লালমসজিদ কর্তৃপক্ষ ও ক্ষমতাসীনদের সমঝোতা কেন ব্যর্থ হল
শ্রদ্ধেয় মুরব্বিয়ানে কেরাম ও আমার সাথী বন্ধুরা! আমি অনুভব করছি, আপনারা লাল মসজিদ সম্পর্কে জানতে উদগ্রীব হয়ে আছেন এবং যে রক্তের খেলা আমাদের চোখের সামনে হল সে কারণে আপনারা দুঃখভারাক্রান্ত এবং অধৈর্য্য হয়ে আছেন। আমার বিশ্বাস, পাকিস্তানের প্রত্যেকটি নাগরিক বেচাইন হয়ে আছে। সংবাদপত্র, রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমে ঘটনার বিস্তারিতরূপ অনেকটা জেনে ফেলেছেন। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমগুলোর উপর আমাদের ঘোর আপত্তি রয়েছে। একটি বাস্তব পরিস্থিতি যতটা বিস্তারিতভাবে খুলে বর্ণনা করা প্রয়োজন তারা সেভাবে খুলে বলে না। তারা কোনো কথাই স্পষ্টভাবে বলে না, গোলমাল করে যেকোনো বিষয়কে অস্পষ্ট রেখে দেয়। আর কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যম তো এ বিষয়টি নিয়ে শত্রু ভাবাপন্ন মানসিকতারও বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। বিশেষত উলামায়ে কেরাম, দ্বীনদার শ্রেণী এবং মান্যগণ্য ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে এমন বিষবাণ নিক্ষেপ করেছে যা কোনো প্রকাশ্য শত্রুর ক্ষেত্রেই সম্ভবপর হতে পারে। এটি একটি দুঃখজনক অবস্থা। এর থেকে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রক্ষা করুন।
এ অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার অভিযোগ আামরা একমাত্র আল্লাহ পাকের কাছেই করতে পারি। কেননা আমাদের অস্ত্র নেই, জনবল নেই, সেনাবাহিনী নেই, তাছাড়া আমাদের সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করা আমাদের জন্য বৈধও নয়। এসব দিক লক্ষ করলে একমাত্র আল্লাহ পাকের দরবারে নালিশ করা ব্যতীত আমাদের আর কোনো উপায় নেই। আর এসব ক্ষেত্রে আমরা তার কাছে পানাহ চাইতে পারি। আর আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ গোনাহের জন্য আল্লাহ পাকের দরবারে একান্তচিত্তে মাফ চাইতে পারি। কেননা যত ধরনের সমস্যার মুখোমুখি আমরা হই এবং যত ধরনের বালা-মুসীবত আমাদের দিকে ধেয়ে আসে তা আমাদেরই কৃতকর্মের ফল।
আমাদের পাকিস্তানের সরকারি পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত যেভাবে আল্লাহ তাআলার নাফরমানী হচ্ছে, সে হিসেবে আমাদের উপর যত কঠিন ও বড় ধরনের আযাব-গজব আসুক না কেন তা অস্বাভাবিক নয়। এই তো অতি বৃষ্টি এবং ঝড় তুফান এখানো চলছে এবং দেশের প্রায় অর্ধেক প্রলয়ের শিকার হচ্ছে, এরই মাঝে লালমসজিদের এ মহাসংকট ও মাহবিপদ সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আমি বহু বার একথা বলেছি যে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসব ফেতনার কথা বহু আগেই জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এমন সময় আসবে যখন এক মুসীবত কেটে না যেতেই আরেক মুসীবত মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে, এ মুসীবত শেষ হতে না হতেই তৃতীয় আরেক মুসীবত সামনে এসে দাড়াবে। একেরপর এক আসতেই থাকবে এবং একটির চেয়ে আরেকটি ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করবে।
মে মাসের ১২ তারিখে নিরপরাধ নিষ্পাপদের রক্ত নিয়ে যে হোলিখেলা হয়েছে টেলিভিশনের মাধ্যমে পৃথিবীর সকল মানুষ তা প্রত্যক্ষ করেছে, খুনিদের চেহারাও টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো হয়েছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের কেউই গ্রেফতার হয়নি। যেন কিছুই হয়নি। অথচ লাল মসজিদ কতৃর্পক্ষের দাবিগুলো ছিল খুবই যৌক্তিক, যা হুবহু আমাদের দ্বীন ও ঈমানের দাবি। ব্যবধান শুধু এতটুকু যে, তারা যে পদ্ধতিতে যে দাবি আদায় করতে চেয়েছিল তা আমাদের পূর্বসূরী আকাবির উলামায়ে কেরামের অনুসৃত পদ্ধতির পরিপন্থী ছিল। তাদের এ ভুল পদ্ধতির ব্যাপারে সবাই তাদেরকে সতর্ক করেছে, বুঝিয়েছে, কিন্তু তারা তা গ্রহণ করেননি। কিন্তু এরপর ভাববার বিষয় রয়েছে যে, তাদের অপরাধটা কী ছিল এবং তাদের পদ্ধতিগত যে ভুল ছিল তা কতটুকু।
শিশু পাঠাগার তারা দখল করেছে, আমরা স্বীকার করি এটা তাদের ভুল। পতিতালয় পরিচালিকা এক মহিলাকে তারা আটক করেছে। এ সবের বিরুদ্ধে দাবি উত্থাপন করে আর যত ধরনের চেষ্টা-প্রচেষ্টা হতে পারে তার সব কিছু বৈধ পদ্ধতিতে এবং আইনগতভাবে করা উচিত ছিল। তা না করে নিজেরাই তাদেরকে আটক রাখা-এটা ছিল তাদের ভুল। কিন্তু তাদের দাবি হচ্ছে, বহু বছর থেকে মহল্লার মানুষ পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে এসব অভিযোগ পেশ করে যাচ্ছে, কিন্তু এর প্রতি মোটেই কর্ণপাত করা হয়নি। পতিতালয় বহাল তবিয়তে চলছে, এলাকার মানুষ পেরেশান, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ পেরেশান। রাতের বেলায় সব ধরনের ব্যভিচারীদের আনাগোনা হরদম চলছে।
