বাইতুল্লাহর মুসাফির
পৃথিবীর সব মানুষেরই কোন না কোন স্বপ্ন থাকে এবং স্বপ্ন দেখেই মানুষ বেঁচে থাকে। স্বপ্নই মানুষের জীবন এবং স্বপ্নই জীবনের অবলম্বন।
মানুষের জীবনের স্বপ্ন বিভিন্ন রকম, কিন্তু মুমিনের জীবনের স্বপ্ন শুধু দীদারে বাইতুল্লাহ এবং যিয়ারাতে মাদীনাহ। মুমিন স্বপ্ন দেখে কালো গিলাফের এবং সবুজ গম্বুজের। একদিন সে বাইতুল্লাহ তাওয়াফ করবে এবং নবীজীর রওযায় সালামের নাযরানা পেশ করবে- এই সুমধুর স্বপ্ন দেখেই মুমিন বেঁচে থাকে। এ স্বপ্নই মুমিনের জীবন, এ স্বপ্নই তার জীবনের অবলম্বন। তাই তো বাংলার কবি বলতে পেরেছেন- বক্ষে আমার কাবার ছবি নয়নে মুহাম্মাদ রাসূল।
আবার অন্য দেশের কবি বলেছেন-
دولت نہ کوئی جاہ چشم مانگ رہا ہوں
میں سایہ دیوا رحم مانگ رہا ہوں
‘চাই না ধনসম্পদ, চাই না খ্যাতি ও সম্মান
হে আল্লাহ, শুধু চাই তোমার ঘরের ছায়া’
عاصی کو جو پہنچا دے مدینے کی زمیں تک
راتا میں وہی نقش قدم مانگ رہا ہوں
‘যে পথ পৌঁছে দেবে মদীনার পুণ্যভূমিতে
অভাগারে হে দয়াময়, দেখাও সে পথের পদচিহ্ন’।
কবিকে আল্লাহ ছন্দ দিয়েছেন তাই তিনি প্রকাশ করতে পেরেছেন তার হৃদয়ের আকুতি এবং তার আত্মার মিনতি। কিন্তু এ আকুতি ও মিনতি তার একার নয়। এ তো সকল যুগের সকল দেশের সকল মুমিনের হৃদয় ও আত্মার আকুতি ও মিনতি। কিন্তু মানুষ শুধু তার হৃদয়ে স্বপ্ন লালন করতে পারে। স্বপ্নকে পূর্ণতা দান করতে পারে না। আল্লাহ যখন ইচ্ছা করেন, আল্লাহ যখন কারো কিসমতের সিতারা উজ্জ্বল করেন শুধু তখনই পূর্ণ হয় তার দীদারে বাইতুল্লাহ এবং যিয়ারাতে মদীনার স্বপ্ন, কখনো জীবনের শুরুতে, কখনো জীবনের সায়াহ্নে। কখনো একবার, কখনো বারবার। আবার কত মুমিন বান্দার সারা জীবনের স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যায়। প্রেমের দহনে তাদের হৃদয় শুধু দগ্ধ হতে থাকে এবং তাদের চোখ থেকে অশ্রু শুধু ঝরতে থাকে, ইশকের আগুনে তারা শুধু জ্বলতে থাকে, আর বিরহের বেদনায় প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে থাকে, কিন্তু বাইতুল্লাহর ডাক আসে না, তার আগেই মৃত্যুর ডাক এসে যায়। স্বপ্নের বেদনা বুকে নিয়েই তারা কবরে চলে যায়। এভাবে কেউ লাভ করে স্বপ্নের আনন্দ, কেউ বহন করে স্বপ্নের বেদনা। তাই আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় স্বপ্নের প্রাপ্তি ও তৃপ্তির কবিতা যেমন দেখতে পাই তেমনি দেখতে পাই বিরহের বেদনা ও ব্যাকুলতার কবিতা। হাসির কল্লোল ধ্বনি যেমন শুনতে পাই তেমনি শুনতে পাই কান্নার তরঙ্গ ধ্বনি। একজন বাইতুল্লাহর কাছে এবং সবুজ গম্বুজের পাশে দাঁড়িয়ে হৃদয়ের সবটুকু প্রশান্তি ছড়িয়ে বলে ওঠেন-
শান্ত হলো মন
ধন্য হলো জীবন
এবার আসে যদি মৃত্যুর আলিঙ্গন
হাসি মুখে দেখো তারে করিবো বরণ।
আরেকজন দূরে বহু দূরে সেই সাগর পারে দাঁড়িয়ে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে আর্তনাদ করে ওঠেন-
জীবনের দিনগুলো হায় ফুরিয়ে গেলো
ধীরে ধীরে সন্ধ্যার আঁধার নেমে এলো
কবরের ডাক এসে গেলো
এলো না তবু ঘরের ডাক।
তবে আমার বিশ্বাস মুমিন বান্দার স্বপ্নের সফলতার আনন্দ এবং স্বপ্নের ব্যর্থতার বেদনা, দুটোই আল্লাহর প্রিয়। তাই কারো স্বপ্ন তিনি পূর্ণ করেন, আর কারো স্বপ্ন আজীবন অপূর্ণই রেখে দেন। ইশক ও মুহাব্বত এবং প্রেম ও ভালোবাসার জগত বড় রহস্যপূর্ণ। এখানে জীবনের সার্থকতা শুধু স্বপ্ন দেখার মাঝে, স্বপ্নের প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তির মাঝে নয়। যে স্বপ্নের আবেদন হৃদয়ের যত গভীরে এবং যে স্বপ্নের মিনতি যত মর্মস্পর্শী সে স্বপ্ন আল্লাহর তত প্রিয়, হোক তা প্রাপ্তির আনন্দে সিক্ত, কিংবা অপ্রাপ্তির বেদনায় তিক্ত। একজনের বারবার ডাক আসে এবং বারবার তিনি শামিল হন হজ্বের সফরে, হিজাযের কাফেলায়। আরেকজন সারা জীবন শুধু দাঁড়িয়ে থাকেন পথের কিনারায় এবং শুধু দেখতে থাকেন হাজীদের কাফেলার চলে যাওয়া এবং ফিরে আসা। কিন্তু কেউ বলতে পারে না, কে আল্লাহর বেশি প্রিয়, ইহরামের সাদা লেবাসের মুসাফির, না পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এবং ব্যাকুল নয়নে তাকিয়ে থাকা আল্লাহর এই মজবুর বান্দা! সুতরাং আমার সশ্রদ্ধ সালাম তাদের সবার জন্য যারা সুন্দর করে স্বপ্ন দেখেছেন; যাদের স্বপ্নের ময়ূর পেখম মেলেছে তাদের জন্য এবং যাদের স্বপ্ন শুধু ডাহুকের ডাক ডেকেছে তাদেরও জন্য। কারণ উভয়ের স্বপ্ন দেখা স্বার্থক, যদি আল্লাহ কবুল করেন।
আমার দাদী শুয়ে আছেন গ্রামের মাটিতে ছায়াঘেরা এক কবরে। দাদীর সঙ্গে আমার স্মৃতি দূর শৈশবের। দাদীর কবরে একটি বড় গাছ ছিলো। সে গাছের ছায়ায় দাদীর কবরকে মনে হতো অনেক প্রশান্ত! অনেক সময় আমি ঘুমিয়ে যেতাম সেখানে গাছের ছায়ায়। দাদীর স্বপ্ন ছিলো দীদারে বাইতুল্লাহ এবং যিয়ারাতে মাদীনার। সহজ সরল এক পল্লী অবলার সহজ সরল স্বপ্ন। সে যুগে ছোট ছোট পয়সা ছিলো। দাদী একটি একটি করে পয়সা জমাতেন, আল্লাহর ঘরের জন্য, কিন্তু দাদী এবং তাঁর স্বপ্ন আজ কবরে মাটির নীচে।
দাদীর মৃত্যুর পর দাদার জীবন ছিলো বড় নিঃসঙ্গ। তিনিও স্বপ্ন দেখতেন এবং শৈশবে সে স্বপ্ন আমাকেও স্পর্শ করতো, কোমল স্পর্শ। তখন বুঝিনি, এখন অনুভব করি, কত ব্যাকুলতা ও অস্থিরতা ছিলো তাঁর বুকে; কত আকুতি ও মিনতি ছিলো তাঁর পশ্চিম দিগন্তে তাকিয়ে থাকা চোখে। সাদা-কালো কত মেঘের আনাগোনা ছিলো তাঁর স্বপ্নের আকাশে। দাদারও কবর হয়েছে স্বপ্নের বেদনাকে সঙ্গে করে। আমার নানারও, যাকে আমি হারিয়েছি আমার জন্মেরও পূর্বে, যার আত্মার সঙ্গে আমার বন্ধন কলমের মাধ্যমে, যার স্বপ্নের বেদনার কথা আমি জেনেছি তাঁর কলম থেকে ঝরা কালির মাধ্যমে।
