমে আসার পথে সেই বাহানাটুকু পেশ করার নিয়তে চৌদ্দশ বছর পরের এক গোনাহগার উম্মতি, গোনাহের গান্দেগিতে ডুবে থাকা উম্মতি নামাযে দাঁড়ালো, গোনাহের সিয়াহি ও কালো দাগ বুকে নিয়ে, কালো গিলাফের নূরানিয়াত সামনে রেখে। হায়, আফসোসে, অনুতাপে কলজে কি আমার ফেটে যাবে! কিংবা আমি কি পাগল হয়ে যাবো আনন্দের আতিশয্যে! সারা জীবনের নামায ছিলো এ ঘরের গায়েবানা, আজ এই প্রথম নামাযে দাঁড়ালাম, এই প্রথম সিজদায় মাথা রাখলাম এ ঘরের হাযিরানা! নামাযে এত স্বাদ, এত শান্তি! সিজদায় এত স্বস্তি, এত প্রশান্তি!

আবার, আবার আমার দৃষ্টি থেকে মুছে গেলো সময়ের সীমানা, বর্তমানের সব নিশানা। আমি দেখলাম অন্যরকম মানুষের অন্যরকম কাফেলা। এঁরা উম্মতের শ্রেষ্ঠতম কাফেলা। নূর! নূর!! চারদিকে শুধু নূর!!! নূরের সাগর! নূরের জোয়ার!! আমি যেন ভেসে গেলাম নূরের জোয়ারে! আমি যেন ডুবে গেলাম নূরের সাগরে!!

সালাম যখন ফেরালাম, চারদিকে যখন তাকালাম, দেখি, সবকিছু বর্তমান, সব কিছু বিদ্যমান। আধুনিক বিদ্যুতের আলোয় সবকিছু প্লাবিত। কিন্তু মনে হলো, অতীত যেন কিছু দিয়ে গেলো। আলোর উজ্জ্বলতায় নূরের পরশ যেন পাওয়া গেলো! যুগে যুগে অতীত এভাবেই মনে হয় ফিরে ফিরে আসে বর্তমানকে নূরস্নাত করার জন্য, কিংবা বর্তমান এভাবেই ফিরে ফিরে যায় অতীতের কাছে নূরস্নাত হওয়ার জন্য।

যখন হাত তুললাম মুনাজাতের জন্য, বিগলিত হৃদয় থেকে কান্না উথলে উঠলো। চোখ থেকে অশ্রুর ধারা নেমে এলো। এ কান্না আনন্দের! এ অশ্রু প্রশান্তির! সকল দাতার বড় দাতা যিনি, ভিখারীকে ডেকেছেন তিনি, কী জন্য! সকল দয়ালুর বড় দয়ালু যিনি, কাঙ্গালকে এনেছেন তিনি, কী জন্য! দান করার জন্যই তো! অনুগ্রহে ও করুণায় সিক্ত করার জন্যই তো!

এবার আবে যামযাম! বিবি হাজেরার ব্যাকুলতা ও অস্থিরতার আবে যামযাম! পিপাসায় কাতর শিশু ইসমাঈলের আবে যামযাম! সর্বোপরি আল্লাহর পেয়ারা হাবীবের পবিত্র থুথু মিশ্রিত আবে যামযাম! দয়াময়ের দয়া তা থেকেও আমাকে বঞ্চিত করলো না! আমার ঠোঁট দুটা অপবিত্র বলে করুণাময়ের করুণা তা থেকে আমাকে দূরে রাখলো না। আমি সিঁড়ি বেয়ে নামলাম এবং কাছে গেলাম। আমি যামযামের কূপ দেখলাম এবং পান করলাম। যামযামের শীতল পানি প্রাণভরে পান করলাম এবং তৃপ্ত হলাম। আমি আরো পান করলাম এবং পরিতৃপ্ত হলাম। আমি আকণ্ঠ পান করে কোষে কোষে সুসিক্ত হলাম।

হে আল্লাহ, তোমার মুসাফির মেহমান তোমার প্রতি খুশী হয়েছে। তার পিপাসা আজ দূর হয়েছে। হে আল্লাহ, তোমার হাবীব বলেছেন, যে মাকছুদে এবং যে উদ্দেশ্যে যামযামের পানি পান করা হবে তুমি তা পূর্ণ করবে। হে আল্লাহ, আখেরাতের কঠিন পিপাসার দিনে তোমার পেয়ারা হাবীবের হাতে একটি পেয়ালার জন্য আজ এখানে যামযামের পারে নাম লিখিয়ে গেলাম। তুমি কবুল করো হে আল্লাহ! (ক্রমশ)

 

 

advertisement