শাওয়াল ১৪৪৪   ||   মে ২০২৩

নতুন শিক্ষাবর্ষ
নতুন উদ্যমে ইলম অন্বেষণে মগ্ন হই

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

الحمد لله وسلام على عباده الذين اصطفى، أما بعد!

আল্লাহ তাআলার অশেষ মেহেরবানী। তাঁর তাওফীকেই আমরা স্বাভাবিকভাবে আরেকটি নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু করতে যাচ্ছি আলহামদু লিল্লাহ।

اللّٰهُمَّ مَا أَصْبَحَ بِي مِنْ نِعْمَةٍ أَوْ بِأَحَدٍ مِنْ خَلْقِكَ، فَمِنْكَ وَحْدَكَ لَا شَرِيكَ لَكَ، فَلَكَ الْحَمْدُ وَلَكَ الشُّكْرُ.

اللّٰهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ خَيْرَ هَذَا الْعَامِ فَتْحَهُ، وَنَصْرَهُ، وَنُورَهُ، وَبَرَكَتَهُ، وَهُدَاهُ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا فِيهِ وَشَرِّ مَا بَعْدَهُ.

সূচনার এ সময়টিতে সাধারণত সবার মধ্যে নতুন উদ্যম ও নতুন উৎসাহ বিরাজ করে। এই নব উদ্যমকে কাজে লাগানো উচিত। একে অলসতা ও অবহেলা করে নষ্ট করা অন্যায়। এতে সময়ের বরকত চলে যায়। ইলমের মহব্বত কমে যায়। অতএব শুরুকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো জরুরি।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন

احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ، وَاسْتَعِنْ بِاللهِ، وَلَا تَعْجَزْ.

যা তোমার উপকার করবে তার প্রতি আগ্রহী হও, আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও এবং অক্ষম হয়ে বসে পড়ো না। সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৬৬৪

এ হাদীসে আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাথেয় রয়েছে। ছোট্ট একটি বাক্যে তিনি আমাদের কাজের মূলনীতি ও কর্মপন্থা বলে দিয়েছেন।

এখানে তিনটি বিষয়ের আদেশ করা হয়েছে

এক. احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ

যা তোমার জন্য উপকারী হবে তার প্রতি আগ্রহী হও।

আগ্রহ ও মহব্বত মানসিক শক্তির অন্যতম উৎস। কোনো বিষয়ে ভালোবাসা ও আগ্রহ তৈরি হয়ে গেলে মানুষ তার জন্য কষ্ট ও পরিশ্রম করতে প্রস্তুত হয়ে যায়। সেজন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রথমে আগ্রহ তৈরি কর, অন্তরে কাজের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি কর।

তাই একজন তালিবে ইলমের প্রথম করণীয়, অন্তরে ইলমের প্রতি মহব্বত সৃষ্টি করা। নিজের ভেতর ইলমের পিপাসা তৈরি করা। এমন পিপাসা, যা নিবারণ হয় না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন

مَنْهُومَانِ لا يَشْبَعَانِ : طَالِبُ عِلْمٍ وَطَالِبُ دُنْيَا.

দুই লোভাসক্ত কখনো তৃপ্ত হয় না দুনিয়া অন্বেষী এবং ইলম অন্বেষী। মুসনাদে বাযযার, হাদীস ৪৮৮০; আলকামিল, ইবনে আদী ৭/৫৫৮

ইলম অতি মূল্যবান। এর মূল্য যেমন বেশি, তার জন্য পরিশ্রমও করতে হয় বেশি। সালাফের এই বাণী তো আমরা বহুবার শুনেছি

العِلْمُ شَيْءٌ لَا يُعْطِيْكَ بَعْضَهُ حَتَّى تُعْطِيَهُ كُلَّكَ، فَإِذَا أَعْطَيْتَهُ كُلَّكَ فَأَنْتَ مِنْ إِعْطَائِهِ لَكَ الْبَعْضَ عَلَى خَطَرٍ.