আমার আব্বা, তিনিও স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর স্বপ্নের ব্যাকুলতা ও অস্থিরতা যেমন আমি দেখেছি তেমনি দেখেছি স্বপ্নের পূর্ণতা লাভের তৃপ্তি। কিন্তু এখনো আমি বলতে পারি না, আব্বার জীবনের কোন সৌন্দর্য আমাকে বেশি মুগ্ধ করেছিলো; স্বপ্নের ব্যাকুলতার সৌন্দর্য, না স্বপ্নপূর্ণতার তৃপ্তির সৌন্দর্য। আমার বিশ্বাস দুটোই সুন্দর এবং দুটোই আল্লাহর প্রিয়। সুতরাং যারা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে স্বপ্নের তৃপ্তির সরোবরে অবগাহন করে, কিংবা বুকে স্বপ্নের অতৃপ্তির বেদনা বহন করে তাদের সবার উদ্দেশ্যে আমার সালাম।
যাদের চোখ থেকে আনন্দের অশ্রু ঝরেছে কাবার কালো গিলাফ ধরে এবং মদীনার সবুজ গম্বুজের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের অশ্রুকে আমার অভিনন্দন। কারণ সে অশ্রু হতে পারে জান্নাতের বাগানে ফুলের পাপড়িতে ঝরা শিশির।
যাদের চোখ থেকে বেদনার অশ্রু ঝরেছে শুধু হাজিদের কাফেলার আসা-যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে কালো-সবুজের বিরহে দগ্ধ হয়ে তাদেরও অশ্রুকে আমার অভিনন্দন। কারণ সে অশ্রু হতে পারে দাউ দাউ আগুনের উপর মেঘ থেকে ঝরা বৃষ্টি।
ঠিক মনে নেই, আমার ছোট্ট হৃদয়ে কখন অংকুরিত হয়েছিলো দীদারে বাইতুল্লাহ এবং যিয়ারাতে মদীনার স্বপ্ন। শুধু মনে পড়ে হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-এর হজ্বের সফরে যাওয়া এবং ফিরে আসার দৃশ্য। তিনি ছিলেন আমার দাদার বন্ধু, সেই সূত্রে আমাদেরও দাদা।
একবারের কথা স্পষ্ট মনে পড়ে, দাদা ও দাদী হজ্ব থেকে ফিরে এসেছেন। অবাক বিস্ময়ে আমি তাদের দেখছিলাম। আমার মনে হয়েছিলো তারা অন্য জগতের মানুষ। অনেক কিছু মনে হয়েছিলো, এখন অনেক কিছু মনে নেই। দাদী ও দাদা আমাকে মদীনা শরীফের খেজুর দিয়েছিলেন এবং ‘মক্কা শরীফের পানি’ পান করিয়েছিলেন।
চল্লিশ বছরের কথা, তবু আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, করুণ আবদারের সুরে আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দাদা, আমাকে আল্লাহর ঘরে নেবেন না! শিশুমনের অবুঝ আবদারে কী ভাব এসেছিলো সেদিন আল্লাহর ঘর থেকে ফিরে আসা ঐ বুড়ো মানুষটির মনে! তিনি কি কোন দু‘আ করেছিলেন সেই অবুঝ শিশুটির জন্য? কিংবা ঘরের মালিক কীভাবে গ্রহণ করেছিলেন অবুঝ শিশুর অবুঝ আবদারকে! এই ঠিকানা ভুল করাকে! হাদীছে যে হাসির কথা এসেছে তিনি কি সেই হাসি হেসেছিলেন বান্দার উদ্দেশ্যে এবং তাকদীরের কলমে নতুন কিছু লিখেছিলেন বান্দার অনুকূলে?
হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ. সেদিন সেই অবুঝ শিশুকে প্রবোধ দিয়ে বলেছিলেন, ইনশাআল্লাহ আমি তোমাকে আল্লাহর ঘরে নিয়ে যাবো।
এটাই ছিলো আমার হৃদয়ে দীদারে বাইতুল্লাহ এবং যিয়ারাতে মাদীনার প্রথম স্বপ্ন, স্বপ্নের প্রথম অংকুর। অবুঝ শিশুর অবুঝ স্বপ্ন, তবু তো স্বপ্ন এবং পবিত্র স্বপ্ন। বড় হৃদয়ের বড় স্বপ্নের চেয়ে ছোট্ট হৃদয়ের ছোট্ট স্বপ্নের মূল্য আল্লাহর কাছে কি কম!
তারপর হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ. বহুবার আল্লাহর ঘরে গিয়েছেন এবং ফিরে এসেছেন। আমি তাঁকে দেখেছি আর ভেবেছি, কত ভাগ্যবান তিনি! আমি কি হতে পারবো তাঁর মত? আমি কি যেতে পারবো আল্লাহর ঘরে তাঁর মত? এভাবে আমার স্বপ্নের অংকুর ধীরে ধীরে আমার হৃদয়ে সবুজের ছায়া বিস্তার করেছে। সে স্বপ্নের স্নিগ্ধ পরশে ছিলো সুখের অনুভূতি এবং আনন্দের শিহরণ। কিন্তু স্বপ্নের যে ব্যথা ও বেদনা আছে, স্বপ্নের যে ব্যাকুলতা ও অস্থিরতা আছে স্বপ্ন যে হৃদয়ে কান্নার ঢেউ তোলে এবং চোখ থেকে অশ্রু ঝরায় তখনো তা বুঝতে পারিনি।
আমার জীবনের বিশটি বসন্ত পার হওয়ার পর সম্ভবত প্রথম আমি অনুভব করি স্বপ্নের মধুর বেদনা, যখন আমার প্রাণপ্রিয় উস্তায হযরত পাহাড়পুরী হুযূর হজ্বের সফরে আল্লাহর ঘরে রওয়ানা হলেন। সেটা ছিলো হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-এর সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ চারমাসের সফর। রামাযানের আগে বর্ষাকাল ছিলো, আমাদের ঘরের দুয়ারে নৌকা বাঁধা ছিলো। মাগরিবের পর নৌকায় করে আমি হুযূরকে, আল্লাহর ঘরের যাত্রীকে নদী পার করেছিলাম। আমার হৃদয় তখন বিগলিত ছিলো এবং চোখে ছিলো অশ্রুর ধারা। সম্ভবত সেই প্রথম আমি আমার প্রিয় উস্তাযের মাধ্যমে প্রেরণ করেছিলাম সালামের নাযরানা এবং নিবেদন করেছিলাম কাবার গিলাফ ধরে মুলতাযামে দাঁড়িয়ে দু‘আ করার তামান্না।
হুযূর নৌকা থেকে নেমে রওয়ানা হলেন। আমি তাকিয়ে থাকলাম বাইতুল্লাহর মুসাফিরের গমনপথের দিকে। সে দৃশ্য এখনো আমার চোখে ভাসে। তাঁর মুখে ছিলো হাসি, আমার চোখে ছিলো পানি। নৌকা নিয়ে ফিরে আসার সময় আমার অনেক কান্না পেয়েছিলো। নদীর জলে সেদিন আমার চোখের পানি মিশেছিলো। একবার ভেবেছিলাম, নৌকা নিয়ে এই নদীপথে যদি চলতে থাকি তাহলে কি একদিন আমি পেঁৗছে যাবো হিজাযের পুণ্যভূমিতে! নাকি সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে ভেঙ্গে যাবে আমার নৌকা! ডুবে যাবে আমার স্বপ্ন! সেদিন নদীর বুকে নৌকায় বসে আমার বুকে অপূর্ণ স্বপ্নের যে বেদনা জেগেছিলো তা মনে হলে এখনো হৃদয়ে মধুর অনুভূতি জাগে। সেই বেদনা আবার আরো বেশি করে পাওয়ার ইচ্ছা জাগে। উপরে তারাভরা আকাশে তাকিয়েছিলাম ব্যাকুল নয়নে। তারকার ঝিলিমিলি ছাড়া কিছু দেখিনি, কিন্তু বিশ্বাস ছিলো, এই ঝিলমিল তারকার আলোকসজ্জার আড়ালে যিনি আছেন তিনি দেখতে পান এবং শুনতে পান। তিনি দয়া করেন এবং দান করেন। তাই হৃদয়ের সবটুকু আকুতি ঢেলে সেদিন দু‘আ করছিলাম আম্মার জন্য, আব্বার জন্য এবং আমার জন্য; আমাদের সবার স্বপ্নের পূর্ণতার জন্য। আমাদের স্বপ্ন তো নয় কোন বিলাস জৌলুসের এবং জীবনের স্থূল কোন আনন্দের। আমাদের স্বপ্ন তো শুধু কালো গিলাফের এবং সবুজ গম্বুজের। আমাদের স্বপ্ন তো শুধু ইশক ও মুহাব্বতের এবং আবে যমযমের, আবে কাওছারের!
