হিফযুন নুসূসি ওয়াল আছার : আয়াত ও হাদীস এবং সালাফের বাণী মুখস্থ করার প্রয়োজনীয়তা ও অপরিহার্যতা
ইসলামে দলীল-প্রমাণের গুরুত্ব অপরিসীম এবং দলীলবিহীন যেকোনো বিষয় ইসলামের দৃষ্টিতে ভিত্তিহীন। দ্বীন ও শরীয়তের সকল বিষয় দলীল দ্বারা প্রমাণিত। এখানে আন্দাজ-অনুমানের কোনো স্থান নেই।
জাগতিক বিষয়েও ইসলামের বিধান-
যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই তার পিছনে পড়ো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ ও হৃদয় প্রত্যেকটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে। (সূরা ইসরা : ৩৬) এবং
কোনো ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এই যথেষ্ট যে, সে যা কিছু শোনে সব বর্ণনা করে।-সহীহ মুসলিম (মুকাদ্দিমা) ৫
পারিবারিক ও সামাজিক বিষয়ে ইসলামের আদেশ-
হে মুমিনগণ! তোমরা অনেক ধারণা পরিহার কর। কারণ কোনো কোনো ধারণা পাপ ...। (সূরা হুজুরাত : ১২) এবং তোমরা ধারণা থেকে বিরত থাক। কারণ ধারণা হচ্ছে নিকৃষ্টতম মিথ্যা।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫১৪৩
দুনিয়াবী বিষয়েই যখন ইসলামের শিক্ষা এই তখন দ্বীন ও শরীয়তের বিষয়ে শিক্ষা কী হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
একথা ঠিক যে, ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য সহজসাধ্যতা। তাই সর্বশ্রেণীর মানুষের উপর দুআ-কালাম ও মাসআলা-মাসায়েল সংক্রান্ত কুরআন-সুন্নাহর নুসূস১ (দলীলের মূল পাঠ) মুখস্থ রাখা ফরয করা হয়নি। এরপরও কিছু ‘নস’ মুখস্থ করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অপরিহার্য। যেমন কালিমাতুত তাওহীদ ও কালিমাতুশ শাহাদাহ, কুরআন মজীদের সূরা ফাতিহাসহ কিছু অংশ এবং নামাযের কিছু দুআ-কালাম। এ থেকেও বোঝা যায়, ইসলামে ‘হিফযুন নুসূস’ বা নুসূস মুখস্থ করার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জীবনের সকল অঙ্গনে যখন শরীয়তের বিধান কার্যকর ছিল এবং সমাজের সর্বস্তরে দ্বীনী ইলমের ব্যাপক চর্চা ছিল তখন একজন সাধারণ মুসলিমেরও কুরআন ও হাদীসের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কণ্ঠস্থ থাকত এবং একটি বড় অংশ এত পরিষ্কার জানা থাকত যে, মুখস্থের মতোই। এমন বহু আম মানুষের আলোচনা তারীখ ও তারাজীমের কিতাবে রয়েছে। অথচ দ্বীনের ধারণ ও বর্ণনার মূল দায়িত্ব তাদের উপর ন্যস্ত ছিল না। এই খিদমতের জন্য তো আল্লাহ তাআলা এমন ব্যক্তিদের নির্বাচন করেছেন, যারা তাঁর ফযল ও করমে অসাধারণ সততা, প্রখর স্মৃতিশক্তি এবং প্রবল কর্মোদ্যমের অধিকারী ছিলেন। তেমনি তাফাককুহ ফিদ্দীন, রুসূখ ফিল ইলম এবং তাকওয়া ও তহারাতের ক্ষেত্রেও ইমাম ছিলেন। বস্ত্তত তাঁরা ছিলেন কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতের বাস্তব দৃষ্টান্ত-
আর আমি তাদের মধ্য থেকে ‘ইমাম’ মনোনীত করেছিলাম, যারা আমার নির্দেশ অনুসারে পথ প্রদর্শন করত। যেহেতু তারা ধৈর্য্যধারণ করেছিল। আর তারা ছিল আমার নিদর্শনাবলিতে দৃঢ় বিশ্বাসী। (সূরা সাজদা : ২৪)
আর তাঁদের সম্পর্কেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভবিষ্যদ্বানী সত্য হয়েছিল-
অর্থাৎ প্রতি যুগে পূর্বসূরীদের নিকট থেকে বিশ্বস্ত উত্তরসূরীরা এই ইলমকে ধারণ করবে। তাঁরা একে রক্ষা করবে সীমালঙ্ঘনকারীদের বিকৃতি, মুর্খদের অপব্যাখ্যা ও বাতিলপন্থীদের মিথ্যাচার থেকে।-আততামহীদ, ইবনে আবদিল বার (মোকাদ্দিমা) ১/৫৮-৫৯
আল্লাহ তাআলা তাদের মাধ্যমে দ্বীন ও দলীলে দ্বীনের হেফাযত করেছেন। তাঁরা শুধু নুসূসে শরীয়তের (কিতাবুল্লাহ, সুন্নাতু রাসূলিল্লাহ, অতপর আছারুস সালাফের) মুল পাঠেরই হাফেয ছিলেন না, নুসূসে শরীয়তের অর্থ ও মর্ম, নুসূসে উল্লেখিত বা অনুল্লেখিত মাকাসেদে শরীয়ত, আহকামে শরীয়তের ইল্লত ও হিকমতের অনুধাবনকারী এবং শরীয়তের কাওয়াইদ ও নীতিমালার মোহাফেয ছিলেন, তদ্রূপ শরীয়তের চিন্তা ও কর্ম এবং রুচি ও স্বভাবের বিশ্বস্ত সংরক্ষক ছিলেন। আর আহকামে শরীয়ত মুখস্থ থাকা ছিল তাঁদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
তাঁদের ‘তরজমা’ ও জীবনী ‘তবাকাতুল কুররা’, ‘তবাকাতুল হুফফায’, তবাকাতুল ফুকাহা’. তবাকাতুল মুফাসসিরীন’, ‘তবাকাতুল আওলিয়া’, ও ‘আলামুন নুবালা’ শীর্ষক অসংখ্য কিতাবের যীনত-সৌন্দর্য হয়ে আছে।
এরপর প্রতি যুগে তাদের নায়েব ও উত্তরসূরীদের অধিকাংশই ছিলেন হাফিযে কুরআন। তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তি ইলমুল হাদীসের পরিভাষায় ‘হাফিয’ (হাদীস ও সুন্নাহ হাফিয) ছিলেন। অন্যরা ইসলামের বুনিয়াদী উলূম ও ফুনূনের এক বা একাধিক কিতাবের হাফিয ছিলেন।
ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. (৮৫২হি.)-এর ‘আদ্দুরারুল কামিনা’; শাওকানী (১২৫০ হি.) এর ‘আল-বাদরুত ত্বালি বিমাহাছিনি মান বাদাল কারনিস সাবি’। সাখাভী (৯০২ হি.)-এর ‘আয-যাওউল লামি’; আলগাযযী (১০৬১ হি.)-এর ‘আলকাওয়াকিবুস সাইরা’; এবং আলমুহিববী (১১১১ হি.)-এর ‘খুলাসাতুল আছার’ প্রভৃতি কিতাবে এমন হাজারো আহলে ইলমের আলোচনা বিদ্যমান রয়েছে।
পরবর্তীতে ‘হিফযুন নুসূস’-এর বিষয়ে অবহেলা ও অমনোযোগিতা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চললেও সব যুগেই সালাফের কিছু নমুনা বিদ্যমান ছিল। আমাদের এই যুগেও আছে, যদিও তাঁদের সংখ্যা নিতান্তই হাতেগোনা। আর প্রয়োজনীয় ও নির্বাচিত নুসূস মুখস্থ রাখেন এমন আলিমের সংখ্যাও মাশাআল্লাহ একেবারে কম নয়। আমাদের এতদাঞ্চলে আমার মতো উদাসীন ইলম-পিপাসুর দল সংখ্যায় ভারি হলেও জরুরি ‘মুনতাখাব নুসূস’ মুখস্থ রাখেন এমন ব্যক্তি এখানেও চোখে পড়ে।
এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনায় না গিয়ে শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা (হাফিযাহুল্লাহু ওয়া রাআহু)-এর একটি মজলিস ও আমার নিজের একটি ঘটনা উল্লেখ করে দেওয়াই যথেষ্ট মনে করছি।
১৪৩০ হিজরীর যিলহজের শেষ দিকে বর্তমান সময়ের বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও মুহাক্কিক শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা আল-হালাবী ছুম্মাল মাদানী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অনেক আলিমকে (যাঁরা তাঁর সাক্ষাতপ্রত্যাশী ছিলেন) দাওয়াত করেছিলেন। মজলিসটি ছিল মদীনার অদূরে একটি কোলাহলমুক্ত মনোরম উদ্যানে। হযরত মাওলানা আরশাদ মাদানী দামাত বারাকাতুহুম ও তাঁর ছোট ভাইও তাশরীফ এনেছিলেন। ঢাকার কয়েকজন আলিমও নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। কিসমত আমাকেও সেই মজলিসে হাজির করেছিল।
দস্তরখানের আগে ও পরে অনেক বিষয়ে কথা হল। মেহমানদের চাপ কিছুটা হালকা হওয়ার পর ‘হিফযে নুসূস’ প্রসঙ্গটি আলোচনায় এল। শায়খ আক্ষেপ করে বললেন, ‘এ বিষয়ে ছাত্রদের উদাসীনতা খুবই দুঃখজনক।’ তিনি আরো বললেন, ‘আমাদের আকাবিরের হালত এমন ছিল না।’
তিনি বিশেষভাবে তাঁর উস্তাদ শায়খ আবদুল্লাহ সিরাজুদ্দীন রাহ. (১৪২০ হি.)-এর স্মতিচারণ করে বললেন, ‘শায়খ রাহ. ছিলেন কুতুবে সিত্তার২ সকল হাদীসের হাফিয।’ ইবনে দাইবাকৃত (৯৪৪ হি.) ‘তাইসীরুল ওসূল ইলা জামিইল উসূল’ কিতাব থেকে তিনি এই হাদীসগুলো হিফয করেছিলেন। কোন হাদীস কোন কিতাবে ও কোন সাহাবীর সূত্রে বর্ণিত, এবং কোন বর্ণনায় অতিরিক্ত কী আছে-এই সকল বিবরণ তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল।
তিনি বলেন, ১৩৭৮ হিজরীতে শায়খ আমাকে বলেছিলেন, দ্বিতীয়বারের মতো ‘মুসনাদে আহমদ’ (যার হাদীস-সংখ্যা প্রায় ত্রিশ হাজার) এর পাঠ সমাপ্ত হল।’ তিনি ‘মুসনাদে আহমদ’ শুধু পড়ে যেতেন না; বরং এ কিতাবের ঐ হাদীসগুলোও মুখস্থ করে ফেলতেন যেগুলো কুতুবে সিত্তায় নেই। তদ্রূপ যে হাদীসগুলোর মূল রেওয়ায়েত কুতুবে সিত্তায় আছে তার অতিরিক্ত অংশটুকুও মুখস্থ করতেন।
এরপর তিনি এক আশ্চর্য ঘটনা শোনালেন। শায়খ আবদুল্লাহ সিরাজুদ্দীনের দুই শাগরিদের মাঝে উস্তাদের কত হাদীস মুখস্থ-এ নিয়ে তর্ক হল। একপর্যায়ে তাদের একজন-আল্লাহ তাকে মাফ করুন-বলে বসল যে,
যদি শায়খ আবদুল্লাহর এক লক্ষ হাদীস মুখস্থ না থাকে, তাহলে আমার বিবি তালাক। (এ ধরনের আচরণ ও উচ্চারণ থেকে আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন।)
এখন শায়খের কাছে জিজ্ঞাসা করা ছাড়া সমাধানের কোনো উপায় ছিল না। কেউ একজন হিম্মত করে তাঁকে জানালেন। যেহেতু শরীয়তের হুকুমের বিষয় তাই শায়খের পক্ষে নিজের অবস্থা গোপন রাখা সম্ভব হল না। তিনি শাগরিদের কাছে ঘটনা শুনলেন এবং বললেন-
‘তোমার বিবি তালাক হয়নি। তবে ভবিষ্যতে এমন কাজ আর করো না।’
ইলমে হাদীসের পরিভাষায় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী ও কর্ম ছাড়াও সাহাবা-তাবেয়ীনের ফতোয়া ও আমলকেও ‘হাদীস’ বলে। তদ্রূপ এক হাদীসের একাধিক সনদ বা রেওয়ায়েত থাকলে প্রতি রেওয়ায়েতকে আলাদা ‘হাদীস’ গণ্য করা হয়। উপরের ঘটনায় ‘হাদীস’ শব্দ এই পারিভাষিক অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।
শায়খ আবদুল্লাহ সিরাজুদ্দীন এ যমানারই মানুষ। ১৪২০ হিজরীতে তাঁর ইন্তেকাল হয়েছে।
শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা বলেন, আমার উস্তাদ ও আমার দেখা শায়খদের মাঝে অন্তত তিনজন ইলমে হাদীসের পরিভাষা অনুযায়ীই ‘হাফেয’ ছিলেন। প্রথমজন শায়খ আবদুল্লাহ সিরাজুদ্দীন রাহ., দ্বিতীয়জন মুহাদ্দিস আহমাদ ইবনুস সিদ্দীক আলগুমারী (১৩২০ হি.-১৩৮০ হি.), তৃতীয়জন মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ ইবনুস সিদ্দীক আলগুমারী (১৪১০ হি.)।
এই দুজনও ‘ইলাল’ ও ‘আসমাউর রিজাল’ শাস্ত্রে বিশিষ্টতার অধিকারী ছিলেন। শায়খ আবদুল্লাহ সিরাজুদ্দীন ছিলেন শরহুল হাদীস, ‘রবতুস সুন্নাহ বিসসুন্নাহ’ ও ‘রবতুস সুন্নাহ বিলকুরআন’ বিষয়ে (অর্থাৎ হাদীসের মর্ম অনুধাবন, হাদীসের আলোকে হাদীসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং কুরআনের আলোকে হাদীসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে) এই দুইজনের চেয়ে অগ্রগামী। এই বিষয়ে তাঁর বিশিষ্টতা ছিল। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর তাঁর সাথে মোলাকাতের সুযোগ হয়েছে এবং সাতাশ বছর সকাল-সন্ধ্যা তাঁর সোহবতে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাঁকে ইলমের কামাল দান করেছিলেন আর আমলের কথা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না।
শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা তাঁর উস্তাদের তাকওয়া ও খোদাভীতি এবং প্রজ্ঞা ও পাত্যি সম্পর্কে দীর্ঘ সময় স্মৃতিচারণ করেছেন, যা লিপিবদ্ধ করলে একটি দীর্ঘ নিবন্ধ প্রস্ত্তত হবে। প্রাসঙ্গিক না হওয়ায় এখানে সেসব কথা আলোচনা করা থেকে বিরত থাকছি।
এবার আমার ঘটনাটি বলি। ১৪২৯ হিজরীর ঘটনা। মক্কা মুকাররামা থেকে জিদ্দার উদ্দেশে বাসে উঠেছি। চালক একজন নওজওয়ান, সম্ভবত সিরীয়। সঙ্গীদের কেউ হয়তো আমার সম্পর্কে তাকে কিছু বলেছেন। আর এসব ক্ষেত্রে তো অতিরঞ্জন আমাদের সাধারণ অভ্যাস। কিছুক্ষণ পর যুবকটি আমার কাছে এল এবং কথাপ্রসঙ্গে বলল, ‘আমাকে গাড়ি চালাতে হয়, সারাদিন ব্যস্ত থাকি, কুরআন মজীদ পড়ার তেমন সময় পাই না; তারপরও আল্লাহর রহমতে চেষ্টা করছি এবং আলহামদুলিল্লাহ, এত পারা হিফয হয়েছে (একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণের কথাই সে বলেছিল)। তোমার সঙ্গীরা তোমার সম্পর্কে অনেক কিছু বলেছেন, আমার জানতে ইচ্ছে করে যে, তোমার কত পারা হিফয হয়েছে?’
