শাবান-রমযান ১৪২৮   ||   সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০০৭

বাইতুল্লাহর মুসাফির

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

পঁচিশ বছর আগে আমার নানী জীবিত ছিলেন, আজ পঁচিশ বছর পর এখনো আল্লাহর রহমতে আমার নানী জীবিত আছেন। প্রথমে নানীর কাছ থেকে বিদায় নিলাম, তারপর অন্যদের কাছ থেকে। সবার শেষে গিয়ে দাঁড়ালাম আম্মার সামনে। সে বিদায়ের দৃশ্য হলো বড় মর্মস্পর্শী। ঝর ঝর করে আম্মার চোখ থেকে অশ্রু ঝরলো। তবে সে অশ্রুর রহস্য বোঝার মত অনুভূতি আমার ছিলো। আমি বললাম, আম্মা, আল্লাহর ঘরের গিলাফ ধরে আমি দুআ করবো, আল্লাহ যেন আপনার স্বপ্ন পূর্ণ করেন। আম্মা শুধু বলতে পারলেন, আমার সালাম... তারপর কান্নায় এমন ভেঙ্গে পড়লেন যে, কথা শেষ করা সম্ভব হলো না। দরকারও ছিলো না। এখানে বলতে পারা এবং না বলতে পারা দুটোই সুন্দর, হৃদয় যদি সুন্দর হয় এবং হৃদয়ের মিনতি যদি আকাশের ঠিকানায় প্রেরিত হয়।

সফরের দুআ পড়ে ঘর থেকে রাস্তায় বের হলাম। যাবো পূর্ব দিকে, কিন্তু তাকালাম পশ্চিম দিকে, একশ গজ দূরে গত রাতে যেখানে ঘটেছিলো গায়বের লীলাখেলা। নিজের অজান্তেই সেদিকে এগিয়ে গেলাম। কিছুটা অবাক হয়ে আব্বাও সঙ্গে এলেন। আমার মনে তখন অন্যরকম এক ভাবের উদয় হলো। আমি আসমানের দিকে তাকিয়ে বললাম, এখানে রাতের আঁধারে যেভাবে রক্ষা করেছো, সফরে সবখানে রাতের আঁধারে এবং দিনের আলোতে সেভাবে রক্ষা করো হে আল্লাহ!

হঠাৎ নযরে পড়লো, একটু দূরে স্কুল ঘরের দেয়াল ঘেষে টুলে বসে সেই তিনজন ঢুলছেন। আমি তাদের কাছে গেলাম। সালাম দিয়ে বললাম, আমাকে চিনতে পেরেছেন? কাল রাত্রে আপনাদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। আমি আল্লাহর ঘরে রওয়ানা হয়েছি। আপনারা আমার অনেক উপকার করেছেন। আমার জন্য দুআ করবেন, আমিও আপনাদের জন্য দুআ করবো।

আমি জোর করে তাদের হাতে কিছু হাদিয়া গুঁজে দিলাম। আব্বা অবাক হয়ে একবার তাকান তাদের দিকে, একবার আমার দিকে। আমি আব্বাকে গত রাতের ঘটনা খুলে বললাম। এবার তিনি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তিনি ভেবেছিলেন, গত রাতে স্ত্রী-কন্যার কাছ থেকে আসতে আমার বিলম্ব হয়েছিলো।

পায়ে হেঁটে পশ্চিমের পথে রওয়ানা হলাম। এখন আমাদের ঘরের সামনে থেকেই গাড়ীতে ওঠা যায়, তখন নৌকা পার হয়ে কিল্লার বাজার পর্যন্ত পায়ে হেঁটে যেতে হতো, তখন মনে হয় আমরা সবল ছিলাম, এখন মনে হয় আমরা দুর্বল হয়ে পড়েছি। কিল্লার মোড়ে হযরত হাফেজ্জী হুযূরের বাড়ীতে দাদীর সঙ্গে দুআ নেয়ার জন্য দেখা করলাম। তিনি দুআ ও দাওয়া দুটোই দিলেন। বিমানবন্দরে ভ্রমণ কর দিতে হয়, লন্ডনের যাত্রীকেও, মক্কার যাত্রীকেও। আমার কাছে তার ব্যবস্থা ছিলো না এবং কীভাবে ব্যবস্থা হবে তাও জানা ছিলো না। শুধু ভাবছিলাম, আর অপেক্ষা করছিলাম। কথাটা কীভাবে যেন দাদীর কানে গেলো। তিনি খুশিমনে নিজের সঞ্চয় থেকে প্রয়োজনীয় টাকা বের করে আমাকে দিলেন। আজ দাদা ও দাদী দুজনেই শুয়ে আছেন নূরীয়ায় মসজিদের ছায়ায় পাশাপাশি দুটি কবরে। আমার আব্বাও শুয়ে আছেন সেখানে। আল্লাহ তাঁদের কবরকে ঠাণ্ডা রাখুন।

হযরত হাফেজ্জী হুযূর ফী আমানিল্লাহ বলে কিল্লার মোড় থেকে আমাদেরকে গাড়ীতে তুলে দিলেন, আর আব্বা বিমানবন্দর পর্যন্ত আমার সঙ্গে এলেন।

বিমানবন্দরগামী পিচঢালা প্রশস্ত পথ আমার পরিচিত পথ। কিন্তু আজ মনে হলো, পথ এবং পথের দুপাশের সব কিছু আমার জন্য নতুন। আমি নিজেই তো আজ নতুন! আমি তো এখন আল্লাহর ঘরের মেহমান! তাই আমার যাত্রাপথ এখন ফুলে ফুলে সুসজ্জিত! বর্ণে বর্ণে শুশোভিত!

আবার আল্লাহ গায়বি কুদরতে আমাদের রক্ষা করলেন। বিমানবন্দরে প্রবেশের মুখে চোখের পলকে ঘটে গেলো ঘটনাটা। প্রথমে আমরা কিছুই বুঝতে পারিনি। মনে হলো, গাড়ী যেন উল্টে যেতে যেতে বেঁচে গেলো। চালকের দোষ ছিলো না। উল্টো দিক থেকে একটি রিক্শা নিয়ম ভঙ্গ করে সামনে এসে পড়েছিলো। পুরুষযাত্রীটি লাফ দিয়ে সরে যেতে পারলেও মহিলাযাত্রীটি এবং রিকশা চালক গুরুতর আহত হলো। গাড়ীর চালক প্রাণপণ চেষ্টা করেছে দুর্ঘটনা এড়াতে। অন্যথায় একটি মর্মান্তিক মৃত্যুর দৃশ্য আমাদের দেখতে হতো। তারপর কী হতো আল্লাহ জানেন। মুহূর্তে কত কিছু ঘটে যায়! কত অনিশ্চিত আমাদের জীবন!

সারা সফর এবং সারা জীবন আল্লাহ যেন এভাবে হিফাযত করেন জিসমানি মুছীবত থেকে এবং রূহানি মুছীবত থেকে। চিন্তা করলাম সফরের দুআ পড়েছিলাম কি না? হাঁ, হযরত হাফেজ্জী হুযূর নিজে আমাদের তিনজনকে সফরের দুআ পড়িয়েছেন। আবার পড়লাম। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এবং প্রতিটি প্রয়োজনে পেয়ারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে দুআ শিক্ষা দিয়েছেন। দুআই হলো মুমিনের জীবনের সবচেয়ে বড় অবলম্বন। অথচ দুআ সম্পর্কে আমরা বড় বেশি গাফেল। কোন সন্দেহ নেই যে, সফরের দুআর বরকতেই আল্লাহ তাআলা আজ তাঁর ঘরের মুসাফিরদের অবশ্যম্ভাবী বিপদ থেকে হিফাযত করেছেন।

বিদায় মুহূর্তে বে-ইখতিয়ার আমি আব্বার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আব্বার সঙ্গে আমার এ দৃশ্য আগে আর কখনো ছিলো বলে মনে পড়ে না। আমার আব্বার দিল বড় নরম। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ফঁুপিয়ে ফঁুপিয়ে কাঁদলেন। চোখের পানিতে নিজেও ভিজলেন, আমাকেও ভেজালেন। কিন্তু আমার না পেলো কান্না, না এলো চোখের পানি। কারণ আমি তখন অন্য জগতে। সেখানে কখনো আনন্দ, কখনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, কখনো শিহরণ, কখনো কম্পন, কখনো উৎকণ্ঠা।

পশ্চিমের কবি বলেছেন-

প্রেমিকের হৃদয়াকাশে কখনো মেঘ ঝরে কখনো রোদ হাসে

যেন প্রেমাস্পদের রহস্যঘেরা মুখের ছায়া

এ রহস্যের স্বাদ যদি পেতে চাও

তাহলে প্রেমিক হও, কিংবা প্রেমিকের সঙ্গী।

বাবা তার সন্তানকে, আল্লাহর ঘরের মুসাফিরকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিলেন এই দুআ পড়ে

أستودع الله دينك وأمانتك وخواتيم أعمالك.                                    

(আমি আল্লাহর হাতে অর্পণ করছি তোমার দ্বীনকে, তোমার আমানতকে এবং তোমার আমলের সুপরিণতিকে।)

কী গভীর মর্মসমৃদ্ধ ও সারগর্ভ দুআ! কত সাহস, কত মনোবল ও নির্ভরতা সৃষ্টি করে মুমিনের অন্তরে এ দুআ! বান্দার দ্বীন ও দুনিয়া, বান্দার জিন্দেগির শুরু থেকে শেষ সবকিছু যখন আল্লাহর হাওয়ালা করা হলো তখন তার আর ভয় কিসের! ভাবনা কিসের! আল্লাহর হাওয়ালা ও হিফাযত থেকে কোন কিছু কি নষ্ট হতে পারে কখনো!

বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করলাম। জীবনের প্রথম সফর। প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা কিছুই জানা নেই। তবু  বেশ সহজেই সব কার্যক্রম সম্পন্ন হলো। পাসপোর্টে আল্লাহর ঘরের সফরের ছিলছাপ দেখে সংশ্লিষ্ট সকলেই খুব অন্তরঙ্গ আচরণ করলেন, আমরা শুধু দাঁড়িয়ে থাকলাম। আল্লাহর ঘরের মেহমান নিজে যদি নিজেকে অসম্মান না করে, তাহলে কেউ তার সম্মান ক্ষুণ্ন করে না, এমনকি অমুসলিম দেশেও না।

এক সময় সিঁড়ি বেয়ে বিমানের দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়ালাম। পিছনে ফিরে তাকালাম, আব্বা হাত নাড়ছেন। হঠাৎ মনটা হুহু করে কেঁদে উঠলো, কেন? জানি না, আমিও হাত নাড়লাম। নিজের অজান্তেই উচ্চারণ করলাম

رَبِّ ارْحَمْهُمَا كَمَا رَبَّیٰنِیْ صَغِیْرًا

(হে আমার প্রতিপালক! আপনি তাঁদের প্রতি রহম করুন যেমন তাঁরা ছোট অবস্থায় আমাকে প্রতিপালন করেছেন।)

মা এবং বাবা সন্তানকে ভালোবাসেন, এটা স্বাভাবিক এবং এটাও সত্য যে, সে ভালোবাসার কোন তুলনা নেই। কিন্তু আমার প্রতি আমার আম্মা ও আব্বার ভালোবাসা তুলনাহীনের মাঝেও অতুলনীয়। হয়ত পৃথিবীর সব সন্তানের একই অনুভূতি এবং আমি তাদের অনুভূতিকে শ্রদ্ধা করি। তবু আমার বলতে ইচ্ছা করে, আমার মা অন্য রকম মা এবং আমার বাবা ভিন্ন রকম বাবা।

