চেলসী ক্লিন্টনের কুরআন অধ্যয়ন ও তার রহস্য
মিস্টার ক্লিন্টন যখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখনকার কথা। মিসেস হিলারী ক্লিন্টন একবার তার মেয়ে চেলসীকে নিয়ে পাকিস্তান সফর করেছিলেন। পাকিস্তান সফরকালে চেলসির গলায় কিতাবের মতো কিছু একটা ঝুলানো ছিল। সাংবাদিকরা তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আপনার গলায় ওটা কী? চেলসী উত্তরে বলেছিল, মুসলমানদের পবিত্র গ্রন্থ আলকুরআন। মিসেস ক্লিনটন একবার বাংলাদেশও সফর করেছিলেন। তখন তার সাথে চেলসী না থাকলেও তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তার মেয়ে চেলসী মুসলমানদের মহাগ্রন্থ আল কুরআন নিয়ে গবেষণা করছে।
চেলসী ও হিলারী ক্লিনটন পৃথিবীর বর্তমান পরাশক্তি আমেরিকার প্রেসিডেন্টের মেয়ে ও ফাস্ট লেডি হওয়ার সুবাদে ভি.ভি.আই.পি হিসাবে তখনকার ইত্তেফাকসহ দেশের বিভিন্ন দৈনিকে খবরগুলো ফলাও করে ছাপা হয়েছিল। তখন এই কুরআন অধ্যয়নের সূত্র বা রহস্য কিন্তু আমরা কেউ জানতে সক্ষম হইনি।
ঘটনার কয়েক বছর পর দিল্লী থেকে হযরত শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ.-এর খান্দানের এক বুযুর্গ হযরত মাওলানা কলিম সিদ্দীকী ঢাকায় তাশরীফ আনয়ন করেন। ঢাকা সফরকালে তাঁর ও তাঁর মিশনের সাথে আমার পরিচিতি হওয়ার সৌভাগ্য হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের ইসলামী বিশ্বকোষ প্রকল্পের সাবেক পরিচালক বন্ধুবর অধ্যাপক মাওলানা ওমর আলী সাহেবসহ আমরা তার সাথে অনেক সময় অতিবাহিত করারও সুযোগ পাই। আমরা তাকে নিয়ে বাংলাদেশের তাবলীগ জামাতের প্রধান মারকায কাকরাইল মসজিদেও গমন করি। তার মিশন সম্পর্কে কাকরাইলের মুরব্বীদের সাথে তাঁর মতবিনিময় হয়। তাঁর প্রধান মিশন হচ্ছে-বিশ্বের নামকরা কিছু অমুসলিমের মধ্যে ইসলামের বীজ বপন করা, সাথে ভারতবর্ষের বিভক্তির আগে ও পরে বিভিন্ন রায়ট ও দাঙ্গা-হাঙ্গামার সময় যে সমস্ত মুসলিম পরিবার মুরতাদ হয়ে গিয়েছিল তাদেরকে দাওয়াতের মাধ্যমে পুনরায় ইসলামে ফিরিয়ে আনা। কাকরাইলের ওই মতবিনিময় অনুষ্ঠানে ব্রিগেডিয়ার মুশাহেদ চৌধুরী সাহেবের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, হরিয়ানা ও পাঞ্জাব রাজ্যে তাঁর বেশি কাজ করতে হয়। সেখানে এধরনের মুরতাদের সংখ্যা অনেক বেশি। এ পর্যন্ত তাঁর হাতে প্রায় আড়াই লক্ষ মুরতাদ পুনরায় ইসলাম ধর্মে দীক্ষা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। কেয়ামতসম ওই সমস্ত রায়টের সময় বহু মুসলমান ভয়ে পালাবার সময় তাদের যুবতী মেয়েকে কোনো হিন্দু অথবা শিখ পরিবারে রেখে কোনো মতে জান নিয়ে পালিয়ে গেছে। আর ওই মুসলিম যুবতীর সাথে হিন্দু বা শিখের বিয়ে ও ঘর-সংসার করার মাধ্যমে যে সমস্ত সন্তান হচ্ছে তাদের আবার মুসলমান করার এক মহাপরিকল্পনা নিয়েই তার ভারতীয় দাওয়াতী মিশন চলছে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে তাঁর আওতায় সরকার অনুমোদিত অনেকগুলো প্রাইমারী স্কুলও রয়েছে। “আরমগানে শাহ ওয়ালি উল্লাহ” নামে তাঁর একটি মাসিক দাওয়াতী পত্রিকাও রয়েছে। যার অর্থ-শাহ ওয়ালি উল্লাহর স্বপ্ন বা ইচ্ছা। হযরত সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. প্রথমে তাঁকে খিলাফত দান করেন। পরে হযরত প্রতাবগাড়ী রাহ. ও শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা যাকারিয়া রহ.ও তাঁকে খিলাফত দানে ভূষিত করেন।
কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাকে বললেন, একবার মক্কা শরীফের জেদ্দা শহরে তাঁর এক বন্ধুর বাসায় দাওয়াত ছিল। সেখানে একজন ভারতীয় মুসলিম ডাক্তারের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। যিনি আমেরিকায় ডাক্তারী পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি বললেন, তাঁর সাথে প্রথম পরিচয় পর্বেই আমি আবেগতাড়িত হয়ে এই বলে কিছু বকা-ঝকা করে ফেললাম যে, ‘কেয়া আপ ছেরেফ দুনিয়া কামানে-কেলিয়ে আমরিকা রহতে হেঁ? আপকো আওর কুছ কাম নেহি? আপকো খোদানে কেয়া ইসিলিয়ে পয়দা কিয়ে হেঁ? ইত্যাদি ইত্যাদি।’ পরে ঐ বাসা থেকে চলে আসার পর আমার অনুশোচনা হল যে, প্রথম পরিচয়ে একজন মুসলমানের সাথে আমার এই ব্যবহারতো সৌজন্যের পরিপন্থী হয়েছে, তদুপরি সুন্নতেরও খেলাফ হয়েছে। তাই লোকটির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য ওই বাসায় আমি ফোন করলাম। আমার ওই বন্ধুর বাসা থেকে বলা হল, তিনি তো চলে গেছেন। মনে মনে আফসোস করলাম, খোদার কাছে লজ্জিত হয়ে ক্ষমাও চাইলাম। এর কিছুদিন পর ভারতে আমার কাছে আমেরিকা থেকে একটি পত্র এল যে, হযরত! আমি সেই ডাক্তার যাকে আপনি জেদ্দার এক বাসায় বকাঝকা করেছিলেন। আপনার বকা খাওয়ার পর আমি এখানে ডাক্তারী পেশা ছেড়ে দিয়েছি এবং বক্সিং শিখানোর একটি ট্রেনিং ক্যাম্প শুরু করেছি। বক্সিং করতে যেহেতু ফুলপ্যান্ট পরা থাকে, তাই গোনাহ থেকেও বেঁচে থাকা যায়। কিছুদিন পর আমার প্রশিক্ষণক্যাম্পে বিশ্ব হেভিওয়েট মুষ্টিযোদ্ধা চ্যাম্পিয়ন মিস্টার মাইক টাইসনকে প্রধান অতিথি করে নিয়ে আসি। এক পর্যায়ে আমি তাঁকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত দেই এবং তিনি তাঁর প্রায় চল্লিশজন সঙ্গী-সাথীসহ ইসলাম গ্রহণ করেন। কিছু আনুষ্ঠানিকতার কারণে সরকারীভাবে তাঁর ইসলাম গ্রহণের খবর প্রকাশ হতে আরো একমাস সময় লেগে যায়।
হযরত মাওলানা কলিম সিদ্দীকী সাহেব বলেন, আমি পত্রখানা পড়ে খুশিতে বাগবাগ হয়ে গেলাম এবং ডাক্তার সাহেবের জন্য অন্তরের গভীর থেকে দুআ করলাম। এরপর আমি অপেক্ষা করছিলাম যে, কখন মাইক্যাল টাইসনের মুসলমান হওয়ার খবরটা সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়। এমনি একদিন এক বন্ধু এসে খবর দিল, হযরত! এইমাত্র ভয়েস অফ আমেরিকা মাইক টাইসনের মুসলমান হওয়ার খবরটি প্রচার করেছে। আমি তখন বিবিসিটা ধরতে চেষ্টা করলাম। বিবিসি তার মুসলমান হওয়ার খবর প্রকাশ করার সাথে সাথে তার এক সুদীর্ঘ সাক্ষাৎকারও প্রচার করে। সাক্ষাৎকারে তিনি তাকে সমকামিতার অভিযোগে কারাগারে নিক্ষেপ করার ষড়যন্ত্রের কথাও উল্লেখ করেন। এসব ছিল তাঁর মুসলমান হওয়ার শাস্তিস্বরূপ বানোয়াট কেচ্ছাকাহিনী মাত্র।