প্রিয় পাঠক! এর কোনো জবাব আমার কাছে ছিল না। তাই নীরবতা অবলম্বন কিংবা দীনতা প্রকাশ ছাড়া আর কী উপায় ছিল? আল্লাহ আমাকে মাফ করুন এবং দীনতা পূরণের তাওফীক দান করুন।
প্রথম ঘটনা আমাদের আলিমদের জন্য আর দ্বিতীয় ঘটনা তালিবে ইলমদের জন্য শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। আল্লাহ তাআলা আমার ও আমার তালিবে ইলম ভাইদের মনে হিফয নুসূসের শওক পয়দা করে দিন।
উদাসীনতা : কিছু কারণ
হিফযে নুসূস সম্পর্কে উদাসীনতার কিছু ‘যুক্তি’ সম্পর্কেও আলোচনা করা দরকার। আমার মতে মৌলিক ‘যুক্তি’গুলো নিম্নরূপ :
১. শৈশবে বাবা-মা হাফিয বানাননি। এখন বয়স হওয়ার পর কি হাফিয হওয়া সম্ভব?
২. আগের যমানায় কিতাব ছিল না। তাই মানুষ সকল বিষয় স্মৃতিতে ধারণ করত। এখন তো হাদীস-তাফসীর, ফিকহ-লোগাত সকল বিষয়ে কিতাব আছে, প্রয়োজনের সময় কিতাব খুলে দেখে নেওয়া যায়। কাজেই এখন হাদীস-তাফসীর মুখস্থ করার প্রয়োজন নেই। আর রিজাল-সনদ মুখস্থ করা তো সম্পূর্ণ পন্ডশ্রম!!
৩. কুরআন ও হাদীসের ‘নুসূস’ হচ্ছে হুকুম-আহকামের দলীল। আমাদের তো আহকাম জানাই যথেষ্ট, দলীল জানার প্রয়োজন নেই। কখনো প্রয়োজন হলে কিতাব আছে, কুতুবখানা আছে। অতএব মুখস্থ করার প্রয়োজন কী?
৪. ‘ফাহম’ ও ‘ইসতিদাদ’ অর্থাৎ নুসূস ও ইবারত বোঝাই হল মূল মাকসাদ। মুখস্থ করার প্রয়োজন নেই।
৫. দোয়া ও যিকর একে তো মুস্তাহাব পর্যায়ের বিষয়, দ্বিতীয়ত নামায-কালামের কিছু দোয়া মুখস্থ রাখাই যথেষ্ট। সুতরাং দোয়া ও যিকির সংক্রান্ত আয়াত-হাদীস মুখস্থ করার কী প্রয়োজন?
৬. জুমার বয়ান ও মাহফিলের ওয়াজের জন্যও নুসূস মুখস্থ রাখার প্রয়োজন নেই। কারণ একটি আয়াত বা একটি হাদীস তেলাওয়াত করেই তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা বয়ান করা যায়।
৭. মাসআলা-মাসায়েল সাধারণত বলা হয় আম মানুষের প্রশ্নের উত্তরে। তাদের যেহেতু দলীল বোঝার যোগ্যতা নেই তাই আমাদেরও দলীল বলার প্রয়োজন হয় না। কাজেই দলীল মুখস্থ রাখারও প্রয়োজন নেই।
৮. এখানে হিফযে নুসূসের পরিবেশ নেই। হিফযে কুরআনের ব্যবস্থা যা আছে তা কেবল শিশু-কিশোরদের জন্য। অর্থাৎ যারা হিফযখানায় ভর্তি হয় তাদের জন্য। আর হিফযে হাদীসের জন্য তো হিফযখানাও নেই। তাছাড়া পরিচিত-অপরিচিত কাউকেই তো নুসূস মুখস্থ করতে দেখি না। তাহলে আমি একা কীভাবে মুখস্থ করব?
৯. ‘হিফযে নুসূস’ আমাদের নেসাবেও নেই এবং এর জন্য কোনো ঘণ্টাও বরাদ্দ নেই।
১০. সবচেয়ে বড় কথা এই যে, আগের যুগে মানুষের মেধা ও স্মৃতিশক্তি অনেক ভালো ছিল। আমরা দুর্বল, আমাদের স্মৃতিশক্তিও দুর্বল। তাই বড় কিছু মুখস্থ করা আমাদের পক্ষে শুধু কঠিনই নয়, একপ্রকার অসম্ভবই বটে।
আমার ধারণা, ‘হিফযে নুসূস’ থেকে বঞ্চিত হয়েও এইসব ‘যুক্তি’র জোরেই আমরা নিজেদেরকে সন্তুষ্ট করে রেখেছি। যেন তা দোষের কিছু নয়; বরং এ যুগে এমন হওয়াই বাঞ্ছনীয়। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!
একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে, এগুলো ‘যুক্তি’ নয়, নিতান্তই খোঁড়া অজুহাত। চিন্তার সুবিধার্থে কিছু কথা আরজ করছি। আশা করি আমরা নিজেদের দোষ ও দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন হব এবং মিথ্যা অজুহাতে প্রবঞ্চিত না হয়ে নিজেকে গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করব।
১. মুখস্থ করার কোনো বয়স নেই
তালাবুল ইলম বা ইলম অন্বেষণ যেমন সারা জীবনের কাজ তেমনি ‘হিফযে নুসূসও’ সারা জীবনের কাজ। কারণ এটিও তালাবুল ইলমেরই অংশ।
সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে প্রতি যুগে বয়স্ক ও প্রবীণ মানুষেরাও কুরআন মজীদ শিখেছেন ও কুরআন হিফয করেছেন। বরং অধিকাংশ সাহাবা তো কুরআনের নেয়ামত লাভ করেছেন প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছার পর।
যদিও একথা সত্য যে, ‘আলহিফযু ফিস সিগার কান নাকশি ফিল হাজার’ অর্থাৎ শৈশবে মুখস্থ করা পাথরে খোদাই করার মতো। তবে একথাও মিথ্যা নয় যে, অর্থ বোঝা ও মনোযোগ দিয়ে পড়া হিফযের পক্ষে অতি সহায়ক। কাজেই মুতাওয়াসসিতা ও উপরের দিকের তালিবে ইলম এবং নেসাব সমাপ্ত করে তাদরীসের খিদমতে যোগদানকারী সবাই কিছু কিছু করে হিফযে নুসূসের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে পারেন।
আরবের নেসাবে প্রতি শ্রেণীতেই হিফযে কুরআন ও হিফযে হাদীস রয়েছে। কুল্লিয়া ও মাজিসতীরও এর ব্যতিক্রম নয়। তারা তো বয়েস হওয়ার পরও কুরআন-হাদীস হিফয করছে।
আরবের কোনো কোনো মুদাররিসকে অবাক হয়ে বলতে শুনেছি যে, শৈশবে হিফযে কুরআনের সুযোগ না হলে পরে তার চিন্তাই করা যাবে না-এ কেমন কথা! দরসিয়াতের সাথে কি অল্প অল্প হিফয জারি রাখা যায় না?
আরবে আম রেওয়াজ আছে যে, ছাত্ররা দুপুর পর্যন্ত মাদরাসা বা স্কুলে পড়ে। আসরের পর (সেখানে আসর মিছলে ছানীতে পড়া হয়।) মসজিদের হিফযখানায় পড়ে। এভাবে কয়েক বছরে তারা হাফিয হয়ে যায়।
একদিকে দাবি করা হয় যে, এদেশের ছেলেদের মেধা ও স্মৃতিশক্তি পৃথিবীর সকল দেশের ছেলেদের চেয়ে ভালো, অন্যদিকে এই অজুহাত খাড়া করা হয় যে, শৈশবে বাবা-মা হিফযখানায় দেননি!!
হিফযখানায় ভর্তি হওয়া ছাড়া যদি হিফয করা সম্ভবই না হয় তাহলে তো দাওরায়ে হাদীসের পরও হিফযখানায় ভর্তি হওয়া যায়। আমাদের হামসবক ও মুখলিস দোসত মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ ইবনে আবুল খায়ের ইবরাহীম রাহ. (১৩৮৯ হি.-১৪২৯ হি.) জামিআতুল উলূমিল ইসলামিয়া বিন্নূরী টাউনে ১৪০৭ হি.-১৪০৮ হিজরীতে দাওরায়ে হাদীস পড়েন। এরপর দুই বছর হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নুমানী রাহ. (১৩৩৩ হি.-১৪২০ হি.)-এর কাছে উলূমুল হাদীস পড়েছেন। দু’ তিন বছর করাচির এক মাদরাসায় শিক্ষকতার পর দেশে ফিরে মিফতাহুল উলূম বাড্ডা মাদরাসায় সম্ভবত দুই বছর তাদরীসের খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। এরপর দাউদকান্দির কাছে এক অজপাড়াগাঁয়ের একটি হেফযখানায় ভর্তি হয়ে প্রায় নয় মাসে হিফয সম্পন্ন করেছেন। এখন তিনি তার হাতে গড়া বাগান-(গোপালগঞ্জ, ভবানীপুর মাদরাসায়) চির নিদ্রায় শায়িত আছেন। এক পুত্র ও ছয় কন্যা রেখে গেছেন। আল্লাহ তাদের হেফাযত করুন।
তাঁর কথা যখনই চিন্তা করি তখনই আমার কুরআনে হাকীমের এই আয়াত মনে পড়ে-
মুমিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে তাদের কৃত অঙ্গিকার পূর্ণ করেছে। তাদের কেউ কেউ শাহাদাত বরণ করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে। তারা তাদের অঙ্গিকারে কোনো পরিবর্তন করেনি। (সূরা আহযাব : ২৩)
যেন মেহেরবান মাওলার সাথে কৃত অঙ্গিকার পূরণ করার পর তিনি অপেক্ষায় ছিলেন। পরিশেষে পিতার ইয়াদত ও ইসতিকবালের জন্য ঘর থেকে বের হলেন এবং সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মাওলায়ে কারীমের সাথে মিলিত হলেন।
যাই হোক, হিফযে কুরআন, হিফযে হাদীস তথা হিফযে নুসূসের কোনো বয়স নেই। কাজেই বয়সের বাহানায় আমরা যেন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবহেলা না করি।
২. মা লা য়ুদরাকু কুল্লুহু লা য়ুতরাকু কুল্লুহু
শুধু ইলম নয়, যেকোনো খায়ের ও কল্যাণের ক্ষেত্রেই মূলনীতি হচ্ছে, ‘ মা লা য়ুদরাকু কুল্লুহু লা য়ুতরাকু কুল্লুহু’ অর্থাৎ পূর্ণ অর্জন সম্ভব না হলে অন্তত পূর্ণ বঞ্চনা থেকে বাঁচার চেষ্টা করা উচিত।
হিফযের বিষয়েও এই মূলনীতি মনে রাখা কর্তব্য। হযরত মাওলানা আবরারুল হক হারদূয়ী রাহ.-এর মুখে তাঁর একজন বয়স্ক মুরীদের কথা শুনেছি, যিনি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত, হিফযে কুরআনের ফযীলত শুনে হিফয শুরু করেছেন এবং অল্প অল্প করে হিফয করছেন। আঠারো বছর যাবত অন্য সকল কাজের সাথে তাঁর এই মেহনত জারি আছে। হযরত হারদুয়ী রাহ. বলেছিলেন, ‘হিফয সমাপ্ত হওয়ার আগেই যদি তার মওত এসে যায় তাহলেও সমস্যা নেই। কারণ মাকসাদ তো ‘হাফেয হওয়া’ নয়; মাওলার মহববতের হক আদায় করা। এটা তো অবশ্যই হাসিল হবে।’
মোটকথা, উপরোক্ত মূলনীতি অনুযায়ী আমরা অন্তত খুনতাখাব ও নির্বাচিত নুসূস হিফয করার সংকল্প করতে পারি এবং ‘আস সা’য়ু মিন্নী ওয়াল ইতমামু মিনাল্লাহ’ বলে নির্দিষ্ট রুটিন অনুসারে অল্প পরিমাণে হলেও হিফযের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে পারি।
৩. গ্রন্থনা কি গ্রন্থ-নির্ভর হওয়ার জন্য?
