ফিকহে হানাফীর সনদ
[পূর্ব প্রকাশিতের পর]
আমি গত সংখ্যায় আরজ করেছিলাম, ফিকহে হানাফীর সনদ প্রসঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, হানাফী ইমামগণ এই ফিকহ কোত্থেকে গ্রহণ করেছেন। বলাবাহুল্য, তাঁরা এই ফিকহের স্রষ্টা কিংবা উদ্ভাবক নন; তাঁরা হলেন সংকলনকারী ও আহরণকারী। তাহলে ফিকহের যে অংশে তাঁরা সংকলক সেখানে দেখার বিষয় এই যে, কাদের সূত্রে এই ফিকহ তাঁদের নিকটে পৌঁছেছে এবং কীভাবে পৌঁছেছে। আর যে অংশে তাঁরা আহরণকারী সেখানে দেখার বিষয় এই যে, তাঁদের আহরণের উৎস ও পদ্ধতি কী ছিল।
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর বোঝার জন্য ফিকহে ইসলামীর পরিচয়, বৈশিষ্ট্য ও ইতিহাস সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকা অপরিহার্য। উপরোক্ত বিষয়গুলোতে ভালো ভালো গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তন্মধ্যে আমার জানামতে সর্বাধিক বিস্তারিত ও ওজনী গ্রন্থ হল আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনে হাসান আলহাজভী রহ. (মৃত্যু: ১৩৭৬ হি.) কৃত ‘আলফিকরুস সামী ফী তারীখিল ফিকহিল ইসলামী’। গ্রন্থটি আরবী ভাষায় রচিত। উর্দূ ভাষায় উস্তাদে মুহতারাম আল্লামা খালিদ মাহমুদ (দা.বা.)-এর কিতাব ‘আছারুত তাশরীইল ইসলামী’ একটি উচ্চাঙ্গের রচনা। আল্লাহ তা’আলা যদি তাওফীক দান করেন তবে এ বিষয়ে সারগর্ভ ও বিস্তারিত প্রবন্ধ আল কাউসারেও প্রকাশিত হবে।
বর্তমান আলোচনায় আমি কয়েকটি বিষয় সংক্ষিপ্ত আকারে পাঠকদের সামনে পেশ করছি।
১. মুয়াররিখে ইসলাম ইমাম শামসুদ্দীন যাহাবী রাহ. (মৃত্যু: ৭৪৮হি.) বলেছেন, “কূফা নগরীতে যেসব সাহাবী বিদ্যমান ছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফকীহ ছিলেন আলী ইবনে আবী তালিব রা. ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা.। তাঁদের শীষ্যদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফকীহ ছিলেন আলকামা রহ. (মৃত্যু: ৬২হি.)। তাঁর শীষ্যদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফকীহ ইবরাহীম নাখায়ী (মৃত্যু: ৯৬ হি.) এবং ইবরাহীম নাখায়ীর শীষ্যদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফকীহ হাম্মাদ ইবনে আবী সুলাইমান রহ. (মৃত্যু: ১২০ হি.)। হাম্মাদ রহ.-এর শীষ্যদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফকীহ আবু হানীফা (৮০হি.-১৫০হি.) এবং আবু হানীফার শীষ্যদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফকীহ ছিলেন আবু ইউসুফ রা. (মৃত্যু: ১৮৩ হি.) আবু ইউসুফ রাহ.-এর শীষ্যগণ (দ্বীন ও ইলমের প্রচার-প্রসারের জন্যে) পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফকীহ ছিলেন মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান (মৃত্যু: ১৮৯ হি)। আর তাঁর শীষ্যদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ফকীহ ছিলেন আবু আবদুল্লাহ আশশাফেয়ী। (অর্থাৎ ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে ইদরীস শাফেয়ী রহ. (১৫০ হি.-২০৪ হি.)। আল্লাহ তাঁদের সকলের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন।” -সিয়ারু আলামিন নুবালা ৫/২৩৬ (হাম্মাদ ইবনে আবী সুলাইমান)
এখানে ইমাম যাহাবী রাহ. একটিমাত্র সূত্র উল্লেখ করেছেন। এ প্রসঙ্গে সারকথা এই যে, ফিকহ ও ফতোয়া এবং তার উৎস কুরআন-সুন্নাহর ইলম নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে তাঁর ফকীহ সাহাবীগণ গ্রহণ করেছেন। এরপর তাঁরা এক দু’জন করে কিংবা তাঁদের এক একটি জামাত এক এক ইসলামী শহরে অবস্থান গ্রহণ করেন। সে অঞ্চলের মানুষ দ্বীন-ঈমান, কুরআন-সুন্নাহ এবং ফিকহ-ফতোয়ার ইলম তাঁদের নিকট থেকেই গ্রহণ করেছেন। এই শিক্ষাগ্রহণকারীদের মধ্যে কিছুসংখ্যক মানুষ ফকীহ পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন। এঁদের ‘ফুকাহায়ে তাবেয়ীন’ বলা হয়। এঁদের প্রত্যেকে নিজ নিজ অঞ্চলে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিগণিত হতেন এবং সাধারণ মানুষ তাঁদের তাকলীদ করত। এই ধারাবাহিকতায় ফিকহের প্রসিদ্ধ ইমামদের যুগ এসেছে যারা ফিকহ-সংকলকরূপে মুসলিম জাহানে সমাদৃত। তাদের সংকলিত ফিকহ মোতাবেক গোটা মুসলিম উম্মাহ আজ পর্যন্ত আমল করছে। ইমাম ইবনুল কাইয়িম রাহ. ‘ই’লামুল মুয়াক্কিয়ীন’-এর শুরুতে ফিকহ ও ফতওয়ার ইতিহাস বিস্তারিতভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। ইমাম শামসুদ্দীন যাহাবী রহ.ও ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’য় (খ: ৮ পৃ: ৯১-৯২; খ: ৯ পৃ: ৫২৫) সংক্ষিপ্ত আকারে সাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকে ইমাম ইবনে জারীর তাবারী (৩১০হি.) ও ইমাম ত্বহাবী (৩২১হি.)-এর যুগ পর্যন্ত প্রসিদ্ধ আইম্মায়ে মুজতাহিদীনের নামের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রদান করেছেন, যাঁরা তৎকালীন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ফকীহ ছিলেন। ‘সিয়ারু আলামিন নুবালা’র ৮ম খণ্ডের ৯১ পৃষ্ঠায় তার আলোচনা এভাবে শুরু হয়েছে -
فالمقلدون صحابة رسول الله صلى الله عليه وسلم بشرط ثبوت الإسناد إليهم، ثم أئمة التابعين ....