আমি তখন এক বছরের শিশু। গ্রামে নানীর বাড়ীতে ভীষণ ঝড় হয়েছিলো, সে ঝড় নাকি ছিলো রোজ কিয়ামতের চেয়ে কিছু কম। আমাকে নানীর কোলে রেখে আম্মা গিয়েছিলেন পাশের গ্রামে কোন আত্মীয়ের বাড়ী। সন্ধ্যাবেলা দশদিক অন্ধকার করে হঠাৎ যখন ঝড় শুরু হলো তখন আমার মা রোজ কেয়ামতের সেই ঝড় উপেক্ষা করে ছুটে এসেছিলেন আমার কাছে, আমার চিন্তায় অস্থির হয়ে। সেই ঝড়ের রাতে আমার মায়ের নাকি একমাত্র চিন্তা ছিলো, নিজের জীবন দিয়ে হলেও কীভাবে আমাকে বাঁচানো যায়! আমার মায়ের প্রশান্ত মুখ দেখে এখনো আমি বুঝতে পারি আমার প্রতি তাঁর অন্তরের মমতা ও ব্যাকুলতা।

আর আমার আব্বা! ঐ যে দূরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন আমার আব্বা! আমি দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু তাঁর চোখ থেকে নিশ্চয় অশ্রু ঝরছে। জীবনের সবকিছু তিনি কোরবান করেছেন আমাদের জীবন গড়ার জন্য। তিনি বলতেন, তোমাদের লেখাপড়ার জন্য প্রয়োজনে আমি আমার রক্ত বিক্রি করবো। বিক্রি করেননি, তবে আমাদের জন্য তিনি তাঁর রক্ত পানি করেছেন।

দূর থেকে আব্বাকে হাত নাড়তে দেখে আমি খুব কাতর হয়ে পড়লাম। আজ আল্লাহর ঘরে রওয়ানা হওয়ার পবিত্র মুহূর্তে মনে হলো, এক ফেঁাটা আমিও হয়ত ভালোবাসি আমার আম্মাকে, আমার আব্বাকে।

বিমানের ভিতরে প্রবেশ করলাম। মনে হলো পিছনের জগতকে ত্যাগ করে সামনের জগতকে বরণ করে নিলাম। সামনের জগত এখনো অবশ্য অনেক দূরে, তবে আমার মনে হলো অনেক কাছে, একেবারে চোখের সামনে। ঐ তো আশিক মজনুর দল ঘুরছে; শুধু ঘুরছে। কালো ঘরকে প্রদক্ষিণ করছে। আমি আসছি, হে আল্লাহ, আমি আসছি, তোমার কুদরতে আমাকে পেঁৗছে দাও তোমার ঘরের দুয়ারে।

সকাল আটটা। বিমান চলতে শুরু করেছে; বিমানের চাকা ঘুরছে। আমার বুক দুরু দুরু করছে। বিমানের চাকার সঙ্গে আমার ভাগ্যের চাকাও যে ঘুরছে! কী আছে আমার ভাগ্যে? মানুষ কি বলতে পারে তার ভাগ্যের কথা? এক মুহূর্ত পরের কথা? তবু জীবনের চাকা ঘুরছে, তবু জীবনের গতি সচল রয়েছে এবং মানুষ এগিয়ে চলেছে। কেউ সত্যের পথে, কেউ মিথ্যার পথে। কেউ আলোর পথে, কেউ অন্ধকারের পথে। এক সময় সময়ের চাকা থেমে যায় এবং জীবনের গতি স্তব্ধ হয়ে যায়। তারপর হয় চির অন্ধকার, না হয় অনন্ত আলো।

বিমানের চাকা আরো জোরে ঘুরছে; সেই সঙ্গে ঘুরছে আমার ভাগ্যেরও চাকা। আমার ভাগ্য আমাকে নিয়ে যাবে তো আমার প্রিয় গন্তব্যে? আমি জানি না, আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তবে আমি জানি, আমি মদীনার পথিক, আমি মক্কার মুসাফির। আমি আল্লাহর ঘরের মেহমান। আমার ভয় কি? তাঁর যা ইচ্ছা, আমারও তাই ইচ্ছা।

বিমান ছুটছে; বিমান থরথর করে কাঁপছে। আমি আমার ভিতরে ভাবের তরঙ্গে দুলছি এবং অজানা ভবিষ্যতের মধুর উত্তেজনায় কাঁপছি। বিমান থামলো এবং দৌড় শুরু করলো। বিমান এক সময় ডানা মেলে আকাশে উড়লো। গতি তার পশ্চিমের অভিমুখে। মনে হলো, বিমান নয়, আমি নিজেই যেন ডানা মেলে উড়ে চলেছি আকাশে, পশ্চিমে। আমি যে পশ্চিমের যাত্রী! সময় যত পার হচ্ছে পশ্চিমের পথে আমি তত এগিয়ে চলেছি, দূরত্ব তত কমে চলেছে। হে কালো গিলাফ! হে সবুজ গম্বুজ! আমি আসছি, আরো কাছে আসছি।

আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, আমার গন্তব্য হিজাযের পবিত্র ভূমি হলেও বিমানের গন্তব্য পাকিস্তান। সুতরাং আমাকে নামতে হলো পাকিস্তানের মাটিতে, করাচীর বিমানবন্দরে। তবু সান্ত্বনা এই যে, আমি যে পথ ধরে চলেছি তা তুর্কিস্তানের পথ নয়, হেজাযেরই পথ। সুতরাং পথ যত দীর্ঘ হোক এবং সময় যত প্রলম্বিত হোক হিজাযের ভূমিতে একসময় পৌঁছে যাবে আমাদের কাফেলা। বরং এ দীর্ঘ পথ এবং এ দীর্ঘ সফর, আমার মনে হলো আল্লাহর নেয়ামত। এ যেন আমাদেরই কল্যাণের জন্য গায়বের তারবিয়াতি ইনতিযাম। ঢাকা থেকে জিদ্দার যাত্রায় হয়ত একদিনেই আমরা পৌঁছে যেতাম আল্লাহর ঘরে। কিন্তু পাপ-পংকিলতায় ডুবে থাকা জীবনের প্রথম সফরে আল্লাহর ঘর যিয়ারতের জন্য জিসমানি, কলবানি ও রূহানি যে শোধন ও সংশোধনের প্রয়োজন তা সম্পন্ন হতো কী করে? মুসাফিরের জন্য সফর হলো এক গায়বি তারবিয়াত, এ সত্য আমি উত্তমরূপে উপলব্ধি করেছি আল্লাহর ঘরে হাজির হওয়ার আগে বিশ দিনের দীর্ঘ এই সফরে। নিজের দেশ নেই, পরিচিত পরিবেশ নেই, কাছের এবং পাশের মানুষগুলো নেই। সবকিছু অজানা, অচেনা। সবকিছু আজনবী; আমি এবং আমার চারপাশের সবাই আজনবী। শুধু উপরের আকাশের দিকে তাকালে মনে হতো, এ আমার চিরপরিচিত, চিরআপনার। কারণ আকাশের কোন ভূগোল নেই। দিনের সূর্য এবং রাতের চাঁদ-তারাদের কোন ভৌগলিক সীমারেখা নেই। তাই তো দূর দেশের মুসাফির এই বলে চাঁদকে মিনতি জানাতে পারেন, আয় চান্দ, উন্সে যাকার মেরা সালাম কাহনা। (হে চাঁদ, আমার মিনতি শোনো, তাকে আমার সালাম নিবেদন করো।)

আমি জানি না, কবির হৃদয়ে কাকে সালাম নিবেদনের আকুতি ছিলো; তবে অনেকবার আমি চাঁদকে মিনতি জানিয়েছি আল্লাহর ঘরকে এবং সবুজ গম্বুজকে আমার সালাম নিবেদন করার জন্য। পরে হিজাযের আকাশে পরিচিত চাঁদকে দেখতে পেয়ে আমার বিশ্বাস হয়েছিলো, চাঁদ নিশ্চয় আমার মিনতি রক্ষা করেছে।

মুসাফিরের দিল থাকে কোমল, চোখ থাকে সজল। আর কোমল হৃদয় ও সজল চোখ আল্লাহর অতিপ্রিয়। তাই মুসাফিরকে আল্লাহ নিজে সঙ্গ দান করেন মুসাফিরের চোখের পানি আল্লাহ নিজের হাতে মুছে দেন, এ সফরে বারবার আমি এ সত্য অনুভব করেছি। এ সফরের মাধ্যমে আমার দেহসত্তা ধীরে ধীরে যেন পবিত্র হয়েছে। আমার হৃদয় ও আত্মা একটু একটু করে যেন পরিশুদ্ধ হয়েছে। আমার ভিতরের আমি যেন ক্ষণে ক্ষণে পরম সত্তার সংস্পর্শ লাভ করে ধন্য হয়েছে। এভাবে আমার সমগ্র অস্তিত্ব যেন কালো গিলাফের এবং সবুজ গম্বুজের বর্ণসৌন্দর্য অনুভবের কিছুটা হলেও উপযোগী হয়েছে।

পাকিস্তানে আমাদের প্রথম দিনটি ছিলো শুক্রবার। করাচীর নাযিমাবাদে যেখানে আমরা ছিলাম সেখান থেকে কিছু দূরে এক শানদার মসজিদ ছিলো। সেখানে আমরা জুমার নামায পড়েছিলাম। লালবাগ জীবনের সহপাঠী ভাই আবদুর রহমান আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। দশ দিন তিনি ছায়ার মত আমাদের সঙ্গ দিয়েছেন এবং প্রিয়জনের মত আনন্দ দিয়েছেন। আজ পঁচিশ বছর পর জানি না তিনি কোথায়, তবে তার ছবি আছে আমার অন্তরে। 

এমন সুন্দর মসজিদ এবং এমন নূরানী চেহারার খতীব জীবনে কম দেখেছি। আমাদের আনন্দের সীমা ছিলো না যে, খতীব সেদিন হজ্ব, ওমরা ও যিয়ারতের ফাযায়েল বয়ান করেছিলেন। উপলক্ষ ছিলো এই যে, মসজিদের মুতাওয়াল্লী সেদিন বাইতুল্লাহর যিয়ারতে রওয়ানা হবেন। খতীব সাহেবের হৃদয়ের উত্তাপ এবং কণ্ঠের উচ্ছ্বাস আমাদের অভিভূত করেছিলো। এক পর্যায়ে আল্লাহর ঘরের যাত্রীকে সম্বোধন করে আবেগ-উদ্বেলিত কণ্ঠে খতীব সাহেব বলেছিলেন, আপনি কি ভাবছেন যে, এখান থেকে আল্লাহর ঘরে আপনি একা যাচ্ছেন? না, বরং আমাদের সবার দিল আপনার সঙ্গে যাচ্ছে। আমাদের জিসিম মজবূর, কিন্তু দিল শাওকে ভরপুর। আর দিলের শাওক হলো সেই ডানা যা উড়িয়ে নিতে পারে দূরে, বহু দূরে। মসজিদে তখন কান্নার রোল পড়েছিলো। আমরাও কেদেছিলাম, কান্নার জন্য এর চেয়ে সুন্দর উপলক্ষ আর কী হতে পারে!

