লাল মসজিদ ট্রাজেডী
পাকিস্তানের সাংবাদিকদের কলমে
[পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে অবস্থিত লাল মসজিদ ও লাল মসজিদ সংলগ্ন জামিয়া হাফসায় নিরাপত্তারক্ষীদের আক্রমণ ও রক্ত ঝরানোর ঘটনায় খোদ পাকিস্তানসহ দেশ-বিদেশের মুসলমান ও চিন্তাশীল নাগরিকরা তীব্র ভাষায় ক্ষোভ প্রকাশ করে চলেছেন। মিডিয়ার বিভ্রান্তিকর প্রচারনায় লাল মসজিদ ট্রাজেডীর সংবাদ এদেশে যথাযথভাবে প্রচারিত হয়নি। ঐ ঘটনার ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তানের প্রভাবশালী পত্রিকা, মিডিয়া ও শক্তিমান সাংবাদিকরা পাক সরকারের বিরুদ্ধে তাদের অগ্নিবাক্য বর্ষণ অব্যাহত রেখেছেন। স্থানের সংকটের কারণে সেসব কলাম ও নিবন্ধ থেকে কিছু চুম্বক অংশ এখানে পত্রস্থ হলো।]
হামিদ মীর
রক্ত বর্ষণ নামের একটি নিবন্ধে লিখেছেন—
ইসলামাবাদে এবারে বর্ষণ বেশ ভারী হয়েছে। সাধারণত বর্ষা মৌসুমে ইসলামাবাদকে অন্য মৌসুমের তুলনায় বেশি সজিব ও সতেজ দেখা যায়। কিন্তু এবার বর্ষায় ইসলামাবাদে রক্তের বৃষ্টি হয়েছে। এই বর্ষায় লাল মসজিদ ও জামিয়া হাফসার অঙিনা রক্তের স্রোতে ডুবে ছিল। যখন এখানকার খুনের দাগ পরিচ্ছন্ন হয়েছে তখনই ইসলামাবাদ ডিস্ট্রিক কোর্টের কাছে এক আত্মঘাতী আক্রমণকারী অসংখ্য লাশ ফেলে পাকিস্তানের রাজধানীর জমিকে আরেকবার মানুষের খুনে রঞ্জিত করে দিয়েছে। সরাষ্ট্রমন্ত্রী আফতাব শেরপাওয়ের বক্তব্য হলো, এই আক্রমণ লাল মসজিদের ঘটনাবলীরই ধারাবাহিকতা হয়ে থাকতে পারে।...
... সেই মেয়েটি ইসলামাবাদের এক ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। ইমেল করে সে আমাকে বলেছে, ইসলামাবাদে এক চীনা ম্যাসাজ সেন্টারের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে সে-ই মাওলানা আব্দুল আজীজের কাছে লাল মসজিদে গিয়েছিল। আইমান (সেই মেয়েটি) লিখেছে, তার সহপাঠী কিছু বান্ধবীরও মনোভাব ছিল এ রকমই যে, চীনা ম্যাসাজ সেন্টারে ভুল কাজ হচ্ছে। তাই তারা সবাই মিলে মাওলানা আব্দুল আজীজের কাছে নিবেদন করেছিল, পুলিশ তো এসব ভুল কাজ বন্ধ করবে না, আপনিই কিছু একটা করুন। আইমান ও তার বান্ধবীদের অভিযোগের কারণেই লাল মসজিদ ওয়ালারা ম্যাসাজ সেন্টারে অভিযান চালায়, চীনা মেয়েদের ধরে আনে, ধৃত চীনা মেয়েদের জামিয়া হাফসায় আবদ্ধ রেখে পরদিন সতর্কবার্তা শুনিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল। আইমান লিখেছে, এই ঘটনার কদিন পর লাল মসজিদে যা কিছু ঘটেছে সে সব ছিল তার কাছে অবিশ্বাস্য। হয়তো এসব কিছুই তার কারণেই ঘটেছে। যদি মাওলানা আব্দুল হাজীজের কাছে অভিযোগ না নিয়ে যেত, চীনা তরুণীরাও অপহৃত হতো না, লাল মসজিদের বিরুদ্ধে অপারেশনের পরিস্থিতিও হতো না। শেষে সে লিখেছে, হায় যদি অপারেশনের শেষ দিন সে-ও লাল মসজিদে থাকতে পারতো এবং সে-ও অন্য অনেকের সঙ্গে এই জালিম দুনিয়াকে ছেড়ে চলে যেতে পারতো! আইমান ইউসুফের অভিব্যক্তি আমাকে কাঁপিয়ে দিল। একটি ইংরেজী মিডিয়াম স্কুলের নিষ্পাপ ছাত্রী কোন্ প্রেরণায় মৃত্যুর আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করছে?
