শাবান-রমযান ১৪২৮   ||   সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০০৭

রমযান ও ঈদের চাঁদ : কার দায়িত্ব কী

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

রমযানুল মুবারক ইবাদত-বন্দেগী ও আল্লাহর নৈকট্য-অন্বেষণের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মওসুম। এ সময় আল্লাহ তাআলার রহমত ও মাগফিরাতের জোয়ার আসে। রমযান শেষে আসে ঈদুল ফিতর, যা কুরআনের ভাষায় আল্লাহর নিয়ামতের পরিপূর্ণতা। তাই এ মাসের মুহূর্তগুলোতে মুমিন হৃদয়ে ঈমানী লযযত তরঙ্গায়িত হতে থাকে। আর তার সত্তা জুড়ে আনন্দ ও প্রশান্তির ঢেউ খেলতে থাকে। কিন্তু এখন পাপাচার ও অনাচারের প্রাবল্যে সমাজের পরিবেশ এতটাই বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে যে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তা মন-মস্তিষ্ককে আক্রান্ত করে। ফলে ঈমানী প্রশান্তি বিনষ্ট হতে থাকে এবং ক্বলবের নূরানিয়্যাত হ্রাস পেতে থাকে। ইদানীং গোদের উপর বিষফোড়ার ন্যায় আরেক নতুন সমস্যা দেখা দিয়েছে। তা এই যে, রমযান বা ঈদের চাঁদ সম্পর্কে কোনো মতানৈক্য সৃষ্টি হলে একে কেন্দ্র করে অনেক মানুষ পরস্পর তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়ে পড়ে এমনকি তা ঝগড়া-বিবাদের রূপও পরিগ্রহ করে গত রোযা ও ঈদের চাঁদকে কেন্দ্র করে যত অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে তা যেকোনো মুসলমানের জন্যই পীড়াদায়ক। এ বিষয়ে মাসিক আলকাউসারের যিলকদ ২৭-ডিসেম্বর ০৬ সংখ্যায় একটি সংক্ষিপ্ত নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল।

সমাজ-পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য ব্যক্তি সংশোধন ও সমাজ-সংশোধনের প্রচেষ্টাই হল একমাত্র পন্থা। এ ক্ষেত্রে দাওয়াত-তাবলীগ এবং তরবিয়ত-তাযকিয়ার মেহনত সবচেয়ে ফলপ্রসূ। তবে সাময়িকভাবে এটুকু অবশ্যই করা উচিত যে, রমযানের দিনগুলো উত্তম পরিবেশে কাটানোর চেষ্টা করা এবং অন্তত এই মুবারক দিনগুলোতে ঘরের পরিবেশে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা।

আর চাঁদকে কেন্দ্র করে তর্ক-বিতর্ক এবং ঝগড়-বিবাদের যে দৃষ্টান্ত আজকাল পরিলক্ষিত হচ্ছে, বলা বাহুল্য যে, তা একেবারেই অর্থহীন একটি কাজ; বরং এক ধরনের স্বাদহীন পাপকর্ম। এটা একেবারেই অনাহূতভাবে সমাজের আতিথ্য গ্রহণ করেছে। এর প্রধান কারণ শরীয়তের হুকুম-আহকাম সম্পর্কে অনবগতি।

আমরা যদি এই একটিমাত্র নীতি অনুসরণ করি যে, জরুরি বিষয়গুলোর প্রয়োজনীয় ইলম অর্জন করব এবং যে বিষয়ে আমার

জানা নেই সে সম্পর্কে চুপ থাকব, আর দ্বীনী বিষয়াদিতে, বিশেষত শরীয়তের সূক্ষ্ম বিষয়গুলোতে, যে সম্পর্কে আমাদের মোটেই জানাশোনা নেই, কিংবা থাকলেও তা শুধু অন্যের মুখে শোনা কিছু তথ্যের হালকা ধারণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, এ জাতীয় বিষয়ে কোনো আলেমের সাথে তো দূরের কথা, নিজেদের মধ্যেও তর্ক-বিতর্ক করব না। এই নীতি অনুসরণ করলে বিভিন্ন দ্বীনী বিষয়ে সংঘটিত বিবাদ-বিসংবাদ সম্পূর্ণ না হোক, বহুলাংশে অবশ্যই হ্রাস পাবে।

