সফর ১৪৩২   ||   জানুয়ারী ২০১১

একটি নূরানী ইজতিমা

হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী

প্রতি বছরের মতো ইনশাআল্লাহ এবারও টঙ্গীতে দাওয়াত ও তাবলীগের সালানা ইজতিমা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ বছর ইজতিমা দুই পর্বে হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রথম পর্ব ২১ জানুয়ারি ’১১ থেকে এবং দ্বিতীয় পর্ব ২৮ জানুয়ারি ’১১ থেকে শুরু হবে। এই বরকতপূর্ণ ইজতিমার প্রসঙ্গে আমরা হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ ইলিয়াস রাহ.-এর যমানার কিছু জলসা ও ইজতিমার সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরছি। যেন আমরা বর্তমান ইজতিমাগুলোকেও তার নূরানী ও বরকতপূর্ণ ইতিহাসের সাথে যুক্ত রাখতে পারি         ও প্রথম যুগের সেই শওক ও জযবার সাথে ফায়েদা হাসিলের চেষ্টা করতে পারি।-তত্ত্বাবধায়ক

মেওয়াতের বিভিন্ন জলসা

প্রায় প্রতি মাসে একবার মেওয়াতের কোনো না কোনো স্থানে এবং বছরে একবার ‘নূহ’ অঞ্চল মাদরাসায় তাবলীগী জলসা হত। দিল্লীর তাবলীগী জামাআত, ব্যবসায়ী দল, নিযামুদ্দীনে অবস্থানকারী যিম্মাদারগণ এবং মাযাহেরুল উলূম সাহারানপুর, দারুল উলূম দেওবন্দ, দারুল উলূম নাদওয়াতুল উলামা ও দিল্লী ফতেহপুর মাদরাসার কতিপয় আলেম ও শিক্ষক তাতে অংশগ্রহণ করতেন। মাওলানা (হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ.) বিশিষ্ট তাবলীগী সাথীদের নিয়ে জলসার উদ্দেশ্যে রওনা হতেন। সফরের সারা পথ আন্দোলনের দাওয়াত দিয়ে যেতেন এবং দাওয়াতের আদব ও নিয়মনীতি সম্পর্কে আবেগপূর্ণ ও সারগর্ভ বক্তব্য রাখতেন। বাস বা ট্রেনের যাত্রীরা (যাদের অধিকাংশই হতেন সফরসঙ্গী মুবাল্লিগ) মাওলানার বয়ানে অশেষ উপকৃত হতেন। এ যেন ছিল এক ভ্রাম্যমান জলসা, যা নিযামুদ্দীন থেকে শুরু করে মেওয়াতে গিয়ে শেষ হত।

মেওয়াতি কসবার লোকেরা মাওলানার শুভাগমনের সংবাদ পেয়ে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে দলে দলে বেরিয়ে আসত এবং মুছাফাহার জন্য পতঙ্গদলের মতো ঘিরে ধরত। মাওলানা সওয়ারিতে বসা অবস্থায় মুছাফাহা করতেন। এভাবে সওয়ারি ঘিরে শিশু-যুবক-বৃদ্ধের বিরাট মজমা কসবায় প্রবেশ করত। তখন আরো অসংখ্য মানুষ এসে যোগ দিত। মাওলানা অপরিসীম ধৈর্য্যের সাথে প্রত্যেকের সাথে আলাদা আলাদা মুছাফাহা করতেন এবং তাদের কারো সাথে আলিঙ্গনাবদ্ধ হতেন। কারো মাথায় হাত রাখতেন এবং তাদের হালকায় সাধারণভাবে বসে আলাপ শুরু করে দিতেন। এ সময় মাওলানা গরীব মেওয়াতিদের মাঝেই অবস্থান করতেন। সারাদিন এবং রাত্রের সিংহভাগ মেওয়াতিদের সাথে আলাপ আলোচনায়ই কেটে যেত। মেওয়াতে পদার্পণ করামাত্র মাওলানার উদ্যম-উদ্দীপনা ও হৃদয়ের সজীবতা বহুগুণ বেড়ে যেত। কথাবার্তায় ইলম ও মারিফতের মুষলধারে বৃষ্টি যেন বর্ষিত হত। দ্বীনের উছূল হাকীকত এবং নিগূঢ় তত্ত্ব ও রহস্যজ্ঞানের ঝর্ণাধারা যেন উৎসারিত হত।