একটি মেয়ে তো নিজেই তার হৃদয়বিদারক দাস্তান শুনিয়েছে। তার ভাষ্যমতে তাকে ধোকা দিয়ে ঐ পতিতালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জোরপূর্বক তার ইজ্জত লুণ্ঠন করা হয়েছে। তাকে উলঙ্গ করে ছবি তোলা হয়েছে এবং এ বলে তাকে ভয় দেখানো হয়েছে যে, এখন যদি তুমি তোমার মা-বাবাকে বলে দাও তাহলে তোমার এ ফটো আমরা প্রচার করে দেব। এরপর বার বার তাকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়েছে এবং তার ইজ্জত লুণ্ঠন করার জন্য তাকে বার বার ডাকা হয়েছে। বেচারী বাধ্য হয়ে পড়েছে, একপর্যায়ে নিজের এ অভিযোগ নিয়ে জামেয়া হাফসায় এসেছে। কিন্তু এত সব অন্যায় অনাচার সংঘটিত হওয়ার পরও আমাদের বক্তব্য হচ্ছে ‘শামীম’ নামের যে মহিলাকে তারা আটক করেছে এটা তাদের ভুল ছিল। এটা তাদের দায়িত্বে পড়ে না। প্রশাসন যদি তাকে গ্রেফতার না করত তাহলে আপনারা সংবাদপত্রে তা জানিয়ে দিতেন, বা অন্য কোনো পদ্ধতি গ্রহণ করতেন। তা না করে ওই মহিলাকে নিজেরা আটক করা আপনাদের দায়িত্ববহির্ভূত। এর কারণে ফাসাদ সৃষ্টি হতে পারে, মার পিট হতে পারে এবং প্রশাসন কঠোর নীতি অবলম্বন করতে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। আর প্রশাসনে যারা রয়েছে তাদেরকে আপনারা ভালোভাবেই জানেন! পরিশেষে ফলাফল যা হওয়ার ছিল তাই হয়েছে।
তারা দ্বিতীয় যে কাজটি করেছিল তা হচ্ছে, পাকিস্তানে প্রচলিত ম্যাসাজ সেন্টারের চীনা মেয়েদেরকে আটক করা। ম্যাসাজ সেন্টার হচ্ছে যেখানে নারী পুরুষ নির্বিশেষে শরীর টেপানো হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব সেন্টারে যেসব মহিলা ম্যাসাজ করে তারা কারা? চীনা মেয়েরা। আর যারা ম্যাসাজ করায় তারাই বা কে? এরা মুসলমান পুরুষ! ইসলামাবাদের মানুষ! এরা প্রায় উলঙ্গ হয়ে এসব কাজ সারে। তাদের এ অপকর্ম। পাকিস্তানের প্রচলিত আইনেরও বিরোধী এবং ধর্মীয় রীতি-নীতিরও বিরোধী। সব দিক থেকেই এ বিষয়টি স্বীকৃত অপরাধ ছিল। যারা এসব সেন্টারকে লাইসেন্স দিয়েছে তারাও অপরাধ করেছে, তারাও অপরাধী। লাল মসজিদ কর্তৃপক্ষের অন্যায় শুধু এটুকু ছিল যে, তারা চীনা মেয়েদেরকে আটক করে নিয়ে এসেছে এবং বোরখা পরিয়ে নিরাপদে তাদেরকে পাঠিয়ে দিয়েছে।
চতুর্থত যে বিষয়টি ঘটেছে তা হচ্ছে, পুলিশ বাহিনী লাল মসজিদের ছাত্রদেরকে গ্রেফতার করার পর তারাও পাল্টা পুলিশদেরকে আটক করে নিয়ে গেছে। এটি ছিল তাদের চতুর্থ ভুল।
তাহলে এখন বিবেচনার বিষয় হচ্ছে, গাজী ভাতৃদ্বয়ের অন্যায় কয়টি? একটি হচ্ছে ‘শামীম’কে আটক করেছে, কিন্তু কোনো প্রকারের মারধর করা ব্যতীতই তাকে ছেড়ে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত ম্যাসাজ সেন্টারের চীনা মেয়েদেরকে আটক করে এনেছে এবং তাদের প্রতি কোনো ধরনের নির্যাতন করা ছাড়াই ছেড়ে দিয়েছে। তৃতীয়ত তাদের ছাত্রদেরকে ছাড়িয়ে আনার জন্য পুলিশের কিছু সদস্যকে আটক করেছে। তাদের চতুর্থ অন্যায় ছিল যে, তারা লাইব্রেরী দখল করেছে। এ চারটি অন্যায়কেই আমরা অন্যায় হিসেবে স্বীকার করি। এগুলোর কোনো ধরনের ব্যাখ্যাও আমরা দিতে চাই না। আমরা তাদেরকে বার বার বলেছি, তোমরা অন্যায় করছ। এমন কিছু করার অধিকার তোমাদের নেই। এক হুকুমতের ভেতর আরেক হুকুমত প্রতিষ্ঠা করা, এক প্রশাসনের মাঝে আরেক প্রশাসন চালু রাখা এবং আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়া এগুলোকে শরীয়ত সমর্থন করে না।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আজকে পশ্চিমা বিশ্ব, আমাদের কলমবাজ কলামলেখক, সাংবাদিক, সংবাদপত্র এবং অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমগুলো এ দাবি করছে যে, দেখুন- মাদরাসাগুলো এজন্য দায়ী, মাদরাসা এমনই হয়, আইন কানুনের বিরোধিতা করে এর প্রচার প্রসার ঘটায়, সশস্ত্র অবস্থান নেয়, হটকারিতা জন্ম দেয়, চরমপন্থী হয়, তারা যদি এভাবে বলে, তাহলে আমাদের মাদরাসাগুলোর ব্যাপারে পৃথিবীর মানুষ কী ধারণা পোষণ করবে। এক টেলিভিশন সাংবাদিক আমাকে এ ধরনের একটি প্রশ্ন করেছিল। আমি তাদেরকে বলেছি, আপনারা এ কথা বলছেন, অথচ আপনাদের জানা থাকা দরকার ছিল যে, জামেয়া হাফসা কতৃর্পক্ষের এ চারটি পদক্ষেপকে সবাই অন্যায় বলেছিল। সংবাদ মাধ্যমগুলোই এর সাক্ষী।
পাকিস্তান বেফাকুল মাদারিসের সাথে যেসব মাদরাসা সংযুক্ত রয়েছে সেগুলোর মধ্যে জামেয়া ফরীদিয়া (এবং ছাত্রীদের ক্যাম্পাস যার নাম জামেয়া হাফসা) ছিল একটি বড় মাদরাসা। এ মাদরাসা এবং তার পরিচালনাধীন শাখাগুলোতে প্রায় দশ হাজার শিক্ষার্থী ছিল। এরপরও বেফাকুল মাদারিস শুধুমাত্র এ কারণেই তাদের অন্তভুর্ক্তি বাতিল করে দিয়েছে যে, বেফাকুল মাদারিস তাদের এসব আইন বিরোধী কার্যক্রমকে বৈধ মনে করে না। এ চরম পন্থাকে তারা ন্যায়সংগত মনে করে না। এ কট্টরপন্থী নীতি তারা সমর্থন করে না। বেফাকুল মাদারিসের কেন্দ্র থেকে শুধু এ কারণেই তাদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করা হয়েছে। শিক্ষকমণ্ডলী ও ছাত্রছাত্রীদের দরখাস্ত ও টেলিফোনের পর টেলিফোন অনবরত আসছেই। তাদের অনুরোধ হচ্ছে, তাদের বছরটি যেন নষ্ট না হয়। কিন্তু আমরা বলেছি, না! অথচ জামেয়া হাফসার তখন কার্যক্রম চলছিল, কিন্তু কর্মকর্তা যেহেতু মাওলানা আব্দুল আযীয সাহেব ছিলেন, আর তিনি জামেয়া হাফসারও মুহতামিম এবং জামেয়া ফরীদিয়ারও মুহতামিম- সে কারণে আমরা জামেয়া ফারীদিয়ার অন্তর্ভুক্তিও বাতিল করে দিয়েছি এবং বার্ষিক পরীক্ষায় তাদের ছাত্র ছাত্রীদের অংশগ্রহণের আবেদনও আমরা ফিরিয়ে দিয়েছি। এটি একটি কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল, যা গ্রহণ করতে আমরা বাধ্য হয়েছি।