কিন্তু এই নীতি অনুযায়ী নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো বিবেচক মানুষ কজন আছেন। আমাদের মধ্যে অধিকাংশেরই অবস্থা এই যে, আমরা সামান্য বিষয়গুলোকেও হাততালি দিয়ে বিবাদ-বিসংবাদ পর্যন্ত পৌঁছে দিতেই যেন তৃপ্তিবোধ করে থাকি। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাজ করা হয় শরীয়তের আহকাম সম্পর্কে অনবগতির কারণে, কিন্তু দ্বীন মনে করে।

এই বিশৃঙ্খলা ও বিপথগামিতার প্রতিকারের জন্য সর্বপ্রথম যে কাজ করা উচিত তা হল, চাঁদ সম্পর্কে সাধারণভাবে এবং রমযান ও দুই ঈদের চাঁদ সম্পর্কে বিশেষভাবে শরয়ী আহকাম ও মাসাইলের বিশুদ্ধ ইলম হাসিল করা। এ বিষয়ে কুরআন-হাদীস ও তার ভাষ্য ফিকহে ইসলামীর আলোকে উম্মাহর বিশিষ্ট আলিমগণ প্রয়োজনীয় পুস্তক-পুস্তিকা রচনা করেছেন। এগুলোর মধ্যে হযরত মাওলানা মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ.-এর পুস্তিকা রুয়াতে হিলাল অত্যন্ত সহজ ও সর্বজনবোধ্য ভাষায় লিখিত। বাংলা ভাষায়ও তা অনুদিত হয়েছে। পাঠকদের প্রতি অনুরোধ, তারা যেন অন্তত এই পুস্তিকাটি অবশ্যই অধ্যয়ন করেন এবং তা বোঝার চেষ্টা করেন।

দ্বিতীয় কাজ এই যে, যদি কখনো চাঁদ প্রমাণিত হওয়া, না হওয়া নিয়ে সরকারী চাঁদ  দেখা কমিটি এবং উলামায়ে কেরামের মধ্যে, কিংবা খোদ আলিমদের মধ্যেই মতানৈক্য সৃষ্টি হয় তখন শরীয়তের দৃষ্টিতে সাধারণ মানুষের করণীয় কী-এ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা।

এ মুহূর্তে আমি কিছু কথা আরজ করতে চাই এবং আশা করি মনোযোগের সঙ্গে কথাগুলো পাঠ করা হবে।

১. প্রথম কাজ, যা ইতোপূর্বে একবার বলে এসেছি, এই যে, আমরা কেউ যেন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার নিজ অঙ্গনের বাইরে পা না রাখি। এটা একদিকে যেমন শরাফত ও দিয়ানতের পরিপন্থী, অন্যদিকে এর মাধ্যমে বিভিন্ন অবাঞ্ছিত জটিলতা, এমনকি বিবাদ-বিসংবাদেরও সূত্রপাত ঘটে। জগতের সকল বিষয়ের (সাবজেক্টের) মতো দ্বীনী বিষয়েও শুধু এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের মতই প্রহণযোগ্য। অন্যদের মতামতের না শরয়ী দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, আর না তা সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে থাকে। শুধু নীতি-শৃঙ্খলা উপেক্ষা করে যেকোনো অভিনব আহ্বানে সাড়া দিতে পারঙ্গম দুচার জন মানুষ এ জাতীয় মতামতকে গ্রহণ করে থাকে এবং তা অবলম্বন করে সমাজের শান্তি ও মানুষের স্বস্তি হরণ করে থাকে। একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি।