আরো পরে আব্বার জীবনে পরম সৌভাগ্যের পরম মুহূর্তটি যখন এলো, তিনি যখন হজ্বের সফরে আল্লাহর ঘরে রওয়ানা হলেন তখন আমি অবলোকন করেছিলাম মুমিনের হৃদয়ে লালিত স্বপ্নের অন্য রকম এক সৌন্দর্য। তুমি যদি জানতে চাও সে সৌন্দর্যের কোন তুলনা, তাহলে আমি বলবো, জীবন ও জগতের আর কোন সৌন্দর্যে আমি খুঁজে পাইনি তার তুলনা। তখন ছিলো লটারীর ব্যবস্থা, নাম আসবে কি আসবে না; কী আছে ভাগ্যে, হাসি, না কান্না! আব্বার মুখমণ্ডলে আশা ও আশংকার এই অপূর্ব আলো-ছায়া। একবার যেন চাঁদের আলো, একবার যেন মেঘের ছায়া। ঘোষকের কণ্ঠে যখন ঘোষিত হলো আব্বার নাম, তিনি বসা থেকে উঠলেন এবং ওঠা থেকে বসলেন। তিনি হাসলেন এবং কাঁদলেন। মুখে হাসি, চোখে কান্না। হায়, তোমাকে যদি আমি দেখাতে পারতাম বাইতুল্লাহর মুসাফিরের মুখমণ্ডলে হাসি-কান্নার অপূর্ব মিলনের সে সৌন্দর্য! এখনো আছে হজ্বের মুসাফির, নেই শুধু সেই হাসি-কান্নার মিলনদৃশ্য! আমার সৌভাগ্য, আমি আমার আব্বার মুখমণ্ডলেই দেখতে পেয়েছিলাম সে পবিত্র দৃশ্য। আমার হৃদয়ে লালিত স্বপ্নের সবুজ বৃক্ষ তাতে যেন আরো সবুজ, আরো সজীব হয়েছিলো। আমার তখনকার জীবনে সেটাই ছিলো শ্রেষ্ঠ আনন্দের মুহূর্ত। আল্লাহর ঘর থেকে আব্বা আমার জন্য চিঠি লিখেছিলেন। কতবার কতভাবে সেই চিঠি পড়ি, তবু যেন তৃপ্তি হয় না, আবার পড়ি, আবার পড়ি। এ চিঠি এসেছে আমার নামে আল্লাহর ঘর থেকে! এ চিঠির প্রতিটি শব্দ যেন ফুল, প্রতিটি শব্দে যেন ফুলের সুবাস। আব্বা যমযমের পাড়ে দাঁড়িয়ে যমযমের পানি পান করার কথা লিখেছিলেন; তাতেই যেন আমি পেয়ে গিয়েছিলাম আবে যমযমের স্বাদ।
এমনিতেই আব্বা নেক মানুষ ছিলেন; আল্লাহর ঘর থেকে তিনি যেন ‘নেককার’ হয়ে ফিরে এলেন। তাঁর সমগ্র সত্তায় যেন অপূর্ব এক আলোকময়তা, যেন কালো গিলাফের খোশবু এবং সবুজ গম্বুজের সুবাস। সেই আলোকময়তায়, সেই খোশবুতে ও সুবাসে আমার আত্মা এমনই আলোকিত ও সুবাসিত হলো, যেন আমি নিজে ফিরে এসেছি মক্কা-মদীনা থেকে কালো-সবুজের সৌন্দর্য নিয়ে।
যমযমের পানি পেলাম, মদীনা শরীফের খেজুর পেলাম, আর পেলাম দশখণ্ডের একটি কিতাব, আব্বার পক্ষ হতে মক্কা-মদীনার হাদিয়া।
মক্কা-মদীনার কথা এবং মিনা-আরাফার ঘটনা আব্বা এমন আবেগ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে শোনাতেন, সবকিছু আমার চোখের সামনে জীবন্ত মনে হতো। হৃদয়ে লালিত স্বপ্ন যেন নতুন করে প্রাণ পেতো। আমি নতুন করে ব্যাকুল হতাম এবং আকুল হয়ে প্রার্থনা জানাতাম আমার স্বপ্ন যেন সফল হয়, কাবাতুল্লাহর দীদার এবং রওযাতুন্নবীর যিয়ারাতের আগে আমার যেন মৃত্যু না হয়।
এভাবে পার হলো আরো কিছু দিন। আমার স্বপ্নের ব্যাকুলতা, আমার হৃদয়ের অস্থিরতা এবং আমার আত্মার আকুতি বৃদ্ধি পেলো দিনদিন। যে ঘর কখনো দেখিনি, অথচ প্রতিদিন পাঁচবার যে ঘরের অভিমুখী হই, সে ঘর দুচোখ ভরে দেখার এবং সে ঘরের কালো গিলাফের কোমল স্পর্শ লাভের ব্যাকুলতা।
যে শহর কখনো দেখিনি, অথচ হৃদয়ের গভীরে যে শহরের প্রতি জন্মভূমির চেয়ে বেশি ভালোবাসা সে শহরের ধূলোবালির সুরমা চোখে মাখার এবং রওযা শরীফের সবুজ মহিমায় আত্মনিবেদনের আকুতি; এই ছিলো আমার তখনকার দিন-রাত এবং সকাল-সন্ধ্যা।
বিরহের মধুর বেদনার বড় প্রিয় দিন ছিলো সেগুলো। নিজেকে তখন সান্ত্বনা দিতাম এই বলে, যত দূরে হোক আছে তো কালো গিলাফে ঢাকা আল্লাহর ঘর! আমি তো এখান থেকেও হতে পারি সে ঘরের অভিমুখী! সে ঘরের অভিসারী! আসমান থেকে প্রতিদিন যত রহমত নামে সে ঘরের উপর, আমি তো এখান থেকেও হতে পরি তার অংশীদার!
যত দূরে হোক সোনার মদীনা, সেখানে সবুজ গম্বুজের নীচে আছে তো পেয়ারা নবীর রওযা! আমি তো এখান থেকেও পাঠাতে পারি দুরূদ ও সালামের নাযরানা। সেখান থেকে উৎসারিত হয় নূর ও নূরানিয়াতের যে ঝরণাধারা, আমি তো এখান থেকেও অবগাহন করতে পারি সে আলোর জোসনায়! কারণ পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের যে কোন মসজিদের হাযিরান যারা, তারা তো মসজিদুল হারামেরও হাযিরান! তারা তো মসজিদুন্নবীরও মুছাল্লিয়ান! যদি অন্তরে অনুরাগ এবং হৃদয়ে আকুতি থাকে; যদি কলবে ইশকের তড়প এবং সিনায় মুহাব্বতের জযবা থাকে।
কিন্তু ইশকের মওজ এবং প্রেমের জোয়ার কখনো কখনো এমন জোরওয়ার হতো যে, সব সান্ত্বনা ভেসে যেতো এবং ব্যথার অস্থিরতা সব কিছুকে ছাপিয়ে উঠতো। পশ্চিমের কবির ভাষায় শরাবের জলসায় যত পান করো উষ্ণ মদীরা/তত তীব্র হবে তোমার প্রেম পিপাসা/বন্ধ করো জলসা, ত্যাগ করো মদীরা/ঘুরে আসো প্রিয়ার নির্জন গলিতে। প্রেমিক কবির উপদেশ গ্রহণ করে তখন চলে যেতাম দূরের নির্জন কোন মসজিদে। আল্লাহর ঘরের নির্জনতা অশান্ত হৃদয়ে প্রশান্তির আশ্চর্য এক শীতল স্পর্শ বুলিয়ে দিতো। কলবে তখন অন্য রকম এক সুকূন ও সাকীনা অনুভব হতো। হয়তো ভালো হতো এ কথাগুলো যদি হৃদয়ের গোপন ভাণ্ডারে জমা থাকতো, কিন্তু কলমের ঝরণা থেকে শব্দগুলো সব কিভাবে যেন ঝরে গেলো, আর মনে হলো, এখনো যারা হৃদয়ের গভীরে লালন করছে অসম্পূর্ণ স্বপ্নের বেদনা, হয়ত আমার এ কথায় তারা পাবে কিছু সান্ত্বনা। কারণ একটি বিরহী হৃদয়ের উত্তাপ-উষ্ণতা আরেকটি বিরহী হৃদয়ের জন্য হতে পারে প্রশান্তির শীতল প্রলেপ।
একদিন অস্থির হৃদয় যখন আর কোন সান্ত্বনা শোনে না এবং পেরেশান কলব যখন আর কোন তাসাল্লি মানে না তখন গভীর রাতে পাহাড়পুরী হুযূরের খেদমতে হাজির হলাম। তাঁকে কিছু বলতে হলো না। যাদের হৃদয় আছে তাদেরকে কিছু বলতে হয় না। হৃদয়ের ব্যথা হৃদয় দিয়ে তারা অনুভব করতে পারেন। তিনি আমার হৃদয়ের ব্যথা অনুভব করলেন এবং এমন কিছু কথা বলে সান্ত্বনা দিলেন যা আমার জন্য ছিলো নতুন ও অশ্রুতপূর্ব। আমার সারা জীবনের অভিজ্ঞতা, ব্যথিত হৃদয়কে সান্ত্বনা দেয়ার ক্ষেত্রে আমার এ প্রিয় মানুষটির তুলনা নেই। এমন কি শেষ জীবনে হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.কে দেখেছি, বৈরী পরিস্থিতিতে যখন অস্থির হতেন, ‘খুব কাছের আঘাতে’ যখন ক্ষত-বিক্ষত হতেন তখন এ মানুষটির কাছেই সান্ত্বনা খুঁজতেন এবং সান্ত্বনা পেতেন।
হুযূর আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, সময় যখন আসন্ন হয় বেদনা তখন তীব্র হয়, তবে বিরহের বেদনা যিনি যত বেশি গ্রহণ করতে পারেন মিলনের স্বাদ তিনি তত বেশি আস্বাদন করতে পারেন। সুতরাং বিরহের বেদনাই তো এ পথের সান্ত্বনা!
