শাওয়াল ১৪৪৪   ||   মে ২০২৩

মুসলিম মনীষীদের জীবন থেকে আমানতদারির কিছু দৃষ্টান্ত

মাওলানা মুহাম্মাদুল্লাহ মাসুম

এই পৃথিবীতে নানা শ্রেণীর নানা পেশার মানুষের বসবাস। জীবিকার তাগিদে আমাদেরকে বিভিন্ন কাজ ও পেশা বেছে নিতে হয়। কারো ব্যবসা, কারো চাকরি। কারো আদালত, কোর্ট-কাচারি। কারো শাসন ও রাজনীতি। কারো আবার কৃষি ও খেত-খামারি। কর্মমুখর জীবনের প্রতিটি পদে থাকে শয়তান ও তার দোসরদের প্ররোচনা, থাকে নফস ও কুপ্রবৃত্তির হাতছানি। এসব উপেক্ষা করেই মুমিন সামনে অগ্রসর হয়। পূর্বসূরি যাদের নিয়ে আমরা গর্ব করি, সাহাবাযুগ থেকে নিকট অতীতের মনীষী, সবার জীবনেই রয়েছে আমানতদারির অনন্য সাধারণ দৃষ্টান্ত ও উপমা। রয়েছে আমাদের জন্য শিক্ষা ও রাহনুমা। নিচে কিছু দৃষ্টান্ত পেশ করা হল, যাতে পূর্বসূরিদের জীবনের ঘটনাগুলো থেকে আলো ও পাথেয় পাওয়া যায়।

ব্যবসায় সততা ও আমানতদারির অনুপম দৃষ্টান্ত

ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর একটি ঘটনা! বিক্রিত পণ্যে সামান্য একটু ভেজাল থাকাতে তিনি কী করলেন সেই গল্পটাই আগে বলি? একবার কাপড় বিক্রি করার জন্য তিনি তাঁর ব্যবসায়িক সহকারীকে দায়িত্ব দিলেন। সেখানে একটি ত্রুটিযুক্ত কাপড়ও ছিল। ওই লোক কাপড়টা বিক্রি করে ফেলল বটে, কিন্তু গ্রাহককে ত্রুটির কথা বলতে ভুলে গেল। গ্রাহকও বিষয়টি খেয়াল করল না। ইমাম আবু হানীফা রাহ. এসে যখন ব্যাপারটি জানলেন, তিনি খুব কষ্ট পেলেন। কিন্তু কীভাবে এখন ওই গ্রাহকের দায় শোধ করবেন আর কীভাবেইবা এই অর্থ নিজের বা পরিবারের জীবিকা নির্বাহের কাজে লাগাবেন! সতর্কতাবসত কাপড়ের পুরো মূল্যটাই তিনি সদকা করে দিলেন।আলখাইরাতুল হিসান ফী মানাকিবিল ইমাম আবী হানীফা আননুমান, পৃ. ৪৩

আসলে মিথ্যা-জালিয়াতি, ধোঁকা ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ব্যবসা করে কী লাভ? আমাকে তো একদিন মহান মালিকের সামনে দাঁড়াতে হবে।

একজন ন্যয়নিষ্ঠ বিচারকের দৃষ্টান্ত

ইমাম আবু হানীফা রাহ.-এর শিষ্য, হানাফী মাযহাবের প্রধান তিন ইমামের একজন কাযী আবু ইউসুফ রাহ.-এর ঘটনা। খলীফা হারূনুর রশীদের যুগে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। জীবনভর ইনসাফের সঙ্গে পালন করেছেন এ গুরুদায়িত্ব। কিন্তু সামান্য একটা বিষয় মৃত্যুর আগে তাঁকে এমনভাবে পেরেশান করেছিল যে, তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন। বারবার বলছেন, আল্লাহর কসম, জীবনে কোনো দিন পাপাচার, জুলুম-অবিচার করিনি, কিন্তু ওই দিনের জন্য ভয় হচ্ছে!

তাঁর শিষ্য ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. জিজ্ঞেস করলেন, কী এমন করে ফেললেন, যার জন্য আপনি এত বিচলিত হচ্ছেন?