ইসলামী ‘উলূম’ ও ‘ফুনূন’ যেমন হাদীস-সীরাত, আছারে সাহাবা-আখবারুস সালাফ, ফিকহে ইসলামী ইত্যাদির গ্রন্থনা ও সংকলন আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নেয়ামত। এইসব ইলম ও ফন সংকিলত হওয়ার যৌক্তিক কারণ রয়েছে এবং তা ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম উজ্জ্বল অধ্যায়। কিন্তু এর উদ্দেশ্য এই ছিল না যে, ইলম-অন্বেষীরা তাদের স্মৃতিশক্তিকে অকেজো করে সম্পূর্ণ গ্রন্থ-নির্ভর হয়ে পড়ুক; বরং উদ্দেশ্য ছিল, দ্বীনী ইলম ও ফন মনীষীদের স্মৃতির পাতার সাথে গ্রন্থের পাতাতেও সংরক্ষিত হোক, যাতে পঠন-পাঠন এবং চর্চা ও ধারণ সহজতর হয়। অতএব সালাফের এই মহান খেদমতের কদরদানী করা এবং তালীম ও তাদরীসের পাশাপাশি হিফযের সিলসিলা জারি রাখাও আমাদের কর্তব্য।
আমাদের পূর্বসূরীরা গ্রন্থ ও গ্রন্থনাকে হিফযের মেহনত থেকে অব্যাহতির অজুহাত বানাননি। তাদের নিকট যেমন কিতাব ছিল তেমনি কিতাবের তথ্যাবলি বা তার উল্লেখযোগ্য অংশ কণ্ঠস্থও ছিল। গ্রন্থের অজুহাতে স্মরণশক্তিকে অকেজো রাখা তালিবে ইলমের পতন-যুগের বৈশিষ্ট্য। একথাও মনে রাখা উচিত যে, হিফযে নুসূসের পরামর্শ দ্বীন ও ইলমে দ্বীনের হেফাযতের জন্য নয়; বরং নিজের হেফাযতের জন্য এবং নিজের ঈমান-আমল ও জ্ঞান-বুদ্ধিকে রক্ষা করার জন্য। এই জন্য গ্রন্থনা ও সংকলনের পর মুখস্থ করার প্রয়োজন নেই মনে করা বোকামি ও নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কী হতে পারে?
৪. ‘মুরাজাআত’ একটি সাময়িক প্রয়োজন, আলিমের মূল বৈশিষ্ট্য নয়
‘সবকিছু কিতাবে লেখা আছে, প্রয়োজনের সময় মুরাজাআত করা যাবে বা দেখে নেওয়া যাবে’-এটা আলিমসুলভ চিন্তা নয়। আলিম কেন, একজন তালিবে ইলমের জন্যও তা শোভনীয় নয়। এটা তো আম লোকের চিন্তা। তারা যেমন মনে করে, ‘আমাদের কুরআন-হাদীস পড়ার দরকার নেই, হুজুররা আছেন, প্রয়োজনে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করে নিব’, আমরাও কিতাব সম্পর্কে এরকম চিন্তা করি। আমরাও মনে করি, প্রয়োজনের সময় কিতাব দেখে নিব, অধ্যয়ন বা মুখস্থ করার প্রয়োজন নেই।
ইমাম আবদুল মালিক ইবনে কুরাইব আলআসমায়ী রাহ. (২১৬ হি.) একটি তিক্ত সত্য পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন। তিনি বলেন, ‘কিছু লোক আছে, যাদেরকে আলিম বলা হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা আলিম নয়। কারণ তাদেরকে কিছু জিজ্ঞাসা করা হলে বলে, জ্বী, এ বিষয়ে আমার কাছে তথ্য আছে, তবে কিতাবের সিন্দুকে!! (জামিউ বয়ানিল ইলমি ও ফাযলিহি, ইবনে আবদিল বার ১/১০৮৯)
ভেবে দেখা উচিত যে, দ্বীনের ‘মাবাদিয়াত’, ‘জরুরিয়াত’ ও সাধারণ মাসআলার ক্ষেত্রেও যদি মানুষকে কিতাব দেখার অপেক্ষায় থাকতে বলা হয় তাহলে এর চেয়ে হাস্যকর বিষয় আর কী হতে পারে? জানা না থাকলে ‘লা-আদরী’ বলা জরুরি ও প্রশংসনীয়, কিন্তু একজন আলিমের হালত এমন হওয়া নিতান্তই লজ্জাজনক যে, দিন রাত তাকে শুধু ‘লা-আদরী’ই বলে যেতে হয়। এই লজ্জা দূর করা অপরিহার্য। (আলমুয়াফাকাত)
আরেকটি বিষয় এই যে, তাৎক্ষণিক কিতাব দেখার দ্বারা কোনো বিষয়ের সকল দিক সামনে আসে না, উপরন্তু তাড়ার কারণে কখনো কখনো ভুলও হয়ে যায়। এজন্য তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে কিতাব দেখার দ্বারা যে ইলম হাসিল হয় তা নিতান্তই নাকিস ও অসম্পূর্ণ ইলম। (মুকাদ্দিমায়ে ফাতাওয়া খলীলিয়াহ)
অভিজ্ঞতা বলে যে, এই ধরনের মৌলভী কখনো তাফাক্কুহ ফিদ্দীন ও রুসূখ ফিল ইলম হাসিল করতে পারে না। (আলইনতিকা, ইবনে আবদিল বার, শায়খ আবদুল ফাত্তাহ রাহ.-এর পরিশিষ্ট; সফহাতুন মুশরিকাহ মিন তারীখি সামাইল হাদীস ইনদাল মুহাদ্দিসীন, শায়খ আবদুল ফাত্তাহ)
এইজন্য কেবল ‘মুরাজাআতে’র উপর নির্ভর করা উচিত নয়; বরং উসূল ও আদাব মোতাবেক মুতালাআর পরিধি বাড়ানো উচিত। ইলমের একটি নির্বাচিত অংশ কণ্ঠস্থ থাকা চাই এবং আহলে ফিকহ ও আহলে দিলের সোহবতে থেকে তাফাক্কুহ ফিদ্দীন ও তাযকিয়া-তহারাত হাসিলের চেষ্টা করা চাই। যাতে এমন না হয় যে, জীবনভর শুধু ইলমের পথঘাট জেনেই তুষ্ট থাকা হল, ইলমের মেহমানদারী অর্জনের সৌভাগ্য হল না।
৫. শুধু কিতাব বোঝার যোগ্যতা ইলম নয়
এটিও একটি স্বীকৃত ও স্বতঃসিদ্ধ কথা। কিতাব বোঝার যোগ্যতা তো ইলমের চাবি। এটা যদি ব্যবহারই না করা হয় এবং ইলমের খাযানা থেকে মণিমাণিক্য স্মৃতির ভান্ডারে সঞ্চয় না করা হয় তাহলে কি ইলমের অধিকারী বলা যায়?
কেউ হয়তো ফাহম ও ইসতিদাদ আর তাফাক্কুহ ফিদ্দীনকে এক বস্ত্ত মনে করেন। অথচ তাফাক্কুহ এক উঁচু মাকামের নাম, ফাহম ও ইসতিদাদ যার একটি সিড়ি এবং অবশ্যই অতি গুরুত্বপূর্ণ সিড়ি। কিন্তু কেউ যদি তা ব্যবহারই না করে তাহলে ঐ উঁচু মনযিলে পৌঁছবে কীভাবে?
জ্ঞানী লোকেরা অনেক আগেই বলে গেছেন যে, জ্ঞানের বাহু দুইটি : তথ্যজ্ঞান ও চিন্তাশক্তি। অতএব কোনো একটির অভাব হলে জ্ঞানের আকাশে উড্ডয়ন অসম্ভব। জাহিয বলেন-
অর্থাৎ যখন স্মৃতি ও চিন্তার মিলন ঘটে তখন ফলাফল হয় অভাবনীয়।
বস্ত্তত এই দুই বৈশিষ্ট্য অর্জনের প্রেরণা ছাড়া আমরা তালিবে ইলম হতে পারি না।
৬. দুআ ও যিকির মুস্তাহাব নয়, জরুরি
কিছু ব্যতিক্রম বাদে অধিকাংশ দুআ ও যিকর (যেগুলোর নির্ধারিত পাঠ রয়েছে) ফিকহী হুকুমের বিচারে মুস্তাহাব হলেও ফায়েদা ও ফলাফলের বিচারে অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ঈমান-আমলের পূর্ণতা, মজবুতি, তাওহীদ ও তাওয়াক্কুলের আখলাক ও চরিত্রের ইসলাহ, সর্বোপরি আল্লাহ তাআলার ইশক ও মহববত পয়দা করার ক্ষেত্রে এর প্রভাব অনস্বীকার্য। যিকর ও দুআর এই বড় বড় ফায়েদা সম্পর্কে আমরা যদি সচেতন হতাম তাহলে এর আইনি হুকুমের অজুহাতে গাফলত ও উদাসীনতার পরিচয় দিতাম না। আমি সাথীদেরকে বলব, আপনারা শুধু মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.-এর পুস্তিকা ‘সীরাতে মুহাম্মাদী দুআওঁ কে আয়নে মে’ এবং মাওলানা মুহাম্মাদ মনযুর নুমানী রাহ.-এর ‘মাআরিফুল হাদীস’-এর আদইয়া ও আযকার অধ্যায়টি পাঠ করুন। ইনশাআল্লাহ দুআ ও যিকরের ফায়েদা আপনাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং এ সংক্রান্ত হাদীসসমূহ হিফয করার ও আমলে আনার জযবা পয়দা হবে।
বস্ত্তত হিফযে নুসূসের বিষয়ে অবহেলার মূল কারণ হিম্মত ও সাহসের অভাব এবং ঈমান ও আমলে তরক্কির অনীহা। তিক্ত ও দুর্বোধ্য হলেও কথাটা সত্য। আল্লাহ তাআলা আমাদের মাফ করুন এবং সংশোধনের তাওফীক দিন।
৭. জানদার ও শানদার আলোচনায় নুসূস ও হাওয়ালা অপরিহার্য
এটা ঠিক যে, মাসআলার সাথে দলীল বা দলীলের ‘নস’ উল্লেখ করা সর্বক্ষেত্রে জরুরি নয়। তেমনি ওয়াজ-নসীহতেও আয়াত-হাদীসের উদ্ধৃতি সর্বদা অপরিহার্য নয়। সর্বাবস্থায় যা জরুরি তা হল, মাসআলা সহীহ হওয়া এবং ওয়াজ-নসীহত ‘ওয়াজ’ ও ‘নসীহত’ হওয়া। সালাফের ফকীহগণের ফতোয়া ও মুসলিহ-সংস্কারকদের ওয়াজ-নসীহত সনদসহ সংরক্ষিত আছে। তাঁরা ফতোয়া বা ওয়াজে সর্বদা দলীল ও হাওয়ালা উল্লেখ করা জরুরি মনে করতেন না। যদিও হাওয়ালা ও দলীল তাদের জানা ছিল এবং অধিকাংশ দলীল, বিশেষত প্রসিদ্ধ মাসআলার দলীলসমূহের মূল পাঠও কণ্ঠস্থ ছিল। প্রয়োজনের সময় তারা তা পেশ করতেন। সুতরাং ‘ওয়াজ ও মাসআলায় সাধারণ অবস্থায় দলীল বলার প্রয়োজন হয় না’-এই কথাটিকে দলীল না-জানা বা জরুরি দলিল মুখস্থ না-রাখার অজুহাত তাঁরা বানাননি। পক্ষান্তরে আমরা একে অজুহাত বানিয়েছি। ফলে সালাফ ও আকাবিরের পথ থেকে আমরা সরে যাচ্ছি। অথচ তাদের তুলনায় দলীল মুখস্থ করার প্রয়োজন আমাদের অনেক বেশি। কারণ ইলম ও তাকওয়ায় সালাফের মাকাম এত উঁচু ছিল যে, তাঁদের কথা ও কাজ ছিল শরীয়তেরই তরজুমান-প্রতিচ্ছবি। ফলে তাঁদের প্রতি মানুষের পূর্ণ আস্থা ছিল। দ্বিতীয়ত সে সময়ের মানুষও সাধারণত সহজ-সরল ছিলেন, অবিশ্বাস ও হঠকারিতা কম ছিল। ফলে দলিল উল্লেখ করার প্রয়োজন সাধারণত হত না। এখন দুই তরফেই অবনতি হয়েছে। অহংকার ও আত্মতুষ্টির বিস্তার ঘটেছে এবং নেক লোকেরাও নিজেদের অজান্তে মানুষকে আলিমদের সম্পর্কে আস্থাহীন করছেন। এ অবস্থায় জরুরি নুসূস ও দালায়েল যদি মুখস্থ না থাকে তাহলে আপনাকে বলতে হবে যে, আমার দলিল আলমারিতে! একটু অপেক্ষা করুন, এনে দিচ্ছি!