ইলম এমন জিনিস, তার জন্য তোমার সর্বস্ব না বিলিয়ে দিলে সে তোমাকে সামান্যও দেবে না। বরং তার জন্য তোমার সর্বস্ব বিলিয়ে দিলেও সে তোমাকে কিছু দেবে কি না সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে।  তারীখে বাগদাদ ৫/৭২-৭৩ (নায্যামের জীবনী), ১২/২২৪ (আবু ইউসুফ রাহ.-এর জীবনী)  

অর্থাৎ ইলমের জন্য বিলীন না হয়ে যাওয়া ব্যতীত ইলমে রুসূখ ও দৃঢ়তা আসে না; দ্বীনের সঠিক সমঝ ও বুঝ হাসিল হয় না। কিন্তু অন্তরে ইলমের প্রতি মহব্বত ও আগ্রহ না থাকলে বিলীন হওয়া তো দূরের কথা, ইলমের জন্য সামান্য কষ্ট সহ্য করাও সম্ভব হবে না। ইলমের জন্য মেহনত-মুজাহাদা ও ত্যাগ-তিতিক্ষা তখনই সম্ভব হবে, যখন অন্তরে ইলমের প্রতি অত্যধিক লোভ ও আগ্রহ থাকবে এবং ইলমের মহব্বতে অন্তর একদম পরিপূর্ণ থাকবে। তখন দেখা যাবে, ইলমের জন্য যে কোনো কষ্ট সহ্য করতে দেহ-মন প্রস্তুত হয়ে আছে। আগে যেসব ওয়াসওয়াসা ও কুমন্ত্রণা মনে ভীড় করত সেগুলো দূর হয়ে গেছে। কারণ ইলমের মহব্বতটাই অনেক রোগের প্রতিষেধক।

ইলমের মহব্বত পয়দা করার অনেক উপায় রয়েছে। এ বিষয়ে ইতিপূর্বে এ বিভাগে লেখা হয়েছে। আগ্রহীগণ তালিবানে ইলম : পথ ও পাথেয় কিতাব থেকে (পৃ. ১০০-১০৭) এ বিষয়ক লেখাটি পড়ে নিতে পারেন। লেখাটির শিরোনাম তালিবে ইলম ভাইদের প্রতি আবেদন, নিজের মধ্যে ইলমের অনির্বাণ তৃষ্ণা সৃষ্টি করুন। সেখানে ইলমের মহব্বত বৃদ্ধির ১২টি উপায় বলা হয়েছে।

দুই. وَاسْتَعِنْ بِاللهِ

আল্লাহর কাছে সাহায্য চাও।

এর কোনো বিকল্প নেই। মেহনত-মুজাহাদা ও চেষ্টা-পরিশ্রম কখনো দুআ ও সাহায্য প্রার্থনার বিকল্প হতে পারে না। ইমাম আবুল আব্বাস কুরতুবী (৬৫৬ হি.) রাহ. লিখেছেন

وَمَعَ إِنْهَاءِ الاجتهادِ نِهايتَه، وإبلاغِ الحِرْصِ غايتَه، فلا بُدَّ مِن الاستعانةِ باللهِ، والتوكُّلِ عليه، والالْتِجاءِ في كلِّ الأمورِ إليه، فَمَنْ سَلَكَ هذين الطريقين حَصَلَ على خيرِ الدَّارَيْن.

অর্থাৎ চূড়ান্ত চেষ্টা-পরিশ্রম ও পরিপূর্ণ আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনিবার্য করণীয় হল, আল্লাহ তাআলার নিকট সাহায্য প্রার্থনা করা, তাঁর উপর ভরসা করা এবং সব বিষয়ে তাঁরই আশ্রয় গ্রহণ করা। এই দুই বিষয় যে অবলম্বন করবে সে উভয় জাহানের কল্যাণ লাভ করবে। আলমুফহিম লিমা আশকালা মিন তালখীসি কিতাবি মুসলিম, আবুল আব্বাস কুরতুবী ৬/৬৮২