কোনো কোনো চিন্তাবিদ- যাদের দ্বীনী উলূম সম্পর্কে পারদর্শিতা তো দূরের কথা, কুরআন-হাদীসের ভাষায় কুরআন-হাদীস বোঝার যোগ্যতাটুকুও নেই, এই সমাধান দিয়েছেন যে, রমযানের সূচনা ও সমাপ্তি, ইসলামী ঈদ ও চাঁদের সঙ্গে সংযুক্ত অন্যান্য ইবাদত চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল না রেখে ক্যালেন্ডার ভিত্তিক করে দেওয়া হোক। বৈজ্ঞানিক নীতিমালার আওতায় প্রণীত এসব ক্যালেন্ডার ভুল-ভ্রান্তিমুক্ত হয়ে থাকে এবং এতে কোনো ধরনের মতানৈক্যও হয় না। এ ক্ষেত্রে চাঁদ দেখা কমিটিরও প্রয়োজন হবে না। ক্যালেন্ডারের মাধ্যমেই বহু বছরের রমযানের সূচনা-সমাপ্তি ও ঈদের তারিখ অগ্রীম জানিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে।

এই সমাধান আপাত দৃষ্টিতে অতি যথার্থ ও চমৎকার হলেও তা নিতান্তই বাতিল ও পরিত্যাজ্য। কেননা, তা শরীয়তের নীতি ও মেযাজ এবং কুরআন-হাদীসের পরিষ্কার নির্দেশনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে উম্মাহর ইজমা রয়েছে যে, চাঁদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইবাদতগুলো চাঁদ দেখার সঙ্গে সংযুক্ত, চাঁদের জন্ম লাভ কিংবা আকাশে চাঁদের বিদ্যমান থাকার সঙ্গে সংযুক্ত নয়।

এখানে এ কথাটি স্মরণ রাখা উচিত যে, ক্যালেন্ডারের ভিত্তি যদি জোতির্বিজ্ঞানের নতুন চাঁদের উপর হয় তবে তা দর্শনযোগ্যই নয় (রুয়াতে হেলাল মওজুদা দাওর মে, জিয়াউদ্দীন লাহোরী, মাহিরে ফালাকিয়াত) চোখে দেখা ছাড়া তার অগ্রীম সময় নির্ধারণ করার কোনো নিশ্চিত পন্থা নেই। এজন্য স্বয়ং জোতির্বিদের মধ্যেই এ বিষয়ে মতানৈক্য হতে থাকে। এ বিষয়ে প্রাচীন ও আধুনিক বিজ্ঞান ও জোতির্বিদ্যার পারদর্শী ব্যক্তিদের বিভিন্ন আলোচনার জন্য দেখুন -রুয়াতে হেলাল মওজুদা দাওর মে, জিয়াউদ্দীন লাহোরী; ইসলামী মাহ আওর রুয়াতে হেলাল, শরীয়ত আওর ইলমে ফালাক কে রোশনী মে, ইয়াকুব কাসেমী পৃ. ৩১-৭৩; রুয়াতে হেলাল, মুফতী মুহাম্মাদ শফী পৃ. ৭, ২৬-৩২

যদি চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্য সময় অগ্রীম নির্ধারণ করা সম্ভবও হয় তবু দর্শন ও দর্শনের সম্ভাবনা এক বিষয় নয়। চাঁদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিধানসমূহকে শরীয়ত সংযুক্ত করেছে চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার সঙ্গে, দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাবনার সঙ্গে নয়। এজন্য যে ক্যালেন্ডার চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার সম্ভাব্য সময়ের উপর ভিত্তি করে প্রণীত হয়েছে তার সঙ্গে রমযান ও ঈদকে সংযুক্ত করার প্রশ্নই আসে না। এজন্য অতীতে যেমন ঈদ ও রমযান চাঁদ দেখার উপর নির্ভরশীল ছিল আজও তেমনি থাকবে। এর উপরই নবী যুগ থেকে অদ্যাবধি উম্মাহর ফকীহগণের ইজমা রয়েছে এবং এটাই হল কুরআন ও হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশনা।

আধুনিক চিন্তাবিদগণ যতই রব তুলুন তুলতে পারেন, এর সামান্যতম মূল্যও শরীয়তে নেই। তাদের কারো যদি এই ধারণা থাকে যে, তাদের সমাধান কুরআন হাদীস সম্মত তবে তা সম্পূর্ণ অমূলক দাবি। সংশ্লিষ্ট আয়াত ও হাদীসের তাহরীফ ও অপব্যাখ্যা ছাড়া এই দাবি কুরআন হাদীস দ্বারা প্রমাণ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

