মুহাররাম ১৪৩২   ||   ডিসেম্বর ২০১০

বাবরি মসজিদ

সাইয়েদ সাবাহুদ্দীন আবদুর রহমান

[সাইয়েদ সাবাহুদ্দীন আবদুর রহমান সংকলিত বাবরী মসজিদ তারীখী পাস্‌-মানযার আওর পেশ-মানযার কী রৌশনী মেঁকিতাবের ধারাবাহিক অনুবাদ। অনুবাদে : মুহাম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ]

ফয়েজাবাদকে মনে করা হত মুসলিম-নগরী। কারণ কিছু দিন তা ছিল আওয়াধের নবাবদের রাজধানী। এই ফয়েজাবাদেরই একটি অংশের নাম অযোধ্যা। এর সাথেও রয়েছে মুসলমানদের ভক্তি ও ভালবাসার সম্পর্ক। ধারণা করা হয় যে, হযরত আদম আ.-এর পুত্র শীছ আ.-এর কবর এখানে আছে এবং চারপাশে আছে আরো বহু বুযুর্গানে দ্বীনের কবর। তদ্রূপ হযরত নূহ আ., হিন্দ ইবনে নূহ ও হযরত আয়্যূব আ.-এর কবরও এখানে আছে বলে মনে করা হয়। আল্লাহই ভালো জানেন।

এছাড়া অযোধ্যার মাটিতে আছে বখশী বাবা রাহ., লালশাহ বায কলন্‌দর রাহ., জঙ্গি শহীদ রাহ., ইলাহী বখশ মাজযূব রাহ., আলম বখশ রাহ., শাহ মাদার রাহ., সাইয়েদ জালালুদ্দীন খোরাসানী রাহ., শাহ ছামান ফরিয়াদরাছ রাহ., হযরত জামালুদ্দীন শাহ ইবরাহীম রাহ., শাহ চপ রাহ., কাযী কুদওয়াহ রাহ., সুলতান মূসা আশেকান রাহ., শাহ আলী আকবর মীর কুশাবী রাহ., বাহাদুর শাহ, মকন শাহ রাহ., কুতুব শাহ, শাহ বদীউদ্দীন রাহ., হযরত জালালুদ্দীন রাহ. এবং হযরত সাইয়েদ সালার মাসউদ গাযী রাহ.-এর শহীদ মুজাহিদদের কবর। এ অঞ্চলের মুসলিম বাসিন্দারা ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে এসব স্থানের রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকেন।

এখানে আছে সুন্দর সুন্দর মসজিদ। স্বর্গদুয়ারী মসজিদ তো এত উঁচু যে, কয়েক মাইল দূর থেকেও চোখে পড়ে।

খাজা নিজামুদ্দীন আওলিয়া রাহ.-এর মশহূর খলীফা নাছীরুদ্দীন চেরাগ আওয়াধী ছুম্মা দেহলভী রাহ.-এর খানদান এখানে আবাদ হয়েছেন। ১৮৮১ সালের এপ্রিল গেজেটিয়ারে ডব্লুডব্লু হান্টার অযোধ্যা সম্পর্কে লিখেছিলেন যে, ‘এখানে ছত্রিশটি মসজিদ রয়েছে।

এই শহর বৌদ্ধ-ধর্মেরও বড় কেন্দ্র ছিল। এক বর্ণনা মতে, গৌতম বুদ্ধ এখানে নয় বা উনিশ বছর অবস্থান করেছেন। একসময় এখানে বিশটি মঠ ও তিন হাজার ভিক্ষুর বসবাস ছিল। এখন সেসবের চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট নেই।

এটি জৈনধর্মেরও পাঁচজন গুরুর জন্মভূমি। তারা এখানে বসবাস করেছেন। তাদের মন্দিরও এখানে ছিল।