জটিল ও সচরাচর ঘটে না-এমন ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ ক্ষমাযোগ্য হলেও যা সব সময়ের প্রয়োজন এমন সাধারণ বিষয়ে তা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে?
যেখানে অমুসলিম মিশনারী ও বেদ্বীন-মুলহিদ এবং বিদআতী ও গোমরাহ লোকেরা আম মানুষকে ভুল দলীল বা দলীলের ভুল ব্যাখ্যা দ্বারা বিভ্রান্ত করছে সেখানে আহলে হক আলিমদের জন্য কি এই সুযোগ আছে যে, দলীল উল্লেখ করা তো দূরের কথা, দলীল জানা ও গুরুত্বপূর্ণ দলীল মুখস্থ রাখার বিষয়েও অবহেলা করবেন? যেখানে নসের সঠিক উচ্চারণে অক্ষম লোকেরা ইসলামের গবেষক ও চিন্তাবিদ এবং আয়াত-হাদীসের ভাবার্থ নিজের ভাষায় বলে আয়াত-নম্বর ও কিতাবের নাম উল্লেখে তৎপর তখন যদি আমাদের তলাবা-মুদাররিসীন ও খতীব-ওয়ায়েজীনকে কথায় কথায় ‘লা-আদরী’ বলতে হয় কিংবা দেখে বলার জন্য সময় নিতে হয় তাহলে আমাদের অবস্থানটা কী দাঁড়ায়? এখনও যদি আমরা সচেতন না হই তাহলে আর কবে?
বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্বীন ও শরীয়তের সফল ও সময়োপযোগী উপস্থাপনার জন্য শুধু দলীল নয়, দলীলের ‘নুসূস’ এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনীয় হাওয়ালা-উদ্ধৃতিও উল্লেখ করা জরুরি। এ বিষয়ে উদাসীনতার সুযোগ নেই। কাজেই অতি প্রয়োজনীয় ‘নুসূস’ হাওয়ালাসহ ইয়াদ করা, অন্তত ইয়াদের চেষ্টা করা আমাদের উপর ফরয।
হাওয়ালার গুরুত্ব বোঝার জন্য তলাবায়ে কেরাম শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.-এর কিতাব ‘সাফাহাত মিন সাবরিল উলামা’ এর তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকাটি অধ্যয়ন করতে পারেন।
৮. নেসাবের একটি অংশ ‘মাহফুযাত’
মাহফূযাত বা হিফযযোগ্য নুসূস নেসাবে নেই-এ কথা ঠিক নয়। কারণ তালিবে ইলমের ঈমানী যিন্দেগী এবং ইলমী ও আমলী যিন্দেগীর জন্য যা কিছু জরুরি সবই তার নেসাবের মধ্যে শামিল। অতএব হিফযের বিষয়টিও তাতে রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। যদি মাদরাসার নির্ধারিত নেসাবের কথা বলেন, তাহলে প্রশ্ন হল, এই নেসাবের বাইরে অনেক প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় বিষয় কি আমরা শিখছি না? সেসব বিষয়ের মধ্যে হিফযে নুসূস অগ্রাধিকার না পাক, অন্তর্ভুক্ত তো হতে পারে।
এরপরের কথা হল, আমাদের দেশের চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ মাদরাসা-নেসাবের এই দুর্বলতা (হিফযে নুসূসের বিষয়ে অবহেলা) দূর করার পদক্ষেপ নিচ্ছেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে হিফযে কুরআন ও হিফযে হাদীস নেসাবে শামিল হয়েছে এবং কোথাও কোথাও ‘মাওয়াদ্দে ইযাফিয়্যাহ’ বা সম্পূরক বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে। দারুল উলূম দেওবন্দের কোনো কোনো উস্তায তালিবে ইলমদের জন্য ‘মাহফুযাত’ নামে কিছু সংকলন প্রস্ত্তত করেছেন। এদেশেও হিফযের জন্য কিছু মুনতাখাব মজমুআ তৈরি হয়েছে। আততরীক ইলাল আরাবিয়্যা কিতাবটির শেষেও কুরআন মজীদের আয়াত ও হাদীস শরীফের একটি সংক্ষিপ্ত সংকলন রয়েছে। তদ্রূপ নূরানী শিক্ষার নেসাবেও হিফযে হাদীসের বিষয়টি রয়েছে।
৯. চর্চার দ্বারা স্মৃতিশক্তি বাড়ে
সম্ভবত আমরা মনে করি যে, স্মরণশক্তি একান্তই জন্মগত, এখানে অর্জনের কিছু নেই। এই ধারণা পুরোপুরি ঠিক নয়। কারণ চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে স্মৃতিশক্তিকে প্রখর ও শাণিত করা যায়। এদিক থেকে তা অর্জনযোগ্যও বটে। তেমনি এই ধারণাও ঠিক নয় যে, সালাফের প্রত্যেকেই অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন এবং শোনামাত্রই তাদের মুখস্থ হয়ে যেত! নিঃসন্দেহে তাঁদের অনেকেই এমন ছিলেন, তবে অসংখ্য ব্যক্তি এমনও ছিলেন, যাদের মেহনত করে মুখস্থ করতে হত। তাঁরা মনোযোগ সহকারে শুনতেন, বারবার শুনতেন, খাতায় লিখতেন, আলোচনা করতেন এবং লেখার পর বার বার পাঠ করতেন।
রিজালের কিতাবে এই মন্তব্য পাওয়া যায় যে, অমুকের স্মরণশক্তি স্বভাবজাত আর আমাদের স্মরণশক্তি চর্চার ফল। অর্থাৎ তিনি স্বভাবগতভাবেই তীক্ষ্ম ও প্রখর স্মরণশক্তির অধিকারী ফলে সবকিছু সহজেই তার মনে থাকে। পক্ষান্তরে আমাদেরকে পরিশ্রম করে মুখস্থ করতে হয়।
ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ রাহ. (১৬১ হি.-২৩৮ হি.) ইমাম ওকী ইবনুল জাররাহ (১২৮ হি.-১৯৭ হি.) সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছেন।
(তাহযীবুত তাহযীব ১১/১৩০)
এটি একটি স্বীকৃত কথা যে, যেকোনো মানবীয় গুণ চর্চার দ্বারা শানিত ও বিকশিত হয়। আর চর্চাহীনতার কারণে দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। আমাদের স্মরণশক্তির দুর্বলতার অন্যতম কারণ চর্চাহীনতা।
জাহেরী কারণের পাশাপাশি স্মরণশক্তি দুর্বল হওয়ার কিছু বাতেনী কারণও আছে। একটি মারাত্মক কারণ গুনাহ ও অশ্লীলতা থেকে পরহেয না করা। ওকী ইবনুল জাররাহ রাহ. সম্পর্কে এইমাত্র বলা হয়েছে যে, তিনি সহজাত স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন, মুখস্থ করার জন্য তাকে পরিশ্রম করতে হত না। তাঁর সম্পর্কেই আলী ইবনে খাশরাম বলেছেন-‘আমি ওকীকে দেখেছি এবং কখনো তার হাতে কিতাব দেখিনি। সবকিছু তার স্মৃতিতে অঙ্কিত থাকত। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘স্মরণশক্তির ওষুধ কী?’ তিনি বললেন, ‘গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। স্মরণশক্তির জন্য এর চেয়ে বড় ওষুধ আমার জানা নেই।’
(তাহযীবুত তাহযীব ১১/১২৯)
ইমাম বুখারী রাহ. সম্পর্কে কে না জানে? তিনিও স্মরণশক্তির জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করেছেন। তাঁর অভিজ্ঞতা হল, স্মৃতিশক্তির জন্য ‘নাহমাতুর রাজুল’ ও ‘মুদাওয়ামাতুন নাযার’ অর্থাৎ গভীর আগ্রহ ও পুনঃ পুনঃ পঠন অতি সহায়ক। ইমাম আবু হানীফা রাহ. বলেছেন, ‘হিফযের জন্য একাগ্রতা ও ঝামেলামুক্ততার প্রয়োজন।’ কোনো কোনো মনীষী স্মরণশক্তির জন্য ওষুধও সেবন করতেন।
মোটকথা, আমাদের পূর্বসূরীরা মুখস্থ করার জন্য অনেক পরিশ্রম করেছেন এবং স্মরণশক্তি বৃদ্ধি ও রক্ষার জন্য জাহেরী ও বাতেনী বিভিন্ন উপায়-উপকরণের সাহায্য নিয়েছেন। সহজাত স্মরণশক্তির বলে সবকিছু তাদের আপসে আপ মুখস্থ হয়ে গিয়েছে-বিষয়টি এমন নয়।
কাজেই দুর্বল স্মরণশক্তির অভিযোগ না করে আমাদের কর্তব্য অল্প অল্প করে মুখস্থ করা এবং স্মৃতিবিভ্রমের সকল কারণ একটি একটি করে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করা। সাথে দরূদ ও ইস্তেগফারের ইহতিমাম করা।
১০. কিছু আসান নুসখা
প্রথম কাজ অলসতা ঝেড়ে মুখস্থ করার মানসিক প্রস্ত্ততি গ্রহণ করা। এজন্য মাঝে মাঝে বিষয়টির গুরুত্ব ও প্রয়োজন সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে এবং আইম্মায়ে হুফফাযের ঘটনাবলি ও আযকিয়ায়ে উম্মতের হালত-জীবনী পাঠ করতে হবে। সাথে সাথে নিজেকে বোঝাতে হবে যে, মুখস্থ করা আমার কাজ। কিন্তু মুখস্থ হওয়া ও মুখস্থ থাকা আমার দায়িত্ব নয়। কারণ আসসায়য়ু মিন্নি ওয়াল ইতমামু মিনাল্লাহ। চেষ্টা আমার কাজ, ফল দিবেন আল্লাহ। অতএব আমি প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব। কবি বলেন, হে প্রেমিক! প্রেমের পথ কণ্টকাকীর্ণ?! আসলে তুমি সাহস হারিয়েছ।/হে পথিক! পদে পদে তোমার ঘটেছে পদস্খলন?! আসলে তোমার পা-ই খোড়া, পথ বাঁকা নয়।/বন্ধু! পথের কষ্টে ভয় পেয়ো না, সাহসে বুক বাঁধ। পথ কঠিন নয়, কঠিন হল পথচলা।/কর্মই তোমাকে নিয়ে যাবে সমাপ্তির শিখরে। সূচনাই কঠিন, সমাপ্তি কঠিন নয়।
খ. মুখস্থ করতে থাকা আমার কাজ। কতটুকু মুখস্থ হল, কত দিনে হল এটা আমার চিন্তার বিষয় নয়। আমি চেষ্টা করতে থাকব আর বলতে থাকব-
গ. ভুলে যাওয়ার ভয়ে মুখস্থ না করা বোকামী। এ যেন ময়লা হওয়ার ভয়ে কাপড় না ধোয়া, অপরিষ্কার হওয়ার ভয়ে আঙ্গিনা পরিষ্কার না করা আর ক্ষুধার ভয়ে আহার না করা।
কবি বলেন-
আমি বলি, ভোলার জন্যই মুখস্থ করুন এবং ভুলতে থাকুন। কত ভুলবেন? এ বিষয়ে কামাল হাসিল করা নিশ্চয়ই আপনার কম্ম নয়!!
কারো মনে হতে পারে যে, ভুলে যাওয়া গুনাহ। অতএব মুখস্থ করে গুনাহর ঝুঁকি সেধে নেওয়ার দারকার কী? আসলে ভুলে যাওয়া গুনাহ নয়, অবহেলা ও চর্চাহীনতার দ্বারা ভুলে যাওয়া গুনাহ। তাই কেউ যদি মুখস্থ করার পর চর্চা ও অনুশীলন অব্যাহত রাখে তাহলে ভুলে যাওয়ার গুনাহ থেকে (কুরআন মজীদের ক্ষেত্রে) এবং ভুলে যাওয়ার বে-বরকতি থেকে (কুরআন ও গায়রে কুরআন সবকিছুর ক্ষেত্রে) আল্লাহ তাআলা তাকে হেফাযত করবেন।
ঘ. একটি সহজ সত্য এই যে, আগ্রহের বিষয় ভোলা যায় না। কবিতা প্রসঙ্গে শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ. একবার বলেছিলেন, ‘যে কবিতা ভালো লাগে তা মুখস্থ হয়ে যায়।’ কাজেই যা মুখস্থ করতে চান অন্তরে তার মহববত বাড়ান। মনে রাখবেন, হৃদয়ে যদি ভালবাসা জাগে বক্ষে ধারণ সহজ হয়ে যায়। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
টীকা :
১. নুসূস শব্দটি ‘নস্’-এর বহুবচন। এখানে নুসূস অর্থ দলীল-আদিল্লার মূল পাঠ। যেমন, প্রথম পর্যায়ে কুরআন মজীদের আয়াত ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর হাদীস, এরপর সাহাবায়ে কেরামের আছার। দ্বিতীয় পর্যায়ে তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন ও আইম্মায়ে দ্বীনের বাণী এবং কিতাব-সুন্নাহ থেকে আহরিত কাওয়াদে শরীয়তও এতে অন্তর্ভুক্ত।
২. কুতুবে সিত্তা অর্থ হাদীসের ছয় কিতাব। (এখানে উদ্দেশ্য হল বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী, তিরমিযী ও মুয়াত্তা।)হিফযুন নুসূসি ওয়াল আছার
আয়াত ও হাদীস এবং সালাফের বাণী মুখস্থ করার প্রয়োজনীয়তা ও অপরিহার্যতা
মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
ইসলামে দলীল-প্রমাণের গুরুত্ব অপরিসীম এবং দলীলবিহীন যেকোনো বিষয় ইসলামের দৃষ্টিতে ভিত্তিহীন। দ্বীন ও শরীয়তের সকল বিষয় দলীল দ্বারা প্রমাণিত। এখানে আন্দাজ-অনুমানের কোনো স্থান নেই।
জাগতিক বিষয়েও ইসলামের বিধান-
যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই তার পিছনে পড়ো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ ও হৃদয় প্রত্যেকটি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে। (সূরা ইসরা : ৩৬) এবং
কোনো ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এই যথেষ্ট যে, সে যা কিছু শোনে সব বর্ণনা করে।-সহীহ মুসলিম (মুকাদ্দিমা) ৫
পারিবারিক ও সামাজিক বিষয়ে ইসলামের আদেশ-
হে মুমিনগণ! তোমরা অনেক ধারণা পরিহার কর। কারণ কোনো কোনো ধারণা পাপ ...। (সূরা হুজুরাত : ১২) এবং তোমরা ধারণা থেকে বিরত থাক। কারণ ধারণা হচ্ছে নিকৃষ্টতম মিথ্যা।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫১৪৩
দুনিয়াবী বিষয়েই যখন ইসলামের শিক্ষা এই তখন দ্বীন ও শরীয়তের বিষয়ে শিক্ষা কী হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
একথা ঠিক যে, ইসলামের অন্যতম বৈশিষ্ট্য সহজসাধ্যতা। তাই সর্বশ্রেণীর মানুষের উপর দুআ-কালাম ও মাসআলা-মাসায়েল সংক্রান্ত কুরআন-সুন্নাহর নুসূস১ (দলীলের মূল পাঠ) মুখস্থ রাখা ফরয করা হয়নি। এরপরও কিছু ‘নস’ মুখস্থ করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অপরিহার্য। যেমন কালিমাতুত তাওহীদ ও কালিমাতুশ শাহাদাহ, কুরআন মজীদের সূরা ফাতিহাসহ কিছু অংশ এবং নামাযের কিছু দুআ-কালাম। এ থেকেও বোঝা যায়, ইসলামে ‘হিফযুন নুসূস’ বা নুসূস মুখস্থ করার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জীবনের সকল অঙ্গনে যখন শরীয়তের বিধান কার্যকর ছিল এবং সমাজের সর্বস্তরে দ্বীনী ইলমের ব্যাপক চর্চা ছিল তখন একজন সাধারণ মুসলিমেরও কুরআন ও হাদীসের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কণ্ঠস্থ থাকত এবং একটি বড় অংশ এত পরিষ্কার জানা থাকত যে, মুখস্থের মতোই। এমন বহু আম মানুষের আলোচনা তারীখ ও তারাজীমের কিতাবে রয়েছে। অথচ দ্বীনের ধারণ ও বর্ণনার মূল দায়িত্ব তাদের উপর ন্যস্ত ছিল না। এই খিদমতের জন্য তো আল্লাহ তাআলা এমন ব্যক্তিদের নির্বাচন করেছেন, যারা তাঁর ফযল ও করমে অসাধারণ সততা, প্রখর স্মৃতিশক্তি এবং প্রবল কর্মোদ্যমের অধিকারী ছিলেন। তেমনি তাফাককুহ ফিদ্দীন, রুসূখ ফিল ইলম এবং তাকওয়া ও তহারাতের ক্ষেত্রেও ইমাম ছিলেন। বস্ত্তত তাঁরা ছিলেন কুরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতের বাস্তব দৃষ্টান্ত-
আর আমি তাদের মধ্য থেকে ‘ইমাম’ মনোনীত করেছিলাম, যারা আমার নির্দেশ অনুসারে পথ প্রদর্শন করত। যেহেতু তারা ধৈর্য্যধারণ করেছিল। আর তারা ছিল আমার নিদর্শনাবলিতে দৃঢ় বিশ্বাসী। (সূরা সাজদা : ২৪)
আর তাঁদের সম্পর্কেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ভবিষ্যদ্বানী সত্য হয়েছিল-
অর্থাৎ প্রতি যুগে পূর্বসূরীদের নিকট থেকে বিশ্বস্ত উত্তরসূরীরা এই ইলমকে ধারণ করবে। তাঁরা একে রক্ষা করবে সীমালঙ্ঘনকারীদের বিকৃতি, মুর্খদের অপব্যাখ্যা ও বাতিলপন্থীদের মিথ্যাচার থেকে।-আততামহীদ, ইবনে আবদিল বার (মোকাদ্দিমা) ১/৫৮-৫৯
আল্লাহ তাআলা তাদের মাধ্যমে দ্বীন ও দলীলে দ্বীনের হেফাযত করেছেন। তাঁরা শুধু নুসূসে শরীয়তের (কিতাবুল্লাহ, সুন্নাতু রাসূলিল্লাহ, অতপর আছারুস সালাফের) মুল পাঠেরই হাফেয ছিলেন না, নুসূসে শরীয়তের অর্থ ও মর্ম, নুসূসে উল্লেখিত বা অনুল্লেখিত মাকাসেদে শরীয়ত, আহকামে শরীয়তের ইল্লত ও হিকমতের অনুধাবনকারী এবং শরীয়তের কাওয়াইদ ও নীতিমালার মোহাফেয ছিলেন, তদ্রূপ শরীয়তের চিন্তা ও কর্ম এবং রুচি ও স্বভাবের বিশ্বস্ত সংরক্ষক ছিলেন। আর আহকামে শরীয়ত মুখস্থ থাকা ছিল তাঁদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
তাঁদের ‘তরজমা’ ও জীবনী ‘তবাকাতুল কুররা’, ‘তবাকাতুল হুফফায’, তবাকাতুল ফুকাহা’. তবাকাতুল মুফাসসিরীন’, ‘তবাকাতুল আওলিয়া’, ও ‘আলামুন নুবালা’ শীর্ষক অসংখ্য কিতাবের যীনত-সৌন্দর্য হয়ে আছে।
এরপর প্রতি যুগে তাদের নায়েব ও উত্তরসূরীদের অধিকাংশই ছিলেন হাফিযে কুরআন। তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তি ইলমুল হাদীসের পরিভাষায় ‘হাফিয’ (হাদীস ও সুন্নাহ হাফিয) ছিলেন। অন্যরা ইসলামের বুনিয়াদী উলূম ও ফুনূনের এক বা একাধিক কিতাবের হাফিয ছিলেন।
ইবনে হাজার আসকালানী রাহ. (৮৫২হি.)-এর ‘আদ্দুরারুল কামিনা’; শাওকানী (১২৫০ হি.) এর ‘আল-বাদরুত ত্বালি বিমাহাছিনি মান বাদাল কারনিস সাবি’। সাখাভী (৯০২ হি.)-এর ‘আয-যাওউল লামি’; আলগাযযী (১০৬১ হি.)-এর ‘আলকাওয়াকিবুস সাইরা’; এবং আলমুহিববী (১১১১ হি.)-এর ‘খুলাসাতুল আছার’ প্রভৃতি কিতাবে এমন হাজারো আহলে ইলমের আলোচনা বিদ্যমান রয়েছে।
পরবর্তীতে ‘হিফযুন নুসূস’-এর বিষয়ে অবহেলা ও অমনোযোগিতা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চললেও সব যুগেই সালাফের কিছু নমুনা বিদ্যমান ছিল। আমাদের এই যুগেও আছে, যদিও তাঁদের সংখ্যা নিতান্তই হাতেগোনা। আর প্রয়োজনীয় ও নির্বাচিত নুসূস মুখস্থ রাখেন এমন আলিমের সংখ্যাও মাশাআল্লাহ একেবারে কম নয়। আমাদের এতদাঞ্চলে আমার মতো উদাসীন ইলম-পিপাসুর দল সংখ্যায় ভারি হলেও জরুরি ‘মুনতাখাব নুসূস’ মুখস্থ রাখেন এমন ব্যক্তি এখানেও চোখে পড়ে।
এ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনায় না গিয়ে শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা (হাফিযাহুল্লাহু ওয়া রাআহু)-এর একটি মজলিস ও আমার নিজের একটি ঘটনা উল্লেখ করে দেওয়াই যথেষ্ট মনে করছি।
১৪৩০ হিজরীর যিলহজের শেষ দিকে বর্তমান সময়ের বিখ্যাত মুহাদ্দিস ও মুহাক্কিক শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা আল-হালাবী ছুম্মাল মাদানী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অনেক আলিমকে (যাঁরা তাঁর সাক্ষাতপ্রত্যাশী ছিলেন) দাওয়াত করেছিলেন। মজলিসটি ছিল মদীনার অদূরে একটি কোলাহলমুক্ত মনোরম উদ্যানে। হযরত মাওলানা আরশাদ মাদানী দামাত বারাকাতুহুম ও তাঁর ছোট ভাইও তাশরীফ এনেছিলেন। ঢাকার কয়েকজন আলিমও নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। কিসমত আমাকেও সেই মজলিসে হাজির করেছিল।
দস্তরখানের আগে ও পরে অনেক বিষয়ে কথা হল। মেহমানদের চাপ কিছুটা হালকা হওয়ার পর ‘হিফযে নুসূস’ প্রসঙ্গটি আলোচনায় এল। শায়খ আক্ষেপ করে বললেন, ‘এ বিষয়ে ছাত্রদের উদাসীনতা খুবই দুঃখজনক।’ তিনি আরো বললেন, ‘আমাদের আকাবিরের হালত এমন ছিল না।’
তিনি বিশেষভাবে তাঁর উস্তাদ শায়খ আবদুল্লাহ সিরাজুদ্দীন রাহ. (১৪২০ হি.)-এর স্মতিচারণ করে বললেন, ‘শায়খ রাহ. ছিলেন কুতুবে সিত্তার২ সকল হাদীসের হাফিয।’ ইবনে দাইবাকৃত (৯৪৪ হি.) ‘তাইসীরুল ওসূল ইলা জামিইল উসূল’ কিতাব থেকে তিনি এই হাদীসগুলো হিফয করেছিলেন। কোন হাদীস কোন কিতাবে ও কোন সাহাবীর সূত্রে বর্ণিত, এবং কোন বর্ণনায় অতিরিক্ত কী আছে-এই সকল বিবরণ তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল।
তিনি বলেন, ১৩৭৮ হিজরীতে শায়খ আমাকে বলেছিলেন, দ্বিতীয়বারের মতো ‘মুসনাদে আহমদ’ (যার হাদীস-সংখ্যা প্রায় ত্রিশ হাজার) এর পাঠ সমাপ্ত হল।’ তিনি ‘মুসনাদে আহমদ’ শুধু পড়ে যেতেন না; বরং এ কিতাবের ঐ হাদীসগুলোও মুখস্থ করে ফেলতেন যেগুলো কুতুবে সিত্তায় নেই। তদ্রূপ যে হাদীসগুলোর মূল রেওয়ায়েত কুতুবে সিত্তায় আছে তার অতিরিক্ত অংশটুকুও মুখস্থ করতেন।
এরপর তিনি এক আশ্চর্য ঘটনা শোনালেন। শায়খ আবদুল্লাহ সিরাজুদ্দীনের দুই শাগরিদের মাঝে উস্তাদের কত হাদীস মুখস্থ-এ নিয়ে তর্ক হল। একপর্যায়ে তাদের একজন-আল্লাহ তাকে মাফ করুন-বলে বসল যে,
যদি শায়খ আবদুল্লাহর এক লক্ষ হাদীস মুখস্থ না থাকে, তাহলে আমার বিবি তালাক। (এ ধরনের আচরণ ও উচ্চারণ থেকে আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন।)
এখন শায়খের কাছে জিজ্ঞাসা করা ছাড়া সমাধানের কোনো উপায় ছিল না। কেউ একজন হিম্মত করে তাঁকে জানালেন। যেহেতু শরীয়তের হুকুমের বিষয় তাই শায়খের পক্ষে নিজের অবস্থা গোপন রাখা সম্ভব হল না। তিনি শাগরিদের কাছে ঘটনা শুনলেন এবং বললেন-
‘তোমার বিবি তালাক হয়নি। তবে ভবিষ্যতে এমন কাজ আর করো না।’
ইলমে হাদীসের পরিভাষায় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী ও কর্ম ছাড়াও সাহাবা-তাবেয়ীনের ফতোয়া ও আমলকেও ‘হাদীস’ বলে। তদ্রূপ এক হাদীসের একাধিক সনদ বা রেওয়ায়েত থাকলে প্রতি রেওয়ায়েতকে আলাদা ‘হাদীস’ গণ্য করা হয়। উপরের ঘটনায় ‘হাদীস’ শব্দ এই পারিভাষিক অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।
শায়খ আবদুল্লাহ সিরাজুদ্দীন এ যমানারই মানুষ। ১৪২০ হিজরীতে তাঁর ইন্তেকাল হয়েছে।
শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা বলেন, আমার উস্তাদ ও আমার দেখা শায়খদের মাঝে অন্তত তিনজন ইলমে হাদীসের পরিভাষা অনুযায়ীই ‘হাফেয’ ছিলেন। প্রথমজন শায়খ আবদুল্লাহ সিরাজুদ্দীন রাহ., দ্বিতীয়জন মুহাদ্দিস আহমাদ ইবনুস সিদ্দীক আলগুমারী (১৩২০ হি.-১৩৮০ হি.), তৃতীয়জন মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ ইবনুস সিদ্দীক আলগুমারী (১৪১০ হি.)।
এই দুজনও ‘ইলাল’ ও ‘আসমাউর রিজাল’ শাস্ত্রে বিশিষ্টতার অধিকারী ছিলেন। শায়খ আবদুল্লাহ সিরাজুদ্দীন ছিলেন শরহুল হাদীস, ‘রবতুস সুন্নাহ বিসসুন্নাহ’ ও ‘রবতুস সুন্নাহ বিলকুরআন’ বিষয়ে (অর্থাৎ হাদীসের মর্ম অনুধাবন, হাদীসের আলোকে হাদীসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং কুরআনের আলোকে হাদীসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে) এই দুইজনের চেয়ে অগ্রগামী। এই বিষয়ে তাঁর বিশিষ্টতা ছিল। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর তাঁর সাথে মোলাকাতের সুযোগ হয়েছে এবং সাতাশ বছর সকাল-সন্ধ্যা তাঁর সোহবতে থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাঁকে ইলমের কামাল দান করেছিলেন আর আমলের কথা তো বলারই অপেক্ষা রাখে না।
শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা তাঁর উস্তাদের তাকওয়া ও খোদাভীতি এবং প্রজ্ঞা ও পাত্যি সম্পর্কে দীর্ঘ সময় স্মৃতিচারণ করেছেন, যা লিপিবদ্ধ করলে একটি দীর্ঘ নিবন্ধ প্রস্ত্তত হবে। প্রাসঙ্গিক না হওয়ায় এখানে সেসব কথা আলোচনা করা থেকে বিরত থাকছি।
এবার আমার ঘটনাটি বলি। ১৪২৯ হিজরীর ঘটনা। মক্কা মুকাররামা থেকে জিদ্দার উদ্দেশে বাসে উঠেছি। চালক একজন নওজওয়ান, সম্ভবত সিরীয়। সঙ্গীদের কেউ হয়তো আমার সম্পর্কে তাকে কিছু বলেছেন। আর এসব ক্ষেত্রে তো অতিরঞ্জন আমাদের সাধারণ অভ্যাস। কিছুক্ষণ পর যুবকটি আমার কাছে এল এবং কথাপ্রসঙ্গে বলল, ‘আমাকে গাড়ি চালাতে হয়, সারাদিন ব্যস্ত থাকি, কুরআন মজীদ পড়ার তেমন সময় পাই না; তারপরও আল্লাহর রহমতে চেষ্টা করছি এবং আলহামদুলিল্লাহ, এত পারা হিফয হয়েছে (একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণের কথাই সে বলেছিল)। তোমার সঙ্গীরা তোমার সম্পর্কে অনেক কিছু বলেছেন, আমার জানতে ইচ্ছে করে যে, তোমার কত পারা হিফয হয়েছে?’
প্রিয় পাঠক! এর কোনো জবাব আমার কাছে ছিল না। তাই নীরবতা অবলম্বন কিংবা দীনতা প্রকাশ ছাড়া আর কী উপায় ছিল? আল্লাহ আমাকে মাফ করুন এবং দীনতা পূরণের তাওফীক দান করুন।
প্রথম ঘটনা আমাদের আলিমদের জন্য আর দ্বিতীয় ঘটনা তালিবে ইলমদের জন্য শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। আল্লাহ তাআলা আমার ও আমার তালিবে ইলম ভাইদের মনে হিফয নুসূসের শওক পয়দা করে দিন।
উদাসীনতা : কিছু কারণ
হিফযে নুসূস সম্পর্কে উদাসীনতার কিছু ‘যুক্তি’ সম্পর্কেও আলোচনা করা দরকার। আমার মতে মৌলিক ‘যুক্তি’গুলো নিম্নরূপ :
১. শৈশবে বাবা-মা হাফিয বানাননি। এখন বয়স হওয়ার পর কি হাফিয হওয়া সম্ভব?
২. আগের যমানায় কিতাব ছিল না। তাই মানুষ সকল বিষয় স্মৃতিতে ধারণ করত। এখন তো হাদীস-তাফসীর, ফিকহ-লোগাত সকল বিষয়ে কিতাব আছে, প্রয়োজনের সময় কিতাব খুলে দেখে নেওয়া যায়। কাজেই এখন হাদীস-তাফসীর মুখস্থ করার প্রয়োজন নেই। আর রিজাল-সনদ মুখস্থ করা তো সম্পূর্ণ পন্ডশ্রম!!
৩. কুরআন ও হাদীসের ‘নুসূস’ হচ্ছে হুকুম-আহকামের দলীল। আমাদের তো আহকাম জানাই যথেষ্ট, দলীল জানার প্রয়োজন নেই। কখনো প্রয়োজন হলে কিতাব আছে, কুতুবখানা আছে। অতএব মুখস্থ করার প্রয়োজন কী?
৪. ‘ফাহম’ ও ‘ইসতিদাদ’ অর্থাৎ নুসূস ও ইবারত বোঝাই হল মূল মাকসাদ। মুখস্থ করার প্রয়োজন নেই।
৫. দোয়া ও যিকর একে তো মুস্তাহাব পর্যায়ের বিষয়, দ্বিতীয়ত নামায-কালামের কিছু দোয়া মুখস্থ রাখাই যথেষ্ট। সুতরাং দোয়া ও যিকির সংক্রান্ত আয়াত-হাদীস মুখস্থ করার কী প্রয়োজন?
৬. জুমার বয়ান ও মাহফিলের ওয়াজের জন্যও নুসূস মুখস্থ রাখার প্রয়োজন নেই। কারণ একটি আয়াত বা একটি হাদীস তেলাওয়াত করেই তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা বয়ান করা যায়।
৭. মাসআলা-মাসায়েল সাধারণত বলা হয় আম মানুষের প্রশ্নের উত্তরে। তাদের যেহেতু দলীল বোঝার যোগ্যতা নেই তাই আমাদেরও দলীল বলার প্রয়োজন হয় না। কাজেই দলীল মুখস্থ রাখারও প্রয়োজন নেই।
৮. এখানে হিফযে নুসূসের পরিবেশ নেই। হিফযে কুরআনের ব্যবস্থা যা আছে তা কেবল শিশু-কিশোরদের জন্য। অর্থাৎ যারা হিফযখানায় ভর্তি হয় তাদের জন্য। আর হিফযে হাদীসের জন্য তো হিফযখানাও নেই। তাছাড়া পরিচিত-অপরিচিত কাউকেই তো নুসূস মুখস্থ করতে দেখি না। তাহলে আমি একা কীভাবে মুখস্থ করব?
৯. ‘হিফযে নুসূস’ আমাদের নেসাবেও নেই এবং এর জন্য কোনো ঘণ্টাও বরাদ্দ নেই।
১০. সবচেয়ে বড় কথা এই যে, আগের যুগে মানুষের মেধা ও স্মৃতিশক্তি অনেক ভালো ছিল। আমরা দুর্বল, আমাদের স্মৃতিশক্তিও দুর্বল। তাই বড় কিছু মুখস্থ করা আমাদের পক্ষে শুধু কঠিনই নয়, একপ্রকার অসম্ভবই বটে।
আমার ধারণা, ‘হিফযে নুসূস’ থেকে বঞ্চিত হয়েও এইসব ‘যুক্তি’র জোরেই আমরা নিজেদেরকে সন্তুষ্ট করে রেখেছি। যেন তা দোষের কিছু নয়; বরং এ যুগে এমন হওয়াই বাঞ্ছনীয়। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!
একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে, এগুলো ‘যুক্তি’ নয়, নিতান্তই খোঁড়া অজুহাত। চিন্তার সুবিধার্থে কিছু কথা আরজ করছি। আশা করি আমরা নিজেদের দোষ ও দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন হব এবং মিথ্যা অজুহাতে প্রবঞ্চিত না হয়ে নিজেকে গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করব।
১. মুখস্থ করার কোনো বয়স নেই
তালাবুল ইলম বা ইলম অন্বেষণ যেমন সারা জীবনের কাজ তেমনি ‘হিফযে নুসূসও’ সারা জীবনের কাজ। কারণ এটিও তালাবুল ইলমেরই অংশ।
সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে প্রতি যুগে বয়স্ক ও প্রবীণ মানুষেরাও কুরআন মজীদ শিখেছেন ও কুরআন হিফয করেছেন। বরং অধিকাংশ সাহাবা তো কুরআনের নেয়ামত লাভ করেছেন প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছার পর।
যদিও একথা সত্য যে, ‘আলহিফযু ফিস সিগার কান নাকশি ফিল হাজার’ অর্থাৎ শৈশবে মুখস্থ করা পাথরে খোদাই করার মতো। তবে একথাও মিথ্যা নয় যে, অর্থ বোঝা ও মনোযোগ দিয়ে পড়া হিফযের পক্ষে অতি সহায়ক। কাজেই মুতাওয়াসসিতা ও উপরের দিকের তালিবে ইলম এবং নেসাব সমাপ্ত করে তাদরীসের খিদমতে যোগদানকারী সবাই কিছু কিছু করে হিফযে নুসূসের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে পারেন।
আরবের নেসাবে প্রতি শ্রেণীতেই হিফযে কুরআন ও হিফযে হাদীস রয়েছে। কুল্লিয়া ও মাজিসতীরও এর ব্যতিক্রম নয়। তারা তো বয়েস হওয়ার পরও কুরআন-হাদীস হিফয করছে।
আরবের কোনো কোনো মুদাররিসকে অবাক হয়ে বলতে শুনেছি যে, শৈশবে হিফযে কুরআনের সুযোগ না হলে পরে তার চিন্তাই করা যাবে না-এ কেমন কথা! দরসিয়াতের সাথে কি অল্প অল্প হিফয জারি রাখা যায় না?
আরবে আম রেওয়াজ আছে যে, ছাত্ররা দুপুর পর্যন্ত মাদরাসা বা স্কুলে পড়ে। আসরের পর (সেখানে আসর মিছলে ছানীতে পড়া হয়।) মসজিদের হিফযখানায় পড়ে। এভাবে কয়েক বছরে তারা হাফিয হয়ে যায়।
একদিকে দাবি করা হয় যে, এদেশের ছেলেদের মেধা ও স্মৃতিশক্তি পৃথিবীর সকল দেশের ছেলেদের চেয়ে ভালো, অন্যদিকে এই অজুহাত খাড়া করা হয় যে, শৈশবে বাবা-মা হিফযখানায় দেননি!!
হিফযখানায় ভর্তি হওয়া ছাড়া যদি হিফয করা সম্ভবই না হয় তাহলে তো দাওরায়ে হাদীসের পরও হিফযখানায় ভর্তি হওয়া যায়। আমাদের হামসবক ও মুখলিস দোসত মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ ইবনে আবুল খায়ের ইবরাহীম রাহ. (১৩৮৯ হি.-১৪২৯ হি.) জামিআতুল উলূমিল ইসলামিয়া বিন্নূরী টাউনে ১৪০৭ হি.-১৪০৮ হিজরীতে দাওরায়ে হাদীস পড়েন। এরপর দুই বছর হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নুমানী রাহ. (১৩৩৩ হি.-১৪২০ হি.)-এর কাছে উলূমুল হাদীস পড়েছেন। দু’ তিন বছর করাচির এক মাদরাসায় শিক্ষকতার পর দেশে ফিরে মিফতাহুল উলূম বাড্ডা মাদরাসায় সম্ভবত দুই বছর তাদরীসের খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। এরপর দাউদকান্দির কাছে এক অজপাড়াগাঁয়ের একটি হেফযখানায় ভর্তি হয়ে প্রায় নয় মাসে হিফয সম্পন্ন করেছেন। এখন তিনি তার হাতে গড়া বাগান-(গোপালগঞ্জ, ভবানীপুর মাদরাসায়) চির নিদ্রায় শায়িত আছেন। এক পুত্র ও ছয় কন্যা রেখে গেছেন। আল্লাহ তাদের হেফাযত করুন।
তাঁর কথা যখনই চিন্তা করি তখনই আমার কুরআনে হাকীমের এই আয়াত মনে পড়ে-
মুমিনদের মধ্যে কতক আল্লাহর সাথে তাদের কৃত অঙ্গিকার পূর্ণ করেছে। তাদের কেউ কেউ শাহাদাত বরণ করেছে এবং কেউ কেউ প্রতীক্ষায় রয়েছে। তারা তাদের অঙ্গিকারে কোনো পরিবর্তন করেনি। (সূরা আহযাব : ২৩)
যেন মেহেরবান মাওলার সাথে কৃত অঙ্গিকার পূরণ করার পর তিনি অপেক্ষায় ছিলেন। পরিশেষে পিতার ইয়াদত ও ইসতিকবালের জন্য ঘর থেকে বের হলেন এবং সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মাওলায়ে কারীমের সাথে মিলিত হলেন।
যাই হোক, হিফযে কুরআন, হিফযে হাদীস তথা হিফযে নুসূসের কোনো বয়স নেই। কাজেই বয়সের বাহানায় আমরা যেন এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবহেলা না করি।
২. মা লা য়ুদরাকু কুল্লুহু লা য়ুতরাকু কুল্লুহু
শুধু ইলম নয়, যেকোনো খায়ের ও কল্যাণের ক্ষেত্রেই মূলনীতি হচ্ছে, ‘ মা লা য়ুদরাকু কুল্লুহু লা য়ুতরাকু কুল্লুহু’ অর্থাৎ পূর্ণ অর্জন সম্ভব না হলে অন্তত পূর্ণ বঞ্চনা থেকে বাঁচার চেষ্টা করা উচিত।
হিফযের বিষয়েও এই মূলনীতি মনে রাখা কর্তব্য। হযরত মাওলানা আবরারুল হক হারদূয়ী রাহ.-এর মুখে তাঁর একজন বয়স্ক মুরীদের কথা শুনেছি, যিনি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত, হিফযে কুরআনের ফযীলত শুনে হিফয শুরু করেছেন এবং অল্প অল্প করে হিফয করছেন। আঠারো বছর যাবত অন্য সকল কাজের সাথে তাঁর এই মেহনত জারি আছে। হযরত হারদুয়ী রাহ. বলেছিলেন, ‘হিফয সমাপ্ত হওয়ার আগেই যদি তার মওত এসে যায় তাহলেও সমস্যা নেই। কারণ মাকসাদ তো ‘হাফেয হওয়া’ নয়; মাওলার মহববতের হক আদায় করা। এটা তো অবশ্যই হাসিল হবে।’
মোটকথা, উপরোক্ত মূলনীতি অনুযায়ী আমরা অন্তত খুনতাখাব ও নির্বাচিত নুসূস হিফয করার সংকল্প করতে পারি এবং ‘আস সা’য়ু মিন্নী ওয়াল ইতমামু মিনাল্লাহ’ বলে নির্দিষ্ট রুটিন অনুসারে অল্প পরিমাণে হলেও হিফযের চেষ্টা অব্যাহত রাখতে পারি।
৩. গ্রন্থনা কি গ্রন্থ-নির্ভর হওয়ার জন্য?
