শাবান-রমযান ১৪২৮   ||   সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০০৭

ইলমের জন্য চাই পিপাসা
কিছু প্রতিবন্ধক ভুল ধারণা

সে সফরে উস্তাদে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম আরেকটি বিষয়ে বারবার তাম্বীহ করেছেন। তা এই যে, ইলম ও তাহকীকের ক্ষেত্রে তুষ্টি নয়, চাই পিপাসা ও উদ্যম। তিনি বলেন, আমাদের সমস্যা হল, আমরা ইলমের ক্ষেত্রে পরিতুষ্ট হয়ে যাই, অথচ এটা পরিতুষ্টির ক্ষেত্র নয়।

বৈষয়িক ক্ষেত্রে অল্পেতুষ্টি কাম্য, কিন্তু সেক্ষেত্রে দেখা যায়, আগ্রহ ও প্রতিযোগিতাই বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। অন্যদিকে দ্বীনী বিষয়ে, বিশেষত ইলম ও তাহকীক, আমল ও আখলাকের দুরুস্তির ক্ষেত্রে, যেখানে শরীয়তের দৃষ্টিতে আগ্রহ ও চাহিদা কাম্য, অনাগ্রহ ও অল্পেতুষ্টিই স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে।

ইলম-অন্বেষণের দ্বিতীয় পর্বকে ব্যর্থতার হাত থেকে রক্ষা করুন

সালাফ বলে গেছেন- শুধু মুখে নয়, নিরন্তর উন্নয়ন-চেষ্টায় এই বোধ কর্মের মধ্যে প্রতিফলিত করেছেন, যে,

من استوى يوماه فهو مغبون

যার দুদিন এক সমান সে ক্ষতিগ্রস্ত। তালিবের জন্য অপরিহার্য, এই ক্ষতিগ্রস্ততা থেকে নিজেকে রক্ষা করা। তাকে প্রতি মুহূর্তে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, চিন্তা ও বুদ্ধি, কর্ম ও চরিত্র, হৃদয়ের পবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা ইত্যাদি সকল বিষয়ে সচেতনভাবে উন্নতির দিকে আগুয়ান হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় উল্টো চিত্র। ছাত্ররা যখন ইলম তলবের প্রথম পর্ব পাড়ি দিয়ে দ্বিতীয় পর্বে পদার্পণ করে তখন পূর্বের চেয়ে আরো বেশি উদাসীনতা ও ক্ষতিগ্রস্ততার শিকার হয়ে পড়ে। কেননা সে সময় পঠিত কিতাবের পাঠদানের দায়িত্বই সাধারণত তাদের উপর অর্পিত হয় আর তারা সেসব কিতাবের অধ্যয়ন সমাপ্ত করেন পাঠদানের প্রয়োজন মেপে। তাই শুধু দু দিন কেন, দু বছরও এমনভাবে কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব যে, প্রথম বছরের প্রথম দিন এবং দ্বিতীয় বছরের শেষ দিনের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য থাকে না, ইলম ও আমল, আকল ও হিলম এবং অন্যান্য গুণ ও বৈশিষ্ট্যের মধ্যেও কোনো পরিবর্তন সূচিত হয় না।

ইলম অন্বেষণের দ্বিতীয় পর্বে এখন এই ক্ষতিগ্রস্ততা ব্যাপকতর হচ্ছে। এর মৌলিক কারণ হল ইলম ও আমলের ক্ষেত্রে অল্পেতুষ্টির প্রবণতা, তাছাড়া বিভিন্ন ভুল ধারণাও এর পেছনে কার্যকর। ব্যাপক কিছু ধারণা এখানে উল্লেখ করছি।

১. নিসাবের বাইরে পড়ার মতো তেমন কিছু নেই!