অতএব কুরআন-সুন্নাহ্য় ইলম সংশ্লিষ্ট যেসব দুআ আছে সেগুলোর প্রতি যত্নবান হতে হবে। কিছু দুআ এই-

১. رَبِّ زِدْنِیْ عِلْمًا  (সূরা ত-হা : ১১৪)

২. رَبِّ اشْرَحْ لِيْ صَدْرِيْ. وَ يَسِّرْ لِيْۤ اَمْرِيْ. وَ احْلُلْ عُقْدَةً مِّنْ لِّسَانِيْ. يَفْقَهُوْا قَوْلِيْ   (সূরা ত-হা : ২৫-২৮)

৩. رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوْبَنَا بَعْدَ اِذْ هَدَيْتَنَا وَ هَبْ لَنَا مِنْ لَّدُنْكَ رَحْمَةً  اِنَّكَ اَنْتَ الْوَهَّابُ  (সূরা আলে ইমরান : ৮)

৪. اللّٰهُمَّ انْفَعْنِي بِمَا عَلَّمْتَنِي، وَعَلِّمْنِي مَا يَنْفَعُنِي، وَارْزُقْنِي عِلْمًا تَنْفَعُنِي بِهِ  (আদদুআ, তবারানী : ১৪০৫)

৫. اللّٰهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْعَجْزِ، وَالْكَسَلِ، وَالْجُبْنِ، وَالْبُخْلِ، وَالْهَرَمِ، وَعَذَابِ الْقَبْرِ، اللّٰهُمَّ آتِ نَفْسِي تَقْوَاهَا،

 وَزَكِّهَا أَنْتَ خَيْرُ مَنْ زَكَّاهَا، أَنْتَ وَلِيُّهَا وَمَوْلَاهَا، اللّٰهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ عِلْمٍ لَا يَنْفَعُ، وَمِنْ قَلْبٍ لَا يَخْشَعُ، وَمِنْ نَفْسٍ لَا تَشْبَعُ، وَمِنْ دَعْوَةٍ لَا يُسْتَجَابُ لَهَا.

(সহীহ মুসলিম : ২৭২২)

৬. اللّٰهُمَّ إِنِّي عَبْدُكَ،ابْنُ عَبْدِكَ،ابْنُ أَمَتِكَ، نَاصِيَتِي بِيَدِكَ،مَاضٍ فِيَّ حُكْمُكَ، عَدْلٌ فِيَّ قَضَاؤُكَ، أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ

 لَكَ، سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ،أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ، أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ، أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ، أَنْ تَجْعَلَ الْقُرْآنَ رَبِيعَ قَلْبِي، وَنُورَ صَدْرِي، وَجِلَاءَ حُزْنِي، وَذَهَابَ هَمِّي.

(মুসনাদে আহমাদ : ৪৩১৮; সহীহ ইবনে হিব্বান : ৯৭২)

৭. اللّٰهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ عِلْمًا نَافِعًا، وَرِزْقًا طَيِّبًا، وَعَمَلًا مُتَقَبَّلًا (সুনানে ইবনে মাজাহ : ৯২৫)

(হাদীসে আছে, এই দুআটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের নামাযের সালাম ফেরানোর পর পড়তেন।)

সকাল-সন্ধ্যার একটি দুআ আছে

أَصْبَحْنَا وَأَصْبَحَ الْمُلْكُ لِلهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ، اللّٰهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ خَيْرَ هَذَا الْيَوْمِ فَتْحَهُ، وَنَصْرَهُ، وَنُورَهُ، وَبَرَكَتَهُ، وَهُدَاهُ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا فِيهِ وَشَرِّ مَا بَعْدَهُ.

