শাওয়াল ১৪৪৪   ||   মে ২০২৩

সকল মুসলমানের জন্যে দ্বীনের মৌলিক শিক্ষা অপরিহার্য
শিখতে হবে আলেমদের শরণাপন্ন হয়ে

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

[গত ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ঈ. তারিখে একটি অনলাইন মাদরাসার শিক্ষার্থীদের উদ্দে্যশে দেয়া বক্তব্যের সারাংশ। বয়ান শেষে দীর্ঘ প্রশ্নোত্তর পর্ব চলেযা এখানে পত্রস্থ হয়নি।

বয়ানটি পত্রস্থ করেছেন মাওলানা উসামা বিন আব্দুর রশীদ।]

 

হামদ ও ছানার পর :

আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ফযল ও করম, তাঁর মেহেরবানীতে আমরা একটি ভাচুর্য়াল দ্বীনী মজলিসে একত্রিত হয়েছি। আমি সাধারণত টুটাফাটা যাই করি ঘরে বসেই করি। বাইরে তেমন একটা বের হওয়া হয় না। তবে সকল দ্বীনী কাজ এবং এর সাথে জড়িত ব্যক্তিদের মহব্বত করি। ঢাকা মাণ্ডার মাওলানা যুবায়ের ছাহেবও তাদের একজন। দাওয়াতী কাজকর্ম করছেন বিভিন্ন জায়গায়। তাঁর সাথে আমাদের মহব্বতের সম্পর্ক। দেখা কম হলেও আন্তরিকতা আছে। সে সূত্রেই তিনি দাবি করেছেন এ মজলিসে আপনাদের উদ্দেশে কিছু কথা বলতে। সেজন্য আজকে উপস্থিত হয়েছি। আমরা যারা এই মজলিসে উপস্থিত আছি, যতটুকু জানি তারা এই মজলিস থেকে দ্বীন শেখার চেষ্টা করেন। এটাকে বলা হচ্ছে অনলাইন মাদরাসা।

আমার মুসলিম ভাইয়েরা! (হয়তো বোনেরাও থাকবেন। যেহেতু এটি কোনো ভিডিও প্রোগ্রাম নয়। )

ইসলাম আমাদের দ্বীন। ইসলামের গোড়ার কথাই হল পড়াশোনা। আমরা জানি, আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আমাদের দ্বীনের সূচনা হয়েছে পড়ার কথা দিয়ে। নাযিল হয়েছে إِقْرَأْপ্রথম যখন গারে হেরায় রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর ওহী অবতীর্ণ হয় তখন এ আয়াত নাযিল হয়েছে। এর আগে তিনি জানতেনও না তাঁর কাছে ওহী আসছে। তিনি নবুওত পাচ্ছেন। এমতাবস্থায় তাঁর প্রতি ওহীর সূচনা করা হয়েছে إِقْرَأْ দিয়ে অর্থাৎ, আপনি পড়ুন। এই إِقْرَأْ বা পড়ুনই হল মুসলমানদের দ্বীনের সূচনা।

এখন প্রশ্ন হল, কী পড়বে?

আল্লাহ তাআলাই বলে দিয়েছেন

بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِيْ خَلَقَ.

যে রব সৃষ্টি করেছেন তাঁর নামে পড়ুন।

তো আমাদের দ্বীন ইসলামের শুরুই হল পড়ার কথা দিয়ে। আল্লাহর নামে পড়ার কথা দিয়ে।

সূরা আররহমানের নাম আমরা সবাই জানি। নিজেরা পড়ি। রমযান মাসে তারাবীহতেও শুনি। এ সূরার মধ্যে বারবার

فَبِاَيِّ اٰلَآءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبٰنِ.

আয়াতটি রয়েছে। সূরাটি শুরু হয়েছে اَلرَّحْمٰنُ (আর রহমান) শব্দ দিয়ে। আমরা যেহেতু কুরআন পড়ি আররহমান শব্দের সাথে আমরা সকলেই পরিচিত। বিসমিল্লাহ ও সূরা ফাতেহার শুরুতেই আররহমান শব্দটি রয়েছে।