তাঁর কথার সারমর্ম এই দাড়ায় যে, তার তালিকায় প্রতি যুগের যে ফকীহগণ উল্লেখিত হয়েছেন স্ব-স্ব যুগে ও স্ব-স্ব অঞ্চলে তাদের তাকলীদ হত এবং আজও প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে তাদের তাকলীদ অব্যাহত রয়েছে।
২. ফিকহে ইসলামী (যার সবচেয়ে প্রাচীন এবং সর্বাধিক সমাদৃত সংকলন হল ফিকহে হানাফী) বিশেষ কোনো যুগ কিংবা বিশেষ কোনো ব্যক্তির উদ্ভাবন নয়; বরং এটা নবী-যুগ থেকে তেমনি অবিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতার মাধ্যমে বর্ণিত হয়ে এসেছে যেভাবে ফিকহের উৎস এবং গোটা দ্বীনের উৎস কুরআন-সুন্নাহ বর্ণিত হয়ে এসেছে।
৩. হাফিয যাহাবী রাহ. দৃষ্টান্তস্বরূপ শুধু একটি সনদ উল্লেখ করেছেন। যেখানে ইমাম আবূ হানীফা রাহ.-এর উস্তাদ হাম্মাদ রাহ.-এর নাম উল্লেখিত হয়েছে। কিন্তু হাম্মাদ রাহ.ই ইমাম আবূ হানীফার একমাত্র উস্তাদ নন। ইমাম আবূ হানীফা রাহ. ফিকহ-ফতোয়া এবং কুরআন-সুন্নাহর ইলম অসংখ্য উস্তাদ থেকে আহরণ করেছেন, যাঁদের অধিকাংশ ছিলেন তাবেয়ী এবং বিপুল সংখ্যক তাবেতাবেয়ী। বরং তিনি একাধিক সাহাবীর জিয়ারতও লাভ করেছিলেন। এই শত শত উস্তাদদের মধ্যে বিশিষ্ট সংখ্যক এমন ব্যক্তিত্বও ছিলেন যারা কুরআন-সুন্নাহর পারদর্শী এবং ফিকহ-ফতোয়ার ইমাম ছিলেন। যে জন্য তারা তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে গণ্য ছিলেন।
মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ আসসালেহী (৯৪২ হি.) (যিনি শাফেয়ী মাযহাবের অনুসারী,) ইমাম আবূ হানীফার গুণ ও বৈশিষ্ট সম্পর্কে রচিত উকূদুল জুমান ফী মানাকিবিল ইমামিল আ’জম আবী হানীফাতান নু’মান’ গ্রন্থে ইমাম আজমের অনেক উস্তাদের নাম উল্লেখ করেছেন, যা এই গ্রন্থের পৃষ্ঠা ৬৩ থেকে পৃষ্ঠা ৮৭ তে বিদ্যমান রয়েছে।
৩. কতজন সাহাবীর সূত্রে ইমাম আবূ হানীফা রহ. পর্যন্ত কুরআন-সুন্নাহ এবং ফিকহ-ফতোয়ার ইলম পৌঁছেছে তা এ বিষয়টি থেকেও অনুমান করা যায় যে, ইমাম আবূ হানীফা রহ. যে নগরীর অধিবাসী ছিলেন এবং যে নগরীতে তিনি তাঁর ইলমী জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেছেন অর্থাৎ কুফা নগরী, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাহাবী অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। ইমাম কাতাদা রহ.-এর বিবরণ এই যে, এক হাজার পঁচিশ জন সাহাবী কুফা নগরীর অধিবাসী হয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে চব্বিশ জন ছিলেন বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী। -কিতাবুল কুনা ওয়াল আসমা, দূলাবী ১/১৭৪
ইমাম আবুল হাসান ইজলী (২৬১ হি.) যাকে রিজাল শাস্ত্রে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল ও ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন রহ.-এর সমকক্ষ গণ্য করা হয়, তিনি কুফা-অধিবাসী সাহাবীদের সংখ্যা আরও বেশি উল্লেখ করেছেন। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী দেড় হাজার সাহাবী কুফায় এসে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। -ফাতহুল কাদীর, ইবনুল হুমাম ১/৪২
হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুর রশীদ নু’মানী রহ. (১৩৩৩ হি.-১৪২০ হি.) উপরোক্ত উদ্ধৃতিগুলো উল্লেখ করার পর লেখেন, ‘কুফা নগরীর আলিমগণের এরূপ জ্ঞান-তৃষ্ণা ছিল যে, খোদ কুফায় এত বিপুল সংখ্যক সাহাবী বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তাঁরা অবিরাম মদীনার সফর করতেন এবং সেখানকার বড় বড় সাহাবীদের সাহচর্য গ্রহণ করে জ্ঞান-তৃষ্ণা নিবারণ করতেন। আল্লামা ইবনে তাইমিয়া ‘মিনহাজুস সুন্নাহ’ গ্রন্থে বলেন, ‘আবু আব্দুর রহমান সুলামী ও কুফার অন্যান্য আলিমদের যেমন, আলকামা, আসওয়াদ, হারিছ, ও যির ইবনে হুবাইশ (যাঁর কাছে সাতকারীর অন্যতম কারী আসিম ইবনে আবিন নাজূদ রহ. কুরআন মজীদ পড়েছেন)- এঁরা সবাই হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর কাছে কুরআন পড়েছেন (অর্থাৎ কুরআন তিলাওয়াত শিখেছেন, কুরআনের অর্থ ও মর্ম এবং তার বিধান ও নির্দেশনার জ্ঞান লাভ করেছেন) সঙ্গে সঙ্গে এঁরা মদীনা তাইয়িবা যেয়ে হযরত উমর রা. ও হযরত আয়েশা রা.-এর নিকট থেকেও ইলম অর্জন করেছেন; এমনকি তাঁরা হযরত উমর রা. ও হযরত আয়েশা রা. থেকে যত ইলম অর্জন করেছেন সেই পরিমাণ হযরত আলী রা. থেকেও অর্জন করেননি। কুফা নগরীর কাজী শুরাইহ রহ. ফিকহের তালীম অর্জন করেছেন হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. থেকে ইয়ামানে।’ -মিনহাজুস সুন্নাতিন নাবাবিয়্যাহ ৪/১৪২
কুফার মনীষীদের ইলমী সফরের বিষয়টি ছাড়াও ‘ইলম-নগরীর দ্বার’ হযরত আলী ইবনে আবী তালিব রা.-এর ইলম বিতরণের স্থানও ছিল কুফা। তিনি সেখানে চার বছর অবস্থান করেছেন। শায়খ ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেন, ‘তবে কুফার অধিবাসীরা হযরত আলী রা.-এর সময়ে তো বটেই, হযরত উসমান রা. খলীফা হওয়ার আগে থেকেই কুরআন-সুন্নাহর পারদর্শী ছিলেন।’ -মিনহাজুস সুন্নাহ ৪/১৩৯
ইবনে তাইমিয়া রহ. আরও লেখেন, ‘কুফার অধিবাসীরা ঈমান, কুরআন, তাফসীরে কুরআন, ফিকহ ও সুন্নাহর ইলম হযরত আলী রা.-এর কুফা আগমনের পূর্বেই হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর নিকট থেকে গ্রহণ করেছিলেন।
‘হযরত আলী রা. কুফা আগমনের পূর্বে কুফাবাসী হযরত সাদ ইবনে আবী ওয়াককাস, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হযরত হুযাইফা, হযরত আম্মার, হযরত আবু মূসা প্রমুখ থেকে দ্বীন হাসিল করেছিলেন। এঁদেরকে হযরত উমর রা. কুফা নগরীতে প্রেরণ করেছিলেন। -মিনহাজুস সুন্নাহ ৪/১৪২, ১৫৭-ইবনে মাজা আওর ইলমে হাদীস পৃ. ৩৭
এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, কুফা নগরী কুরআন-সুন্নাহর ইলমের এত বড় কেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও ইমাম আবু হানীফা রহ. এখানকার ইলমের মধ্যে সীমাবন্ধ থাকেননি; বরং অন্যান্য ইসলামী শহরের সাহাবীদের ইলম হাসিলের জন্যও গুরুত্বের সঙ্গে সফর করেছেন। কেননা, হতে পারে তাঁদের ইলমের কিছু অংশ কুফা নগরীতে পৌঁছয়নি। মুয়াররিখে ইসলাম শামসুদ্দীন যাহাবী রহ. পরিষ্কার লেখেন,
فإن الإمام أبا حنيفة طلب الحديث وأكثر منه في سنة مئة وبعدها.
‘ইমাম আবূ হানীফা রহ. একশ হিজরী ও তার পরবর্তী সময়ে ব্যাপকভাবে ইলমে হাদীস অন্বেষণ করেছেন।’ তিনি আরও লেখেন,
‘ইমাম আবূ হানীফা হাদীস অন্বেষণে মনোযোগ দিয়েছেন এবং এ উদ্দেশ্যে সফর করেছেন।’ -সিয়ারু আলামীন নুবালা ৬/৩৯২-৩৯৬
তাছাড়া ১৩০ হি, থেকে ১৩৬ হি. পর্যন্ত প্রায় সাত বছর ইমাম আবু হানীফা রহ. মক্কা মুকাররামায় অবস্থান করেছেন, যা গোটা মুসলিম জাহানের ফিকহ ও হাদীসের ইমামগণের কেন্দ্রভূমি ছিল। ইমাম আবূ হানীফা রহ. ‘ইমাম’ হওয়ার পরও তাঁর নীতি এই ছিল যে, কুফা নগরীতে কোনো বিশিষ্ট মুহাদ্দিসের আগমন হলে তার ইলম দ্বারা নিজের ইলমভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতেন। ইমাম নযর ইবনে মুহাম্মাদ মারওয়াযী, যিনি ইমাম সাহেবের প্রসিদ্ধ শীষ্যদের অন্যতম, বলেন যে, ‘আমি হাদীস বিষয়ে ইমাম আবু হানীফা রহ. থেকে অধিক যত্নবান আর কাউকে দেখিনি। একবার আমাদের এখানে ইয়াহইয়া ইবনে সায়ীদ আনসারী, হিশাম ইবনে উরওয়া ও সায়ীদ ইবনে আবী আরুবা এলেন। তখন ইমাম আবু হানীফা রহ. আমাদের বললেন, দেখ তো তাঁদের কাছে এমন কিছু আছে কিনা যা আমরা শ্রবণ করতে পারি। -আল জাওয়াহিরুল মুযীয়া, আব্দুল কাদির কুরাশী ৩/৫৫৬
মানাকিব বিষয়ক গ্রন্থাদিতে এ ধরনের আরও ঘটনা উল্লেখিত হয়েছে। মোটকথা, বিভিন্ন ইসলামী শহরের তাবেয়ীদের একটি সুবৃহৎ জামাতের মাধ্যমে ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর শীষ্যগণ সাহাবায়ে কেরামের ইলম (কুরআন, সুন্নাহ, ফিকহ) হাসিল করেছেন, আর সাহাবায়ে কেরাম তা হাসিল করেছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট থেকে। তাঁর নির্দেশনা থেকে কিংবা তাঁর শিক্ষা ও নির্দেশনার গভীর থেকে। তাই এ বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর শীষ্যগণের সনদ একটি নয়, অসংখ্য। তবে ইমাম যাহাবী রহ. যে সনদটি উল্লেখ করেছেন তার মাধ্যমেই তাঁরা কুরআন, সুন্নাহ ও ফিকহের সবচেয়ে বেশি ইলম হাসিল করেছেন। এ সনদের গোড়ায় রয়েছেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. ও হযরত আলী ইবনে আবী তালিব রা.।
৪. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও হযরত আলী ইবনে আবী তালিব এর পর যে সাহাবীদের সূত্রে হানাফী ইমামগণের কাছে কুরআন, সুন্নাহ ও ফিকহের ইলম সবচেয়ে বেশি পৌঁছেছে, কিংবা বলুন, ফিকহে হানাফীতে যাঁদের প্রভাব সর্বাধিক তাদের মধ্যে খলীফায়ে রাশিদ হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এবং হিবরুল উম্মাহ ওয়া তারজুমানুল কুরআন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এজন্য খলীফা আবু জাফর মনসূর (মৃত্যু: ১৫৮ হি.) যখন ইমাম আবূ হানীফাকে প্রশ্ন করেন যে, আপনি কাদের কাছ থেকে এবং কাদের সূত্রে ইলম হাসিল করেছেন, তখন তিনি উপরোক্ত চার জনের নাম উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর জওয়াব শোনামাত্র মনসূরের যবান থেকে যে বাক্য উৎসারিত হয়েছিল তা এই-
بخ! بخ! استوثقت ما شئت يا أبا حنيفة، الطيبين الطاهرين المباركين، صلوات الله عليهم.
‘মারহাবা ইয়া আবু হানীফা! আপনি তো পরম নির্ভরযোগ্য পথ গ্রহণ করেছেন। এরা তো হলেন “তায়্যিব” “তাহির” মোবারক জামাত। আল্লাহ তাঁদের প্রতি রহমত বর্ষণ করুন।’ -তারীখে বাগদাদ ১৩/৩৩৪
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, উপরোক্ত চার সাহাবীকে বিশেষভাবে উল্লেখ করার কারণ হল সূত্র হিসেবে তাঁদের অগ্রগণ্যতা। অর্থাৎ অন্যদের তুলনায় এঁদের সূত্রেই ইমাম ছাহেবের কাছে কুরআন, সুন্নাহ ও ফিকহের ইলম বেশি পৌঁছেছে। অন্যথায় হাদীস ও ফিকহ বিষয়ে ইমাম ছাহেবের সবচেয়ে ছোট রচনা ‘কিতাবুল আছার’ এবং তারও সবচেয়ে ছোট নুসখা, যা ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আশশাইবানী রহ. বর্ণনা করেছেন, তাতেও উপরোক্ত চার সাহাবী ছাড়া আরও অনেক বড় বড় সাহাবীর হাদীস ও আছার বিদ্যমান রয়েছে।
ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ.-এর উস্তাদ, হাদীস-ফিকহ ও ইলমে বাতিনের ইমাম, আবু সায়ীদ খালাফ ইবনে আইয়ুব (মৃত্যু ২০৫ হি.) সত্যই বলেছেন,
‘ইলম আল্লাহর পক্ষ থেকে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসেছে, এরপর তা পৌঁছেছে তাঁর সাহাবীগণের কাছে, এরপর তাবেয়ীনের কাছে, এরপর আবু হানীফা ও তাঁর শীষ্যগণের কাছে। এখন যার ইচ্ছা সন্তুষ্ট থাকুন, যার ইচ্ছা অসন্তুষ্ট হোক। -তারীখে বাগদাদ ১৩/৩৩৬, মাকানাতুল ইমাম আবী হানীফা ফিল হাদীস পৃ. ৩৩-৩৬
খালাফ ইবনে আইয়ুব রহ. বক্তব্যের উদ্দেশ্য হল, ইমাম ছাহেবই সর্বপ্রথম তাঁর শাগরিদদের নিয়ে ইলমে ওহীকে অধ্যায় ও পরিচ্ছেদের বিন্যাসে সুবিন্যস্ত করেছিলেন এবং ‘ফিকহে মুদাল্লাল’১-এর সঙ্গে সাধারণ মানুষের সুবিধার্থে ‘ফিকহে মুজাররাদ’২-এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহ.-এর বর্ণনা অনুযায়ী এটা এক ঐতিহাসিক বাস্তবতা। তিনি লেখেন,
من مناقب أبي حنيفة التي انفرد بها أنه أول من دون علم الشريعة ورتبه أبوابا، ثم تبعه مالك بن أنس في الموطأ، وسفيان الثوري في جامعه، ولم يسبق أبا حنيفة أحد.