আরও কিছু চিন্তাবিদ রয়েছেন, যারা মনে করেন, চাঁদ দেখার উপর ভিত্তি করে হলেও এমন কোনো নিয়ম হওয়া উচিত, যার মাধ্যমে গোটা মুসলিম বিশ্বে একই দিন রমযানের সূচনা এবং একই দিন রমযানের সমাপ্তি ও ঈদ হবে। তাদের ধারণা মতে এই নিয়ম তৈরি হওয়া জরুরি এবং এছাড়া ঈদের মূল উদ্দেশ্যেই ব্যর্থ হয়ে যায়।

এই দাবিও অমূলক। সকল জনপদে একই দিন রমযান শুরু করা এবং একই দিন ঈদ করা না মুসলমানদের জন্য জরুরি, আর না এতে বিশেষ ছওয়াব ও ফযীলত রয়েছে। না ঈদের উপকারিতা এর সঙ্গে সংযুক্ত আর না ইবাদতের কোনো শরয়ী মাকসাদ ও হিকমত এতে নিহিত রয়েছে।

সাহাবা-যুগে রমযান ও ঈদ মদীনায় কোনো দিন হত, মক্কায় কোনো দিন, শামে কোনো দিন, ইরাক ও মিসরে ভিন্ন কোনো দিন। সকল শহরে একই দিনে রোযা ও ঈদ করা, সে সময়ের উপায় উপকরণের নিরিখে যতটুকু সম্ভব ছিল সাহাবায়ে কেরাম ততটুকুর জন্যও ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। যদি একযোগে রোযা ও ঈদ পালন শরীয়তের দৃষ্টিতে মুস্তাহাবও হত তাহলেও সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়ীন এর জন্য সাধ্যমতো ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন।

তো আমার প্রথম আরজ এই যে, আমরা যেন দ্বীনী বিষয়াদিতে, বিশেষত রোযা ও ঈদের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত সম্পর্কে প্রস্তাব প্রদান থেকে বিরত থাকি। বিশেষজ্ঞ আলিমদের কাছে প্রশ্ন করতে পারি, কিন্তু কোনো প্রস্তাব দেওয়ার অধিকার আমরা রাখি না। উপরন্তু নিজ প্রস্তাবের উপর একগুয়েঁ মনোভাব পোষণ করা এবং একে কেন্দ্র করে বিবাদ-বিসম্বাদের সূত্রপাত ঘটানো যে কতখানি নিন্দনীয় বিষয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

২. দ্বিতীয় আরজ এই যে, যদি কখনো সরকারী চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্তের উপর সকল আহলে হক্ব আলিম আপত্তি উত্থাপন করেন তবে, সেক্ষেত্রে কমিটির দায়িত্বশীলদের কর্তব্য হল, ঘোষিত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে পুনরায় চিন্তা-ভাবনা করা এবং সঠিক ফয়সালায় উপনীত হওয়া। আর যদি কিছু আলিম আপত্তি করেন এবং অন্যরা কমিটির সিদ্ধান্তের সঙ্গে দিয়ানতদারীর সাথে ঐকমত্য পোষণ করেন তাহলে এর অর্থ এই দাড়াবে যে, চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার বিষয়ে আলিমদের মধ্যেই, যারা সবাই হানাফী মাযহাবের অনুসারী, মতানৈক্য সৃষ্টি হল। এ অবস্থায় উলামায়ে কেরামের করণীয় কী তা তো তাঁদের জানাই রয়েছে কিংবা তারা তা জেনে নিতে পারবেন তবে তালিবে ইলম ভাইদের জন্য, আল্লাহ তাআলা যদি তাওফীক দান করেন, আরবী ভাষায় একটি রিসালা রচনা করার ইচ্ছা রয়েছে। এ প্রবন্ধে আমি শুধু এটুকু বলতে চাই যে, এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের করণীয় কী হবে?

এই প্রশ্নের উত্তর এই যে, এখানেও সাধারণ মানুষের করণীয় তা-ই যা আহলে হক আলিমদের মাঝে মতানৈক্যপূর্ণ অন্যান্য মাসআলায় করণীয়। তা এই যে, যে আলিমের প্রতি আপনার অন্তরে আস্থা রয়েছে কিংবা সাধারণত আপনি যার কাছে মাসআলা জিজ্ঞেস করে থাকেন তাঁর ফতোয়া মোতাবেক আমল করবেন। তবে এ সিদ্ধান্ত অন্য সবার উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। কেননা যখন একই মাযহাবের আহলে হকের মাঝে ইখতিলাফ দেখা দিয়েছে তখন আপনি কীভাবে এই আশা করতে পারেন যে, সবাই এক আলিমের তাহকীক মোতাবেক আমল করবেন। জগতের সকল মানুষ আপনার শাইখেরই মুরীদ হবেন কিংবা প্রত্যেকে আপনার পসন্দনীয় মুফতী সাহেবের ফতোয়া অনুযায়ী চলবেন তা জরুরি নয়। যদি মুত্তাবিয়ে সুন্নত অন্য কোনো শায়খ বিদ্যমান থাকেন তবে যার ইচ্ছা সে তাঁরও মুরীদ হতে পারেন, তদ্রƒপ ইলমে দ্বীনের পারদর্শী অন্য কোনো আলিম বিদ্যমান থাকলে যার ইচ্ছা সে তাঁর নিকট থেকেও মাসআলা জিজ্ঞেস করতে পারে, তার ফতোয়া অনুযায়ী আমল করতে পারে। এ বিষয়ে আপনার বাধা দেওয়ার কিংবা এই বলে সমালোচনা করার কোনো অধিকার নেই যে, তুমি ঈদের দিন কেন রোযা রাখলে কিংবা তুমি ত্রিশতম রোযা কেন পরিত্যাগ করলে!

৩. তৃতীয় কথা চাঁদ দেখা কমিটি সম্পর্কে। এ সম্পর্কে আগেও আরজ করেছিলাম যে, সরকারের দায়িত্ব হল চাঁদ দেখা কমিটিকে মজবুত বানানো এবং চাঁদ বিষয়ক সকল বিধি বিধানের অনুগামী থাকতে কমিটিকে বাধ্য করা। নিশ্চয় হেলাল কমিটির নির্ধারিত নীতিমালা রয়েছে। সেই নীতিমালা দেশের নির্ভরযোগ্য আলেমদের সামনে পেশ করে তাতে পরিবর্তন পরিবর্ধনের প্রয়োজন থাকলে তা করা উচিত এবং সেই আলেমদের সাক্ষর ও সত্যায়ন গ্রহণ করে তা প্রচার করা উচিত, যাতে আলিম ও দ্বীনদার শ্রেণী আস্থাশীল হতে পারেন যে, চাঁদ দেখা কমিটি যে মানদণ্ডের ভিত্তিতে ফায়সালা করে থাকে তা বিশুদ্ধ।

এ কমিটি সম্পর্কে জনগণের আস্থা বহাল করার জন্য তাদের কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত সে সম্পর্কে আমরা ইতোপূর্বেও লিখেছি। সংক্ষিপ্ত আকারে আবার তা উল্লেখ করছি।

ক. কমিটি কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষের রোযা ও ঈদ এবং অন্যান্য ইবাদতের গুরুত্ব অনুধাবন করে চাঁদের বিষয়টি বিবেচনা করবেন এবং চাঁদ দেখা কমিটির সকল সদস্যকে, যদিও তিনি জেনারেল শিক্ষিত হন না কেন, এ বিষয়ক সকল মাসআলা ভালোভাবে জানিয়ে দিবেন এবং হেলাল কমিটিকে চাঁদবিষয়ক সকল বিধি-বিধানের অনুসরণ করতে বাধ্য করবেন।

খ. দেশের নেতৃস্থানীয় আলেমদের থেকে আরো কয়েকজনকে এই কমিটির অন্তভুর্ক্ত করা উচিত। এ কমিটির অধিকাংশ সদস্য ফিক্হ বিষয়ে যেন দক্ষ হন এমনভাবে কমিটি সাজানো উচিত।

