চাকুরী
সেবা কিংবা চাকুরির পার্সেন্ট ঠিক করে নিতে পারেন বারডেম এর ডাক্তারগণ
দাবি আদায়ের জন্য মানুষকে জিম্মি করলে আমরা সমালোচনায় সরব হই। জিম্মিকারীদের নিন্দা করি ও ক্ষুব্ধ হই। অস্ত্রের মুখে কিছু মানুষকে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ঠেলে দিয়ে দাবি আদায়ের এ পদ্ধতিটিকে আমরা অমানবিক বলি। বলি, এটা হচ্ছে অসভ্য, বর্বর ও অশিক্ষিত শ্রেণীর ঘৃণ্য কৌশল। কিন্তু শিক্ষিত চিকিৎসক সমাজ যখন মরণাপন্ন রোগীদের চিকিৎসা থামিয়ে দিয়ে চাকুরি নিশ্চিত করার দাবি করেন, দাবিটিকে বাস্তবায়িত করতে দিনের পর দিন অসহায় রোগীদের সামনে দিয়ে কর্মবিরতি দেয়া চিকিৎসকরা সাদা পোশাক গায়ে চড়িয়ে ক্ষুদ্ধ ও বিরক্ত মুখে চলাচল করেন তখন সেই কৌশলী কর্মপন্থাকে আমরা কী বলবো? সেটা কি মানবিক ও ভদ্রোচিত পন্থা হিসেবে গণ্য হতে পারে? গত জুনের শেষ সপ্তাহে দেশের প্রধান ডায়বেটিক বিশেষায়িত হাসপাতাল বারডেম-এর শতশত ডাক্তার একাজটি করেছেন। তাদের দাবির যৌক্তিকতা, তাদের পেশাগত জীবনের অনিশ্চয়তা এবং তাদের রাশি রাশি বক্তব্য ও ক্ষুব্ধতার পাশাপাশি পত্রপত্রিকায় তাদেরই চিকিৎসা বিরতির কারণে মুমূর্ষু, অসহায়, বিপন্ন ও হতাশ রোগী এবং রোগীর নিকটজনদের অশ্র“মাখা মুখের ছবি ও সংবাদ ছাপা হয়েছে। হাত গুটিয়ে রাখা ডাক্তারদের ভাবলেশহীন মুখের সামনে দিয়ে ব্যর্থ ও কাতর রোগীরা স্ট্রেচারে করে হাসপাতাল ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। সেই সব চিকিৎসাবঞ্চিত রোগী, সেই সব রোগীদের স্বজন এবং তাদের খবর দেখা ও পড়া মানুষেরা কি বারডেম-এর ওই ডাক্তারদের দাবির ন্যায্যতা নিয়ে মাথা ঘামানোর ফুরসৎ পেয়েছেন? নাকি বুকের মধ্যে মানবতা ও সেবাশূন্য ‘চাকুরিজীবী’ ডাক্তারদের প্রতি স্তুপ স্তুপ ঘৃণার অস্তিত্ব নিয়ে সীমাহীন বেদনা ও অস্বস্তিতে ভুগেছেন, বারডেম-এর ডাক্তারসমাজ সে বিষয়ে একটু খোঁজ নিলে ভালো করতেন।
সার্ভিস ও সেবার পরিবর্তে ইউনিয়ন, দাবি ও শ্লোগানের পাল্লাটাই এ দেশের ভাগে যেন একটু বেশি পরিমাণে দেখা যায়। এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে ইউনিয়ন নেই, দাবি ও চিৎকার নেই এবং এসব নিয়ে ক্ষয়-ক্ষতি ও ভোগান্তি নেই। সরকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শিল্প ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সব শাখাতেই এ অবস্থা। গচ্চার কারণে বহু প্রতিষ্ঠান এ কারণে বন্ধ হয়েছে, বহু প্রতিষ্ঠান বিক্রি হয়েছে, বহু প্রতিষ্ঠান ভারী মাথা নিয়ে হোচট খেতে খেতে চলছে। বেসরকারী সেক্টরের মধ্যে এক গার্মেন্টস সেক্টরে বছর খানেক আগে যে নৈরাজ্যের সর্বনাশা আগুন দেখা গিয়েছিল- এদেশের বেসরকারী খাতে দাবি দাওয়ার নেতিবাচক প্রবণতা নিয়ে ভয় পেয়ে যাওয়ার জন্য সেটুকুই যথেষ্ট। কিন্তু সাধারণ মানুষের স্বস্তি ও আশার কিছু অবলম্বন এরপরও থাকতে হয়। ধারণা করা হয়েছিল এবং ধারণা করা অন্যায়ও ছিল না যে, এসব জন ভোগান্তি মার্কা দাবি ও আন্দোলন থেকে অন্তত বহু অভিযোগে অভিযুক্ত থাকা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যখাত এবং চিকিৎসক সমাজ ভিন্ন থাকবেন। অন্তত চিকিৎসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি কখনো হবে না। যদিও কোনো কোনো হাসপাতালে কোনো কোনো দুর্ঘটনা কিংবা তাৎক্ষণিক সংকটের কারণে ইন্টার্নি ডাক্তারদের দু-চার ঘণ্টা বা দু-চারদিনের কর্ম বিরতির ঘটনা ইতিপূর্বে ঘটেছে, কিন্তু এভাবে গোটা হাসপাতাল চিকিৎসাশূন্য হয়ে যাওয়ার ঘটনা তখন ঘটেনি। চিকিৎসা কোনো না কোনো ভাবে চলেছে। ধর্মঘটের কারণে চিকিৎসায় বড় ধরনের ব্যাঘাত ইতিপূর্বে সৃষ্টি হলেও জনগণের চোখে সেভাবে সেটা ধরাও পড়েনি। কিন্তু ডায়বেটিক রোগীদের অসহায়ত্ব অন্যখানে। এ রোগে আক্রান্তদের মেডিসিন ও সার্জারি কোনো পর্যায়ের চিকিৎসাই বারডেম-এর মতো ডায়বেটিক বিশেষায়িত হাসাপাতাল ছাড়া নিরাপদ নয়। অর্থাৎ বারডেমে ভর্তি হওয়া রোগীকে ইচ্ছা ও সামর্থ থাকলেও বিকল্প হিসেবে অন্য হাসপাতালে নেওয়া সম্ভব নয়। রোগীর মজবুরী যেখানে এ পর্যায়ের সেখানে চিকিৎসা বন্ধ করে চাকুরির নিশ্চয়তার দাবি জানানো এবং দাবিতে সপ্তাহ খানেক বা অনির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য চিকিৎসা বন্ধ করে রাখায় রোগীগণ কতটা বিপন্নতার মধ্যে পড়তে পারেন, তা সহজেই অনুমেয়। সে বিপন্নতার মধ্যে রোগীদের ফেলেই ডাক্তাররা তাদের দাবি পূরণের পক্ষে প্রতিশ্র“তি আদায় করেছেন।
ডাক্তারদের দাবি ছিল, তাদের চুক্তিভিত্তিক (অস্থায়ী) নিয়োগকে স্থায়ী করতে হবে। তা না হলে দশ-পনের বছর এখানে শ্রম ও সেবা দেওয়ার পর এ চুক্তি বাতিল হলে তাদের কর্মজীবন বিপন্ন হবে। দাবি যথার্থ। কিন্তু এর সঙ্গে এটাও স্মরণযোগ্য যে, তারা অস্থায়ী ভিত্তিতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েই এ হাসপাতালে সাগ্রহে যোগ দিয়েছিলেন। তখন পরবর্তীতে এ অস্থায়ী নিয়োগের পরিণতি কী হতে পারে, সেটা অনুমান করেই তারা সম্মতি দিয়েছিলেন। সুতরাং চাকুরিজীবী মানুষ হিসেবে তাদের দাবি বাস্তব ভিত্তিক হলেও নৈতিক ভিত্তি সে দাবির পেছনে দুর্বল ছিল। আর এ ধরনের দাবি নিয়ে রোগীদের বিপন্ন করার উদ্যোগ ও কর্মসূচী ছিল মানবিকতার সীমা বহির্ভূত। ধরেই নেওয়া যাক, ডাক্তারদের দাবি একশ’ভাগ সঠিক ও যৌক্তিক ছিল, তারপরও কি সে দাবি পূরণের জন্য ‘রোগীমারা’ কর্মবিরতি করার নৈতিক অধিকার তারা রাখেন? প্রচলিত ট্রেড ইউনিয়নের মতো আচরণ করে আদমজির সিদ্দীক, ব্যাংকপাড়ার জামাল-বাকিরদের কাতারে এদেশের উচ্চ শিক্ষিত স্বাস্থ্য সেবক-ডাক্তাররাও নেমে পড়েছেন, ভাবলে মনটা আচ্ছন্ন হয়ে যায় হতাশায়। বিপন্ন মানুষকে ভিকটিম বানিয়ে এভাবে দাবি আদায়ের কালচার বিকশিত হতে থাকলে এমনও দিনের দেখা মিলতে পারে, বিমানটাকে আকাশে উঠিয়ে নিয়ে পাইলট দাবি আদায়ে কর্তৃপক্ষকে ফোনে কমবিরতির ঘোষণা দিচ্ছেন কিংবা ওটিতে রোগীর পেট বা বুক কেটে অপারেশন অর্ধেক সেরে ডাক্তাররা কর্মবিরতির চ্যালেঞ্জ দিচ্ছেন। আর সেটাকেও ইউনিয়নের স্বাভাবিক দাবি আদায়ের বৈধ উপায় হিসেবে মনে করে নিচ্ছে দাবি-দাওয়া পেশকারীরা।
বারডেমে ডাক্তারদের চাকুরির নিশ্চয়তা কেন্দ্রিক এই ‘কর্মবিরতি’র পর মনে যে তিক্ত বাস্তবতাটি ধাক্কা দিচ্ছে সেটি হচ্ছে, ডাক্তারদের বড় একটি অংশের কথা ঘোষণা দেওয়ার সময় হয়ে গেছে যে, তারা তাদের পেশায় কতভাগ চাকুরিজীবী আর কতভাগ সেবক। যদি চাকুরিজীবীর ভাগটাই বেশি দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে চাকুরির শৃঙ্খলা, কঠোর নিয়মানুবর্তীতা, আনুগত্য এবং বাস্তব দায়িত্বশীলতাটুকু যেন তাদের আচরণে অক্ষুন্ন থাকে। চিকিৎসকদের এমন দুর্দিন আমরা দেখতে চাই না যে, জনগণের দাবির মুখে ‘স্বাস্থ্য-অপরাধ’ নামের নতুন কোনো ফৌজদারি আইন বিধিমালা তৈরির পর তাদের সেবার সঙ্গে সে বিধিমালার কালোছায়াকে কোনো সরকার সচল করে দিয়েছে। ডাক্তাররা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন আর তাদের পেছনে পেছনে সন্দেহকারী তদন্ত দল ছুটে বেড়াচ্ছে।