আর হিন্দুদের কাছে তো এটি তীর্থস্থান। কারণ, হিন্দুধর্মে কিংবদন্তী আছে যে, রামচন্দ্রজী এখানেই জন্মগ্রহণ করেছেন এবং রাজত্ব করেছেন। মৃত্যুর পর এখানেই তার দাহ হয়েছে।

সম্ভবত এটি অযোধ্যার মাটির বৈশিষ্ট যে, প্রাচীন কাল থেকেই তা ছিল সর্বধর্মের আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের বিচরণকেন্দ্র। এটি এ ভূখণ্ডের একটি ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য, যা অক্ষুণ্ন রাখা অতি জরুরি। বিশেষ কোনো ধর্মের একাধিপত্যের মাধ্যমে এই বৈশিষ্ট্য বিলুপ্ত করে দেওয়া সমীচীন হবে না।

এই বৈচিত্রের কারণেই মঠ ও মন্দিরের মতো এখানে নির্মিত হয়েছে অনেক মসজিদ। বাবরি মসজিদ তার একটি। ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক স্বার্থে একে বিতর্কের বিষয়ে পরিণত করেছে।

মাঝে দীর্ঘদিন এ নিয়ে তেমন উচ্যবাচ্য ছিল না, ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে হঠাৎ করেই উত্তেজনা দেখা দেয়। বর্তমান লেখক এ বিষয়ে মাআরিফের পাঁচ সংখ্যায় শাযারাতলিখেছি, যা গোটা হিন্দুস্তানে আগ্রহের সাথে পঠিত হয়েছে। পাঠকবৃন্দ লেখাগুলি পুসি-কা আকারে প্রকাশেরও অনুরোধ করেছেন। ইতিমধ্যে আরো কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তাই বিষয়টির পুনঃঅধ্যয়নের পর নির্ভরযোগ্য ও প্রাসঙ্গিক তথ্যাবলি একজায়গায় সংকলিত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়েছে, যাতে বিষয়টি বোঝা সহজ হয় এবং প্রচলিত ভুল ধারণাগুলিরও অবসান ঘটে। বর্তমান পুসি-কাটি এই চিন্তার ফলাফল, যা এখন পাঠকের হাতে রয়েছে।

১৯৪৭-এর আগে পাকিস্তান-আন্দোলনের সমর্থকরা দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রচার করেন এবং এরই ভিত্তিতে ভারতবর্ষ দুই ভাগ হয়। সাতচল্লিশের পর জাতীয় ঐক্য ও  সমপ্রীতি এবং অভিন্ন জাতীয়তার ধারণা জোরেসোরে প্রচার করা হয়েছে এবং এর কিছু সুফলও পরিলক্ষিত হয়েছে। ৪৭ থেকে এ পর্যন্ত অনেক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা সংঘটিত হলেও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক অটুট ছিল। সম্ভবত মুসলিম-সমপ্রদায়ের অবমাননার হীন উদ্দেশ্যে এক কট্টর হিন্দুর পক্ষ থেকে কলকাতা হাইকোর্টে কুরআন মজীদের মুদ্রণ ও প্রচার নিষিদ্ধ করার জন্য একটি রিট আবেদন দায়ের করা হয়। তখন প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের অসামান্য সহানুভূতি ও আইনী পদক্ষেপের কারণে তা আর অগ্রসর হতে পারেনি, যার কারণে মুসলিম জনগণ উভয় সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ হয়েছেন। তদ্রূপ শাহবানু মামলায় মুসলিম তালাকপ্রাপ্তা মহিলার ভরণ-পোষণের বিষয়ে যখন সুপ্রিম কোর্ট কুরআনবিরোধী রায় দিয়েছিল তখন মুসলমানদের ব্যাপক গণঅসন্তোষও প্রশমিত হয়েছিল পার্লামেন্টে এ সংক্রান্ত বিল পাস হওয়ার পর। কিন্তু বাবরি মসজিদকে রাম-মন্দিরে পরিণত করার বিষয়ে ছিয়াশির ফেব্রুয়ারিতে আদালত প্রদত্ত রায় এবং এর প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি  প্রমাণ করে যে, সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি ও অভিন্ন জাতীয়তার যে পাঠ এতদিন উভয় সমপ্রদায়কে দেওয়া হয়েছে তা বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে।