নামাযের পর অন্য সকলের সঙ্গে আমরাও আল্লাহর ঘরের মুসাফিরের সঙ্গে মুসাফাহা করলাম। কোন দিন যার সঙ্গে চোখের দেখা ছিলো না, মনের জানা ছিলো না, তাকেই মনে হলো হৃদয় ও আত্মার কত নিকটের! মানুষ মানুষের নিকটে হয় কিভাবে, মানুষ মানুষ থেকে দূরে হয় কিভাবে, এ প্রশ্নের জবাব কি আছে তোমার কাছে?

পাকিস্তানে দশদিনের সফরে একদিন তারাবীর পর আমরা গেলাম আরব সাগরের পারে ক্লিফটনে। জোসনা রাত ছিলো, আকাশে সাদা সাদা মেঘের আনাগোনা ছিলো। সাগরের ঢেউ তীরে এসে আছড়ে পড়ছে। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তা দেখছি। সাগরের ঢেউ এবং আমার ভিতরের ঢেউ যেন একাকার হয়ে গেলো। শুভ্রস্নিগ্ধ জোসনায় সৈকতের বালু যেমন চিকচিক করছে, সাগরের পানিও তেমনি ঝিলমিল করছে। আরব শব্দটি যেন সাগরের মাঝে এবং আমার হৃদয়ের মাঝে অপূর্ব এক বন্ধন সৃষ্টি করলো। আরবভূমি এবং আরবসাগর আমার কাছে অভিন্ন মনে হলো। আরবসাগরের নোনা বাতাসে আমি যেন পেলাম আরবের মরুভূমির অন্যরকম বাতাসের স্পর্শ। এই প্রথম আমি এমন কিছুর সান্নিধ্য লাভ করলাম যার সঙ্গে রয়েছে আরবের নাম। এই সাগর পাড়ি দিয়েই তো আরবভূমি এবং আরবের বন্দর!

সাগর পাড়ি দিয়ে যারা হজ্বের সফরে যায় তাদের কিছু কিছু সফরনামা আমি পড়েছি। দূর থেকে আরবভূমির তীর এবং আরবের পাহাড়-পর্বত দেখে তাদের হৃদয়ে যে ভাবের উদয় হয়, যে অনুভব অনুভূতি তাদেরকে আন্দোলিত করে, ইশক ও মুহব্বত এবং প্রেম ও ভালোবাসার যে অপূর্ব তরঙ্গদোলা তাদেরকে উদ্বেলিত করে তা আমি তাদের লেখা থেকে জেনেছি। আরবসাগরের তীরে দাঁড়িয়ে সেই সব অনুভব অনুভূতি আমারও হৃদয়ে অপার্থিব এক তরঙ্গদোলা সৃষ্টি করলো। আমার হৃদয়সাগরের পালতোলা জাহাজ যেন ঢেউয়ের বাঁধা ভেঙ্গে ভেঙ্গে এগিয়ে চললো এবং আরবের বন্দরে গিয়ে নোঙ্গর করলো।

সেদিন আরবসাগরের তীরেই আমাদের রাত ভোর হলো। খোলা আকাশের নীচে কাগজের দস্তরখান বিছিয়ে খুব সামান্য সেহরী খাওয়া হলো, কিন্তু আমার জীবনে সেটা ছিলো অসামান্য। এমন সেহরী জীবনে আমার প্রথম। মনে হলো, আমি যার মেহমান, এ তাঁরই দস্তরখান। বিশ্বাস করো, পৃথিবীর সব রাজা-বাদশাহর দস্তরখান আমি কোরবান করে দেবো আরব সাগরের তীরে সেদিন শেষরাতে বিছানো সেহরীর সেই দস্তরখানের জন্য।

পাকিস্তানে দশদিনের অবস্থানে বিভিন্ন স্থানে আমাদের যাওয়া হয়েছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের অসংখ্য ব্যক্তির সাথে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। মাদরাসার প্রয়োজনে দূর দারাজের অনেক সফরও হয়েছে। এ সময় আমি যা দেখেছি, শুনেছি এবং চিন্তা ভাবনার যে সকল উপাদান পেয়েছি তাতে এক কথায় আমার অভিজ্ঞতার সঞ্চয় বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আমি মনে করি, অন্যদের জন্যও তাতে রয়েছে শিক্ষার মূল্যবান উপকরণ। কিন্তু এখানে যদি সেগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণও আমি তুলে ধরতে চাই তাহলে পথেই আমার সফরনামা হয়ে যাবে অনেক দীর্ঘ। তাই কোন উপযুক্ত সময়ের জন্য সেগুলোকে মূলতবী রেখেই আমি সামনে এগিয়ে যেতে চাই। এখানে শুধু এইটুকু বলে রাখি, পূর্বের ও পশ্চিমের পার্থক্য আমি দেখতে পেয়েছি সমাজের সর্বস্তরে, এমন কি দুদেশের আলিম সমাজেরও মাঝে। ওখানকার বিত্তশালীরাও সাধারণভাবে অনেক বিনয়ী এবং দ্বীনের খেদমতের ক্ষেত্রে নিজেদের কাছেই প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ। আবার আহলে ইলমও যথেষ্ট সমাজ সচেতন।

এখানে আমি অন্যরকম দুটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই যা আমার হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে, যা আমি জীবনে কখনো ভুলতে পারবো না। তাছাড়া ঘটনাদুটো আমার হজ্বের সফরেরই অংশ এবং আমি মনে করি, এর মাধ্যমে গায়েব থেকে আমার তারবিয়াতের ইনতিযাম করা হয়েছিলো বাইতুল্লাহর যিয়ারাতের জন্য।

সম্ভবত আটই রামাযান, মাদরাসার প্রয়োজনে সেদিন আমাদেরকে যেতে হলো অনেক দূরের সফরে। সকাল আটটায় রওয়ানা হয়ে পথে এক নির্জন ভূমিতে গাড়ী থামিয়ে আমরা যোহর আদায় করলাম। সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম পাকিস্তানী গরম কাকে বলে! সফরের সুবিধা গ্রহণ করে একবার ইচ্ছা হলো রোযা ভেঙ্গে ফেলি। কিন্তু লজ্জা হলো কালো ঘরকে স্মরণ করে। সফরের এই সামান্য কষ্টে যদি এমন কাতর হয়ে পড়ি তাহলে সেই ঘরের দরজায় মুলতাযামে গিয়ে দাঁড়াবো কী করে? আবে যমযমের কিনারে গিয়ে বলবো কীভাবে, দাও, শীতল পানি দাও, আমি পিপাসার্ত!

শুকনো ঠোঁটের সামনে পানির বোতল এনেও তাই শুধু মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বোতল নামিয়ে রাখলাম। আছরের সময় আমরা গন্তব্যস্থানে পৌঁছলাম। আফসোস, দৌঁড়ঝাঁপ হলো, কিন্তু মাদরাসার কাজ তেমন কিছু হলো না। এর কারণ কিছুটা অভিজ্ঞতার অভাব, কিছুটা পরিচয়ের সংকট, আর কিছুটা দায় আত্মসম্মানবোধের। পুরো সফরেই এ তিন উপসর্গ আমাদেরকে যথেষ্ট  ভুগিয়েছে। ফলে মাদরাসার কাজ আমাদের দ্বারা, বিশেষ করে আমার দ্বারা বলতে গেলে কিছুই হয়নি।

ফেরার পথে কিছু দূর এসে ইফতারের সময় হয়ে গেলো। আমাদের সঙ্গে ছিলো সামান্য পানি। আমরা মসজিদ তালাশ করলাম। নিজ দেশে হোক কিংবা পরদেশে, মসজিদের চেয়ে আপন ও নিশ্চিন্ত ঠিকানা আর কী হতে পারে! হোক সে মসজিদ আলিশান ইমারতের, কিংবা সামান্য খেজুর পাতার। কিন্তু মসজিদের ঠিকানা খুঁজে পেলাম না।

আমরা কাঁচা পথ ধরে হাঁটছিলাম, আর ভাবছিলাম, কোথাও রুমাল বিছিয়ে বসে পড়ি। এলাকাটা মনে হলো বেশ দারিদ্র্যপীড়িত। একটি বাড়ীর বাইরের অঙ্গনে ছেড়া শতরঞ্চি পেতে কয়েকজন রোযাদার সামান্য কিছু ইফতার নিয়ে বসে আছেন। আমরা পরদেশী তা বোঝাই যায়। আমাদেরকে তারা ইফতারে শরীক হওয়ার দাওয়াত দিলেন। ইফতারের সময় মুমিন রোযাদার মুমিন রোযাদারের কত আপন হয় তা নিজের দেশে পুরোপুরি অনুভব না করলেও যত পশ্চিমে গিয়েছি তত বেশি উপলব্ধি করেছি। কিন্তু এই রোযাদারদের দাওয়াত গ্রহণ করতে আমাদের সংকোচ বোধ হলো, (অন্তত আমার সংকোচের কারণ ছিলো ইফতারের শুধু গরিবানা নয়, বরং এতিমানা হালত) কিন্তু তারা উঠে এসে এমন অন্তরঙ্গতার সঙ্গে আমাদের নিয়ে গেলেন যে, আমরা সত্যি সত্যি অভিভূত হলাম। আজ পঁচিশ বছর পরও সে দৃশ্য আমার স্মৃতিতে অম্লান। বিত্তে দরিদ্র, চিত্তে ধনাঢ্য কথাটা বইয়ের পাতায় পড়েছিলাম, জীবনের পাতায় সেদিন প্রথম পড়ার সুযোগ হলো।

তাদের সঙ্গে আমাদের জীবনে এই প্রথম দেখা। এর আগে না ছিলো কোন সাক্ষাৎ, না ছিলো কোন পরিচয়। অথচ সারা দিনের ক্ষুধার্ত রোযাদারগণ কয়েক টুকরো রুটি ও খোরমা খেজুরের সামান্য ইফতারে এমন সাদরে আমাদের বরণ করে নিলেন, কিসের টানে! কিসের বন্ধনে!! তারপরও কি থাকতে পারে ভাষার ব্যবধান! ভূগোলের দূরত্ব!! আসলে রাজনীতির খেলা বড় বিচিত্র!

জীবনের স্মরণীয় ইফতার মাহফিল শেষ করে সেখানেই আমরা মাগরিব আদায় করলাম। সুন্নাত শেষে আমি সামনের খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে পশ্চিম দিগন্তের সৌন্দর্য-শোভা উপভোগ করছিলাম এবং কিছুটা তন্ময় হয়ে পড়েছিলাম। আকাশ দিগন্তের লালিমা আমার হৃদয়দিগন্তেও যেন ছড়িয়ে দিলো ভাবের লাল আবির। আমি তো যাবো আরো পশ্চিমে। সেখানে দিগন্তের লালিমা নিশ্চয় আরো সুন্দর, আরো মনোহর!

ভাবের তন্ময়তা ছিন্ন হলো কারো উপস্থিতির শব্দে। পিছনে ফিরে তাকালাম। জীর্ণশীর্ণ এক বৃদ্ধা এক গদ্বাস দুধ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন, দুকদম এগিয়ে এসে তিনি বললেন, বেটা, ইয়ে দুধ, পী লো।

কী ছিলো তার অনুরোধের কণ্ঠে! আন্তরিকতা! স্নেহ!! মমতা!!! কেন আমার মনে হলো এ কণ্ঠ আমার চিরপরিচিত! এ কণ্ঠের দেশ, কাল নেই; নেই কোন ভাষা ও গোত্র! এ কণ্ঠ চিরকালের, সকল দেশের, সকল ভাষা ও গোত্রের!

আমি আগে বেড়ে দুধের গদ্বাস হাতে নিলাম। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়েও থেমে গেলাম। কারণ আমার মনে হলো, তাতে মমতার এ মাতৃমূর্তিকে অসম্মান করা হবে।

দুধ পান করে গদ্বাস ফিরিয়ে দিলাম, তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি ইতস্তত করে বললাম, কিছু বলবেন? বাইরে দ্বিধার জড়তা, ভিতরে পুঞ্জীভূত ব্যথা গলার আওয়াজে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতা নিয়ে তিনি বললেন, বেটা, শুনেছি তোমরা আল্লাহর ঘরের মুসাফির! আমাদের মত গরীবদের কি আর সে কিসমত হবে! যিন্দগী পার হয়ে গেলো, দিলের হাসরাত ও তামান্না দিলেই রয়ে গেলো, এখন তো এ আফসোস নিয়েই কবরে যেতে হবে। বেটা, তুমি কাবা শরীফের গিলাফ ধরে আমার জন্য দুআ করো, আর পেয়ারা নবীর হুযূরে আমার সালাম পেশ করো।

সেদিন আল্লাহর সেই বান্দীর সামনে দাঁড়িয়ে আমি যেন ইশক ও মুহাব্বাতের এক নতুন দিগন্তের সন্ধান পেলাম। দিলের আরযু ও তামান্না এবং দিলের দরদ ও হাসরতের এক নতুন রূপ যেন আমার সামনে প্রকাশ পেলো। মনে পড়লো আমার দাদীর কথা। তিনিও কি আল্লাহর ঘরের কোন মুসাফিরকে এভাবে সালাম ও দুআর মিনতি জানিয়েছিলেন? কে বেশি ভাগ্যবান, সালাম বহনকারী, না সালামের নাযরানা প্রেরণকারী? কে যাও সোনার মদীনায়! আমার সালামখানি পেঁৗছে দিও নবীজীর রওযায়- এ আবদার ও মিনতি তো চিরকালের এবং সকল দেশের সকল মাজবুর আশিকানের। তুমি যদি এমন সালাম বহন করে নিয়ে যেতে পারো তাহলে ভালো মজুরি আশা করতে পারো। এক ভিখারী তো মজনুর সালাম পেঁৗছে দিয়েই লায়লার সকৃতজ্ঞ অভ্যর্থনা লাভ করেছিলো!

আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের ঘটনা, কিন্তু আমার স্মৃতিতে এখনো তা সমুজ্জ্বল। আল্লাহর ঘরের গিলাফ ধরে  এবং মুলতাযামে দাঁড়িয়ে আল্লাহর সেই মাজবুর বান্দীর জন্য আমি দুআ করেছিলাম এবং নবীজীর রওযায় তার সালাম ও আকীদাতের নাযরানা পেশ করেছিলাম।

আল্লাহর সেই বান্দী কি এখনো বেঁচে আছেন দুনিয়ায়? তার দিলের তামান্না কি পূর্ণ হয়েছিলো? না কি আমার দাদীর মত অপূর্ণ স্বপ্নের বেদনা সঙ্গে করে তিনি এখন শুয়ে আছেন কবরের বিছানায়! মাটির উপরে কিংবা নীচে যেখানেই থাকুন আল্লাহ তাকে শান্তিতে রাখুন।

করাচীর নাযিমাবাদের যে বাড়ীতে আমরা মেহমান ছিলাম, সেটা ছিলো হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-এর খাছ মুহাব্বাতের মানুষ হাজী হাবীব সাহেবের বাড়ী। তিনি ঢাকায় থাকতেন। তাঁর কন্যা ও জামাতা পরম যত্নের সঙ্গে আমাদের মেহমানদারি করেছেন। তাদের আন্তরিকতা কোন দিন ভোলবার নয়। অকৃতজ্ঞ বান্দা ভুলে যেতেও পারে, কিন্তু কৃতজ্ঞ মনীব ভোলেন না, ভুলতে পারেন না।

বিদায়ের আগের দিন তাদের ছোট ছেলে- নাম এখন মনে নেই-আমার সঙ্গে তার বেশ ভাব হয়েছিলো- সে চুপি চুপি আমার কামরায় এলো, ভাবখানা এই, কেউ যেন দেখে না ফেলে। আমি কিছুটা অবাক, সে আমাকে আরো অবাক করে দুটো চকলেট আমার হাতে দিয়ে বললো, আল্লাহ মিয়াঁকো দে দেনা।

আমি তার হাদিয়া নিয়ে গিয়েছিলাম আল্লাহ মিয়াঁর কাছে। সে যদি বেঁচে থাকে তাহলে এখন নিশ্চয় বেশ জোয়ান হয়েছে। আমার বড় জানতে ইচ্ছা করে, তার কি মনে পড়ে আল্লাহ মিয়াঁর কাছে পাঠানো হাদিয়ার কথা! আল্লাহ যেন তার হাদিয়া কবুল করেন, আল্লাহ যেন তার দিলের তামান্না পূর্ণ করেন।

পাকিস্তানে আমাদের অবস্থানের দশদিন এক সময় শেষ হয়ে এলো। এ দশদিনে হৃদয়ের জগতে অর্জন আমাদের কিছু হলো কি না তা বলতে পারবো না, তবে শাওক ও তামান্না এবং আকুলতা ও ব্যাকুলতা যে বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে তা অনুভব করতে পারছিলাম। হায়, আজ পঁচিশ বছর পর তার ছিটে ফোঁটাও যেন নেই এ অভাগা অন্তরে। বসন্ত কি জীবনে একবারই আসে! বারবার আসে না! বারবার আসতে পারে না!

বিদায়ের আগের রাত্রটি আমরা যাপন করলাম জামেয়া ফারুকিয়ায়। এর প্রতিষ্ঠাতা পাকিস্তানের সর্বজনমান্য আলিম হযরত মাওলানা সালীমুল্লাহ খান ছাহেব। তিনদিন আগে একবার আমরা তাঁর খিদমতে হাজির হয়েছিলাম দুআ নেয়ার জন্য। তখন তিনি খুব মুহব্বতের সঙ্গে বলে দিয়েছিলেন, বিদায়ের রাত্রে যেন আমরা এখানে থাকি এবং এখান থেকে বিমানবন্দরে যাই। আমাদের মেজবান একটু আপত্তি করেছিলেন। হযরত মাওলানা মৃদু হেসে এই বলে তাকে থামিয়ে দিলেন, ভাই, হাম ফাকীরেঁা কো ভী কুছ মাওকা মিলে। এরপর একজন শরীফ মেযবানের আর কী বলার থাকতে পারে! এটাই ছিলো হযরত মাওলানার আন্দাযে কালাম বাকভঙ্গি। তাঁর মুখের মৃদুহাসি এবং সহজ সরল অভিব্যক্তি যে কোন মানুষকে মুগ্ধ করতো। আমরা তো ছিলাম এক রাত্রের মেহমান। কিন্তু পুরো দশদিন আমরা আলিম ও তালিবে ইলম সবার অন্তরেই তাঁর প্রতি আযমত ও মুহব্বত দেখতে পেয়েছি।

তারাবী থেকে সেহরী পর্যন্ত দীর্ঘ সময় আমরা হযরত মাওলানার খিদমতে ছিলাম। অন্যদের জন্য এটা বিস্ময়ের বিষয় ছিলো। কারণ তাঁর সময়যাপন ছিলো সুশৃঙ্খল। কিন্তু সেদিন আমাদের জন্য তিনি ব্যতিক্রম করেছিলেন। আর বলাই বাহুল্য যে, হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-এর নিসবতই ছিলো এর মূল কারণ। তারপরো তাঁর প্রতিটি আচরণে ও উচ্চারণে আমরা তাঁর ফিতরী শারাফাত ও স্বভাবভদ্রতা এবং বিনয়, ইখলাছ ও আন্তরিকতা অনুভব করেছি। তাঁর ছোহবত ও নছীহত আমাদের জন্য ছিলো আবে হায়াত। আল্লাহর ঘরের সফরে তো বটেই, পরবর্তী জীবনেও আমি তা দ্বারা উপকৃত হয়েছি।

বিনিদ্র রাতের ঐ মজলিসে যেন নেমে এসেছিলো বসন্তের বাহার। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি তাঁর দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা ও চিন্তা ভাবনার কথা বলেছিলেন। বিশেষ করে যুগের দাবী এবং দ্বীনী শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য ছিলো খুবই সুচিন্তিত। বাংলাদেশে নূরীয়া মাদরাসায় হযরত হাফেজ্জী হুযূরের তত্ত্বাবধানে তালীমের ক্ষেত্রে, বিশেষত আরবী ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে তা সবিনয়ে আমরা তার খিদমতে নিবেদন করেছিলাম। আমাদের মত না-তাজরাবাকার নও জোওয়ানদের কথা তিনি যে মনোযোগ ও আন্তরিকতার সাথে শুনেছেন এবং যেভাবে উৎসাহ দিয়েছেন, এক কথায় আমার জন্য তা ছিলো পরম বিস্ময়ের বিষয়।

হজ্ব ও যিয়ারতে বাইতুল্লাহ সম্পর্কে তাঁর নছীহতমূলক সুদীর্ঘ আলোচনা ছিলো লিখে রাখার মত। কিন্তু আফসোস, তখন তা করা হয়নি। কে জানতো, আজ পঁচিশ বছর পর আমার হাতে কলম ওঠবে এবং সেই কলম থেকে কালি ঝরবে! তখন যদি তা সংক্ষিপ্ত আকারেও লিখে রাখা হতো তাহলে খুব কাজে আসতো। তাঁর একটি উপদেশ এখনো আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। তিনি বলেছিলেন, হামেশা ডরতে রাহনা, মাকাম কি আযমত কা খেয়াল রাখনা আওর মাকামে আবদিয়াত কা ইসতিহযার রাখনা। সব সময় ভয় করতে থেকো। আল্লাহর বড়ত্ব ও আযমতের মাকাম মাকাম স্মরণে রেখো এবং নিজেদের আবদিয়তে ও দাসত্বের অনুভূতি অন্তরে জাগরূক রেখো। আকাবিরীনে উম্মতের হজ্ব ও যিয়ারতের বিস্ময়কর অসংখ্য ঘটনা তিনি আমাদের বলেছিলেন। নিজের জীবনের প্রথম হজ্ব ও যিয়ারাতের এবং আল্লাহর ঘর প্রথম অবলোকনের অনুভব-অনুভূতির সুমধুর স্মৃতিচারণ করেছিলেন। তখন তাঁর চেহারায় ইশক ও মুহাব্বতের যে অপূর্ব উদ্ভাস আমি দেখেছিলাম এখনো যেন তা আমার চোখের তারায় ভাসছে।

আমাদের বড়রা সত্যই বলেছেন, কিতাবের হাজার পাতার চেয়ে আল্লাহর কোনো নেক বান্দার ক্ষণিকের ছোহবত অনেক বেশী উপকারী। কিতাব হয়ত জ্ঞান দান করে, কিন্তু ছোহবত দান করে অন্তর্জ্ঞান। অধ্যয়ন যদি হয় প্রদীপ তাহলে সান্নিধ্য হলো হৃদয়ে সেই প্রদীপের প্রজ্বলন।

সেদিনই আমাদের প্রথম দেখা এবং প্রথম পরিচয়। কিন্তু বিদায়কালে মনে হলো, তাঁর কলিজার ভিতরে কোথাও যেন টান পড়ছে এবং তাঁর কষ্ট হচ্ছে। খোদা হাফিয আমাদেরকে অনেকেই বলেছেন, এমনভাবে কেউ বলেননি। আজ এত বছর পরো তাঁর সেদিনের অশ্রুছলছল চোখের দৃষ্টি আমাকে আপ্লুত করে। এ অভিজ্ঞতা আমার জীবনে আগে ও পরে আর কখনো হয়নি। সেদিন তিনি দুআ করেছিলেন, পবিত্রভূমির সকল রূহানী নেয়ামত দ্বারা আল্লাহ যেন তোমাদের মালামাল করেন।

তাঁর নির্দেশে তাঁর পুত্র মাওলানা খালিদ নিজে গাড়ী চালিয়ে আমাদের বিমানবন্দরে পৌঁছে দিয়েছিলেন।

আশ্চর্য! এঁদের পয়দায়েশ যে মাটি থেকে, এটা কি সে মাটিরই গুণ! শুনেছি জমির মাটি পরীক্ষার বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক উপায় রয়েছে। মানুষের শরীরের মাটি পরীক্ষার ব্যবস্থা কি হবে কোন দিন! আমার জানতে ইচ্ছে করে, কী পার্থক্য পূর্ব দেশের এবং পশ্চিম দেশের মাটিতে? কেন তারা আমাদের মত নয় এবং কেন আমরা তাদের মত নই? দশদিনে এখানে যা দেখলাম, যা পেলাম পঁচিশ বছরের জীবনে আমার দেশে কেন তা পেলাম না?

বিমানবন্দরে খালিদ যখন আমাকে বিদায় আলিঙ্গন করলেন এবং তার হৃদয়ের উষ্ণতা আমার হৃদয়কে স্পর্শ করলো, এ প্রশ্নগুলো তখন কাঁটা হয়ে খচখচ করে আমার বুকে বারবার বিঁধল। আমার দেশে বহু খালিদের সঙ্গে আরো বেশী করে আমার পরিচয় হয়েছে এবং আমরা পরস্পরকে আলিঙ্গন করেছি, কিন্তু সেই খালিদের সেই আলিঙ্গন-উষ্ণতা কখনো অনুভব করিনি। খালিদ যখন খোদা হাফিজ বললেন তখন বাবার মত তারও চোখ দুটো ছিলো অশ্রুসিক্ত। সম্ভবত এজন্যই সন্তান এদেশে বাবার প্রতিচ্ছবি হয়। খালিদ, আশা করি আপনি বেঁচে আছেন এবং সুন্দর ও শান্তিময় জীবন যাপন করছেন। এত দূর থেকে আমার হৃদয় আপনাকে দিতে পারে শুধু শিশিরভেজা এক টুকরো শুভ কামনা।

পাকিস্তানের আলিমসমাজ যা পারেন, আমরা কেন তা পারি না, এর জবাব আমি পেয়েছি এই দশদিনের সফরে কিছু তিক্ত এবং কিছু মধুর অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। এখন থাক সে প্রসঙ্গ।

বিমানবন্দরের সমাপ্ত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে অদৃশ্য কণ্ঠের অনুরোধ অনুসরণ করে আমরা যখন বাসে উঠবো আবুধাবী গামী পিআই-এর বিমানে আরোহণ করার উদ্দেশ্যে তখন দেখলাম এবং অভিভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। সেই পোশাক যাতে পরিচয় থাকে না কোন দেশের, কোন ভাষার ও গোত্রের, পরিচয় থাকে শুধু একটি, বাইতুল্লাহর মুসাফির। অন্য একটি নির্গমন পথ দিয়ে ইহরামের শুভ্র পোশাকে পাঁচসাতজন বের এবং বাসে আরোহণ করলো। দূরে দাঁড়িয়ে আসে সউদিয়ার বিমান। আহা ভাগ্যবান মুসাফির। আজই তোমরা দেখতে পাবে কালো গিলাফের দুলহানকে!

আমরা আমাদের বিমানে আরোহন করলাম। সাউদিয়ার বিমান যাত্রা করলো আমাদের আগে। জানালা পথে ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম। কিছুক্ষণ আমাদের বিমান উড়লো আকাশে এবং পশ্চিমেরই উদ্দেশ্যে। আমরাও যে পশ্চিমের যাত্রী! সফরের শুরুতে কলবের যে হালাত ছিলো, আমার মনে হলো, দশদিনে তাতে আরো পরিবর্তন এসেছে। আমি যেন এখন নতুন সত্তার, নতুন অস্তিত্বের অন্য এক মানুষ। অন্তর যেন আরো স্থির, আরো শান্ত। হৃদয় যেন আরো কোমল, আরো বিগলিত, অনুভব-অনুভূতি যেন আরো নিবিড়, আরো গভীর। অন্যদিকে আশংকা ও উৎকণ্ঠার মেঘ যেন আরো ঘণীভূত।

অবশ্যই এটা আল্লাহর ঘরের সফরের বরকত। এ সফর যত দীর্ঘ হবে, পথে পথে যত কষ্ট হবে, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের জন্য তা তত কল্যাণকর হবে। আগের যুগে হজ্বের সফরে পথেই পার হতো দিন, মাস, এমন কি বছর। পথও ছিলো কষ্টবহুল ও বিপদসংকুল; খাতরা ছিলো, মালের এবং জানের। কিন্তু পথের সকল খাতরা ও বিপদ-দুর্যোগ পাড়ি দিয়ে সুদীর্ঘ সফর শেষে আল্লাহর বান্দা যখন হাযির হতো আল্লাহর ঘরে তখন সে হতো সত্যিকারের মুসাফির, বাইতুল্লাহর মুসাফির, তার তখনকার অবস্থা যেন ফুটে ওঠে কবির ভাষায়-

মজনু হাজির দুয়ারে তোমার

কংকাল দেহে স্বাস্থ্যের জৌলুস!

সে তো বিলিয়ে এসেছি পথে পথে!

আর যাবো না ফিরে

থাকবো পড়ে তোমার দুয়ারে

এখন শুধু মৃত্যুর সেতু মিলনের মাঝে।

এমন সফরের পর যখন বাইতুল্লাহর দীদারে কেউ ধন্য হতো তখন বাইতুল্লাহর ফয়েয ও ফয়েযান লাভের জন্য তাঁর হৃদয় ও আত্মার প্রস্তুতি হতো চূড়ান্ত। সে তখন পৌঁছে যেতো ইশক ও মুহব্বতের সেই স্তরে, যেখানে কোন ব্যবধান থাকে না মিলনের ও বিরহের।

এমন বান্দা যখন ফিরে যেতেন নিজের দেশে নিজের পরিবেশে তখন তিনি হতেন অন্য মানুষ। মাটির পুতলা হয়েও তিনি হতেন নূরের ফিরেশতা। একজন হাজী একটি জনপদের জন্য হতেন আলোর মিনার। মাটির উপরে বিচরণ করেও তিনি হতেন মাটির নীচের বাসিন্দা। কিন্তু এখন! হজ্বের কাফেলা আছে, নেই হজ্বের মুসাফির। আকার আছে, আকৃতি আছে, নেই শুধু সজীব প্রাণ। এখনো লাব্বাইক ধ্বনি শোনা যায়, শোনা যায় না শুধু প্রতিধ্বনি।

আমরা দুর্বল বান্দা, আল্লাহর কাছে আমরা মেহনত চাই না, শুধু নেয়ামত চাই এবং আমার মনে হলো, বাইতুল্লাহর পথে কষ্ট-ক্লেশহীন এ দীর্ঘ সফর আমার জন্য ছিলো আল্লাহর বিরাট নেয়ামত। সফরের দীর্ঘ পথে বিনা মেহনতে আমার কলব ও রূহ এবং হৃদয় ও আত্মা দীদারে বাইতুল্লাহর জন্য কিছুটা হলেও প্রস্তুতি গ্রহণের সুযোগ লাভ করেছে। তোমার শোকর হে আল্লাহ, তোমার শোকর।

কিন্তু হায়, একটি ভুল যেন সব কিছু করে দিলো ভন্ডুল। এখনো আমি বুঝতে পারি না, কীভাবে হলো এমন ভুল! আসল কথা, পাত্র যদি ছোট হয়, কিসমত কি বড় হতে পারে! আমার পাত্র ছিলো ছোট, তাই বড় কিসমত হয়ে গেলো ছোট। অবুঝ মন তবু আশা করে তোমার কাছে হে আল্লাহ, ক্ষমা করে ও দয়া করে তোমার দান তুমি পূর্ণ করবে।

داتا تيرے كرم كا كوئى نہيں كنارا

দাতা তোমার দয়া ও করুণার, নেই কোন কূল কিনার

বিমানে জানালার পাশে বসেছিলাম। মাওলানা হামীদুল্লাহ সাহেব আমাকে জানালার পাশে বসতে দিয়েছিলেন। নীচে তাকালাম, নীল সমুদ্র, উপরে তাকালাম, নীল আকাশ। আর দূরে শুভ্র মেঘের অপূর্ব লীলা খেলা! যেন সৃষ্টির সৌন্দর্যে স্রষ্টার অপার সৌন্দর্যের ছায়া। এতদিন মেঘের সৌন্দর্য দেখেছি মাটিতে দাঁড়িয়ে উপরের আকাশে। আজ মেঘের সৌন্দর্য দেখলাম আকাশের উচ্চতা থেকে মাটির দিকে তাকিয়ে। এতদিন মেঘের ছায়া আড়াল করেছে সূর্যের আলো, আজ সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে মেঘের রাজ্য। দূর দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত শুধু তুষারশুভ্র মেঘের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য। কে তিনি সব সৌন্দর্যের আড়ালে, সব সৌন্দর্যের ঊর্ধ্বে?! তিনি আল্লাহ। আজ বিমুগ্ধ হৃদয়ে সমর্পিত চিত্তে তাঁর কাছে আমার প্রার্থনা- হে সকল সৌন্দর্যের আধার! সকল জামাল ও কামালে তোমারই একক অধিকার। আমি যেতে চাই তোমার ঘরে, আমি পেতে চাই তোমাকে আপন করে। সৃষ্টির সকল সৌন্দর্য ছাপিয়ে আমাকে তোমার ঘরের সৌন্দর্য দেখাও এবং তাওফীক দাও তোমার ঘরের সৌন্দর্যে তোমার, শুধু তোমার সৌন্দর্য অনুভব করার।

এখনো অনেক দেরী। এখনো অনেক পথ বাকি। সাগর শেষ হলো, মরুভূমি পার হলো, আকাশের উচ্চতা থেকে আরব জনপদ দেখা গেলো। আমার জীবনে এই প্রথম কোন আরব জনপদের অবলোকন। সমগ্র সত্তায় আনন্দের শিহরণ বয়ে গেলো। এ যেন পরম আনন্দের পূর্বাভাস, কিংবা পূর্ব প্রস্তুতি।

আকাশ থেকে আবুধাবী শহর মনে হলো ছবির মত সুন্দর। দেখতে দেখতে বিমান ভিড়লো বিমানঘাটে। করাচীতে একজন ছিলেন আমাদের অপেক্ষায়, এখানেও কথা ছিলো, কিন্তু কেউ ছিলো না। যখন কেউ থাকে না তখন আল্লাহ বেশী করে থাকেন। ঠিকানাহীন মুসাফির  কথাটার স্বাদ ও গন্ধ সাহিত্যের পাতায় এবং জীবনের পাতায় ভিন্ন, তা এই প্রথম অনুভব করলাম। সত্যি সত্যি আমরা তখন ঠিকানাহীন মুসাফির। পথের ঠিকানা, ঘরের ঠিকানা কিছুই জানি না। যিনি আসবেন, তিনি আসেন নি। ফোন নাম্বার সঙ্গে ছিলো, কিন্তু নেই। বোধ হয় এরই নাম চারদিকে অন্ধকার দেখা। বড় দিশেহারা অবস্থা। বুঝতে পারছি না, কী করবো, কোথায় যাবো, কাকে ডাক...।

আচ্ছা! এতক্ষণ কেন মনে পড়েনি তাঁকে ডাকার কথা! মানুষের ভিড় এড়িয়ে কোণে গিয়ে দাঁড়ালাম এবং দুরাকাত সালাতুল হাজাত পড়লাম। সে নামায ছিলো অন্য আবেগের, ভিন্ন অনুভবের। জীবনে খুব কম পাওয়া যায় এমন নামাযের স্বাদ। আব্বাকে সারা জীবন দেখেছি, বিপদ এসেছে, আর তিনি জায়নামাযে দাঁড়িয়েছেন এবং সুফলও পেয়েছেন। সারা জীবন দেখেছি, কিন্তু অনুসরণ করতে শিখিনি। বিপদে পড়েই আমরা শুরু করি দৌড়ঝাঁপ, কিংবা হা হুতাশ। ফলে কষ্ট, হয়রানি ও পেরেশানি কমে না, বাড়ে। আব্বা বলতেন, যখন তোমার কোন ঠিকানা থাকে না, নামাযকে বানাও তোমার ঠিকানা। যখন তোমার কোন আশ্রয় থাকে না তখন নামাযের আশ্রয় ভুলে যেয়ো না। নামাযের মাধ্যমে যাকে ডাকবে তিনিই তোমাকে দেবেন নিশ্চিত আশ্রয় ও ঠিকানা।

আমি তাঁকে ডাকলাম। পথের দিশা হারিয়ে ফেলা এবং ঠিকানা খুঁজে না পাওয়া মুসাফিরের ডাক কত করুণ হতে পারে তা ঘরের ছায়ায় বসে আমি বুঝিনি, তুমিও বোঝবে না।

আমি ডাকলাম এবং... এর পরেরটুকু শুনতে চাও? বলতে আমি তো আনন্দই পাবো। আমার গল্প বলা তোমার বিশ্বাসের উদ্যানে যদি একটু জলসিঞ্চন করতে পারে তাহলে আমি কেন কার্পণ্য করবো! শোনো।

ফোন নাম্বার তখন তো খুঁজে পাইনি কাগজের পাতায়, এখন মুনাজাতের মাঝে ভেসে উঠলো মনের পাতায়। আবছা আবছা, কিছুটা মনে পড়ে, কিছুটা মনে পড়ে না। প্রিয় পাঠক, দয়া করে তুমি হাসবে না, মুনাজাত ছেড়েই আমি দৌড়ে গেলাম বিমানবন্দরের কর্মকর্তা পাকিস্তানী ভদ্রলোকের কামরায়, যিনি সেদিন আমাদেরকে তার দিলের হামদর্দি দান করেছিলেন, সেই হামদর্দি যা এখন প্রতিদিন একটু একটু করে কমছে মানুষের দিল থেকে। অনুমানের উপর নাম্বার বললাম, তিনি ডায়াল ঘুরালেন, হলো না।

আমার চারপাশে হতাশা আবার জমাট বাঁধে। কিন্তু ভিতর থেকে যেন আওয়ায এলো, হতাশ হয়ো না, যা কিছু হয় তোমার কল্যাণের জন্যই হয়।

কুণ্ঠিত স্বরে ভদ্রলোককে বললাম, ৯৩ এর পরিবর্তে ৩৯ করুন। তিনি প্রসন্নতার সাথেই করলেন। অপর প্রান্তের কণ্ঠে সম্ভবত প্রসন্নতা ছিলো না। তিনি আফওয়ান বলে রেখে দিলেন। আমি হায় আল্লাহ বলে বসে পড়লাম। এখন যত সহজে বলছি, তখন তত সহজ ছিলো না। আমার দুই হামসফর কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ যোগাযোগের দায়িত্ব ছিলো আমার, এখন ভুলের ভোগান্তি হচ্ছে সবার। ডুবন্তের শেষ চেষ্টা রূপে, এখন মনে নেই, অন্য একটি সংখ্যা বললাম। পাকিস্তানী ভদ্রলোক, আল্লাহ তাকে জাযা দান করুন, কোন বিরক্তি প্রকাশ না করে নাম্বার ঘুরালেন এবং আল্লাহর শোকর! রহমতের ফিরেশতার আওয়ায পাওয়া গেলা। পাকিস্তানী ভদ্রলোকের চেহারা খুশিতে যাকে বলে, গোলাব হয়ে উঠলো, লীজিয়ে, বাত কী জিয়ে বলে তিনি রিসিভার এগিয়ে দিলেন।

আনন্দ এবং ক্ষোভ. দুইয়ের মিশ্রণে আমার গলার আওয়ায নিজের কাছেই অদ্ভুত মনে হলো। সালাম দিলাম, কি দিলাম না, বললাম, নিতে এলেন না যে! তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। তোমরা না আগামীকাল আসছো!

সুবহানাল্লাহ! এতক্ষণে মনে পড়লো ফ্লাইট পরিবর্তনের কথা। এবং তা ঘটেছিলো আমাদের আমীর সাহেবের সৌজন্যে। কী কারণে যেন তিনি ভেবেছিলেন, বাংলাদেশ বিমানের চেয়ে পাকিস্তানের বিমান বেশী আরামদায়ক। সেখবর তো আর আবুধাবিতে আসেনি। কিন্তু আমি মোটেও দমে না গিয়ে বললাম, আজই তো আগামীকাল, এখন কী করি বলুন! তিনি বললেন, রাস্তার দিকে তাকাও এবং কানমলার জন্য প্রস্তুত হও। আমি আসছি।

উপকারটুকু করতে পেরে পাকিস্তানী ভদ্রলোক মনে হলো আমাদের চেয়ে খুশী। আল্লাহর ঘরের মুসাফির শুনে আরো খুশী হলেন। বললেন, আরদে মুকাদ্দাসা মে ইয়াদ রাহে গা না মেরা নাম? (পবিত্রভূমিতে মনে থাকবে তো আমার নাম!) বললাম, আমাদের দেখে কি এতটা অকৃতজ্ঞ মনে হয়? তিনি মৃদু হেসে বললেন, কঠিন পেরেশানির মাঝেও আপনার পুরসুকূন আন্দায আমার ভালো লেগেছে।

বিমানবন্দরের মূল ভবন থেকে বের হয়ে কাঁচঘেরা একটি বিরাট হলঘরে উপস্থিত হলাম। এ ঘরটিরও শীতাতপ  নিয়ন্ত্রিত এবং আরো শীতল। ভিতরে বসেই বাইরের রাস্তা দেখা যায়। পায়চারি করছি আর রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছি কিছুটা অস্থিরতার সঙ্গে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে হয় চাতক পাখী, রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকলে! কোন উপমা খুঁজে পাওয়ার আগেই দেখি তিনি গাড়ী নিয়ে হাজির। কানমলা না দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আল্লাহ তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন। এখন তিনি চরিনিদ্রায় শায়িত। আমার পরম প্রিয় মাওলানা হারুন ইসলামাবাদী।

মোট দশদিন ছিলাম আবুধাবীতে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিলো মাদরাসার কাজ। কিন্তু তিনদিনের অভিজ্ঞতায় বোঝা গেলো, এখানে সবার পড়ে থেকে কাজ নেই। মশওয়ারা হলো, দুজন রওয়ানা হয়ে গেলেন মক্কা শরীফে। মাদরাসার কাজে আমি রয়ে গেলাম আবুধাবীতে।

মাওলানা হারুন সাহেবের ছোহবতে সফরের পুরো দশদিন ছিলো আমার জীবনের স্মরণীয় দিন। পাকিস্তানে কিছুটা হলেও সফরের কসর ছিলো, কিন্তু এখানে তাঁর স্নেহছায়া ঘরের ও সফরের পার্থক্য-রেখা একেবারেই মুছে দিয়েছিলো। তিনি যেমন চিন্তা করেছেন আমার জিসিমের আরামের কথা তেমনি চিন্তা করেছেন আমার কলব ও রূহের খোরাকের কথা।

ওমরা ও হজ্ব কীভাবে করবো, আল্লাহর ঘর কীভাবে তওয়াফ করবো, কীভাবে মদীনার যিয়ারাত করবো এবং দীর্ঘ তিন মাস কীভাবে সফরের পূর্ণ আদব রক্ষা করে চলবো সে সম্পর্কে অনেক মূল্যবান নসীহত তিনি আমাকে করেছিলেন এবং বলেছিলেন, যা পড়েছো এবং যা শুনেছো, সেখানে গিয়ে দেখবে সব ভুলে গেছো, মনের পাতা থেকে সবকিছু মুছে গেছে। শুধু আছো তুমি, আর তোমার সামনে আছে আল্লাহর ঘর। তখন শুধু বলবে, আমি কিছু জানি না, আমি কিছু বুঝি না, তোমার দয়া ছাড়া আমি কোন উপায় দেখি না; তখন গায়ব থেকে আল্লাহর মদদ নেমে আসবে এবং তোমার অজান্তে তোমার কাজ হতে থাকবে। বস্তুত হজ্বের সফরে আল্লাহর মদদ ছাড়া বান্দার কিছুই করার নেই।

তিনি আরো বলেছিলেন, মসজিদে নববীতে তোমার আব্বার নামায আমি দেখেছি, খুব কম মানুষেরই হয় এমন নামায। যেন কামা রাআইতুমুনী ওয়ালা নামায। সেই নামায তুমিও অর্জন করার চেষ্টা করবে।