তিনি বললেন, আসলে আমি তো খলীফার নির্দেশে মামলার শুনানি করতাম এবং তাঁর উপস্থিতিতেই ফয়সালা করতাম। কিন্তু একদিন ঘটে গেল একটু বিপত্তি। একটা মামলা এল, যেখানে এক খ্রিস্টানের পক্ষ থেকে খলীফাকে ভূমি আত্মসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হল। অর্থাৎ মামলার বিবাদী স্বয়ং খলীফা হারূনুর রশীদ আর বাদী হল খ্রিস্টান। বিষয়টি যখন খলীফার কাছে পেশ করলাম, তিনি বললেন, এই জমিন তো আমি আমার দাদা খলীফা মানসূর থেকে মীরাসসূত্রে পেয়েছি।

আমি খ্রিস্টানকে বললাম, শুনেছ তো? এবার থাকলে তুমি তোমার দলীল পেশ করো।

সে বলল, আমার কাছে দলীল নেই। আপনি হারূনুর রশীদকে শপথ করান।

হারূনুর রশীদ শপথ করলেন। তখন খ্রিস্টান চলে গেল। ফয়সালা খলীফার পক্ষেই গেল।

কিন্তু এখন আমার ভয় হচ্ছে, আমি কেন খলীফাকে খ্রিস্টানের সমমর্যাদায় রেখে আদালত-কক্ষে বসাইনি! আল্লাহর কসম, জীবনে কোনোদিন পাপাচার, জুলুম-অবিচার করিনি, কিন্তু ওই দিনের জন্য ভয় হচ্ছে! (কারণ বিচার-মঞ্চে মর্যাদার দিক থেকে বাদী-বিবাদী দুজনই সমান।)

ইমাম মুহাম্মাদ রাহ. বললেন, এতে ভয়ের কী আছে? আপনি তো অন্যায় করেননি; বরং ন্যায়সংগত সিদ্ধান্তই দিয়েছেন।

তিনি বললেন, কিন্তু আমীরুল মুমিনীনকে যে বাদীর সমমর্যাদায় রাখিনি! (দ্র. ফাযাইলু আবী হানীফা, ইবনে আবিল আওয়াম, পৃ. ৩২৬; মানাকিবুল ইমাম আবী হানীফা ওয়া ছাহিবাইহি, পৃ. ৭০)

আহা, এই এতটুকুর জন্য তিনি এখন এত বিচলিত হচ্ছেন! তাকওয়ায় উদ্ভাসিত হৃদয়গুলো আসলে এমনই হয়ে থাকে। আমাদের মনীষীদের জীবনে পাওয়া যাবে আমানতদারি ও দায়িত্বশীলতার এমন অনেক দৃষ্টান্ত।

রাষ্ট্রীয় সম্পদ হেফাজতের ক্ষেত্রে সততা ও আমানতদারি

ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর রা.। দেশের শাসনক্ষমতা তখন তাঁর হাতে। বাহরাইন থেকে একবার কিছু দামি আতর-সুগন্ধি ও মিশ্ক এল তাঁর দরবারে। তিনি নিজের স্ত্রীকে ডেকে বললেন, ভালো ওজন করতে পারে, এমন একজন মহিলা খুঁজে বের করো! এগুলো মেপে মানুষের মাঝে বণ্টন করে দিতে হবে।

স্ত্রী বললেন, কেন, আমিই তো ভালো ওজন করতে পারি। এদিকে নিয়ে আসুন, মেপে দিই!

খলীফা বললেন না, তুমি না।

স্ত্রী বললেন, কেন?

তখন তিনি বললেন, আমার আশঙ্কা, এগুলো স্পর্শ করতে গেলে তোমার হাতে লাগবে। তারপর এভাবে করবে। (এ বলে তিনি তাঁর হাতের আঙ্গুল নিজের কানের ভেতর ঢুকালেন) এরপর গলায় হাত মুছবে। ফলে জাতির সম্পদ আমার ব্যবহারে চলে আসবে।

অর্থাৎ এগুলো ওজন করার সময় ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় কিছু সুগন্ধি তো তাঁর স্ত্রীর হাতে লেগেই যেতে পারে। সেই হাত স্ত্রীর গলা, কান ইত্যাদিতে লাগবে। একেই তিনি রাষ্ট্রীয় সম্পদ ভোগ করা ভাবছেন সুবহানাল্লাহ। (দ্র. কিতাবুয যুহদ, আহমাদ ইবনে হাম্বাল, পৃ. ১১৯)