তবে আনন্দের বিষয় এই যে, এ সময় কিছু হিন্দু লেখক-বুদ্ধিজীবী বাবরি মসজিদ ও রাম-জন্মভূমি সম্পর্কে সারগর্ভ আলোচনা করেছেন এবং সামপ্রদায়িক গোষ্ঠীকে শান্তভাবে বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত উত্তরপ্রদেশের মন্ত্রী পণ্ডিত লোকপতি ত্রিপাঠির দীর্ঘ বিবৃতি এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাঁর বক্তব্যের কোনো কোনো অংশের সাথে দ্বিমতের অবকাশ থাকলেও অনেক কথাই গভীর মনোযোগের দাবিদার। যেমন, তিনি বলেছেন, ‘বর্তমানে (প্রাচীন) অযোধ্যার কোনো অস্তিত্বই নেই। তুলশি দাসের রামায়ণে বলা হয়েছে, অযোধ্যা ... ডুবে গিয়েছিল। আজকের অযোধ্যা আওয়াধের নবাবদের প্রতিষ্ঠিত।

তিনি আরো বলেছেন, ‘রাম-জন্মভূমির আন্দোলন শুরু হয়েছে আমেরিকাতে। এই আন্দোলনের কারণে রথযাত্রা বের করা হয়েছে। আমি শতভাগ নিশ্চিত যে, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতি ঘটানোর জন্য অযোধ্যায় সিআইএর এজেন্টরা তৎপর।

তিনি আরো বলেন, ‘সকল উসকানী ও নির্যাতনের মুখেও ভারতের মুসলমানরা গভীর বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রেখেছেন।  যারা ভারতবর্ষের সর্বত্র হিন্দু সামপ্রদায়িকতা ও হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ছড়িয়ে দিতে চায় তাদের এজেন্টরা  মুসলমানদের মধ্যেও ঢুকে পড়েছে।’’

পাটনার একটি হিন্দি সাপ্তাহিকের ... এক প্রবন্ধে দেখানো হয়েছে যে, অযোধ্যার হিন্দু-মুসলিম অধিবাসীদের মাঝে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টির লক্ষ্যেই ইংরেজরা বাবরি মসজিদ ও রাম জন্মভূমির বিতর্ক জন্ম দিয়েছে। প্রবন্ধকার হুমায়ুনকে লিখিত বাবরের (ঐতিহাসিক) অসিয়তনামাটিও উদ্ধৃত করেছেন। বর্তমান পুস্তিকায় আমরা তা নকল করেছি। প্রবন্ধকার লিখেছেন যে, এই অসিয়তনামার নকল জাতীয় সংগ্রহ শালায় সংরক্ষিত আছে। প্রবন্ধকার আরো লেখেন, ‘হুমায়ুন তার পিতার আদেশে বেনারসের জগন্নাথ মঠকে মির্জাপুর জেলায় তেরোশ একর জমি দান করেছিলেন। ঐ হুকুমনামাটি এখনো জগন্নাথ মঠের (গ্রন্থশালায়) সংরক্ষিত আছে।

দিল্লীর ডক্টর আর এল শাকলা ও  প্রাবন্ধিক চিত্তানন্দ দাশ গুপ্তের এ বিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধও এই পুস্তিকায় উদ্ধৃত হয়েছে।