(সুনানে আবু দাউদ : ৫০৮৪)

এই দুআয় যেসব জিনিস প্রার্থনা করা হয়েছে সেগুলো অত্যন্ত ব্যাপক। ইলমী বিষয়সমূহও এর অন্তভুর্ক্ত। সেজন্য দুআটি পাঠের সময় ইলম সংক্রান্ত বিষয়গুলোও খেয়াল রাখা যায়। অর্থাৎ মনে মনে এই দুআও করা আল্লাহ! আমি একজন তালিবুল ইলম। এই দিবসে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ইলম সংক্রান্ত যত কল্যাণ ও বিজয় আছে, যত সাহায্য ও নূর আছে এবং যত বরকত ও হেদায়েত আছে, সব আপনি আমাকে দান করুন। তেমনি এই দিনে ও তার পরবতীর্ দিনসমূহে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ইলম সংক্রান্ত  যত অকল্যাণ আছে, সব অকল্যাণ থেকে আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি।

সালাতুল হাজতের অভ্যাস গড়ে তুলুন। কোথাও আটকে গেলে, মাসআলা বুঝে না আসলে কিংবা সবক কঠিন মনে হলে দুই রাকাত সালাতুল হাজত পড়ে আল্লাহর কাছে দুআ করুন।

ইসতিগফার ও দরূদ শরীফের ইহতিমাম করুন এবং দুআ কবুলের মুহূর্তগুলোতে দুআর প্রতি যত্নবান হোন।

ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বল রাহ. তাঁর এক শাগরিদকে নসীহত করেছিলেন

سُبْحَانَ اللهِ! رَجُلٌ يَطْلُبُ الْعِلْمَ، لَا يَكُونُ لَهُ وِرْدٌ مِنَ اللَّيْلِ!

সুবহানাল্লাহ! একজন ইলম তলব করে, অথচ রাতে তার নির্ধারিত কোনো আমল (নফল নামায) নেই! আলজামে, খতীব বাগদাদী, পৃ. ১৪৩; মাআলিমু ইরশাদিয়্যা, মুহাম্মাদ আওয়ামা, পৃ. ২৪০

এককথায় আমরা  নিজেদের لَحَلِیْمٌ اَوَّاهٌ مُّنِیْبٌ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করি।

তিন. وَلَا تَعْجَزْ

অক্ষম হয়ে বসে পড়ো না।

কোনো ভালো ও উপকারী কাজ শুরু করার পর হাল ছেড়ে দেওয়া ও হতোদ্যম হয়ে পড়া মুমিনের শান নয়। ওযীর ইয়াহইয়া ইবনে হুবায়রা (৫৬০ হি.) রাহ. লিখেছেন

فأمَّا قولُه: (وَلَا تَعْجَزْ)، فَإِنَّهُ لَا يَحْسُنُ بِالُمُؤْمِنِ أَنْ يَعْجَزَ؛ وَقَدْ بَقِيَ فِي الْأَمْرِ مَطْلَعٌ لِاحْتِيَالٍ.

অর্থাৎ যতক্ষণ ঘুরে দাঁড়াবার কোনো না কোনো সুযোগ অবশিষ্ট রয়েছে ততক্ষণ অক্ষম ও হতোদ্যম হয়ে বসে পড়া মুমিনের পক্ষে শোভনীয় নয়। আলইফসাহ আন মাআনিস সিহাহ, ইবনে হুবায়রা ৮/৪৩

অতএব তালিবে ইলমের কাজ হল, সে কখনো হাল ছাড়বে না। সবর ও ইসতিকামাতের সঙ্গে ইলম অর্জনের প্রচেষ্টায় যথাসম্ভব লেগে থাকবে।

আবু বকর কফ্ফাল (القفّال) মারওয়াযী। পূর্ণ নাম আবদুর রহমান ইবনে আহমাদ ইবনে আবদুল্লাহ, আবু বকর কফ্ফাল মারওয়াযী। শাফেয়ী মাযহাবের একজন ফকীহ। ওফাত ৪১৮ হি.। তাঁর সম্পর্কে প্রসিদ্ধ আছে, তিনি বয়স হয়ে যাবার পর ইলম শিখতে গিয়েছেন। তাঁর প্রথম দিনের সবক ছিল একটিমাত্র বাক্য

هَذَا كِتَابٌ اخْتَصَرْتُهُ.