‘যে বৈশিষ্টগুলোতে ইমাম আবূ হানীফা রহ. একক ও অপ্রতিদ্বন্দী তা এই যে, তিনিই সর্বপ্রথম শরীয়তের ইলমকে সংকলিত করেছেন এবং বিষয় ভিত্তক বিন্যাসে অধ্যায় ও পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত করেছেন। এরপর ইমাম মালিক “মুয়াত্তা” গ্রন্থে তাঁর অনুসরণ করছেন।’
৭. ‘ফিকহে মুতাওয়ারাছ’ (ফিকহের যে অংশ নবী-যুগ থেকে চলে আসছে) সংকলিত করা এবং সাহাবা ও শীর্ষস্থানীয় তাবেয়ীগণের যুগ শেষ হওয়ার পর যেসব নতুন সমস্যার উদ্ভব হয়েছে তার সমাধান দেওয়ার জন্য ইমাম ছাহেবকে কী কী কাজ করতে হয়েছিল এবং এ প্রসঙ্গে তিনি কী কী অবদান রেখেছেন তা আলোচনা করতে হলে একটি গ্রন্থ রচনা করতে হবে। তাই আমি এখানে ইমাম ছাহেবের ভাষায় শুধু এ বিষয়টি উল্লেখ করতে চাই যে, ফিকহ ও ফতোয়ার বিষয়ে তাঁর মৌলিক নীতিমালা কী ছিল।
এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন সহীহ সনদে ইমাম আবূ হানীফা রহ. থেকে যে নীতিগুলো উল্লেখিত হয়েছে তার সারকথা এই :
১. মাসআলার সমাধান যখন কিতাবুল্লায় পাই তখন সেখান থেকেই সমাধান গ্রহণ করি।
২. সেখানে না পেলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ এবং সহীহ হাদীস থেকে গ্রহণ করি, যা নির্ভরযোগ্য রাবীদের মাধ্যমে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। সহীহ হাদীস আমাদের জন্য শিরোধার্য। একে পরিত্যাগ করে অন্য কিছুর শরণাপন্ন হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
৩. এখানেও যদি না পাই তবে সাহাবায়ে কেরামের সিদ্ধান্তগুলোর শরণাপন্ন হই।
৪. কিতাবুল্লাহ, সুন্নাতু রাসূলিল্লাহ ও ইজমায়ে সাহাবার সামনে কিয়াস চলতে পারে না। তবে যে বিষয়ে সাহাবীগণের একাধিক মত রয়েছে সেখানে ইজতিহাদের মাধ্যমে যার মত কিতাব-সুন্নাহর অধিক নিকটবর্তী বলে বোধ হয় তাই গ্রহণ করি।
৫. মাসআলার সমাধান এখানেও পাওয়া না গেলে ইজতিহাদের মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছে থাকি। তবে এক্ষেত্রেও তাবেয়ীগণের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত থেকে বিচ্ছিন্ন হই না। -আলইনতিকা ফী ফাযাইলিল আইম্মাতিছ ছালাছাতিল ফুকাহা, ইবনে আব্দিল বার পৃ. ২৬১, ২৬৪, ২৬৭; ফাযাইলু আবী হানীফা, আবুল কাসিম ইবনু আবিল আউয়াম, পৃ.২১-২৩ মাখতূত; আখবারু আবী হানীফা ওয়া আসহাবিহী, আবূ আব্দুল্লাহ আসসাইমারী (মৃত্যু ৪৩৬ হি.) পৃ. ১০-১৩; তারীখে বাগদাদ, খতীবে বাগদাদী ১৩/৩৬৮; উকূদুল জুমান, মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ সালিহী পৃ. ১৭২-১৭৭; মানাকিবুল ইমাম আবী হানীফা, মুয়াফফাক আলমক্কী ১/৭৪-১০০
‘ফিকহে মুতাওয়ারাছ’-এর সংকলন এবং ‘ফিকহে জাদীদ’ আহরণের যে নীতিমালা ইমাম ছাহেবের নিজের ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে তা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের সকল ইমামের সর্বসম্মত নীতি। কোনো ফিকহ তখনই ইসলামী ফিকহ হতে পারে যখন তা উপরোক্ত নীতিমালার ভিত্তিতে সংকলিত ও আহরিত হয়।
ফিকহ সংকলন এবং ফিকহ আহরণের ক্ষেত্রে উপরোক্ত নীতিমালা অনুসরণে ইমাম ছাহেব রহ. কতটুকু সফল হয়েছেন তা তাঁর সমসাময়িক স্বীকৃত ইমামগণের বক্তব্য থেকে জানা যেতে পারে, যারা তাফসীর, হাদীস, ফিকহ ইত্যাদি সকল ইসলামী শাস্ত্রের ইমাম ছিলেন। ইমাম সুফিয়ান ছাওরী রহ. (মৃত্যু ১৬১ হি.) বলেন,
كان أبا حنيفة شديد الأخذ للعلم، ذابا عن حرم الله أن تستحل، يأخذ بما صح عنده من الأحاديث التي كان يحملها الثقات، وبالآخر من فعل رسول الله صلى الله عليه وسلم وبما أدرك عليه علماء الكوفة.