তারপর তিনি কয়েকজন আকাবিরীনের হালাত শোনালেন, যারা আজীবন স্বপ্ন লালন করেছেন দীদারে বাইতুল্লাহ ও যিয়ারাতে মাদীনার। কিন্তু এ জীবন থেকে সে জীবনে তাঁরা পাড়ি দিয়েছেন স্বপ্নের অপূর্ণতার বেদনা বুকে ধারণ করেই। তবে বিরহের বেদনার মাঝেও ইশক ও মুহাব্বতের স্বাদ ও লায্যাত থেকে তাঁরা বঞ্চিত ছিলেন না কখনো। যদ্দুর মনে পড়ে সেদিন তিনি মুজাদ্দিদে আলফে ছানি রহ.-এর ঘটনাও শুনিয়েছিলেন।
আরো কিছুদিন গেলো, ১৪০০ হিজরী ২৯ যিলকদ হযরত হাফেজ্জী হুযূর আমার ‘দাদা’ হলেন এবং পয়লা যিলহজ্ব আল্লাহর ঘরে রওয়ানা হয়ে গেলেন। আশ্চর্য! আল্লাহ যেন তাঁর এই পেয়ারা বান্দার মনের ইচ্ছা সবসময় পূর্ণ করতেন। তিনি হজ্বের নিয়ত করতেন, শরীর-স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি সবই হয়ত প্রতিকূল, কিন্তু গায়ব থেকে যেন সব ইনতিযাম হয়ে যেতো এবং যথাসময়ে তিনি হজ্বের সফরে রওয়ানা হয়ে যেতেন।
সেবার তিনি সফরের বিদায় মজলিসে এমন কিছু কথা বললেন যাতে কান্নার রোল পড়ে গেলো। সবার ধারণা হলো, হয়ত হযরত আর ফিরে আসবেন না, হয়ত এ সফর তাঁর আখেরাতের সফর। এরপর ছিলো আমাদের মত নওজোয়ানদের অবাক হওয়ার পালা। তিনি বলে উঠলেন এবং মুখে স্নিগ্ধ হাসির উদ্ভাসকে সঙ্গে করে, ‘আপনারা পেরেশান কেন? আমি তো এখনো মওতের ইরাদা করি নাই।’
মওতের ইরাদা! সুবহানাল্লাহ! তো মওতের সঙ্গে আল্লাহর যে বান্দার ইরাদা করা, না করার সম্পর্ক, তিনি আল্লাহর ঘরের নিয়ত করবেন, আর আল্লাহ তা পূর্ণ করবেন, তাতে আশ্চর্যের কী!
সফরের পূর্বরাত্রে হযরত আমাকে তাঁর কামরায় ডেকে পাঠালেন। আমি অবাক হলাম, আর তো কখনো এভাবে ডাক আসেনি! আমি গেলাম এবং কাছে বসলাম। হযরত হাসিমুখে আমার দিকে তাকালেন। আহা, যারা তাঁকে দেখেনি তাদেরকে কীভাবে বোঝাবো, কেমন ছিলো সে হাসির সৌন্দর্য এবং সে দৃষ্টির স্নিগ্ধতা। হাসি তো নয় যেন নূরের আভাস! দৃষ্টি তো নয় যেন মমতার শিশির! দেহ যেন তাতে সিক্ত, হৃদয় যেন তাতে আপ্লুত। হযরত আমাকে কিছু হাদিয়া দিলেন, আর বললেন, এটা আমার পক্ষ হতে তোমার নিকাহের তোহফা, হজ্বের নিয়তে রেখে দাও।
আনন্দে আমার চোখ দুঁটো ছলছল করে উঠলো। কৃতজ্ঞচিত্তে আমি হযরতের ‘তোহফা’ গ্রহণ করলাম। তবে শৈশবে যেমন ঠিকানা ভুল করেছিলাম, এবার তা করলাম না। সোজা মসজিদে হাজির হলাম। সেখানে কেউ ছিলো না, আমি ছিলাম, আমার আল্লাহ ছিলেন। দু’রাকাত নামায পড়ে দু’হাত প্রসারিত করে আবেগ উদ্বেলিত কণ্ঠে বললাম, আল্লাহ, আমাকে আপনার ঘরে নেবেন না! তখন দু’চোখে যেন অশ্রুর বাঁধভাঙ্গা জোয়ার এলো। আর অশ্রুর যখন জোয়ার আসে পাপের আবর্জনা তখন ভেসে যায়, হৃদয় তখন স্বচ্ছ ও পবিত্র হয়। মুনাজাত ও প্রার্থনা তখন বড় মিনতিপূর্ণ হয়। আমারও সেদিনকার মুনাজাতে অন্য রকম আবেদন ও নিবেদন এবং অন্য রকম আকুতি ও মিনতি ছিলো। সেদিন আমার বিগলিত হৃদয়ে আল্লাহ যেন এ আশ্বাস দান করেছিলেন, আসবে বান্দা! তুমি আমার ঘরে অবশ্যই আসবে! আমি আল্লাহর শোকর আদায় করলাম যে, তিনি আমাকে এমন দু‘আ করার তাওফীক দিয়েছেন।
মানুষের কল্পনাশক্তি আল্লাহর অতি বড় দান। কল্পনার সাহায্যে মানুষ ফিরে যেতে পারে অতীতের শৈশবে; এমনকি বিচরণ করতে পারে অনাগত ভবিষ্যতেরও অঙ্গনে। কল্পনায় মুহূর্তে সে চলে যেতে পারে বহু দূরে তার প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে এবং তার প্রিয় ভূমির সংস্পর্শে। বাধার বেড়াজাল আটকে রাখতে পারে তোমার মাটির দেহকে, তোমার এই জড় সত্তাকে; কিন্তু তোমার হৃদয় ও আত্মা বাধাবন্ধনহীন। তাই বাজারে থেকেও তুমি থাকতে পারো মসজিদে এবং আরশের ছায়া পেতে পারো রোয হাশরে।
তাবুকের অভিযান থেকে ফেরার পথে আল্লাহর নবী যে বলেছেন, মদীনায় রয়ে গেছে কিছু মানুষ যারা এই সফরে প্রতিটি পথে, প্রতিটি উপত্যকায় আমাদের সঙ্গে ছিলো, বিভিন্ন মাজবুরি তাদের (জড়দেহ)কে মদীনায় আটকে রেখেছে। যে মদীনায় পড়ে থেকেও তাবুকের সফরে শরীক থাকা এবং প্রতিটি পথে ও উপত্যকায় সঙ্গ দান করা, এটা মানুষের কল্পনা শক্তিরই কারিশমা।
তাই তো আজমের নাম নাজানা এক দিওয়ানা শায়ের বলতে পেরেছেন-
তোমরা দেখো, আমি বসে আছি ইরানের গুলবাগিচায়
ভুল, ভুল, আমি তো মদীনায়! খেজুর বাগানের ছায়ায়!
হযরত হাফেজ্জী হুযূর আল্লাহর ঘরে রওয়ানা হলেন, আর আমি মাজবুর অবস্থায় পড়ে থাকলাম সুদূর বাংলাদেশে। কিন্তু আল্লাহর শোকর, মাজবুরির বেড়াজালে আবদ্ধ ছিলো শুধু এই জড়দেহ। হৃদয় আমার কল্পনার ডানা মেলে উড়ে গিয়েছিলো হিজাযভূমিতে। আমিও যেন শামিল ছিলাম হযরতের কাফেলার পথ চলাতে। আমার অন্তর্সত্তা যেন হযরতের সঙ্গে আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করেছে, আরাফার ময়দানে এবং মিনার তাবুতে অবস্থান করেছে। আমার কলব যেন ইশকের সওয়ারিতে সওয়ার হয়ে মদীনার পথে সফর করেছে এবং হযরতের আড়ালে দাঁড়িয়ে রওযা শরীফে সালামের নাযরানা পেশ করেছে। কল্পনার স্বাদ ও আনন্দ এবং تصور এর লায্যাত ও ফারহাত সম্ভবত এই প্রথম আল্লাহ আমাকে দান করলেন। শোকর আলহামদুলিল্লাহ।
হজ্বের সফর থেকে হযরত ফিরে এলেন, সবাই বিমান বন্দরে গেলো, আমিও গেলাম, কিন্তু কাছে না গিয়ে দূর থেকে যিয়ারত করলাম বাইতুল্লাহর মুসাফিরের নূরানী চেহারা। কাছে কেন গেলাম না, কিংবা যেতে পারলাম না, সে রহস্য এখনো আমার অজানা। এমন কি পরে যখন হযরত জিজ্ঞেস করলেন, সবাই গেলো, তুমি কেন গেলে না? তখনো আমি বলতে পারিনি আমার হযরতকে সেই গোপন কথা। শুধু বললাম, হযরত, আমার মনে হয়েছে تصور ও কল্পনার জগতে আমি যেন আপনার কাফেলায় শামিল ছিলাম।
হযরত শুনে শুধু মৃদু হাসলেন, আর কিছু রিয়াল আমার হাতে দিয়ে বললেন, এইগুলো আপনার কাছে রাখেন, যখন খরচ করার সময় হবে তখন খরচ করবেন।
ঐ সফরে হযরত আমার জন্য একটি কালো জুব্বা এনেছিলেন, আর আমি একটি ভুল করেছিলাম। তবে ইশকের জযবায় যে ভুল করা হয় তা ক্ষমা করা হয়। চিরকাল তা ক্ষমা করা হয়েছে, চিরকাল তা ক্ষমা করা হবে। আমি সেদিন হযরতকে বলেছিলাম, আমার জন্য ইহরামের লেবাস আনলে বেশি খুশি হতাম। হযরত কিন্তু হাসি মুখে বললেন, আমার ইহরামের লেবাস তোমাকে দিয়ে দেবো।
আমার শ্রদ্ধেয় প্রফেসর হামিদুর রহমান সাহেব অনেকবার বলেছেন, হযরত নিজে দোকানে গিয়ে আমার জন্য এই কালো জুব্বা খরীদ করেছেন। তখন বুঝতে পারিনি, এখন মনে হয়, কালো জুব্বার মাঝে হয়তো ছিলো কালো গিলাফের ইশারা।
আহলে দিল যারা তাদের কথায় ও কাজে থাকে আসমানের অনেক ইঙ্গিত-ইশারা। অন্তর্চক্ষু যাদের দুর্বল তারা তা বুঝতে পারে না। ভিতরের রহস্য তারা অনুধাবন করতে পারে না। যদি পারতাম তাহলে সেই কালো জুব্বার প্রতি আমার আচরণ হতো অন্য রকম। আমার কাছ থেকে কখনো তা হারিয়ে যেতো না। কালোর প্রতি কালোর এবং সবুজের প্রতি সবুজের ইঙ্গিতরহস্য আমি বুঝেছিলাম অনেক পরে। তখন আমি মদীনা শরীফ থেকে একটি সবুজ এবং মক্কা শরীফ থেকে একটি কালো ওড়না এনেছিলাম আমার দুই মেয়ের জন্য।
আল্লাহ যে বান্দাকে গায়ব থেকে তরবিয়াত করেন এ সময় আমি তা উপলব্ধি করলাম একটি কিতাব হাতে পেয়ে। সেই কিতাবে বাইতুল্লাহর মুসাফিরদের ইশক ও মুহাব্বতের আশ্চর্য সব ঘটনা ছিলো। একেকটি ঘটনা পড়ি আর আবেগের তরঙ্গে উদ্বেলিত হই। ভিতরে কান্নার ঢেউ জাগে, আর চোখে অশ্রুর বান ডাকে। ইশক ও মুহাব্বতের নতুন নতুন রহস্য উন্মোচিত হয়, আর নিজের দীনতা ও হীনতায় আমি কুণ্ঠিত হই। হায়! আল্লাহর ঘরের এই সব আশিকান যে সকল পথ অতিক্রম করে আল্লাহর ঘরে পৌঁছেছেন আমি যদি তাঁদের পথের ধুলো হতে পারতাম!
একটি ঘটনা ছিলো এরকম— হজ্বের কাফেলা চলছে খোরাসান থেকে সুদূর হেজাযভূমির উদ্দেশ্যে। আর সে যুগের সফর ছিলো সে যুগের মত। কষ্টের উপর কষ্ট এবং বিপদের উপর বিপদ। পথে পথে এবং পদে পদে বিভিন্ন দুর্যোগ। এভাবেই চলতে হতো হাজীদের কাফেলাকে। সেই কাফেলায় ছিলো এক সওদাগরের এক ক্রীতদাসী। না, আমি ভুল বলেছি; সে ছিলো আল্লাহর প্রিয় দাসী। আল্লাহর ইশক ও মুহাব্বতে তার কলব ছিলো বে-তাব, বে-কারার। চলার পথে কাফেলা যখন বিভিন্ন মনযিলে থামে, আল্লাহর দাসী তখন ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দিগন্তবিস্তৃত মরুভূমির দিকে। কোথায়, আর কতদূর আল্লাহর ঘর! কাফেলা যত আগে বাড়ে, আল্লাহর ঘর যত কাছে আসে দাসীর অন্তরের অস্থিরতা ও ব্যাকুলতা তত বাড়তে থাকে। মরুভূমির বালুর উত্তাপ, আর তার হৃদয়ের উত্তাপ যেন একাকার হয়ে যায়।
সুদীর্ঘ সফর শেষে কাফেলা অবশেষে মক্কা শহরে প্রবেশ করলো এবং ধীরে ধীরে মসজিদুল হারামের নিকটবর্তী হলো। আল্লাহর দাসী তখন যেন একেবারে ‘মজনু দিওয়ানা’! বুক যেন ভেঙ্গে যায়, কলব যেন ফেটে যায়। তাঁর ব্যাকুল দৃষ্টিতে একই জিজ্ঞাসা, কোথায়! কোথায় আমার মাওলার ঘর! কাফেলার সকলে হয়রান পেরেশান। দাসীর অবস্থা তখন বিলকুল লবেজান! অবশেষে হাবশী দাসীকে দেখানো হলো কালো গিলাফে ঢাকা আল্লাহর ঘর। আর সে শুধু একটি চিৎকার দিলো, দেখেছি, আমার আল্লাহর ঘর আমি দেখেছি! পেয়েছি, আমার আল্লাহকে আমি পেয়েছি! তারপর? তারপর কী হলো? আল্লাহর দাসী আল্লাহর ঘরের সামনে লুটিয়ে পড়লো এবং তড়পাতে তড়পাতে স্থির হয়ে গেলো। আল্লাহর দাসীর স্বপ্ন পূর্ণ হলো, একটি নয়, দুটি; ঘরের এবং ঘরের মালিকের সঙ্গে মিলনের স্বপ্ন।
আরেকটি ঘটনা সে যুগের হিন্দুস্তানের। হজ্বের যাত্রীদের নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে চলেছে পালের জাহাজ। সাগরেই কেটে যায় দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ। কত ভয়ংকর ছিলো সে যুগের সমুদ্রযাত্রা তা এখন কল্পনা করাও সম্ভব নয়। এককথায় সেটা ছিলো প্রাণের মায়া ত্যাগ করে প্রাণদাতার মায়ায় আকুল হয়ে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপ দেয়া। কিন্তু আল্লাহর ঘরের আশিক যারা, আল্লাহর মুহাব্বতের দিওয়ানা যারা জীবন-মৃত্যুর পরোয়া না করে এভাবেই তারা সাগর পাড়ি দিতেন। একদিন সাগরে ঝড় উঠলো, পাহাড় সমান ঢেউ সৃষ্টি হলো, জাহাজ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। প্রতিটি যাত্রীর জন্য তখন মৃত্যু ছিলো অবধারিত। এমন সময় এক ডুবন্ত যাত্রী মৃত্যুর ভয়ে নয়, বঞ্চনার ভয়ে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করলো এভাবে- ‘তোমার ঘরের যিয়ারতের আগে নয় হে আল্লাহ!
এরপর সে আর কিছু জানে না, যখন জ্ঞান ফিরে এলো তখন সে একা এক নির্জন দ্বীপে। তিন বছর পর গায়বি কুদরত তাকে পৌঁছে দিলো মক্কাভূমিতে, আল্লাহর ‘বাড়ীতে’। কীভাবে? তা লেখা নেই কিতাবে, আছে শুধু এ কথা যে, হজ্বের পর আবার সাগরপথে শুরু হলো তার সফর। যেখানে জাহাজ ডুবেছিলো সেখানে যখন জাহাজ এসে পৌঁছলো তখন সে জাহাজের কিনারে দাঁড়িয়ে অন্যদের দেখাতে লাগলো, এখানে, ঠিক এখানে ডুবেছিলো আমাদের জাহাজ। আর তখন.... কেউ জানে না কীভাবে, সে পড়ে গেলো জাহাজ থেকে। সাগরের পানিতে ডুবেই তার মৃত্যু হলো, তবে আল্লাহর ঘর যিয়ারত করার আগে নয়, পরে, যেমন সে ফরিয়াদ করেছিলো আল্লাহর দরবারে। আল্লাহর বান্দাদের সঙ্গে এমনই হয় আল্লাহর আচরণ। মাথায় তোমার পাপের বোঝা! নিরাশ হয়ো না। চাওয়ার মত যদি চাইতে পারো তাহলে তুমিও অনেক কিছু পেতে পারো। এ দুয়ার থেকে তো ডাক আসে দিন রাত। এসো হে নেককার, এসো হে গোনাহগার, লুটে নাও আমার দানের ভাণ্ডার।
আল্লাহর ইশকে দিওয়ানা বান্দাদের আল্লাহর ঘর যিয়ারতের আরো বহু ঘটনা ছিলো সেই কিতাবে। প্রতিটি ঘটনা হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে, চিন্তায় নতুন জাগরণ আনে এবং কলবকে সজীবতা দান করে। এ কিতাব শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কতবার পড়েছি তা বলতে পারবো না। শুধু বলতে পারবো, এ কিতাবের মাধ্যমে আমার অন্তরের লালিত স্বপ্ন শৈশব ও কৈশোর অতিক্রম করে যৌবনে আজ নতুন জৌলুস ও সৌন্দর্য লাভ করলো। আমি নতুনভাবে অবগাহন করলাম আমার হৃদয়ে, আমার স্বপ্নের সরোবরে। এ কিতাবের লেখক যিনি আল্লাহ তাকে শান্তি দান করুন, কবরে, হাশরে এবং জান্নাতের নহরে, দুধের নহরে, মধুর নহরে।
আসমান থেকে সৌভাগ্য যখন নামে তখন নামতে থাকে। এ সময় আরেকটি সৌভাগ্য নেমে এলো আমার হাতে। হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. এর লেখা আরকানে আরবাআ কিতাবটি পেলাম। স্বপ্নকে সবুজ সজীব রাখার জন্য যে জলসিঞ্চনের প্রয়োজন, এ যেন ছিলো তার দ্বিতীয় পর্যায়। হজ্বের হাকীকত ও রূহানিয়াত কী, তা আগেও বুঝিনি, এখনো বুঝি বলার সাহস নেই। তবে এ কিতাব যেন দিলের অনেক পর্দা সরিয়ে দিলো এবং হৃদয়কে নতুন করে আলো দান করলো, উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর আলো। আমি আপ্লুত হলাম, উদ্বেলিত হলাম এবং উদ্দীপ্ত হলাম এক নতুন চেতনায়, যা প্রকাশ করার ভাষা মুখের উচ্চারণে নেই, আছে হৃদয়ের অনুভবে। আমি যেন ডুবে গেলাম, হারিয়ে গেলাম এবং তলিয়ে গেলাম সেই সাগরে যেখানে ডুবে গেলে শান্তি, হারিয়ে গেলে প্রাপ্তি এবং তলিয়ে গেলে মুক্তি- আল্লাহ যাকে করুণা করেন।
এরপর পেলাম তৃতীয় একটি কিতাব, মাওলানা আব্দুল মাজিদ দরয়াবাদী রহ.-এর ‘হিজাযের সফরনামা।’ এটা ছিলো আল্লাহর বিশেষ দান। আর আল্লাহ যখন দান করেন তখন অনুগ্রহ করেই দান করেন। কিন্তু মানুষ লেগে যায় কারণের সন্ধানে। তার লক্ষ্য হারিয়ে যায় উপলক্ষের ধাঁধায়। তাই আমি এখানে বইটির প্রাপ্তির উপলক্ষ বলবো না, আমি শুধু বলবো, শৈশব থেকে লালিত আমার স্বপ্নকে সিঞ্চিত করার এটি ছিলো তৃতীয় ও চূড়ান্ত পর্যায়।
এ কিতাব নিছক কোন সফরনামা ছিলো না, ছিলো আল্লাহর ঘরে আল্লাহর এক প্রেমিক বান্দার জীবন্ত সফর, জীবন্ত হজ্ব এবং জীবন্ত যিয়ারত। অবশ্যই এ কিতাব ছিলো একটি জাদু, তবে অন্যদের মত আমি বলবো না, কলমের জাদু। এটি ছিলো প্রেম ও ভালোবাসার জাদু এবং ইশক ও মুহাব্বতের কারিশমা। এটি ছিলো ভাব ও আবেগের তরঙ্গ-উচ্ছ্বাস এবং হৃদয় ও আত্মার আলোক-উদ্ভাস। কলম শুধু কালি ঝরিয়েছে এবং আলো ছড়িয়েছে। আর হৃদয় থেকে হৃদয় সে আলো গ্রহণ করেছে, আল্লাহ যাকে যতটুকু তাওফীক দান করেছেন। হযরত আলী নদভী রহ. তাঁর জীবনের প্রথম হজ্বসফরে এ সফরনামা সঙ্গে রেখেছিলেন ভাব ও আবেগের উত্তাপে হৃদয়কে উত্তপ্ত রাখার জন্য এবং ইশক ও মুহাব্বতের তড়পে কলবকে বে-তাব রাখার জন্য। এ সফরনামাই ছিলো দরয়াবাদীর কলমের ও কলবের সাথে আমার প্রথম পরিচয় এবং শুভ পরিচয়। হৃদয়ে শৈশব থেকে লালিত স্বপ্ন পূর্ণ যৌবনে এসে এবার যেন একটু একটু করে পেখম মেলতে শুরু করলো। হৃদয়ের উদ্যানে স্বপ্নের ময়ূর যখন ধীরে ধীরে পেখম মেলতে শুরু করে তখন হৃদয় ও আত্মা কেমন আনন্দবিহ্বলতা অনুভব করে তা তারাই শুধু বুঝতে পারে যাদের হৃদয়ে কখনো কোন স্বপ্ন ছিলো এবং এক সময় সে স্বপ্ন পেখম মেলেছিলো। স্বপ্নের ময়ূর যত সুন্দর হয় তার পেখম মেলার আনন্দবিহ্বলতা তত গভীর হয়। আমার হৃদয়ের স্বপ্নময়ূর আমাকে নিয়ে গেলো স্বপ্নের রাজ্যে। মাঝে মাঝে বিভিন্ন স্বপ্ন দেখি, মধুর মধুর স্বপ্ন। জেগে ওঠার পরও সে স্বপ্নের আবেশে পুলকিত ও শিহরিত হই। কখনো দেখি আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করছি। কখনো দেখি, উটের কাফেলায় মদীনার পথে চলেছি, আবার দেখি, পাল তোলা জাহাজ আমাকে নিয়ে ভেসে চলেছে সাগরের বুকে। হিজাযের মরুভূমি ও পাহাড়-পর্বত, মক্কার অলিগলি এবং মদীনার খেজুর বাগান সব যেন আমার পরিচিত, সব কিছুর সঙ্গে যেন আমার আত্মার সম্পর্ক এবং হৃদয়ের বন্ধন।
এভাবে দিন আসে, রাত যায়, আনন্দের উচ্ছলতায়। কারণ হৃদয়ের স্বপ্ন অন্তত নিদ্রার স্বপ্নে বাস্তবতা লাভ করতে শুরু করেছে। আবার সকালে-সন্ধ্যায় বুক দুরু দুরু করে আবেগে উৎকণ্ঠায়। আমার ডাক আসবে তো! লাব্বাইক বলে হাজির হতে পারবো তো! আল্লাহর ডাক যদি শুধু নেককারদের জন্য, তাহলে গোনাহগার বান্দারা যাবে কোথায়? মুলতাযামে দাঁড়িয়ে তাহলে চোখের পানি ফেলবে কারা? হাজারে আসওয়াদ তাহলে আরো কালো হবে কাদের দ্বারা, যমযমের ‘আবে কাউছারে’ তাহলে বিধৌত হবে কাদের আত্মা?
হে কালো গিলাফ! হে সবুজ গম্বুজ! আমি আসতে চাই আলোকিত ও পবিত্র হওয়ার জন্য। আমি আসতে চাই মিলন-সরোবরে অবগাহন করে দগ্ধ হৃদয়ের যন্ত্রণা দূর করার জন্য। কিন্তু আর কত দেরী! রাত পোহাবার আর কত দেরী!!
অবশেষে রাত পোহালো এবং ভোরের আলো দেখা দিলো। পূর্বদিগন্তে লাল সূর্য উদিত হলো আমার স্বপ্নের নতুন দিনের শুভবার্তা নিয়ে, আমাকে পুলকিত, শিহরিত এবং উদ্বেলিত করে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি কি ভুলতে পারবো সেদিনের সেই সুখস্মৃতি! সেই সুমধুর মুহূর্তটি! হায় যদি আমার কলমে সেই কালি থাকতো, যা আঁকতে পারে সুখের চিত্র এবং আনন্দের ছবি! যা তুলে ধরতে পারে হৃদয়ের অনুভব এবং অনুভূতি!
১৪০৩ হিজরী ২৬ শে শা‘বান। ফজরের পর নূরীয়ার মসজিদে বসে তিলাওয়াত করছি, এমন সময় হযরত হাফেজ্জী হুযূর ডাকলেন। আমি গেলাম। মুখে সেই স্নিগ্ধ পবিত্র হাসি, যার সঙ্গে আমি পরিচিত আমার শৈশব থেকে, যে হাসিতে শৈশবে ও কৈশোরে আমি পেয়েছি নির্ভয়তা এবং এখন জীবনের চলার পথে পাই সান্ত্বনা ও নির্ভরতা।
হযরত খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, মওলবী আবু তাহের, তৈয়ার হও। আমি কিছু বুঝলাম, কিছু বুঝলাম না। তবু সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ইনশাআল্লাহ আমি তৈয়ার।
মুখের স্নিগ্ধ হাসিকে আরো আলোকিত করে এবং চোখের প্রশান্ত দৃষ্টিকে আরো মমতাসিক্ত করে হযরত বললেন, কিসের জন্য?
তখন অন্তরের গভীরে অদৃশ্য লোক থেকে আমি যেন অনুভব করলাম এক পরম আশ্বাস ও আলোক-উদ্ভাস। তাই প্রশান্ত চিত্তে স্থির প্রত্যয়ের সঙ্গে আমি উচ্চারণ করলাম, দীদারে বাইতুল্লাহ এবং যিয়ারাতে মাদীনার জন্য!
দু’হাত প্রসারিত করে হযরত আমাকে টেনে নিলেন তাঁর প্রশস্ত বুকে। আমি জানতাম, এ বুকে একটি আলোকিত হৃদয় রয়েছে এবং সে হৃদয়ে অন্য হৃদয় থেকে প্রাপ্ত অন্য রকম স্পন্দন রয়েছে। তাই পরম সৌভাগ্য মনে করে আমি সমর্পিত হলাম হৃদয় থেকে হৃদয়ে স্পন্দন গ্রহণ করার জন্য। হযরত বললেন, জাযাকাল্লাহ, বারাকাল্লাহ।
এটা ছিলো আমার জীবনে হযরতের প্রথম আলিঙ্গন। সে আলিঙ্গনে কী ছিলো এবং কী ছিলো না তা আমি জানি না। আমার শুধু মনে হয়েছে এ আলিঙ্গন হযরত থেকে শুরু নয় এবং হযরত পর্যন্ত শেষ নয়।
নিজেকে তখন মনে হলো সেই মহাভাগ্যবান, যার দীর্ঘ জীবনের লালিত স্বপ্নের ময়ূর এখন পূর্ণ পেখম মেলে এক আলোকিত রূপ ধারণ করেছে। মনে হলো এখন থেকেই আমি আল্লাহর ঘরের মুসাফির এবং সবুজ গম্বুজের অভিসারী। যুগে যুগে দেশে দেশে যত কাফেলা চলেছে হিজাযের অভিমুখে তাদের কাতারে আমিও শামিল হলাম আজ। শোকর আলহামদুলিল্লাহ।
মসজিদে এসে দু’রাকাত শোকরানা আদায় করে দু’হাত উপরে উঠালাম এবং কাঁদলাম। শুধু কাঁদলাম আর অশ্রু ঝরালাম। অন্তরে ভাবের এমন তরঙ্গ সৃষ্টি হলো যে, কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে কিছু বলতে চেয়েও কিছু বলা হলো না। আসলে মুখের উচ্চারণে বলার কিছু ছিলোও না। তখন তো শব্দের মুহূর্ত নয়, তখন তো নৈঃশব্দের মুহূর্ত। তিনি তো অন্তর্জামী। তিনি তো জানেন অন্তরের সব কথা ও ব্যথা, অন্তরের সব আকুতি ও মিনতি। আমার হৃদয় এবং হৃদয়ের স্বপ্ন সবই তো তাঁর। আমার চাওয়া ও পাওয়া, আমার মিনতি ও পরিণতি সবই তো তাঁর। হে আল্লাহ, এ যেন সত্য হয়! এ যেন পূর্ণ হয়! মধুর বেদনা এবার যেন মধুর আনন্দে পরিণত হয়!