আররহমান আল্লাহ তাআলার সবচেয়ে বড় ও শ্রেষ্ঠ গুণবাচক নাম। সবাই কমবেশি এর অর্থ জানি তিনি দয়ালু। আসলে এর যথাযথ কোনো বাংলা অর্থ হয় না। কুরআনে কারীমে এবং দ্বীনে ইসলামে কিছু শব্দ আছে, যেগুলোর কোনোরকম ভাবানুবাদ তো করা যায়, কিন্তু পরিপূর্ণ অর্থ করা সম্ভব হয় না। আমরা যারা মাদরাসায় পড়ি বা আরবী ব্যাকরণের সাথে পরিচিত, তারা জানি, মুবালাগাহ বা সিফাতে মুশাব্বাহার মানে হল, কোনো গুণ বড় করে বুঝানো। কিন্তু কিছু কিছু শব্দ আছে, যেগুলোর বড়ত্বের পরিধি মানুষের ভাবনার চেয়েও বেশি। 

যেমন, আমরা বললাম, দয়ালু। আপনি এখানে দয়ার আধিক্য বোঝানোর জন্য কী যোগ করবেন? অতি দয়ালু, অনেক দয়ালু, বেশি দয়ালু! পরিপূর্ণ অর্থ আদায় হয়নি!

আররহীম শব্দের অর্থ এর চেয়েও বেশি। আররহমান-এর অর্থ তো তার চেয়েও  অনেক বেশি। এজন্য এ ব্যাপারে উলামায়ে কেরাম একমত যে, আররহমান শব্দটি এমন বেশি দয়ার কথা বুঝায়, যেটা আল্লাহ তাআলা ছাড়া অন্য কারো দ্বারা সম্ভব নয়। এজন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নাম রহমান রাখা নিষেধ। আব্দুর রহমান নাম রাখা যাবে। রহমানের বান্দা, রহমানের গোলাম এটা বলা যাবে, কিন্তু রহমান বলা যাবে না। কারণ আল্লাহ তাআলা ছাড়া কেউ রহমান হতে পারে না।

তো আল্লাহ তাআলা সূরা আররহমান শুরু করলেন اَلرَّحْمٰنُ (আররহমান) শব্দ দিয়ে। اَلرَّحْمٰنُ তথা অনেক অনেক অ-নে-ক বেশি দয়ালু আল্লাহ। এটা বলার পরে আল্লাহ তাআলা বললেন

عَلَّمَ الْقُرْاٰنَ.

তিনি মানুষকে কুরআন শিখিয়েছেন।

এরপরে বলেছেন

خَلَقَ الْاِنْسَانَ.

অর্থাৎ তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। এখন কথা হল, আল্লাহ তাআলা তো আগে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তারও অনেক পরে শেষ নবীর উপর কুরআন নাযিল করেছেন। তাহলে আল্লাহ তাআলা কেন আগে বললেন, কুরআন শিখিয়েছেন এরপরে বললেন, মানুষকে সৃষ্টি করেছেন?

এর রহস্য উদ্ঘাটনে বিভিন্ন মুফাসসির চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, আল্লাহ তাআলা তো অনেক অনেক বড় দয়ালু। মানুষের উপরে তাঁর দয়ার সবচেয়ে বড় বহিঃপ্রকাশ হল, আলকুরআন। মানুষকে কুরআন  শেখানো। কুরআন হল, আল্লাহ তাআলার দয়ার সবচেয়ে বড় বহিঃপ্রকাশ। কুরআন আল্লাহর কালাম। আমাদের দ্বীন। আমাদের ইসলামের ভিত্তি। আমাদের রব, আমাদের সৃষ্টিকর্তা, যার ইহসান ছাড়া আমি আপনি কারো জন্যই এক মুহূর্ত টিকে থাকার সুযোগ নেই সে রবের কালাম ও বাণী।

তো আমাদের ইসলাম শুরু হয় কুরআনে কারীম থেকে। ইসলাম শুরু হয় পড়া থেকে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ ও আফসোসের বিষয় হচ্ছে, এত কম পড়ুয়া, দ্বীন সম্পর্কে এত কম জানা এবং এত উদাসীন মুসলমান অতীতে কখনো যায়নি। আমরা নামের মুসলমান থেকে যাচ্ছি। যত দিন যাচ্ছে আমরা অনেকেই কেন যেন অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মতো হয়ে যাচ্ছি, যারা শুধু পাসপোর্টে বা জাতীয় পরিচয়পত্রে ধর্মের নাম ব্যবহার করে।