তিনি তাঁর কর্মস্থল থেকে সাত দিনের ছুটি নিয়েছিলেন আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য। আরো সত্য করে বলি, আমাকে আল্লাহর ঘরের জন্য প্রস্তুর করার জন্য। এটা ছিলো এমন এক সৌভাগ্য যা আমি কল্পনাও করিনি কখনো। সফরের কদমে কদমে, মানযিলে মানযিলে আমি অনুভব করেছি তাঁর ছোহবতের বরকত। আবুধাবীর সর্বমহলে মাওলানা হারুন সাহেবের বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা ছিলো, যেমন হিন্দুস্তানী, পাকিস্তানী ও বাংলাদেশী মহলে তেমনি আরবদের মহলে। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও দাওয়াত, ইফতার মাহফিলে কিংবা তারাবীর পর নৈশভোজে। কোন দিন কোন বাংলাদেশীর ঘরে, কোন দিন কোন পাকিস্তানী বা হিন্দুস্তানীর মাকানে। আবার কোন দিন কোন আরব শায়খের দস্তরখানে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসভবনেও দাওয়াত ছিলো একদিন, আরেকদিন আবু ধাবীর প্রধান বিচারপতি শায়খ আবদুল আযীয আলমোবারকের বালাখানায়। সবখানেই আমাকে তিনি সঙ্গে নিয়ে যেতেন। সেই সুবাদে আবুধাবীর চলমান জীবন ও সমাজের অনেক কিছু দেখার শোনার এবং অনুভব করার সুযোগ আমার হয়েছিলো। সুখের অনুভূতি যেমন ছিলো অল্প কিছু তেমনি দঃখের অনুভূতিও ছিলো অনেক। এখানে সেগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণেও এ সফরনামা পথেই হয়ে যাবে অনেক দীর্ঘ, তাই এখানে আমি তা এড়িয়ে যাবো, যদিও তাতে রয়েছে শিক্ষার বহু উপকরণ। তবে এতটুকু না বলে পারবো না যে, আরব বলো, অনারব বলো সবাই যেন শুধু ছুটে চলেছে ব্যস্ত জীবনের পিছনে। দ্বীনের প্রতি দায় ও দায়িত্ব এবং উম্মতের প্রতি ব্যথা ও দরদ- এগুলো যেন জীবনের কোন অংশ নয়। জীবন যেন শুধু উপার্জনের প্রয়াস এবং আনন্দ ও ভোগবিলাস। সম্মানজনক ব্যতিক্রম অবশ্যই দেখেছি; তবে এটাই ছিলো সেখানকার সমাজজীবনের সাধারণ চিত্র। সব কিছু চলছে শুধু বস্তুজীবনকে কেন্দ্র করে, এমন কি দুই মুসলিম দেশ ইরাক-ইরান যুদ্ধ সম্পর্কেও বড় বড় মাথাগুলোর কোন মাথাব্যথা নেই, এবং সম্ভবত এটা কোন একটি মাত্র মুসলিম জনপদের চিত্র নয়। আরেকটি  বিষয় যা আমাকে খুব বিচলিত করেছে তা হলো অপচয়। এবং তা আমি দেখেছি বিশিষ্ট-সাধারণ সর্বমহলে। শুধু একটি ঘটনা বলি, মাওলানা হারুন সাহেবের কর্মস্থল ছিলো আবুধাবীর বিচারমন্ত্রণালয়। বিচারকদের এক ইফতার মাহফিলে তার দাওয়াত ছিলো। যথারীতি আমি হলাম বিনা দাওয়াতের মেহমান। প্রথা অনুযায়ী ইফতারের পূর্বে সংক্ষিপ্ত আলোচনা হলো রোযার হাকীকত, শিক্ষা ও তাৎপর্য সম্পর্কে। দ্বীনের জন্য সাহাবা কেরাম কত ত্যাগ ও কোরবানী করেছেন, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবা কেরাম ক্ষুধার যন্ত্রণায় কীভাবে পেটে পাথর বেঁধেছেন সে আলোচনাও উঠে এলো অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ভাষায়। ১৭ই রামাযান উপলক্ষে গাযওয়াতুল বদরের শিক্ষাও আলোচিত হলো। আগাগোড়া সুন্দর আলোচনা এবং যথেষ্ট শিক্ষার খোরাক। তবে কবি জিগার মুরাদাবাদীর ভাষায়-

واعظ كا ہر ايك ارشاد بجا تقرير دلچسپ مگر

آنكهوں ميں سرور عشق نہيں چہرے پہ يقين كا نور نہيں.

তোমার সব কথা সত্য এবং বক্তব্য অনবদ্য, কিন্তু হায়

চোখের তারায় নেই প্রেমের উদ্ভাস, চেহারায় নেই বিশ্বাসের আলোর আভাস।

ইফতারের সময় দেখলাম সেই আলোচনা ও শিক্ষার বাস্তব নমুনা! আমাদের সামনে ছিলো খাদ্যের স্তুপ। সামান্য কিছু খাওয়া হলো। বাকি সব ফেলে দেওয়া হলো। অপচয়ের এমন দৃশ্য জীবনে এই প্রথম দেখা। বড় কষ্ট হলো, অক্ষম কষ্ট। মনে পড়লো আমার দেশের ক্ষুধার্ত মানুষগুলোর কথা। এসব খাবার যদি ঢাকা শহরের ডাস্টবিনেও ফেলার ব্যবস্থা করা যেতো কংকালসার বহুশিশু ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকে বেঁচে যেতো।

চেহারার আয়নায় দিলের প্রতিফলন দেখে মাওলানা হারুন সাহেব নিজে থেকেই বললেন, তুমি তো প্রথম দেখেছো, আমি দেখছি বহুদিন। যখন বলার সুযোগ হয় বলিও। কিন্তু প্রাচুর্য দারিদে্র্যর চেয়ে বড় অভিশাপ, এ বড় নির্মম সত্য। আমার তো আশংকা, এদের পরবর্তী প্রজন্ম না এই অপচয়ের ফল ভোগ করে। তবে সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় এই যে, এখানে বাংলাদেশী পরিবারগুলোও অচপয়মুখী, (দু একটি নমুনা আমিও দেখেছি) অথচ দেশে এরা ক্ষুধা ও দারিদে্র্যর বীভৎস রূপ দেখে এসেছে।

এবার অন্য রকম একটি ঘটনা বলি, যা আমি মনে করি, বাইতুল্লাহর মুসাফিরের তারবিয়াতের জন্য ছিলো গায়বি এক ইনতিযাম। আবুধাবীতে আসার দ্বিতীয় দিন আছরের পর মাওলানা হারুন সাহেব আমাকে এবং ফারুক ভাইকে পাঠালেন এক ভদ্রলোকের কাছে, মাদরাসার কাজে। ভদ্রলোক চিটাগাংনিবাসী। বড় ব্যবসায়ী, বিরাট দোকান। ফোনের যোগাযোগে ভদ্রলোক আমাদের যেতে বলেছিলেন। আমরা গেলাম, ঠিকানা মত অনেক দূর পথ হেঁটে। ইফতারের তখন সময় প্রায় হয়ে এসেছে।

ব্যস্ত দোকান। আমরা সালাম দিলাম এবং একপাশে দাঁড়ালাম। তিনি আমাদের দিকে তাকালেন না এবং বসতে বললেন না। অপ্রস্তুত অবস্থায় আমরা অপেক্ষায় থাকলাম। হঠাৎ তিনি আমাদের দিকে ফিরলেন এবং যে ভাষা তার মুখে সাজে সে ভাষায় বললেন, কী জন্য এসেছেন? ভিক্ষা করতে? দেশে বটগাছের ভিক্ষা নাই?....

একটানা অনেক ক্ষণ তিনি মধু বর্ষণ করলেন। মধু শব্দটি আমি সজ্ঞানে ব্যবহার করছি। প্রতিটি শব্দ আমার কাছে সত্যি সত্যি মনে হয়েছিলো ফোঁটা ফোঁটা মধু এবং তাতে ছিলো তায়েফের স্বাদ। এমনই হয় বান্দার প্রতি দয়াময়ের দয়া! পাথরের পরিবর্তে শুধু কথার আঘাতে জখম করে, চৌদ্দশ বছর পরের এক আদনা উম্মতকে জুড়ে দেওয়া হলো তায়েফের জনপদে জখমি নবীর পবিত্র জীবনের সঙ্গে। এর চেয়ে বড় দয়া, এর চেয়ে বড় মায়া আর কী হতে পারে! বাইতুল্লাহর মুসাফিরের জন্য এর চেয়ে বড় পাথেয়ই বা আর কী হতে পারে! তাই সেদিন সেই অপরিচিত মানুষটিকেই মনে হয়েছিলো পরম বন্ধু। আল্লাহ তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন। অন্তরে সেদিন যে স্বাদ ও শান্তির অনুভূতি হয়েছিলো এখনো যেন তার আমেজ রয়ে গেছে। দ্বীনের জন্য যলীল হওয়ার ইযয্ত সবার জুটে না এবং সবসময় জুটে না। শুধু আল্লাহ যখন ইচ্ছা করেন এবং যাকে করুণা করেন।

ফারুক ভাই আমাকে সান্ত্বনা দিলেন এবং আশ্চর্য! তিনি তায়েফের ঘটনা স্মরণ করতে বললেন। দুই দিলের এক চিন্তা আমাকে বড় আনন্দ দিলো।

আমরা সালাম দিয়ে নীরবে চলে এলাম। আযান হয়ে গেলো। আযানের আওয়ায এবং অন্য একটি আওয়ায একসঙ্গে কানে এলো, আইয়ে মওলভীজী, ইফতার লীজিয়ে।

কাছের এক দোকান থেকে দাওয়াত এলো এবং আমার চোখে পানি এসে গেলো। হাতের ইশারায় শুকরিয়া বলে এগিয়ে যেতে চাইলাম। পারলাম না।

দোকানের মালিক নেমে এসে আমাদের নিয়ে গেলেন। পাকিস্তানী অথবা হিন্দুস্তানী। আমি আমার ভিতরে আবার প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম, এটা কি মাটির পার্থক্য? এটা কি রক্তের ব্যবধান? আল্লাহ ভালো জানেন।

সম্ভবত উনিশে রমাযান। শুনতে পেলাম আবুধাবীতে বিশিষ্ট দ্বীনী ব্যক্তিবর্গের এক কাফেলা আগামী কাল রওয়ানা হবে আল্লাহর ঘরে ওমরার উদ্দেশ্যে। স্থলপথের কাফেলা। আমার চেহারায় হয়ত কোন অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছিলো এবং মাওলানা হারুন সাহেব তা বুঝতে পেরেছিলেন। আল্লাহ তাঁকে যত গুণ দিয়েছিলেন তার মাঝে একটি এই যে, মুখের আয়নায় মনের ছবি তিনি দেখতে পেতেন। অবশ্য মাঝে মাঝে এক্ষেত্রে তাঁর ভুলও হতো। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন। যেখান থেকে কাফেলা রওয়ানা হবে তা বেশ দূরে। তবু সকালে যথাসময়ে আমরা পৌঁছলাম। প্রায় সকলেই তার পরিচিত এবং তিনি সবার অন্তরঙ্গ। আমার পরিচয় দিলেন একটু আড়ম্বর করে। আমি বিব্রত বোধ করলাম। প্রয়োজনীয় ব্যস্ততার মাঝেও প্রায় প্রত্যেকে কুশলবিনিময় করলেন। আল্লাহর ঘরের মুসাফিরদের বিদায় জানাতে এসেছি জেনে খুশী হলেন, শুকরিয়া জানালেন। একজন অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে মূল্যবান আতর হাদিয়া দিলেন। এই প্রথম আরবের আলিমদের সংস্পর্শ লাভের সৌভাগ্য হলো এবং আমি অভিভূত হলাম। আচরণে ও উচ্চারণে এঁরা অকৃত্রিম। এঁদের সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি দুটোই নির্ভেজাল। তাকাল্লুফ এঁদের স্বভাবে নেই। ঈমান ও আকীদায় সুদৃঢ়। কোরআন ও সুন্নাহর দলীল পেশ করো, যে কোন সময় যে কোন সত্য মেনে নিতে প্রস্তুত। কূটতর্ক তাঁদের জানা নেই। একজন কী কারণে একটু ক্ষুদ্ধ হলেন। অন্যজন বললেন, ছাল্লি আলান নবী। (নবীর উপর দরূদ পড়ো) তিনি সঙ্গে সঙ্গে দরূদ পড়লেন এবং শান্ত হয়ে গেলেন।

সময়ের আয়তন ছিলো মাত্র দুঘণ্টা। কিন্তু এই সামান্য সময়ের আয়নায় আমি যেন দেখতে পেলাম অতীতের আলোকিত যুগেরও কিছু ছবি। আরবদেশে আরবদের মাঝে আল্লাহর নবী কেন প্রেরিত হলেন? ইসলামের আবির্ভাবকেন্দ্র কেন হলো জাযীরাতুল আরব? এসকল প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাকে এখন আর কিতাব খুলতে হবে না। এঁরা যদি হন এ যুগের আরব, তাহলে কেমন ছিলেন সে যুগের আবর?! মক্কা মদীনার আরব?! কোরায়শ ও আউস-খাযরাজের আরব?! কেমন ছিলেন তাঁরা, মুহূর্তের জন্য হলেও যারা লাভ করেছিলেন সর্বোত্তম নবীর সঙ্গগৌরব এবং সান্নিধ্য সৌরভ?!