কলিম সিদ্দীকী সাহেব আমাকে আরো বললেন, কিছুদিন পর আরো জানতে পারলাম যে, ডাক্তার সাহেবের মেয়ে যে স্কুলে পড়ালেখা করে সে স্কুলে প্রেসিডেন্টের মেয়ে চেলসীও পড়ালেখা করে। তবে সে এই মেয়ের একটু উপরের ক্লাশের ছাত্রী। মেয়েটি চিন্তা করল যে, আমার আব্বা এত বড় একটি কাজ করে ফেললেন, বিশ্ব হেভিওয়েট মুষ্টিযোদ্ধা চ্যাম্পিয়ন মাইক টাইসনকে মুসলমান বানানোর কৃতিত্ব অর্জন করলেন, দেখি আমি কিছু করতে পারি কি না? এই ভেবে ডাক্তার সাহেবের মেয়েটি স্কুল ছুটির সময় একটি ফুল নিয়ে চেলসীর গাড়ির কাছে চেলসীর জন্য অপেক্ষা করছিল। চেলসী এলে তাকে সে ফুলটি গিফট করল। চেলসী ফুল পেয়ে খুব খুশি হল এবং তাদের রীতি অনুযায়ী তাকে চুমু খেল ও আদর করল এবং বলল, তুমি আমার জন্য আরো ফুল আনবে কিন্তু। উল্লেখ্য যে, পাশ্চাত্যে ফুলের কদর অনেক। কেউ কাউকে ফুল গিফট করার অর্থও অনেক। মেয়েটি আরেক দিন ফুল নিয়ে উপস্থিত হলে সেদিনও তাকে চেলসী খুব আদর করল। এভাবে তাদের উভয়ের মধ্যে সখ্যতা ও বন্ধুত্বের সৃষ্টি হলে একদিন পরিকল্পিতভাবে মেয়েটি ফুল ছাড়াই উপস্থিত হল। আজ চেলসী তাকে ফুলবিহীন অবস্থায় দেখে খুব মর্মাহত হল এবং জিজ্ঞাসা করল তুমি ফুল আননি কেন? মেয়েটি বলল, আমি একজন ক্ষুদ্র মুসলিম পরিবারের মেয়ে আর তুমি হলে প্রেসিডেন্টের মেয়ে। আমার ক্ষুদ্র গিফট তোমার জন্য বেমানান নয় কি? চেলসী রাগতঃস্বরে বলল, কী যে তুমি বলছ? তুমি যাই আনবে, আমি তা সাদরে গ্রহণ করব। মেয়েটি বলল, প্রমিজ? চেলসী বলল, প্রমিজ। এবার মেয়েটি সব ঘটনা তার বাবা ডাক্তার সাহেবকে খুলে বলল এবং পরামর্শ চাইল যে, সে এখন কী করবে? প্রমিজ যখন করেছে, তখন আমি তাকে যাই দেইনা কেন সে তা সাদরে গ্রহণ করে নেবে অবশ্যই। ডাক্তার সাহেব মেয়েকে বললেন, এই নাও পবিত্র কুরআনের ইংরেজী তরজমাটা তাকে দিয়ে দাও।’ মেয়েটি স্কুল গেটে ছুটির সময় আজ আবার চেলসীর জন্য অপেক্ষা করছিল। চেলসী আসার পর তাকে গিফট হিসাবে পবিত্র কুরআনের ওই অনুবাদখানি দিল। চেলসী প্রমিজ রক্ষার্থে পবিত্র কুরআনখানাকে যথাযথ সম্মানের সাথেই গ্রহণ করল। আর তখন থেকেই চেলসী পবিত্র কুরআনের প্রতি ঝুঁকে পড়ল এবং তা অধ্যয়ন আরম্ভ করল।
আমি হযরত মাওলানা কলিম সিদ্দীকীর মুখে এত সব ঘটনা শোনার পর বুঝতে পারলাম যে, চেলসীর কুরআন নিয়ে চিন্তা ভাবনার পিছনে ডাক্তার সাহেবের এই মেয়ের ভূমিকাই কাজ করেছে। আর ওই মেয়ে ও তার বাবা ডাক্তার সাহেবের দাওয়াতী কাজে উদ্বুদ্ধ হওয়ার পিছনে কাজ করেছে সিদ্দীকী সাহেবের ওই বকাঝকা, যা তিনি ডাক্তার সাহেবকে জেদ্দা শহরে এক বন্ধুর বাসায় করেছিলেন।
মহান আল্লাহপাক কাকে কখন কীভাবে তাঁর দ্বীনের কাজে লাগাবেন তা শুধু তিনিই জানেন। দাওয়াতের জন্য প্রয়োজন প্রচুর হেকমতের, যা মেয়েটি অবলম্বন করেছিল। মহান আল্লাহপাক চেলসীকে ইসলামের নেয়ামত নসীব করুন। আমীন।