...শেষ দিন আব্দুর রশীদ গাজী বিকাল সাড়ে তিনটায় আমাদের সাংবাদিক বন্ধু আব্দুস সব্বুহ সাইয়েদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বলেছেন, তিনি রোযা রেখেছেন এবং শাহাদত দ্বারা তিনি ইফতার করবেন। অন্য এক সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে আখেরী পরামর্শ স্বরূপ তিনি তাকে বলেছেন, সে যেন শরাব পান করা ছেড়ে দেয়। শেষ মুহূর্তে তিনি কারো কাছে জীবন বাঁচানোর আবেদন জানাননি।...
মালিক আলতাফ হোসাইন
চিন্তার বিষয় শিরোনামে একটি নিবন্ধের সূচনায় প্রশ্ন সৃষ্টি করে লিখেছেন—
লাল মসজিদের সহকারী ইমাম মাওলানা আব্দুর রশীদ গাজী এবং জামিয়া হাফসার ছাত্রীরা যেভাবে ইসলামী শরীয়ত প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন সেজন্য তাদের বিরুদ্ধে প্রোপাগাণ্ডার একটি তুফান দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। আইন ও সংবিধানের উদ্ধৃতি দেওয়া হচ্ছে। ১৫ কোটি মানুষের ওপর এক হাজার মানুষের মর্জি চাপিয়ে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। আইন হাতে তুলে নেওয়ার অভিযোগ করা হচ্ছে। শক্তি ব্যবহারের কথাও বলা হচ্ছে। আসুন! লাল মসজিদের উলামায়ে কেরাম এবং জামিয়া হাফসার বোনদের অবস্থান ও দাবির একটি সহজ নিরীক্ষা আমরা চালিয়ে এটা বুঝতে চেষ্টা করি যে, তারা কিভাবে সঠিক পথে রয়েছেন এবং কি করে ভুল পথে গিয়েছেন? এটা কি বাস্তব নয় যে, পাকিস্তান হাসিল করাই হয়েছিল ইসলামের নামে? লাখো মানুষের হিজরত এবং হাজারো মানুষের শাহাদাত যদি এক ইসলামের জন্য না হয়ে থাকে তাহলে কিসের জন্য হয়েছিল? ১৯৭৩ সনে জাতীয় এসেম্বলিতে সর্ব সম্মতিতে পাশকৃত আইনে এটা কি অন্তর্ভুক্ত ছিল না যে, সব অনৈসলামিক আইনকে ১০ বছরের মধ্যে ইসলামী আইনে পরিবর্তন করে দেওয়া হবে, সেটি কি করা হয়েছে? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো- আইন, সংবিধান, এসেম্বলি এবং শাসকবৃন্দের সবাই মিলেও যদি অনৈসলামিক আইনের পক্ষ গ্রহণ করে এবং ইসলামী আইনের বিরোধিতা করে তবে সেরকম করার এজাযত কি আছে? কোনো ইসলামী রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণও যদি এ বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায় যে, আমরা ইসলামী বিধিবিধানের প্রতিষ্ঠা মেনে নেব না- তবে কি মাখলুকের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আল্লাহ ও রাসূলের হুকুমের বিপরীতে কোনো অবস্থান ও গুরুত্ব রাখে? এক হাজারের বিপরীতে ১৫ কোটির মর্জি চাপিয়ে দেওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে প্রথমত শুরু থেকেই সে কথাটি ছিল গলদ।
ইরফান সিদ্দিকী
মাতমকারী আর কী করতে পারবে নামে একটি নিবন্ধের সূচনায় আবেগময় ভাষায় লিখেন—
এখন তো খুনের তরঙ্গ মাথা থেকে নেমে গেছে। একজন নয়, হাজার হাজার মাতমকারী সঙ্গে থাকলেও এই সীমাহীন দুঃখ ও বেদনার প্রকাশ সম্ভব নয়। এ বেদনা বহন করছে এখন গোটা জাতি। লাল মসজিদ ও জামিয়া হাফসার বেদনাবহ ঘটনা ঘটে গিয়েছে দুসপ্তাহের বেশি আগে, কিন্তু আত্মার হুতাশন কমছে না। রাতের কোনো না কোনো সময় চোখ খুলে যায়। হৃদয় সশব্দে এমনভাবে ধ্বক ধ্বক করতে থাকে, যেন এখনই সিনার খাঁচা ভেঙ্গে বের হয়ে যাবে। ঘামে মাথা ভিজে যায়। চোখগুলো আগুনের অঙ্গারের মতো জ্বলতে থাকে। আপনা থেকেই চোখের অশ্রু প্রবাহিত হয়। ঘুম উড়ে চলে যায় অন্য কোনো বসতিতে। নানা ধরনের উদ্বেগ ও চিন্তা মাথাটাকে ঘিরে রাখে।
: যখন আগুন ও বারুদের বৃষ্টি ঝরছিল তখন কতজন তাজাপ্রাণ সেখানে বিদ্যমান ছিল?