মর্মস্পশীর্ মুনাজাত হলো। বৃদ্ধ শায়খ কাঁদলেন এবং কাঁদালেন, তবে যাকে বলে কান্নার রোল, তা নয়। শান্ত কান্না এবং নীরব অশ্রুবর্ষণ। আরবদের মুনাজাতে, কান্নায় এবং অশ্রুবর্ষণেও রয়েছে নিজস্ব সৌন্দর্য। আপনজনদের সঙ্গে বিদায়ের কোলাকুলি হলো। আমিও পেলাম কিছু উষ্ণ আলিঙ্গন। কেন? আমি কি তাঁদের আপনজন! কিসের বন্ধন! দেশের! ভাষা ও গোত্রের! না এটা হলো ইন্নামাল মুমিনূনা ইখওয়াতুন এর বন্ধন, সময়ের ব্যবধানে সন্দেহ নেই আরবরা অনেক নেমে এসেছে, তবে সব সময়ের মত এখনো তারা সবার উপরে এবং অনেক উপরে।

কাফেলা রওয়ানা হলো, আল্লাহর ঘর দীদারের কাফেলা, নবীর রাওযা যিয়ারাতের কাফেলা। যত দূর দেখা যায় তাকিয়ে থাকলাম। বেদনার্ত হৃদয়ে, তৃষ্ণার্ত চোখে। এ কাফেলার যাত্রাপথে তাকিয়ে থাকাও সৌভাগ্য। তারাই পথ চলার সৌভাগ্য অর্জন করে যারা পথের দিকে তাকিয়ে থাকে।

হে আল্লাহ! আমি পারবো তো পথ চলতে! আমি পারবো তো মানযিলে পৌঁছতে! হে আল্লাহ, আমার স্বপ্ন যেন সত্য হয়, তোমার করুণা ও রহমত যেন সঙ্গী হয়।

একবার এশা ও তারাবী পড়লাম আবুধাবীর কেন্দ্রীয় মসজিদে, যদ্দুর মনে পড়ে প্রেসিডেন্ট যায়দ বিন সুলতান আলে নাহিয়ান-এর নামে মসজিদ। পাকিস্তানে অনেক শানদার মসজিদ দেখেছি, কিন্তু এ মসজিদ অনন্য, যেমন আয়তনে তেমনি অবয়বে। মুসল্লী কিন্তু এককাতার এবং তারাবী আলামতারার দশরাকাত। তার চেয়ে মসজিদ যদি হতো খেজুর পাতার, কিন্তু নামায ও নামাযী দ্বারা হতো আবাদ!

তারাবীর পর মাওলানা হারুন সাহেব আমাকে নিয়ে গেলেন সমুদ্রতীরে। অবাক হলাম এদের পয়সা খরচের বহর দেখে! তীর থেকে বহু দূর দিয়ে পানি থেকে সামান্য উঁচু করে প্রাচীর তৈরী হয়েছে, নিরাপত্তাপ্রাচীর। ব্যয় কতশত কোটি ডলার কে জানে! এবং প্রয়োজনীয়তাই বা ছিলো কতটুকু! মুসলিম বিশ্বে দেখা যায়, পশ্চিমা শোষকরা আমাদের শাসকদের মাথায় প্রয়োজনের কিছু কল্পনা এবং অর্থ ব্যয়ের বিরাট বিরাট পরিকল্পনা ঢুকিয়ে দেয়। তারা প্ররোচিত ও প্রলুব্ধ হয়। তাতে জনকল্যাণ হোক বা না হোক, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী পশ্চিমা কোম্পানীগুলোর মুনাফা হয় হাজার হাজার কোটি ডলার। রাতের বেলা দূর থেকে দেখা সমুদ্রতীরের নিরাপত্তাপ্রাচীরকে আমার মনে হলো তেমনি কোন কল্পনা ও পরিকল্পনার ফসল। এখন মনে নেই, সম্ভবত ঐ প্রাচীরের উপর দিয়ে গাড়ী চলাচলেরও ব্যবস্থা ছিলো।

বেড়াবার জন্য সেটা বেশ মনোরম স্থান ছিলো, কিন্তু মন আমার বিনোদনের অবস্থায় ছিলো না। এ মনের শান্তি তো এখন অন্যখানে, অন্য কিছুতে। আমি শুধু ভাবছি, আর কত দূরে আমার মানযিল! পশ্চিমের মুসাফির পূর্বদিগন্তকে জিজ্ঞাসা করে- রাত পোহাবার আর কত দেরী!

দিনের বেলা মাওলানা হারুন সাহেব আমাকে নিয়ে যেতেন বিভিন্ন ইসলামী ও দাওয়াতী সংস্থার দফতরে। তিনি বলতেন ঘুরে ঘুরে দেখো, সবার সঙ্গে কথা বলো এবং সবার কথা শোনো, তোমার অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ হবে। তোমার কাজের ময়দানে এগুলো কাজে আসবে। আমি ঘুরে ঘুরে দেখেছি এবং কিছু অনুভব করার চেষ্টা করেছি। একটা বিষয় আমি বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছি, গোরবত ও দারিদে্র্যর সঙ্গে দ্বীনী কাজ ও দ্বীনী মেহনতের যে হৃদ্যতা রয়েছে প্রাচুর্যের সঙ্গে তা নেই। প্রাচুর্য দ্বারা সাজ যতটা হয় কাজ ততটা হয় না। পরবর্তীতে আমি আমার এ অনুভূতি হযরত হাফেজ্জী হুযূরের খেদমতে নিবেদন করে বলেছিলাম, আমাদের দেশে দ্বীনী খেমদতের জন্য আরবদের পয়সার প্রয়োজন নেই। গোরবতের মাঝে যে কাজ হবে, প্রাচুর্যের মাঝে সে কাজ হবে না। মাওলানা হারুন সাহেবকেও আমি সে কথা বলেছিলাম। আজ এত বছর পরো আমার সে বিশ্বাস অটুট রয়েছে। আমাদের দেশে আল্লাহ এই পরিমাণ সম্পদ রেখেছেন যা দ্বারা দ্বীনের সকল প্রয়োজন হতে পারে, প্রয়োজন শুধু মালদারদের দ্বীনদার হওয়া আর প্রয়োজন আহলে ইলমের দুনিয়া বিমুখ হওয়া। আরবদের কাছে আমাদের যাওয়া প্রয়োজন দ্বীনের দাবী নিয়ে, অর্থের চাহিদা নিয়ে নয়।

বিচার, ধর্ম ও ওয়াক্ফ মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা আলমানারের দফতরে গিয়েছিলাম, শানদার ইমারত, বিপুল আয়োজন। এর একশ ভাগের একভাগ আয়োজন দ্বারা, আমাদের দেশে একটি দ্বীনী পত্রিকা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে চলতে পারে এবং পাঠকদের দ্বীনী প্রয়োজন পুরা করতে পারে।

একদিন গেলাম আরব আমিরাতের জাতীয় দৈনিক আল ইত্তিহাদের কার্যালয়ে। আগে থেকে সময় নেয়া ছিলো, সেদিন মাওলানা হারুন সাহেব সঙ্গে ছিলেন না। পত্রিকার প্রধান সম্পাদক তার দফতরে আমাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করলেন। আমার স্বচ্ছন্দে আরবী বলা তার ভালো লাগলো। তিনি নিজে আমাকে সব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। বিশাল মুদ্রণবিভাগও দেখলাম। এই প্রথম আমি ছাপার ফোরকালার মেশিন দেখলাম। আমাকে বলা হলো, এগুলো মুদ্রণজগতের সর্বশেষ মডেল। আমাদের দেশের জাতীয় দৈনিক হলো ইত্তেফা। নির্বাচনকালে ইত্তেফাকভবনেও আমি গিয়েছি। এখানে দাঁড়িয়ে একটা উপমাই শুধু আমার কল্পনায় এলো, ধনীর দুলালের পাশে এতীম বাচ্চা।

ইত্তেহাদ ও ইত্তেফাক, একই বাবের এবং কাছাকাছি অর্থের দুটি মাসদার। দুদেশের দুটি জাতীয় পত্রিকার শিরোনাম। কিছুক্ষণের জন্য আমি নিমগ্ন হলাম আমার চিন্তার জগতে। ইত্তেফাক তো জানা কথা, আমাদের সম্পদ নয়। ইত্তেহাদও কি আমাদের? বাংলাদেশে কিংবা আবর দেশে, অথবা অন্যকোন দেশে আমাদের আলিমসমাজের হাতে আসলে আছে কি? খুব সাধারণ মানের হোক, তবু বাংলাদেশে হক্কানী আলিমসমাজের একটি দৈনিক পত্রিকার ভীষণ প্রয়োজন। কবে পূর্ণ হবে আমাদের এ স্বপ্ন! হযরত হাফেজ্জী হুযূরের ছত্রচ্ছায়ায় আমাদের পক্ষে কি সম্ভব হবে এ স্বপ্নের বাস্তবায়ন!

আল ইত্তেহাদ প্রকাশনা সংস্থা থেকেই প্রকাশিত হয় ছোটদের সাপ্তাহিক পত্রিকা মাজিদ, আরববিশ্বে ছোটদের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা। এ পত্রিকার সঙ্গে আমি কয়েক বছর আগে থেকেই পরিচিত। আমাদের দেশে আরব আমিরাত দূতাবাস থেকে পত্রিকাটি আমি নিয়মিত পাই। আমার কাজের জন্য বেশ সহায়ক।

ঘুরে ঘুরে পত্রিকাটির সব বিভাগ দেখলাম। এর সম্পাদক আহমদ ওমর আমাকে সঙ্গ দিলেন। আমরা বাংলাদেশ থেকে গরীবানা হালাতে ছোটদের জন্য একটি আরবী পত্রিকা বের করছি এবং আমি তার সম্পাদক, শুনে তিনি খুশী হলেন। আমি তাকে ইকরা পত্রিকার কয়েকটি নোসখা দিলাম। তিনি বিদ্বান ব্যক্তি। তিনি বুঝতে পারলেন, আরবী মাতৃভাষা নয়, এমন ছোটদের জন্য এ পত্রিকার কেন প্রয়োজন। তিনি আমাকে মাজিদ পত্রিকার পিছনের একশটি সংখ্যার বড় একটা প্যাকেট উপহার দিলেন।

অবশেষে আবুধাবীর শেষ দিন উপস্থিত হলো। শৈশব থেকে লালিত আমার হৃদয়ের স্বপ্ন আলোর আরো নিকটবর্তী হলো। আমি আমার স্বপ্নের মানযিল থেকে আর মাত্র একদিনের দূরত্বে রয়েছি। আজকের সূর্যাস্ত এবং আগামী দিনের সূর্যোদয়ের মধ্যবর্তী সময়ে ইনশাআল্লাহ আমি দেখতে পাবো স্বপ্নের সুন্দর তাবীর। মাওলানা হারুন সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার ইহরামের কাপড় আছে তো। এ জিজ্ঞাসার সঙ্গত কারণ আছে। কেননা নাসীরুদ্দীন হোজ্জার অনেকগুলো স্বভাব আমার মধ্যে আছে বলে তিনি জানতেন। আমি হাসি মুখে ভিফকেস খুলে তাকে দেখালাম এবং বললাম, ইহরামের এ লিবাসের পরিচয় বলবো? হযরত হাফিজ্জী হুযূর এই ইহরাম পরে হজ্ব করেছেন। তিনি বললেন, তুমি ভাগ্যবান।

 

 

advertisement