রজব ১৪২৮   ||   আগস্ট ২০০৭

তরবিয়ত
শিশুর সঙ্গে সত্যবাদিতা

আবিদা

আম্মা তাঁর শৈশবের একটি ঘটনা আমাদেরকে বলেছেন। সে সময় তার খুব পেটে ব্যথা হত। চিকিৎসক এক্সরে করাতে বললেন। এক্সরে করানোর আগে খুব বিস্বাদ ও কটুগন্ধী এক ধরনের জিনিস পান করতে হত। আম্মা যখন জিনিসটা দেখলেন ও তার ঘ্রাণ পেলেন তখন কিছুতেই তা পান করতে প্রস্তুত হলেন না। নানীজান বিভিন্নভাবে তাকে বোঝাতে লাগলেন যে, এর ঘ্রাণ ভালো না হলে কী হবে, স্বাদ ভালো। তোমার খেতে একটুও খারাপ লাগবে না ইত্যাদি। আম্মা নানীজানের কথায় কিছুটা আস্বস্ত হলেন বটে, কিন্তু যেইমাত্র জিনিসটা একটুখানি পান করেছেন অমনি একদম গোঁ ধরে বসলেন যে, এই জিনিস তিনি আর খাবেন না। নানীজান যত কিছুই বলেন কিছুতেই তিনি বিশ্বাস করেন না। নানীজান রাগান্বিত হয়ে ধমক দিলেন, কোমল স্বরে আদরের কথা বললেন, কিন্তু সবই ব্যর্থ হল।

নানাজী ছিলেন তাঁর কামরায়। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে কী হয়েছে দেখতে এসে নানীজানকে বললেন, ঠিক আছে আমাকে দাও।এরপর আম্মার দিকে তাকিয়ে বললেন, মামণি, আমি তোমাকে সত্য কথা বলব। এই ওষুধটার স্বাদ ভালো নয় এবং তা পান করা মোটেই সহজ নয়। একবার আমাকেও ডাক্তার এই ওষুধ দিয়েছিল, কিন্তু আমি তা পান করতে পারিনি। তাই পেটের ব্যথা নিয়েই দিন কাটিয়েছি। কিন্তু তুমি কি আব্বুর মতো হবে? আমি তো মনে করি, তোমার সাহস আমার চেয়েও বেশি। আমি যা করতে পারিনি তুমি তা করে দেখাবে এবং আল্লাহ তোমাকে সুস্থ করবেন।

আম্মা বলেন, আব্বা যখন আমাকে এই কথাগুলো বললেন তখন আমি নাক চিপে

ধরে, চোখ বন্ধ করে ওষুধটা পান করেছিলাম। কেননা, আমার মনে হয়েছিল যে, আব্বা আমার কষ্টটা বুঝছেন।

*   *   *

আমরা অনেক সময় বুঝি না, কিন্তু একথা ঠিক যে, শিশুরা আমাদের ধারণার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান। আমরা যদি তাদের সঙ্গে মিথ্যা বলি তাহলে তারা খুব সহজেই তা বুঝতে পারে। এরপর তারাও আমাদের সঙ্গে সেই কৌশল প্রয়োগ করে এবং মিথ্যা বলে। এভাবে তাদের মধ্যে মিথ্যা বলার অভ্যাস সৃষ্টি হয়। আর মিথ্যা হল এমন এক বদঅভ্যাস, যা রপ্ত করা খুব সহজ, কিন্তু পরিত্যাগ করা খুব কঠিন।

শিশুরা কখনো মিথ্যা বলে আগ্রহের জিনিসটা পাওয়ার জন্য, কখনো মিথ্যা বলে শাস্তির ভয়ে। শৈশবের কথা এখনো আমার মনে আছে। যদিও আমরা সত্য বলতেই অভ্যস্ত ছিলাম এবং পরিবারের সবাই আমাদের সঙ্গে সত্য বলতেন, তবুও কখনো কখনো শাস্তির ভয়ে মিথ্যা বলতে উদ্যত হতাম।

নানাজী এ বিষয়ে কখনো ছাড় দিতেন না। তবে এর চিকিৎসা করতেন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে। কারো সম্পর্কে যদি তাঁর ধারণা হত, সে মিথ্যা বলছে, তাহলে তিনি তাকে প্রতিশ্রতি দিতেন, সে যদি সত্য বলে তাহলে তাকে কোনো শাস্তি দিবেন না। সত্যিই তিনি শাস্তি দিতেন না। শুধু অপরাধটি জেনে ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতেন। নানাজীর এই নিয়ম আমাদের জানা ছিল। তাই আমরা তাঁর কাছে এবং মায়ের কাছে সর্বদা সত্য কথা বলতাম। আমাদের বিশ্বাস ছিল যে, সত্য বলার কারণে আমরা শাস্তি থেকে নিরাপদ থাকব। এভাবে একসময় সত্য বলা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হল এবং পরবতীর্তে শাস্তির বিষয়ে পূর্ণ ইয়াকীন হলেও আমরা মিথ্যা বলতে পারতাম না।

*   *   *

নানাজীর সঙ্গে এবং মায়েদের সঙ্গে আমাদের সবকিছু ছিল স্পষ্ট ও খোলামেলা। যখন আমাদের বয়স সাত বছর হল তখন নানাজী আমাদেরকে নামায পড়তে উদ্বুদ্ধ করলেন, কিন্তু নামাযের প্রতি আগ্রহী করার জন্য তিনি একথা বলেননি যে, নামায খুব সহজ কাজ ইত্যাদি। তদ্রূপ যখন আমাদের পর্দা করার সময় হল তখন তিনি আমাদেরকে প্রথমেই সচেতন করে দিলেন যে, পর্দা একটি কঠিন বন্ধন। এভাবে প্রত্যেক বিষয়ের কঠিন দিক আমরা নিজেরা অনুভব করার আগে তিনিই তা আমাদের সামনে তুলে ধরতেন, এরপর অতুলনীয় প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তা জয় করার সাহস যোগাতেন।

একজন মেয়ের জন্য অবশ্যই পর্দা একটি কঠিন বন্ধন, বিশেষত তার নতুন তারুণ্যের রঙিন দিনগুলোতে। নানাজী এই মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলেই তার কোনো মেয়েকে কিংবা নাতনীকে বিপরীত ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করতেন না; বরং মুখে এর কঠিনতার কথাই বলতেন, এরপর বিভিন্নভাবে বিষয়টিকে সহজ করে দিতেন।

একটি দৃষ্টান্ত দিচ্ছি- আমার বড় খালার যখন পর্দার বয়স হল তখন নানাজীর ইঙ্গিতে নানীজান তাকে খুব ভালো একটি দোকানে নিয়ে গেলেন এবং সবচেয়ে সুন্দর ও মূল্যবান ওড়নাটি কিনে দিলেন। আমার ধারণা, সেই ওড়নাটি কিনতে নানাজীকে তার মাসিক বেতনের একচতুর্থাংশ ব্যয় করতে হয়েছিল- নানাজী তখন আদালতের বিচারপতি ছিলেন। এর ফল এই হয়েছিল যে, সেই মূল্যবান ওড়না পড়ে যখন খালাম্মা মাদরাসায় গেলেন তখন অন্য ছাত্রীরাও তার মতো ওড়না সংগ্রহ করতে প্রতিযোগিতায় লেগে গেল। ফলে ওড়না তার মাথাব্যথা না হয়ে মাথার মুকুট হয়েছিল।

 

 

advertisement