: কতজন পুরুষ, কতজন তরুণ, কতজন নারী, কতজন শিশু?
: ফোর্সের নিক্ষিপ্ত বোমা ফাটার পর তাদের কী অবস্থা হয়েছিল?
: কত দিন ধরে তারা ক্ষুধার্ত ছিল?
: তাদের অন্তরে কোন্ ধরনের আবেগ ভীড় করেছিল?
: তাদের মস্তিষ্কে কি কি চিন্তা পাকিয়ে উঠছিল?
: তাদের কি বিশ্বাস ছিল যে, এত নিষ্ঠুরভাবে তাদের হত্যা করা হবে?
: তাদের মন ও মস্তিষ্কের কোথাও কি এই ভীতি ভর করেছিল যে, তাদেরই সেনাবাহিনী, তাদেরই পুলিশ এমনসব কাণ্ড তাদের সঙ্গে করতে পারবে?
: তাদের কি একীন ছিল যে, তারা সেখান থেকে কখনো জীবিত রেব হতে পারবে না?...
ড. শাহেদ মাসউদ
কারা ছিলেন? কোথায় চলে গেছেন? শিরোনামের নিবন্ধে লিখেছেন—
অন্যায় তো শুধু এটুকুই ছিল যে, তারা সমাজ থেকে অনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে ছিল। এ লক্ষ্যে বাইরে বের হয়ে অশ্লীল কর্মকাণ্ড চালানোর একটি কেন্দ্র থেকে পরিচালিকাকে সবক শেখাতে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে এসেছিল, দু তিন দিন পর বোরকা পরিয়ে, তওবা করিয়ে তাকে ছেড়ে দিয়েছিল। এরপর একটি ম্যাসাজ সেন্টারে গিয়ে সেখানকার দেহব্যবসায়ী কয়েকটি মেয়েকে নিজেদের সঙ্গে এনে কিছু শাস্তি দিয়ে-নসীহত করে ছেড়ে দিয়েছিল। লাঠি নিয়ে ঘুরছিল কিন্তু কারো মাথায় আঘাত করেনি। এই প্রিয় মাতৃভূমিতে যেখানে শাসক ও শক্তিমানদের প্রতি দুজনের একজন ভূমি মাফিয়া সেজে বসে আছে, লাল মসজিদ শহীদ হওয়ার পর পাশের একটি লাইব্রেরীতে গিয়ে তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে এসেছে। এরা হচ্ছে প্রগতিশীল, স্বচ্ছল, সুশোভিত পোশাকে আচ্ছাদিত, শাসনকেন্দ্রের জাঁকজমকপূর্ণ রুমের বাসিন্দা। এদের অধিকাংশই রাতের বেলায় শরাব ও যৌবনের আসরে নিজেদের উন্নতি দেখেন। অপরদিকে এই নিষ্পাপ, শুভ্র হৃদয়, হিজাবে আবৃত, পবিত্র আত্মাগণ..কুরআন তেলাওয়াতে মগ্ন-বিভোর। তারা কারা ছিলেন? কোথায় চলে গেলেন? ...
[ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত]