জুমাদাল আখিরাহ ১৪২৮   ||   জুলাই ২০০৭

তরবিয়ত
বন্ধু এবং অভিভাবক

আবিদা

এমন একজন রুক্ষ ও ভীতিকর পিতারূপে আত্মপ্রকাশ করতে অনেকেই সক্ষম নন, যিনি তার ইচ্ছামতো পরিবারের লোকদের পরিচালনা করেন এবং রক্তচক্ষুর মাধ্যমে সবাইকে নিয়ন্ত্রণে রাখেন। কিন্তু এমন পিতার সংখ্যা খুব বেশি নয়, যারা স্নেহ ও ভালবাসা দিয়ে সবার আনুগত্য লাভে সমর্থ হয়েছেন এবং নম্রতা ও কৌশলের মাধ্যমে পারিবারিক শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পেরেছেন। আমার নানাজী (শায়খ আলী তানতাভী) ছিলেন সেই সামান্য সংখ্যক ব্যক্তিদের অন্যতম।

পরিবারের গৃহকর্তারূপে দৃঢ় ব্যক্তিত্বে অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও এবং পরিবারের সকল ব্যয় নির্বাহ করা সত্ত্বেও অধীনদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার ছিল অত্যন্ত মধুর। তিনি আমাদের সঙ্গে কখনো রুক্ষ ব্যবহার করেননি; বরং স্নেহ ও ভালবাসার শীতল ছায়ায় প্রতিপালন করেছেন। তাঁর পরিবারটি বেশ বড় ছিল এবং স্বভাবতই পরিবারের সদস্যদের রুচি ও মেযাজে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য ছিল। তবুও তিনি সকলের দিকে সমান মনোযোগ দিতেন এবং তাদের সমস্যা ও জটিলতাগুলো দূর করতে সচেষ্ট থাকতেন।

নানাজী ছিলেন আমাদের বন্ধু এবং অভিভাবক। গল্পের আসরে তিনি আমাদের গল্প শোনাতেন এবং অবসর সময়ে আমাদের নিয়ে আনন্দ করতেন। কিন্তু যখন পড়ার সময় হত তখন বলতেন, এবার তোমর পড়তে বস। তিনি আমাদেরকে অনেক কিছু উপহার দিতেন এবং আমরাও যেন অন্যদের কিছু কিছু দেই এজন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। নানাজীর এই অপূর্ব ব্যবহারের কারণে আমরা সবাই ছিলাম তাঁর একান্ত অনুগত।

তাঁর যে কোনো সিদ্ধান্ত আমরা আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করতাম এবং তাঁর ডাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিতাম। তাঁর আদেশ পালনের জন্য এবং তাঁকে খুশি করার জন্য আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা আরম্ভ হত। মোটকথা, আমরা তাঁকে ভালবাসতাম এবং শ্রদ্ধা করতাম। তাঁর সঙ্গে আনন্দ করতাম, আবার তাঁকে ভয়ও পেতাম। তাঁর মত বিনিময় করতাম, কিন্তু শেষে তাঁর সিদ্ধান্তই অনুসরণ করতাম।

কখনো কোনো অপরাধ করলে কিংবা তাঁর ডাকে সাড়া দিতে অবহেলা করলে তার একটি তীক্ষè দৃষ্টিই আমাদের জন্য যথেষ্ট হত। আর কেউ যদি কোনো বড় অপরাধ করত তাহলে তিনি তাকে গম্ভীরভাবে কিছু ভৎর্সনা করতেন। তাঁর কণ্ঠস্বর উচ্চকিত হত না এবং ক্রোধ তাঁকে বেসামাল করত না। কেননা চিৎকার চেঁচামেচিতে মানুষের ব্যক্তিত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ক্রোধে আত্মহারা হলে মানুষ অন্যের দৃষ্টিতে খাটো হয়ে যায়। নানাজীর শাসন সাধারণত এ পর্যন্তই হত। তিনি প্রহার করেছেন এমন দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। আমি তাঁর পঞ্চম দৌহিত্রী। আমার পরে তাঁর আরও সতেরজন দৌহিত্র-দৌহিত্রী ছিল। কিন্তু আমার মনে পড়ে না যে, তিনি আমাকে কিংবা আমার সম্মুখে অন্য কাউকে কখনো প্রহার করেছেন। তাঁর যে দু একটি প্রহারের ঘটনা বড়দের কাছ থেকে শুনেছি তা-ও ছিল শেষ চিকিৎসারূপে। আমার মা-খালাদের কাছে শুনেছি যে, এ সময়ও তিনি যথেচ্ছা প্রহার করেননি; প্রহারের বিষয়েও তিনি নিয়ম মেনে চলতেন, যার মূল কথা এই ছিল যে, প্রহার হল প্রহৃতের সংশোধনের জন্য, প্রহারকারীর ক্রোধ চরিতার্থ করার জন্য নয়। কেউ অনিচ্ছাকৃতভাবে কোনো কিছু ভেঙ্গে ফেললে তিনি তাকে শাস্তি দিতেন না। যদিও জিনিসটি অত্যন্ত মূল্যবান হত। অন্যদিকে তার এক নাতীকে এজন্য শাস্তি পেতে হয়েছিল যে, সে একটি ফুলদানী নিয়ে খেলা করার সময় তা হাত থেকে ফেলে দিয়েছিল। ফুলদানীটির মূল্য খুব বেশি ছিল না। তবে সে নিয়ম ভঙ্গ করেছিল। কেননা, ফুলদানী হচ্ছে সাজিয়ে রাখার জন্য, খেলার জন্য নয়।

জগতের সকল কিছুর মতো মানুষের জীবনও সদা পরিবর্তনশীল। আজ যিনি সর্বাধিক শক্তিমান ও ক্ষমতাশালী কাল তিনিই হবেন সর্বাধিক দুর্বল ও মুখাপেক্ষী। এই অধীনদেরই ভালবাসা ও সহানুভূতি ছাড়া তখন তার সময় কাটানো কঠিন হয়ে উঠবে। এই আসন্ন পরিবর্তনের কথা বিস্মৃত হওয়ার ফল অত্যন্ত অশুভ হতে পারে। কেননা, পর্যুদস্তুতা মানুষকে ক্রোধান্বিত করে। অত্যাচার মানুষের মনে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। লাঞ্ছনা ও অপমান মানুষকে অবাধ্য করে তোলে আর মানুষ যখন কোণঠাসা হয় তখনই সে আক্রমণ করে।

এটা একটা স্বতঃসিদ্ধ নীতি যে, কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। তাই আপনি যদি অধীনদের আনুগত্য পেতে চান তবে অবশ্যই আপনাকে যত্ন ও ভালবাসা প্রদান করতে হবে। পরিবার পরিচালনার এ এক সোনালী নীতি, যা নানাজী তাঁর বাস্তব জীবনে সর্বদা অনুসরণ করেছিলেন।

নানাজীর জীবনের নব্বইটি বছর কেটে গেছে। তিনিও বদলেছেন, তাঁর চারপাশের অনেক কিছুই বদলে গেছে, কিন্তু সেই শ্রদ্ধা ও ভালবাসা এখনও অটুট রয়েছে। যা তিনি আমাদের অন্তর-ভূমিতে বপন করেছিলেন, এই সুরভিত শ্রদ্ধা নিয়েই আমরা এখন তাঁকে দেখতে যাই, তাঁর পাশে বসি এবং তাঁকে সন্তুষ্ট ও আনন্দিত রাখতে চেষ্টা করি।

 

 

advertisement