কৃষি ও চাষাবাদে আমানতদারি

ইমাম শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে আবদুর রহীম আলমাকদীসী রাহ. (৬৮৮)-এর ঘটনা। তিনি ছিলেন হাদীস ও ফিকহের বড় ইমাম। দুনিয়াবিমুখ এক মহান পুরুষ। তাকওয়া ও আমানতদারির প্রশ্নে বড় মজবুত। নিজের কোনো কাজে একবার পাহাড়ে মাটি খুঁড়ছিলেন। সাথে ছিল তাঁর স্ত্রী। সেখানে সোনাভর্তি একটি কলসি পেলেন। তিনি ভয় পেয়ে গেলেন। হায় আল্লাহ, এ তো আমার জন্য বড় পরীক্ষা! এই বলে ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন পড়া শুরু করলেন। তারপর কলসিটি যেভাবে ছিল মাটিতে সেভাবে আবার রেখে দিয়ে ওপরে মাটিচাপা দিয়ে দিলেন। শুধু তাই নয়; স্ত্রী থেকে ওয়াদা নিলেন, এই তথ্য যাতে কারো কাছে ফাঁস না হয়। কারণ হতে পারে, এর কোনো প্রকৃত মালিক বা হকদার আছে, কিন্তু আমরা জানি না! স্ত্রীও ছিলেন স্বামীর মতো নেককার ও দুনিয়াবিমুখ এক মহিয়সী। দারিদ্র্য ও শত প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তারা কলসিটি রেখেই খালি হাতে বাড়িতে চলে এলেন। শাযারাতুয যাহাব ৫/৪০৬

প্রতিষ্ঠানের সময় হেফাযতে সততা ও আমানতদারি

শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী  রাহ. নিকট অতীতের আমাদের ওসব বুযুর্গদের অন্যতম, প্রত্যেক যুগে যাদের দৃষ্টান্ত নিতান্ত হাতেগোনা। তাঁর রচিত কুরআন মাজীদের অনুবাদ তরজমায়ে শাইখুল হিন্দ অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। এছাড়া উপমহাদেশ ইংরেজ জালেমদের কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পেছনে তাঁর রেশমি রুমাল আন্দোলন, খেলাফত আন্দোলনের মতো বিশেষ অবদান ও ভূমিকা আমাদের ইতিহাসের আলোকোজ্জ্বল অধ্যায়।

তিনি ছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দের প্রথম ছাত্র। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্তির পর জীবনভর তিনি দারুল উলূম দেওবন্দেই শিক্ষকতার মহান খেদমতে রত ছিলেন। অবশেষে তিনি সেখানকার শাইখুল হাদীস-এর পদেও আসীন হয়েছিলেন। নিকট অতীতের অসংখ্য বিখ্যাত মনীষী তাঁর শিষ্যত্ব লাভে ধন্য হয়েছেন।

তিনি যখন শাইখুল হাদীস হিসেবে দারুল উলূমের খেদমতে নিয়োজিত, মাদরাসার মজলিসে শূরা বিশেষভাবে উপলব্ধি করলেন যে, তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, পদ ও ব্যক্তিত্বের বিচারে ওযীফা (মাসিক সম্মানী) একেবারে সামান্য; বরং নাই-এর মতো। এছাড়া দারুল উলূম থেকে প্রদত্ত ভাতা ছাড়া তাঁর আয়ের আর কোনো উৎসও নেই। অথচ প্রয়োজন ও খরচাদি দিন দিন বেড়েই চলেছে! তাই মজলিসে শূরার সম্মতিতে সিদ্ধান্ত হল, তাঁর ওযীফা বাড়ানো হবে! মজলিশে শূরার পক্ষ থেকে এই মর্মে একটি প্রস্তাব গৃহীত হল। কিন্তু ঘটনা যা ঘটার তাই ঘটল। হযরতকে যখন মজলিশে শূরার এই সিদ্ধান্ত শোনানো হল, তিনি খুশি হবেন তো দূরের কথা, একেবারে বিচলিত হয়ে পড়লেন। তৎক্ষণাৎ মজলিসে শূরা বরাবর একটি দরখাস্ত লিখে পাঠালেন। যার সারমর্ম হল

আমি জানতে পেরেছি, দারুল উলূমের পক্ষ থেকে আমার ভাতা বাড়ানো হচ্ছে। বিষয়টি জানতে পেরে আমি অত্যন্ত পেরেশান হয়েছি। কারণ আমার বার্ধক্য এবং অন্যান্য ব্যস্ততার কারণে দারুল উলূমের পক্ষ থেকে আমাকে দরস ও পাঠদানের সময় কমিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ আগে আমার দায়িত্বে দরস ও পাঠদানের জন্য আরো বেশি সময় নির্ধারিত ছিল। সেই হিসেবে ওযীফা বাড়ানো তো দূরের কথা, উচিত তো ছিল মজলিশে শূরার পক্ষ থেকে আমার ওযীফা আরো কমিয়ে দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করা। তাই আমার আবেদন হল, আমার ওযীফা বৃদ্ধির সিদ্ধান্তটি প্রত্যাহার করা হোক এবং পড়ানোর সময় কম হয়েছে বিধায় ওযীফা কম করার ব্যাপারে ভেবে দেখা হোক!