সবক ইয়াদ করার জন্য তিনি রাতের বেলা বাড়ির ছাদে ওঠেন। এশা থেকে ফজর পর্যন্ত এই একটি বাক্যই জপতে থাকেন। ফজরের সময় তার ঘুম চলে আসে। চোখ খুলে দেখেন, বাক্যটি আর মনে নেই। পেরেশান হয়ে যান তিনি।

দিনের বেলা উস্তাযকে পুরো ঘটনা খুলে বলেন। তখন উস্তায তাকে নসীহত করেন

لَا يَصُدَّنَّكَ هَذَا عَنِ الْاِشْتِغَالِ، فَإِنَّكَ إِذَا لَازَمْتَ الْحِفْظَ وَالْاِشْتِغَالَ صَارَ لَكَ عَادَةً.

অর্থাৎ এ কারণে তুমি ইলম অন্বেষণ থেকে পিছিয়ে যেয়ো না। তুমি যদি অব্যাহতভাবে হিফয ও ইলম অন্বেষণের কাজে লেগে থাক, দেখবে একসময় এটা তোমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। মুজামুল বুলদান, ইয়াকুত হামাবী ৫/১১২-১১৩

এই মারহালা তালিবে ইলমের জন্য বড় পরীক্ষার মারহালা। প্রথম কিছুদিন হয়ত পড়ার আগ্রহ থাকে; এরপর ভাটা পড়তে থাকে। একসময় হারিয়ে যায়। এই ক্রমাবনতির বিভিন্ন কারণ রয়েছে। তবে সেগুলো থেকে বাঁচারও উপায় আছে। নিম্নে কয়েকটি উপায় উল্লেখ করা হল

১. সবর ও ইস্তিকামাতের সঙ্গে মেহনতে লেগে থাকার চেষ্টা করা। মেহনতের মধ্যে যেন ছেদ না পড়ে। যেমন, একদিন পড়লাম, আরেকদিন পড়লাম না। জুমার দিন ও বিরতির দিনগুলো পড়াশোনা ছাড়া এমনিতেই কাটিয়ে দিলাম। কোনো কারণে উস্তায সবকে আসেননি, তাই গল্পগুজবে সময় পার করে দিলাম। এসব করলে মুতালাআর অভ্যাস হবে না। অথচ আমাদের উদ্দেশ্য হল, মুতালাআ ইনহিমাক এগুলো যেন একদম অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়।

২. ইলম অন্বেষণে যেসব জিনিস প্রতিবন্ধক, সেসব জিনিস থেকে বেঁচে থাকা। কারো সঙ্গে অতিরিক্ত মেলামেশা থেকে বিরত থাকা।

     মোবাইল, ইন্টারনেট ও এজাতীয় জিনিসগুলো তালিবে ইলমের জন্য বিষ। এগুলো ইলমের আগ্রহকে একদম নষ্ট করে দেয়।

৩. দরসে নিয়মিত হাজিরির বিষয়ে পূর্ণ মনোযোগী থাকা।

৪. প্রতিদিনের সবক প্রতিদিন ইয়াদ করার চেষ্টা করা। অলসতা করে সামনের জন্য রেখে দেবে না। এতে পড়া জমতে থাকে এবং একপর্যায়ে পড়াশোনার আগ্রহ দমে যায়।

বছরের শুরু থেকেই হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর নসীহতটির উপর গুরুত্বের সঙ্গে আমল করবে। তিনি বলতেন, ব্যস তোমরা তিনটি কাজ নিজেদের জন্য আবশ্যক করে নাও। আমি দায়িত্ব নিচ্ছি, তোমাদের ইলমী ইসতিদাদ হাসিল হয়ে যাবে (ইনশাআল্লাহ)।

ক. দরসের আগে অবশ্যই সামনের সবক মুতালাআ করবে। এটা কোনো কঠিন কাজ নয়। কারণ এই মুতালাআর উদ্দেশ্য কেবল এটুকু যে

معلومات اور مجہولات متميز ہو جائيں۔

জানা আর অজানা বিষয় চিহ্নিত হয়ে যাওয়া। (অর্থাৎ কতটুকু বুঝেছি আর কতটুকু বুঝিনি এটা চিহ্নিত হয়ে যাওয়া।) ব্যস, এর বেশি (আপাতত) দরকার নেই।

খ. এরপর দরসে উস্তাযের নিকট সবক ভালোভাবে বুঝে পড়বে। (বিশেষভাবে লক্ষ রাখবে, মুতালাআর সময় যা বুঝেছিলাম তা সঠিক ছিল কি না। আর যে অংশ বুঝিনি তা খুব ভালো করে শুনব, যাতে এখন বুঝে নিতে পারি।) তখন যদি উস্তাযের মন প্রস্তুত না থাকে এবং জিজ্ঞেস করলে বিরক্ত হওয়ার আশংকা থাকে তাহলে অন্যসময় বুঝে নেবে।

গ. দরসের পর পুরো সবকের সারকথা তাকরার করে নেবে। কোনো সাথী না পেলে নিজের সঙ্গে নিজে তাকরার করবে।

এই তিন কাজ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়মিত করতে পারলে নিশ্চিন্ত হয়ে যাও; পেছনের পড়া মনে আছে কি না এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না। ইনশাআল্লাহ অবশ্যই ইসতিদাদ হয়ে যাবে।

এই তিন কাজ তো ওয়াজিব পর্যায়ের। আরেকটি কাজ আছে মুস্তাহাব পর্যায়ের। প্রতিদিন আমুখতা অর্থাৎ পেছনের কিছু পড়া দোহরাবে। আশরাফুস সাওয়ানেহ, খ. ১, পৃ. ৫০-৫১; খুতুবাতে হাকীমুল উম্মত, খ. ২৫, পৃ. ৫২ (হুদূদ ওয়া কুয়ূদ)

৫. প্রথম জামাত থেকেই বুঝে বুঝে পড়া। এ ব্যাপারে সবোর্চ্চ গুরুত্বারোপ করা। কারণ প্রথম জামাতগুলোই ইলমী ইসতিদাদের ভিত্তি। সেজন্য এক্ষেত্রে কোনো রকমের অবহেলা গ্রহণযোগ্য নয়। এই জামাতগুলোতে না বুঝে পড়লে পরবর্তীতে কিছুই বুঝবে না। তখন দেখা যাবে, নিজেও পড়ে না আবার আরেকজনের পড়ারও ক্ষতি করে।

৬. নিজের মুহাসাবা করা। আমার উন্নতি হচ্ছে, নাকি অবনতি? অবনতি হলে খেয়াল করা, কী কারণে অবনতি হচ্ছে। উস্তাযের কাছে নিজের অবস্থা পেশ করা। সমস্যা নিয়ে বসে না থাকা। এতে সমস্যা আরো বড় হয়।

৭. তাজদীদে নিয়ত তথা নিয়ত নবায়ন করা। উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নুমানী রাহ. বলতেন, প্রতিদিন সকালে যখন কাজ শুরু করবে তখন নতুন করে নিয়ত বিশুদ্ধ করবে।

৮. গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা। কারণ গুনাহ মনকে কলুষিত করে; ফলে নেক কাজের আগ্রহ শেষ হয়ে যায়। সেজন্য কখনো গুনাহ হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তওবা-ইসতিগফার করা এবং ক্ষতিটা যথাসম্ভব নেক আমলের দ্বারা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা।

মনে রাখবেন, শুরু তো অনেকেই করে; কিন্তু সবর ও ইস্তিকামাতের সঙ্গে টিকে থাকে খুব কম মানুষই। টিকে থাকে তারাই, যাদের ইলমের প্রতি সাচ্চা পেয়ার ও মহব্বত আছে, দুআ ও রোনাজারি আছে। আর আছে অক্লান্ত পরিশ্রম।

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সেই সৌভাগ্যবান তালিবে ইলমদের কাতারে শামিল হওয়ার তাওফীক দান করুন আমীন।

وآخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين.

২৩-০৮-১৪৪৪ হি.

১৬-০৩-২০২৩ ঈ.

বৃহস্পতিবার

 

 

advertisement