বেফাকুল মাদারিস তাদের এ সিদ্ধান্ত সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে। গাজী ভাতৃদ্বয়ের ভুল পদক্ষেপের ব্যাপারে আমি যা যা বলছি বেফাকুল মাদারিস তার ঘোষণাপত্রে এভাবে বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছিল। বেফাকের এ পদক্ষেপ কি প্রমাণ করে না যে, বেফাকুল মাদারিস তার সাথে সংযুক্ত কোনো মাদরাসার চরমপন্থা এবং সন্ত্রাসবাদী নীতিকে বৈধ মনে করে না। শুধু তাই নয়, বরং এমন কোনো মাদরাসার সংযুক্তিই তারা অনুমোদন করতে প্রস্তুত নয় যারা চরমপন্থা গ্রহণে আগ্রহী কিংবা আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়ার পক্ষপাতী।
শুধু বেফাকুল মাদারিসই নয়, সারা দেশের সকল মাদরাসার দায়িত্বশীল উলামায়ে কেরাম এবং সকল দলের যিম্মাদার আলিমগণ জামেয়া হাফসা কতৃর্পক্ষের এ অন্যায় পদক্ষেপগুলোর নিন্দা করেছেন এবং তাদের পদক্ষেপগুলোকে অন্যায়ই বলেছেন।
তাদের এ অবস্থান কি স্পষ্টভাবে এ কথা প্রমাণ করে না যে, সকল দ্বীনী মাদরাসা এবং সকল উলামায়ে কেরাম চরমপন্থা অবলম্বনের ঘোর বিরোধী, আইন লংঘনের ঘোর বিরোধী এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ারও ঘোর বিরোধী।
এ ঘটনা থেকে গোটা পৃথিবীর কাছে এ সংবাদ পৌঁছাবার দরকার ছিল যে, সকল উলামায়ে কেরাম সন্ত্রাসবাদ ও কট্টর পন্থাকে অন্যায় মনে করেন এবং এত মারাত্মক অন্যায় মনে করেন যে, তারা এসব কারণে তাদের অনেকদিনের সাথী বন্ধুদেরকেও মাদরাসা বোর্ড থেকে বের করে দিয়েছেন। আমি টিভি সাংবাদিকদের বলেছি, আপনারা পৃথিবীকে এ পয়গাম জানিয়ে দিন এবং সরেজমিনে যে বাস্তব চিত্র দেখেছেন তাই দুনিয়ার সামনে তুলে ধরুন।
কিন্তু আমাদের সরকার লাল মসজিদ কতৃর্পক্ষের এ চারটি দাবির একটির প্রতিও গুরুত্ব দেয়নি। কোনো ব্যাপারেই কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আজো পর্যন্ত পাকিস্তানের মানুষ এ অপেক্ষায় আছে যে, কোনোভাবে তারা জানতে পারবে যে, বহুকাল থেকে প্রশাসনের যেসব লোক আন্টি শামীমের এ পতিতাবৃত্তির তত্ত্বাবধান করে আসছিল তারা কারা? যারা এ পতিতালয় চালানোর অনুমতি দিয়ে রেখেছে তারা কারা? সেখানে কোন লোকেরা আসা যাওয়া করত? তাদের কি কোনো অপরাধ নেই? তারা কি নিষ্পাপ? তারা কি কোনো অন্যায় করেনি? অন্যায় কি শুধু তারাই করেছে যারা শামীমকে পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে ধরে নিয়ে এসেছে এবং তাকে তওবা পড়িয়ে নিরাপত্তার সাথে পাঠিয়ে দিয়েছে?
আপনারা বলুন এক্ষেত্রে কারা বড় অপরাধী? এ পতিতালয় পরিচালনাকারীরা নাকি জামেয়া হাফসার কতৃর্পক্ষ?
ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে মসজিদসমূহ ধ্বংস করা হয়েছে, আল্লাহর ঘর ধ্বংস করা হয়েছে, আর সে থেকেই লাল মসজিদ ও জামেয়া হাফসা কতৃর্পক্ষ এ আন্দোলন শুরু করেছে। বরং বাস্তব সত্য কথা হচ্ছে, সরকারের একমুখী নীতিই তাদেরকে এ আন্দোলনে নামতে বাধ্য করেছে।
আমাদের সরকারের মানসিকতাই এমন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত আইন কানুন লংনের পদ্ধতি গ্রহণ না করা হবে, ভাংচুর না করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সরকার কারো কোনো দাবি মানতে রাজি হয় না। এ বিষয়টি আমরা প্রধানমন্ত্রীকেও জানিয়েছি, আমাদের মেইন বৈঠকেও বলেছি, সে বৈঠকে প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী এবং তার কয়েকজন মন্ত্রী ও সেনাবাহিনীর জেনারেলও উপস্থিত ছিলেন। আমরা বলেছি, প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা যে পদ্ধতি গ্রহণ করেছে যদি এ পদ্ধতিই বহাল থাকে তাহলে দেশে নিরাপত্তা বিধান সম্ভব নয়। ভদ্রভাবে বললে আপনারা আমাদের কথা শোনেন না। প্রমাণভিত্তিক কথা মানেন না। কুরআন হাদীসের কথা মন দিয়ে শুনতে প্রস্তুত নন। আইন কানুনের কোনো কথাও আপনারা শুনতে প্রস্তুত নন। আপনারা আপনাদের মনমতো ইসলাম বিরোধী কূটকৌশলের উপর গোঁ ধরে বসে থাকবেন তো ফলাফল কী হবে? ফলাফল এমনই হবে যে, মানুষ উঠে দাঁড়াবে, সর্ব শক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়াবে। আইন নিজের হাতে তুলে নেবে। এরপর তারা না আমাদের কথা শুনবে, না আপনাদের কথা শুনবে।