এটা কীভাবে হল? কীভাবে আমাদের এ অধঃপতন ঘটল? আপনারা যেহেতু দ্বীনী পড়াশোনা করছেন, ইতিহাস কমবেশি আপনাদের জানার কথা। মুসলমানদের অবস্থা কিন্তু কোনো যুগেই এমন ছিল না। হাজার বছরেরও বেশি সময়  এমন মুসলমান খুঁজে পাওয়া কঠিন ছিল, যার দ্বীনের মৌলিক পড়াশোনা ও জ্ঞান নেই। মুসলমানদের হাত থেকে শাসনব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থা চলে যাওয়ার পর মা-বাবা, দাদা-দাদি, নানা-নানীরা তাদের সন্তানাদি, নাতী-নাতনীদের জীবনের প্রথম শিক্ষা ইসলামের শিক্ষাই দেওয়ার চেষ্টা করতেন। যে যে বিষয়েই  পড়াশোনা করুক অথবা কেউ মাঝপথে পড়াশোনা শেষ করে দিক কিংবা প্রাইমারির গণ্ডি পার না করুক, কিন্তু কুরআনে কারীমের কিছু সূরা, জীবন চলার জন্য কিছু মাসআলা-মাসায়েল এবং মৌলিক কিছু বিষয় শেখা হয়ে যেত।

বিয়ের সময় মেয়ে পার্থিব পড়াশোনা কতটুকু করেছে জিজ্ঞাসা করার আগে কুরআন কতটুকু পড়েছে তা জানতে চাওয়া হত। এটা ছিল প্রথম জিজ্ঞাসা। আজকের মুসলিম সমাজ এসকল সোনালী ঐতিহ্য ভুলে গিয়েছে। ফলে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক।

এসব পরিস্থিতি সামনে রেখে এই যে পড়াশোনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, কিছু পড়াশোনার চেষ্টা হচ্ছে এটা ভালো লাগার বিষয়। এটা আমাদেরকে আনন্দ দেয়। মুসলমানেরা নিজ নিজ পেশায় থেকে দ্বীন শেখার চেষ্টা করছেন, কিছু সময় বের করছেন দ্বীন শেখার জন্য এটা আশাব্যঞ্জক এবং মোবারকবাদ পাওয়ার যোগ্য।

আমরা জানি, ইসলাম কোনো শর্টকার্ট জিনিসের নাম নয়। এক কথায় বলে দেয়া যায় এমন জিনিস নয়। বরং আমাদের জীবনের সকল স্তর, ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর থেকে আবার ঘুমানো পর্যন্ত পুরো সময়ে জীবনে আমরা যত ধরনের অবস্থার সম্মুখীন হই; আমাদের ঘরোয়া জীবন, লেনদেন, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সাথে সাথে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল স্তরের জন্য কুরআনে কারীম ও রাসূলের সুন্নাহ্য় মৌলিক নির্দেশনা দেওয়া আছে। আমাদের যে বিশাল ফিকহের ভাণ্ডার আছে সেখানে একেবারে ছোট ছোট বিষয়ের সমাধানও দেওয়া আছে।

বাংলাদেশের কিছু কিছু জায়গায় সর্বস্তরের মানুষের দ্বীন শিক্ষার যে আয়োজন রয়েছে তালীমুদ্দীন একাডেমি নামে (সেটা অবশ্য অফলাইনে, অনলাইনে নয়) সেটার তিনটি শাখায় গত মাসে দুয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে  আমার যাওয়া হয়েছে। সেখানে জেনারেল শিক্ষিত, কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী সমাজ এবং সব শ্রেণির মুসলমানেরা ছিলেন। তাদের অনেকেই দীর্ঘদিন থেকে এসব জায়গায় পড়ছেন। যেহেতু তারা অনেক দিন থেকেই পড়াশোনার সাথে লেগে আছেন তাই তাদেরকে আমরা জানতে চেষ্টা করেছি, বুঝতে চেষ্টা করেছি। আমি জিজ্ঞাসা করেছি, আচ্ছা আপনারা দ্বীনের কিছু কিছু মৌলিক কথাবার্তা তো ইতিমধ্যেই জেনে গেছেন, কুরআন মাজীদও অনেকের শেখা হয়ে গেছে; তো আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন, দ্বীনের যে নির্দেশনাগুলো আমরা পাচ্ছি, দ্বীন সম্পর্কে যে মোটা মোটা কথাগুলো ইতিমধ্যেই শিখেছি সেগুলোর উপর আমরা আমল করে চললে, এগুলো পালনের ব্যাপারে আমরা সচেতন হলে আমরা কি শুধু আখেরাতেই সওয়াব পাব, জান্নাত পাব, না দুনিয়াতেও এর কোনো লাভ আছে?

এটা আমার জন্য খুশির বিষয় ছিল যে, এই জেনারেল শিক্ষিত ভাইয়েরাই বলেছেন, দুনিয়াতেও এর লাভ আছে।

তাঁদের উত্তরে আমি বুঝতে পেরেছি, তাঁরা বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরেছেন। কোনো কোনো বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছি, ব্যাখ্যা দিয়েছি। আমি বিষয়টি আরো বিস্তারিতভাবে বুঝাতে চেষ্টা করেছি। 

কেউ কেউ মনে করে, দ্বীনী বিষয়ে না জানা ভালো, জানলে আরো ঝামেলা বাড়ে।

জানলে ঝামেলা বাড়ে না। দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলো যদি আমরা জেনে যাই, যদি আমরা দ্বীনের উপর চলি, যতটুকু জেনেছি তার উপর আমল করি, তাহলে এর সুফল আমরা দুনিয়াতেও পাব ইনশাআল্লাহ।

লেনদেনের ক্ষেত্রে আমরা ব্যবসা-বাণিজ্যের শরয়ী নিয়মনীতি মেনে চললে, সে অনুযায়ী বাজার চলা শুরু করলে দেখা যাবে, বাজার থেকে অনেক জুলুমই কমে গেছে। রাষ্ট্র ঠিক না হলেও বাজার পর্যায়ের ব্যক্তিরা ঠিক হয়ে গেলে অনেক প্রতারণা, অনেক জুলুম থেমে যাবে। ক্রেতা বিক্রেতাকে ঠকানো, বিক্রেতা ক্রেতাকে ঠকানো অনেক অংশেই বন্ধ হয়ে যাবে।

আমরা যদি ঘরোয়া জীবনে ইসলাম মানতে শুরু করি, স্বামী যদি স্ত্রীর হক আদায় শুরু করে, স্ত্রী যদি স্বামীর হক আদায় শুরু করে তাহলে তালাকের প্রবণতা কমে যাবে। সংসারে ঝগড়া-বিবাদ কমে যাবে। ঘরের মধ্যে শান্তি বিরাজ করবে। মা-বাবা সন্তানের হক আদায় করলে, সন্তান মা-বাবার হক আদায় করলে, ইসলাম পারস্পরিক যে হক নির্ধারণ করে দিয়েছে সেগুলো জানলে, সে অনুযায়ী আমল করলে ঘরের মধ্যে কোনো ধরনের অশান্তি হবে না।

এখন মুসলমানদের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাধি ক্রমেই বাড়ছে। আত্মহত্যার কথা শোনা যায়, পারস্পরিক ঝগড়া-বিবাদের কথা শোনা যায়, এসবই দুঃখজনক। বিবাহ বিচ্ছেদসহ বিজাতীয় চর্চাগুলো আমাদের মধ্যে বেড়ে গেছে। কারণ আমরা দ্বীন ও শরীয়ত সম্পর্কে উদাসীন। আমরা পারস্পরিক হক, আত্মীয়র হক, আপনজনের হক সম্পর্কে অনবগত অথবা জেনেও আমল করি না। এজন্য আস্তে আস্তে অন্যদের মতো হয়ে যাচ্ছি। আমাদের শুধু উপরেই জৌলুস। আমরা বাতির উজ্জ্বল আলোতে থাকি। কথিত বিনোদনের মাঝেও হয়তো কিছুক্ষণ নিমগ্ন থেকে নিজেদেরকে আনন্দ দিতে চেষ্টা করি, কিন্তু সবকিছুর পরে আবার সে কষ্টের মধ্যেই ডুবে যাই। জীবনে শান্তির দেখা আমরা আর পাই না।

কেন পাই না? না পাওয়ার মূল কারণ একটাই সেটা হল, আমরা আমাদের দ্বীন, আমাদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত বিধিবিধান প্রথমত আমরা জানতে চেষ্টা করি না, জানলেও মানতে চেষ্টা করি না।

যে কথার জন্য আমি তালীমুদ্দীন একাডেমির কথা বললাম সেটা হল, মুসলমান ভাইয়েরা বুঝতে পারছেন যখনই আমরা দ্বীন সম্পর্কে জানব, বুঝব এবং আমল করব তখনই  সমাজের অনেক সমস্যা ক্রমেই কমে যেতে দেখব।

সে সপ্তাহে আমি তালীমুদ্দীন একাডেমি সিলেটেও কথা বলেছিলাম। আমি অল্প কিছু সময় কথা বলেছি। এর মধ্যে জজকোর্টের একজন সিনিয়র উকিল প্রবেশ করলেন। তিনি আলেমদের সাথে মহব্বত রাখেন। তাঁকে দেখে একটি কথা মনে পড়ল। উপস্থিত লোকদের উদ্দেশে বললাম, উকিল সাহেব এসেছেন, এখন আরেকটি উদাহরণ বুঝুন। যারা আইন-আদালত সম্পর্কে খোঁজ-খবর রাখি তারা জানি, আমাদের দেশের কোর্টগুলোতে লক্ষ লক্ষ মামলা ঝুলে আছে। সিভিল কোর্টগুলোতে লক্ষ লক্ষ দেওয়ানি মামলা ঝুলছে। একথা মশহুর আছে, জামি-জমা নিয়ে মামলা করলে তৃতীয় প্রজন্ম হয়তো চূড়ান্ত ফয়সালা দেখে যেতে পারে। কেন এই লক্ষ লক্ষ মামলা ঝুলে আছে?!

এর অন্যতম কারণ হল, আমরা ইসলামের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজেদের জীবন পরিচালিত করি না। প্রতিবেশীরা ইসলামের নির্দেশনা মেনে চললে মামলা দেওয়ার মতো পরিস্থিতিই তৈরি হত না। অতি দুষ্ট লোক বা সমাজের সবচেয়ে খারাপ লোকেরা হয়তো মামলা দিত, অথবা তাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার প্রয়োজন হত। তাও অতি দ্রুত নিষ্পত্তি হয়ে যেত। তৃতীয় প্রজন্ম কেন? আবেদনকারীই কয়েক মাসের মধ্যে মামলার ফয়সালা পেয়ে যেত।

আপনি ইসলামের হাজার বছরের ইতিহাস দেখেন। বিচারব্যবস্থা, বিচারকদের ইতিহাস এবং বিচারকরা যে ফয়সালা করেছেন, রায় দিয়েছেন সেগুলোর তথ্যভাণ্ডার সংকলিত আছে। সেখানে দেখুন কয়টা মামলা হয়েছিল আর কয়টা ঝুলে ছিল? তখন খুবই কম মামলা হত। কেন? এজন্য যে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলায় মামলা করার মতো পরিস্থিতি কম তৈরি হত। মানুষ সুন্দর পরিবেশে থাকত। পাড়া-পড়শি একে-অন্যের ব্যাপারে নিরাপত্তা বোধ করত এবং আশ্বস্ত থাকত। আমরা নিজেদের দ্বীন থেকে সরে গিয়ে সে সোনালী ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছি।

কথা আর দীর্ঘ করছি না। আপনাদের উস্তায মাওলানা যুবায়ের ছাহেব যখন অনলাইন মাদরাসায় কথা বলতে অনুরোধ করলেন তখন আমি বললাম, আমাকে ওখানে নিয়েন না। আমাকে নিলে ঝামেলা বাড়বে।

তিনি বললেন, হুজুর! আপনার যা মনে চায় তাই বলবেন।

আমি বললাম, আমি তো অনলাইনে পড়াশোনার বিরুদ্ধে বলব।

তিনি বললেন, আপনি সেটাই বলবেন। কোনো সমস্যা নেই।

যে কথাটা বলব বলে আমি তাকে বলেছিলাম সেটা এখন আপনাদের বলছি। অনলাইনে আমরা যে দ্বীন শেখার চেষ্টা করছি তা ঠেকার কাজ চালানোর মতো। বিষয়টা এমন যে, না হওয়ার চেয়ে অল্প কিছু হওয়াও ভালো। দ্বীন শেখার জন্য কিন্তু আমাদেরকে সরাসরি মাধ্যম অবলম্বন করতে হবে। সরাসরি আলেমদের কাছে যেতে হবে। তাঁদের সাহচর্য লাগবে। দেখুন কুরআন নাযিল হওয়া শুরুর পর মক্কার তৎকালীন কাফেররা বলেছিল

وَ قَالَ الَّذِيْنَ کَفَرُوْا لَوْلَا نُزِّلَ عَلَيْهِ الْقُرْاٰنُ جُمْلَةً  وَّاحِدَةً.