এ ধারণা মন থেকে দূর করতে পারলে দেখা যাবে, নিসাবের বাইরে পড়ার মতো অসংখ্য বিষয় রয়েছে। সেসব বিষয়ের কোনো কিতাবই হয়তো নিসাবে নেই, কিংবা থাকলেও তার মাধ্যমে সে বিষয়ের প্রয়োজনীয় ইলম অর্জিত হয় না। দৃষ্টান্ত স্বরূপ উলূমুল কুরআন, উলূমুল হাদীস, উলূমুল ফিকহ, সীরাতে নববী ও উসওয়ায়ে নববীর মতো বিষয়গুলোও উল্লেখ করা যায়। এরপর কুরআন মজীদ, হাদীস শরীফ এবং সীরাত ও ইতিহাসে উল্লেখিত বিভিন্ন স্থানের ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিচিতি, আধুনিক ফিকহী সমস্যা ও তার সমাধান, ‘জরুরিয়াতে দ্বীনেরদলীল-নির্ভর গভীর জ্ঞান, বাতিল ফির্কা ও বিভিন্ন ভ্রান্ত মতবাদ সম্পর্কে প্রমাণ ভিত্তিক অবগতি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর শাখাগত বিষয়ের তো কোনো সীমা-সংখ্যা নেই।

২. যতটুকু ইলম দৈনন্দিন জীবনে ও পাঠদানের প্রয়োজনে অপরিহার্য তার অতিরিক্ত ইলম অর্জন করা মুস্তাহাব, আর তা আমাদের মতো লোকদের অর্জন করার প্রয়োজন নেই।

এটাও একটা মারাত্মক ক্ষতিকর ধারণা, একেবারেই অমূলক। কেননা, ঈমান-আকীদার হিফাযত, সুন্নতের উপর ইস্তেকামাত, আখলাক-চরিত্রের তাহারাত এবং দাওয়াত ও তাবলীগ ইত্যাদি কোন কাজটিকে মুস্তাহাব বলা যায়? অথচ এই সবগুলো কাজ, বিশেষ করে এই ফিতনা-ফাসাদের যুগে, মজবুত ইলম ছাড়া আঞ্জাম দেওয়া সম্ভব নয়। আপনি যদি আকাইদ সংরক্ষণ, কর্ম ও চরিত্রের সংশোধন এবং অন্তরের পরিশুদ্ধি, শুধু এই তিনটি বিষয়ে মনোযোগ নিবদ্ধ করেন তাহলেও দেখতে পাবেন একাজগুলোর জন্য আপনার কী পরিমাণ ইলম অর্জনের প্রয়োজন।

مقدمة الفرض فرض  এই নীতি অনুযায়ী আপনার জন্য ইলমের এই মাকাম অর্জন করাও ফরজ। ইলম অন্বেষণের প্রথম পর্বে যদি আপনি এই মাকাম অর্জন না করে থাকেন তবে এখন সচেষ্ট হওয়া আপনার দায়িত্ব।

৩. দরসী মুতালাআর উদ্দেশ্যে শুধু কিতাব হল করা!

উপরোক্ত ভুল ধারণার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি এই দাঁড়াবে যে, দুতিন বছর কোনো কিতাব পড়ানোর পর দরসের প্রস্তুতির জন্যও আর সেই কিতাব মুতালাআ করার প্রয়োজনহবে না। এবার ভাবুন, যে মুতাআলাকে দরসী প্রয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করে সে যখন দরসী মুতালাআ থেকেও নিষ্কৃতি পাবে তখন ইলমী দুনিয়ার সঙ্গে তার সম্পর্কের আর কী সূত্র বাকী থাকবে?

বস্তুত দরসী মুতালাআরও অনেকগুলো পর্যায় রয়েছে। যথা :

১. কিতাব হল করা।

২. কিতাবের নির্দিষ্ট ভাষা ও উপস্থাপনা থেকে মুক্ত হয়ে অধিত অধ্যায়টি নিজের ভাষায় ও সহজ উপস্থাপনায় পেশ করার যোগ্যতা অর্জন করা, যাতে তালিবে ইলমদেরকে কাওয়াইদ ও মাসাইল কণ্ঠস্থ করানোর কৌশল আয়ত্বে এসে যায়। এই মুতালাআ হবে চোখ বন্ধ করে।

৩. কুরআন, হাদীস ও আরবী সাহিত্যিকদের ব্যবহার থেকে মাসআলাটির অনেক উদাহরণ আহরণ করা, যাতে ভালোভাবে এ মাসআলার অনুশীলনী করানো যায়।