জামেয়া হাফসায় এ ব্যাপারই ঘটেছে। এখন মসজিদসমূহ ধ্বংস করা হল, সাধারণ মানুষ এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে, দায়িত্বশীলদের সাথে আলোচনা করেছে, উলামায়ে কেরামও উপরস্থ কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করেছেন, কিন্তু তাদের কানে পানি গলেনি। যার ফলে জামেয়া হাফসা কতৃর্পক্ষ এর জবাব দিয়েছে যে, তোমরা আমাদের আল্লাহর ঘর ধ্বংস করেছ, আমরাও তোমাদের লাইব্রেরী দখল করেছি।
জামেয়া হাফসার যিম্মাদারদের দাবি ন্যায়-সঙ্গত ছিল, কিন্তু তাদের পদ্ধতি ভুল ছিল। উলামায়ে কেরাম, তাদের বড়রা, এমনকি বেফাকুল মাদারিসিলি আরাবিয়ার যিম্মাদারগণ গিয়ে তাদেরকে বুঝিয়েছে। কিন্তু তারা একথাই বলেছিল যে, আপনারা বলুন, আমাদের প্রশাসনের লোকেরা কি এমন যে, বাধ্য করা ব্যতীত কোনো কথা শুনবে।? মানার প্রশ্নতো আরো পরে, তারা তো শুনতেই রাজি নয়। আপনারাই বলুন, আমরা কী করতে পারি। আমরা তাদেরকে বলেছি, আপনারা ধৈর্যের পরিচয় দিন, আল্লাহর কাছে দুআ করুন এবং আইনের পথ থেকে বিচ্যুত হবেন না। কিন্তু তারা আমাদের একথা মেনে নিতে পারেনি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারের দৃষ্টিতে তাদের অন্যায় কী কী? চারটি অন্যায়। এগুলোর কোনোটির ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক কোনো পদক্ষেপ তারা নেয়নি। কোনো ঘরবাড়ি ধ্বংস করেনি। কাউকে কোনো ধরনের কষ্ট দেয়নি। এতসব কিছু করার ক্ষেত্রে তারা কারো গায়ে একটি আঁচড়ও লাগতে দেয়নি। কিন্তু সারা পৃথিবীব্যাপী তাদের ডাণ্ডার খবর পৌঁছে গেছে। ডাণ্ডাবাজির শরীয়ত, জোর-জুলুমের শরীয়ত। অথচ কোনো ছাত্র কখনও লাঠি ব্যবহার করেছে-এর একটি উদাহরণও কেউ দিতে পারবে না। এখন আমাদের জিজ্ঞাসা হচ্ছে, তাদের কৃত এ চারটি অন্যায়ের কোন অন্যায়টি এমন যার জন্য পাকিস্তানের আদালত হত্যার বিধান দিতে পারে? কিন্তু আইনকে উপেক্ষা করে আদালতকে ডিঙ্গিয়ে শুধু এটুকু অপরাধের জন্য শত শত ছাত্র-ছাত্রী ও হাফেযে কুরআনের রক্তের বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়েছে। বলুন, এটা কেমন ইনসাফ?
এদের দাবি হচ্ছে, জামেয়া হাফসা কতৃর্পক্ষ সরকারের দেওয়া রিটকে চ্যালেঞ্জ করেছে, কিন্তু আমরা বলি, যারা চল্লিশটি লাশের স্তুপ তৈরি করেছে তারা কি তোমাদের রিট অমান্য করেনি? এখানে এসে তোমাদের রিট রক্ষা করার কোনো প্রয়োজন তো হয়নি? কিন্তু করাচির এ মজলুম মানুষগুলোর যেহেতু পৃষ্ঠপোষকতা করার মতো কেউ ছিল না, আর হত্যাযজ্ঞ সংঘটনকারীদের পেছনে বিদেশি শক্তির মদদ রয়েছে, তাই চল্লিশটিরও বেশি তাজা প্রাণ করে ঝরে যাওয়ার পরও না তোমাদের দয়ার উদ্রেক হয়েছে, আর না সেসব জালেমদের প্রতি তোমাদের কিছুমাত্র ক্ষোভ প্রকাশ পেয়েছে!
আজ ন্যাটো বাহিনী তোমাদের এ রিট উপেক্ষা করে চলেছে, নিরপরাধ পাকিস্তানী মুসলমানদের উপর বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে, মিসাইল নিক্ষেপ করা হচ্ছে, এর শিকার হয়ে কত মুসলমান শহীদ হয়েছে, উড়োজাহাজে করে বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছে, সেখানে তোমাদের রিট নিয়ে তোমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। কেননা সেখানে তো তোমরা তাদের দেওয়া রিট রক্ষা করার জন্য ব্যস্ত। তোমাদের পবিত্র সীমান্তের রিট থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছ। তাদের এসব আচরণ তোমাদের আত্মাভিমানে আঘাত করে না, তোমাদের আইনের অবমাননা তোমরা দেখতে পাও না। তবে তোমাদের অত্যাচারিত ভাই-বোন, ছেলেমেয়েদের উপরই তোমাদের যত বাহাদুরি। নিপরাধ, মহিলা, শিশু ও অসহায়দের উপর তোমাদের বাহাদুরি উথলে উঠে।
সেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, যারা আল্লাহ তাআলার অপার অনুগ্রহে ১৯৬৫ খৃস্টাব্দের যুদ্ধে তাদের শক্তি, যোগ্যতা, বাহাদুরি, ত্যাগ এবং নিজেদের ঈমানদীপ্ত মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছে এবং এখনো পর্যন্ত আল্লাহর শোকর আমাদের সেনাবাহিনী সম্পর্কে এ ধারণাই মানুষ রাখে, মানুষ মনে করে সার্বিক বিবেচনায় আমাদের সেনাবাহিনী ঈমানী চেতনায় উদ্বেলিত এবং পৃথিবীর প্রথম সারির সেনাবাহিনীগুলোর একটি, পাকিস্তানের মানুষ নিজের পেট বেঁধে রেখে কর দিয়ে দিয়ে এ বাহিনীকে লালন পালন করেছে, তারা আমাদের আমানত, আমাদের পুজি, আমাদের শক্তি, আমাদের সীমান্তের রক্ষক, আমরা তাদেরকে নিয়ে গর্ব করি; কিন্তু তোমরা আমাদের সে বাহিনীকে কাপুরুষোচিত অজ্ঞতাপূর্ণ জুলুম অত্যাচারের ক্ষেত্রে ব্যবহার করছ। আমাদের এ বাহিনী যাদেরকে ইসলামের শত্রুদের মোকাবেলা করার জন্য তৈরি করা হয়েছে, যে বাহিনীকে পাকিস্তান রক্ষার জন্য গড়ে তোলা হয়েছে- তোমরা আজ সে বাহিনীকেই শত্রুদের হুকুমে পরিচালিত করার চিন্তায় ব্যস্ত। তোমরা তাদের আটশতরও বেশী জওয়ান ও অফিসারকে খুন করিয়ে ছেড়েছ।