‘আবূ হানীফা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে ইলম অন্বেষণ করেছেন। তিনি ছিলেন (দ্বীনের প্রহরী) দ্বীনের সীমানা রক্ষাকারী, যাতে আল্লাহর হারামকৃত কোনো বিষয়কে হালাল মনে করা না হয়, কিংবা হালালের মতো তাতে লিপ্ত থাকা না হয়। যে হাদীসগুলো তার কাছে সহীহ সাব্যস্ত হত, অর্থাৎ যা নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিগণ বর্ণনা করে এসেছেন, তার উপর তিনি আমল করতেন এবং সর্ববিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেষ আমলকে গ্রহণ করতেন। কুফার আলিমগণকে যে আমল ও ধারার উপর প্রতিষ্ঠিত দেখেছেন তিনিও তা থেকে বিচ্যুত হননি (কেননা, এটাই ছিল সাহাবা-যুগ থেকে চলমান আমল ও ধারা)- আলইনতিক্বা, ইবনে আব্দিল বার পৃ.২৬২; ফাযাইলু আবী হানীফা, ইবনু আবিল আউয়াম পৃ.২২ (মাখতূত)
উপরোক্ত নীতিমালার ভিত্তিতে যে ফিকহ সংকলিত হয়েছে তার মান ও গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যায় ইমাম শাফেয়ী রহ.-এর নিম্নোক্ত উক্তি থেকে
الناس عيال على أبي حنيفة في الفقه.
‘ফিকহ বিষয়ে সকল মানুষ আবূ হানীফা রহ.-এর কাছে দায়বদ্ধ।’ -তারীখে বাগদাদ ১৩/৩৪৬; সিয়ারু আলামিন নুবালা ৬/৪০৩, তাহযীবুত তাহযীব ১০/৪৫০
তিনি আরো বলেছেন,
ما طلب أحد الفقه إلا كان عيالا على أبي حنيفة.
‘যে কেউ ফিকহ অন্বেষণ করবে তাকে আবূ হানীফার কাছে দায়বদ্ধতা স্বীকার করতেই হবে।’ -ফাযাইলু আবী হানীফা; ইবনে আবিল আউয়াম পৃ. ১৭
এই ফিকহের ভিত্তিই যখন হাদীস ও সুন্নাহর উপর প্রতিষ্ঠিত তখন হাদীস সুন্নাহর সঙ্গে এর সম্পর্ক কতখানি মজবুত হবে তা বলাই বাহুল্য। এজন্যই ইমাম ইবনুল মুবারক রহ. বলেছেন,
لا تقولوا : رأي أبي حنيفة، ولكن قولوا : تفسير الحديث.
(আবূ হানাফীর ফিকহকে) শুধু রায় বলো না, কেননা তা হল হাদীসের তাফসীর।’ -ফাযাইলু আবী হানীফা, ইবনু আবিল আউয়াম পৃ.২৩
ইসলামের বড় বড় ইমামগণ ইমাম আবূ হানীফা রহ.-এর এই খিদমতের যথাযথ স্বীকৃতি দিয়েছেন। ইমাম বুখারীর দাদা উস্তাদ ইমাম আব্দুল্লাহ ইবনে দাউদ খুরাইবী তো এও বলেছেন, ‘মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য হল নিজেদের নামাযে আবূ হানীফার জন্য দুআ করা। কেননা, তিনি উম্মাহর জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহ ও ফিকহ সুরক্ষিত করে গিয়েছেন।’ -তারীখে বাগদাদ ১৩/৩৪৪; তাহযীবুল কামাল; আবুল হাজ্জাজ মিযযী ১৯/১১০
কেউ যদি ইমাম আবূ হানীফার এই অবদানের প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করে তবে তার নেপথ্য কারণ কী হতে পারে তা-ও তাঁর ভাষাতেই শুনুন-
‘আবূ হানীফার বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপনকারীরা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। কিছু লোক হিংসা-বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে অভিযোগ করে, আর কিছু লোক রয়েছে যারা তাঁর সিদ্ধান্তগুলোর সুক্ষতা ও গভীরতায় পৌঁছতে না পেরে তাঁর সম্পর্কে অভিযোগ করে। আমার কাছে দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকগুলোকেই তুলনামূলক ভালো মনে হয়।’ -তারীখে বাগদাদ ১৩/৩৬৭
ইমাম আবূ হানীফা রহ. পর্যন্ত সূত্র-পরম্পরা
এবার আমি পূর্বের ওয়াদা অনুসারে আমাদের থেকে ইমাম আবূ হানীফা রহ. পর্যন্ত ফিকহের অসংখ্য সনদের মধ্যে উদাহরণস্বরূপ শুধু একটি সনদ উল্লেখ করছি। সংক্ষিপ্ততার উদ্দেশ্যে শুধু সনদের ব্যক্তিদের নাম ক্রমিক নাম্বার দিয়ে উল্লেখ করব। যাঁর নাম আগে আসবে তিনি হলেন শিষ্য আর যাঁর নাম পরে আসবে তিনি উস্তাদ।