বর্তমান যামানায় যদি কোনো কর্মচারী ব্যবস্থাপনা পরিষদ বরাবর এমন দরখাস্ত পেশ করে, তাহলে প্রবল ধারণা এই হবে যে, এই দরখাস্তের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনা পরিষদকে তিরস্কার করা হয়েছে। দরখাস্তকারীর বেতন যে পরিমাণে বৃদ্ধি করা হয়েছে, তাতে সে সন্তুষ্ট নয়; বরং ব্যবস্থাপনা পরিষদের বিরুদ্ধে তার চরম অভিযোগ এই যে, পরিষদ অতি সামান্য বেতন বৃদ্ধি করে তাকে অপমানিত করেছে। তাই সে ক্ষোভে-দুঃখে তিরস্কারমূলক এই পত্র লিখেছে।

কিন্তু শাইখুল হিন্দ রাহ. যে দরখাস্তটি লিখেছিলেন, তাতে তিরস্কারের লেশমাত্রও ছিল না। বাস্তবিকই তিনি মনে করতেন, তাঁর যেই বেতন বৃদ্ধি হচ্ছে, সেটি নীতিগতভাবে হয়তো তাঁর কাজের তুলনায় তাঁর জন্য গ্রহণ করা বৈধ নয়। কারণ সেই পরিবেশে এমন লোক অনেক ছিলেন, যাঁরা তাঁদের পাঠদানের সময়ের এক একটি মিনিটের হিসাব রাখতেন। তাঁরা মনে করতেন, এটি তাঁদের বিক্রিত সময়, যা অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবে না। [ইসলাম ও আমাদের জীবন (যিক্র ও ফিক্র), পৃ. ৮৩]

সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যারা চাকরি করি, আমাদের জন্য রয়েছে এখানে অনেক শিক্ষা।

এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। মাযাহেরে উলূম সাহারানপুরের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মুহাম্মাদ মাযহার নানুতবী রাহ.-এর ঘটনা। শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রাহ. বলেন, তাঁর সম্পর্কে একটি বিষয় ব্যাপকভাবে প্রসিদ্ধ ছিল। সব সময় নিজের কাছে একটি খাতা রাখতেন। মাদরাসার কর্ম-ঘন্টায় তাঁর নিকট ব্যক্তিগত সাক্ষাতের জন্য কোনো মেহমান এলে তার সঙ্গে যখন কথা শুরু হতো, তিনি ঘড়ির দিকে লক্ষ্য করতেন। মেহমান বিদায় নেওয়ার পর কত মিনিট থেকে কত মিনিট মেহমানের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে, তারিখসহ সেটি খাতায় লিখে রাখতেন। মাসশেষে খাতা খুলে অতিথিদের সঙ্গে ব্যয়িত মিনিটগুলো হিসাব করতেন। সবমিলিয়ে যদি অর্ধদিনের কম হতো, দরখাস্ত দিয়ে তিনি মাদরাসা থেকে অর্ধদিবসের ছুটি মঞ্জুর করাতেন। অর্ধ-দিনের বেশি হলে একদিনের ছুটি মঞ্জুর করাতেন। হাঁ, যারা কোনো ফতোয়া জানার জন্য বা মাদরাসার কোনো কাজে আসতো, তাদের সঙ্গে ব্যয়িত সময়গুলো খাতায় লিখতেন না। আপবীতী খ. ১, পৃ. ৩০

আকাবির আসলাফের জীবনের এমন টুকরো ঘটনাগুলোতে রয়েছে আমাদের জন্য সমূহ শিক্ষার উপকরণ।

শাসকের বাসস্থান যখন খেজুরপাতার ছাউনি

উমর রা.-এর খেলাফতকালে সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন বিশিষ্ট সাহাবী আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা.। সিরিয়ার অধিকাংশ এলাকা তাঁর হাতেই বিজিত হয়েছে। সে যুগের সিরিয়া আর আজকের সিরিয়া এক নয়। বর্তমানের সিরিয়া, জর্দান, ফিলিস্তিন, লেবানন মিলে পুরোটা ছিল সে যুগের সিরিয়া। এ চারটি দেশ মিলে তখন ইসলামী খেলাফতের একটি প্রদেশ ছিল। প্রদেশটি খুব উর্বর ছিল। ছিল অর্থ-সম্পদের ছড়াছড়ি। রোমানদের পছন্দনীয় ও লোভনীয় ভূমি ছিল এটি। আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ রা. ছিলেন এই এলাকার গভর্নর।