তোমাদের এ বাহাদুরি আজ কাশ্মীরে চলে না, কার্গিল থেকে সকল সৈন্যবাহিনী ফিরিয়ে নিয়ে এসেছ। তোমাদের এ বাহাদুরি পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্ত রক্ষা করার ক্ষেত্রে কার্যকারিতা হারিয়েছে। তোমরা ন্যাটো বাহিনীকে পাকিস্তানের পবিত্র সীমান্ত মাড়াতে বাধা দিতে পারনি। তোমাদের বাহাদুরির প্রদর্শনি চলছে ‘বাজোড়’ এর মাদরাসার উপর, সেখানকার মজলুম ছাত্রদেরকে হত্যা করার উপর। তোমাদের বাহাদুরী চলছে জামেয়া হাফসার উপর, সেখানকার ছাত্র-ছাত্রীদের উপর। বস্তুত এগুলো হচ্ছে তোমাদের কাপুরুষোচিত অত্যাচারী মনোভাবের রক্তপিপাসু আচরণ। তোমরা এরপরও আশা কর যে, শান্তি- নিরাপত্তা বজায় থাকুক। শান্তি-নিরাপত্তা ধ্বংস করার সকল পন্থাই তোমরা গ্রহণ করে চলেছ, আবার আমাদেরকে বল শান্তি-নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় উলামায়ে কেরামের ভূমিকা থাকা জরুরি।
সরকার পক্ষের এসব অন্যায় পদক্ষেপ সত্ত্বেও শান্তি-নিরাপত্তার লক্ষ্যে লাল মসজিদ ও জামেয়া হাফসার বিষয়টি নিষ্পত্তি করার মানসিকতা নিয়ে উলামায়ে কেরাম বারবার ইসলামাবাদে এসেছেন। প্রথমে শুজাআত হোসাইন চৌধুরীর সাথে কথা হয়েছে। আমরা অর্থাৎ বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার সদস্যবৃন্দ তাকে আমাদের প্রস্তাবগুলো দিয়েছি, তিনি বললেন, একথাগুলো আমি প্রেসিডেন্টের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি এবং আমরা যে ফমূর্লা তৈরি করেছি তা তাঁর কাছে যুক্তিসংগত মনে হয়েছে, তিনি বলেছেন, উপরস্থ কর্মকর্তাদের সাথে আমি এ বিষয়ে কথা বলব।
রাতে ধর্মমন্ত্রী এজাযুল হক সাহেব আমাদের কাছে আসলেন। কথাগুলো তার সামনে পেশ করা হল। সামান্য কাটাকাটির পর শেষমেষ তিনিও এ ব্যাপারে একমত হলেন যে, এ ফর্মূলাটি এমন যার উপর কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া যায়। এতে সরকারের রিটও বহাল থাকবে এবং কানূনও সসম্মানে রক্ষা পাবে এবং সংঘর্ষ ও হানাহানি থেকেও বাঁচা যাবে, বিষয়টির একটি সুষ্ঠু সমাধান হবে। কিন্তু এটি রক্ষা করবেন বলে তারা কোনো ওয়াদা করেননি। শুধু এটুকু বলেছেন যে, প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমরা সাক্ষাৎ করিয়ে দিচ্ছি। আমি এজাযুল হক সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, বলুন তো প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার মতো অধিকার রাখেন কি না? তিনি বললেন, শতকরা একশ ভাগ তিনি সিদ্ধান্ত দেওয়ার অধিকার সংরক্ষণ করেন। পরের দিন সোমবার তিনি আমাদের কাফেলাকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করিয়ে দিলেন। সে বৈঠকেও আমাদের পূর্বোক্ত ফমূর্লাটি পেশ করা হয়েছে। ফর্মূলার যে যে বিষয় তাঁর চোখে সমস্যা হিসেবে ধরা পড়েছে সেগুলোর কথা বললেন, যেভাবে এর আগে এজাযুল হক সাহেবও বলেছিলেন, যাই হোক সেসব সমস্যার সমাধান দেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর সাথে এ মিটিঙে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, আব্দুর রশীদ গাজী সাহেবকে গ্রেফতার করা হবে না। কেননা তিনি টেলিফোনে আমাদেরকে বারবার বলছিলেন যে, ‘আমি জান দিতে রাজি আছি, কিন্তু তাদের হাতে গ্রেফতার হব না। সম্ভবত এর কারণ ছিল, মাওলানা আব্দুল আযীয সাহেবকে গ্রেফতার করে যেভাবে তাঁকে লাঞ্চিত করা হয়েছে এবং যেভাবে পাকিস্তান টেলিভিশনে ঠাট্টা করা হয়েছে, এবং যেভাবে ছাত্রদেরকে গ্রেফতার করে তাদের জামা খুলে খুলে চোখ বেঁধে অপমানজনকভাবে তাদেরকে টিভিতে প্রদর্শন করা হয়েছে- এসব দেখে তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, ‘অপমানজনক জীবনের চাইতে ইজ্জতের মৃত্যুই উত্তম।’
মরহুম আব্দুর রশীদ গাজী টেলিফোনে বারবার আমাকে বলেছেন যে, ‘আমি গ্রেফতার হতে রাজি নই, আমি এজন্য সাক্ষাতে প্রস্তুত নই। আমি জীবন দেব কিন্তু গ্রেফতার হব না। তবে এটুকু হতে পারে যে, আমাকে আমার বিবি বাচ্চা এবং আমার জরুরি আসবাবপত্রসহ আমার গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হোক। আমি জামেয়া হাফসাও ছেড়ে দেব এবং জামেয়া ফারীদিয়াও ছেড়ে দেব, লাল মসজিদও ছেড়ে দেব এবং শিশু পাঠাগারও ছেড়ে দেব। আমার কাছে যেসব অস্ত্র রয়েছে সেগুলো আপনাদের হাতে তুলে দেব। আমাকে আমার বাড়িতে যেতে দেওয়া হোক। তবে জামেয়া হাফসা ও জামেয়া ফরীদিয়াকে আমি বেফাকুল মাদারিসের দায়িত্বে দিয়ে দেব, যাতে মাদরাসার কোনো ক্ষতি না হয়। মসজিদ ওয়াকফফ স্টেট নিয়ে নেবে এবং তারাই তা চালাবে। এ হিসেবে এ চুক্তিনামা পাস হল এবং মৌখিক কথাবার্তাও সমাপ্ত হল। প্রধানমন্ত্রীও বলে দিলেন যে, এভাবেই কার্যক্রম শুরু করে দিন। তখন ছিল যোহরের পরের সময়।
অতঃপর এ মোতাবেক পরবর্তী কথাগুলো সম্পন্ন করার জন্য শুজাআত হোসাইন চৌধুরী সাহেব, ধর্মমন্ত্রী এজাযুল হক সাহেব, তথ্যমন্ত্রী মুহাম্মাদ আলী দুররানী সাহেব, গণমাধ্যম মন্ত্রী তারেক আযীম সাহেব এবং আমাদের প্রতিনিধি দলটি কয়েকটি গাড়িতে করে লাল মসজিদের কাছে গিয়ে পেঁৗছলাম। বন্ধ রাস্তাগুলো আমাদের জন্য খুলে দেওয়া হল। একটু সামনে গিয়ে যেখান থেকে লাল মসজিদ যাওয়ার রাস্তা সেখান থেকে আমাদেরকে পায়ে হেঁটে যেতে হচ্ছিল। এ সময় উপস্থিত নিরাপত্তা বাহিনীর হেড অফিসার- জানি না সে কে ছিল এবং কোন স্তরের ব্যক্তি- সে আমাদেরকে সামনে যেতে বাধা দিল এবং বলল, আপনারা সামনে যাবেন না। মন্ত্রীদেরও একই কথা বলল এবং শুজাআত হোসাইন চৌধুরীকেও সে কথাই বলল। তার কথাবার্তা থেকে মনে হচ্ছিল, যেন সে জানেই না যে, আমাদের মাঝে কোনো চুক্তির কথাবার্তা চলছে এবং সে মোতাবেক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আমাদের এ চুক্তি সন্ধির সাথে তার সামান্যতম সম্পর্ক আছে বলে বোঝা গেল না।
সে বলছিল সামনে যাওয়া যাবে না। কেন যাবে না? রিস্ক আছে। আমাদের ভয় হচ্ছে, তারা আপনাদেরকে আটক করে ফেলবে। আমাদের সাথে যেসব উলামায়ে কেরাম এসেছেন তারা বললেন, আমরা এ রিস্ক নিতে প্রস্তুত আছি। আর আমরা এ ব্যাপারে আশাবাদী যে, তারা আমাদেরকে আটক করবে না। তারা তো আমাদেরই ভাই। আমরা তাদের কাছে যাব, তাদের সাথে কথা বলব এবং এসব কিছু তাদেরকে জানাব। তারা সব জানিয়ে দিল, না হবে না। যাওয়া যাবে না।
আমরা আমাদের সাথীদেরকে অনুমতি দিয়ে দিয়েছি, তারা যেন নিজ যিম্মাদারিতে চলে যায়। কিন্তু আমাদের কোন কোন সাথী গোপনে এসে আমাকে বলল, একটি বিষয়ে আশংকা হচ্ছে যে, মসজিদের আশেপাশে উপস্থিত নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা গাছের আড়ালে সব জায়গায় প্রস্তুত রয়েছে, খুবই আশংকা রয়েছে যে, তাদের লোকেরাই আমাদের সাথীদের উপর ফায়ার করে মেরে ফেলবে এবং আব্দুর রশীদ গাজী সাহেবকে সেজন্য দায়ী করবে। এ আশংকা নিঃসন্দেহে গুরুত্ব পাওয়ার মত ছিল। তাই আমরা সাথীদের এমন কোন বিপজ্জনক পরিস্থিতির শিকার হওয়া থেকে বিরত রাখলাম এবং সিদ্ধান্ত হল যে, কাছাকাছি কোন জায়গায় যা সেনাদের অধিকারভুক্ত ছিল সেখানে বসে সন্ধিচুক্তিটি লিখে নেব এবং কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা হবে তা সে নীতিমালার ভিত্তিতেই বাস্তবায়ন হবে যা প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে গৃহীত হয়েছে। মন্ত্রীবর্গের পরামর্শক্রমে মাওলানা যাহেদ রাশেদী সাহেব ও তথ্যমন্ত্রী তারেক আযীম সাহেব তার খসড়া তৈরি করেছেন। প্রতিটি শব্দের উপর ভিন্ন ভিন্নভাবে বিবেচনা করা হয়েছে, প্রত্যেকটি শব্দ নিয়ে পরামর্শ করা হয়েছে। যেখানে যারই আপত্তি ছিল সেখানে তা পরিবর্তন করে সর্বসম্মত শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যার যত সংশয় ছিল তা দূর করা হয়েছে।
এরই মাঝে আব্দুর রশীদ গাজী সাহেবের একজন প্রতিনিধি এসে গেছেন। তার মাধ্যমে আব্দুর রশীদ গাজী সাহেবের সাথে সার্বক্ষণিক টেলিফোনে যোগাযোগ চলছিল। তার ফোনের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়েছে। বাহির থেকে একটি ফোন ভেতরে পাঠানো হয়েছে যেন স্বাভাবিকভাবে তার সাথে কথাবার্তা বলা যায়। চুক্তিপত্রের সকল বক্তব্যের সাথে তিনিও একমত পোষণ করেন।
তবে আব্দুর রশীদ গাজী সাহেবে টেলিফোনে বার বারই আমাদেরকে বলছিলেন যে, মন্ত্রীদেরকে নিয়ে আপনারা এখানে চলে আসুন, যাতে আমি তাদেরকে অস্ত্রগুলো দেখিয়ে দিতে পারি যে, আমার কাছে কী ধরনের অস্ত্র রয়েছে। কেননা আমার বিশ্বাস এরা হয়ত আমাকে মেরে ফেলবে, অথবা কোন একটা ধোকা দিয়ে আটক করে ফেলবে। এরপর এখানে অস্ত্রসস্ত্র এনে সংবাদ মাধ্যমে একথা প্রচার করবে যে, অস্ত্রগুলো এদের এখান থেকে পাওয়া গেছে। আমি আপনাদের অনুরোধ করছি, আল্লাহর ওয়াস্তে আপনারা এখানে আসুন, যাতে অস্ত্রগুলো আপনাদেরকে দেখাতে পারি। কিন্তু আমরা যে সেখানে যাব সে রাস্তাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমাদের জন্যও বন্ধ করা হয়েছে। মন্ত্রীদের জন্যও বন্ধ করা হয়েছে এবং সাংবাদিকদের জন্যও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
শেষমেশ চুক্তিপত্র লেখা হয়েছে। সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। আমরাও খুব সন্তোস প্রকাশ করলাম। এজাযুল হক সাহেব তো এতদূরও বলে ফেলেছেন যে, আজ যদি এ সমস্যা
সমাধান হয়ে যায় তাহলে আমি দুদিনের জন্য ওমরা পালন করতে রওয়ানা হয়ে যাব। এক সপ্তাহ যাবত যে মানসিক পেরেশানিতে ভুগছি তা দূর হয়ে যাবে। যখন সর্বজন গৃহীত এ চুক্তিপত্রের উপর উভয় পক্ষের স্বাক্ষর বরাবর হল তখন তারা নিচে দোতলার বারান্দার দিকে চলে গেলেন। আমরা যেখানে অবস্থান করছিলাম তা ছিল একটি ছোট দোতলা বাড়ি। আমরা ছিলাম উপর তলায়, সেখানে চুক্তিপত্র লেখা হচ্ছিল। এমতাবস্থায় কিছুক্ষণ পর উপরে আমাদের এখানে এসে তারা বলতে লাগলেন, আমাদেকে প্রেসিডেন্টের দফতরে যেতে হবে এবং প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে এর অনুমতি নিতে হবে। আমরা আশ্চর্য হলাম, যেখানে প্রধানমন্ত্রী মহোদয় পুরো মজলিসের সামনে ফায়সালা করেছেন এবং তার দেওয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এসব তাফসীল নেয়া হয়েছে, মন্ত্রীবর্গের কমিটি আমাদের সাথে বসে এ খসড়া অনুমোদন করেছেন, শুজাআত হোসাইন চৌধুরী সাহেবও পুরো কার্যক্রমের সাথে শরীক ছিলেন, তিনি এখানে আমাদের সাথেই আছেন- এমতাবস্থায় প্রেসিডেন্টের দফতর থেকে অনুমতি নেওয়ার কী অর্থ হতে পারে। বিশেষত প্রধানমন্ত্রী মহোদয় যখন মিটিংয়ে একথাও বলেছেন যে, প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের সাথে আজ এ বিষয়ে আমাদের পরামর্শ হয়েছে। আব্দুর রশীদ গাজী সাহেবও প্রস্তুত ছিলেন। আমরা তখন এ বিষয়ের আলোচনা শুরু করে ছিলাম যে, মসজিদের ভেতর ছাত্র সবাই হয়ত ক্ষুধার্ত অবস্থায় রয়েছে, তাই তাদের জন্য খানার ব্যবস্থা করতে হবে। মাদরাসার ছাত্ররা ও মহিলারা ক্ষুধার্ত, তাদের জন্য খানার ব্যবস্থা করতে হবে।