ইসলামী ‘উলূম’ ও ‘ফুনূন’ যেমন হাদীস-সীরাত, আছারে সাহাবা-আখবারুস সালাফ, ফিকহে ইসলামী ইত্যাদির গ্রন্থনা ও সংকলন আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নেয়ামত। এইসব ইলম ও ফন সংকিলত হওয়ার যৌক্তিক কারণ রয়েছে এবং তা ইসলামী ইতিহাসের অন্যতম উজ্জ্বল অধ্যায়। কিন্তু এর উদ্দেশ্য এই ছিল না যে, ইলম-অন্বেষীরা তাদের স্মৃতিশক্তিকে অকেজো করে সম্পূর্ণ গ্রন্থ-নির্ভর হয়ে পড়ুক; বরং উদ্দেশ্য ছিল, দ্বীনী ইলম ও ফন মনীষীদের স্মৃতির পাতার সাথে গ্রন্থের পাতাতেও সংরক্ষিত হোক, যাতে পঠন-পাঠন এবং চর্চা ও ধারণ সহজতর হয়। অতএব সালাফের এই মহান খেদমতের কদরদানী করা এবং তালীম ও তাদরীসের পাশাপাশি হিফযের সিলসিলা জারি রাখাও আমাদের কর্তব্য।
আমাদের পূর্বসূরীরা গ্রন্থ ও গ্রন্থনাকে হিফযের মেহনত থেকে অব্যাহতির অজুহাত বানাননি। তাদের নিকট যেমন কিতাব ছিল তেমনি কিতাবের তথ্যাবলি বা তার উল্লেখযোগ্য অংশ কণ্ঠস্থও ছিল। গ্রন্থের অজুহাতে স্মরণশক্তিকে অকেজো রাখা তালিবে ইলমের পতন-যুগের বৈশিষ্ট্য। একথাও মনে রাখা উচিত যে, হিফযে নুসূসের পরামর্শ দ্বীন ও ইলমে দ্বীনের হেফাযতের জন্য নয়; বরং নিজের হেফাযতের জন্য এবং নিজের ঈমান-আমল ও জ্ঞান-বুদ্ধিকে রক্ষা করার জন্য। এই জন্য গ্রন্থনা ও সংকলনের পর মুখস্থ করার প্রয়োজন নেই মনে করা বোকামি ও নির্বুদ্ধিতা ছাড়া আর কী হতে পারে?
৪. ‘মুরাজাআত’ একটি সাময়িক প্রয়োজন, আলিমের মূল বৈশিষ্ট্য নয়
‘সবকিছু কিতাবে লেখা আছে, প্রয়োজনের সময় মুরাজাআত করা যাবে বা দেখে নেওয়া যাবে’-এটা আলিমসুলভ চিন্তা নয়। আলিম কেন, একজন তালিবে ইলমের জন্যও তা শোভনীয় নয়। এটা তো আম লোকের চিন্তা। তারা যেমন মনে করে, ‘আমাদের কুরআন-হাদীস পড়ার দরকার নেই, হুজুররা আছেন, প্রয়োজনে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করে নিব’, আমরাও কিতাব সম্পর্কে এরকম চিন্তা করি। আমরাও মনে করি, প্রয়োজনের সময় কিতাব দেখে নিব, অধ্যয়ন বা মুখস্থ করার প্রয়োজন নেই।
ইমাম আবদুল মালিক ইবনে কুরাইব আলআসমায়ী রাহ. (২১৬ হি.) একটি তিক্ত সত্য পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন। তিনি বলেন, ‘কিছু লোক আছে, যাদেরকে আলিম বলা হয়, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা আলিম নয়। কারণ তাদেরকে কিছু জিজ্ঞাসা করা হলে বলে, জ্বী, এ বিষয়ে আমার কাছে তথ্য আছে, তবে কিতাবের সিন্দুকে!! (জামিউ বয়ানিল ইলমি ও ফাযলিহি, ইবনে আবদিল বার ১/১০৮৯)
ভেবে দেখা উচিত যে, দ্বীনের ‘মাবাদিয়াত’, ‘জরুরিয়াত’ ও সাধারণ মাসআলার ক্ষেত্রেও যদি মানুষকে কিতাব দেখার অপেক্ষায় থাকতে বলা হয় তাহলে এর চেয়ে হাস্যকর বিষয় আর কী হতে পারে? জানা না থাকলে ‘লা-আদরী’ বলা জরুরি ও প্রশংসনীয়, কিন্তু একজন আলিমের হালত এমন হওয়া নিতান্তই লজ্জাজনক যে, দিন রাত তাকে শুধু ‘লা-আদরী’ই বলে যেতে হয়। এই লজ্জা দূর করা অপরিহার্য। (আলমুয়াফাকাত)
আরেকটি বিষয় এই যে, তাৎক্ষণিক কিতাব দেখার দ্বারা কোনো বিষয়ের সকল দিক সামনে আসে না, উপরন্তু তাড়ার কারণে কখনো কখনো ভুলও হয়ে যায়। এজন্য তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে কিতাব দেখার দ্বারা যে ইলম হাসিল হয় তা নিতান্তই নাকিস ও অসম্পূর্ণ ইলম। (মুকাদ্দিমায়ে ফাতাওয়া খলীলিয়াহ)
অভিজ্ঞতা বলে যে, এই ধরনের মৌলভী কখনো তাফাক্কুহ ফিদ্দীন ও রুসূখ ফিল ইলম হাসিল করতে পারে না। (আলইনতিকা, ইবনে আবদিল বার, শায়খ আবদুল ফাত্তাহ রাহ.-এর পরিশিষ্ট; সফহাতুন মুশরিকাহ মিন তারীখি সামাইল হাদীস ইনদাল মুহাদ্দিসীন, শায়খ আবদুল ফাত্তাহ)
এইজন্য কেবল ‘মুরাজাআতে’র উপর নির্ভর করা উচিত নয়; বরং উসূল ও আদাব মোতাবেক মুতালাআর পরিধি বাড়ানো উচিত। ইলমের একটি নির্বাচিত অংশ কণ্ঠস্থ থাকা চাই এবং আহলে ফিকহ ও আহলে দিলের সোহবতে থেকে তাফাক্কুহ ফিদ্দীন ও তাযকিয়া-তহারাত হাসিলের চেষ্টা করা চাই। যাতে এমন না হয় যে, জীবনভর শুধু ইলমের পথঘাট জেনেই তুষ্ট থাকা হল, ইলমের মেহমানদারী অর্জনের সৌভাগ্য হল না।
৫. শুধু কিতাব বোঝার যোগ্যতা ইলম নয়
এটিও একটি স্বীকৃত ও স্বতঃসিদ্ধ কথা। কিতাব বোঝার যোগ্যতা তো ইলমের চাবি। এটা যদি ব্যবহারই না করা হয় এবং ইলমের খাযানা থেকে মণিমাণিক্য স্মৃতির ভান্ডারে সঞ্চয় না করা হয় তাহলে কি ইলমের অধিকারী বলা যায়?
কেউ হয়তো ফাহম ও ইসতিদাদ আর তাফাক্কুহ ফিদ্দীনকে এক বস্ত্ত মনে করেন। অথচ তাফাক্কুহ এক উঁচু মাকামের নাম, ফাহম ও ইসতিদাদ যার একটি সিড়ি এবং অবশ্যই অতি গুরুত্বপূর্ণ সিড়ি। কিন্তু কেউ যদি তা ব্যবহারই না করে তাহলে ঐ উঁচু মনযিলে পৌঁছবে কীভাবে?
জ্ঞানী লোকেরা অনেক আগেই বলে গেছেন যে, জ্ঞানের বাহু দুইটি : তথ্যজ্ঞান ও চিন্তাশক্তি। অতএব কোনো একটির অভাব হলে জ্ঞানের আকাশে উড্ডয়ন অসম্ভব। জাহিয বলেন-
অর্থাৎ যখন স্মৃতি ও চিন্তার মিলন ঘটে তখন ফলাফল হয় অভাবনীয়।
বস্ত্তত এই দুই বৈশিষ্ট্য অর্জনের প্রেরণা ছাড়া আমরা তালিবে ইলম হতে পারি না।
৬. দুআ ও যিকির মুস্তাহাব নয়, জরুরি
কিছু ব্যতিক্রম বাদে অধিকাংশ দুআ ও যিকর (যেগুলোর নির্ধারিত পাঠ রয়েছে) ফিকহী হুকুমের বিচারে মুস্তাহাব হলেও ফায়েদা ও ফলাফলের বিচারে অতি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ঈমান-আমলের পূর্ণতা, মজবুতি, তাওহীদ ও তাওয়াক্কুলের আখলাক ও চরিত্রের ইসলাহ, সর্বোপরি আল্লাহ তাআলার ইশক ও মহববত পয়দা করার ক্ষেত্রে এর প্রভাব অনস্বীকার্য। যিকর ও দুআর এই বড় বড় ফায়েদা সম্পর্কে আমরা যদি সচেতন হতাম তাহলে এর আইনি হুকুমের অজুহাতে গাফলত ও উদাসীনতার পরিচয় দিতাম না। আমি সাথীদেরকে বলব, আপনারা শুধু মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.-এর পুস্তিকা ‘সীরাতে মুহাম্মাদী দুআওঁ কে আয়নে মে’ এবং মাওলানা মুহাম্মাদ মনযুর নুমানী রাহ.-এর ‘মাআরিফুল হাদীস’-এর আদইয়া ও আযকার অধ্যায়টি পাঠ করুন। ইনশাআল্লাহ দুআ ও যিকরের ফায়েদা আপনাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং এ সংক্রান্ত হাদীসসমূহ হিফয করার ও আমলে আনার জযবা পয়দা হবে।
বস্ত্তত হিফযে নুসূসের বিষয়ে অবহেলার মূল কারণ হিম্মত ও সাহসের অভাব এবং ঈমান ও আমলে তরক্কির অনীহা। তিক্ত ও দুর্বোধ্য হলেও কথাটা সত্য। আল্লাহ তাআলা আমাদের মাফ করুন এবং সংশোধনের তাওফীক দিন।
৭. জানদার ও শানদার আলোচনায় নুসূস ও হাওয়ালা অপরিহার্য
এটা ঠিক যে, মাসআলার সাথে দলীল বা দলীলের ‘নস’ উল্লেখ করা সর্বক্ষেত্রে জরুরি নয়। তেমনি ওয়াজ-নসীহতেও আয়াত-হাদীসের উদ্ধৃতি সর্বদা অপরিহার্য নয়। সর্বাবস্থায় যা জরুরি তা হল, মাসআলা সহীহ হওয়া এবং ওয়াজ-নসীহত ‘ওয়াজ’ ও ‘নসীহত’ হওয়া। সালাফের ফকীহগণের ফতোয়া ও মুসলিহ-সংস্কারকদের ওয়াজ-নসীহত সনদসহ সংরক্ষিত আছে। তাঁরা ফতোয়া বা ওয়াজে সর্বদা দলীল ও হাওয়ালা উল্লেখ করা জরুরি মনে করতেন না। যদিও হাওয়ালা ও দলীল তাদের জানা ছিল এবং অধিকাংশ দলীল, বিশেষত প্রসিদ্ধ মাসআলার দলীলসমূহের মূল পাঠও কণ্ঠস্থ ছিল। প্রয়োজনের সময় তারা তা পেশ করতেন। সুতরাং ‘ওয়াজ ও মাসআলায় সাধারণ অবস্থায় দলীল বলার প্রয়োজন হয় না’-এই কথাটিকে দলীল না-জানা বা জরুরি দলিল মুখস্থ না-রাখার অজুহাত তাঁরা বানাননি। পক্ষান্তরে আমরা একে অজুহাত বানিয়েছি। ফলে সালাফ ও আকাবিরের পথ থেকে আমরা সরে যাচ্ছি। অথচ তাদের তুলনায় দলীল মুখস্থ করার প্রয়োজন আমাদের অনেক বেশি। কারণ ইলম ও তাকওয়ায় সালাফের মাকাম এত উঁচু ছিল যে, তাঁদের কথা ও কাজ ছিল শরীয়তেরই তরজুমান-প্রতিচ্ছবি। ফলে তাঁদের প্রতি মানুষের পূর্ণ আস্থা ছিল। দ্বিতীয়ত সে সময়ের মানুষও সাধারণত সহজ-সরল ছিলেন, অবিশ্বাস ও হঠকারিতা কম ছিল। ফলে দলিল উল্লেখ করার প্রয়োজন সাধারণত হত না। এখন দুই তরফেই অবনতি হয়েছে। অহংকার ও আত্মতুষ্টির বিস্তার ঘটেছে এবং নেক লোকেরাও নিজেদের অজান্তে মানুষকে আলিমদের সম্পর্কে আস্থাহীন করছেন। এ অবস্থায় জরুরি নুসূস ও দালায়েল যদি মুখস্থ না থাকে তাহলে আপনাকে বলতে হবে যে, আমার দলিল আলমারিতে! একটু অপেক্ষা করুন, এনে দিচ্ছি!
