রজব ১৪২৮   ||   আগস্ট ২০০৭

হীনম্মন্যতা
পিছিয়ে থাকার রোগ

নাঈম আবু বকর

মানুষের পরকালীন বা ইহকালীন যে কোনো উন্নতির মূল চাবি হচ্ছে দৃঢ় মনোবল। দৃঢ় মনোবল ছাড়া উন্নতি অসম্ভব। আমরা যে অল্পতেই হতাশ হয়ে পড়ি, উন্নতির ক্ষেত্রে আমাদের টার্গেট হয় ছোট ছোট, কোনো কিছু করতে হলে দীর্ঘ সাধনা লাগবে, ফলে সেটা করতে আমরা মনে জোর পাই না-এগুলো সবই হীনম্মন্যতার পরিচায়ক। মনোবল যার আছে, সাহস যার আছে, সে ভয় পায় না। ঝুঁকি নিয়ে হলেও সামনে বাড়ে। সে ঠিক করে, আমাকে এটা করতে হবে। তারপর লক্ষ্য পূরণে সে করে যায় অবিরাম সাধনা। এক সময় দেখা যায়, সে আপন লক্ষ্যে পৌঁছে গেছে। না পৌঁছালেও কাছাকাছি। ইতিহাসের উন্নতি করা মনীষীদের ক্ষেত্রে সাধারনভাবে এ নিয়মটিই অনুসৃত। উন্নতি,অগ্রগতির এটাই নিয়ম, এটাই প্রধান উপায়।

আমাদের পূর্বসুরীদের মনোবল কখনো দুর্বল ছিল না। সাহাবী-তাবেয়ীদের প্রায় সবাই ছিলেন দৃঢ় মনোবলে বলিয়ান। ইতিহাসের পাতা উল্টালেই এর অসংখ্য নজীর চোখে পড়ে। শুধু একটি ঘটনা শুনুন! হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাযি: বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের পর আমি এক আনসারী সাহাবীকে বললাম, চলুন, আমরা বড় বড় সাহাবীদের কাছে জিজ্ঞেস করে করে ইলম অর্জন করবো। এখন তাদের সংখ্যা অনেক একদিন তাঁরা থাকবেন না। আমাদের কাছে তখন লোকজন জানতে আসবে। তিনি বললেন, আরে এত বড় বড় সাহাবীগণ থাকতে তোমাকে কে জিজ্ঞেস করতে আসবে? তার কথা শুনে আমি তার আশা বাদ দিলাম। নিজেই চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলাম। কোনো হাদীস শুনলেই বর্ণনাকারীর দরজায় গিয়ে চাদর বিছিয়ে পড়ে থাকতাম। তার কষ্ট হবে ভেবে আওয়াজ দিতাম না। যখন তিনি বের হতেন আমাকে দেখে হতবাক হয়ে বলতেন, আল্লাহর রাসূলের চাচাতো ভাই! কী মনে করে? খবর পাঠালেই তো আমি যেতে পারতাম। আমি বলতাম, আমার আসাই বেশি যুক্তিযুক্ত। তারপর আমি তাকে সে হাদীস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতাম। শেষ পর্যন্ত সেই আনসারী দেখেছেন, আমার চারপাশে মানুষের ভীড়। তারা আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করছেন। তখন তিনি বললেন, এতরুণ আমার চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান ছিলো। দেখুন, কেমন মনোবল ছিল তাঁর! আর এ মনোবল ও নবীজীর দুআর ফলে কোথায় পেঁৗছে ছিলেন তিনি। রঈসুল মুফাসসিরীন ইবনু আব্বাস বলেন... শুনলেই সবাই চোখ তুলে তাকায়। তাফসীরের ক্ষেত্রে তাঁর অভিমত অন্যাদের মতের চেয়ে অগ্রগণ্য হয়ে থাকে।

এবার আমাদের মনোবলহীনতা আমাদেরকে কোথায় নিয়েছে, কিভাবে আমাদেরকে তুচ্ছ তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত করে রেখেছে-তার একটি নমুনা দেখুন।

উলুয়্যুল হিম্মাহগ্রন্থের লেখক মুহাম্মদ বিন আহমদ আলমুকাদ্দাম লিখেছেন, একবার আমি আমার বন্ধু এক বড় রাজনৈতিক নেতার কাছে গেলাম। তিনি খুব উৎফুল্ল ছিলেন। সাধারণত এতটা উৎফুল্ল তাকে দেখা যেতো না। আমি বললাম, ব্যাপার কী? আপনাকে আজ খুব খুশি খুশি দেখাচ্ছে যে?

: খুশি খুশি দেখাবে না? আজ যে আমি তিন তিনটি বিজয় লাভ করেছি।

: তাই নাকি? আজকাল তো আমরা একশোটা পরাজয়ের মধ্যেও একটা বিজয় পাই না। কী সে বিজয়গুলো? যদি গোপন কিছু না হয় . . .?

: প্রথম বিজয় হচ্ছে, তিনদিন যাবৎ আমার শোবার ঘরে একটি মাছি ঢুকেছিল। মাছিটি আমাকে খুবই বিরক্ত করছিল। আজ আমি সেটাকে মারতে সক্ষম হয়েছি।

: দ্বিতীয় বিজয়?

আজকে মেপে দেখলাম, আমার ওজন নিরানব্বই কেজি থেকে নেমে আটানব্বই কেজি সাতশো পঞ্চাশ গ্রাম হয়েছে।

: তৃতীয় বিজয়?

আজ পাশা খেলায় এক বন্ধুকে আমি পরপর দুবার হারিয়েছি। সে সবসময় আমাকে হারিয়ে দেয়। তুমিই বল, এ বিজয়গুলো পেয়েও কি আমি উৎফুল্ল হব না?

: অবশ্যই! অবশ্যই!!

তারপর ভারাক্রান্ত মনে আমি সেখান থেকে বিদায় নিলাম।

প্রিয় পাঠক, সত্যিই আমাদের বর্তমান করুণ দশার জন্য হীনম্মন্যতাই প্রধানত দায়ী। মানসিকভাবে আমরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি।

তাই সাহাবী- তাবেয়ীদের জীবন থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। ভয়-ভীতি ঝেড়ে ফেলতে হবে। ভুলে যেতে হবে অতীত ব্যর্থতা। ইসলাম ও মুসলমানের হিত সাধনের জন্য উল্লেখযোগ্য কিছু করার দীপ্ত চেতনায় আমাদের উজ্জীবিত হতেই হবে।

 

 

advertisement