গত জুনে (১৯৮৬ ঈ.) ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার নয়াদিল্লীতে হিন্দু-মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের একটি কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। বাবরি মসজিদ ইস্যুতে আলোচনা ও মতবিনিময়ের পর এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, সর্বশ্রেণীর জনগণ সব ধরনের দাঙ্গা-হাঙ্গামা থেকে বিরত থাকবেন, উদার মনোভাব ও উন্নত দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিবেন এবং বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার সাথে পরিস্থিতির মোকাবেলা করবেন। দেশে এমন একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির অবকাঠামো প্রতিষ্ঠার জন্য সবাই অঙ্গিকারাবদ্ধ হবেন, যেখানে সমাজের কোনো অংশ নিজেদেরকে অনিরাপদ বা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মনে করবে না এবং যেখানে সত্যিকার অর্থেই সাম্য ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত থাকবে।

আমরাও মুসলমানদের পক্ষ থেকে বলতে পারি যে, রাম-মন্দির ভেঙ্গে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে প্রমাণ হলে সে মসজিদ ভেঙ্গে দিতে কোনো আপত্তি নেই; বরং জবরদখলকৃত জমির উপর নির্মিত মসজিদ ভেঙ্গে দেওয়াই কর্তব্য। তাতে নামায পড়ার ফতোয়া কোনো ফকীহ বা আলেম দিতে পারেন না। তবে প্রমাণ করার জন্য নির্ভরযোগ্য ও সমসাময়িক সূত্রের উদ্ধৃতি লাগবে। ইংরেজ-আমলের গেজেটিয়ার, প্রত্নতাত্বিক রিপোর্ট কিংবা নিছক জনশ্রুতি এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তদ্রূপ মুসলমানদের ঐসব বই-পুস্তক ও প্রবন্ধ-নিবন্ধও গ্রহণযোগ্য নয়, যা দাঙ্গা-হাঙ্গামার সংঘাতপূর্ণ পরিবেশে কিংবা ইংরেজদের মুসলিম-বিরোধী প্রচারণার পর লিপিবদ্ধ হয়েছে। ইংরেজরা মুসলিম-বিদ্বেষ তৈরির জন্য অবিরাম এই প্রপাগাণ্ডা করেছে যে, মুসলমানরা যেখানেই যায় ভিন্ন ধর্মের উপাসনালয় ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়। গোড়া থেকে এটাই তাদের ধর্মীয় নীতি।

অথচ এই কথাগুলি লেখার সময় ঐ ইংরেজ লেখকরা ভুলে গিয়েছিলেন যে, খৃস্টবাদের ইতিহাস অন্য ধর্মের উপাসনালয়; বিশেষত মুসলমানদের মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় পরিপূর্ণ। মুসলমানরা দুশো বছর সিসিলি শাসন করেছেন, এরপর শাসনক্ষমতা খৃস্টানদের হাতে যাওয়ার পর মুসলমানদের অসংখ্য মসজিদ ও ইমারত কীভাবে ধ্বংস করা হয়েছে তা একজন খৃস্টান ঐতিহাসিকের মুখ থেকেই শুনুন। এসবি.স্কট অত্যন্ত দুঃখ করে বলেছেন যে, সিসিলিতে মুসলমানদের ছিল অসংখ্য মসজিদ ও ইমারত। অপূর্ব নির্মাণশৈলী ও স্থাপত্য-সৌন্দর্যের কারণে এগুলো ছিল গোটা মুসলিম-জাহানের গর্বের বস'। কিন্তু আজ সেগুলোর চিহ্নমাত্রও অবশিষ্ট নেই। উচ্ছৃঙ্খল জনতার নির্বিচার ভাংচুর আর গির্জার সামপ্রদায়িক বিদ্বেষের শিকার হয়ে সেগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। (আখবারুল আনদালুছ ২/৭৫)

স্পেনে মুসলমানরা ছিলেন প্রায় ৮০০ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে বহু আলীশান মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। কর্ডোভা ও আলহামরার শানদার মসজিদসমূহ ছিল স্থাপত্য-সৌন্দর্যের বিশ্বসেরা নমুনা। কিন্তু শাসন-ক্ষমতা খৃস্টানদের হাতে যাওয়ার পর হাজার হাজার মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে এবং গির্জা ও ঘরবাড়িতে পরিণত করা হয়েছে।

