জুমাদাল উলা ১৪২৮   ||   জুন ২০০৭

রিপুর জিহ্বার পানি শুকাবে আর কত দিন পর

বুড়িগঙ্গায় লঞ্চভ্রমণ শেষে সদরঘাটে ফেরার পর এক সংঘর্ষে নদীতে ডুবে নিহত হয় কজন তরুণ-তরুণী। নিখোঁজ হয় আরো কজন। তরুণ-তরুণীদের বড় অংশই সংঘর্ষ চলাকালে স্থান ত্যাগ করে জানে বেঁচে যায়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এক তরুণীসহ নিহত দশজনের লাশ পাওয়া গেছে। উদ্বিগ্ন স্বজনদের হাহাকার, প্রতিবাদ এবং মাতম সদরঘাট ও মিটফোর্ড হাসপাতালের চত্বর ভারী করে তুলেছে। সব  সংবাদ মাধ্যমেই ৪মের এঘটনাটি লিড হয়েছে। দুতিন দিন যাবৎ এ বিষয়ক রিপোর্ট -মূল্যায়ণ ও মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। সংঘর্ষের ঘটনাটির ধরন ও চরিত্রে কিছু ভিন্নতার কারণে  দেশজুড়েই এটি একটি মিশ্র উদ্বেগ ও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে।

প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল লঞ্চআরোহীদের সঙ্গে কেবল লঞ্চকর্মচারী ঘাটশ্রমিক ও আনসারদের সংঘর্ষেই এ ঘটনাটি ঘটেছে। পরে প্রকাশিত বিবরণে দেখা যায় ঘটনার গভীরে আরো কিছু অসংযত ও অশ্লীল কার্যকারণ  বিদ্যমান ছিল। লঞ্চভ্রমণটি নিছক কোনো ভ্রমণের সীমানায় আবদ্ধ ছিল না। এটি ছিল একটি প্রমোদভ্রমণ । ৪ মে শুক্রবার সকালে পূর্ব নির্ধারিত প্রোগ্রাম অনুযায়ী এ ভ্রমণ শুরু হয়। আগ্রহী তরুণদের  মনোরঞ্জনের জন্য সেখানে গানবাদ্যের ব্যবস্থাও করা হয়। বেশ কজন তরুণী গায়িকাসহ একটি ব্যান্ডদলও নেওয়া হয় সঙ্গে। দলবদ্ধ ও প্রকাশ্য আয়োজনের পাশাপাশি কেবিনে কেবিনে চলে মদসহ চুড়ান্ত পর্যায়ের অসামাজিক কাজকর্ম। এ সবেরই এক পর্যায়ে মদ নিয়ে মাতলামি আর নারীর দখল নিয়ে বিবাদে তাৎক্ষনিক ভাবে ভ্রমণকারীদের মাঝে দুটি দলের সৃষ্টি হয়। লাগে মারপিট। লঞ্চে অবস্থানরত আনসার ও লঞ্চকর্মচারীদের পক্ষ থেকেও বাধা আসে। তখন তাদের সঙ্গেও সংঘর্ষ বেঁধে যায় ভ্রমণকারীদের। সদরঘাটে এসে তীব্ররূপ ধারণ করে এর জের। ত্রিমুখি সংঘর্ষে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়া অনেকেই আর উঠে আসতে পারেননি। কেউ সাঁতার না জানার কারণে, কেউ মারাত্মক আহত হয়ে পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার কারণে।

পত্র-পত্রিকার খবরে দেখা গেল, মদ ও নারী নিয়ে চরম অশ্লীলতাপূর্ণ এরকম প্রমোদ ভ্রমণ প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ঘটতো। পুরনো ঢাকার কিছু যুবকের উদ্যোগে প্রশাসনের অবগতির মধ্যেই এসব প্রমোদ-ভ্রমণ সম্পন্ন হলেও গত ৪মের দুর্ঘটনার আগে এ বিষয়ে জনসমক্ষে কিছু প্রকাশ হয়নি। এখন প্রমোদ ভ্রমণে অংশ নেওয়া অনেকে মুখ খুলতে শুরু করেছে এবং অনেক কেঁচোই সাপ হয়ে বের হচ্ছে।  তদন্ত কমিটি হয়েছে, হৈ-চৈও হচ্ছে বিস্তর ।  কিন্তু নীতি-নৈতিকতা ও সম্ভ্রম বিসর্জন দেয়া তারুণ্যের এই অধোগতি নিয়ে আগেভাগেই কেন কর্তাব্যক্তিরা নজর দিলেন না-সে বিষয়টি নিয়ে তেমন কোন উচ্চবাচ্য মিডিয়ায় নেই। আসলে মদ ও নারী নিয়ে কঠোর সংরক্ষণশীলতা বজায় রাখাকে যারা এক ধরনের  পানসে সংস্কার বলে মনে করেন তারা এ ঘটনাটির মধ্যে মৃত্যুর দুর্ঘটনা ছাড়া মানব জীবনের অন্য কোন প্রাণের হানি দেখতে চাইবেন না। ফুর্তির মধ্যে ব্যাঘাত ঘটলো কেন, প্রমোদ করতে গিয়ে মারা পড়ল কেন- তাদের দুঃখ ও প্রশ্ন এতটুকুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকাটা সে জন্যই অস্বাভাবিক নয়।

মানুষের জীবনের মূল্যতো অমূল্য, সন্দেহ নেই। মুসলমানদের কাছে সেই জীবনের সঙ্গে চরিত্রের শুভ্রতা, সংযম ও শালীনতার মূল্য আরো অমূল্য । কখনো কখনো দ্বীন ও মনুষ্যত্বের প্রয়োজনে এ সবের মূল্য জীবনের চেয়েও বেশি। কিন্তু আমরা আমাদের তারুণ্যের শুভ্র প্রাণটাকে নষ্ট করে দেওয়ার সব আয়োজন দেখে নীরব থাকি। কেবল ধড় থেকে প্রাণ চলে গেলে বিচলিত হই। এটা ঈমান ও ইসলামের সহজাত প্রেরণার মধ্যে পড়ে না। কখনো হোটেল, বাসায় সম্ভ্রম বিনাশী আয়োজন, কখনো প্রকাশ্যে -অপ্রকাশ্যে মাদকের আসর, কখনো তারুণ্যকে উন্মাদ করে তোলা নানা চটকদার সামাজিক ও মিডিয়াগত ব্যবস্থাপনা আর কত চলবে! সম্ভ্রমহীন, শান্তিশূন্য বিত্তবান পশ্চিমের বাতাসে তারুণ্যের পাল তুলে দিলে যাত্রা বড়ই গন্তব্যহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়বে। দেশ, জাতি, সমাজ-সংসার ক্রমাগত উচ্ছন্নেই যেতে থাকবে। আখেরাতের জীবনে অন্ধকার আনার এসব ব্যবস্থাপনায় দুনিয়াতেই বা নির্বিবাদ সুখের গ্যারান্টি কোথায়? এতগুলো তরুণ-তরুণীর সলিলসমাধি অসংযত মানুষের রিপুর জিহ্বার পানি শুকিয়ে দেওয়ার জন্য কি যথেষ্ট হতে পারে  না

গ্রন্থনা : ওয়ারিস রব্বানী   

 

 

advertisement