গ. চাঁদ দেখা কমিটিকে এ বিষয়ে বাধ্য করতে হবে যে, চাঁদ প্রমাণিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সাক্ষ পাওয়া গেলে তারা চাঁদের ঘোষণা দিতে পারবে, কিন্তু সাক্ষ্য ও প্রয়োজনীয় শর্তাবলি পূরণ না হওয়ার ক্ষেত্রে তারা চাঁদের ঘোষণার ব্যাপারে তড়িঘড়ি করতে পারবে না। প্রয়োজনে রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। সকল সদস্য যদি উপস্থিত থাকতে না পারেন তবে তারা অন্যান্য সদস্যকে চাঁদের ঘোষণার ক্ষমতা অর্পণ করে বৈঠক অব্যাহত রাখবেন।

ঘ. বৈঠক সমাপ্ত হওয়ার পরও একটি সাবকমিটি বিদ্যমান থাকবে, যাদের কাছে পরবর্তী সময়ে আসা তথ্য-সংবাদ, সাক্ষ্য ইত্যাদি উপস্থাপন করা যায়। এই কমিটিতে এক-দুজন অভিজ্ঞ মুহাক্কিক আলেম থাকা জরুরি।

ঙ. হেলাল কমিটির সভাপতি বা প্রধান, একজন মুহাক্কিক আলেমকেই বানানো উচিত। সরকারের মন্ত্রী/সচিবগণ কমিটির সদস্য ও সেক্রেটারি থাকতে পারেন।

চ. প্রতি জেলার শাখা কমিটিগুলোকেও আরো ব্যাপক ও সুশৃঙ্খল করা প্রয়োজন এবং প্রত্যেক শাখা কমিটিতেই নির্ভরযোগ্য আহলে হক আলেমদেরকে সদস্য হিসেবে অন্তভুর্ক্ত করা জরুরি। এই কমিটিগুলোর সার্বক্ষণিক সঙ্গে সাধারণ মুসল্লিদের সরাসরি সম্পর্ক এবং কেন্দ্রের সঙ্গে এই কমিটিগুলোর সম্পর্ক নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য থানায় থানায় মসজিদ ও মাদরাসাভিত্তিক শাখা কমিটি থাকা প্রয়োজন।

ছ. মিডিয়াকে বাধ্য করতে হবে, তারা যেন চাঁদের বিষয়ে শুধু চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্তই প্রচার করে এবং কমিটির ভাষায় তা প্রচার করে। কেননা তারা যদি নিজেদের পক্ষ থেকে

মানুষকে চাঁদের সংবাদ প্রদান করে তবে মানুষ কীভাবে সেই সংবাদের উপর নির্ভর করবে?

যদি এমন দায়িত্বশীল খোদাভীরু দ্বীনদার কর্মকর্তা ও নির্ভরযোগ্য আলেমদের সমন্বয়ে চাঁদ দেখা কমিটি কার্যকর থাকে তবে সে ক্ষেত্রে এমনও বিধান করা যাবে যে, চাঁদের ঘোষণা ও স¤প্রচার চাঁদ দেখা কমিটি ছাড়া দেশের অন্য কেউ করতে পারবে না।

মোটকথা, এ জাতীয় জরুরি পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করে চাঁদ দেখা কমিটির নির্ভরযোগ্যতা প্রতিষ্ঠা করা সরকারের জন্য অপরিহার্য। অন্যথায় এক সময় দেখা যাবে উলামায়ে কেরাম মুসলিম জনগণের ইবাদত-বন্দেগীকে রক্ষা করার জন্য বর্তমান চাঁদ দেখা কমিটির বিকল্প খেঁাজার এবং জনগণকে সেই বিকল্পের উপরই আস্থাশীল হওয়ার ফত্ওয়া দিতে হয়তো বাধ্য হবেন। আল্লাহ তাআলা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদেরকে বিষয়টি যথাযথভাবে অনুধাবন করার তাওফীক দান করুন এবং বিষয়টির গুরুত্ব বিবেচনা করে এর জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা তাদের জন্য সহজ করে দিন। আমীন।

 

 

advertisement