মিন্ আদাবিল্ ইসলাম - ৩
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আগন্তুকের পরিচয় জিজ্ঞাসা করা হলে ‘আমি’ বলে পরিচয় দেওয়াকে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপসন্দ করেছেন।
ইমাম বুখারী রাহ. ও ইমাম মুসলিম রাহ. হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে এসে দরজার কড়া নাড়লাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে?’ আমি বললাম, ‘আমি।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপসন্দের সুরে বললেন, ‘আমি! আমি!’
এ প্রসঙ্গে একটি চমৎকার ঘটনা আছে। তা হল, প্রসিদ্ধ ইমাম ও মুহাদ্দিস আবু নুয়াইম আলফাদল ইবনে দুকাইন আলকুফী রাহ. (১৩০-২১৯হি.) রসিক মানুষ ছিলেন। আলী ইবনে আব্বাস আলমাকানীয়ী বর্ণনা করেন যে, আমি হুসাইন ইবনে আমর আলআনকাযীকে বলতে শুনেছি, একদা এক ব্যক্তি আবু নুয়াইমের বাড়ি এসে দরজায় আওয়াজ দিল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কে? সে বলল, আমি। তিনি বললেন, আমি কে? সে বলল, জনৈক আদম-সন্তান। একথা শুনে আবু নুয়াইম বের হয়ে এলেন এবং তাকে সাদরে চুম্বন করে বললেন, আহলান, সাহলান। এই বংশের কেউ এখনো ভূপৃষ্ঠে বেঁচে আছেন তা তো আমার জানা ছিল না! (তাহযীবুল কামাল, মিযযী ও সীয়ারু আলামিন নুবালা, যাহাবী)
এজন্যই সাহাবায়ে কেরাম পরিষ্কারভাবে নিজেদের নাম বলতেন। আবু যর রা. বলেন, এক রাতে আমি বাইরে বের হয়ে দেখতে পেলাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একাকী হাঁটছেন। আমিও চাঁদের আলোয় হাঁটতে লাগলাম। তিনি (নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পিছনে ফিরে আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কে?’ আমি বললাম, ‘আবু যর।’ (বুখারী ও মুসলিম)
হযরত আলী রা.-এর সাহোদরা ও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচাত বোন উম্মে হানী রা. বলেন, আমি একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এলাম। তিনি তখন গোসল করছিলেন। আর ফাতিমা রা. তাঁকে আড়াল করে রেখেছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কে? আমি বললাম, উম্মে হানী। (বুখারী ও মুসলিম)
কারো সাথে সাক্ষাত করলে গেলে, তা সময় নিয়ে হোক বা সময় নেওয়া ছাড়া, যদি সে সাক্ষাতে অপারগতা প্রকাশ করে তাহলে তার অপারগতা স্বানন্দে মেনে নাও। কারণ বাড়ির কর্তা বাড়ির অবস্থা ভালো জানেন। হয়ত তোমাকে সময় দেওয়ার পর এমন কোনো পরিসি'তি সৃষ্টি হয়েছে যার কারণে এখন তোমাকে অভ্যর্থনা জানানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব অপারগতা জানানোর অধিকার তার রয়েছে।
বিশিষ্ট মনীষী তাবেয়ী কাতাদাহ ইবনে দিআমাহ আস সাদুসী রাহ. বলেন, কারো বাড়ি থেকে ফিরে যেতে বলা হলে সেখানে আর দাঁড়িয়ে থেকো না। কারণ তোমার হল প্রয়োজন আর তাদের হল্য ব্যস্ততা। সুতরাং অপারগতা প্রকাশের অধিকার তাদেরই রয়েছে।
ইমাম মালিক রাহ. বলেন, সকল মানুষ নিসঙ্কোচে অপারগতার কথা বলতে পারে না। এজন্য পূর্বসূরীদের নিয়ম ছিল, তারা কারে সাথে সাক্ষাতের প্রক্কালে বলতেন, সম্ভবত এ মুহূর্তে আপনার কোনো সমস্যা আছে। যেন কোনো অসুবিধা থাকলে প্রকাশ করা তার পক্ষে সহজ হয়।
বিষয়টির গুরুত্বের কারণে এবং সাক্ষাত লাভে ব্যর্থ হলে কোনো কোনো সাক্ষাতকামীর মনক্ষুণ্নতার আশঙ্কা থাকায় আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে বিষয়টি পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-
তোমাদেরকে যদি ফিরে যেতে বলা হয় তাহলে তোমরা ফিরে যাও। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম।-সূরা নূর : ২৮
এই গুরুত্বপূর্ণ কুরআনী আদবের মাধ্যমে আমরা একটি নিকৃষ্ট বিষয় থেকে মুক্তি পেতে পারি। কোনো কোনো সময় দেখা যায়, সাক্ষাতপ্রার্থীর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয় এবং বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও বলা হয়-বাড়ি নেই। পরিবারের শিশুরাও বড়দের এসব করতে দেখে এবং তারাও এই মন্দ স্বভাব রপ্ত করে ফেলে। উপরন্তু এর মাধ্যমে সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়।
কুরআন মজীদ এসব মন্দকর্ম থেকে আমাদেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। কারণ একদিকে অপারগতা প্রকাশের অবকাশ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে সাক্ষাত প্রার্থীকেও অপারগতা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কারো বাড়িতে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনার সময় বাড়ির ভেতরে দৃষ্টিপাত করবে না। কারণ তা ইসলামী আদবের খেলাফ। ইমাম আবু দাউদ ও তবারানী রাহ. সা’দ বিন উবাদা রা. থেকে বর্ণনা করেন যে, একবার এক লোক এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দরজার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনুমতি প্রার্থনা করল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এভাবে দাড়াও। অর্থাৎ দরজার সম্মুখ থেকে সামান্য দূরে দাড় করিয়ে দিলেন। অতপর বললেন, অনুমতির নির্দেশ দেওয়াই হয়েছে নযরের কারণে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
অনুবাদে: নাজিবুল্লাহ সিদ্দীকুল্লাহ