৪. যেসব ক্ষেত্রে মুসান্নিফের ভুল হয়েছে সে সম্পর্কে প্রশান্তিদায়ক তাহকীক জানা থাকা।

৫. কিতাবের ভালো কোনো শাস্ত্রীয় শরাহ থাকলে তা অধ্যয়ন করা।

৬. প্রচলিত নোট বই ও শরহের বইগুলোতে যেসব হাস্যকর ভুলভ্রান্তি লক্ষ করা যায় এবং যা এসব নোট বইয়ের দৌলতে যা তালিবে ইলমদের মধ্যেও অনুপ্রবেশ করে সেই ভুলভ্রান্তিগুলো চিহ্নিত করা।

৭. দরসাধীন কিতাবের কাওয়াইদ ও মাসাইলের জন্য উপরের বিভিন্ন কিতাব ও শরাহ মুতাআলা করা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যে উস্তাদ চার পাঁচ বছর যাবৎ কুদূরীপড়াচ্ছেন তিনি যদি ষষ্ঠ বছর কুদূরীর মাসাইল হিদায়া, ফতহুল কাদীর, বিনায়া ইত্যাদিতেও অধ্যয়ন করেন তাহলে কোনো ক্ষতি হবে কি? হাঁ, ছাত্রদের সামনে তাদের যোগ্যতা ও প্রয়োজন অনুপাতেই তাকরীর হবে, কিন্তু নিজের ইলম ও তাহকীকের পরিধি বৃদ্ধি করার জন্য যত বেশি মুতাআলা করা হবে ততই উপকার, এতে ক্ষতির কোনো প্রশ্নই আসে না। বরং কুদূরীকানযকিতাবের উস্তাদগণকে মুফতাবিহীমত নির্ধারণ করার জন্য রাদ্দুল মুহতারইমদাদুল ফাতাওয়াইত্যাদি কিতাবও অধ্যয়ন করার প্রয়োজন হতে পারে। যে মাসাইল উরফআদাতেরউপর ভিত্তিশীল কিংবা যে মাসআলার অধীনে কোনো আধুনিক বিষয় আলোচনায় আসতে পারে সেগুলোর জন্য জাদীদ মাসাইলের কোনো ভালো কিতাব অধ্যয়ন করাও দরসী মুতালাআরই অন্তভুর্ক্ত।

এ ক্ষেত্রে এমন বলা যে, ‘সামান্য যা কিছু বলা হয় তা-ই ছাত্ররা আত্মস্থ করতে পারে না তাহলে এর চেয়ে বেশির প্রয়োজন কী’- ভিন্ন ভিন্ন দুইটি বিষয়কে গুলিয়ে ফেলা ছাড়া আর কিছুই নয়। কেননা, আমরা আলোচনা করছি অধিক অধ্যয়ন প্রসঙ্গে, অধিক তাকরীর প্রসঙ্গে নয়। খারেজী তাকরীর তো নয়ই, প্রয়োজনের অধিক তাকরীর করাও উচিত নয় তবে নিজের ইলমী তরক্কীর জন্য অধ্যয়নের পরিধি অবশ্যই বৃদ্ধি করতে হবে। নিজের মুতাআলা এবং ছাত্রদের সামনে তাকরীর-এই দুই বিষয় এক করে দেখা কোনো অবস্থাতেই ঠিক নয়।

মোটকথা, ইলম অন্বেষণের দ্বিতীয় পর্বে আপনি যদি দরসী মুতালাআও হক্ক আদায় করে এবং তার পর্যায়গুলোর প্রতি লক্ষ রেখে জারি রাখেন তাহলে ইনশাআল্লাহ ইলম ও আমলে তরক্কী হতে থাকবে।

৪. আমাদের কি এত মুতালাআর যোগ্যতা আছে?