সৌভাগ্যের প্রথম ‘সন্দেশ’ তাঁকেই নিবেদন করলাম যার পায়ের নীচে আমার জান্নাত। আব্বাও অবগত হলেন আম্মার কাছ থেকে। সন্তানের সৌভাগ্য সন্দেশে দু’জনেই ‘মিষ্টিমুখ’ হলেন, দু’জনেই আনন্দে আপ্লুত হলেন, তবে আম্মার অভিব্যক্তি ছিলো শান্ত সরোবরের মত, সব সময় যেমন দেখি; আব্বার অভিব্যক্তি ছিলো সমুদ্রতরঙ্গের মত, সব সময় যেমন দেখতাম।
পাহাড়পুরী হুযূর সম্ভবত আগেই জানতেন, তবু তাঁকে জানালাম। জীবনের চলার পথে যিনি সব সময় আলোর মশাল ধরে রাখেন, এমন সুসংবাদ তিনি জানলেও তাঁকে জানাতে হয়। পশ্চিমের কবি যেমন বলেছেন-
‘ফুলফোটা এ বাগানের মাটি তো ভিজেছে তাঁর ‘খুন পাসীনায়’
মিথ্যে তোমার বাগানের বসন্ত হে বন্ধু, তাঁকে যদি ফুলের সুবাস না দাও।
এরপর জানালাম আমার জীবনসঙ্গিনীকে, সেদিনই যিনি জীবন-মৃত্যুর মাঝে অবস্থান করে মাতৃত্বের প্রথম গৌরব অর্জন করেছেন এবং আমাকে দান করেছেন পিতৃত্বের প্রথম গর্ব। এমন সুসংবাদে এমন আনন্দের উদ্ভাসই তার মুখমণ্ডলে আমি আশা করেছিলাম। কোলের ‘পুষ্পকলির’ দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বললেন, আলহামদুলিল্লাহ, দেখো, আমাদের ‘চাঁদকন্যা’ আমাদের জন্য কেমন ‘আকাশ সৌভাগ্য’ বয়ে এনেছে।
পরদিন হযরত হাফেজ্জী হুযূর আমাকে ডাকলেন, তিনি জিজ্ঞাসা করলেন না, আমার পাসপোর্ট আছে কি নেই। শুধু বললেন, তোমার পাসপোর্ট দাও। আল্লাহর শোকর, আমার পাসপোর্ট আগেই তৈয়ার ছিলো, কারণ কিছু দিন আগে হঠাৎ আমার মনে এ চিন্তা এসেছিলো, কিংবা যার হুকুম ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না তিনি আমার মনে এ চিন্তা এনেছিলেন যে, আল্লাহর ঘরে যাওয়ার জন্য তোমার সাধ্যের কাজটুকু তো তুমি করে রাখতে পারো!
তখনকার কথা মনে হলে আপনা থেকেই এখন চোখে পানি এসে পড়ে। এখন তো আল্লাহ অনেক সচ্ছলতা দান করেছেন, কিন্তু তখন পাসপোর্টের প্রয়োজনীয় কয়েকশ টাকা জোগাড় করা আমার জন্য অনেক কঠিন ছিলো। তবে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর রহমতে পাসপোর্ট তৈরী হয়েছিলো এবং সেদিন আমি তা সঙ্গে রেখেছিলাম যেন চাওয়ামাত্র পেশ করতে পারি। বিসমিল্লাহ বলে সেটা হযরতের হাতে তুলে দিলাম। হযরত হাসিমুখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘মাশাআল্লাহ, দিলমে বহুত শাওক হায়!’ হৃদয় তখন আবেগের তরঙ্গে এমন উদ্বেলিত হলো যা প্রকাশ করার যথাশব্দ আমার জানা নেই। আমি যেন মিশরের বাজারে সেই খরিদ্দার যার হাতে নেই একমুঠ গমের দানা, অথচ দিলে রয়েছে ইউসুফকে পাওয়ার তামান্না! কিন্তু তিনি যখন ইচ্ছা করেন তখন তো গায়বের পর্দার ভিতর থেকে সব আয়োজন সম্পন্ন হতে থাকে। আমারও সফরের সব আয়োজন সেভাবে সম্পন্ন হতে লাগলো।
প্রথমে সিদ্ধান্ত হলো হযরত হাফেজ্জী হুযূর দীর্ঘ চার মাসের জন্য বাইতুল্লাহর সফরে যাবেন, আমরা তিনজন হযরতের সফরসঙ্গী হবো। হযরতের ছাহেবযাদা মাওলানা হামীদুল্লাহ, মাওলানা ফারুক আহমদ এবং আমি।
কতবড় সৌভাগ্য! আল্লাহর ঘরে জীবনের প্রথম সফর, দীর্ঘ চার মাসের জন্য, তদুপরি হযরত হাফেজ্জী হুযূর-এর ছোহবত ও তারবিয়াতের ছত্রচ্ছায়ায়! আমার প্রাণপ্রিয় উস্তায হযরত পাহাড়পুরী হুযূরও জীবনের প্রথম সফর করেছিলেন দীর্ঘ চার মাসের জন্য এবং হযরত হাফেজ্জী হুযূর-এর ছোহবতে, তাঁর খাদেমরূপে। এত বড় করে তো আমি চাইনি কখনো! কিন্তু দয়াময় যখন দান করেন বান্দার চাওয়া ও চাহিদার সীমা ছাড়িয়েই দান করেন। বান্দা চায় জান্নাত, আল্লাহ দান করেন জান্নাতুল ফেরদাউস। সত্যি, সেদিন নিজের সৌভাগ্যে নিজেরই যেন ঈর্ষা হলো। মাটির মানুষ হঠাৎ করে যদি আসমানে পৌঁছে যায় এবং আসমানের চাঁদ হাতে পেয়ে যায় তাহলে! তাহলে নিজের উপর নিজেরই তার ঈর্ষা তো হতেই পারে!
হযরত হাফেজ্জী হুযূর-এর পাসপোর্ট যে দূতাবাসেই যায় সঙ্গে সঙ্গে কাজ হয়ে যায়। ফলে কল্পনার চেয়েও দ্রুত সময়ে পাকিস্তান, আরব আমিরাত ও সৌদী আরবের ভিসা হয়ে গেলো। বাংলাদেশ বিমানের ‘সদর দফতরে’ গিয়ে মধুর এক অভিজ্ঞতা হলো। বিমানের পাকিস্তানগামী ফ্লাইটে টিকেট পাওয়া যাচ্ছিলো না। বিমানের এক বড় কর্মকর্তা -হাফেজ্জী হুযূরকে যিনি দেখেছেন শুধু ছবিতে- যখন শুনলেন, হযরত হাফেজ্জী হুযূর পাকিস্তান যাচ্ছেন তখন তিনি বলে উঠলেন, যে ফ্লাইটে হাফেজ্জী হুযূর-এর টিকেট পাওয়া যাবে না সে ফ্লাইট আকাশে ডানা মেলবে না। সুতরাং আমরা বসে থেকেই ত্রিশ মিনিটের মধ্যে চারটা টিকেট হাতে পেয়ে গেলাম।
কী বিপুল সম্ভাবনা ছিলো বটগাছের মত এই বিরাট মানুষটির নিরাপদ ছায়ায় থেকে এদেশের মাটিতে দ্বীনের শতমুখী কাজ করার! অথচ কী নির্দয়ভাবে আমরা সে সম্ভাবনার অপচয় করেছি! এদেশে আমাদের চেয়ে হতভাগা আর কারা আছে! পশ্চিমের কবি কি আমাদের সম্পর্কেই বলেছিলেন?
قسمت بڑی ظرف چہوٹا.
(ভাগ্য নয় ছোট, তবে পাত্র হলো ফুটো)
মাদরাসায় এসে হযরতকে আমি ঘটনা বললাম, আর বললাম, বিমানের ঐ ভদ্রলোকের নামে যদি আপনার পক্ষ হতে একটি শোকরানা চিঠি যায়, তাহলে ভালো হয়। হযরত আমার কথা পছন্দ করলেন। সেই চিঠি ফারুক ভাই নিয়ে গিয়েছিলেন। তার মুখে শুনেছি, ভদ্রলোক চিঠি পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন। নিজের সৌভাগ্য তিনি যেন বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। সবাইকে ডেকে ডেকে তিনি বলছিলেন, দেখো, হাফেজ্জী হুযূর ধন্যবাদ জানিয়ে আমাকে চিঠি লিখেছেন।
এতটুকু কাজ আমরা অনেক সময় করি না। সবকিছুকে নিজের প্রাপ্য বলে সহজেই হযম করে যাই। অথচ আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, من لم يشكر الناس لم يشكر الله
(যে মানুষের শোকর আদায় করে না সে আল্লাহরও শোকর আদায় করে না।)
দুনিয়ার কোন উপকার যদি নাও থাকে তবু আমাদের এটা করা উচিত, অথচ এতে দুনিয়ারও বিরাট ফায়দা রয়েছে; বিশেষত যারা সামাজিক ও দ্বীনী কাজ করতে চায় তাদের জন্য। আর হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রহ. বলেছেন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য শোকরিয়া, ধন্যবাদ ইত্যাদির চেয়ে جزاك الله خيرا বলাই হলো সর্বোত্তম।
যাই হোক, সবকিছু ঠিকমত চলছিলো, কিন্তু হঠাৎ সব কিছু বদলে গেলো। ‘কী কারণে যেন’ হযরতের সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হলো। তিনি এখন সফরে যাবেন না। এখন শুধু আমরা তিনজন যাবো। নূরীয়া মাদরাসার প্রয়োজনে পাকিস্তান ও আবুধাবীতে দশদিন দশদিন অবস্থান করে মক্কা শরীফে গিয়ে আমরা হযরতের জন্য ইনতিযার করবো এবং হযরতের সঙ্গে হজ্ব আদায় করবো।
ভরা আনন্দের মাঝে হঠাৎ যেন এক বিপর্যয়। মনটা একেবারে চুপসে গেলো। মনে হলো মেঘের ছায়া সরে গিয়ে হঠাৎ যেন প্রখর রোদ মাথায় লাগলো। কিন্তু সেটা সামান্য সময়ের জন্য। গায়েব থেকেই যেন আমার মন এ বুঝ পেয়ে গেলো যে, আল্লাহর যা ইচ্ছা আমার তাতে অনিচ্ছা হবে কেন? আল্লাহর ঘরের মুসাফিরের জন্য তো পয়লা সবকই হলো, তোমার কোন ইচ্ছা নেই; এখন থেকে আল্লাহর ইচ্ছার সামনে তোমার সব ইচ্ছার মৃত্যু হলো। তুমি খুশিমনে তোমার ইচ্ছার মৃত্যুকে বরণ করে নিলে।
এ চিন্তা আমার মনে সান্ত্বনার পরশ বুলিয়ে দিলো। আমি বললাম, হে আল্লাহ, তোমার ঘরে তুমি যেভাবে নেবে আমি সেভাবেই রাজি। তুমি শুধু কবুল করে নাও।
কবির ভাষায়—
‘মজনু তো শুধু যেতে চায় লায়লার দেশে
ডানায় উড়ে, ঘোড়ায় চড়ে, পায়ে হেঁটে, হামাগুড়ি দিয়ে
মজনু তো শুধু পেতে চায় লায়লার মুখের একটুকরো হাসি
তার মূল্য যদি হয় প্রাণ, তুলে নাও তবে তরবারি।
যেদিন সন্ধ্যায় পশ্চিম আকাশে রামাযানের নতুন চাঁদ উদিত হলো সেদিন আমার তাকদীরের আসমানেও উদিত হলো ‘নও হেলাল’। আমাকে বলা হলো, হে ভাগ্যবান, আর তিনদিন পর শুরু হবে আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে তোমার মোবারক সফর। জান্নাত ছাড়া এর চেয়ে খুশির খবর আর কী হতে পারে মুমিনের জীবনে!
প্রায় তিন যুগ সময় নিয়ে সেই তিন দিন পার হলো। তৃতীয় রামাযানের তারাবী নূরীয়ায় পড়লাম। পাহাড়পুরী হুযূরের খিদমতে দীর্ঘ সময় থাকলাম। হুযূর তাঁর জীবনের প্রথম হজ্ব সফরের অনেক ঘটনা শোনালেন। আল্লাহর ঘরের প্রথম দীদারের অনুভূতি অনেকবার তাঁর মুখে শুনেছি, তবু মনে হলো, যেন আজ প্রথম শুনছি।
হুযূরের উর্দূ কবিতার আবৃত্তি বড় মর্মস্পর্শী। সেই ছাত্রজীবন থেকে শুনে আসছি, কখনো হুযূরের কামরায়, কখনো জোসনা রাতে নদীতে নৌকায়। হুযূর নিজের রচিত যে দীর্ঘ কাসীদাটি রওযা শরীফে নিবেদন করেছিলেন সেটি অনেকবার হুযূরের মুখে শুনেছি। আজ আবার আবৃত্তি করে শোনালেন। কবিতা তো নয়, যেন অশ্রুর তরঙ্গ। বিরহী হৃদয়, দরদী কণ্ঠ এবং ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুর বর্ষণ-এই তিনে মিলে সেই না‘তে রাসূলের আবৃত্তি এমন মর্মস্পর্শী হলো যে, আমারও চোখে অশ্রুর বাঁধ ভেঙ্গে গেলো। না‘তে রাসূল অনেক শুনেছি, কিন্তু এমন আর কখনো নয়। হয়ত এ জন্য যে, তখন আমার ‘বক্ষে ছিলো কাবার ছবি, নয়নে মুহাম্মাদ রাসূল’।
বাসায় রওয়ানা হলাম রাত এগারটায়। সঙ্গে আমার ছাত্র এবং আত্মীয় ওবায়দুল হক। তখন এটাই ছিলো কামরাঙ্গীর চরের জন্য গভীর রাত, তদুপরি দেশে ছিলো ‘সামরিক পরিস্থিতি’। পথে কোন মানুষ ছিলো না, ছিলো তিনজন পুলিশ। তারা পথ রোধ করে দাঁড়ালো এবং ভীতিকর রকমে উত্ত্যক্ত করতে লাগলো। কামনা করি, মানুষ যেন মানুষকে কখনো এমন কষ্ট না দেয়। যতই আমরা নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করি, তাদের মেজাজ ততই যেন উত্তপ্ত হয়। তাদের এক কথা, এত রাতে কেন? ফাঁড়িতে চলো, সেখানে গিয়ে যা বলার বলো।
বাসা থেকে নূরিয়া; কামরাঙ্গীর চরের এই সোজা পথটুকুই শুধু আমার চেনা, তখনো যেমন এখনো তেমন। ফাঁড়ি কোথায় কে জানে! সেখানে যাওয়া মানে কোন্ বিপদ কে জানে! হায় আল্লাহ, হঠাৎ এ কোন্ পেরেশানি! হঠাৎ এ কী ‘জুলমানি’! রাত পোহালেই আল্লাহর ঘরের সফর, এমন সময় বান্দার উপর এমন বিপদ! আর মাত্র একশ গজ দূরে আমার মা-বাবা, অথচ তাঁদের জানা নেই, এখানে আমার কী হাশরের অবস্থা। নিরুপায় বান্দা শুধু আল্লাহকে ডাকতে পারে এবং ডাকে। আমিও মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম এবং আল্লাহ ডাক শুনলেন। হঠাৎ তাদের একজনের মন কিছুটা নরম হলো। অর্থাৎ যতটা নরম হলে জানের পরিবর্তে মালের দিকে নযর পড়ে। তাই শেষ পর্যন্ত তারা আমাদের ছেড়ে দিলো পকেটের সামান্য কিছু যা ছিলো তা রেখে দিয়ে। পথের উপর এই অল্প সময়ে ছোট্ট একটি হাশর যেন গুজরে গেলো আমাদের উপর। তবু আমার মনটা শান্ত হয়ে গেলো এই ভেবে যে, নিশ্চয় এটা আল্লাহর ঘরের সফরের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে গায়বী তারবিয়াত। নইলে হঠাৎ কেন এমন বিপদ নেমে আসবে! আবার হঠাৎ কেন এভাবে তা উঠে যাবে! কত কিছুই তো হতে পারতো, অথচ কিছুই হলো না; এটা গায়বি তারবিয়াত এবং গায়বি নুছরাত ছাড়া আর কী!
বাসায় পৌঁছলাম রাত একটায়। আম্মা-আব্বা তখন পেরেশান। তারা আমার বিলম্বের এমন একটা কারণ ভাবলেন যাতে আমার কিছুটা দোষ হয়। তবু তাদেরকে পথের এই পেরেশানির কথা বলা ভালো মনে হলো না। নীরবেই তাদের বকা খেলাম এবং রাতের খাবার খেলাম।
রাতের বাকি সময়টুকু দু’চোখের পাতা আর এক হলো না। সময়ও যেন পার হতে চায় না। থেকে থেকে মনে জেগে ওঠে বিভিন্ন শংকা, আশংকা ও উৎকণ্ঠা। হঠাৎ যদি আসমান থেকে কোন বিপদ নেমে আসে! কিংবা যমীন থেকে কোন আপদ উঠে আসে! হঠাৎ যদি আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি! হঠাৎ যদি ‘অসুস্থ দেশ’ আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে! মুহূর্তে কত কিছুই তো হতে পারে! তাকদীরের কাছে মানুষ কত অসহায়, তবু মানুষের অহংকার ও দম্ভ থেকে যায়।
হে আল্লাহ, আজকের এ রাত পোহাবে তো? তাকদীর আমাকে সঙ্গ দেবে তো? আগামীকাল আমার সফর শুরু হবে তো? পথের শেষে মানযিলের দেখা পাবো তো?
অবশেষে রাত পোহালো, ভোরের আলো দেখা দিলো এবং পূর্বদিগন্তে লাল সূর্য উদিত হলো। আমার জীবনের প্রথম লাল সূর্য। এ সূর্যোদয়ের মাধ্যমেই তো শুরু হলো আমার নতুন জীবনের নতুন দিন। শুরু হলো আমার স্বপ্নের বাগানে ফুল ফোটার প্রথম বসন্তের শিশির ধোয়া প্রথম দিন। সূর্যের লালিমায় আমার জন্য যেন লেখা ছিলো, দীদারে বাইতুল্লাহ এবং যিয়ারাতে নবীর পবিত্র সফরের প্রথম শুভেচ্ছা, ‘আহলান ওয়া সাহলান’। (চলবে)