ক্রুসেডের সময় ক্রুসেডাররা যেভাবে জেরুজালেমের মসজিদগুলো ধ্বংস করেছে তার ইতিহাস অত্যন্ত মর্মান্তিক।

আঠারো শতকের মাঝমাঝি সময়ে রুশ ও তুর্কীদের মাঝে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইউরোপিয়ান ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড ক্রেসি বলেন, রুশ সৈনিকরা গর্ব করে বলত যে, ঐ যুদ্ধে তারা ছয় হাজার ঘরবাড়ি ও আটত্রিশটি মসজিদ জ্বালিয়ে দিয়েছে।

মোটকথা, খৃস্টানদের ইতিহাসে এ জাতীয় দৃষ্টান্তের অভাব নেই।

একথা কেউ দাবি করতে পারবে না যে, মুসলিম-বাহিনীর দ্বারা ভারতবর্ষের কোথাও কোনো মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। হয়েছে, তবে কোন মন্দিরগুলো ধ্বংস করা হয়েছে এবং কেন, তা বলার সুযোগ মুসলমানদের দেওয়া উচিত।

মুসলিম-বাহিনীকে তিন ধরনের হিন্দুর মুখোমুখি হতে হয়েছে : ১. হরবী বা যুদ্ধরত ২. আধা হরবী, ৩ ওফাদার ও অনুগত।

হরবী হল ঐসব হিন্দু, যারা সাধারণত আঞ্চলিক শাসনক্ষমতার জন্য যুদ্ধরত ছিল এবং মুসলমানদেরকে বহিষ্কার করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিল। এই সব অঞ্চলে যুদ্ধাভিযান চলাকালীন কিছু মন্দির ধ্বংস হয়েছে। তবে তা ধর্মীয় প্রেরণা থেকে নয়, যুদ্ধাভিযানের প্রয়োজনে হয়েছে। এমন দৃষ্টন্তও কিছু কম নয় যে, হরবী হিন্দুরা যখন বিজয়ী হয়েছে তখন নির্বিচারে মুসলমানদের ইবাদতখানা ধ্বংস করেছে। এ পুস্তিকায় দেখানো হয়েছে যে, আওরঙ্গযেবের আমলে রাজা ভীম সিং গুজরাটের একশ মসজিদ জ্বালিয়ে দিয়েছিল।

আধা হরবী, আধা ওয়াফাদার হল ঐসব হিন্দু, যারা যুদ্ধে পরাজিত হলে সন্ধি করত এবং আনুগত্য প্রকাশ করত। আর কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হলে বিদ্রোহ করত এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করত। সেসময় অনেক মন্দির এদের বিদ্রোহী কর্মতৎপরতার আখরায় পরিণত হত। ফলে ঐসব মন্দিরেও অভিযান পরিচালনা করতে হয়েছে। একে তুলনা করা যায় শিখদের স্বর্ণমন্দিরে হিন্দু-অভিযানের সাথে। স্বর্ণমন্দির শিখ সন্ত্রাসীদের কেন্দ্রে পরিণত হওয়ায় রাষ্ট্রীয় সেনাঅভিযান ছিল অপরিহার্য। মুসলিম-শাসনামলেও বিদ্রোহ দমনের জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে হয়েছে। শিখরা যদি অভিযোগ করে যে, সরকার সামপ্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বশবর্তী হয়েই স্বর্ণমন্দির ধ্বংস করেছে তাহলে তা কি যথার্থ হবে? হবে না। মন্দিরের বিষয়ে আওরঙ্গযেবের সশস্ত্র ও রাজনৈতিক পদক্ষেপগুলোকেও এই দৃষ্টিকোণ থেকেই বিবেচনা করতে হবে।