একটি অর্থহীন মানসিকতা। এ মানসিকতা তালিবে ইলমকে তার তলবে ইলমের দ্বিতীয় পর্বে মর্মান্তিকভাবে বঞ্চিত

করে। তালিবে ইলমের যোগ্যতা যতই কম হোক, তারপরও গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান অনেক কিতাব তার জন্য বিদ্যমান রয়েছে, কিন্তু অমনোযোগিতা ও উদাসীনতা এগুলো থেকেও তালিবে ইলমদেরকে বঞ্চিত রাখে। বলুন তো মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ.-এর মাআরিফুল কুরআনঅধ্যয়নের জন্য কত যোগ্যতা প্রয়োজন? ‘তাফসীরে উসমানীবোঝার জন্য কি অনেক যোগ্যতা দরকার? তাফসীরে ইবনে কাসীরের কথা নয় বাদই দিলাম। এরপর রিয়াযুস সালেহীন’ ‘আততারগীব ওয়াত তারহীব’ ‘আল মুহাযযাব মিন ইহয়াই উলূমিদ্দীনএবং আলআযকারইমাম নববী ইত্যাদি কিতাব অধ্যয়ন করার জন্য তো মুখতাসারুল মাআনী ও শরহে জামী বোঝার মতো যোগ্যতাও প্রয়োজন নেই। অথচ উপরোক্ত কিতাবগুলোতে রয়েছে একজন তালিবে হকের জন্য রূহ ও কলব এবং আকল ও দিমাগের মুকাম্মাল গিযা ও দাওয়া। কিন্তু কেউ যদি এগুলোর দিকে ভ্রূক্ষেপই না করে তাহলে আর কীভাবে হবে!

হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ.-এর হায়াতুল মুসলিমীন, কসদুস সাবীল, আদাবুল মুআশারা, জাযাউল আমাল, আততাশাররুফ বিমারিফাতি আহাদীসিত তাসাওউফ এবং এ ধরনের আরও অনেক রিসালা ও তার অনুদিত মাওয়ায়েজ ইত্যাদিতে কি এমন কোনো জটিলতা রয়েছে যে, স্বল্প যোগ্যতার অজুহাতে সেগুলো থেকে বঞ্চিত থাকতে হবে?

মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানভী রাহ. মাওলানা মুহাম্মাদ তক্বী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম, হযরত মাওলানা মনযুর নুমানী রাহ. প্রমুখের রচনাবলি তো পানির চেয়েও সহজ। কোনো তালিবে ইলম যদি এই তিন ব্যক্তিত্বের রচনাবলি মনোযোগের সঙ্গে অধ্যয়ন করে এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে বারবার পড়ে তবে নিঃসন্দেহে বলা যায় এগুলো তার ইলম বৃদ্ধি এবং ঈমান-আমলের তরক্কীর জন্য অত্যন্ত সহায়ক হবে।

৫. অধিক পরিমাণে মুতাআলা শুধু তারাই করবেন যারা পথ-নির্দেশক পর্যায়ের ব্যক্তিত্ব, মানুষ যাদের শরণাপন্ন হয়ে থাকে। আমাদেরকে কেইবা মাসআলা জিজ্ঞেস করবে আর আমাদের কাছে কেইবা সমস্যার সমাধান নিতে আসবে? অতএব আমাদের অধিক মুতাআলার প্রয়োজন কী?

এই ধারণার বশবর্তী ভাইয়েরা যেন এ কারণে উদ্বিগ্ন যে, এত ইলম দিয়ে তারা করবেন কী? এই ধারণা এবং এই উদ্বিগ্নতা যে নিতান্তই অমূলক ও কাল্পনিক তা বলাই বাহুল্য। সঙ্গে সঙ্গে তা অত্যন্ত দুঃখজনকও বটে। কেননা এই ধারণার পিছনে রয়েছে একটি মারাত্মক আত্মিক ব্যাধি- কিবর, উজব। উঁচুম্মন্যতা ও হীনম্মন্যতা দুটোই কিবর’-বৃক্ষের স্বতন্ত্র দুই শাখা। ভেবে দেখুন, মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী কতটা বক্র হলে মানুষ ইলম অন্বেষণের মতো নেক আমলকে, যা সব সময় কাম্য, ‘শায়খ বনারসঙ্গে যুক্ত করতে পারে। বলাবাহুল্য যে, ইলম সর্বপ্রথম নিজের জন্যই অন্বেষণ করতে হয়। নিজের কর্ম ও চরিত্র সংশোধন করার জন্য, ঈমান ও আকীদা বিশুদ্ধ করার জন্য, ইলমের মাকাম ও তার আব্ররক্ষার জন্যই ইলমের প্রয়োজন। এ পরিমাণ ইলম আগে অর্জন করুন এরপর আপনার ওই উদ্বিগ্নতা দূর করার চিন্তা করা যাবে, যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে।