এ বিষয়ে সিদ্ধান্তও হয়ে গেছে যে, প্রশাসনের চারজন এবং আমাদের মধ্যে থেকে চারজন সকল ছাত্রীকে আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসব এবং নিরাপদ কোন জায়গায় নিয়ে তাদেরকে অভিভাবকদের হাতে তুলে দেব। এদের মধ্য থেকে কারো বিরুদ্ধে যদি কোন মামলা থাকে তাহলে তা খতিয়ে দেখা হবে। আর যাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা নেই তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে। তবে এ ঘটনার আগে যদি কারো উপর কোন মামলা থেকে থাকে তাহলে তাদেরকেও ছাড়া হবে না। অতঃপর তারা কথা বলে প্রেসিডেন্টের দফতরে চলে গেল। বলে গেল আমরা আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসব।
আমরা সারা দিনে একটু বিশ্রাম নিতে পারিনি। এর আগের রাতেও আমরা জেগেই ছিলাম। আর এর মাঝে আবার এ অপেক্ষার পালা সামনে এসে দাঁড়াল। আবার ভয় হতে লাগল, প্রেসিডেন্ট হাউজে গিয়ে সব কিছু ভেস্তে যায় কি না। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর তারা ফিরে এসেছেন এবং তারা যখন ফিরেছেন তখন তাদের চেহারাই অন্যরকম ছিল। একটি পৃষ্ঠার উপর তিনটি কথা লিখে এনেছেন, শব্দ মালা খুবই সুন্দর ছিল, যা আজকাল সরকারী লোকদের মাঝে সাধারণত হয়ে থাকে। কিন্তু সে কথাগুলোর সারমর্ম ছিল, বিষয়গুলো নিয়ে যে কথাবার্তা আব্দুর রশীদ গাজী সাহেবের সাথে হয়েছিল সেগুলোকে অস্বীকার করে দেয়া হয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ এ নতুন লেখার মাঝে প্রথম বিষয় লেখা ছিল, আব্দুর রশীদ গাজী তার সকল সাথীদের নিয়ে বেরিয়ে আসবেন। তাকে এবং তার পরিবারের সবাইকে তার ব্যক্তিগত আসবাপত্রসহ ‘ঘরে’ রাখা হবে। আমরা জিজ্ঞেস করলাম, কোন ঘরে রাখা হবে? আব্দুর রশীদ গাজী তো শুরু থেকে বলে আসছেন আমি নযরবন্দী হয়ে থাকতে রাজি নই। কোন সরকারী বাসা যা বাংলোতে থাকবে না। আমি আমার গ্রামের বাড়িতে চলে যাব। সন্ধিচুক্তিতে বিষয়টিকে এভাবেই লেখা হয়ে ছিল যে, তাকে তার গ্রামের বাড়িতেই রাখা হবে। অথচ নতুন চুক্তিপত্রে লেখা ছিল ‘ঘরে’ রাখা হবে। জিজ্ঞেস করলাম কোন্ ঘরে রাখা হবে? তারেক আযীম বলতে থাকলেন, যে কোন এক ঘরে রাখা হবে। আমরা বললাম, লিখুন, তার গ্রামের বাড়িতে রাখা হবে। তিনি বললেন, না ভাই তা সম্ভব নয়। এর মাঝে একটি শব্দও আগে-পিছে হতে পারবে না। কোন একটি শব্দ বেশকমও করা যাবে না। কেননা শেষ সিদ্ধান্তের পরই আমরা এটি নিয়ে এসেছি। এবং এ লেখাটির ফটোকপিও প্রেসিডেন্টের দফতরে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে।
এর মাঝে কোন প্রকার হেরফের হতে পারবে না।
এরপর তারেক আযীম সাহেব গোপনে আমাকে বললেন, দেখুন আমাদেরকে শুধুমাত্র আধা ঘণ্টা সময় দেয়া হয়েছে। এরই মাঝে হাঁ বা না একটি করিয়ে নিন। আর দেখুন, এর মধ্যে পনের মিনিট চলে গেছে, আমি বললাম দেখুন, এতে তো আর আমাদের সে চুক্তি বহাল রইল না সে ভিত্তিতে আমরা আব্দুর রশীদ গাজী সাহেবের সাথে কথা বলেছিলাম এবং অনেক কষ্টে তাকে রাজি করিয়েছিলাম। এখন তো একটি নতুন বিষয় সামনে আসল, এর দায়-দায়িত্ব আমরা নিতে পারব না। আব্দুর রশীদ গাজী সাহেবের প্রতিনিধি এখানে উপস্থিত আছেন, তাকে আপনারা এ লেখা দেখান, তিনি যদি গাজী সাহেবের কাছ থেকে মঞ্জুর করিয়ে নিতে পারেন তাহলে খুব ভাল হবে। একথার উপর আব্দুর রশীদ গাজী সাহেবের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হল, কিন্তু তিনি এ নতুন চুক্তি মানতে স্পষ্ট ভাষায় অস্বীকৃতি জানিয়ে দিয়েছেন।
যখন আমাদের মাঝে একথাগুলো চলছিল, এরই মাঝে সম্ভবত সেনাবাহিনীর কোন কমান্ডার হবেন, কামরায় ঢুকে দাঁড়িয়ে গেলেন, কামরাটি ছিল অনেক ছোট, যার মাঝে অনেক কষ্টে চার জন আলেম এবং চারজন সরকারের প্রতিনিধি ছিলাম। সে কমান্ডার লোকটি এসে এক বিশেষ ভঙ্গিতে আমাদেরকে লক্ষ করছিলেন এবং ঘড়ি দেখছিলেন। যেন তিনি বলতে চাচ্ছিলেন, মেহেরবাণী করে আপনারা এখান থেকে চলে যান। যার ফলে আমরাও নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম যে, এখন আর এখানে দেরি করার কোন অর্থ নেই। তাদের নিয়ত খারাপ মনে হচ্ছে। নিচের তলায় আমাদের যেসব সাথী ছিল তারা আমাদেরকে পরে বলেছে, সেনাবাহিনীর এক অফিসার এসে তাদেরকে বলেছে, আপনারা এখান থেকে চলে যান। সে কারণে নিচের সাথীরা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। তাদেরকে সাথে নিয়ে অতন্ত দুঃখ ও ভারাক্রান্ত মন নিয়ে গাড়িতে চড়ে চলে এসেছি।