সরলপ্রাণ মেওয়াতিরা বুঝকু, না বুঝুক প্রভাবিত ও অভিভূত অবশ্যই হত। মেওয়াতে অবস্থানকালে নিরবতা অবলম্বন এবং বিশ্রাম গ্রহণ দুটোই মাওলানার খুব কম হত। তাবলীগী আলোচনা ও দাওয়াতি মেহনত-এই হত তার দিন রাতে মাশগালা। ফল এই দাঁড়াত যে, মেওয়াত সফরের পর সীমাহীন ক্লান্তিতে তিনি ভেঙ্গে পড়তেন। প্রায়ই গলা বসে যেত। এমনও হয়েছে যে, জ্বর নিয়ে তিনি মেওয়াত থেকে ফিরেছেন।

এ সকল তাবলীগী ইজতেমার সময় এমন ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক পরিবেশ সৃষ্টি হত এবং এমন নূর ও তাজাল্লীর উদ্ভাস হত যে, পাষাণ হৃদয়ও আর্দ্রতা ও স্নিগ্ধতার পরশ অনুভব করত। যিকিরের সুমধুর গুঞ্জণে পরিবেশ মুখরিত হত এবং যাকিরীনের সমাগমে সকল মসজিদ গমগম করত। মুছল্লীদের এমন ঢল নামত যে, সড়কে-রাস্তায় কাতার চলে যেত এবং সামান্য বিলম্বেই মসজিদে জায়গা পাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ত। শেষ রাতের দৃশ্য তো চেয়ে চেয়ে দেখার মতোই হত। শীতের মৌসুমে কষ্টসহিষ্ণু ও দ্বীনপিপাসু মেওয়াতিরা মসজিদের চত্বরে খোলা আকাশের নিচে কিংবা গাছতলায় সুতির চাদর ও কম্বল গায়ে দিয়ে পড়ে থাকত। শীতের সকালে বৃষ্টিতে ফোঁটা ফোঁটা পানিঝরা শামিয়ানার নিচে বা গাছের তলায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্থির-প্রশান্তির সাথে বসে থেকে তারা ওলামায়ে কেরামের ওয়াজ শুনে যেত। স্ব স্ব স্থান থেকে সামান্য নড়াচড়াও করত না কেউ।

এ সকল ইজতিমায় ওয়াজ-বয়ান ছিল একান্তই গৌণ বিষয়। আসল উদ্দেশ্য ও মূল চেষ্টা ছিল নতুন নতুন জামাআত তৈরি করে আল্লাহর রাস্তায় বের করা। সুতরাং বাইরের এলাকায় এবং ইউপিতে গাশতের জন্য তৈরি জামাআতের সংখ্যা এবং নাম লেখানো মানুষের হিসাব ও সময়ের পরিমাণ-এগুলোই ছিল ইজতিমার কামিয়াবির মাপকাঠি। হযরত মাওলানা বরাবর এ তাগাদাই দিতে থাকতেন এবং এ দৃষ্টিকোণ থেকেই গোটা মজমার নেগরানি করতেন। মজমায় লোকদের কাছে এ বিষয়ে কি পরিমাণ তাকাযা করা হচ্ছে, বারবার সে খোঁজ খবর নিতেন। নিযামুদ্দীন ও মেওয়াতের অভিজ্ঞ মুবাল্লিগগণ আম ইজতিমা ছাড়াও খান্দানের চৌধুরী, মিয়াজী, আলিম-ওলামা ও প্রভাবশালী লোকাদেরকে আলাদা জমা করে তাদের দ্বারা নিজ নিজ খান্দান ও নিজ নিজ প্রভাব বলয়ে তাশকীল করাতেন। এভাবে তাদের মাধ্যমে নতুন নতুন জামাআত তৈরি হত।

কাজের ব্যাপারে যতক্ষণ মাওলানার ইতমিনান ও আশ্বস্তি না হত ততক্ষণ খাওয়া দাওয়া ও ঘুম যাওয়া তাঁর জন্য কষ্টকর ছিল এবং মেহনতের সুফল ঘরে না তুলে মেওয়াত ছেড়ে নিযামুদ্দীন ফিরে যাওয়া মুশকিল ছিল। কাজের ভবিষ্যত কর্মসূচি ও রূপরেখা তৈরি হওয়ার পর যখন তিনি পূর্ণ আশ্বস্ত হতেন তখনই কেবল ফিরে যাওয়ার প্রস্ত্ততি নিতেন। তখন কিন্তু কোনো ভক্ত অনুরাগীর দাওয়াত অনুরোধ কিংবা বিশ্রামচিন্তা তাঁর যাত্রা শুরুতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারত না।