যদি আমার এই বন্ধুরা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর ইলম অন্বেষণের ওই ঘটনাটি স্মরণ করতেন তাহলে তাদের এই ভুল ধারণার অবসান ঘটত। ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের সময় আমি ছিলাম একজন কিশোর।

আমি একজন আনসারী তরুণকে বললাম, ‘চল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বড় বড় সাহাবীদের নিকটে গিয়ে আমরা ইলম অর্জন করি। তাঁদের অনেকেই এখনো জীবিত আছেন।সে বলল, হে ইবনে আব্বাস, তোমার প্রতি আমার আশ্চর্য হচ্ছে! এত বড় বড় সাহাবী বিদ্যমান থাকতে লোকেরা তোমার শরণাপন্ন হবে কেন! ইবনে আব্বাস রা. বলেন, একথা বলে সে ঘরে বসে রইল আর আমি সাহাবীদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ইলম অন্বেষণ করতে লাগলাম। এমন হত যে, আমি একজন সাহাবীর নিকটে গেলাম, তিনি তখন বিশ্রাম করছেন। আমি তাকে জাগ্রত করা সমীচীন মনে করতাম না; বরং তিনি বিশ্রাম শেষে ঘর থেকে বের হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতাম। এই অপেক্ষার সময় চারদিকের ধুলাবালি বাতাসে উড়ে এসে আমার চেহারায় পড়ত। কাপড়-চোপড় হয়ে যেত ধুলিমলিন। এভাবেই আমি ইলম অন্বেষণ করেছি। শেষে যখন সেই আনসারী আমাকে দেখত যে, আমার চতুর্পার্শ্বে লোকেরা সমবেত হয়েছে এবং বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করছে তখন সে বলত

هذا الفتى كان أعقل مني

এই যুবক আমার চেয়ে বুদ্ধিমান ছিল।’ -আলমুস্তাদরাক, হাকিম ১/১৯৪, জামিউ বয়ানিল ইলম ১/১০৬, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১/৮৫

ইবনে আব্বাস রা. থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন

إن كنت لأسأل عن الأمر الواحد ثلاثين من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم.

আমি এক বিষয়ে তিরিশ জন সাহাবীকেও জিজ্ঞাসা করতাম।’ -সিয়ারু আলামিন নুযালা ৪/৪৪৭

ইবনুল আদীম তারীখে হালাবগ্রন্থে নিযামুল মূলক-এর তরজমায় হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. সম্পর্কে বর্ণনা করেন যে, শায়খ হয়ে যাওয়ার পরও আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর ইলমের প্রতি গভীর অভিনিবেশ দেখে এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল

كم تكسب العلم

আর কত অর্জন করবেন? তিনি বললেন

إذا نشطت فهو لذتي وإذا اغتممت فهو سلوتى

উদ্যমের মুহূর্তে ইলমই আমার আনন্দ জোগায়, আর পেরেশানীর সময় সেই আমাকে সান্ত্বনা দেয়। -সাফাহাত মিন সাবরিল উলামা, শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ পৃ. ১১৩

আমাদের মধ্যে যদি নসীহত গ্রহণের সামান্য বুদ্ধি ও প্রেরণা বিদ্যমান থাকে তাহলে হিবরুল উম্মাহরজীবন থেকে গ্রহণ করার মতো অনেক কিছু রয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সাহাবায়ে কেরাম ও তাদের নেককার নায়েবদের পদচিহ্ন  অনুসরণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

৬. সহজ জিনিস পড়ার প্রয়োজন কী, কিংবা দ্বীন ও শরীয়তের মাসাদিরে আসলিয়্যাহ পড়ার প্রয়োজন কী, শুধু মাসাইল জেনে নেওয়াই তো আমাদের জন্য যথেষ্ট।

এই ভ্রান্ত ধারণার ফলাফল এই হয় যে, আমাদের মতো নাকেস তালিবে ইলমের কুরআন কারীম, হাদীস শরীফ এবং সীরাত অধ্যয়নের প্রেরণা নিতান্ত দুর্বল হয়ে থাকে। যা নিঃসন্দেহে অনেক বড় মাহরূমী।

উপরোক্ত ধারণা সৃষ্টি হওয়ার পিছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। তাই কারণ চিহ্নিত করার পরিবর্তে শুধু এটুকু জেনে নেওয়াই যথেষ্ট যে, এটা একটা ভ্রান্ত ধারণা। বস্তুত কুরআন-হাদীস ও সীরাত অধ্যয়নের উদ্দেশ্য কেবল দলীল জানা নয়- এ তো এ অধ্যয়নের একটি মাত্র উদ্দেশ্য, এ অধ্যয়নের গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ও উপকারিতা হল, ঈমান তাযা করা, অন্তরে আল্লাহর মহব্বত ও তাওয়াক্কুল সৃষ্টি করা, ভয় ও আশা, আল্লাহ নিবেদন ও চরিত্রের শুদ্ধতা ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য অর্জন করা, রূহকে শক্তিশালী করা, চিন্তার বিশুদ্ধতা ও সমুচ্চতা অর্জন করা, চরিত্রের পবিত্রতা ও অন্তরের পরিশুদ্ধি অর্জন করা এবং আল্লাহর স্মরণ ও আল্লাহর আনুগত্যের বিষয়ে নিজেকে উদ্যমী বানানো ইত্যাদি।

বলা বাহুল্য যে, এই বৈশিষ্ট্যগুলো অর্জনের জন্য চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে কুরআন মজীদ তেলাওয়াত, হাদীস শরীফ ও সীরাতে পাক অধ্যয়ন এবং সাহাবায়ে কেরামের জীবনী পাঠ হল অত্যন্ত ফলদায়ক মাধ্যম। বরং মুমিন হৃদয়ের সবচেয়ে বড় গিযা হল চিন্তাভাবনার সঙ্গে কুরআন অধ্যয়ন এবং আল্লাহ তাআলার যিকর।

এজন্য এখন থেকেই আমাদেরকে এই ভুল ধারণা দূর করতে হবে যে, শুধু কঠিন বিষয়ই পড়া হয় কিংবা পাঠ ও অধ্যয়নের একমাত্র উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন। তাই যেখানে জ্ঞান-অর্জনের প্রয়োজন থাকে না সেখানে অধ্যয়নেরও প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়। মনে রাখতে হবে যে, প্রত্যেক প্রয়োজনীয় বিষয়ই পড়তে হয়। জরুরি বিষয় যদি সহজ হয় তাহলে তা অধিক গুরুত্বের সঙ্গে এবং বারবার পড়তে হয়। তদ্রূপ অধ্যয়নের একমাত্র উদ্দেশ্য জ্ঞানবৃদ্ধি করা নয়; বরং ঈমান ও আমলের উন্নতি এবং হৃদয় ও আত্মার খোরাক জোগাবার জন্যও অনেক কিছু পড়তে হয়। আর সেই অবশ্যপাঠ্য বিষয়গুলোর মধ্যে সর্বশীর্ষে হল আল্লাহর কালাম, এরপর হাদীসে রাসূল ও সীরাতে রাসূল। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে আহলে দিল বুযুর্গানের জীবনী, মালফুযাত, মাকতুবাত।

মোটকথা, আপনি যদি দরসী মুতালাআর সঙ্গে, যার পরিচয় উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, এই শেষোক্ত ধরনের মুতাআলাও শামিল করেন তবে ইলম অন্বেষণের দ্বিতীয় পর্বকে, যার বৈশিষ্ট্যই হয়ে দাঁড়িয়েছে সময়ের অপচয়, বরবাদী থেকে রক্ষা করে ফলদায়ক বানাতে পারবেন। তখন দরসী জিম্মাদারী এবং অন্যান্য দায়িত্ব কম হলেও সময় ব্যয় করার মতো কাজ না পাওয়ার অভিযোগ আর থাকবে না এবং সময় কাটানোর জন্য গাফলতের নিদ্রা, অসার গল্প-গুজব, পরিস্থিতি সম্পর্কে অর্থহীন পর্যালোচনা এবং বিভিন্ন ব্যক্তিত্বদের বিষয়ে নিন্দা-সমালোচনা ইত্যাদি ধ্বংসাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ারও প্রয়োজন হবে না।

আকাবিরের আরও কিছু পয়গাম

চলতি শিক্ষাবর্ষের সমাপ্তিলগ্নে আকাবিরের আরও কিছু পয়গাম উল্লেখ করার মতো রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে সম্ভবত তেরোটি পয়গাম আমি লিখেছিলাম কোনো দোস্তের অনুরোধে, যা আলকাউসার, সংখ্যা রমযান-শাওয়াল ১৪২৬ হি. (মোতাবেক অক্টোবর-নভেম্বর ২০০৫ ইং) পৃ. ৫১-৫৪ তে প্রকাশিত হয়েছিল। ওই আলোচনাও একবার পড়ে নেওয়া যেতে পারে।

তালিবে ইলমগণ ছুটির দিনগুলো কীভাবে কাটাবে

এ বিষয়েও আকাবিরের অনেক নির্দেশনা রয়েছে, যার সারাংশ আলকাউসার সংখ্যা শাবান ১৪২৬ হি. (মোতাবেক সেপ্টেম্বর ০৫) উল্লেখ করেছিলাম। ওই আলোচনাও পড়ে নেওয়া ফলদায়ক হবে ইনশাআল্লাহ।

তাখাসসুস-এর উদ্দেশ্য

দরসে নেযামীর নির্ধারিত পড়াশোনা সমাপ্ত করার পর আজকাল আমাদের তালিবে ইলম ভাইদেরকে দেখা যায়, তারা তাখাসসুসশ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন, তাদের ভাষায় এর নাম হল তাখাসসুস করা। অনেকে বলেন, ‘তাখাসসুস পড়া। এখান থেকেই বোঝা যায়, আজকাল তাখাসসুস বিষয়টি একটি রেওয়াজে পরিণত হতে চলেছে। অথচ তাখাসসুসের সূচনা হয়েছিল নামমাত্র রেওয়াজী পড়াশোনার ধারা থেকে তালিবে ইলমদেরকে মুক্ত করার উদ্দেশ্য নিয়ে।

তাখাসসুসের বিভাগগুলো কখন, কাদের মাধ্যমে এবং কী লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আরম্ভ হয়েছিল, পাক-ভারত-বাংলা অঞ্চলে তাখাসসুসের উৎপত্তি ও বিকাশ কীভাবে হল, বর্তমানে এই উদ্যোগ কেন ফলদায়ক হচ্ছে না এবং এর প্রতিকার কীভাবে হতে পারে এ সম্পর্কে একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধ দরকার। আল্লাহ যদি বাঁচিয়ে রাখেন এবং তাওফীক দান করেন তাহলে এ বিষয়ে লিখব ইনশাআল্লাহ।

আপাতত যে কথা বলতে চাই তা এই যে, ‘তাখাসসুস’-এর উদ্দেশ্যে হল বিশেষ কোনো বিষয়ে বিশেজ্ঞতা অর্জন করা। এ উদ্দেশ্যে সফল হওয়ার জন্য আগ্রহী তালিবে ইলমের মাঝে পূর্ণ কিতাবী ইসতিদাদ বিদ্যমান থাকা জরুরি। এর সঙ্গে তাফানী ফিল ইলমইহতিরাক লিলইলম’-এর মেজাজও থাকতে হবে। তাকওয়া ও ইখলাস যা সকল দ্বীনী কাজে জরুরি, তাখাসসুসের জন্য তা অপরিহার্য বিশেষভাবে। তাখাসসুসঅসম্পূর্ণ কিতাবী ইসতিদাদ পূর্ণ করার জন্যও নয়, কিংবা বিশেষ কোনো উপাধী অর্জনের জন্যও নয়। তাখাসসুসের নিসাব ও পাঠদান প্রক্রিয়ায় এমন কিছু অন্তর্ভুক্ত নেই যা তালিবে ইলমের কিতাবী ইসতিদাদ তৈরি করতে পারে। বরং এখানে সকল কর্মসূচী এমনভাবে বিন্যস্ত যা কিতাবী ইসতিদাদ সম্পন্ন তালিবে ইলমের মাঝে ফন্নী ইসতিদাদ তৈরি করতে সহায়ক হয়। যাতে সঠিক পন্থায় উস্তাদের তত্ত্বাবধানে কাজ অব্যাহত রাখলে ধীরে ধীরে ফন্নী ইখতিসাস অর্থাৎ বিশেষজ্ঞতা ও পারদর্শিতা হাসিল হয়।

আর উপাধী সম্পর্কে যে কথা মনে রাখা

উচিত তা এই যে, ‘মুহাদ্দিস’, ‘মুফতী’, ‘ফকীহমুফাসসিরএই উপাধীগুলোর প্রত্যেকটিই হল শরয়ী উপাধী, যার জন্য বিশেষ মানদণ্ড রয়েছে। সেই নির্ধারিত মানদণ্ডের সঙ্গেই এই উপাধীগুলোর সম্পর্ক, এক বছর বা দুই বছর মেয়াদী কোনো নিসাব স¤পন্ন করার সঙ্গে নয়। এই শরয়ী উপাধীগুলোর যে মানদণ্ড রয়েছে তার মধ্যে একটি বিষয় এ-ও রয়েছে যে, যে উপাধী অর্জনের জন্য মেহনত করে এবং নিজের জন্য উপাধী ব্যবহার করে সে পয়লা দফাতেই এই উপাধীর অযোগ্য সাব্যস্ত হয়। এজন্য যে বন্ধু তাখাসসুসবিভাগে ভর্তি হতে চান তিনি নিজের বিবেচনায় নয়, তালীমী মুরব্বীর পরামর্শক্রমে ভর্তি হবেন এবং উপরোক্ত কথাগুলো স্মরণ রাখবেন।

সফর

মিশকাত বা দাওরায়ে হাদীসের পরে অনেক বন্ধু দেশের ভিতরে এবং বাইরে সফর করে থাকেন। সুযোগ সুবিধা থাকলে এটা ভালো। এই মুবারক সফর পরিভাষায় আররিহলা লিতালাবিল ইলমনামে পরিচিত। এর বিশেষ আদব ও নীতিমালা আদাবুল ইলমউলূমুল হাদীসের কিতাবসমূহে উল্লেখিত হয়েছে। আমরা যদি এই ইলমী সফরের পূর্বে এই সফরের আদব ও নীতিমালা জানা ও বোঝার চেষ্টা করি তাহলে তা অধিক ফলদায়ক হতে পারে।

সফর করে কোথায় যাব, কেন যাব, কার সাহচর্য গ্রহণ করব ইত্যাদি বিষয়ে সাধারণত আমাদের তালিবে ইলম ভাইরা চিন্তাভাবনা করেন না। অনেকের অবস্থা দৃষ্টে অনুমিত হয় যে, তাদের মানসিকতা হল, আগে যাই, পরে চিন্তা করা যাবে কী করব। যেন দেশের বাইরে পা রাখাটাই তাদের সর্বোচ্চ লক্ষ্য।

এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা প্রয়োজন। আপাতত শুধু এটুকু বলছি যে, সফরে আগ্রহী বন্ধুরা সফরের নিয়ত করার আগে কিংবা পরে নিজের তালীমী মুরুব্বী ও অভিজ্ঞ উস্তাদদের সঙ্গে পরামর্শ করবেন এবং নিজে নিজে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা থেকে বেঁচে থাকবেন। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।

 

 

advertisement