তখন রাত প্রায় আড়াইটা বেজে গেছে, আমরা ফায়সালা করলাম, আমরা যে হোটেলে থাকছি সেখানে গিয়ে এ বিষয়ে পরামর্শ করব। উল্লেখ্য সে হোটেলে আমরা নিজেরাই থাকার ব্যবস্থা করেছি। সরকার পক্ষের সেখানে কোন দখল ছিল না। সফরের ব্যয় ইত্যাদির ব্যবস্থা আমরা নিজেরাই করেছি।
সম্ভাব্য একটি হালকা আশার আলো তখনও আমাদের মনে জেগেছিল, আর তা হচ্ছে, আব্দুর রশীদ গাজী সাহেবের প্রতিনিধি তখনও শুজাআত হোসাইন চৌধুরী এবং মন্ত্রীবর্গের কাছেই উপস্থিত ছিলেন। তিনি ফোনের মাধ্যমে গাজী সাহেবের সাথে যোগাযোগ করে যাচ্ছিলেন। আব্দুর রশীদ গাজী সাহেবও আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত ছিলাম ততক্ষণ পর্যন্ত সে নতুন খসড়া মানার বিষয়ে খুব জোরেসোরে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিলেন। এবং তিনি একথা বলেই দিয়েছেন যে, এটি একটি ধোকা। এ নতুন প্রস্তাবনার সার কথা হচ্ছে আমাকে গ্রেফতার করা, এ ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এ গ্রেফতার করাকে আমি কোনভাবেই গ্রহণ করতে প্রস্তুত নই। আমি গ্রেফতার হওয়া থেকে শাহাদতকেই প্রাধান্য দেব। তাঁর এ কথার পরই আমরা নিরাশ হয়ে সেখান থেকে ফিরে এসেছি। তবুও এ ক্ষীণ একটি আশা মনে জেগেছিল যে, হয়ত এ নতুন প্রস্তাবনার উপর উভয় পক্ষের কোন সমঝোতা হয়েই যাবে।
আমরা আমাদের মোবাইল ফোনগুলো বন্ধ করে ফেললাম। কারণ টি.ভি চ্যানেলগুলো বার বার আমাদের সাথে যোগাযোগ করছিল। এদিকে আমাদের ভয় ছিল, আমরা যদি এখনি বলে দেই, আমাদের আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে, তাহলে আশার আলো এখনো জেগে আছে, হয়ত সন্ধি হয়ে যাবে- এই শেষ আশাটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এ ভয়েই আমরা সবাই নিজ নিজ মোবাইল ফোন বন্ধ রেখেছি। আর আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, এভাবে কেউই এ বিষয়টির ঘোষণা দেব না। ফজরের নামাযের সময় হয়ে গিয়ে ছিল, তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, ফজরের নামায আদায় করে কিছুক্ষণের জন্য আমরা সবাই চলে আসব। এরপর পরামর্শ করে ঘোষণা দেব। এরই মধ্যে হঠাৎ আমার কাছে খবর এল যে, সেখানে তো হামলা শুরু হয়ে গেছে, সেখানে ব্যাপকভাবে বোমা নিক্ষেপ এবং গেলাগুলি চলছে। যেমনভাবে কোন শুত্র“র উপর হামলা করা হয় ঠিক সেরকমই পরিস্থিতি। আর সেখানে ভয়ানক ধ্বংসলিলা ছড়িয়ে পড়ছে। টেলিভিশনে সে হৃদয়বিদারক দৃশ্যগুলোর সাথে সাথে বিভিন্ন কল্পনাপ্রসূত ধারণা ও বিভিন্ন ধরনের বক্তব্যও প্রচার করা হচ্ছে।
প্রশ্ন করা হচ্ছে এটা কী হল? একটু আগেই শোনা যাচ্ছিল যে, আলোচনা ফলপ্রসূ হয়ে গেছে, এখন হঠাৎ এটা কী হল? ধারণা করে একেজন একেকটা বলে যাচ্ছে। একথা সঠিক যে, সিদ্ধান্তমূলক পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। আমি ভাবলাম, আমরা তো এ সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি যে, এককভাবে কেউই কোন ঘোষণা দেবে না। পরামর্শক্রমে সংবাদ সম্মেলনের মাধমেই ঘোষণা দেয়া হবে। কিন্তু যখন হামলা শুরু হয়েই গেছে, সারা দেশে এজন্য অস্থিরতা বিরাজ করছে, দেশের মানুষ পেরেশানিতে রয়েছে, সেজন্য আমি আমার মোবাইল চালু করে দিলাম। মোবাইল চালু করার সাথে সাথেই জিও. টিভি থেকে ফোন এসে গেছে, তারা জিজ্ঞেস করল, ব্যাপার কী ঘটেছে? তাদেরকে বিস্তারিত শুনিয়ে দিলাম। তখন প্রায় ভোর পাঁচটা বেজেছে, তারা তখনই সে খবর সারা পৃথিবীকে জানিয়ে দিয়েছে। এরপর আটটার দিকে জনাব হামিদ মীর সাহেব এসেছেন এবং অত্যন্ত দুঃখের সাথে বললেন, দেখুন এ মন্ত্রীগুলো কত মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছে। আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি আসল ঘটনাটি আমাদেরকে খুলে বলুন। তিনি ক্যামেরাও সাথে নিয়ে এসেছিলেন। আমি ভোর পাঁচটায় জিও. টিভিকে ফোনে যেকথাগুলো বলেছিলাম সে গুলোই আরো বিস্তারিতভাবে হামিদ মীর সাহেবকে শুনিয়ে দিয়েছি। তিনি আমার সেকথাগুলো রেকর্ড করে নিয়েছেন এবং বলেছেন আমি আধা ঘণ্টার মধ্যে একথাগুলো প্রচার করে দেব। কিন্তু তিনি সন্ধার দিকে কোন এক সময় প্রচার করেছেন। ততক্ষণে আমাদের সংবাদ সম্মেলনও ডাকা হয়ে গেছে।
এসব হচ্ছে অত্যন্ত দুঃখজনক ও হৃদয়বিদারক দাস্তান। কোন এক টিভি চ্যানেলের প্রতিনিধি আমাকে জিজ্ঞেস করেছে, আপনি এ রক্তপাতের জন্য কাকে দায়ী করেন? আমি বলেছি, প্রেসিডেন্টের দফতরকে। আল্লাহ তাআলা তাকে সুমতি দান করুন, আমাদের উপর এবং আমাদের প্রিয় ভূমির উপর দয়া করুন এবং যেসব আশংকা আমাদেরকে ঘিরে রেখেছে সেগুলো থেকে আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন। আমীন।
[উর্দু মাসিক আল বালাগ-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধ। অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ যোবায়ের হোসাইন]