খলীফাতুল মুসলিমীন উমর রা. মদীনাতে বসে এ বিশাল ইসলামী সাম্রাজ্য পরিচালনা করতেন। একবার তিনি পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে সিরিয়া গমন করলেন। সেই সুবাদে তিনি একদিন আবু উবাইদা রা.-কে বললেন, ভাই আবু উবাইদা! আমার মন চায়, আমার ভাইয়ের সেই বাড়িটি একটু দেখি, যেখানে তুমি থাক।

উমর রা. ভাবলেন, আবু উবাইদাকে এত বিশাল এলাকার গভর্নর বানানো হয়েছে, সেখানে তো প্রাচুর্যের ছড়াছড়ি, তার ঘরটা কেমন সেটাও একটু দেখা দরকার!

আবু উবাইদা বললেন, আমীরুল মুমিনীন! আপনি আমার বাড়ি দেখে কী করবেন? কারণ আমার বাড়ি দেখার পর আপনার চোখ মোছা ছাড়া আর কিছুই হবে না। তবু উমর রা. পীড়াপীড়ি করলেন। বললেন, আমি দেখতে চাই। অবশেষে হযরত আবু উবাইদা রা. আমীরুল মুমিনীনকে নিয়ে চললেন। যেতে যেতে শহরের পথ অতিক্রম করে তাঁরা অনাবাদি ভূমিতে প্রবেশ করলেন।

উমর রা. বললেন, ভাই! আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?

আবু উবাইদা উত্তর দিলেন, এই তো আর সামান্য পথ। বলতে বলতে একসময় তাঁরা প্রাচুর্যে ভরা দামেশক শহর পেছনে রেখে পৌঁছলেন জনমানবহীন এক প্রান্তরে। আবু উবাইদা রা. সেখানে পৌঁছে একটি ঝুপড়ির দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, আমীরুল মুমিনীন! এই আমার ঘর, আমি এই গৃহে বাস করি।

উমর রা. খেজুরপাতার ছাউনিতে প্রবেশ করে চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখতে পেলেন, একটিমাত্র জায়নামায ছাড়া ঘরে আর কিছুই নেই।

এই দৃশ্য দেখে হযরত উমর রা. বলে উঠলেন, আবু উবাইদা! তুমি এখানেই থাক? থাকা-খাওয়ার আসবাবপত্র বলতে তো কিছুই নেই! তাহলে তুমি এখানে থাক কীভাবে?

আবু উবাইদা উত্তর দিলেন, আমীরুল মুমিনীন, প্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র আলহামদু লিল্লাহ, এখানেই আছে। যে জায়নামাযটি দেখছেন, রাতের বেলা এটাতে দাঁড়িয়েই নামায পড়ি আর ঘুমের সময় হলে এটার ওপরেই শুয়ে পড়ি।

এই বলে তিনি ঝুপড়ির চালের দিকে হাত বাড়িয়ে একটি পাত্র বের করলেন। ঝুপড়ির অভ্যন্তরে অন্ধকারের কারণে পাত্রটি স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল না। পাত্রটি বের করে বললেন, আমীরুল মুমিনীন! এই যে খাবারের পাত্র।

উমর রা. লক্ষ্য করলেন, পাত্রটি পানি দ্বারা ভর্তি। রুটির শুকনো দুটি টুকরো ভিজিয়ে রাখা হয়েছে সেখানে।

তারপর আবু উবাইদা বললেন, আমীরুল মুমিনীন! দিন-রাত তো কাজে ব্যস্ত থাকি, তাই পানাহারের আয়োজন করার ফুরসত পাই না। এক মহিলা একসাথে দুইতিন দিনের রুটি প্রস্তুত করে দেয়, আমি সেগুলো থেকে খাই আর শুকিয়ে গেলে পানিতে ভিজিয়ে রাখি, যেন রাতে ঘুমানোর আগে খেয়ে নিতে পারি। [সিয়ারু আলামিন নুবালা, খ. ৩, পৃ. ১৩; ইসলাহী খুতুবাত ৩/১১৭]

মনীষীদের জীবনের একেকটি ঘটনা আমাদের প্রেরণার উৎস, যার মাধ্যমে লাভ করতে পারি ঈমানি জীবনে সজীবতা। আল্লাহ আমাদের জীবনকে তাকওয়ার সজীবতা দান করুন আমীন। 

 

 

advertisement