তৃতীয় প্রকার হিন্দু, যারা ছিলেন মুসলিম হুকুমতের ওফাদার, তাদের মন্দির-মূর্তি সম্পূর্ণ নিরাপদ ছিল। এজন্য আগ্রা ও দিল্লীর ফরমাবরদার হিন্দুদের মন্দির ধ্বংসের কথা ইতিহাসে পাওয়া যায় না।

কিছু মন্দির অশ্লীলতার আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছিল। স্বয়ং হিন্দুদের ইঙ্গিতেই এসব মন্দির ধ্বংস করে দেওয়া হয়।

দেশবাসীর ভেবে দেখা উচিত যে, শত শত বছর আগের পুরোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে গোটা দেশে হিংসা ও প্রতিহিংসার আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া কি দেশপ্রেম হতে পারে? এই প্রবণতা প্রশ্রয় পেলে তো শুধু কাঁদা ছোড়াছুড়িই হবে। বিষ্ণু-মন্দিরের পুজারীরা কতগুলো শিবমন্দির আর শিব-মন্দিরের পুজারীরা কতগুলো বিষ্ণু মন্দির ধ্বংস করেছে কিংবা হিন্দুরা কতগুলো বৌদ্ধ-মন্দির আর বৌদ্ধরা কতগুলো হিন্দু-মন্দির ধ্বংস করেছে কিংবা জৈন ধর্মের অনুসারীরা বৌদ্ধদের কোন কোন স্থানের অবমাননা করেছে এই বিতর্কই চলতে থাকবে। এসব বিষয়ের বিস্তারিত পরিসংখ্যান লিপিবদ্ধ করা হলে একটি দীর্ঘ গ্রন্থ প্রস্তুত হবে।

হিন্দুরা অবশ্য ঐসব মন্দিরের তালিকা তৈরি করে রেখেছে, যেগুলো মুসলিম-আমলে মুসলমানদের হাতে ধ্বংস হয়েছে। তবে মুসলমানদের নির্ভরযোগ্য গ্রন'সমূহেও এই বিবরণ সংরক্ষিত আছে যে, খোদ মুসলিম-শাসনামলে হিন্দুরা কতগুলো মসজিদ শহীদ করেছে। ১৯৪৭ সালের পর তো, সরকারি রিপোর্টের মাধ্যমেই প্রমাণ করা যায় যে, অসংখ্য মসজিদ থেকে মুসলমানদেরকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, দেশের শিল্প-বাণিজ্যের প্রসার ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কর্ম-পরিকল্পনার  পরিবর্তে যদি শুধু বিদ্বেষ-বিভক্তিই ছড়ানো হতে  থাকে তাহলে তো গোটা ভারতে শুধু প্রতিহিংসার আগুনই জ্বলতে থাকবে। খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখা উচিত যে, এটা কি দেশপ্রেম হবে, না দেশদ্রোহিতা?

বাবরি মসজিদের ফলকগুলিই প্রমাণ করে যে, এই মসজিদ শুধু ইবাদতের জন্যই নির্মিত হয়েছে। রাম-মন্দিরের সাথে এর কোনো সম্পর্কই নেই। ১৫২৮ ঈ. থেকে ১৮৫৫ ঈ. পর্যন্ত এটি মসজিদই ছিল। ১৮৮৫-এর মামলায় একে মসজিদ বলেই স্বীকার করা হয়েছে এবং যথারীতি  মসজিদ হিসেবেই এর রেজিস্ট্রেশন হয়েছে, কিন্তু যারা মনে করেন, অযোধ্যার ভূমিতে একমাত্র হিন্দুদেরই অধিকার এবং  সংখ্যাগরিষ্ঠ সমপ্রদায় হিসেবে তাদের মর্জিই সর্বক্ষেত্রে শিরোধার্য তারাই এই মসজিদটিকে মন্দির বানানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত। কিন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, কিছু ভুল এমনও আছে, যে সম্পর্কে ভুলকারী বেখবর থাকলেও শত শত বছর পর্যন্ত এর কুফল চলতে থাকে। 

 

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement