সদকায়ে ফিতরের পরিমাণ : কিছু কথা
সদকায়ে ফিতর সম্পর্কিত হাদীসগুলো পর্যালোচনা করলে এ বিষয়ে মোট পাঁচ প্রকার খাদ্যের বর্ণনা পাওয়া যায়। (১) যব (২) খেজুর (৩) পনির (৪) কিসমিস (৫) গম। এ পাঁচ প্রকারের মধ্যে যব, খেজুর, পনির ও কিসমিস দ্বারা সদকা ফিতর আদায় করতে চাইলে প্রত্যেকের জন্য এক ''সা'' দিতে হবে। কেজির হিসাবে যা তিন কেজি ১৮৩ গ্রাম। আর গম দ্বারা আদায় করতে চাইলে আধা ''সা'' দিতে হবে। কেজির হিসাবে ১ কেজি ৫৯১.৫ গ্রাম হয়। এটা হল ওজনের দিক দিয়ে তফাত। আর মূল্যের দিক থেকে তো পার্থক্য রয়েছেই। যেমন-
(ক) আজওয়া (উন্নতমানের) খেজুরের মূল্য ৮০০/- টাকা প্রতি কেজি হিসাবে এক ''সা'' (৩ কেজি ১৮৩ গ্রাম)-এর মূল্য হয় ২৫৪৬/- দুই হাজার পাঁচশত ছিচল্লিশ টাকা।
(খ) মধ্যম ধরনের খেজুর ২০০/- প্রতি কেজি হিসাবে এক ''সা'' (৩ কেজি ১৮৩ গ্রাম)-এর মূল্য ৬৩৭/- ছয়শত সাঁইত্রিশ টাকা।
(গ) কিসমিস প্রতি কেজি ১৮০/- টাকা হিসাবে এক ''সা'' (৩ কেজি ১৮৩ গ্রাম)-এর মূল্য ৫৭৩/- (পাঁচশত তিয়াত্তর) টাকা।
(ঘ) পনির প্রতি কেজি ৪০০ টাকা দরে ৩ কেজি ১৮৩ গ্রামের মূল্য ১২৭৩/- (এক হাজার দুই শত তিয়াত্তর) টাকা।
(ঙ) গম প্রতি কেজি ২৫ টাকা হিসাবে আধা ''সা'' (১ কেজি ৫৯১.৫ গ্রাম)-এর মূল্য ৪০ টাকা।
হাদীসে এ ৫টি দ্রব্যের যে কোনোটি দ্বারা ফিতরা আদায়ের সুযোগ দেওয়া হয়েছে যেন মুসলমানগণ নিজ নিজ সামর্থ্য ও সুবিধা অনুযায়ী এর যে কোনো ১টি দ্বারা তা আদায় করতে পারে। এখন লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, সকল শ্রেণীর লোক যদি সবচেয়ে নিম্ন মূল্য-মানের দ্রব্য দিয়েই নিয়মিত সদকা ফিতর আদায় করে তবে হাদীসে বর্ণিত অন্য চারটি দ্রব্যের হিসাবে ফিতরা আদায়ের উপর আমল করবে কে? আসলে এক্ষেত্রে হওয়া উচিত ছিল এমন যে, যে ব্যক্তি উন্নতমানের আজওয়া খেজুরের হিসাবে সদকা ফিতর আদায় করার সামর্থ্য রাখে সে তা দিয়েই আদায় করবে। যার সাধ্য পনিরের হিসাবে দেওয়ার সে তাই দিবে। এর চেয়ে কম আয়ের লোকেরা খেজুর বা কিসমিসের হিসাব গ্রহণ করতে পারে। আর যার জন্য এগুলোর হিসাবে দেওয়া কঠিন সে আদায় করবে গম দ্বারা। এটিই উত্তম নিয়ম। এ নিয়মই ছিল নবী, সাহাবা-তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনের স্বর্ণযুগে।
এ পর্যন্ত কোথাও দুর্বল সূত্রেও একটি প্রমাণ মেলেনি যে, স্বর্ণযুগের কোনো সময়ে সব শ্রেণীর সম্পদশালী সর্ব নিম্ন মূল্যের দ্রব্য দ্বারা সদকা ফিতর আদায় করেছেন।
এখানে এ সংক্রান্ত কিছু বরাত পেশ করা হচ্ছে।
হাদীস
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বোত্তম দান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ইরশাদ করেন—
أغلاها ثمنا وأنفسها عند أهلها
‘দাতার নিকট যা সর্বোৎকৃষ্ট এবং যার মূল্যমান সবচেয়ে বেশি’
—সহীহ বুখারী, কিতাবুল ইতক ৩/১৮৮, সহীহ মুসলিম, কিতাবুল ঈমান, বাব আফযালুল আমল ১/৬৯
সাহাবায়ে কেরাম-এর আমল
(ক) হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. বলেন—
كنا نخرج زكاة الفطر صاعا من طعام أو صاعا من شعير أو صاعا من ثمر أو صاعا من أقط أو صاعا من زبيب، وذلك من صاع النبي صلى الله عليه وسلم.
আমরা সদকা ফিতর আদায় করতাম এক ''সা'' খাদ্য দ্বারা অথবা এক ''সা'' যব অথবা এক ''সা'' খেজুর, কিংবা এক ''সা'' পনির বা এক ''সা'' কিসমিস দ্বারা। আর এক ''সা'' -এর ওজন ছিল নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ''সা'' অনুযায়ী। -মুআত্তা মালেক পৃ. ১২৪, আল ইসতিযকার, হাদীস নং ৫৮৯, ৯/৩৪৮
এ হাদীসে রাসূলের যুগে এবং সাহাবাদের আমলে সদকা ফিতর কোন কোন বস্তু দ্বারা আদায় করা হয় তার সুস্পষ্ট বর্ণনা রয়েছে।
(খ) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. সারা জীবন খেজুর দ্বারাই সদকা ফিতর আদায় করেছেন। তিনি মাত্র একবার যব দ্বারা আদায় করেছেন। -আল ইসতিযকার, হাদীস নং ৫৯০ ৯/৩৫৪
ইবনে কুদামা রা. আবু মিজলাযের বর্ণনা উল্লেখ করে বলেন, এ বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায় যে, সাহাবায়ে কেরাম অধিকাংশই যেহেতু খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করতেন তাই ইবনে উমর রা. সাহাবাদের তরীকা অবলম্বন করত: তিনিও সারা জীবন খেজুর দ্বারাই আদায় করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইবনে উমরের ভাষ্য হল—
إن أصحابي سلكوا طريقا وأنا أحب أن أسلكه
‘সাহাবীগণ যে পথে চলেছেন আমিও সে পথেই চলতে আগ্রহী।’
এবার দেখা যাক মাযহাবের ইমামগণ উত্তম সদকা ফিতর হিসেবে কোনটিকে গ্রহণ করেছেন।
উত্তম সদকা ফিতর
ইমাম শাফেয়ীর মতে উত্তম হল হাদীসে বর্ণিত বস্তুর মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্যের দ্রব্য দ্বারা সদকা দেওয়া। অন্য সকল ইমামের মতও এমনই।
ইমাম মালিক রহ.-এর নিকটে খেজুরের মধ্যে সবচেয়ে উন্নত খেজুর ''আজওয়া'' দেওয়া উত্তম। আজওয়া খেজুরের ন্যূনতম মূল্য ৮০০-১০০০ টাকা প্রতি কেজি।
আর ইমাম আহমদ রহ.-এর নিকট সাহাবায়ে কেরামের ইত্তিবা হিসাবে খেজুর দ্বারা ফিতরা আদায় করা ভালো। -আল মুগনী ৪/২১৯, আওজাযুল মাসালিক ৬/১২৮
ইমাম আবু হানীফা রহ.-এর নিকটেও অধিক মূল্যের দ্রব্য দ্বারা ফিতরা আদায় করা ভালো। অর্থাৎ যা দ্বারা আদায় করলে গরীবের বেশি উপকার হয় সেটাই উত্তম ফিতরা।
সাহাবায়ে কেরামের যুগে আধা সা গমের মূল্য এক সা খেজুর সমপরিমাণ ছিল
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে মদীনাতে গমের ফলন ছিল না বললেই চলে। পরবর্তীতে হযরত মুআবিয়া রা.-এর যুগে ফলন বৃদ্ধি পেলেও মূল্য ছিল খুব বেশি। সদকা ফিতরের জন্য নির্ধারিত খাদ্যসমূহের মধ্যে গমের মূল্য ছিল সবচেয়ে বেশি। একাধিক বর্ণনায় এসেছে যে, সেকালে আধা ''সা'' গমের মূল্য এক সা খেজুরের সমপরিমাণ ছিল।
فلما كان زمن معاوية وكثرت الحنطة جعل نصف صاع منها مثل صاع من تلك الأشياء.
হযরত মুআবিয়া রা.-এর যুগে গমের ফলন বৃদ্ধি পেলে আধা ''সা'' গমকে সদকা ফিতরের অন্যান্য খাদ্য দ্রব্যের এক ''সা''র মতো গণ্য করা হত। -আল ইসতিযকার ৯/৩৫৫
ইবনুল মুনযির বলেন,
فلما كثر في زمن الصحابة زأوا أن نصف صاع منه يقوم مقام صاع من شعير.
সাহাবীদের যুগে যখন গম সহজলভ্য হল তখন তারা আধা ''সা'' গমকে এক ''সা'' যবের সমতুল্য গণ্য করলেন। -ফাতহুল মুলহিল ৩/১৫, আওজাযুল মাসালিক ৬/১৩
তাহলে বুঝা গেল যে, হযরত মুআবিয়া রা.-এর যুগে গম দ্বারা সদকা ফিতর আদায়ের প্রচলন বেড়েছিল। এর কারণ হল যে, তখন গমই ছিল সর্বোৎকৃষ্ট ও সর্বোচ্চ মূল্যমানের খাদ্য। এ সময় হযরত ইবনে উমর সাহাবাদের অনুকরণে খেজুর দ্বারাই সদকা ফিতর আদায় করতেন। তখন তাঁকে আবু মিজলায রহ. বললেন—
إن الله قد أوسع والبر أفضل من التمر.
‘আল্লাহ তাআলা তো এখন সামর্থ্য দিয়েছেন। আর গম খেজুরের চেয়ে অধিক উত্তম।
অর্থাৎ আপনার সামর্থ্য রয়েছে বেশি মূল্যের বস্তু সদকা করার। তবুও কেন খেজুর দ্বারা তা আদায় করছেন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমি সাহাবাদের অনুকরণে এমন করছি।
যাক আমাদের কথা ছিল, সাহাবায়ে কেরাম গম দ্বারা এজন্যই সদকা ফিতর আদায় করতেন যে, এর মূল্য সবচেয়ে বেশি ছিল। হাদীসে পাঁচ প্রকারের খাদ্য দ্রব্যের মধ্যে বর্তমানে গমের মূল্য সবচেয়ে কম। তাহলে এ যুগে সর্ব শ্রেণীর জন্য এমনকি সম্পদশালীদের জন্যও শুধুই গম বা তার মূল্য দ্বারা সদকা ফিতর আদায় করা কী করে সমীচীন হতে পারে?
বড়ই আশ্চর্য! পুরো দেশের সব শ্রেণীর লোক বছর বছর ধরে সর্বনিম্ন মূল্যের হিসেবে ফিতরা আদায় করে আসছে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সকলেই ফিতরা দিচ্ছে একই হিসাবে জনপ্রতি ৪০/৪৫ টাকা করে। মনে হয় সকলে ভুলেই গেছে যে, গম হচ্ছে ফিতরার ৫টি দ্রব্যের একটি (যা বর্তমানে সর্বনিম্ন মূল্যের)।
সুতরাং আমরা এদেশের ফিতরা আদায়কারী ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি তারা যেন যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী হাদীসে বর্ণিত দ্রব্যগুলোর মধ্যে তুলনামূলক উচ্চমূল্যের দ্রব্যটির হিসাবে ফিতরা আদায় করেন। পনির, কিসমিস, খেজুর কোনোটির হিসাব যেন বাদ না পড়ে। ধনি শ্রেণীর মুসলিম ভাইদের জন্য পনির বা কিসমিসের হিসাবে ফিতরা আদায় করা কোনো সমস্যাই নয়। যেখানে রমযানে ইফতার পার্টির নামে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়, ঈদ শপিং করা হয় অঢেল টাকার, সেখানে কয়েক হাজার টাকার ফিতরা তো কোনো হিসাবেই পড়ে না। যদি এমনটি করা হয় তবে যেমনিভাবে পুরো হাদীসের উপর মুসলমানদের আমল প্রতিষ্ঠিত হবে এবং একটি হারিয়ে যাওয়া সুন্নত যিন্দা করা হবে, তেমনি এ পদ্ধতি দারিদ্র্যবিমোচনে অনেক অবদান রাখবে। গরীব-দুঃখীগণের মুখেও হাসি ফুটে উঠবে ঈদের পবিত্র দিনে।
আরেকটি আবেদন ইসলামিক ফাউন্ডেশন, দেশের সম্মানিত মুফতীগণ, মাশায়েখ হযরত ও দারুল ইফতাগুলোর কাছে, তাঁরা যেন সদকাতুল ফিতর এর পরিমাণ ঘোষণা দেওয়ার সময় হাদীসে বর্ণিত সকল দ্রব্যের হিসাবেই পৃথক পৃথকভাবে তা বলে দেন এবং মানুষকে যথাসম্ভব উচ্চমূল্যের ফেতরা আদায়ের প্রতি উৎসাহিত করেন। আল্লাহ আআলা আমাদের তাওফীক দিন।