দিল্লী ও নিযামুদ্দীনে মুবাল্লিগগণ সাধারণত ইজতিমার কিছু আগে গিয়ে ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করতেন এবং বিভিন্ন তাবলীগী গাশতের মাধ্যমে ইজতিমার ওয়াজ ও বয়ান থেকে ফায়দা হাসিল করার যোগ্যতা ও চাহিদা গড়ে তুলতেন। আবার ইজতিমা শেষে নতনু তৈরি লোকদের তাজা তাজা অনুভূতিকে কাজে লাগানো এবং তাদেরকে ঠিক মতো জুড়ে দেওয়ার জন্য কিছূ দিন অবস্থান করতেন।

হযরত মাওলানার অবস্থানকালে বিপুল সংখ্যক মেওয়াতি তাঁর হাতে বাইআত হত। কিন্তু বাইআতকালেও অনিবার্যভাবেই মাওলানা তাঁর দাওয়াত পেশ করতেন এবং এ কাজে আত্মনিয়োগ করার ওয়াদা নিতেন। পরবর্তীতে এ দাওয়াতি শিক্ষাই তিনি তাদেরকে দিতেন। বস্ত্তত নতুন বাইআতীরা যেন ছিল  মাওলানার দ্বীনী ও তাবলীগী ফৌজের রিক্রট। কসবার লোকেরা বিপুল সংখ্যক মেহমানের মনখুলে মেহমানদারী করত। বাইরের এলাকা এবং বিভিন্ন মেওয়াতি এলাকা থেকে আগত কয়েক হাজার মেহমানের কয়েক ওয়াক্তের খিদমতের ইন্তিজাম করা খুব সহজ মনোবলের ব্যাপার ছিল না। কিন্তু এমনই ছিল তাদের মেজবানির জোশ ও জযবা যে, এরপরও তারা যথাযোগ্য খেদমত হয়নি বলে দুঃখ প্রকাশ করত। মোটকথা, মেওয়াতি কওম তাদের মহানুভবতা ও অভাবনীয় মেহমান-সেবা দ্বারা প্রাচীন আরব-ঐতিহ্যকে যেন নবজীবন দান করেছিল।

সাধারণভাবে মুসলমানদের প্রতি এবং বিশেষভাবে আলিম ওলামা ও দ্বীনদারদের প্রতি ইকরাম ও সম্মানপ্রদর্শনের এমন অভ্যাস তাদের গড়ে তোলা হয়েছিল এবং এমন তরবিয়ত তাদের করা হয়েছিল যে, প্রত্যেক মেওয়াতি প্রত্যেক নবাগতকে পরম কৃতার্থতার সাথে গ্রহণ করত, ঠিক যেন ভক্ত মুরীদ তার শায়খকে বরণ করেছে। কেননা, বহিরাগত প্রত্যেককেই তারা তাদের দ্বীনী মুহসিন ও ধর্মীয় উপকারী মনে করত। যেন ঈমানের দওলত এবং দ্বীনের নেয়ামত তার কাছ থেকেই তারা পেয়েছে। এই গ্রাম্য মেওয়াতিদের দ্বীনী জযবা ও উদ্দীপনা, মুহাববত ও আন্তরিকতা, বিনয় ও কৃতার্থতা, যিকির ও ইবাদতমগ্নতা, অশ্রুসিক্ততা ও হৃদয়ার্দ্রতা এবং এলাকার দ্বীনী ও রূহানী ভাবদৃশ্য দেখে অনেকেরই নিজের ‘জীবন-অবস্থা’র উপর আফসোস হত, ঘৃণা হত, এমনকি নিজেকে মুনাফিক বলেও সন্দেহ হত।

মেওয়াতের জলসা প্রত্যাগত জনৈক ব্যক্তিকে হযরত মাওলানা একবার জিজ্ঞাসা করলেন, বলো ভাই, নিজের অবস্থার উপর কোনো আফসোস হল তোমার? সে বলল, যা কিছু দেখলাম, তাতে তো নিজেকে মুসলমান ভাবতেও লজ্জা হয়।

নূহ অঞ্চলের বৃহৎ ইজতিমা

৮, ৯ ও ১০ যিলকদ ১৩৬০ হিজরী, মোতাবেক ২৮, ২৯ ও ৩০ নভেম্বর ১৯৪১ খৃস্টাব্দে গৌড়গানো জেলার নূহ অঞ্চলে এক বিরাট তাবলীগী ইজতিমা অনুষ্ঠিত হল। বস্ত্তত মেওয়াতভূমি মানুষের এত বড় সমাবেশ ইতিপূর্বে আর দেখেনি। বাস্তবানুগ ধারণামতে লোকসংখ্যা ছিল বিশ/পঁচিশ হাজার। এদের একটা বিরাট অংশ নিজের সামান ও নিজের খাবারদাবার কাঁধে করে ত্রিশ/চল্লিশ ক্রোশ পথ হেঁটে হাজির হয়েছিল। বহিরাগত বিশিষ্ট মেহমানদের সংখ্যাও হাজারের কাছাকাছি ছিল। তারা মুঈনুল ইসলাম মাদরাসার ভবনে শানদার মেহমানদারিতে ছিলেন।

মজমার সুপ্রশস্ত শামিয়ানার নিচে মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ. জুমার নামায পড়িয়েছিলেন। জামে মসজিদসহ প্রায় মসজিদে নামায হওয়া সত্ত্বেও প্রধান জামাতের কাতারের কারণে সড়ক চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এমনকি ছাদে ও বালাখানার উপরেও শুধু মানুষ আর মানুষ দেখা যাচ্ছিল।

জুমাবাদ জলসা শুরু হল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জলসা চলত। না ছিল কোনো সভাপতি, না ছিল অর্ভ্যথনা কমিটি কিংবা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। কিন্তু যাবতীয় ব্যবস্থা ও কার্যক্রম অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে আঞ্জাম হয়ে আসছিল। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের যে সুশৃঙ্খল কর্মতৎপরতা ও দায়িত্ববোধ ছিল তা পোশাকধারী সুসংগঠিত স্বেচ্ছাসেবক দলেও দেখা যায় না। ইজতিমায় দিল্লীর সর্বস্তরের বিশিষ্ট ও সাধারণ সকল মানুষ বিপুল সংখ্যায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। খানবাহাদুর হাজী রশীদ আহমদ, হাজী ওয়াজীহুদ্দীন ও জনাব মুহাম্মাদ শফী কোরায়শী নিজ নিজ গাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে অন্যান্য মেহমান ও ওলামায়ে কেরামের আসা যাওয়ার বেশ সুবিধা হয়েছিল।

জলসা ও ইজতিমা সম্পর্কে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে মুফতী কেফায়েতুল্লাহ ছাহেব বলেছেন, ‘পঁয়ত্রিশ বছর ধরে আমি সব রকম ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সভায় অংশগ্রহণ করছি, কিন্তু এমন প্রকৃতির এবং এমন বরকতের ইজতিমা আজ পর্যন্ত আমি দেখিনি।’

বস্ত্তত এই মানব-সমাবেশ সাধারণ কোনো জলসা ছিল না। ছিল এক জীবন্ত ‘খানকাহ’। দিনের সংসারী এখানে হয়ে যেতেন রাতের সংসারত্যাগী। আবার রাতের ইবাদতগোযার দিনের আলোতে হয়ে যেতেন খেদমতগোযার। মানুষের কর্মজীবনে এ বিপরীত দুটি গুণের একত্র সমাবেশ ঘটানোই ছিল হযরত মাওলানার মেহনতের অন্যতম উদ্দেশ্য।

ইজতিমার নিয়মিত জলসাগুলো ছাড়াও হযরত মাওলানা স্বয়ং উঠতে বসতে এবং প্রতি নামাযের পরে তাঁর ‘কথা’ বলে যেতেন। তাছাড়া নামায শেষের আত্মসমাহিত অবস্থার আবেগ-উদ্বেলিত দুআগুলোও হৃদয়ে আলোড়ন তোলা বক্তৃতার চেয়ে কোনো অংশেই কম ছিল না। ষ

[হযরত মাওলানা ইলিয়াস রাহ. ও তাঁর দ্বীনী দাওয়াত পৃ. ১২৭-১৩১]

 

advertisement