রজব ১৪২৮   ||   আগস্ট ২০০৭

হযরত হারদুঈ : যে শিক্ষাগুলো ব্যাপক হওয়া দরকার

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

মুহিউসসুন্নাহ হযরত মাওলানা আববারুল হক হারদুঈ রহ. (জন্ম ১৩৩৯ হিজরী মৃত্যু ১৪২৬ হিজরী)-এর ব্যক্তিত্ব এই শেষ যুগে উম্মতের জন্য ছিল এক মহান নেয়ামত। তাঁর শিক্ষা ও হেদায়াতের আলো আলহামদুল্লিাহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ.-এর শেষ খলীফা হওয়ার কারণে তাঁর ব্যক্তিত্ব রূপান্তরিত হয়েছিল সকলের মধ্যমণিরূপে। ব্যক্তি জীবনে তিনি নিজেকে তাকওয়া তাহারাতে (আখলাক ও আদর্শের পবিত্রতা) উত্তীর্ণ রেখে দাওয়াত, তাবলীগ, তালীম ও তাযকিয়ার ময়দানে অক্লান্ত পরিশ্রমরত অবস্থায় ৮৭ বছর বয়সে এই নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে যান।

হযরতের গুরুত্বপূর্ণ কীর্তিগুলোর অন্যতম হচ্ছে আশরাফুল মাদারিসহারদুঈ এবং মজলিসে দাওয়াতুল হক। বিশ্বের অনেক দেশেই এখন মজলিসে দাওয়াতুল হকের শাখা বিদ্যমান। মজলিসে দাওয়াতুল হক বাংলাদেশ-এর প্রতি হযরতের কৃপাদৃষ্টি ছিল অনেক বেশি। আল্লাহ তাআলা হযরতের এই সুধারণা কবুল করুন।

বেশ কিছুদিন থেকে ভারত উপমহাদেশের কোনো কোনো ব্যক্তি বা গ্রুপের পক্ষ থেকে এই বাতিল চিন্তা-ধারণা যা এক পর্যায়ে ঈমান বিধ্বংসীও প্রচার করা হচ্ছে যে, কুরআনে হাকীমের শুধু তেলাওয়াত কোনো সওয়াবের কাজ নয়। আসল বিষয় হচ্ছে কুরআন বোঝা। সুতরাং যে ব্যক্তি না বুঝে কুরআন পড়বে সে কোনো সওয়াব পাবে না। (নাউযুবিল্লাহ)

এই ধারণা যে সম্পূর্ণ বাতেল তাতো খুবই স্পষ্ট বিষয়। কারণ কুরআনে হাকীমের তেলাওয়াত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। অর্থ না বুঝে তেলাওয়াত করলে সে তেলাওয়াতও ঈমান, আমল এবং ইসলাহ ও তারবিয়তের ক্ষেত্রে অনেক উপকার পৌঁছায়। আর পরকালের সওয়াব তো আছেই। সেখানে তো প্রত্যেক হরফের জন্যই কমপক্ষে দশ নেকী করে পাওয়া যাবে।

হযরত হারদুঈ রহ.কে আল্লাহ জাযায়ে খায়ের দিন তিনি এই বাতেল বিশ্বাসের অসারতা এবং সহীহ মাসআলা না বুঝে তেলাওয়াত করলেও প্রতি হরফে দশ নেকী পাওয়া যাবে-একথা মানুষের মনে বদ্ধমূল করার জন্য এই নির্দেশনা দিতেন যে, মশকের সময় কিংবা কোনো মাহফিলে তেলাওয়াত করার সময় যেন শ্রোতাদেরকে সতর্ক করার জন্য নিম্নোক্ত কথাগুলো তেলাওয়াতের আগে বলে নেওয়া হয়।

তেলাওয়াতের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ফায়েদা

১. দিলের মরিচা দূর হয়।

২. আল্লাহ তাআলার মহব্বত বৃদ্ধি পায়।

৩. না বুঝে পড়লেও প্রত্যেক হরফে দশ নেকী পাওয়া যায়। যদি কেউ বলে যে, না বুঝে পড়লে কী লাভ? তবে সে হয় বদ-দ্বীন, না হয় জাহেল।

তেলাওয়াতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ আদব

১. তেলাওয়াতকারী অন্তরে এই খেয়াল করবে যে, আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন যে, শোনাও দেখি তুমি কেমন পড়।

২. শ্রোতা অন্তরে এই খেয়াল করবে যে, আহকামুল হাকিমীন এবং সবচেয়ে বড় মেহেরবানের কালাম পড়া হচ্ছে। সুতরাং অত্যন্ত আজমত ও মহব্বতের সঙ্গে শুনতে হবে।

এ দ্বারা হযরতের উদ্দেশ্য এটাই ছিল যে, সহীহ মাসআলাটি যেন মানুষের অন্তরে বদ্ধমূল হয়ে যায়। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ এটা থেকে একথা বুঝতে আরম্ভ করেছে যে, একথাগুলোর কারণে মানুষের অন্তর থেকে কুরআন বোঝার গুরুত্ব কমে যায়। তাদের এ ধারণা ঠিক নয়। কেননা কুরআন বোঝার চেষ্টা করা এবং কুরআনের তালীম ও হেদায়াত নিয়ে চিন্তা ভাবনা করা একটি স্বতন্ত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ আমল, যা স্ব স্ব অবস্থান অনুযায়ী প্রত্যেক মুমিনের জন্যই কাম্য।

স্বয়ং হযরত হারদুঈ রহ. এক মিনিটের মাদরাসানামে দাওয়াতের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত উপকারী ধারা শুরু করেছেন, যাতে নামাযের যিকির ও দুআগুলোর অনুবাদের পাশাপাশি ওইসব সংক্ষিপ্ত সূরাগুলোর সহজবোধ্য অনুবাদও সন্নিবেশিত করেছেন যেগুলো সাধারণ মানুষ অধিকাংশ সময় নামাযে তেলাওয়াত করে থাকে।

আজ কুরআন বোঝার বিষয়টি ব্যাপক করার জন্য বিভিন্ন পন্থায় মেহনত চলছে। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে সবগুলোই সুচারু ও সুষ্ঠু নিয়মনীতির আওতায় হচ্ছে না, যার ফলে কোথাও কোথাও এই ফলাফল সামনে আসছে যে, অনেক ইংরেজি শিক্ষিত লোক কুরআনের শুধু অনুবাদ কিংবা কোনো তাফসীরের সংক্ষিপ্ত অনুবাদ পুঁজি করেই নিজেকে মুজতাহিদ ভাবতে শুরু করেছে এবং তারা যেন দ্বীনের ইজমাসম্পন্ন বিধান এবং উম্মতে মুসলিমার স্বতঃসিদ্ধ বিষয়গুলো- যেগুলো মূলত কুরআন হাদীসেরই ভাষ্য- অস্বীকার করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। একথা স্পষ্ট যে, কুরআন বোঝার নামে এমন লাগামহীনতা এবং মানসিক বিভ্রাটের কোনো সুযোগ ইসলামে নেই। তাই সংশি­ষ্ট সকল দায়িত্বশীলদের ব্যক্তিগতভাবে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অবিলম্বে ভাবা প্রয়োজন যে, এমন লাগামহীন ও বিভ্রান্ত গবেষণার উপর কীভাবে বিধি-নিষেধ আরোপ করা যায় এবং কীভাবে কুরআন বোঝার ফিকির ও চেষ্টাগুলো একটা সমন্বিত নিয়ম নীতির আওতায় আনা যায়। তাহলে তাদাব্বুর ও তাযাক্কুরে কুরআন অর্থাৎ কুরআন নিয়ে চিন্তাভাবনা, গবেষণা এবং কুরআন থেকে নসীহত গ্রহণের কাজও হবে এবং কুরআন বোঝার নামে কুরআনের তাফসীরে অবৈধ দখলদারিত্ব - যা সকল তাহরীফের (বিকৃতির) মূল- তার পথও বন্ধ হবে।

এ পর্যায়ে আমি পাঠকদের কাছে যা বলতে চাচ্ছি তা হল, হযরত হারদুঈ রহ.-এর একটি আলোচনা, যা ১৪২০ হিজরী রমযান মাসে তিনি একটি বিশেষ মজলিসে করেছিলেন। ওই মজলিসে মাওলানা মুহাম্মাদ আরশাদ ফারুকী উপস্থিত ছিলেন, যিনি ওই মজলিসের একটি প্রতিবেদনও তৈরি করেছিলেন- যা মাসিক আয়েনায়ে মাজাহিরুল উলূম মুহিউসসুন্নাহসংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।

কিছুদিন আগে তার একটি কপি মাওলানা আব্দুল মাজীদ (উস্তাদ বাবুস সালাম মাদরাসা, ঢাকা) আমাকে সংগ্রহ করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দিন। এখানে আমি হযরত হারদুঈর ওই আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ দুটি কথা পেশ করা সমীচীন মনে করছি।

১. মজলিসে কথা চলছিল, মাঝে একজন এসে বললেন, হযরত! তাফসীরের সময় হয়ে গেছে। হযরত বললেন, রাখ ভাই, একটু দেরি হোক না এখানেও তো গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাই চলছে এবং গুরুত্বপূর্ণ লোকদের সামনে।

তারপর বললেন, হযরত থানভী রহ. অনেক চিন্তা-ভাবনা করে ফায়দা পৌঁছানোর জন্য তাফসীরে বয়ানুল কুরআনলিখেছেন। আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ. যখন সেটা দেখলেন তখন এক মজলিসেই হাতের খণ্ডটি সম্পূর্ণ পড়ে ফেললেন এবং বললেন, এখন আমি নিশ্চিত হলাম যে, দ্বীনী ইলম উর্দূ ভাষায়ও এসে গেছে।

আরো বললেন, হযরত থানভী রহ. বয়ানুল কুরআন লিখেছেন সাধারণ মানুষদের জন্য। কিন্তু সাধারণ পাঠকের জন্য তা বোঝা কষ্টসাধ্য। মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ. মাআরিফুল কুরআনের মাধ্যমে বয়ানুল কুরআনকে অনেক সহজ করে দিয়েছেন। এ জাতীয় তাফসীরগুলো সাধারণ মানুষদের জন্য লেখা হয়েছে। যাতে তারা তা পড়ে বুঝে দিক নির্দেশনা পায় এবং সে অনুযায়ী আমল করে কামিয়াব হতে পারে। কিন্তু বিষয়টি এতই অবহেলার শিকার যে, মানুষ এখন শুধু তেলাওয়াত করেই তৃপ্ত থাকছে। অথচ তেলাওয়াত যেমন একটি স্বতন্ত্র ইবাদত তেমনি কুরআন বোঝাও স্বতন্ত্র একটি ইবাদত। এই প্রয়োজন অনুভব করেই আমরা সর্বপ্রথম আশরাফুল মাদারিসে তাফসীরে বয়ানুল কুরআনের দরস আরম্ভ করেছি। ধরনটা খুবই সহজ এবং সময় খুবই সংক্ষিপ্ত। একেবারে সাদাসিধাভাবে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা করে আয়াতের মূল বিষয়টি বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। আলহামদুলিল্লাহ এ দরসে অংশগ্রহণকারী তালিবে ইলমদের উপর এর খুব ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

যেদিন وَ السَّارِقُ وَ السَّارِقَةُ فَاقْطَعُوْۤا اَیْدِیَهُمَا  এ আয়াতের তাফসীর বয়ান করা হল সেদিন একজন তালিবে ইলম পেরেশান হয়ে এসে বলতে লাগল, হযরত! আমি তো চুরির অপরাধে আক্রান্ত হয়ে গেছি এখন আমি কী করি? জিজ্ঞাসা করা হল, আপনি কোথায় এবং কীভাবে চুরি করেছেন? সে বলল, আমাকে দুধ ভাগ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আমি কখনো ছাত্রদেরকে কম দিতাম আবার কখনো পানি মিশিয়ে দিতাম। ভাগ করার পর যা থেকে যেত তা আমি পান করে নিতাম। এখন আমি কী করব? আমরা তাকে সান্ত্বনা দিলাম এবং জিজ্ঞাসা করলাম যে, কী পরিমাণ দুধ হবে তুমি চুরি করেছ? পরিমাণ ঠিক হওয়ার পর আনুমানিক দাম ঠিক করা হল। কিন্তু এ গরীব ছাত্র তার মূল্য কীভাবে আদায় করবে? পরে সে নিজেই ঠিক করল যে, আমি এত মাস পর্যন্ত বোর্ডিং থেকে যে দুধ পাব তা নিব না। সঙ্গে সঙ্গে সে তওবাও করল।

হযরত আরো বললেন, কুরআনে কারীমের মধ্যে যে শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে তা পৃথিবীর অন্য কোনো কিতাবেই নেই এবং সম্ভবও নয়। তাই বন্ধুগণ, কুরআনের দরস ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর করুন।

২. কবুলিয়াতের প্রথম এবং শেষ শর্ত হচ্ছে ইখলাস। তালাবাদের উচিত তারা যখন ভর্তি ফরম পূরণ করে তখন ফরমের একটি ফটোকপি নিজেদের কাছে রেখে দেওয়া। কারণ ফরমে যেসব শর্ত ও নিয়মনীতি থাকে সেগুলোর উপর দস্তখত করার পর তারা সেগুলো পূরণ করার উপর অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে যায়। যার ফলে সেগুলোর কোনোটা লঙ্ঘন করলে তা ওয়াদাভঙ্গের অন্তভুর্ক্ত হবে। অথচ কুরআনে ইরশাদ হয়েছে

اِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْـُٔوْلًا

নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে। -বনী ইসরাঈল ৩৪

তালিবে ইলমরা যদি এ বিষয়টির প্রতি খেয়াল রাখে তো তারা সফলকাম হবে এবং ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে এগিয়ে যেতে পারবে। পরিচালক যিনি থাকবেন তার উচিত হবে নিজেকে মাদরাসা এবং তালিবে ইলমদের খাদেম মনে করা, কখনো আত্মগরিমার শিকার না হওয়া। তারপর বললেন, এটা বড় আশ্চর্যের বিষয় যে, সব মাদরাসার লোকেরাই বিজ্ঞাপন কেলেন্ডারে অত্যন্ত গর্বের সাথে একথা প্রচার করে যে, আমাদের মাদরাসায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মেহমানদের সংখ্যা এত! বলুন তো মাদরাসাগুলোতে তালাবাদের সাথে একজন সাধারণ মেহমানের মতো আচরণও কি করা হয়? আপনি যেরকম লেখেন তাদের সাথে সেরকম আচরণ করুন। ভালো তালীম, ভালো খাবার, ভালো পোশাক, ভালো বসার জায়গা, ভালো নিবাসের ব্যবস্থা করুন। ভালো তরবিয়তের ব্যবস্থা করুন। তাদেরকে মেহমানে রাসূলের মতো প্রাণের চেয়ে প্রিয় জানুন।

অনুবাদ : মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ

 

 

advertisement