ইলমে ওহীর ধারক-বাহকদের নিকট থেকে ইলমের আমানত গ্রহণ করার অনেকগুলো স্বীকৃত পদ্ধতি রয়েছে, যেগুলোর আলোচনা উসূলে হাদীস এবং উসূলে ফিকহের কিতাবে রয়েছে। নিম্নোক্ত সনদের প্রত্যেকে তাঁর উপরের ব্যক্তির নিকট থেকে সেই স্বীকৃত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে এক বা একাধিক পদ্ধতিতে ফিকহের ইলম; বরং ফিকহের উৎস অর্থাৎ কুরআন-হাদীসের ইলমও অর্জন করেছেন। এ বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ ‘ইলমুল ইসনাদ’ বিষয়ক ওই কিতাবগুলোতে বিদ্যমান রয়েছে যেগুলোকে পরিভাষায় ‘ছাবাত’ ‘বারনামিজ’ ‘ফিহরিছ’ ‘মুজাম’ ও ‘মাশীখা’ ইত্যাদি নামে নামকরণ করা হয়। তদ্রƒপ সনদে উল্লেখিত ব্যক্তিদের পরিচিতি এবং তাঁদের ইলমী ও আমলী জীবনের ইতিহাস আসমাউর রিজাল, তারাজিম, ত্ববাকাত ও তারীখের কিতাবে বিদ্যমান রয়েছে। যদি আমি শুধু একটি সনদের ব্যক্তিদের সম্পর্কে বিস্তারিত সবকিছু লিখতে যাই তাহলে তা একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ হয়ে যাবে। এজন্য আপাতত শুধু সনদটিই উল্লেখ করব। ইনশাআল্লাহ সমঝদার ও ইনসাফপ্রিয় ব্যক্তিদের জন্য এটুকুই যথেষ্ট হবে। তবে সনদের অধিকাংশ ব্যক্তিত্ব যেহেতু বিভিন্ন ফিকহের-গ্রন্থাবলির রচয়িতা তাই তাঁদের নামের সঙ্গে তাঁদের রচিত কিছু গ্রন্থের দিকেও ইঙ্গিত করব। এতে ফিকহের ওই গ্রন্থগুলো পর্যন্ত আমাদের যে সনদ রয়েছে তারও একটি নমুনা সামনে এসে যাবে।
সনদ
আল্লাহ তাআলার বিশেষ অনুগ্রহে বর্তমান সময়ের অনেক ব্যক্তিত্বের নিকট থেকে বান্দার (মুহা. আব্দুল মালেক ইবনে শামসুল হক কুমিল্লায়ী) ইলমে দ্বীন হাসিল করার তাওফীক হয়েছে। যাঁদের নিকট থেকে ফিকহ ও হাদীসের ইলম বেশি হাসিল হয়েছে তাঁদের মধ্যে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হলেন মুসলিম বিশ্বের বিশিষ্ট মুহাদ্দিস ও ফকীহ শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ রহ. (১৩৩৬হি.-১৪১৭হি.) শায়খ রহ. জান্নাতুল বাকীতে সমাহিত আছেন। আমি বরকতের জন্য তাঁর মাধ্যমেই সনদটি উল্লেখ করছি।
১. আব্দুল ফাত্তাহ আবূ গুদ্দাহ
২. মুহাম্মাদ যাহিদ ইবনুল হাসান আলকাউসারী
৩. ইবরাহীম হাক্কী আল আকীনী
৪. আলাউদ্দীন ইবনে আবিদীন আশশামী
৫. আমীন ইবনে আবিদীন আশশামী (‘রদ্দুল মুহতার’-এর গ্রন্থকার, যা ফাতওয়া শামী নামে প্রসিদ্ধ)।
৬. হিবাতুল্লাহ আল বা’লী
৭. সালিহ ইবনে ইবরাহীম আলজীনীনী
৮. মুহাম্মাদ ইবনে আলী আলমাকতাবী
৯. আব্দুল গাফ্ফার মুফতিল কুদস
১০. মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহ আলগাযযী (‘তানবীরুল আবসার’-এর গ্রন্থকার)
১১. যাইন ইবনে নুজাইম (‘কানযুদ দাকাইক’-এর ভাষ্যগ্রন্থ আলবাহরুর রায়েক’-এর গ্রন্থকার
১২. আহমদ ইবনে ইউনুস ইবনুশ শিলবী (শরহুল কানয-এর গ্রন্থকার)
১৩. আব্দুল বার ইবনুশ শিহনাহ (শরহুল ওয়াহবানিয়্যাহ-এর গ্রন্থকার)
১৪. কামালুদ্দীন ইবনুল হুমাম (হিদায়ার ভাষ্যগ্রন্থ ‘ফতহুল কাদীর’-এর গ্রন্থকার)
১৫. সিরাজুদ্দীন উমর ইবনে আলী কারিউল হিদায়া
১৬. আকমালুদ দ্বীন মুহাম্মাদ আলবাবারতী (‘আলইনায়াহ’-এর গ্রন্থকার)
১৭. কিওয়ামুদ্দীন মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ আলকাকী (‘মিরাজুদ্দিরায়া’-গ্রন্থকার)
১৮. আলহাসান ইবনে আলী আসসিগনাক্বী
১৯. হাফিযুদ্দীন আবুল বারাকাত আননাসাফী (‘কানযুদ দাকাইক’-গ্রন্থকার)
২০. মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুস সাত্তার আলকারদারী
২১. বুরহানুদ্দীন আবুল হাসান আলী আলমারগীনানী (হিদায়া-গ্রন্থকার)
২২. নাজমুদ্দীন উমর আননাসাফী
২৩. খালাফ ইবনে আহমদ আদদারীর
২৪. আবূ আব্দিল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনে আলী আদ্দামাগানী
২৫. আবুল হুসাইন আলকুদূরী (‘মুখতাসারুল কুদুরী’ গ্রন্থকার)
হিদায়া গ্রন্থকার (২১ নম্বরে উল্লেখিত) আবুল হাসান আলমারগীনানী-এর অনেক উস্তাদের আরেকজন হলেন আসসাদরুশ শাহীদ উমর ইবনে আব্দুল আযীয ইবনে মাযাহ। (ইনি ‘আল মুহীতুল বুরহানী’ রচয়িতার মুহতারাম পিতৃব্য।)