কাফেররা বলে, তার প্রতি সম্পূর্ণ কুরআন একবারেই নাযিল করা হল না কেন? সূরা ফুরকান (৩২) : ২৫

এই কুরআন পুরোটা একত্রে নাযিল হয়ে গেলে, ঘরে ঘরে এক কপি করে কুরআন পৌঁছে দেওয়া হলে তো আমাদের মধ্যে কম টাকা। পয়সাওয়ালা মুহাম্মাদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কাছে যেতে হত না। তার কাছে গরীব লোকেরা আসে। ওখানে যেতে হবে। এর চেয়ে কি ভালো ছিল না আমাদের ঘরে ঘরে এক কপি করে কুরআন দিয়ে গেলে?!

আল্লাহ তাআলা চাইলেই তো পারতেন। কিন্তু আল্লাহ তাআলা তাদের এই অযৌক্তিক দাবি প্রত্যাখান করেছেন। তারা তো জানে না, কেন কুরআন রাসূলের মাধ্যমে এল। আল্লাহ তাআলা কেন হেদায়েত রাসূলের মাধ্যমে দিলেন। এরপরে সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, আতবায়ে তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন, সালাফ-খালাফ আমরা যাঁদের মাধ্যমে দ্বীন পেয়েছি সর্বযুগেই কিন্তু উলামায়ে কেরামের মাধ্যমেই আমাদের কাছে এসেছে। দ্বীনের জন্য কে কত কষ্ট করেছেন?! আপনাদের উস্তাযদেরকে জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা বলবেন।

আমরা যে হাদীসের কিতাবগুলো পাই; এর মধ্যে প্রসিদ্ধ কিতাব যেমন, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম এমন আরো অনেক কিতাবের সংকলকের বাড়িই মধ্য এশিয়ায়। আফগানিস্তান, ইরানের ওপারে, রাশিয়ার আশেপাশে। তারা আরব থেকে এত দূরের হওয়া সত্ত্বেও সহীহ হাদীস নির্বাচন ও সংকলন করে আমাদের জন্য রেখে গেছেন। এসব হাদীসের বর্ণনাকারীরা কোন্ এলাকার? সনদের উপরের দিকে তাকালে দেখা যায়, বেশিরভাগ বর্ণনাকারীই হিজায, কুফা, ইরাক, সৌদি আরবের অধিবাসী।

এই যে তারা পায়ে হেঁটে, উটে চড়ে শত শত মাইল সফর করে, কত কষ্ট সহ্য করে, আমাদের জন্য হাজার হাজার হাদীস সংকলন করেছেন এটা ইসলামের ইতিহাসে সামান্য একটা নমুনা যে, বড় বড় ইমাম ইলমের জন্য কত কষ্ট করেছেন।

এমন নজির পেশ করা কঠিন। কিন্তু আমরা যারা এভাবে দ্বীন শিখছি, আপনারা যে শিখছেন, সেটার প্রতি সম্মান জানিয়েই আমি বলতে চাই, অনলাইনে যতটুকু শিখছি ততটুকুতেই ক্ষ্যান্ত হওয়া উচিত নয়; বরং আলেমদের কাছে যাওয়া, তাঁদের কাছে গিয়ে দ্বীনের বিষয়গুলো বুঝতে চেষ্টা করা। দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলো তাদের থেকে সরাসরি নিতে চেষ্টা করা। যেটা আমরা অনলাইন থেকে শিখলাম সেটাও যথাযথ শিখলাম কি না সেটা যাচাই করা। কারণ অনলাইনের শেখা হচ্ছে একতরফা শেখা। আমি বলে যাচ্ছি, আপনি শুনে যাচ্ছেন। কোনো সময় হয়তো আপনি শুনিয়েও দিচ্ছেন উস্তাযকে। কিন্তু আসলে সেটা কতটুকু হচ্ছে?

আমাদের মাঝে প্রযুক্তি অন্তরায় হয়ে যাচ্ছে। যেহেতু আমরা একধাপ এগুতে পেরেছি; অনলাইনে পড়া শুরু করেছি, আস্তে আস্তে আলেমদের কাছেও যাতায়াত শুরু করি। তাঁদের কাছ থেকে সরাসরিও শিখতে চেষ্টা করি।

আপনাদের অনেক অনেক শুকরিয়া। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলো পড়ার, বোঝার এবং সে অনুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুন।

মনে রাখা দরকার, মুসলমানরা যদি তাদের শৌর্য-বীর্যে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে চায় তাহলে এর পূর্বশর্তই হল ইসলামী সমাজব্যবস্থায় ফিরে আসা। ইসলামকে আঁকড়ে ধরা। ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোর উপর আমল শুরু করলে সমাজে পরিবর্তন আসতে সময় লাগবে না ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলাই তাওফীকদাতা। 

 

 

advertisement