জটিল ও সচরাচর ঘটে না-এমন ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ ক্ষমাযোগ্য হলেও যা সব সময়ের প্রয়োজন এমন সাধারণ বিষয়ে তা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে?
যেখানে অমুসলিম মিশনারী ও বেদ্বীন-মুলহিদ এবং বিদআতী ও গোমরাহ লোকেরা আম মানুষকে ভুল দলীল বা দলীলের ভুল ব্যাখ্যা দ্বারা বিভ্রান্ত করছে সেখানে আহলে হক আলিমদের জন্য কি এই সুযোগ আছে যে, দলীল উল্লেখ করা তো দূরের কথা, দলীল জানা ও গুরুত্বপূর্ণ দলীল মুখস্থ রাখার বিষয়েও অবহেলা করবেন? যেখানে নসের সঠিক উচ্চারণে অক্ষম লোকেরা ইসলামের গবেষক ও চিন্তাবিদ এবং আয়াত-হাদীসের ভাবার্থ নিজের ভাষায় বলে আয়াত-নম্বর ও কিতাবের নাম উল্লেখে তৎপর তখন যদি আমাদের তলাবা-মুদাররিসীন ও খতীব-ওয়ায়েজীনকে কথায় কথায় ‘লা-আদরী’ বলতে হয় কিংবা দেখে বলার জন্য সময় নিতে হয় তাহলে আমাদের অবস্থানটা কী দাঁড়ায়? এখনও যদি আমরা সচেতন না হই তাহলে আর কবে?
বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্বীন ও শরীয়তের সফল ও সময়োপযোগী উপস্থাপনার জন্য শুধু দলীল নয়, দলীলের ‘নুসূস’ এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনীয় হাওয়ালা-উদ্ধৃতিও উল্লেখ করা জরুরি। এ বিষয়ে উদাসীনতার সুযোগ নেই। কাজেই অতি প্রয়োজনীয় ‘নুসূস’ হাওয়ালাসহ ইয়াদ করা, অন্তত ইয়াদের চেষ্টা করা আমাদের উপর ফরয।
হাওয়ালার গুরুত্ব বোঝার জন্য তলাবায়ে কেরাম শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ.-এর কিতাব ‘সাফাহাত মিন সাবরিল উলামা’ এর তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকাটি অধ্যয়ন করতে পারেন।
৮. নেসাবের একটি অংশ ‘মাহফুযাত’
মাহফূযাত বা হিফযযোগ্য নুসূস নেসাবে নেই-এ কথা ঠিক নয়। কারণ তালিবে ইলমের ঈমানী যিন্দেগী এবং ইলমী ও আমলী যিন্দেগীর জন্য যা কিছু জরুরি সবই তার নেসাবের মধ্যে শামিল। অতএব হিফযের বিষয়টিও তাতে রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। যদি মাদরাসার নির্ধারিত নেসাবের কথা বলেন, তাহলে প্রশ্ন হল, এই নেসাবের বাইরে অনেক প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় বিষয় কি আমরা শিখছি না? সেসব বিষয়ের মধ্যে হিফযে নুসূস অগ্রাধিকার না পাক, অন্তর্ভুক্ত তো হতে পারে।
এরপরের কথা হল, আমাদের দেশের চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ মাদরাসা-নেসাবের এই দুর্বলতা (হিফযে নুসূসের বিষয়ে অবহেলা) দূর করার পদক্ষেপ নিচ্ছেন। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে হিফযে কুরআন ও হিফযে হাদীস নেসাবে শামিল হয়েছে এবং কোথাও কোথাও ‘মাওয়াদ্দে ইযাফিয়্যাহ’ বা সম্পূরক বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে। দারুল উলূম দেওবন্দের কোনো কোনো উস্তায তালিবে ইলমদের জন্য ‘মাহফুযাত’ নামে কিছু সংকলন প্রস্ত্তত করেছেন। এদেশেও হিফযের জন্য কিছু মুনতাখাব মজমুআ তৈরি হয়েছে। আততরীক ইলাল আরাবিয়্যা কিতাবটির শেষেও কুরআন মজীদের আয়াত ও হাদীস শরীফের একটি সংক্ষিপ্ত সংকলন রয়েছে। তদ্রূপ নূরানী শিক্ষার নেসাবেও হিফযে হাদীসের বিষয়টি রয়েছে।
৯. চর্চার দ্বারা স্মৃতিশক্তি বাড়ে
সম্ভবত আমরা মনে করি যে, স্মরণশক্তি একান্তই জন্মগত, এখানে অর্জনের কিছু নেই। এই ধারণা পুরোপুরি ঠিক নয়। কারণ চর্চা ও অনুশীলনের মাধ্যমে স্মৃতিশক্তিকে প্রখর ও শাণিত করা যায়। এদিক থেকে তা অর্জনযোগ্যও বটে। তেমনি এই ধারণাও ঠিক নয় যে, সালাফের প্রত্যেকেই অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন এবং শোনামাত্রই তাদের মুখস্থ হয়ে যেত! নিঃসন্দেহে তাঁদের অনেকেই এমন ছিলেন, তবে অসংখ্য ব্যক্তি এমনও ছিলেন, যাদের মেহনত করে মুখস্থ করতে হত। তাঁরা মনোযোগ সহকারে শুনতেন, বারবার শুনতেন, খাতায় লিখতেন, আলোচনা করতেন এবং লেখার পর বার বার পাঠ করতেন।
রিজালের কিতাবে এই মন্তব্য পাওয়া যায় যে, অমুকের স্মরণশক্তি স্বভাবজাত আর আমাদের স্মরণশক্তি চর্চার ফল। অর্থাৎ তিনি স্বভাবগতভাবেই তীক্ষ্ম ও প্রখর স্মরণশক্তির অধিকারী ফলে সবকিছু সহজেই তার মনে থাকে। পক্ষান্তরে আমাদেরকে পরিশ্রম করে মুখস্থ করতে হয়।
ইসহাক ইবনে রাহুয়াহ রাহ. (১৬১ হি.-২৩৮ হি.) ইমাম ওকী ইবনুল জাররাহ (১২৮ হি.-১৯৭ হি.) সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছেন।
(তাহযীবুত তাহযীব ১১/১৩০)
এটি একটি স্বীকৃত কথা যে, যেকোনো মানবীয় গুণ চর্চার দ্বারা শানিত ও বিকশিত হয়। আর চর্চাহীনতার কারণে দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। আমাদের স্মরণশক্তির দুর্বলতার অন্যতম কারণ চর্চাহীনতা।
জাহেরী কারণের পাশাপাশি স্মরণশক্তি দুর্বল হওয়ার কিছু বাতেনী কারণও আছে। একটি মারাত্মক কারণ গুনাহ ও অশ্লীলতা থেকে পরহেয না করা। ওকী ইবনুল জাররাহ রাহ. সম্পর্কে এইমাত্র বলা হয়েছে যে, তিনি সহজাত স্মরণশক্তির অধিকারী ছিলেন, মুখস্থ করার জন্য তাকে পরিশ্রম করতে হত না। তাঁর সম্পর্কেই আলী ইবনে খাশরাম বলেছেন-‘আমি ওকীকে দেখেছি এবং কখনো তার হাতে কিতাব দেখিনি। সবকিছু তার স্মৃতিতে অঙ্কিত থাকত। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘স্মরণশক্তির ওষুধ কী?’ তিনি বললেন, ‘গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। স্মরণশক্তির জন্য এর চেয়ে বড় ওষুধ আমার জানা নেই।’
(তাহযীবুত তাহযীব ১১/১২৯)
ইমাম বুখারী রাহ. সম্পর্কে কে না জানে? তিনিও স্মরণশক্তির জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করেছেন। তাঁর অভিজ্ঞতা হল, স্মৃতিশক্তির জন্য ‘নাহমাতুর রাজুল’ ও ‘মুদাওয়ামাতুন নাযার’ অর্থাৎ গভীর আগ্রহ ও পুনঃ পুনঃ পঠন অতি সহায়ক। ইমাম আবু হানীফা রাহ. বলেছেন, ‘হিফযের জন্য একাগ্রতা ও ঝামেলামুক্ততার প্রয়োজন।’ কোনো কোনো মনীষী স্মরণশক্তির জন্য ওষুধও সেবন করতেন।
মোটকথা, আমাদের পূর্বসূরীরা মুখস্থ করার জন্য অনেক পরিশ্রম করেছেন এবং স্মরণশক্তি বৃদ্ধি ও রক্ষার জন্য জাহেরী ও বাতেনী বিভিন্ন উপায়-উপকরণের সাহায্য নিয়েছেন। সহজাত স্মরণশক্তির বলে সবকিছু তাদের আপসে আপ মুখস্থ হয়ে গিয়েছে-বিষয়টি এমন নয়।
কাজেই দুর্বল স্মরণশক্তির অভিযোগ না করে আমাদের কর্তব্য অল্প অল্প করে মুখস্থ করা এবং স্মৃতিবিভ্রমের সকল কারণ একটি একটি করে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করা। সাথে দরূদ ও ইস্তেগফারের ইহতিমাম করা।
১০. কিছু আসান নুসখা
প্রথম কাজ অলসতা ঝেড়ে মুখস্থ করার মানসিক প্রস্ত্ততি গ্রহণ করা। এজন্য মাঝে মাঝে বিষয়টির গুরুত্ব ও প্রয়োজন সম্পর্কে চিন্তা করতে হবে এবং আইম্মায়ে হুফফাযের ঘটনাবলি ও আযকিয়ায়ে উম্মতের হালত-জীবনী পাঠ করতে হবে। সাথে সাথে নিজেকে বোঝাতে হবে যে, মুখস্থ করা আমার কাজ। কিন্তু মুখস্থ হওয়া ও মুখস্থ থাকা আমার দায়িত্ব নয়। কারণ আসসায়য়ু মিন্নি ওয়াল ইতমামু মিনাল্লাহ। চেষ্টা আমার কাজ, ফল দিবেন আল্লাহ। অতএব আমি প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব। কবি বলেন, হে প্রেমিক! প্রেমের পথ কণ্টকাকীর্ণ?! আসলে তুমি সাহস হারিয়েছ।/হে পথিক! পদে পদে তোমার ঘটেছে পদস্খলন?! আসলে তোমার পা-ই খোড়া, পথ বাঁকা নয়।/বন্ধু! পথের কষ্টে ভয় পেয়ো না, সাহসে বুক বাঁধ। পথ কঠিন নয়, কঠিন হল পথচলা।/কর্মই তোমাকে নিয়ে যাবে সমাপ্তির শিখরে। সূচনাই কঠিন, সমাপ্তি কঠিন নয়।
খ. মুখস্থ করতে থাকা আমার কাজ। কতটুকু মুখস্থ হল, কত দিনে হল এটা আমার চিন্তার বিষয় নয়। আমি চেষ্টা করতে থাকব আর বলতে থাকব-
গ. ভুলে যাওয়ার ভয়ে মুখস্থ না করা বোকামী। এ যেন ময়লা হওয়ার ভয়ে কাপড় না ধোয়া, অপরিষ্কার হওয়ার ভয়ে আঙ্গিনা পরিষ্কার না করা আর ক্ষুধার ভয়ে আহার না করা।
কবি বলেন-
আমি বলি, ভোলার জন্যই মুখস্থ করুন এবং ভুলতে থাকুন। কত ভুলবেন? এ বিষয়ে কামাল হাসিল করা নিশ্চয়ই আপনার কম্ম নয়!!
কারো মনে হতে পারে যে, ভুলে যাওয়া গুনাহ। অতএব মুখস্থ করে গুনাহর ঝুঁকি সেধে নেওয়ার দারকার কী? আসলে ভুলে যাওয়া গুনাহ নয়, অবহেলা ও চর্চাহীনতার দ্বারা ভুলে যাওয়া গুনাহ। তাই কেউ যদি মুখস্থ করার পর চর্চা ও অনুশীলন অব্যাহত রাখে তাহলে ভুলে যাওয়ার গুনাহ থেকে (কুরআন মজীদের ক্ষেত্রে) এবং ভুলে যাওয়ার বে-বরকতি থেকে (কুরআন ও গায়রে কুরআন সবকিছুর ক্ষেত্রে) আল্লাহ তাআলা তাকে হেফাযত করবেন।
ঘ. একটি সহজ সত্য এই যে, আগ্রহের বিষয় ভোলা যায় না। কবিতা প্রসঙ্গে শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ. একবার বলেছিলেন, ‘যে কবিতা ভালো লাগে তা মুখস্থ হয়ে যায়।’ কাজেই যা মুখস্থ করতে চান অন্তরে তার মহববত বাড়ান। মনে রাখবেন, হৃদয়ে যদি ভালবাসা জাগে বক্ষে ধারণ সহজ হয়ে যায়। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
টীকা :
১. নুসূস শব্দটি ‘নস্’-এর বহুবচন। এখানে নুসূস অর্থ দলীল-আদিল্লার মূল পাঠ। যেমন, প্রথম পর্যায়ে কুরআন মজীদের আয়াত ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর হাদীস, এরপর সাহাবায়ে কেরামের আছার। দ্বিতীয় পর্যায়ে তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন ও আইম্মায়ে দ্বীনের বাণী এবং কিতাব-সুন্নাহ থেকে আহরিত কাওয়াদে শরীয়তও এতে অন্তর্ভুক্ত।
২. কুতুবে সিত্তা অর্থ হাদীসের ছয় কিতাব। (এখানে উদ্দেশ্য হল বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসায়ী, তিরমিযী ও মুয়াত্তা।)