তিনি তাঁর পিতা বুরহানুল আইম্মা আব্দুল আযীয ইবনে মাযাহ থেকে রেওয়ায়েত করেন। তিনি রেওয়ায়েত করেন শামসুল আইম্মা আসসারাখসী থেকে, যিনি আলমাবসূত শরহু মুখতাসারিল হাকিম-এর রচয়িতা। শামসুল আইম্মা আসসারাখসী রহ.-এর বিশিষ্ট উস্তাদ হলেন শামসুল আইম্মা আলহালওয়ানী।
হিদায়া-গ্রন্থকারের উস্তাদ নাজমুদ্দীন উমর আননাসাফী (২২ নম্বরে উল্লেখিত)-এর উস্তাদগণের সংখ্যা হল পাঁচশত পঞ্চাশ জন, যাঁদের পরিচিতি বিষয়ে তিনি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। সনদের সামনের অংশ তাঁর একজন উস্তাদ আবুল ইউসর সদরুল ইসলাম বাযদাভী-এর মাধ্যমে উল্লেখ করছি।
২৩. আবুল ইউসর সদরুল ইসলাম আলবাযদভী
২৪. ইসমাঈল ইবনে আব্দুস সাদিক আলবিয়ারী আলখতীব
২৫. আব্দুল করীম আলইয়াযদী
২৬. আবু মানছুর আল মাতুরীদী
২৭. আবু বকর আলজুযজানী
২৮. আবু সুলায়মান আলজুযজানী
২৯. মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান আশশায়বানী
৩০. ইমাম আবু হানীফা
উল্লেখিত আবুল ইউসর সদরুল ইসলাম বাযদভী (২৩) এবং শামসুল আইম্মা সারাখসী উভয়ের উস্তাদদের মধ্যে শামসুল আইম্মা আলহালওয়ানী অন্যতম। তাঁর মাধ্যমে আরেকটি সনদ এই-
২৪. সামসুল আইম্মা আলহালওয়ানী
২৫. আবূ বকর মুহাম্মাদ ইবনে উমর ইবনে হামদান
২৬. আবূ ইবরাহীম মুহাম্মাদ ইবনে সায়ীদ আলবায়দভী
২৭. আবূ জাফর আতত্বহাবী (ইমাম ত্বাহাবী)
২৮. বাক্কার ইবনে কুতাইবা আলবাসরী
২৯. হিলাল ইবনে ইয়াহইয়া আলবাসরী
৩০. আবূ ইউসুফ আলকাযী ও যুফার ইবনুল হুযাইল আলবাসরী (এই দুই মনীষী ইমাম আবূ হানীফার প্রসিদ্ধ শিষ্য)
ইমাম আবূ হানীফা রহ. যে উস্তাদগণের নিকট থেকে কুরআন-হাদীসের ইলম সবচেয়ে বেশি অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সাহচর্য গ্রহণ করেছেন মোহাম্মাদ ইবনে আবী সুলাইমান রহ.-এর।
৩১. হাম্মাদ ইবনে আবী সুলাইমান
৩২. ইবরাহীম আননাখায়ী
৩৩. আসওয়াদ, আলকামা ও আবূ আব্দুর রহমান আসসুলামী প্রমুখ।
৩৪. আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. উমর ইবনুল খাত্তাব রা. আলী ইবনে আবী তালিব রা. আয়েশা সিদ্দীকাহ রা.সহ অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম।
এঁরা ইলমে ওহী অর্জন করেছেন খাতামুন্নাবিয়ীন, সাইয়িদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে, যার সম্পর্কে স্বয়ং রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেছেন
وَ مَا یَنْطِقُ عَنِ الْهَوٰیؕ۳ اِنْ هُوَ اِلَّا وَحْیٌ یُّوْحٰی.
পরিশেষে আল্লাহ তাআলার দরবারে দুআ করি যে, রাব্বুল আলামীন যখন শুধু তাঁর ফযল ও করমে এই বরকতময় নূরানী সূত্রের সঙ্গে এবং এর মতো অন্যান্য সূত্রগুলোর সঙ্গে যুক্ত করেছেন, যাঁদের মাধ্যমে আমরা কুরআন-হাদীস-সুন্নাহ এবং তা থেকে আহরিত ইলম বর্ণনা করে থাকি, তখন এই সূত্রের মর্যাদা রক্ষারও তাওফীক তিনি আমাদের দান করুন এবং এই নূরানী কাফেলার আখলাকে নিজেদের আখলাক গঠন করার তাওফীক দিন, যা ছিল নবী-আখলাকেরই প্রতিচ্ছবি। এবং শুধু নিজ ফযল ও করমে আমাদেরকে মৃত্যু পর্যন্ত ‘মা আনা আলাইহি ওয়া আসহাবী’-এর উপর অবিচল রাখুন।
বি.দ্র. উল্লেখিত সনদ এবং অন্যান্য সনদ সম্পর্কে জানার জন্য ‘আছবাত’ ও ‘ত্ববাকাতুল ফুক্বাহা’ বিষয়ক গ্রন্থাদি এবং ফিকহের বিশদ গ্রন্থাবলির মুকাদ্দিমা ও খাতিমা অংশ পড়তে হবে। উল্লেখিত সনদের জন্য বিশেষভাবে ‘আততাহরীরুল ওয়াজীয’, ‘তাকমিলাতু রাদ্দিল মুহতার’ ‘রদ্দুল মুহতার’ ‘উকূদুল লাআলী’ ‘আলজাওয়াহিরুল মুযীআ’ এবং ‘আলফাওয়াইদুল বাহিয়্যা’ ইত্যাদি গ্রন্থের সাহায্য নেওয়া যাবে। শেষোক্ত গ্রন্থদু’টিতে সনদে উল্লেখিত ফক্বীহগণের তরজমা মনোযোগের সঙ্গে পড়া জরুরি।
وإلا لا يتبين مواضع السقط والتحريف التي نشأت لأجل غفلة الناسخين والطابعين.